এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কোলকাতা জিপিও এবং অন্ধকূপ হত্যার কলঙ্ক (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ মে ২০২৩ | ২৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • তৃতীয় পর্বের পরে ....



    এই ইংরাজ-লেখক অধুনা প্রকাশিত সমস্ত কাগজপত্রের সহায়তায় যেরূপ নিপুণতার সঙ্গে বিষয়টির আলোচনা করিয়াছেন, তাহা মুক্তকন্ঠে প্রশংসিত হইবার যোগ্য। হলওয়েলের করুণ কাহিনিকেই প্রধান অবলম্বন করিয়া, এই লেখক প্রচুর সমালোচনা কৌশলে দেখাইয়া দিয়াছেন,- সে কাহিনি লৌকিক কাহিনি হইতে পারে না, তাহা যে নিতান্ত রচা কথা, কাহিনির মধ্যেই তাহার অনেক প্রমাণ প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। হলওয়েলের রচনাভঙ্গি ভুক্তভোগীর অকৈতব রচনাভঙ্গি নহে,- তাহা আখ্যায়িকা-লেখকের সুকৌশল-বিন্যস্ত কৃত্রিম রচনাভঙ্গি। তাহার সাহায্যে কারাকক্ষের যে সকল বর্ণনা লিখিত হইয়াছে, তাহাও অন্ধকার রজনীর যন্ত্রণাপূর্ণ কারা-কক্ষের বন্দিগণের নয়ন গোচর হইবার সম্ভাবনা ছিল না।

    অধুনা যে সকল কাগজপত্র প্রকাশিত হইয়াছে তাহার সাহায্যে দেখিতে পাওয়া গিয়াছে,- অনেক ইংরাজ দুর্গ-জয়-কালে বীরের ন্যায় দেহ বিসর্জন করিয়াছিলেন। ইহাদের মৃত্যু কাহিনি দুর্গবাসী অন্যান্য ইংরাজ সহযোগীগণ বিলাতে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন। যাহারা এইরূপে দুর্গরক্ষার্থ প্রাণ বিসর্জন করেন, তাহাদের নামও অন্ধকূপে নিহত ব্যক্তিগণের তালিকাভূক্ত করিয়া, হলওয়েল কাহিনি রচনা করিয়াছিলেন। এই তথ্য এতদিন অপ্রকাশিত ছিল; ইহা এখন হলওয়েলের কাহিনিকে আরও সংশয়পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে।

    হত্যা-কাহিনি ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছিল। কি উদ্দেশ্যে হলওয়েল এই কাহিনি-রচনায় ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, কি উদ্দেশ্যে এই কাহিনির প্রতিবাদ করিবার জন্য সেকালের কেহ কোনরূপ চেষ্টা করেন নাই, শ্রীযুক্ত লিটল তৎসম্বন্ধে স্টেটসম্যান পত্রে এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন।

    অন্ধকূপহত্যা-কাহিনি ইউরোপীয়গণের মধ্যে প্রচারিত হইলেও, দেশের লোকে তাহার বিন্দু-বিসর্গ জানিত না। অন্য স্থানের লোকের কথা দূরে থাকুক, খাস কলিকাতার লোকেরাও তাহা জানিত না। চন্দননগরের ফরাসি ও হুগলির ওলন্দাজ যাহা জানিয়াছিলেন, তাহাও স্বাধীনভাবে জানিতে পারেন নাই,- ‘হলওয়েল কোম্পানির’ নিকট হইতে তাহারা ইহার কথা অবগত হইয়াছিলেন। সুতরাং তাহাদের কাগজপত্রে ইহার যাহা কিছু উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা জানা কথা নহে, শোনা কথা,- আখ্যায়িকা রচয়িতা হলওয়েলের নিকট হইতে শোনা কথা!

    এই সকল কারণে হলওয়েলের কাহিনির সমালোচনা করিতে গিয়া হয় তাহাকে বিনা বিচারে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে, না-হয় বিচার করিয়া সন্দেহপূর্ণ বলিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে। যাহারা এই কাহিনি এখনও গ্রহণ করিবার পক্ষপাতী, তাহারাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছেন যে,- হলওয়েলের কাহিনি সর্বাংশে সত্য হইতে পারে না। একজন স্পষ্টই লিখিয়াছেন,- ‘কলিকাতার দুর্গ-জয়কালে অনেকে প্রাণ বিসর্জন করিয়াছিল, ইহা সত্য কথা। যদি তাহারা অন্ধকূপ-কারাগারে প্রাণ বিসর্জন করিয়া থাকে, তবে হলওয়েলের কাহিনি সর্বাংশে সত্য না হইলেও, একেবারে মিথ্যা হইতে পারে না।’ এখন ইতিহাসের সকল তর্ক এই ‘যদির’ উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

    (ভারতী, ১৩২৩ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত)

    অর্থাৎ, একমাত্র হলওয়েল সাহেব ছাড়া অন্যকারুর এই অন্ধকূপ হত্যা সম্পর্কে কোনো বিবৃতি সেই আমলে পাওয়া যায়নি। তিনি একজন ইংরেজ সেনাপতি ছিলেন মাত্র। সেই সময়ের ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর রজার ড্রেক সাহেব, যদিও তিনি সেই ঘটনার আগেই ফলতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, তবুও গভর্নর হিসেবে তাঁর বিবৃতি বা রিপোর্ট থাকা উচিত ছিল, যা পাওয়া যায় না। ঘটনাটি অদ্ভুতভাবে সেইসময়ে হলওয়েল সাহেবের বিবৃতির পরেও ইংরেজ জমানাতেও গুরুত্ব পায়নি। প্রথম গুরুত্ব পায়, ১৮৫৮ সালে জেমস মিলের 'হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থ প্রকাশের পর, অর্থাৎ ঘটনার একশো দুই বছর পরে। এইরকম ইতিহাসের এক অন্ধকারময় অধ্যায়ের গুরুত্ব পেতে একশো দুই বছর লেগে গেলো, এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়, যখন ক্ষমতা, ইচ্ছে, ইতিহাস বিকৃত করার অধিকার সবটাই ইংরেজদের হাতে। উপসংহারে বলতেই হয়, হলওয়েল এবং মিল সাহেবের ইচ্ছাকৃত রটনা ছাড়া অন্ধকূপ হত্যা আর কিছুই নয়। নইলে পুরনো স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার কারণই বা কি আর নতুন স্মৃতিস্তম্ভে মুদ্রিত নামের সাথে পুরনো স্মৃতিস্তম্ভের নাম মিলবে নাইবা কেনো। নিজেদের ব্যর্থতা বা পরাজয়ের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না এই ঘটনাকে।

    অথচ এইরকম একটি ভুয়ো ঘটনার দায় এখনও আমাদের ওপরে চাপানো আছে। সরকারিভাবে অন্ধকূপ হত্যার বিরোধীতা করা হয়েছে এইরকম খবরও নেই আমাদের কাছে। ঐতিহাসিকদের বক্তব্য এখনও তাদের একান্তই নিজস্ব বলে চালানো হয়। আর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কোলকাতা জিপিও - র সুন্দর বাড়ীটিকে দেখলেই কিছু মানুষের মনের কোণে আজও উঁকি মারে অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী। কলকাতা জিপিও - র বাড়ীটি পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের জায়গায় গড়ে উঠেছিল, এর বেশী কিছু নয়। পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে কোনো অন্ধকারময় অধ্যায়ের সাথে ভারতবাসীরা কোনোদিনই যুক্ত ছিল না, ইংরেজরা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তাদের পাপের ভার আমরা তো বহন করবো না একেবারেই। আমাদের কলকাতা জিপিও - র বাড়ীটি বাইরে যেমন ফুটফুটে সাদা ভেতরেও তেমনি সাদাই ছিল এবং আজও আছে।

    সমাপ্ত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন