এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্বপ্নদ্বিত্বা

    Faruq Ahmed লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ জুন ২০২২ | ৫৭৬ বার পঠিত
  • আমি আরিফুল ইসলাম আরিফ। দিন দশেক হলো ডিবি লটারি জিতে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসলাম। আসলে আমেরিকার প্রতি সবারই একটা ফ্যাসিন্যাশন কাজ করে আমার মনে হয়। সেক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান বলতেই হবে।  আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য। অবশেষে আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। ঈনশা-আল্লাহ। আমার বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, সুন্দরী বউ হবে, সংসার হবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, আব্বা-আম্মার কষ্ট লাঘব হবে, আব্বা-আম্মাকে হজ্জ করাবো ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কতকিছু ভাবছিলাম উৎফুল্ল মনে সারাদিন কাজ করে বাসায় ফেরার পথে গাড়িতে বসে। আমার বাসা কর্মস্থল থেকে নাতিদীর্ঘ নিউইয়র্ক শহরেই। প্রতিদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে জানালার পাশে বসে ভি. জি. প্রকাশ কুমারের 'life is beautiful ' ও বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ইন্দ্রানী সেনের গাওয়া 'চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে' গান শুনতে শুনতে পাশের লেকের পানির উপর চাঁদের আলো উপভোগ করতে করতে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যাই । এইভাবে ভালোই কেটে যাচ্ছে আমার প্রবাস জীবন । 

    মাসখানিকের মধ্যেই আনিস,মুনিম, রাতুল নামে নিজ দেশের বেশ ক'জনের সাথে পরিচিত হলো আমার। তাদের মধ্যে রাতুল ও মুনিম স্কলারশিপ নিয়ে হাইয়ার স্টাডিজ-এর জন্য এসেছে আমেরিকাতে আর আনিস আমার মত ডিবি লটারি তে। বাই দ্যা ওয়ে সময়ের পরিক্রমায় আমরা ভাল বন্ধু ও হয়ে গেলাম। সময় পেলেই আমরা  এক সাথে গান গাই, আড্ডা দেই, মজা মাস্তি করি। প্রবাস বলে কথা, কাছের মানুষ ও আত্মীয় বলতে তারাই। খুবই প্রানবন্ত সবাই।

    একদিন উইকেন্ডে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা সমুদ্রে( সী বীচে) যাবো সমুদ্রস্নানের জন্য। নিউইয়র্কের ব্রুকলেইনে কোনিই আইল্যান্ড বীচ নামে একটি বিখ্যাত বীচ আছে। যেই কথা সেই কাজ। আমাদের বন্ধু রাতুল বেশ কয়েকদিন আগে একটি নতুন এলিয়েন গাড়ী কিনেছে। আমিও  মাস দু'য়েকের মধ্যে একটি কেনার চিন্তা-ভাবনা করছি। যাইহোক, আমরা যাত্রা শুরু করলাম সকাল দশটায়। গন্তব্য অবশ্য বেশি দূরে নয়, দু'শত কি.মি.মাত্র। ঘন্টা দুই লাগতে পারে। শ্রদ্ধেয় লাকী আখান্দের ' চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে' গানের ছন্দে গাড়ী চলছে তার আপন বেগে। ড্রাইভ করছে রাতুল নিজেই। সে খুবই ভাল গাড়ি চালায়। এক্কেবারে পাক্কা ড্রাইভার যাকে বলে। আর আমরা মজা করছি ও রাস্তার দু'পাশের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি। অবশেষে আমাদের গন্তব্যে ঠিকঠাক পৌঁছালাম এবং হালকা নাস্তা করে নেমে গেলাম সমুদ্রে। 

    বলা হয়ে থাকে বেদনার রং নীল আর সেই সাথে সমুদ্রের পানিও নীল। তাই প্লাসে প্লাসে প্লাস হওয়ার মত সবকিছু থাকার পরও প্রবাসে থাকার যে একটা একাকিত্ব বা পরিবারের সবাইকে কাছে না পাওয়ার যে একটা খারাপ লাগা বা কাজ করতে করতে যে একটা ক্লান্তি, এইসব কিছুই যেন সমুদ্রের পানিতে নিমেষেই বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে হলো আমার কাছে। সাথে চমৎকার কিছু মানুষের সংঘ, আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!

    যাইহোক দীর্ঘক্ষণ হৈ-হুল্লোর করে সবাই উঠে গেলাম তীরে। ফ্রেশ হয়ে আমার বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাই গাড়িতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরই মুখে ভেজা কিছু একটা অনুভব করলাম এবং কানে হালকা হালকা শুনতে পেলাম, আরিফ ঘুম থেকে ওঠ, ওঠ, তোর অফিসের সময় চলে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠে চোখ কচলাইতে কচলাইতে অবলোকন করলাম ফার্মগেটের তেজকুনি পাড়ায় আমি আর আমার বন্ধু অয়ন যেখানে থাকি সেই বাসায় বসে আছি। কিছুক্ষণ আবাক হয়ে......। 

    আমি ডান হাত দিয়ে নিজের মাথা ঠুকে মুচকি হেসে ফিসফিস করে নিজেকেই বললাম, "ধুর! স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ? এইডা কিছু হইলো?"
    পরক্ষণেই আলতো করে মাথাটা ঘুরিয়ে পাশের দেয়ালে ঘড়িতে চোখ পড়তেই চক্ষু চরকগাছ আমার! কারণ ইতোমধ্যে নয়টা ত্রিরিশ মিনিট ঘড়িতে। অফিস টাইম দশটা। ঠিক সময়ে অফিসে না যেতে পারলে বস বারোটা বাজাবে।(অবশ্য প্রতিদিনই বাজায়!) আর এইদিকে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। ঠিক ন'টায় বাসা থেকে বের হলেও কোনদিন দশটা পাঁচ/ দশ মিনিটের আগে অফিসে পৌঁছাতে পারি না আমি।

    যাইহোক কোনরকম ফ্রেশ হয়ে রাস্তার সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অফিসে যেতে এগারো টা বাজলো। এক ঘন্টা দেরি। (বলে রাখা ভাল যে আমি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি প্রায় ছয় মাস ধরে এ. জি. এম. পদে হ্যান্ডসাম সেলারিতে।)

    প্রতিদিনের ন্যায় আজকে একটু বেশিই বসের রক্তচক্ষুকে হজম করতে হলো আমাকে (অবশ্য আমি এখনও স্বপ্নের কথাই চিন্তা করছি!)। অবশ্য এইসবকে বেশি পাত্তা না দিয়ে চিল মুডে থাকতেই বেশি পছন্দ আমার। কি আছে জীবনে  টাইপ আরকি। তাইতো প্রায় প্রতি উইকেন্ডেই বন্ধু অয়ন কে নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে যাই আমি। এছাড়া আরও কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে আমার যাদের সাথে সময় পেলেই আড্ডায় মেতে ওঠি। এইভাবেই কাটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পাস করা আমার কর্পোরেট জীবন। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন থাকে এবং প্রতিমাসে তাদেরকে মোটা অংকের টাকাও পাঠাতে হয় এবং পাঠাই ও বটে সংসারের খরচের জন্য।

    এরই মধ্যে মার্চ মাসের দুই তারিখ আমাদের তিন দিনের বার্ষিক অফিসিয়াল টুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং স্থান হিসেবে কোম্পানির এমডি স্যার কক্সবাজারকেই প্রেফার করেন। ত্রিশ সদস্যের একটি টিম যাচ্ছি আমরা ভ্রমণে। ঔদিন অর্ধ দিবস অফিসের পরই সবাই যার যার মত করে প্রিপারেশন নিয়ে সময় মত সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ডে চলে আসলাম। আমরা ঠিক রাত দশটায় রওয়ানা হলাম। বাস মেঘনা ব্রিজ ক্রস করতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো  সাথে বাসে ল ভলিয়মে হিন্দি গান ' বহুত পেয়ার করতিহে তুমকু সানাম' বাজছে। আহা! সেই কেমিস্ট্রি। এইভাবে বৃষ্টি আর গান উপভোগ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পেলাম না আমি।

    "নবাবের ফুতের(ছেলের) এহনও ঘুম অয়ছে না বেলা দুফুর(দুপুর) অইয়া গেছেগা। মাইনষের ফুতেরা বালা রেজাল্ লইয়া আইয়ে(ইন্টারমেডিয়েট)  ফাশ(পাস) কইরা ঢাহা শহর গিয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফইরা(পড়ে) বালা বালা ছারকি করে। আর নবাবের ফুতে আইয়ে ফাশ কইরা দুনিয়া উল্ডাই লাইছে, সারাদিন রাইত পইরা পইরা ঘুমায় খালি। ক্ষেতে যাইয়া বাফের(বাপের) লগে ইট্টু(একটু) কাম করলেও তো বাফের ইট্টু আছান অয়। সারাডা রাইত মেঘে-তুফানে ক্ষেতের ধানের যে কি অইছে আল্লায়ানা জানে"

    উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটকের স্বগতোক্তির মত আমার মায়ের এই কথাগুলো আস্তে আস্তে শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিজ গ্রামে টিনের তৈরি কাচা ঘরের চৌকির উপর! হুমহ!

    এইটাই আসল আমি। আসলে সেই শুরু থেকে এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।

    এখন আমি আনমনে ভাবছি আর বিড়বিড় করছি, "এইভাবেও স্বপ্ন দেখা যায়? একের পর এক-উফহ! 'স্বপ্নদ্বিত্বা' নাকি! আর এগুলো কি স্বপ্নই থেকে যাবে আমার!! কখনোই কি বাস্তব হবে না?"

    পুনশ্চঃ আরিফের এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হইছে কিনা জানি না। তবে স্বপ্ন দেখতে নাই মানা।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 2401:4900:1f2b:677e:6424:155e:8c75:1a16 | ০৩ জুন ২০২২ ২২:৩২508445
  • ইনসেপশান? 
  • Faruq Ahmed | ০৩ জুন ২০২২ ২৩:১৪508462
  • জী
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন