এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হোলি ম্যান টেলস আস লাইফ ইজ অ্যা মিস্টেরি 

    Diponkar Chanda লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ জুলাই ২০২২ | ৫৫৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  •  
    জ্বর হলেই বুঝতে পারতাম ও আছে।

    প্রথমে ছিলো তীব্র আতঙ্ক, তারপর আধিভৌতিক আশা-নিরাশার ঘোর, তারপর আশাভঙ্গের বেদনাজাত অসাড়তা, তারপর একটা ভীতি, যেমন প্রকট শীতের সন্ধ্যায় পৃথিবীর আশপাশ সঘন বাহুতে আঁকড়ে ধরে সফেদ কুয়াশা, তেমন, তারপর হতাশা, জোরালো থেকে ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ, তারপর মলিন বিষাদ, মানিয়ে না নিয়ে উপায় নেই বলে মানিয়ে নেয়া তারপর, তারপর একত্রবাসের অভ্যস্ততা।

    আমি এখন অভ্যস্ত ওর সাথে বসবাসে।

    ওকে ধারন করি, ও আছে। ওকে অনুভব করি, ও আছে। ওকে লালন করি, ও আছে। ওকে এখন ভালোই হয়তো বাসি, ও আছে।

    পর পর কয়েকদিন জ্বর না হলে এখন বরং ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বোধ করি, ওর উপস্থিতি-অনুপস্থিতির মধ্যবর্তী দোদুল্যমানতায় কাতর বোধ করি, অনুভূতির প্রচণ্ডতা দিয়ে ওকে স্মরণ করতে থাকি জপমালার মতো, স্মরণ করতে থাকি মনে মনে, 'এই তুমি কোথায়?'

    এক আলোকবর্ষ দূর থেকে ও সাড়া দিতে থাকে সূক্ষ্ম তরঙ্গের মতো, 'এ-ই-যে-আ-মি'

    'অনেকক্ষণ তুমি নেই আমার অনুভবে', আমি বললাম ধীরে ধীরে।

    'মাঝে মাঝে এমন হয়, অস্তিত্ব বিবশ হয়ে যায়, মনে হয় এই আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি, কোনো এক কৃষ্ণবিবর যেন আমাকে দৃশ্য থেকে মুছে যাবার জন্য টানছে প্রবল', ভাঙা কাঁচের টুকরোর মতো অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন তরঙ্গের বার্তা পাঠাচ্ছে ও আমার মস্তিষ্কে।

    'আমি অবশ্য ঘুমিয়ে ছিলাম অনেকটা সময়, অথবা ঘুমাইনি হয়তো, হয়তো তন্দ্রাচ্ছন্নতা, অথবা ঘোর', আমার কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি প্রবল।

    'আমাকে ভুলে ছিলে?'

    'আরে না, ডাক্তার আঙ্কেল এলেন...'

    'উনি মোটেই ভালো নন...'

    'আমার তো ওনাকে ভালোই মনে হয়', আমি আমার অভিমত জানালাম।

    'না। উনি চান আমাদের বিচ্ছেদ...'

    'ওনার ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত, উনি একজন বিশ্বখ্যাত ডাক্তার। ওনার তত্ত্বাবধানেই চলছে কেমোথেরাপি...'

    'কেমোথেরাপির বিষয়টা জানা নেই আমার, তবে এই ঘটনাটা যখন ঘটতে থাকে, আমি এবং আমার অংশবিশেষ ধ্বংস হতে থাকে, আমি চিৎকার করতে থাকি, নির্জীব হতে থাকি ক্রমশ, তারপর একটা সময় আমি আমার নিয়ন্ত্রণকে হারিয়ে যেতে দেখি, দেখি তোমার সাথে আমার দুরত্ব বাড়তে বাড়তে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে...'

    'খুব কষ্ট হয় তোমার?'

    'হ্যাঁ...'

    'আমারও খুব কষ্ট হয় জানো, তুমি যখন আঁকড়ে থাকো আমাকে, কী ভীষণ ক্ষয় আমার ভেতরটা চূর্ণ বিচূর্ণ করতে থাকে বলে বোঝাতে পারবো না! আবার যখন তুমি অস্তিত্বহীন সত্তার মতো প্রায় দেহবিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে কোথাও হারাতে থাকো, তখন একটা শূন্যতা অনুভব করি, প্রবল শূন্যতা...'

    'দীর্ঘ একত্রবাস আমাদের...'

    'বিচ্ছেদ নিয়ে তবু ভাবতে হবে, একটা মানসিক প্রস্তুতি, যদি বিচ্ছেদ ঘটেই আমাদের, কখনও, অতিলৌকিক কোনো ঘটনায় যদি বদলে যায় জীবনের হিসেব নিকেশ...'

    'বিচ্ছেদ আমার পছন্দ নয় একদম, দেখো সর্বশক্তি দিয়ে তোমাকে ধরে রাখবো আমি...আমৃত্যু...'

    পাঠক, এতোক্ষণ যা পড়ছিলেন, সেটা একটা সাবকনসাস কনভারসেশন, ক্যান্সার জীবাণুর সাথে সামান্থার। সামান্থা হচ্ছে আট বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে  যে কিনা হসপিটালাইজড, যে কিনা ক্যান্সারের দীর্ঘ চিকিৎসায় ফিজিক্যালি সাইকোলজিক্যালি ট্রমাটাইজড। আবার গল্পে ফিরছি।
     
    গল্পের এই পর্যায়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি যাঁর সাথে, তিনি ডাক্তার উইলিয়াম স্মিথ, তাঁরও পছন্দ নয় বিচ্ছেদ। ভীষণ আশাবাদী একজন মানুষ তিনি, তিনি জানেন লৌকিক সর্বনাশের কৃষ্ণগহ্বর থেকেও কী করে তুলে আনতে হয় অলৌকিক সাফল্যকে। ডাক্তার উইলিয়াম স্মিথ হচ্ছেন সামান্থার চিকিৎসক।

    তাঁর পেশাগত দক্ষতা, প্রচন্ড নিষ্ঠা এবং একাগ্র প্রচেষ্টার প্রতি তিনি আস্থাশীল। সামান্থার সর্বশেষ ল্যাব টেস্টের রেজাল্ট তাঁর হাতে এখন। 

    তিনি জানতেন ক্যান্সারকে পরাজিত করতে পারবেন তিনি। এবং সেটা পেরেছেনও। সামান্থা এখন শঙ্কামুক্ত। মরনব্যধি পারেনি সামান্থার সাথে জীবনের বিচ্ছেদ ঘটাতে। হেরে গেছে পরাক্রমশালী জীবাণুরা মানুষের অতুলনীয় ইচ্ছেশক্তির কাছে।

    এই মুহূর্তে হসপিটালের বেডে সামান্থা। ঘুমন্ত। 

    বাইরে সকাল। মিষ্টি রোদে প্লাবিত হচ্ছে প্রান্তর। ঘুমন্ত সামান্থার স্নিগ্ধ মুখের তাকিয়ে আছেন ডাক্তার স্মিথ। কেমোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ঝরে গেছে বাচ্চা মেয়েটার মাথার চুলগুলো। এবং শরীর ভেঙে গেছে ভীষণভাবে। মেয়েটার সাউথ এশিয়ানদের মতো টানা টানা কাজল কালো চোখ। এতো এতো ধকল সত্ত্বেও সামান্থার চোখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক পৃথিবীর মায়া।

    ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করেন ডাক্তার স্মিথ, একজন মানুষকে আবার তার নিজস্ব ভুবনে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অনুভব করেন প্রচণ্ড কৃতজ্ঞতা।

    আজ রবিবার নয়, তবু ডাক্তার উইলিয়াম স্মিথ আজ চার্চে যাবেন। প্রতিটি পেশেন্টকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার পর অনেকটা সময় চার্চে কাটান তিনি। চোখ দুটো একটু ভেজা ভেজা তাঁর এই মুহূর্তে।

    একটু অপ্রসঙ্গে যাচ্ছি পাঠক, ডাক্তার স্মিথ আবিষ্কার করলেন সামান্থার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি চলে গিয়েছিলেন অনেকটা অতীতে, ভাবছিলেন তাঁর নিজের মেয়ে এলিজাবেথের কথা, যাকে আদর করে লিলিবেথ নামে ডাকতেন তিনি, লিলিবেথকে তিনি হারিয়েছিলেন কাকতালীয় ভাবে ওর আট বছর বয়সেই, ক্যান্সারই ছিলো লিলিবেথের মৃত্যুর কারণ, তখন তিনি সবেমাত্র শুরু করেছেন প্র্যাকটিস, তখন তিনি ছিলেন নিরুপায়, ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন ডাক্তার স্মিথ, তিনি বিশ্বাস করেন তাঁকে একজন অতুলনীয় ক্যান্সার চিকিৎসক হিসেবে সৃষ্টি করবেন বলেই ঈশ্বর নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন লিলিবেথকে।

    পুনরায় প্রসঙ্গে ফিরছি পাঠক, ডাক্তার স্মিথ হসপিটাল থেকে বাইরে এলেন। তাঁর মুখমণ্ডলের চারপাশ জুড়ে অদ্ভুত এক পুণ্যাভার বলয়। হাঁটতে হাঁটতে নিকটবর্তী চার্চে যাচ্ছেন তিনি।

    ডাক্তার স্মিথ হাঁটছেন, হাঁটছেন আর স্মরণ নিচ্ছেন ঈশ্বরের, বিড়বিড়িয়ে বলছেন, 'ঈশ্বর! সুন্দর রাখো এই পৃথিবীকে, সুস্থ রাখো পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে।'

    সামনেই চার্চ।
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Katha Haldar | ১৬ জুলাই ২০২২ ০৪:১১509914
  • আলো-আঁধারময় কুয়াশবৃত যেন গল্পটি। ভালো লাগলো। 
  • Diponkar Chanda | ১৮ জুলাই ২০২২ ২৩:৫৪510019
  • স্বাগত আপনাকে সবসময়।
     
    শুভকামনা, এবং অনেক ভালো থাকবেন কবি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন