এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চৌর্যবৃত্তির স্বদেশ ও বিদেশ - ১

    Suparna Sanyal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ মার্চ ২০২২ | ৬৬৬ বার পঠিত
  • চৌর্যবৃত্তির স্বদেশ ও বিদেশ - ১
    মাঘের মধ্যরাত। সারা কলকাতা লেপ-কাঁথার ওমে নিদ্রামগ্ন। সৌদামিনী গভীর ঘুমের মধ্যেই যেন একবার ক্ষীণ বাসনের শব্দ পাইলেন। বিড়াল অথবা ছুঁচো হইবে – ইহা ভাবিয়া উহাকে অগ্রাহ্য করিয়া তিনি পাশ ফিরিয়া শুইলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই ফের শব্দ হইল। এইবার তাঁহার বোধ হইল যে ইহা তো একতলার কলতলায় এঁটো বাসন বা হাঁড়ী-কড়ার শব্দ নহে, পিতলের বাসনের শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে স্মরণে আসিল যে সংক্রান্তির পুজার জন্য পিতল, তামা ও রূপার বাসনাদি পুবের ছোট ঘরে বের করিয়া রাখা হইয়াছে। অনতিবিলিম্বে কার চাপা, সতর্ক অথচ দ্রুত পদক্ষেপ ঘরের সন্মুখবর্তি বারান্দায় শ্রুতিগোচর হইল। সৌদামিনীর আর বুঝিতে বাকি রহিল না। কোনমতে খাট থেকে নামিয়া দরজা খুলিয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াইলেন। প্রথমে কিছুই ঠাহর হইল না। পরক্ষনেই অন্ধকারে চোখ সহিয়া গেলে দেখিলেন যে পশ্চিমে পগাড়ের গলির দিকের ছাদের দরজা খোলা। চরম উত্তেজনায় সৌদামিনীর পা কাঁপিতে  লাগিল। আবিবাহিত দেবর ও চাকরের নাম করে তিনি উচ্চস্বরে ডাকিয়া উঠিলেন – ও শ্যামল, ওরে বনমালি, চো--র, চোর এসেছে। ওরে চোরে সব পুজোর বাসন চুরি করে নিয়ে গেল। শ্যামলের ঘরে আলো জ্বলিয়া উঠিল, তথাপি সৌদামিনী তাহার অপেক্ষা না করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পশ্চিমের ছাদের দিকে ধাবমান হইলেন। তাঁহার স্থুলদেহ, অবিন্যস্ত শাড়ী –  সব মিলিয়ে ছাদের উঁচু চৌকাটে পা বাধিয়া, বাবাগো মাগো আর্তচিৎকার সহ ভূপতিত হইলেন! চোর বাবাজি শীর্ণকায়, বাসনের গোছা ছাদের কার্নিশে নামাইয়া সবে মাত্র দুইভাগ করিয়া থলিতে পুরিবার উপক্রম করিতেছিল। সৌদামিনীর পতনের শব্দে সে চমকাইয়া উঠিল। অতঃপর পুরুষ কণ্ঠের শব্দ পাইয়া আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করিয়া সে একটি বাসনের গোছা ফেলিয়া রাখিয়াই লাফিয়ে পাশের বাড়ির ছাদে অপসৃত হইল। উত্তর কলিকাতার গৃহ সমুদয় এমনভাবে গ্রন্থিত যে এক ছাদ হইতে অন্য ছাদে পলায়ন মোটেই দুরূহ নহে। বৌঠাকুরুনকে সামলাইয়া যতক্ষণে শ্যামল ছাদে উপস্থিত হইল ততক্ষনে চোর মহাশয়ের টিকির দেখাও মিলিল না। কেবল বেশ কিছু বাসন বাঁচিয়া গিয়াছে এই আনন্দেই সৌদামিনী পাঁচ টাকার পূজা বেশী চড়াইলেন। পশ্চিমের ছাদের দরজায় তালা পড়িল। বনমালি যথা সময়ে উঠিতে পারে নাই বলিয়া তাহার চাকুরী যাইবার উপক্রম হইল। রাতে পাহারাদারী তাহার কাজ নয় এই যুক্তিতে চাকুরী বাঁচাইতে পারিলেও বনমালী হইতে কুম্ভকর্ণ নামে তার পদোন্নতি হইল।
    সৌদামিনী আমার পিতার দূর সম্পর্কিত পিসি। ফলে উক্ত ঘটনার আনুমানিক সময়কাল আনুমানিক এক শতক পূর্বে।
    ----------------------------------------------
    বছর পনেরো আগের ঘটনা। আমরা সপরিবারে এক মাস কলকাতায়  ছুটি কাটিয়ে সবে সুইডেনের উপসালায় বাড়ির পথে। আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামা মাত্রই চোখে পড়ল যে বাড়ীর সামনে সাইকেলের স্ট্যান্ডে আমার কর্তা আর ছেলের দুটো সাইকেলই নেই। মাথায় তো বাজ পড়ল। দেশে ঘুরে আসার সব আনন্দ মাটি। দুটোতেই তো জবরদস্ত তালা লাগানো ছিল। কিন্তু তার কোন চিহ্নমাত্র চোখে পড়ল না। বুঝতে বাকি রইল না যে কেউ নিপুন হাতে শিকল কেটে  কর্ম সেরেছে। প্রথামত পুলিসকে জানানো হোল, কিন্তু তারা বিশেষ আমল দিল না।
    পরের দিন রোববার, আমরা কর্তা-গিন্নি পায়ে হেঁটে বাজারের দিকে রওনা দিলাম। একথা সেকথা বললে কি হবে, মন পড়ে রয়েছে সেই সাইকেলের দিকে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই সাইকেল। লাল, কালো, সাদা, সবুজ... নিশব্দ বাহনেরা সারি দিয়ে দণ্ডায়মান। প্রসঙ্গত, উপসালায় ২ লাখ বাসিন্দা আর দেড় লাখ রেজিস্টার ভুক্ত সাইকেল!!! সবেমাত্র আমাদের বাড়ির চৌহিদ্দি পেরিয়ে পাশের বাড়ীর সামনে দিয়ে যাচ্ছি, একখানা কালো মজবুত সাইকেলে চোখ আটকে গেল। ঠিক যেন আমাদের বড় সাইকেলটা। আমি বল্লাম যে দেখেছো? ঠিক তোমারটার মতো। আসলে বিপ্লবের সাইকেলটা ছিল একটা ২১ গিয়ারের মাউন্টেন বাইক, ব্রান্ডটাও আন-কমোন। কিছুতেই কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সাইকেলটার দিকে। কাছে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! দেখতে শুধু  হুবহু আমাদেরটার মতো নয়, সবচেয়ে আশ্চর্য যে তালা দেওয়া নেই। নিচু হয়ে দেখি সিটের তলায় দামের স্টিকারটা অবধি আছে! উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ড মিনিটে ১০০ কি ২০০ বার দপদপ করতে লাগল। আমরা প্রায় নিশ্চিত যে সাইকেলটা আমাদেরই। চুরি করে এনে এখানে রেখেছে, কিন্তু সরানোর সময় পায়নি। এবারে চিন্তা যে আমরা এখন কি করব। এদিক ওদিক তাকিয়ে সাইকেলটার হাতল ধরে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। চোরের ওপর বাটপারি একেই বলে আর কি। কিন্তু ভীষণ ভয় হতে লাগল যে কেউ যদি দেখে ফেলে আর আমাদেরই চোর বলে ভাবে? কোনমতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সাইকেলটা টানতে টানতে সোজা চারতলায় আমাদের ফ্লাটের মধ্যে নিয়ে এলাম। কিন্তু ধুকপুকুনি আর কমে না। বাজার যাওয়া মাথায় উঠল। জানলা দিয়ে নীচে দেখতে লাগলাম যে কেউ আসছে কিনা। শেষে পুলিসকে ফোন করে জানানো হোল। তারা তো প্রশ্নবাণে আমাদের জর্জরিত করে দিল। অবশেষে মীমাংসা হল যে সাইকেলটা দশ দিনের মধ্যে কেউ ক্লেম না করলে আমরাই ওটার মালিক মেনে নেওয়া হবে। সেই দশ দিন যে কি উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছি বলে বোঝাতে পারব না।  সেটা চুরি যাওয়া সাইকেল পুনরুদ্ধারের জন্য নয়, বরং বিদেশে কর্মসূত্রে যেটুকু সন্মান অর্জন করেছি তা যেন চুরি না যায় সেই উৎকণ্ঠা!
    উপসালাতে সাইকেল চুরি প্রায় আর্ট বলে বিবেচ্চ্য হয় এবং শুধু হস্তশিল্প দেখানোর জন্যেই অনেকে সাইকেল চুরি করে। প্রতিবছর এখানের নদীবক্ষ থেকে প্রায় ৫০টি সাইকেল উদ্ধার করা হয় :)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন