বাজে তখন বেলা দুটো; শিয়ালদহ স্টেশনের দক্ষিণ শাখার বাজারের সামনে, তৃণমূল কংগ্রেসের বন্ধ পার্টি অফিসের গেটের মুখের রাস্তাতে বসে সাতটা থালায় খাওয়া চলছে। মোটা চালের এক মুঠো ভাত, মুরগির মাংসের ছাঁট আর এক থোকা টমেটোর ঝাল। পেছনের ব্যানার দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের ভবিষৎ শ্রীমান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সে খাওয়া হাসি মুখে উঁকি মেরে দেখছেন। সম্ভবত ব্যানারটি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ৭৪তম ‘প্রজাতন্ত্র‘ দিবস উপলক্ষ্যে লাগানো হয়েছে।
আজ মোটামুটি কলকাতার রেডরোড থেকে দিল্লি সমস্ত জায়গাতেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সেনা-গরিমায় ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হলো।
আমি দুই পা হেঁটে গেলাম, উনাদের সাথে আলাপ করতে। ওনারা তখন ওখানে বসে মুরগির ছাঁট দিয়ে ভাত খেতে খেতে প্রজাতন্ত্র দিবস উপভোগ করছিলেন। কথা বলতে বলতেই, ছন্দা দেবী(নাম পরিবর্তিত) কথায় কথায় মিশে গেলেন। বয়স উনার হবে ওই ৬০-এর উপরে। উনি ওখানে আজকের এই একসাথে খাওয়া দাওয়া'র আয়োজন করেছিলেন, ‘প্রজাতন্ত্র‘ দিবস উপলক্ষ্যে। ছন্দা দেবী প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেলো ওখানে কাজ করছেন। উনারা সকলেই শিয়ালদা'র সামনের মার্কেটে সবজি বিক্রি করেন। দিনে-রাতে থাকেনও স্টেশন চত্বরে। কেবলমাত্র সবজি আনতে যান- কোলে মার্কেটে। একেক করে। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের আয় কেমন হয় দৈনিক? উত্তরে বললেন, “ঠাকুরের ইচ্ছায় দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ উঠে যায়। পেট চলে যায় কোনরকমে, বাবা।“ আমি ফের কৌতূহলের বসে জিজ্ঞাসা করলাম, মার্কেট থেকে মাল কত’তে কেনেন? এবার উত্তরে বললেন, “যা দাম বাবু’রা দেয় আমাদের।“- কে এই বাবু? উনি বললেন, “কেন মার্কেট কমিটির মাথার উপরের লোকে'রা আর ফোঁড়ে’রা।" শুনে আমি বললাম, আপনাদের এই মাল কেনার জন্যে দাম বলবার কোন নিজস্ব অধিকার থাকে না? উত্তরে এলো, “না।“ ফের আমি বললাম, এই মার্কেট কমিটির মাথায় তাহলে কারা রয়েছে আর ফোঁড়ে গুলোই বা কারা, যারা দাম নির্ধারণ করে? উনি বললেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের ছেলেপিলেরা। ওরাই ওখানকার হতাকর্তা বিধাতা। কিছু বললেই, রে রে করে তেড়ে আসে। এই নিয়ে প্রচুর ঝগড়া অশান্তি হয়েছে বাবা কিন্তু ওদের সাথে পারে কে!” এবার আমি খানিক অন্য কথা বলতে বলতে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, আজ প্রজাতন্ত্র দিবস কেমন কাটছে আপনাদের? শুনে উনারা সবাই হেসে উঠলেন একসাথে। ছন্দা দেবী বললেন, “এইতো আজও ভোরে রেলের পুলিশ আমাদের লাঠির বাড়ি দিয়ে গেছে। জায়গা পরিষ্কার করে ছাড়ার জন্যে। আমরা তখন ঘুমাচ্ছিলাম। আর বাকি কেমন কাটছে সেতো তুমি এখন দেখতেই পাচ্ছ, বাবা। ছুটির দিনে খড়িদার কম।“ খানিক থেমে আবার বললেন, “জানতো এখানে বাইরের লোক এসে নোংরা করে আর রেল পুলিশ আমাদের মারে, টাকা নেয় আমাদের থেকে।“ আমি বললাম, তা আপনারা কিছু বলেন না?- “না। কী বলবো? আমাদের কী বা জোর আছে? স্বামী ছেলেও নেই এখানে। আমরা মাত্র ৪২ জন বসি এই জায়গাতে। কী করবো আমরা?”- এই শুনতে শুনতে হটাৎ করে তখন আমার ফোন বেজে উঠলো। ডিসপ্লে তে তাকিয়ে দেখি, প্রায় তিনটে বাজতে যায়। জানুয়ারি শেষের ২৬-এর গরিমা'ময় ছুটির দিনে বেশ ভালোই রোদের ভ্যাপসানো তাপ বেড়েছে। গা হাত পা হালকা-হালকা ঘামছে। সাথে তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অনেকটা বেড়েছে প্রজা’দের পিঠে ৭৪ বছরের রাষ্ট্রযন্ত্র'র চাপ আর তাঁদের জ্বিভে তখন লেগেছে, ছুটির দিনে একসাথে মিলেমিশে খাওয়া মাংসের ছাঁটের স্বাদ। পেছন দিয়ে উঁকি মেরে যা- স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী হাসি মুখে দেখছেন। বোধয় প্রজাদের নজরে রাখছেন!
আজ সকালে চা আর মেরি বিস্কুট খেতে খেতে খবরে দেখেছিলাম- দেশের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান নরেন্দ্র মোদী মহাশয় এবং রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু মহাশয়া, প্রথমবারের মতন দিল্লির “সেন্ট্রাল ভিস্তা”(সদ্য উদ্বোধন হওয়া নয়া সংসদ ভবন) থেকে ইজিপ্টের প্রেসিডেন্টের সাথে কর্তব্য-পথে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবেন। ভীষণ জাঁকজমক, আলোর ঝমকানিতে মঞ্চ সাজিয়ে তেরঙ্গা পতাকা উঁচিয়ে- দেশের সবজি বিক্রেতা, রিক্সা চালক তথা খেটেখাওয়া মানুষদের সামনের সারিতে বসিয়ে আজকের দিনটি পালিত হতে চলেছে। এই দেখে সকালে অনেকের মতন আমারো ভালো লেগেছিল তখন। ভেবেছিলাম, যাক অনেক বাজের মধ্যেও ভালো খবর এটা! কিন্তু মাটিতে তাকাতেই ভালোর পেছনে থাকা কালো রূঢ় সত্য আমার চোখের সামনে উঠে এলো এক নিমেষে, আবারো। যা, কোন বিচ্ছিন্ন কিংবা আলাদা ঘটনা নয়। এটাই আমাদের গোটা দেশের অবস্থা। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবে ভয়ংকর থেকে অতীব ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে চলেছে যে দেশের, সংখ্যাগুরু ৯০% খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের। উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়নের রঙিন পৃথিবীতে রাষ্ট্র কতটা নোংরা এবং ভয়ংকর তা বুঝতে আর মোটা মোটা বই ঘাটতে হয় না আমাদের।
প্রজাতন্ত্র দিবসের ইতিহাসে- ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি, ভারতীয় সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছিল। প্রজাতন্ত্র দিবস, ওই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকেই স্মরণ করেই পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে ভারত প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। যদিও, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়নি। কিন্তু, ওইদিন থেকেই ভারত একটি 'সার্বভৌম রাষ্ট্র' হিসেবে পরিগণিত হয় এবং দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান গৃহীত হয়। পাশাপাশি, প্রজাতন্ত্র দিবস ভারতীয় নাগরিকদের গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালিত সরকার নির্বাচনের অধিকারকেও সম্মান করে। তবে মূলত, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন সারা দেশ জুড়ে নেতামন্ত্রী, কর্পোরেট-আধাসামন্ত চক্র, আমলা, সেনা, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশদের হাত ধরে তাদের স্বার্থেই পালিত হয়ে আসছে, ৭৪ বছর ধরে। যেখানে সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র সেলিব্রিটি শারুখ খানের লাইভ শো- দেখবার মতন মাঠ ময়দান ভরাট করে রেখেছে! বলা ভালো সাধারণ মানুষের অর্থ-সামাজিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে, কখনো পয়সা এবং খাবারের লোভ তো কখনো ভয় দেখিয়ে এই শো- দেখতে নিয়ে আসা হয়ে থাকে। এদিন, রাষ্ট্রপতির জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার পর বিভিন্ন রাজ্য এবং সরকারি বিভাগগুলির চমৎকার সামরিক ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যা আমরা দেখতে পাচ্ছি টিভি কিংবা মোবাইল ফোন জুড়ে। এছাড়াও, ভারতের রাষ্ট্রপতি সৈন্যদের পরমবীর চক্র, অশোক চক্র এবং বীর চক্র প্রদান করেন এবং দেশের যোগ্য নাগরিকদের পদ্ম পুরস্কারও দেওয়া হয়ে থাকে, এইদিনে। পিআইবির- তথ্য অনুযায়ী যা এইবারও হয়েছে, আরো বড় করে। কিন্তু দেশের সখ্যাগুরু খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষ'কে এইদিনের শুভেচ্ছা জানানো যায় কোন মুখে! যারা প্রতিদিন রুজিরুটির জোগান করতে গিয়ে সেনা-পুলিশের রুলের বাড়ি এবং শাসকশ্রেণীর নেতা-মন্ত্রীদের শোষণ-শাসনে অত্যাচারিত হচ্ছে, বিচারব্যবস্থার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে তাঁরা এর মানেই কী বুঝবে?
শেষে শিয়ালদহের ওই বাজার থেকে বেরোনোর সময়; আমাকে অন্য আরেক সবজি বিক্রেতা বললেন, “বাবা কোন ক্ষতি করো না আমাদের”। শুনে ফের গরম নিয়ে চোখ পাকিয়ে ছন্দা দেবী বলে উঠলেন, “আমরা বসে নয়, খেটে খাই। আমাদের ক্ষতি করবে কে রে!”