এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ধারাবাহিক ভ্রমণ কথাঃ অচিনপুরের বালাই – ৫

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ জানুয়ারি ২০২২ | ৬০৪ বার পঠিত
  • লাজবন্তী মালতীমায়ের কাঁধে বাঁ হাত রেখে, মা যেমন সমবেদনায় মেয়ের ঘনিষ্ঠ হয় সেভাবেই, ডানহাতে মালতীমায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে, রে, কানছিস কেন?” মালতীমা লাজুক হেসে সব কথাই মনে হল বললেন, আমি শুনতে পেলাম না, কিন্তু লাজবন্তী মাঝেমাঝেই আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিলেন, তার থেকেই বুঝতে পারলাম, আমার কথার পিঠে যা সব কথা হয়েছে, সে সবই রিপোর্ট হল লাজবন্তীর কাছে। কথা শেষ হতে লাজবন্তী হেসে মালতীমাকে বললেন, “অনেক বেলা হল, দোকান তুলে বাড়ি যা। বিকেলে আবার দোকান খুলবি...যা দেরি করিস না”।

    মালতীমায়ের বাড়ি যাওয়ার কথায় আমার হুঁশ হল, ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে পার্স বের করতে করতে বললাম, “আমাদের চায়ের দাম কত হল দিদি? ওই সঙ্গে দুপ্যাকেট সিগারেট দেবেন। আর এই ছেলে মেয়েদের সকলের হাতে দুটো করে ক্যান্ডি...ইয়ে মানে লজেন্স আর বিস্কুট দিন না। যা দাম হবে আমি দেব”।

    মালতীমা বললেন, “ওদের আবার ওসবে কী দরকার? ওরা তো সব এখন যার যার ঘরে যাবে ভাত খাবে”।

    “তা খাক। এতক্ষণ ধরে ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রইল, একদম শুকনো মুখে থাকবে? না না, আপনি দিন সব্বাইকে”।

    মালতীমা প্লাস্টিকের বয়াম খুলে সকলের হাতে লজেন্স দিলেন, প্যাকেট ছিঁড়ে বিস্কুট দিলেন। ওদের মধ্যে একটু যারা বড়ো, বিশেষ করে হাল্কা নীল আর গভীর নীলের মেঘ মেঘ ছাপা ফ্রক পরা মেয়েটি, সে লজ্জা পাচ্ছিল। বললাম, “স্কুলে যেতিস নিশ্চয়ই? স্কুল তো কতদিন হয়ে গেল বন্ধ। সারাটা দিন কী করিস? এই বাঁধের ধারে ঘুরে বেড়াস, আর বড়ো বড়ো লোকেদের কথাবার্তা শুনিস? পুরোনো বইখাতাগুলো আছে? সেগুলো উলটেপালটে দেখিস? নাকি সব ভুলে গেছিস”?

    মেয়েটি এবার লজেন্স বিস্কুট নিল, বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলল, “মালতীমাসি বলল না, বানে ঘরদোর সব ভেসে গেছিল? বই-খাতাই নাই, পড়বো কী”? “ওঃ” আমি এইটুকুই শুধু বলতে পারলাম। তারপর মালতীমার মুখের দিকে তাকালাম। মালতীমা হিসেব করে বললেন, কত টাকা হয়েছে। আমি টাকা মিটিয়ে দিয়ে লাজবন্তীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “চলুন দিদি, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। নানান কথায় দেরিও হয়ে গেল অনেক”।

    লাজবন্তী ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ, তারপর কোমরে হাত রেখে রীতিমতো জেরার সুরে বললেন, “আপনি নাকি গানও শুনিয়েচেন...আমার বালাইকে, মালতীকে...ঝড়ের রাতের গান”। একথার কী জবাব দেওয়া যায় আমার মাথায় এল না। অবিশ্যি আমার জবাবের অপেক্ষায় লাজবন্তী যে বসে থাকবেন তাও কখনো হয়? “আমি ঘরের কাজ সেরে সবে একটু হাত খালি করে এসেচি, একটু সুখদুখের কথা কব, ঘরে-পরিবারের সমাচার জানবো...তার আগেই বালাইকে গান অব্দি শোনানো হয়ে গেল”?

    মালতীমায়ের দোকান গোছানো হয়ে গিয়েছিল, ছেলেমেয়েরা সকলে মিলে দোকানদারি নিয়ে এগিয়ে গেল বাঁধের ঢাল বেয়ে গ্রামের দিকে। তাদের মুখে লজেন্স থাকায় সবারই একপাশের গাল টোপলা হয়ে আছে। এই বয়সে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা কত কীই খায়, কত বায়না আবদার...অথচ সামান্য এই লজেন্সেই এরা কত খুশি। একটি ন্যাংটাপুটো শিশু, সে চলেছে দিদির কোলে, নিজের মুখের থেকে বের করে দিদি ভাইয়ের জিভেও দু একবার ছুঁইয়ে দিচ্ছিল, লজেন্সের গুলিটা। ভাইকে পুরোটা দেয়নি, এক রত্তি ভাই - গলায় লাগিয়ে ফেললেই তো বিপত্তি! ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, আর লাজবন্তীর অভিযোগের কী জবাব দেব ভাবছিলাম।

    “গান কী বলছিস, লাজবন্তী? যে সে গান নয়, বাবুর যেমন গলা তেমনি ভাব”। বালাই আবার উস্কে দিল লাজবন্তীকে, “মালতীমা ওই যে বললে, দুর্যোগের রাতেই ভগমানের নিষ্ঠুর আসল রূপটি দেখা যায়, বাবুও অমনি নিজের মনে গান গেয়ে উঠলেন। পরাণসখা মানে তো ভগমানই, তাই না বাবু? ঝড়ের রাতে তিনিই আসেন অভিসারে – কত দূর দূরান্ত থেকে...তাই না?”

    লাজবন্তী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বালাইকে মুখঝামটা দিয়ে বললেন, “ঢের হয়েছে, এবার ঘরে চলো, নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলে চলবে?” বলেই তিনি ছেলেকে কোলে তুলে নেওয়ার মতো বালাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে, আমার দিকে ফিরে বললেন, “আসেন বাবু। আমাদের খাওয়ার যা ছিরি, জুড়িয়ে গেলে মুখে তুলবেন কী করে?”

    কথা না বাড়িয়ে আমি লাজবন্তীকে অনুসরণ করলাম। বাঁধের যে বাঁকের মুখে আমরা ছিলাম, সেদিক থেকে উত্তরের দিকে সোজা বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁধের ঢাল বেয়ে আমরা নেমে এলাম মাটিতে। তারপর পশ্চিমের মেঠোপথ ধরে কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল পরিচ্ছন্ন ছিমছাম একটা মন্দির, সেই মন্দির ঘিরেই কয়েকটা পলেস্তারাহীন ইঁটের ঘর – মাথায় টিনের ছাউনি।

    বালাই লাজবন্তীর ঘাড়ের পাশে মুখ তুলে বলল, “ওই ঝড়ের রাতে আমাদের এই বসতটুকুও চলে গেছিল সাগরের ঢেউয়ের তলায়। খড়ের চাল দেওয়া মাটির ঘর ছিল। সব ধুয়ে মুছে ভেসে একাকার। শিবের থান ওই মন্দিরটুকুই শুধু টিকে ছিল। আপনার পরাণসখা বোধ হয় শিবঠাকুরই হবেন, তাই নিজের থানটুকু আর ভাসিয়ে দেননি”।

    আমি আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সে সময় তোমরা কোথায় ছিলে? এখানেই”?

    “না, না বাবু। সরকারি বাবুরা তাই থাকতে দেন, নাকি? গাঁয়ের সব লোকদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, বড়ো রাস্তার ওধারের ইস্কুল বাড়িতে। প্রায় দিন দশেক আমাদের ঠিকানা হয়েছিল ওখানেই। সেও এক আজব কাণ্ড, বাবু। গাঁয়ের যারা দালান কোঠায় থাকা বড়ো মানুষ আবার আমাদের মতো হাভেতে হাঘরে ভিখিরির দল - সব্বাই ছিলাম একসঙ্গে। ইস্কুলের বড়ো বড়ো ঘরগুলোতে। সবাই একই খিচুড়ি খেয়েচি, বাবু, দুবেলা করে, পাশাপাশি মেঝেয় বসে...। আপনের পরাণসখার এক ধাক্কায় সক্কলে একই মেঝেয় নেমে এসেছিলাম - উঁচু-নিচু, জাত-বেজাত, ধনী-নিকড়ি সব্বাই”।

    টানা দাওয়ার পাশাপাশি বেশ কখানা ঘর, সে দাওয়ায় নিচু হয়ে লাজবন্তী বালাইকে নামালেন। এতখানি রাস্তা মানুষটাকে বয়ে আনতে তাঁর পরিশ্রম হয়েছে বেশ, নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। একটু দম নিয়ে লাজবন্তী কোমরে হাত রেখে বললেন, “সাবান গামছা নিয়ে কলতলায় গিয়ে নেয়ে আসবে আগে, তারপর অন্য কথা। বাবুকেও সঙ্গে নে যাও...”

    আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম, “না, না আমি চান করবো না, সকালে আমি চান করেই বেরিয়েছি”।

    লাজবন্তী বললেন, “তা হোক মুখে হাতে পায়ে একটু জল দেবেন না। নাহলে খেতে বসবেন কী করে?”

    ঠিক কথা। খাওয়া অনেক রকমের হয় – বাধ্যতামূলক ক্ষুণ্ণিবৃত্তি – স্টেসনে, বাসস্ট্যাণ্ডে আমরা অনেকসময় খিদে মেটানোর জন্যে যত্রতত্র খাওয়া শুরু করি, শেষ করি। কিন্তু এখানে তেমনটি চলবে না, হাত-পা মুখে চোখে জল দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, তারপর আসনে পরিপাটি বসে খাদ্যের মুখোমুখি হতে হবে। হোক না খুদকুঁড়ো, কিন্তু সেও তো অন্ন। আর অন্ন দিয়ে যিনি উদরকে পূর্ণ করান, তিনিই অন্নপূর্ণা। মলিন শরীরে অন্ন স্পর্শ করলে অন্নপূর্ণা অখুশি হবেন বৈকি!

    বালাইয়ের সঙ্গে আমি কলতলায় গেলাম, এ পাড়ায় এই একটিই টিউবওয়েল, চলতি কথায় যাকে বলে টেপাকল। বালাই কলের নিচে বসল, বলল, “বাবু কলটা ক’বার টিপেন দেখি, রুখা শরীলটারে পেথমে জুড়িয়ে নিই”। আমি টিপলাম, বার চারেক টেপার পরেই বালাই বলল, “আর না বাবু, এখন থাক”। কোমরে গামছা জড়িয়ে ময়লা পেন্টুলুনটা খুলে ফেলল অনেক কসরতে। আর তখনই আমি শিউরে উঠলাম আমার ভ্রান্ত ধারণায়। শুরুর থেকেই বালাইকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, ও হয়তো পোলিও বা রিকেট্‌স্‌ রোগী। ওর যা বয়েস ওর শৈশবে “দো বুঁদ”-এর এত ব্যাপক প্রচার বা প্রচলন হয়নি। কাজেই এ ধরনের মানুষের সচরাচর যেমন হয়ে থাকে তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম, দাবনার মাঝামাঝি থেকে বালাইয়ের দুটি পা-ই কাটা! ফুলপ্যান্টের বাড়তি দৈর্ঘের মোড়কে মুড়ে ও এমন ভাবে বসে থাকে এবং পশ্চাৎ ঘষটে চলে বেড়ায় - বোঝাই যায় না, তার এই অঙ্গহানির বীভৎসতা!

    বালাই তার গায়ের জামা আর প্যান্টে সাবান ঘষতে লাগল, আমি কলের মাথায় ভর দিয়ে ডুবে গেলাম ভাবনার মধ্যে। কী করে এমন হল? ও কি কারখানায় কাজ করত, কোন চালু মেশিনে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে? নাকি রাস্তাঘাটে গাড়ির তলায় চাপা পড়েছিল? জিগ্যেস করা উচিৎ হবে কী? হয়তো ও ভুলে থাকতেই চায়, আমি আবার খুঁচিয়ে সেই দুর্ভাগ্যের কথা ওকে মনে করিয়ে দিই কেন? কলের নিচে জামা-প্যান্ট থোবা দিয়ে কিছুক্ষণ কাচার পর, একই সাবান সে সারা গায়ে মাখল, মুখে মাথায়, সাদা ফেনায় মুড়ে তাকে এখন ভূতের মতো দেখাচ্ছে। সাবানের ফেনায় তার চোখও এখন বন্ধ, হাতড়ে হাতড়ে আবার সরে এল কলের মুখের নিচে। তারপর বলল, “বাবু, ও বাবু, কলটা টেপেন দেকি”। আমার ভাবনায় আমি এতটাই ডুবেছিলাম প্রথমে আমি বালাইয়ের ডাক শুনতেই পাইনি।

    বালাই দু হাতে চোখের থেকে ফেনা সরিয়ে, চোখ কুঁচকে বলল, “কী ভাবছেন, বাবু? ও বাবু, কলটা টেপেন না”! আমি সম্বিৎ পেয়ে কল টিপতে লাগলাম ধীরে ধীরে। প্রথমে সে নিজে চান করল। তারপর জামাকাপড় কাচতে কাচতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার পা দুখানির কথাই ভাবছেন, তাই না বাবু?” আশ্চর্য এই কথার মধ্যেও ওর মুখের হাসি এতটুকু মলিন হয়নি।

    জামা কাপড় কাচতে কাচতে সে বলতে লাগল, “ছোকরা বয়সে বেশ ডাকাবুকো ছিলাম, জানেন বাবু। গা-গতরে ক্ষেমতাও ছিল খুব। বিঘে দুয়েক জমি ছিল, নিজেই চাষবাস করতাম। অবসরে অন্য লোকের জমিতেও মুনিষের কাজ করতাম। থা আমাদের এখানে ফি বছরই ঝড়ের তাণ্ডব কামড় মারে, সেকথা তো শুনলেন মালতীমায়ের কাছে। আজ থেকে তা ধরুন চল্লিশ বছর আগে, আমার বয়েস তখন কত আর, আঠেরো, উনিশ হবে। সে সময় ঝড়ের খবর আজকের দিনের মতো আগাম জানা যেত না। আর সরকারি ব্যবস্থাও যা ছিল সে না থাকাই। ওইসব দিনে পেত্যেকবার আমরাই লড়তাম বাবু, গায়ের সব লোকজন মিলে। ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেই ভাঙা বাঁধ মেরামত করার কাজে লাগতাম। গ্রামে জল ঢুকে পড়লে ছেলেমেয়েদের বুড়োবুড়িদের নিয়ে কলাগাছের ভেলায় করে বড়ো রাস্তায়, ইস্কুলবাড়িতে পৌঁছে দিতাম। তখনকার ইস্কুলবাড়িগুলোও হত ছোট ছোট কামরার একতলা বাড়ি – সকলের সংকুলান হত কই?”।

    “আরেক বার টেপেন বাবু, আপনারে বেজায় কষ্ট দিচ্ছি বটে, কিন্তু বিশ্বাস করেন এতটুকু সংকোচ হচ্ছে না আপনারে হুকুম করতে”। হাসতে হাসতে বলল বালাই। আমি আবার কল টেপা শুরু করতে, সে আবার শুরু করল, “ঘন অন্ধকারে, ঝড়ে জলে কাদায় পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিলাম বাবু, গ্রামের বাড়ি বাড়ি... কেউ আটকে রইল কিনা, চেনা লোকেদের নাম ধরে চেঁচাচ্ছি আর দৌড়ে বেড়াচ্ছি এ ঘর সে ঘর। হঠাৎ কী যে হল, আমার ওপরেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল টিনের চালদেওয়া একটা ঘরের মাটির দেওয়াল। অন্ধকারের মধ্যেও যেটুকু ঠাহর করতে পাচ্ছিলাম, সেও গেল ঘুঁচে”। বালাইয়ের জামা প্যান্ট কাচা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো নিংড়ে জল ঝরিয়ে, নিজের কাঁধে রাখল, তারপর বলল, “চলেন বাবু”। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে, বালাইয়ের হাল্কা শীর্ণ শরীরটা লাজবন্তীর মতোই বুকে তুলে ধরলাম, বালাই বলে উঠল, “এ কী করেন বাবু, আমার ভেজা গায়ের জলে আপনার জামা-প্যান্ট নোংরা হয়ে যাবে যে...ছি ছি, লাজবন্তী দেখলে আমাকে খুব...”

    “তুমি সেই ভয়ংকর রাত্রের কথা বলো বালাই, আমরা যারা শহরে থাকি তাদেরকেও টের পেতে দাও তোমাদের জীবন যুদ্ধের বীভৎসতা”, আমি বালাইকে নিয়ে ফিরে চললাম ওদের বাসার দিকে।

    বালাই হাসল, বলল, “পেথম দেখাতেই আমি আপনারে চিনতে ভুল করিনি বাবু, ঠিক কিনা বলেন?” তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সে রাত্তিরের তারপরের কথা তো আমার মনে নাই বাবু। যখন আবার চোখ মেলে তাকালাম, আমি তখন হাসপাতালে, লাজবন্তী শুকনো মুখে বসে আছে আমার বিছানার পাশে। শুনেছি ওই দেওয়ালের তলায় চাপা পড়ে আমি নাকি সারারাত ওখানেই ছিলাম। বেলার দিকে ঝড় বৃষ্টি থামতে একটা দল গ্রামে এসে আমার গোঙানির আওয়াজ শুনে, আমায় বের করেছিল। তাদের সঙ্গে ছিল লাজবন্তী। লাজবন্তী নাকি সারারাত পাগলের মতো আমাকে খুঁজে বেরিয়েছিল – ইস্কুলবাড়িতে আর বড়ো রাস্তার ওপরে – যেখানে যেখানে গ্রামের লোকেরা আশ্রয় নিয়েছিল। পরের দিন সকালে যে দলটি আমায় উদ্ধার করতে এসেছিল – সে ওরই জোরাজুরিতে”।

    “তোমাদের কী তখনই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

    বালাই হাসল, “বিয়ে তো আমাদের কোনদিনই হয় নাই, বাবু। কে দিবে আমাদের বিয়ে? আমি তো ছোটবেলাতেই বাপ-মা মরা। লাজবন্তীর বাবা-মা-দাদা সবই ছিল। কিন্তু হাসপাতালে আমার থ্যাঁতলানো পা দুটো বাদ যাওয়ার পর, ওর বাপ-মা আমার সঙ্গছাড়া করতে অনেক চেষ্টা করেছিল। আমিও অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু লাজবন্তী বড্ডো অবুঝ বাবু, সব্বাইকে ও ছাড়ল, ছাড়ল না আমাকে...”।

    এই দুই চরিত্রকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি, পরিচয়ের শুরুতে আমার বাঁধা গতের চিন্তায় যা মনে হয়েছিল, তার কিছুই মিলছে না...কী আশ্চর্য বাঁধন দুজনার।

    আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে, এই জীবনে কী করে চলে এলে? তোমার তো বিঘে দুয়েক জমি ছিল বললে?”

    বালাই বেশ জোরে হেসে উঠল, তারপর বলল, “মানুষরে আপনি তেমন চেনেননি, বাবু। আমার সেরে উঠতে উঠতে সাত-আটমাস পার হয়ে গেল বাবু, ততদিনে আমার জমি আর তখন কোথায়? গ্রামের লোকেরাই সে সব আপন করে নিয়েছে। গ্রামে ফিরতে আমাকে বললে, এ জমি নিয়ে তুই কী করবি, চাষ করতে তো পারবি না? জমিন নাকি মা লক্ষ্মী – অনাবাদী রাখতে নেই! আমার বা লাজবন্তীরও সে নিয়ে বিবাদে যাওয়ার দুর্মতি হয়নি। সব হারিয়ে ভিখারিই হলাম, বাবু, তবে ভিক্ষে করি ভগমানের নামে। ছোটবেলা থেকেই আমার যাত্রা-পালা, গানটানের দিকে ঝোঁক ছিল, লাজবন্তীর সঙ্গে আমার ভাবও সেই কারণেই। পঞ্চায়েত থেকে গ্রামের বাইরে একখান থাকার ঘর দিল, সেখানেই আমাদের বাসা হল, কপালে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে লাজবন্তী আমার বউ হল। ব্যস, তারপর থেকে জীবন চলছে এ ভাবেই। এই গ্রামের মায়া ছাড়তে পারিনা, তাই ফিরে ফিরে আসি – আর সারা বছর ঘুরে বেড়াই নানান মেলায় – জয়দেব, ঘোষপাড়া, বোলপুর, এক্তেশ্বর, জল্পেশ...”। কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, বালাই বলল, “লাজবন্তীর সামনে এ সব কথা তুলবেন না, বাবু। মন খারাপ করে খুব”।

    “তোমার করে না?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

    বালাই হেসে বলল, “নাঃ, বিশ্বাস করেন, বাবু একটুও না। যদি দুই পা আজ থাকত, এই গ্রামেই আমি পড়ে থাকতাম, জমিজিরেত নিয়ে পাড়াপড়শিদের সঙ্গে আকচাআকচিতেই আমার দিন কাটত। এখন দেখেন আমার পা নাই, কিন্তু কত দেশ দেখছি, কত গ্রাম দেখছি, কত লোক দেখছি। আমার যদি পা থাকত, আপনি আজ আমাকে এমন করে বুকে ধরতেন বাবু, বলেন না, বুকে তুলতেন এমন করে?”

    আমি বালাইকে যখন দাওয়ায় বসিয়ে দিলাম, ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন লাজবন্তী। অবাক হয়ে আমার দুই চোখের দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, কিছু বললেন না, তাঁর দুই চোখ ভরে উঠল জলে। বালাইও মিচকে হাসি মাখা চোখে তাকিয়ে রইল লাজবন্তীর দিকে – বলল, “এ বাবুকে কিছুটা কী বুঝলি, লাজবন্তী?”

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন