এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • দক্ষিণ দামোদর জনপদ

    কৃষ্ণা মালিক
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৭ আগস্ট ২০২২ | ১১০৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • ছয়




    ক্ষুদিরাম বাঁড়ুজ্জ্যে প্রসাদের থালা হাতে বেরিয়ে এসে হাঁক দিলেন, “কই রে, এদিকে আয় – ”

    মঙ্গলবারে গঙ্গাধরের মন্দিরে গ্রামের বাইরে থেকে আসা ভক্তদের সমাগম। আরতির ঘণ্টা বাজছিল এতক্ষণ। গর্ভগৃহের দরজা দিয়ে তাকালে দেখা যেত, ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় আরতি করছেন নাচের ছন্দে। নিত্য পূজার ভার তাঁর। শনি, মঙ্গলবার দূর দূর থেকে লোক আসে পুজো দিতে, মানত পূরণ করতে, ওষুধ নিতে। পাঁচজনে বলে “ক্ষুদে বামুন”। শুনে আমার গা রি-রি করে। তো সেই “ক্ষুদে বামুন”ই লতাপাতার ওষুধ দেন। তাতে নাকি র‌োগমুক্তিও ঘটে।
    পুজোমানতওষুধে যে প্রণামী আর শাড়ি-গামছা পড়ে, সেটাই তাঁর রোজগার। বারোয়ারী থেকে বাৎসরিক একটা পাওনা জোটে। আর কিছু যজমান বাড়ি। এই সামান্য সামান্য খুঁটেখুঁটেই তাঁকে বড় পরিবার সামলাতে হয়। তবু এত নির্লোভ মানুষ – পুজোর প্রসাদ, নৈবেদ্যর ফলমিষ্টি বেশিটাই তিনি বিলিয়ে দেন।

    আরতির পর আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্ম শেষ হল। যে সমস্ত যাত্রী ওষুধ নিতে এসেছে, তাদের ওষুধ দিলেন। হাতে হাতে চানজল। সব গোছগাছ সেরে তিনি প্রসাদের থালা হাতে বেরিয়ে এলেন।
    আটচালায় কয়েকজনের গুলতানি। দু’-একটি বাচ্চা ধুলোয় খেলছিল। তাঁর ডাক শুনে বাচ্চারা দৌড়ে এসে হাজির। রাস্তা দিয়ে তাঁর ছাত্র বিমল যাচ্ছে দেখে ডাকলেন, “বিমল, আয় বাবা! প্রসাদ নিয়ে যা।”

    মাস্টারমশাই-এর ডাক উপেক্ষা করা সহজ নয়। সে এগিয়ে গিয়ে আগে মাস্টারমশাইকে প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু তিনি পিছিয়ে যান – “দেবতার সামনে প্রণাম নয়, বাবা। হাত পাতো।”
    সে মাথায় বুলিয়ে নিয়ে হাতটা পাতে। সবাইকে প্রসাদ দেওয়ার পর যারা আজ পুজো দিতে এসেছিল বাইরে থেকে, তাদের খোঁজ করলেন। বেশিরভাগ যাত্রীই চলে গেছে তখন। বাতাসপুরের যাত্রীরা এখনও আছে। তাদের সঙ্গে আসা বৌটি টিউবওয়েল থেকে জল ভরতে গেল ঘটি নিয়ে। গাছতলায় বসে চাট্টি মুড়ি খেয়ে উপোস ভাঙবে। তারপর রওনা দেবে তারা তিনজন। স্বামী-স্ত্রী মিলে এক প্রৌঢ়ার সঙ্গে এসেছে।

    কলতলায় হরেন বোস্টমের বৌ জল নিচ্ছিল। অচেনা বৌটাকে দেখে বুঝতে পারে গঙ্গাধরের যাত্রী। তাই তাড়াতাড়ি তাকে জল নেবার জন্য ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তু সে বলে, “তুমি নিয়ে নাও। অত ব্যস্ত হতে হবে না।”
    হরেনের বৌ আবার জল নিতে থাকে। জিগ্যেস করে, “পুজো দিতে এসেছ বুঝি?”
    – হ্যাঁ।
    – তা বাড়ি কোথায়?
    – বাড়ি বাতাসপুর। সেই সকালে বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। অল্পবয়সী বৌটি বেশ বলিয়ে কইয়ে বোঝা যায়। এরপর সে আর একটু প্রাঞ্জল হয়। বলে, “স্বামীকে নিয়ে এসেছি। অনেকদিন ধরে পেটের অসুখে ভুগছে। কত ডাক্তার দেখালাম, কিছুতেই কিছু হল না। শেষে পাড়ার এক ননদ এখানে আসার কথা বলল। বলল এই ঠাকুরমশাই নাকি গঙ্গাধরের ভাল ওষুধ দেয়। এখানে মানত করলে ও ভাল হয়ে যাবে।” – একটু থেমে মুখে এক অনিশ্চিতের ভঙ্গি করে হাতের পাতা উল্টে বলে, “দেখি, কী হয়! গঙ্গাধর যদি দয়া করে –”

    হরেনের বৌ চুপচাপ এতক্ষণ ধৈর্য ধরে বৌটির কথা শুনছিল। এবার বলল, “ঠাকুরমশাই বড় ভাল মানুষ গো! ভালই ওষুধ দেয় – যাই ভাই” বলে জলের বালতি তুলে নেয় সে। বাতাসপুরের বৌ তার দিকে তাকিয়ে হাসে। হালকা গোলাপি সিন্থেটিক শাড়ি দু’-পায়ের চাপে ধরে থেকে ঘটিতে জল ভরে নেয়।

    কলটা মন্দির চত্বরের এক কোণে। পাড়ার অনেকেই ওখান থেকে জল নেয়। গোলাপি শাড়ি জল নিয়ে ফিরে আসে। থালায় থালায় মুড়ি তোলে। বাড়ি থেকে আনা তেলেভাজা, শশা বের করতে করতে মিষ্টি দেখে বলল, “ও ঠাকুরঝি, মিষ্টি কোথায় পেলে?”
    ওর স্বামী, রুগ্ন ধরণের বছর পঁয়ত্রিশের লোকটি বলল, “পুরুতমশাই দিলেন। তিনি নাকি পুজোর প্রসাদ বাড়ি নিয়ে যান না। বড় নির্লোভ মানুষ। দেখলেই ভক্তি হয়।”
    – দ্যাখ না, এখানের ওষুধেই তুই সেরে উঠবি।
    “তাই যেন হয়, দিদি! তাই যেন হয়!” বলতে বলতে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দু’-হাত তুলে বৌ নমস্কার করে। দেখাদেখি লোকটাও।

    জলখাবার খেতে খেতে তারা দেখে, গঙ্গাধরের ঘরে শেকল তুলে মন্দির থেকে নেমে আসছেন ঠাকুরমশাই। তারপর কাঠের খড়ম পায়ে দিয়ে, কাঠের বাঁটের তালি দেওয়া বড় ছাতাটি খুলে হাঁটা লাগালেন তিনি।
    কুলির বাঁশতলা দিনের বেলাও আঁধার। তার নীচে ধুলোয় ধুলোয় ছায়ায় ছায়ায় জমে উঠছে জীবনের আলো আঁধারির জাফরি।

    বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ডাকলেন, “সিদ্ধেশ্বরী – !”
    সিদ্ধেশ্বরী তাঁর স্ত্রী। তিনি বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হয়তো নন, তবে তাঁদের বয়সের যথেষ্ট ফারাক। তাতে অবশ্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালবাসার কোনো ফারাক হয়নি। মাস্টারমশাই খুব লম্বা মানুষ। বয়সটা বাদ দিলে স্ত্রীর সঙ্গে বড্ড মানানসই চেহারা। তাঁর চওড়া চওড়া হাড়ের কাঠামো, তবে রোগা আর সামান্য কুঁজো। উজ্জ্বল গৌর ‘বন্ন’ চেহারায় সর্বদা ধুতি পরা, গায়ে পুজোর সময় নামাবলী। তাঁকে কোনোদিন জামা পরতে দেখা যায় না, মাঝে মাঝে ফতুয়া পরা। বাড়িতে ধুতি, গা খালি। খড়ম পায়ে দিয়ে হাঁটতেন। গ্রামে উনি একাই খড়ম-পায়ে।

    সিদ্ধেশ্বরী বেরিয়ে এলেন ডাক শুনে। তিনিও বেশ লম্বা-চওড়া-ফর্সা এক মহিলা। তাঁদের পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তাদের চেহারাও তাদের বাবা-মা-র মত। মাস্টারমশাই-এর হাতে ছিল গামছা-বাঁধা পুজোর চাল। তিনি ছাতা আর গামছাটা হাত থেকে নিলেন। সেগুলো ঘরে রেখে আবার বেরিয়ে এলেন একগ্লাস সরবত নিয়ে। নিত্যপুজো শেষ না হলে জলগ্রহণ করেন না তাঁর স্বামী। পুজোর পর এই সরবতটুকু, তারপর একেবারে দুপুরের আহার।
    সরবতটা হাতে নিয়ে দুয়ারে বসলেন। জিগ্যেস করলেন, “শেফু কোথায়?”
    গিন্নি উত্তর দিলেন, “কল্যাণীদের বাড়ি গেছে।এখনই চলে আসবে।”
    শেফালি তাঁদের কনিষ্ঠা কন্যা। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটটি বড় চঞ্চল। ঘরে থাকতে ওর যেন ভারি কষ্ট। প্রাথমিক স্কুলটাই গেছে। পড়ায় তার মনোযোগ ছিল না। ওর পরের দু’টি পুত্র সন্তান। তারা সামান্য উঁচু ক্লাসে পড়ে।

    দারিদ্রে ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় কাতর নন মোটেই। অভাবের কোনো ছাপ তাঁদের চোখেমুখে একটুও লেগে নেই। তবে বর্তমানে দুশ্চিন্তার কারণ একটি ঘটেছে। শেফুটা বড় হয়েছে, তাকে পাত্রস্থ করতে হবে। কিন্তু বিবাহের খরচ জোটানোই মুশকিল। তাঁর নিজস্ব সঞ্চয় বলে কিছু নেই। কোনোদিন ছিলও না। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আত্মীয়স্বজন, গ্রামের লোকজন আর যজমানবাড়ির সাহায্যে। এবারও তারাই ভরসা, আর গঙ্গাধরের আশীর্বাদ! শেফুটা পাত্রস্থ হলে তিনি নিশ্চিন্তে মরতেও পারেন। আবার কী, বয়স তো হল সত্তরের কাছাকাছি।

    গিন্নি রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি নামাবলী খুলে দুয়ারের একপাশে আলনায় ঝুলিয়ে রাখলেন। এই সংসারের সবকিছু বড় পরিপাটি। দারিদ্র তাঁদের সৌন্দর্যবোধ নষ্ট করতে পারেনি। একটি খুরপি নিয়ে লঙ্কা-বেগুনের চারার গোড়া আলগা করতে লেগে গেলেন তিনি।

    চৈত মাসে গাজনের সময় সন্ন্যাসীরা আটচালায় লম্বা করে পাতা সামিয়ানায় শুয়ে শুয়ে থেকে থেকে হাঁক পাড়ছে, “বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি মহাদে – ব!” ‘দেব’টা বেশ টেনে টেনে বলে শেষ হচ্ছে।
    রাত দু’-পহরের মাঝামাঝির দিকে সন্ন্যাসীরা ঘট তুলতে গিয়েছিল কংসায়। ওই তারা ফিরছে। ঢাকের আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসছে। ঠাকুমা ডাকল, “বুড়ি, সন্ন্যাসীরা ফিরছে, যাবি দেখতে? আমি পুজো দিয়েছিলুম, পাত্তর আর পুষ্প আনতে যাচ্ছি।”
    ঘুমে আমার চোখ টেনে আসছে। জড়ানো গলায় বললাম, “যাব –”। বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। ঠাকুমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, এখন তবে ঘুমো। মনুই রান্না হয়ে গেলে যখন গঙ্গাধরের পেসাদ দেবে তখন যাস।
    বলতেই আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। এখনই যাব। সন্ন্যাসীরা ওই চলেই এল! ঠাকুমাকে পিছনে ফেলে ছুট।

    দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে।
    যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে।
    রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা।

    যাদের রাস্তার গায়ে বাড়ি, তারা বিকেলে বালতি বালতি জল ঢেলে ধুলো মেরে দিয়েছিল। অথচ কখন নাচের চোটে কাদা আবার ধুলো হয়ে গেছে। রাত্রির এই মধ্যযামে দু-পাশে পুকুর-ডোবা, বাঁশঝাড়, অশ্বত্থ গাছের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মাটির রাস্তায়, অন্ধকারে যেন এক প্রাগৈতিহাসিক নাট্যাভিনয় হয়ে চলেছে। ঠিক যেন সত্যজিতের ‘গুপিগাইন বাঘাবাইন’-এ বাঁশবাগানে হরেক কিসিমের ভূতের নাচের দৃশ্য।
    আমি যে এত ভীতুরাম, সে ঢাকের বাদ্যি শুনে অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে চলে এসেছে! অন্য সময় সন্ধের পর অলিগলি থেকে, গাছের ফাঁক-ফোকড় থেকে কারা যেন ফিসফিস করে আর ভাঁটার মত চোখ নিয়ে আমাকে দেখে। আজ তারাও আমাকে খেয়াল না করে চুপচাপ দেখে চলেছে নৃত্যনাট্য।

    এপাড়া-ওপাড়া থেকে লোক এসেছে “মনুই” প্রসাদ নিতে। গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তে দাসপাড়া, আর উত্তর প্রান্তে ডোমপাড়া থেকেও। গঙ্গাধরের ঘরের ভেতর শুধু শুকনো তালপাতা দিয়ে মাটির পাত্রে মাস্টারমশাই গঙ্গাধরের জন্য মনুই তৈরি করবেন। আতপ চাল, দুধ আর ডাবের জলে সেদ্ধ হবে বাতাসা দিয়ে। বাইরের চাতালে একই উপকরণ দিয়ে যেটা রান্না হবে, তা তাঁর সহকারী কার্তিক করবে অন্যদের সহযোগিতায়। গঙ্গাধরকে নিবেদন, অন্যান্য আচার সারতেই রাত কাবার। এই প্রসাদেও নাকি রোগমুক্তি ঘটে, তাই এর জন্য মানুষের অপেক্ষা। স্বাদও না ভোলার মত। গাজনও দেখা হল, স্বাদও নেওয়া হল!

    মাস্টারমশাই আর বারোয়ারির ম্যানেজার বালতি ভরে প্রসাদ এগিয়ে দিচ্ছেন, দু’-একজন তা পরিবেশন করছে। সবাই গাদাগাদি দাঁড়িয়ে, শুধু উত্তর-দক্ষিণের মানুষেরা ভিড় থেকে আলাদা হয়ে অপেক্ষায়। মাস্টারমশায়ের সহকারী বেঁটে কাত্তিক, ওরফে বেঁটে বামুন, ওরফে বিটলে বামুন। কুঁড়ের বাদশার মত কিছু মানুষ দিনরাত ফুটানি করে, নামবিকৃতি তাদের নিজস্ব শিল্প। এসবই ছিল মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত বিশেষণ। তার নাকি বজ্জাতির শেষ নেই, তাই এত বিশেষণের বাহার। কিন্তু কী তার বজ্জাতি, শান্তার তা জানা নেই।
    মাস্টারমশাই একটা বালতি এগিয়ে দেন কাত্তিককে। বলেন, “যা, ওদের ডাক। শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবি –!” ভিড়ের বাইরে যারা দাঁড়িয়ে তাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তাঁর কন্ঠস্বরে নির্দেশ। গলা তুলে মানুষগুলিকে ডাকলেন, “এস এস, প্রসাদ নাও।”

    হঠাৎ শেতলদাকে দেখতে পাই। “ও শেতলদা!” বলে এগোতে যেতেই ঠাকুমা আমার হাত টেনে ধরে – “রাত দুপুরে ওকে ছোঁবার কী দরকার? আমাকে আবার কাপড় ছাড়তে হবে না?”
    শেতলদা আমাদের বাঁদী কিরষেণ। আমাদের ভাই-বোনেদের কত্ত ভালবাসে! আমাকে একবার কাঁধে করে মামার বাড়ি থেকে বাড়ি এনেছিল। ওকে ছুঁলে কেন চান করতে হবে? কাউকে ছুঁলেই বা কেন?
    পাশের গাঁ, শিবাইডাঙায় একটা ছোট হাইস্কুল আছে। আরমান স্যার ওখানে শিক্ষকতা করেন। আবার গাঁ-গঞ্জে অল্পস্বল্প চিকিৎসাও করেন। কাচের পরিষ্কার শিশিতে কয়েক দাগ কুইনাইন ঢেলে সাদা কাগজ সরু ও লম্বা করে চারকোনায় কেটে শিশির গায়ে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেন। এক-একটা চারকোনা যেখানে শেষ, সেটা এক দাগ। সর্দি, কাশি, জ্বরে রোগীকে নির্দেশমত দাগ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হয়। আমরা খেয়েই ঢকঢক জল খাই, চিনি মুখে দিই, যা তেতো!

    সুন্দর চেহারার পরিপাটি মানুষ তিনি। পরিষ্কার কামানো মুখ। প্যান্ট-শার্ট পরেন। তিনি রোগী দেখে চলে গেলেই মা-ঠাকুমারা জামাকাপড় ছাড়ে। সত্যি! ছোঁয়াছুঁয়ি’র কত বৈচিত্র্য! দাস আর ডোমপাড়ার লোকেরা সবার কাছে অচ্ছুৎ। দুলে পাড়ার লোকেরাও। অথচ দুলেপাড়ার লোকেরা রুইদাস আর ডোমেদের ছোঁবে না। আমরা দুলেদের ছুঁই না। অথচ আমরাও অচ্ছুৎ কায়েত-বামুনদের কাছে। ভেবে কুলকিনারা পেলাম না, জাত জিনিসটা কী?

    বড়পুকুরে চান করতে গেছি মায়া, রীনা, খোকনের সঙ্গে। এক পাল ছেলেমেয়ে তখন পুকুরের জলে তোলপাড় করছে। আমি আর মায়া ঘাটের তালকাঁড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামছি। নেমেই ঝাঁপিয়ে পড়েছি জলে। সাঁইঠাকুমা চান করে উঠে আসছিল। হাঁ হাঁ করে উঠল, “এই তোরা ঘাট থেকে সরে গিয়ে সাঁতার কাট। দিলি তো জল ছিটিয়ে! এক-এক বার একএকদল আসছিস, আর জল ছেটাচ্ছিস গায়ে। কতবার করে গা ধোব?” গজগজ করতে করতে আনার গা ডোবাল জলে।
    উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, “এই দিলুর বেটি! তুই ওদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিস কেন? দাঁড়া, তোর ঠাকুমাকে গিয়ে বলছি।” বলে গজগজ না থামিয়ে তালকাঁড়ির সিঁড়ি হাত দিয়ে জল ছিটিয়ে ধুয়ে উঠে গেল। আমি অতটা ব্রাত্য নেই। কিন্তু আমার সঙ্গীসাথীরা ব্রাত্য। পুকুরের জলে দাঁড়িয়েও তাদের ছোঁয়া জল গায়ে লাগলে অশুচি হয়ে যায় ওরা।
    বিকেলে খেলতে খেলতে মায়াকে জিগ্যেস করলাম ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা। ও আমার থেকে বয়সে বড় হলেও একক্লাসে পড়ে। একেবারে গেছো মেয়ে, অনেক কিছু জানে ও।
    বলল, “দাসপাড়ার ওরা মুচি তো? ভাগাড় থেকে গরুর মাংস তুলে এনে খায়। সেই জন্যেই ওদের কেউ ছোঁয় না!” এর বেশি আর তার জানা নেই। আমি অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।

    একদিন সময় হবার বেশ আগে ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল। মাস্টারমশাইরা জানালেন ক্ষুদিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেছেন। আমি অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছি। সকালে যে আমি পড়ে এলাম!
    সবার সঙ্গে ছুটলাম ওঁর বাড়ির দিকে। এত ভিড়, এগোতেই পারলাম না। খুব ইচ্ছা করছে একবার তাঁর মুখখানা দেখতে। ফ্যালফ্যাল চোখে সবার দিকে তাকাই, সবার আফশোস, আর চোখে জল। ওঁকে যখন চৌদোলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, শুধু তাঁর পা দু’টি বেরিয়ে থাকতে দেখলাম। সেই পায়ে এত চলা, এত ধুলো! ধুলোর ভেতর তাঁর পায়ের ছাপ। আবছাভাবে মনে হয় মানুষ যেভাবে চলছে প্রতিদিন, সে চলায় ছন্দপতন হচ্ছে। কোনো আলোকিত সুষমা নয়, যেন অন্ধকারের ভেতর ঢুকে পড়ছে মানুষ। বহির্বিশ্ব ছাপিয়ে ছন্দপতনের শব্দ শ্রুতিকটু হয়ে অপস্বর সৃষ্টি করছে। তাঁর আদুল পা কোনো দিক নির্দেশ করছে কিনা, তখন বুঝিনি। এত কথা তখন মনেও হয়নি। এসবই আমার পরের দিকের ভাবনা।

    কিছুদিন আগে বিয়ে হওয়া শেফালি পিসিকে দেখতে পেলাম। পাগলের মত করছে। ঠাকুমা বাড়ির দরজায় এগিয়ে এসেছেন। তাঁকে ধরে আছেন দু’জন মহিলা। ঠাকুমার যেন দেবীমুখ। সিঁদুরদানের পর নববিবাহিতা মেয়ের মত তাঁর মাথাভরা সিঁদুর। ফরসা কপালের বড় সিঁদুরের টিপ ধেবড়ে গেছে। ভেতর থেকে কী এক আভা এসে তাঁর মুখখানাকে যেন অপার্থিব করে তুলেছিল। শাড়ির লাল পাড়টাও যেন বড্ড টকটকে। চোখ দুটো কান্নায় ভেজা তো নয়, যেন বৃষ্টি মেখে এসেছে টলটল করছে পদ্মের পাপড়ি। ঠাকুমার এত সৌন্দর্য ওই বয়সেও কোথায় ছিল? কিন্তু ওই সবটুকুই যেন ঝরে পড়া। আমি ঠাকুমাকে স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলাম।

    কিন্তু মাস্টারমশাইএর পায়ে এত রক্ত কেন? টকটকে লাল রক্ত। তারপর বুঝতে পারলাম, পায়ে আলতা মাখানো। কে জানে, আলতা নয়, হয়তো বুকে জমেছিল গোপন রক্ত! এখন পা বেয়ে নেমে এসেছে!
    জুঁইফুলের মত খই ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হয়, যেন জুঁই-এর সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন। জীবনে না পাওয়ার আফশোষে যারা ধুঁকে ধুঁকে শতবার মরে, আর পথচলায় দুর্গন্ধ ছাড়া কিছু পায় না তিনি তার পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। হঠাৎ আমার খুব কান্না পেল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বই-এর ঝোলা কাঁধে বাড়ির দিকে ছুটলাম।




    (ক্রমশঃ)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৭ আগস্ট ২০২২ | ১১০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৮ আগস্ট ২০২২ ১৪:৩৮511444
  • বড় ভাল লেখা। 
  • Ranjan Roy | ২৮ আগস্ট ২০২২ ২২:২৪511465
  • পড়ছি। 
    আমার অজানা সমাজ, অজানা সময়। খুব যত্নে তুলে ধরছেন লেখক।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন