এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হাত্যরু

    আফতাব হোসেন লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ জুন ২০২২ | ৫০৭ বার পঠিত
  • - " দাজু, য়াদি তপাই হাত্যরু হেরনা চাহুঞ্চা ...
    চিত্তো আও "
    ( দাদা, মার্ডার দেখতে হলে তাড়াতাড়ি আসুন )

    থ্রিলার লেখার একটা ইচ্ছে জীবনভর। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া থ্রিলার লিখলে কলম না মন কোনটাই শান্তি হয়না ঠিক। বারো বছর আগে যখন পেটভাতার জোগাড়ে পাহাড়ে এসে পৌছেছিলাম তখন থেকেই এই থ্রিলার ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই চাগাড় দিয়ে গেলেও জমে উঠছিলোনা। সাহস টা দিল রুহান। রুহান তামাং। আমার অসময়ের সঙ্গী। সময়েরও। বলবো না বলবো না করেও একদিন বলেছিলাম রুহান কে থ্রিলার লেখার ইচ্ছের কথা। আজ সকালে ফোন টা আসতেই আবার হাত নিশপিশ হল। গুছিয়ে নিয়ে বসলাম। আরো একবার। গুপ্ত আশা মরতে মরতেও মরে না।

    উইকিপিডিয়া বলছে ভালো থ্রিলার এর কয়েকটা গুন থাকা দরকার। মানে প্লট গুলো একটা নিরবচ্ছিন্ন ঢঙে সাজিয়ে নিলে ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর হয় আরো। আমিও সাজালাম। মোটামোটি থ্রিলারে কিছুটা কন্সপিরেসি, কিছুটা ফিকশন, কিছুটা উপায়হীনতা সাথে বীভৎসতা আর মিস্ট্রি কে চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে শেষমেষ চরিত্রকে ভিলেন করে ভিকটিম কে খুন আর দুর্ঘটনার মাঝে এনে ফেলে অক্ষর শেষ করতে পারলেই বেস্ট সেলার হবার চান্স একশ ভাগ।

    শুরু করি। প্রথমে কিছুটা ইতিহাস সাথে কন্সপিরেসি। কোন গ্রেটার কন্সপিরেসি তে বোকা দুই পক্ষ যুদ্ধ করলে তৃতীয় চালাক পক্ষ কিভাবে মজা নেয় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শৈলসহর। স্বাধীনতার পূর্বে সিকিম আর নেপালের মারামারিতে নেপালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশের সাহায্য নিল সিকিম। ব্যাস নেপোয় মারে দই এর মত কুইন ভিক্টরিয়া জোর করে গিফ্ট নিল কুইন অফ হিলসের। মার্ডারের প্লট সম্ভবত তখন থেকেই শুরু। উল্লেখ করি সেই মুহূর্তে পাহাড়ের রানীকে পাহাড় সাজিয়ে রেখেছিল দু হাত ভরে। পুরো পাহাড় জুড়ে মোট লোকসংখ্যা তখন শ খানেক মাত্র। পাহাড় তখন শীতে চুপ থাকে নববধূর লজ্জায়, গরমে আল মোড়া ভাঙে, বর্ষার শৃঙ্গারে রীতিমত লাল হয়ে পাইন জঙ্গলে মুখ লুকিয়ে নেয়। ঘুণাক্ষরেও বেচারা টের পায়নি ভবিষ্যতের কথা, টের পায়নি বলেই স্বাধীন হয়ে আবার পরাধীন হল সাদা চামড়ার লোকের জন্য। লাট সাহেবরা থাকবে। শীতের রাজধানী। দক্ষযজ্ঞ শুরু। তিলে তিলে মরা সেইসময় থেকেই। ভিড় বাড়লো সেই সময় থেকেই। দি ইভিল কন্সপিরেসি শুরু তখন থেকেই।

    এবার আসি ফিকশন, নিরুপায়তা আর বীভৎসতায়। রুহান তামাং এর দাদু প্রথমবার পালিয়ে এসেছিল সিকিম থেকে সেই যুদ্ধের সময়। তখন সাদা চামড়ার দাপাদাপি। মালদার কোন এক ঠিকাদারের হাতে এসে পড়ে তামাং এর দাদু। তখনও রাজভবন হয়নি। তারপর নতুন নতুন যত বাড়ি নতুন নতুন তত লেবারের সাপ্লাই করার দায়িত্ব চাপলো তামাং এর দাদুর। সাথে পাহাড়ের শক্ত মাটির সন্ধান। সে অনেকদিন ধরে। দেশ স্বাধীন হবার পর যত সময় এগিয়েছে ততই সারা দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছে ব্যবসায়। পাহাড় ব্যবসায়। মাটি, গাছ,পাথর কেটে তছনছ করে ইমারতের পাহাড় তুলেছে। একদিন ধরে না। যুগ যুগ ধরে। তামাং এর দাদু থেকে যে ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল সেই ট্রেন্ড থামলো যখন তখন আর পাহাড়ে পাহাড়ি জমি নাই। রুহান তামাংরা চার নম্বর জেনারেশন এ এসে দেখলো শুধু একহাতে পাহাড়ি রাস্তায় স্টিয়ারিং ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই ওদের আর। যে পাহাড়ের জমি,যে পাহাড়ের বুক চিরে ওর দাদুরা এখানে বসবাস স্থাপন করছিল সাথে করিয়েছিল সেই জমি এখন কর্পোরেট দখলে। সব পেতে চেয়ে সব হারিয়ে শুধু ' পাহাড়ের ড্রাইভার ' হয়ে বেঁচে থাকা রুহান দের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় আমারও। ড্রাইভার হিসেবেই। বাদ দিন ওসব। এবার মার্ডার স্পটে আসুন,মার্ডার হবার অনুঘটক গুলো দেখুন। রুহান দেখতে নেপালি। ভালো পাহাড়ি ড্রাইভার। গরমের ছুটিতে কলকাতার বাবুদের কাছে হেব্বি ডিমান্ডেবল। টোটাল কুড়ি জনের টিম। টগবগে তরুণ, বুড়ো, বুড়ি, যুবক সব মিশিয়ে। টিমের সবচেয়ে মোটাসোটা কালো মধ্যবয়স্ক লোকটা NJP স্টেশনের বাইরেই অন্য কোন পার্টির জন্য অপেক্ষায় থাকা রুহান কে দেখিয়ে এগিয়ে এলো খানিক। কলকাতার লোকজন পাহাড়ে এলে কেন জানি শিলিগুড়ি কে বাংলার অংশ ভাবেই না। কালো লোকটা ফিসফিসিয়ে তাই হিন্দি গলায় রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল
    - ' পাহাড় জানা হে, কিৎনা টাকা লোগে ?
    রুহান নিস্পৃহ ভাবে উত্তর দেয়, ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে।
    - 'নেহি সব, মে অলরেডি বুক হু '
    দেখতে নেপালি, জাতে ড্রাইভার। কলকাতার স্পর্ধা। না শুনতে অভ্যস্ত নয় মনে হয়।
    আবার মোটা লোকটা হিন্দিতে
    - 'উ লোগ কিতনা দেখা তুমকো ?
    হম উসসে বেশি দেগা '...
    রুহান জানে এভাবে, এভাবেই ব্যবসা করতে হয়। মাত্র কয়েকমাসের ব্যবসায় পুরো বছর চালাতে হবে। তাই অন্য পার্টির আগে থেকে বুক করা
    'বিশ্বাস 'অবলীলাল ভেঙে ফোনের সুইচ টা অফ করে বেশি টাকার ' বাবু ' নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। মাঝে পাহাড়ের বাঁকে শুনতে পায়, বাংলায়, পিছনের সিটে,সেই মোটা কালো লোকটার ফিসফিসানি গলা
    - ' শ্লা...
    সেই পাহাড়ি বাহাদুর মার্কা সতী সাবিত্রী আর নেই নেপালিগুলো। সালারা এখন টাকায় বিক্রি. ..'
    বাংলায় চার যুগ ধরে বাস ধরা, বাঙালি কিন্তু নেপালি দেখতে রুহান স্টিয়ারিংয়ে আর একটু মন দেয় ভালো করে, নেপালি স্টাইলে...

    এখন পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কোন ইশারা থাকেনা। কোন রোমান্টিক আহ্বান ও থাকে না। থাকে একরাশ হাহাকার। মুখ দিয়ে বলতে না পারা হাহাকার। সাথে অস্তিত্বের সঙ্গে ধুঁকতে থাকা অনিশ্চয়তা। কিন্তু মজার ব্যাপার পর্যটকরা পাহাড়ে ইদানিং রোমান্স খুঁজে পায়, খুঁজে পায় সতেজ হবার রসদ। আসলে ব্যাপারটা সেই সেই মনন্তরের আমলের মত। টু এইচ বি কে এর মরা গুলো, মরতে চলা কাউকে দেখে যেমন করে রস খুঁজে পায়, ঠিক তেমন করেই আধমরা, হাঁফিয়ে ওঠা মানুষ এর ছাল চামড়ার অবয়ব গুলো পাহাড়কে সঞ্জীবনী ভাবলেও বুঝতেই পারে না বা চায় না পাহাড় আর পুরো জ্যান্ত নেই, আধমরা হয়ে ধুঁকছে অনবরত।

    এই যেমন রুহানের গাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য রোহিনী পেরোনোর পরেও যখন পাহাড় কোনটা পাহাড় কোনটা বলে অস্থির হয়ে উঠছে, তখনও কেউ খেয়াল করেনি পাহাড়ের এত কাছেও পাহাড় আর দেখা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দিনে দিনে বিষিয়ে যাচ্ছে পাহাড়রানির বায়ু। বাড়ছে ‘এরোসল’ বা ভাসমান কণার মাত্রা। উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের কার্বনকণা এবং অন্য নানা ধরনের দূষিত কণা পাহাড়ের দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ে প্রতি ঘনমিটারে পোড়া কার্বনের মাত্রা প্রায় ১০-১২ মাইক্রোগ্রাম। যা স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। এই ধরনের দূষণের ক্ষেত্রে প্রথম সারির শিল্পশহরও পাহাড়ের রানির পিছনে পড়ে গিয়েছে। এই দূষণের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন পর্যটকেরাও। কখনো কখনো আবার হানা দিচ্ছে কালো রঙের মেঘ, ধোঁয়াশা। ফলে দিনভর প্রকৃতির শোভা সে-ভাবে চোখেই পড়ছে না। গাড়ি চালাতে গিয়েও নাজেহাল হচ্ছেন চালকেরা। এর মাঝে একটুকরো পাহাড় দেখে মোটা কালো লোকটা বাচ্চাদের মত গদগদ। উত্তেজনায় ছোট সদস্য কে আঙ্গুল তুলে দেখানোর চেষ্টায়,
    - ঐ দেখ বাবা, ওই দেখ পাহাড় '
    ছোট সদস্য অবাক চোখে। বইয়ের ছবির সঙ্গে মেলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিরক্তির উত্তর -
    -'ধুর, ওগুলো তো বাড়ি একগাদা '...
    বিজ্ঞ চোখে মোটা লোকটা এতক্ষনে শান্তিতে। উত্তর দিল -' বোকা, পাহাড় কেটেই তো বাড়ি বানানো,ওপরে পাহাড় মানেই বাড়ি, বাড়ি মানেই পাহাড়'...
    রুহান শোনে সব, দীর্ঘশ্বাস চেপে যেতে শিখেছে মনে হয় আজকাল। শেষ কথাগুলো ভাসছে এখনো বাতাসে।
    -'পাহাড় কেটেই তো বাড়ি বানানো,
    ‘ পাহাড় মানেই বাড়ি, বাড়ি মানেই পাহাড় ‘…

    শীতকাল এলে লোকের পুলক জাগে। আমি আবার কুঁকড়ে থাকি। ভাগ্যিস মুঠোফোন আছে। লোকে চোখ বেঁধে স্বর্গ খুঁজে ফেরে আর আমি কম্বলের নীচে মুঠোফোনে স্বর্গ নামিয়ে আনি। তবে শীতের রাতগুলো রুহানদের খুব একটা রোমান্টিক হয় না অন্য বঙ্গবাসীদের মত। গত কয়েকবছর পাহাড়ে শীত খুব একটা পড়েনি। পড়লেও নিরবচ্ছিন্ন নয়। কখনো খুব শীত, আবার কখনো গরমের ভাব একটানা। লোকজন বলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং।

    শীতে রুহানদের খুব একটা কষ্ট হয় না। সমস্যা হত রুহানের মায়ের। বয়সের ভারে শরীরের যন্ত্র গুলো একে একে জবাব দেওয়া শুরু করেছিল আগেই, শীতকালে ধোঁয়াশার মাঝে পড়ে বছর তিনেক আগেই আর শ্বাস নিতে না পেরে পাহাড়ের শান্তিতেই শান্তি খুঁজেছিল রুহানের মা। রুহানরা এই ধোঁয়াশা কে বলে বার্বি ফগ। অনেক কষ্টে মানে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম।আসলে নিজেদের বসতি গুলো বেকার রুহানদের মত পাহাড়ী তরুণরা রোজগারের আশায় ব্যবসায়ীদের ভাড়ায় দিয়ে দেয় অনেক সময়। ব্যবসায়ীরা মেজে ঘষে সেগুলোকে একটু চকচকে করে নাম দেয় হোম স্টে। কার হোম আর কারা স্টে করে সে ইতিহাস থাক। মোটা টাকা আমদানিটাই তখন প্রধান হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে আবার হোম স্টের শহুরে বাবুদের জংলি হবার ইচ্ছে হয় বড্ড। তাও আবার ইংলিশ স্টাইলে। নাম দেয় বন ফায়ার। হেঁড়ে গলায় ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে ভুলভাল গান সাথে লাইভ পোড়া মাংস মানে বারবিকিউ। তা বেশ। এন্টারটেন্টমেন্ট অলওয়েজ ওয়েলকাম। কিন্তু ভাবার ব্যাপার হল এরকম হোমষ্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাজারখানেক প্রায়। পিক সিজনে প্রতিদিন ঘন্টা খানেক বন ফায়ার হলে পাহাড়ের পরিবেশের কি হবে ? সাথে রয়েছে শিলিগুড়ি তথা সমতলে দূষণ। সমতলে অনিয়মিত,প্ল্যান ছাড়া অট্টালিকা সাথে রাস্তার চেয়ে বেশি গাড়ি যার বেশিরভাগ ই দূষণের কোন নিয়ম না মেনেই রাস্তায় বের হয়।, সেই সমতলের বিষাক্ত ধোঁয়া গরম হয়ে উপরে উঠে। আবার পাহাড়ের আনাচে কানাচে জুড়ে লাইভ বারবিকিউ নেশনের জ্বালায় এক রহস্য ময় ধোঁয়াশা তৈরি করে। কলকাতার যে বাবুদের রুহান পাহাড় দেখাচ্ছিল তাদেরই একজন সরু গলায় পুরুষ সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে এই ধোঁয়াশা দেখে হালকা স্বরে বলে উঠলো
    - ' ওয়াও...
    সো রোমান্টিক'..
    সঙ্গীও কম না খুব একটা। রুহানের দিকে তাকিয়ে নিজের হিন্দি জ্ঞান জাহির করে বললো
    ' তুম লোগ খুব লাকি হো,
    এইসা ধুঁয়া ধুঁয়া মার্কা রোমান্টিক জায়গা পে রহতা হো..'
    রুহান জানে চুপ থাকতে হয়। রুহান জানে ধোঁয়া ভালো হয় মাঝে মাঝে। ধোঁয়ায় চোখ ঢাকা সোজা বড়। চোখ বন্ধ করাও, যেমনটা রুহানের মা করেছিল, একেবারে...

    রুহানদের গাড়িটা ঘুম স্টেশনঘেঁষা রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাবার সময় উসখুক করে দলের মোটা মত লোকটা জিজ্ঞাস করলো
    - ' ভাইয়া বমি বমি লগ রাহা হে ' রুকো একটু..
    পানি কি বোতল লেনা হে...'
    একটু পরেই বাইরে হাঁকডাক এর আওয়াজ শুনতে পায় রুহান। মোটা লোকটা তারস্বরে চিৎকার করছে,
    -'ইয়ে দিনমে ডাকাতি হে,তুম লোগ চুরি কর্তা হে, কুড়ি রূপায়ে কে বোতল পঞ্চাশ মে বেচতা হে..'
    রুহানের স্মৃতিতে ওর ছোটবেলা আর এর মায়ের কষ্টের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে ওরা তিন বোন আর মা মিলে পাহাড়ের ফেটে যাওয়া পাইপ গুলো থেকে কত কষ্ট করে জল বেয়ে তুলতো।
    আসলে কেবল দার্জিলিং শহর নয়, জল নিয়ে এই সমস্যা পাহাড়ের প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রেই৷ মিরিক, কার্শিয়াং থেকে কালিম্পং, সর্বত্র পানীয় জল নিয়ে সমস্যা। এক সময় ভোটে পাহাড়ের ইস্যুই ছিল পানীয় জল৷ দিনের নিয়মে সে ইস্যু ফুরিয়েছে। পাহাড়ের কিছু শহরের সাধারণ নাগরিকদের পানীয় জল আসে রেলি-ফুকচু থেকে৷ রেলি-ফুকচুর হালও কাকঝোরার মতো হওয়ায় জল নিয়ে প্রতিদিন নাজেহাল হচ্ছেন বাসিন্দারা৷ বিপাকে পড়তে হচ্ছে পর্যটকদেরও৷ ব্রিটিশ জমানা থেকে কাকঝোরার জল দার্জিলিংয়ে সরবরাহ করা হত৷ কয়েক দশক আগে কাকঝোরা শুকিয়ে যেতে শুরু করায় বালাসন প্রকল্প তৈরি হয়৷ তাতেও শৈলশহরে জলের সঙ্কট মিটছে না স্রেফ সরবরাহ ব্যবস্থা বেহাল হয়ে থাকায়৷ এদিকে রিসার্ভার এ জমা পানীয় জল বেশি টাকা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ ঠিকাদার কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে বড় হোটেলগুলো। ফলে এখনো সাধারণ মানুষকে জলের জন্য প্রতিদিন সকালে লাইনে দাঁড়াতে হয় ৷ অনেকে আবার এসব কষ্ট বাঁচিয়ে রোজগারের আশায় বিপথে যাচ্ছেন ও। পাহাড়ের জল বোতলে ভরে ডুপ্লিকেট ব্যবসা। দক্ষিনের শহরের বাবুদের এসব বোঝার ক্ষমতা বা অভ্যেস কোনটাই নেই।
    তাই 'তুম লোগ সালে চোর হো ' শোনাটা রুহানদের অভ্যেসে আর নিয়তিতে দাঁড়িয়েছে এখন।রুহান কান বন্ধই রাখে এসময়।

    সারাজীবন ফ্লপ মানুষ আমি,সব্বাই যে বয়সে সিঁড়ি ভাঙা শিখে দুপদাপ করে ওপরে উঠে যেত, সেই বয়সেও মাঝে মাঝেই হোল কিউয়ের সূত্রে আমি কুপোকাত ছিলাম।ব্রায়ান এডামস আর বিটেলস এর বিটকেল মার্কা সুরের চেয়ে আমায় বারান্দায় রোদ্দুর অনেক বেশি এড্রিনালিন দিত।এমনকি পাবদো নেরুদার মধ্যযুগেও, আমার, পাড়ার পারমিতার কবিতাই ভালো লাগতো। তাই যাদের আমি বুঝে ফেলি বলে ভাবি তাদের আদৌ বুঝেছি কিনা এই বোঝার জ্ঞান টুকুও আমার সব সময় থাকে না। এই যেমন মোবাইলে রুহানের মেসেজ টা পাবার পর কোন কিছু না ভেবেই কেনই যে বেরিয়ে পড়েছিলাম রুহানের খোঁজে তা নিজেও জানি না। তখন সকাল আটটা। ঘুম পেরিয়ে পাহাড়ের এক অনামি ভিউ পয়েন্ট ছাড়িয়ে পাহাড়ের কেন্দ্রে ঢোকার আগে জ্যামে পড়ে আটকে আছি প্রায় তিন ঘন্টা। এখন বেলা একটা প্রায়। প্রায় তিন কিলোমিটারের ওপর জ্যাম। রাস্তার দোকান থেকে শুনলাম এগুলো নাকি সিজিনাল ভিড়। অবাক হয়ে দেখছি, দেখছি যে পাহাড়ে নাকি বাতাসের বিষ কয়েকদিন আগেও সমতলের বিষের থেকে প্রায় কুড়ি গুন বেশি ছিল, সেখানে এত গাড়ির পারমিশন কিভাবে দেয় প্রশাসন। বেশির ভাগ গাড়িরই পলুশন সার্টিফিকেট প্রায় নেই বললেই চলে। তার মাঝেই শুনলাম নতুন রাস্তা হচ্ছে পাহাড় চিরে। এশিয়ান হাইওয়ের মত। রাস্তার ধারের থরে থরে বহু পুরানো পাইন সারি নতুন রাস্তার অপেক্ষায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামির মত দাঁড়িয়ে। 

    জ্যাম সামান্য ক্লিয়ার হল মনে হয়। এগিয়ে চলছি খুবই কম গতিতে। আধঘন্টা পর শুনলাম আবার জ্যাম। পর্যটক বোঝাই গাড়ি খাদে পড়েছে। পর্যটকদের উদ্ধার করা গেলেও ড্রাইভার নাকি স্পট ডেড। এসব মাঝে মাঝেই হয় পাহাড়ে। নতুন কিছু নয়। বর্ষার শুরুতে ফেটে যাওয়া পাহাড়ের মাটিতে জল জমে প্রেসার দেয় মাটিকে। তাই ধ্বস নামে খুব। আগে যখন গাছ বেশি ছিল তখন গাছের শিকড় আটকে রাখতো এই ভূমিধ্বস। এখন উন্নয়নের যজ্ঞে এই সব কো ল্যাটারাল ড্যামেজ এড়িয়ে চলতেই হয়। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে সব অট্টালিকার নীচেই প্রচুর মেহনতি মানুষের লাশ বিছানো থাকে। থাক ওসব।
    অবশেষে ধ্বস সরিয়ে জ্যাম ক্লিয়ার। এগোলাম খানিক। ফোনটা বাজলো আবার। রুহানের ফোন।

    রুহানের বদলে অন্য গলা,বললো ট্রাফিক গার্ড, 
    -' তপাইকো ফোন মা অন্তিম কল, কে তিমি উসলাই চিহ্নও'...
    ( আপনার ফোনেই শেষ ফোন করেছিল, চেনেন এনাকে )
    গলা কাঁপলো একটু
    - 'উ মারেকো ছ '
    (উনি মারা গেছেন )।

    পুলিশের দেওয়া ছবিগুলো দেখছি এখনো।রুহানকে চার ঘণ্টা পর উদ্ধার করতে পেরেছিল ওরা। মাটির মধ্যে মুখ গুঁজে শ্বাসকষ্টেই শেষ।
    ন্যাচারাল।
    আমিই শুধু বোকা। খুব বোকা। এখনো মেলাতে পারছি না এত বৃষ্টিতে মাটি সরে গেল না কেন ওর মুখ থেকে। পাহাড়ি মাটি তো ভঙ্গুর বড্ড। কিংবা ওর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা শরীরটার চারপাশে এত পলিথিনের স্তুপ কেন ? পাহাড়ের মাটির সাথে এত প্লাস্টিক মিশে কেন ?
    উত্তর খুঁজছি এখনো। খুঁজছি রুহান কার মার্ডার দেখাতে চেয়েছিল। পাহাড়ের না নিজের ?
    পাঠক খুঁজুক উত্তর। আমি আপাতত শুধু থ্রিলার লিখতে চেয়েছিলাম। আর উইকিপিডিয়া বলে ভালো থ্রিলার মানে প্লট গুলো একটা নিরবচ্ছিন্ন ঢঙে সাজিয়ে নিলে কিছুটা কন্সপিরেসি, কিছুটা ফিকশন, কিছুটা উপায়হীনতা সাথে বীভৎসতা আর মিস্ট্রি কে চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে শেষমেষ চরিত্রকে ভিলেন করে ভিকটিম কে খুন আর দুর্ঘটনার মাঝে এনে ফেলে অক্ষর শেষ করতে পারলেই বেস্ট সেলার হবার চান্স একশ ভাগ।

    ******** সমাপ্ত ********            

    #মাধুকরি কলম বাজে প্রকাশিত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন