এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আগামী পৃথিবী, আল হাবিবি

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ মে ২০২৩ | ৩০২ বার পঠিত
  • পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশ বা সম্রাজ্যের মানচিত্র সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে এবং এখনও যাচ্ছে। দেশ বা সম্রাজ্যের বিস্তারের কারণেও হতে পারে আবার দেশ বা সম্রাজ্যের খণ্ডিত হওয়ার কারণেও হতে পারে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোও পাল্টে যাচ্ছে সময়ের সাথে। আজ যে প্রতিবেশী কাল সে হয়তো আমার দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে অথবা আর প্রতিবেশী থাকবে না অর্থাৎ মাঝখানে অন্য দেশ বা সম্রাজ্য গড়ে উঠবে। ফলে যে কোনো দেশ বা সম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতিও সময়ের সাথে পাল্টে পাল্টে যায়। এককথায় বলতে গেলে ইতিহাসের সাথে ভূগোলও পাল্টে যায়। আমাদের ভারতবর্ষের কথাই যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যায় আজ যাকে আমরা সুদূর প্রাচ্য বলি, এককালে তারাই আমাদের প্রতিবেশী ছিল। আবার আমাদের দেশেরই এককালের অংশ বাংলাদেশ বা পাকিস্থান বর্তমানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ। সুতরাং বর্তমানের বাংলাদেশ বা পাকিস্থান সম্পর্কে এককালে আমাদের ভাবনা না থাকলেও বর্তমানে তাদের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক নীতি তৈরী করতে হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রেই একই কথা খাটে।

    পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র, বর্তমানের রাশিয়া সম্পর্কে যদি দেখা যায়, তাহলে দেখতে পাই, জার সম্রাজ্যের সময়ে তার একধরনের চেহারা বা সীমারেখা ছিল। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট শাসনের সময়ে আর একধরনের সীমারেখা তৈরী হয়েছিল। আবার গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রইকার আবহাওয়ায় সীমারেখা অন্যরকমের হয়েছে। আবার ক্ষমতার দিক দিয়ে ভাবলে মূল ক্ষমতা কিন্তু চিরকালই রাশিয়াকেন্দ্রিক ছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও, অনেকগুলো রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, সারা পৃথিবী সোভিয়েত ইউনিয়নকে যে সম্ভ্রম দেখাতো আগে, বর্তমানে সেই সম্ভ্রম দেখায় রাশিয়াকে। পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৯৯১ সালে রাশিয়া ছাড়াও মোট চোদ্দটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, রাষ্ট্রগুলো হলো, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন এবং উজবেকিস্তান। এই নতুন রাষ্ট্রগুলোর সকলের সাথেই যে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো তা নয়, বরং অনেকের সাথেই খুব খারাপ।

    আবার আগের ঠান্ডা যুদ্ধ আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যেরকম ছিল, বর্তমানে তা আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া কমিউনিস্ট দেশ হলেও আমেরিকার মত তারও চূড়ান্ত সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম হওয়া চোদ্দটি রাষ্ট্রকেই সে গিলে খেতে চায়। সেই মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ আমরা বিগত প্রায় দেড় বছর সময়কালে দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে। এই যুদ্ধকে শুধু যুদ্ধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। অনেকগুলো স্তর আছে এই যুদ্ধে, সেই কারণেই এতদিন ধরে চলছে এই যুদ্ধ। সামরিক শক্তির কথা বিবেচনা করলে রাশিয়ার সাথে এতদিন ধরে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে ইউক্রেন, সেটাই আশ্চর্যের। যতই পাশ্চাত্য দেশগুলো, আমেরিকা সহ, ইউক্রেনকে সাহায্য করুক না কেনো, এত সময় ধরে রাশিয়া জিততে পারছে না, এটাই ভাবিয়ে তোলে আমাদের।

    রাশিয়ার ভৌগলিক অবস্থান দেখলে দেখা যায়, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী সমুদ্র ঘেরা সীমানা (প্রায় আটতিরিশ হাজার কিলোমিটার) থাকলেও তা কোনো কাজে লাগে না রাশিয়ার। কারণ বেশীরভাগ সমুদ্র বরফে ঢাকা থাকে প্রায় সারা বছর ধরে। কৃষ্ণসাগর, আজভ সাগর, আর্কটিক মহাসাগর, জাপান সাগর, শ্বেতসাগর, কৃষ্ণসাগর, কাসপিয়ান সাগর, পেসিফিক সাগর, আটলান্টিক মহাসাগর প্রভৃতি সাগরের মধ্যে বেশীরভাগ সাগরই রাশিয়ার বাণিজ্যের কাজে লাগে না। এদিকে সারা বিশ্বের গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী তেলের মোট চাহিদার সিংহভাগের রপ্তানিকারক হলো রাশিয়া। সুতরাং সাধারণ সমুদ্র বন্দর রাশিয়ার কাছে অতীব প্রয়োজনীয় যে বন্দরগুলো দিয়ে সে সারাবছর রপ্তানির কাজ করতে পারবে। পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন রাশিয়ার এই অসুবিধা হয়নি কারণ আজকের যারা প্রতিবেশী দেশ তারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং তাদের সমুদ্র বন্দর অনায়াসেই রাশিয়া ব্যবহার করতো। সীমানা পাল্টে যাওয়ায় এ এক অনাহুত সমস্যা রাশিয়ার। ফলে তাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে এবং বর্তমানের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। বেশ কিছু পূর্বতন সোভিয়েত দেশগুলোতে ইতিমধ্যেই রাশিয়া তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের শাসকের আসনে বসাতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা সেইসব দেশের ক্ষেত্রে যেখানে রাশিয়ার পুতুল সরকার নেই।

    আমেরিকা, রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধের একদিক এখন সত্যিই ঠান্ডা। পরমাণু অস্ত্রের সম্ভার বাড়ানো বা হুঁশিয়ারি বর্তমানকালে আর নেই বললেই চলে কিন্তু অন্যদিকের ডঙ্কা নিত্যই বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে নিজস্ব অক্ষ তৈরী করা এবং সেই দেশগুলোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। ন্যাটো এইরকমই একটি অক্ষ, উত্তর আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর একটি সংগঠন। নাম এবং সংগঠনের সংবিধান অনুযায়ী উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোই এর সদস্য হতে পারবে। ১৯৪৯ সালের ৪ ই এপ্রিল এটি তৈরী হয়েছিল এবং দেশগুলোর মধ্যে সামরিক সহযোগিতার জন্যেই এই সংগঠন তৈরী করা হয়েছিল। জন্মলগ্নের পরবর্তীতে কোনো বিচ্যুতি না দেখা গেলেও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পরেই এর বিচ্যুতি লক্ষ করা শুরু হয়।

    সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরেই আমেরিকার কাছে সুযোগ আসে উত্তর আটলান্টিক সাগরের তীরবর্তী বা কাছাকাছি পূর্বতন সোভিয়েত দেশগুলোকে নিজেদের অক্ষে টেনে নেওয়ার, যা রাশিয়ার নাকের ডগায় বসে সলতে পাকানোর কাজ করবে। রাশিয়ার পশ্চিমের সব দেশগুলোর কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয় ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার। রাশিয়াও বুঝতে পারে ন্যাটোর নাম করে আমেরিকা রাশিয়ার নাকের ডগায় আসতে চাইছে। আমেরিকার এই অভিসন্ধি পূর্ণ হতে দিলে রাশিয়ার শিরে সংক্রান্তি অবস্থা হবে। অধুনা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাই সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরীর চেষ্টা শুরু হয়। উল্টোদিকে এইসব নতুন দেশগুলোও দীর্ঘকাল সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থেকে রাশিয়ার দাদাগিরির কারণে হাঁফিয়ে উঠেছিল। তাদের কাছে ন্যাটোর হাতছানি অনেক বেশী আকর্ষণীয় ছিল। কেউই তারা ন্যাটোর আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করে রাশিয়ার কব্জায় থাকতে রাজী নয়। ফলে কিছু দেশে সরকার পাল্টে পুতুল সরকার বসিয়ে দেয় রাশিয়া, কিন্তু কিছু দেশে সেই খেলায় সফলতা পায়নি রাশিয়া। এইসব খেলায় নতুন নতুন রাজনৈতিক, সন্ত্রাসবাদী অক্ষ তৈরী হয়েছে সেইসব দেশগুলোয়। অনেক দেশে গৃহযুদ্ধও শুরু হয়েছে। রাশিয়ার পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকের সমস্ত দেশের অবস্থাই আজ কমবেশী একইরকম। 

    আরও অনেক রাজনৈতিক জটিলতা আছে রাশিয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের, তবুও মোটের ওপর প্রেক্ষাপটটা এইরকমই। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন এতদিন কি করে যুদ্ধে টিকে আছে। রাশিয়া কি তবে কাগুজে বাঘ? নাকি যুদ্ধের লক্ষ অন্য কিছু? এমনিতেই পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ইউরেশিয়া মহাদেশের যে রাজনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবেশ তৈরী হয়েছে, তাতে রাশিয়ার সাথে প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তাদের ঠোকাঠুকি বা যুদ্ধ লেগেই থাকবে ভবিষ্যতে। সুতরাং ইউক্রেন একা নয়, অন্যান্য দেশগুলোর ভবিষ্যতও ভালো কিছু নয়। ইউরেশিয়া মহাদেশে এইরকম যুদ্ধ চলতে থাকবেই। 

    প্রশ্ন অন্য জায়গায়, রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে যে বিষয়গুলো চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলেছে, ভবিষ্যতের পৃথিবী চালিত হবে সেইসব বিষয়গুলোর ওপরেই। আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে এখনও অংশগ্রহণ করেনি, ইউক্রেনকে ঘুরপথে সাহায্য করছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে সহযোগিতা করছে, এছাড়াও ইউরোপিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো সাহায্য করছে। কেউ সরাসরি আবার কেউ ঘুরপথে। রাশিয়ার গম, ভুট্টা আর সূর্যমুখী তেল ছাড়াও সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। এই কারণেই, যতই আমেরিকা বা ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করুক, তাতে রাশিয়ার ক্ষতির চেয়ে তাদের নিজেদের ক্ষতিই বেশী। রাশিয়াও ওই সমস্ত দেশগুলোতে খনিজ সম্পদ, গম, ভুট্টা ইত্যাদি বিক্রি করবে না বলে ঘোষণা করেছে। ফলে যতদিন যাচ্ছে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ক্ষতির উপলব্ধি প্রকট হচ্ছে। আমেরিকা মুখে কিছু না বললেও রুবলের যে ক্ষতি তারা করতে চেয়েছিল তা তো পারেই নি, উল্টে আমেরিকান ডলার খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। এতে লাভ হচ্ছে অন্য দেশের। রাশিয়া থেকে ঘুর পথে সেই সমস্ত খনিজ সম্পদ বিক্রি হচ্ছে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, দ্বিতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে। নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে বহু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে সরাসরি খনিজ সম্পদ বা গম, ভুট্টা ইত্যাদি কিনতে পারছে না। আবার না কিনতে পারার জন্য অসহায় অবস্থা হচ্ছে তাদের। ফলে দ্বিতীয় দেশের ওপর ভরসা করতেই হচ্ছে দুকূল বজায় রাখার জন্য। এই দ্বিতীয় দেশেরও এই পরিস্থিতিতে কিছু লাভ হচ্ছে। চাহিদা না কমে উল্টে বরং দেখা যাচ্ছে রাশিয়ার খনিজ সম্পদের চাহিদা এখন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

    যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা, রাশিয়াকে অনেকভাবে, সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে এবং পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করছে। ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে রাশিয়া এতদিন ধরেও জিততে পারছে না, এই ভাবনা ভেবে যারা রাশিয়ার সমরাস্ত্র সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ছেন, তাদেরকে মূর্খ প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই রাশিয়া করছে না। বরং রাশিয়া ব্যস্ত আছে নিজেদের লক্ষ পুরণে। কারণ যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে আমেরিকার। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও বাস্তব সত্যি এটাই। রাশিয়ার দীর্ঘকালীন লক্ষ হলো, একাই মানে প্রতিপক্ষবিহীন ভাবে পৃথিবীকে শাসন করা। সেই লক্ষ পূরণের জন্য মূল দুটো জিনিস দরকার। এক, সবথেকে উন্নতমানের সমর সরঞ্জাম এবং অস্ত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা। দুই, উন্নত অর্থব্যবস্থা এবং টাকার উচ্চমূল্য। আমেরিকান, ইউরোপিয়ান এবং ন্যাটোর নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ান টাকার মূল্য ক্রমেই উচ্চস্তরে নিয়ে যাচ্ছে, উল্টোদিকে আমেরিকান ডলার বা ইউরোপিয়ান ইউরোর দাম রুবলের প্রেক্ষিতে ক্রমহ্রাসমান হচ্ছে। কারণ রাশিয়ার বহিঃবানিজ্য ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী এবং রাশিয়ার শর্ত অনুযায়ী দাম রুবলে প্রদান করতে হচ্ছে। এমনিভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দ্বিতীয় শর্তপূরণ হবে। প্রথম শর্তের ক্ষেত্রে দুটো জিনিস প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এক, অন্যের চেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র হতে হবে আর দুই, অন্যের অস্ত্রের কার্যকারীতা জেনে সেইগুলোর কার্যকারীতা ধ্বংসের কৌশল জানতে হবে। আমেরিকার ও রাশিয়ার অস্ত্রশস্ত্র তুলনা করলে তুল্যমূল্যই হবে, কিছু ক্ষেত্রে হয়তো রাশিয়া এগিয়ে আছে আর কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকা। কিন্তু দুই দেশেরই অস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতি উচ্চমানের হলেও কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না প্রতিপক্ষের সব ধরনের অস্ত্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা তার কাছে আছে। কারণ এই দুই দেশের সেনা বা অস্ত্রের সামনাসামনি সেরকমভাবে হয়নি কোনোদিন। অন্যের ক্ষমতা মাপতে গেলে এদের গোয়েন্দা তথ্যকেই ভরসা করতে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়াকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। আমেরিকার অযাচিতভাবে ইউক্রেনকে সাহায্য রাশিয়ার কাছে সেই সুযোগ করে দিয়েছে, যা রাশিয়া পূর্ণরূপে সদ্ব্যবহার করছে। আমেরিকা, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, যারাই ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে যুদ্ধে সাহায্য করছে, তাদেরই অস্ত্রশস্ত্র যুদ্ধের ময়দানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও সেগুলো চালনা করার লোক যেহেতু দিচ্ছে না, ফলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকেই সেগুলো চালনা করতে হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া সেই অস্ত্রচালনা যে খুব একটা কার্যকর হয়না তা আমরা আগেও বিভিন্ন দেশে দেখতে পেয়েছি। ফলে ইউক্রেন খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না যুদ্ধক্ষেত্রে, উল্টে রাশিয়ার সাহায্য হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিত্যক্ত সেইসব অস্ত্র রাশিয়া বাজেয়াপ্ত করে পাঠিয়ে দিচ্ছে ইরানে।

    শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই আপ্তবাক্যতেই কূটনীতি চলে সারা বিশ্বে। এই পথেই বর্তমানে রাশিয়া আর ইরান বন্ধু। এককালে ইরান, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিবেশী দেশ ছিল, স্থলপথে আন্তর্জাতিক সীমানা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে অবশ্য ইরান আর রাশিয়ার মধ্যে স্থলপথে সীমানা নেই। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে জলসীমা রয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ইরানের সাথে রাশিয়ার বহুবার যুদ্ধ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না কোনোকালেই। কিন্তু আমেরিকা রাশিয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পরে দেখা যাচ্ছে দুই দেশের ওপরেই বিভিন্ন রকমের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আমেরিকার। এই পরিস্থিতিই দুই দেশকে কাছে নিয়ে এসেছে। ক্রমশঃ মজবুত হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক। ইরান বিগত প্রায় দুই দশক ধরে "রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং"- এর কাজে হাত পাকিয়েছে। বিপক্ষের অস্ত্রকে বিশ্লেষণ করে তাতে ব্যবহৃত কৌশলের উল্টো কৌশল তৈরীর নামই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং। আসল জিনিস হলো বিপক্ষের অস্ত্রের সুক্ষাতিসুক্ষ বিশ্লেষণ। সেই কাজে ইরানী বিজ্ঞানীরা এখন সিদ্ধহস্ত। যে কোনো অস্ত্রের কার্যকারীতার যে কৌশল, তার বিপরীত কৌশল তৈরী করতে পারলেই সেই অস্ত্রের কার্যকারীতা হারিয়ে যায়, তা সে যতই উন্নত, অত্যাধুনিক হোক না কেনো। বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি খুব ছোট ছোট কৌশলে নামী দামী অস্ত্রের কার্যকারীতা নষ্ট করে দেওয়া যাচ্ছে। অস্ত্র প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রেও তাই, বিপক্ষ কি কৌশলে অস্ত্রের ধরন অনুসন্ধান ও স্থান নির্ধারণ করে সেটা জানতে পারলেই কৌশল বার করে ফেলা যায় যাতে করে আমার অস্ত্র সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধরতে না পারে। আবার নিজের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সেইভাবে উন্নত করে নেওয়া যায়। রাশিয়া এবং ইরান এখনও অব্দি খুব গোপনে এই কাজ করে চলেছে। ফলাফল যে খুব ভালো তা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

    যুদ্ধ নিশ্চয়ই আরও দীর্ঘায়িত করবে রাশিয়া। ফল ভুগবে ইউক্রেনবাসী আর আমেরিকা। খুব সুচারুরূপে বিশ্লেষণ করলে মনে হচ্ছে, আগামী পৃথিবীর সমীকরণ পাল্টাতে চলেছে। দ্বিপাক্ষিক ঠান্ডা যুদ্ধ, আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি উল্টে গিয়ে আগামী বিশ্বে রাশিয়াকেন্দ্রিক একপাক্ষিক ভরকেন্দ্র তৈরী হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রটাও পাল্টাবে। কারণ একদিকে যেমন ভারতবর্ষ সরাসরি না হলেও রাশিয়াকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে, রাশিয়ার এই দুঃসময়ে, অন্যদিকে পাকিস্থান সরাসরিভাবে সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ইউক্রেনকে। আগামী পৃথিবীর পটচিত্রের রং পাল্টে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। খোলা হাওয়া (গ্লাসনস্ত) না বইলেও আগামী পৃথিবীর পুনর্গঠন (পেরেস্ত্রইকা) অনিবার্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন