এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জ্যোতিবাবুর জয়-পরাজয়

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • জ্যোতিবাবুর জয়-পরাজয়
    প্রবুদ্ধ বাগচী

    সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর (১৯৫২) বরানগর সিঁথির মোড়ের সার্কাস ময়দানে এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন ওই বিধানসভা কেন্দ্রের সদ্য নির্বাচিত তরুণ কমিউনিস্ট বিধায়ক। নানা কথার সূত্রে তিনি বললেন, ইতিমধ্যেই দলে প্রচুর অবাঞ্ছিত সদস্য ঢুকেছেন, এদের কাজকর্ম বিষয়ে আমাদের পার্টি নেতৃত্বকে সজাগ থাকতে হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই প্রথম সাধারণ নির্বাচনেও সমস্ত দলের পক্ষেই ফলস ভোট পড়েছিল। এই জনসভার পনেরো বছর পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট পশ্চিমবাংলায় প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পাবে। আর, তার চার বছর আগে (১৯৪৮) নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির এই তরুণ সংগঠক নেতাকে প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকতে হবে বেশ কিছুকাল। এই ঘটনার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) র পরিচালনাধীন বামফ্রন্ট সরকার যখন সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা করার জন্য মরিয়া ও সরকারিভাবে মারমুখী --- গাড়ি কারখানার সর্বোচ্চ কর্তা যখন কারখানার জমি দেখতে গিয়ে স্থানীয় কৃষকদের বিক্ষোভে কোণঠাসা --- তখন সেই একই নেতা, অশীতিপর, হৃত বল, তাঁর উত্তর প্রজন্মের নেতৃত্বের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমাদের কৃষকসভার লোকেরা কী করছিল? এই তিনটি ঘটনারই নায়ক একজন। জ্যোতি বসু। যাকে কোনোদিন কেউ জ্যোতিদা বলার স্পর্ধা রাখেনি তাঁর নিজের দলেরই কোনও কমরেড! বরং আপামর সকলের কাছেই তিনি জ্যোতিবাবু। বাঙালিবাবু বলতে গড়পড়তা যে চেহারাটা কিছুদিন আগেও আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক অ্যালবামে খোদিত ছিল --- এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তা খাপে খাপে মানানসই। ধুতি-পাঞ্জাবি, পাম্প শু, মাথায় পেতে আঁচড়ানো স্বল্প চুল, মিতবাক, ব্যক্তিত্বের ছটার সঙ্গে রুচিশীল আভিজাত্য, ভরাট কণ্ঠস্বর আর যা যা প্রয়োজন সবই। নীরদ সি চৌধুরী একবার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় বলেছিলেন, নিশিকান্তর ব্যাটা আবার কমিউনিস্ট হল কবে থেকে (নিশিকান্ত অর্থে নিশিকান্ত বসু, জ্যোতি বাবুর বাবা)? কিন্তু একথা ঠিক, গত শতকের বাঙালির রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাস লিখতে গেলে যেমন কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ রাখা সম্ভব নয়, তারই সূত্রে একদম অসম্ভব জ্যোতিবাবুকে সরিয়ে রাখা। শুধু অসম্ভব নয়, অনৈতিহাসিক। আমরা তাঁর রাজনীতির সমর্থক হই বা না হই, ইতিহাস বোধের সজাগ নিরপেক্ষতা অন্য ব্যাপার, যাতে স্থূলে ভুল থাকা উচিত নয়।

    গত শতকের সত্তরের দশকে আমাদের মতন যাঁদের বড় হয়ে ওঠা, তারা ছোট থেকে বড় হয়েছি জ্যোতি বসু নামক এক ব্যক্তির ছায়ায়। এই ‘ছায়ায়’ কথাটায় যেন কেউ না বোঝেন যে তাঁর দলের মতাদর্শ বা কর্মসূচির কুচকাওয়াজে আমার মতো কেউ কেউ পা মিলিয়েছি। শৈশব কৈশোরের সেই আলো আঁধারে, ঘরে বাইরে পরিবারে বড়দের আলোচনায় আমরা তখন দুটো নামের সঙ্গেই পরিচিত ছিলাম --- ইন্দিরা গান্ধী আর জ্যোতি বসু । একজন দেশের সর্বময় নেত্রী, অন্যজন তখনও রাজ্যের প্রধান হয়ে ওঠেন নি, হয়ে উঠবেন তার একটু পরেই। কিন্তু ছেলেবেলার স্মৃতিতে যে কংগ্রেস আর সিপিএমের আদল, সেখানে দল নয়, আসলে এই দুই ব্যক্তিরই এসে পড়া ছবি। মনে পড়বে, কলকাতা থেকে বিশ বাইশ কিলোমিটার দূরের সেই মফস্বল জনপদের দগ্ধ দুপুর --- মায়ের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার অবসরে এসে দাঁড়িয়েছি বাড়ির বাইরে সদর রাস্তায়। আমাদেরই বাড়ির দেওয়ালে চুনকাম করে লেখা হচ্ছে নির্বাচনী ইস্তাহার, শ্লোগান : ‘ইন্দিরার কালো হাত ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’! ওঁরা জ্যোতি বসুর দল। আবার ঠিক রাস্তার ওপারে আমাদের বাড়ির উল্টো দিকের বাড়ির পাঁচিলে জ্যোতি বসুর কার্টুনচিত্র, সঙ্গে ব্যঙ্গ ছড়া : শোনরে কৃষক, শোন রে সর্বহারা / তোদের ভিটেতে ঘু ঘু চরাবে কাস্তে হাতুড়ি তারা! মাঝখানে ফুট ছয়েকের গলি রাস্তা। রাজনীতির “র” এর ফুটকি টুকুও যখন বুঝি না, তখন কিন্তু এই চালচিত্রের মধ্যেই আমাদের রাজনীতির বর্ণপরিচয় শিখতে থাকা। আর সেই বর্ণপরিচয়ের প্রথম পাঠেই এই খর্বাকৃতি কমিউনিস্ট নেতার দীর্ঘ প্রতিচ্ছবি। মার্কসবাদ, শ্রেণি সংগ্রাম বা বুর্জোয়া পার্লামেন্ট কিংবা সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা জানার আগেই জ্যোতি বসুর সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের পরিচয় ও তার প্রলম্বিত রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি আমাদের আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যাওয়া।

    ২.

    একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে যেহেতু জ্যোতি বসু ও সিপিআইএম দল একেবারে অভিন্ন সত্ত্বা নিয়েই আমার কাছে হাজির হয়েছিল তার প্রাথমিক অভিঘাত, অন্তত আমার কাছে একেবারেই তেতো। কারণ ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘট যেদিন শুরু হয়, সেইদিন রাত সাড়ে দশটায় আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতী, যারা সকলেই ছিল সিপিএম এর আশ্রিত ও মদতপুষ্ট। লক্ষ্য আমরা ছিলাম না। ছিলেন আমাদের বাড়িওয়ালা মাস্টারমশাই, যিনি ঘোষিতভাবে কংগ্রেস সমর্থক এবং সেই সময় ‘কংশাল’ নামক এক সংকর শ্রেণির রাজনৈতিক যুবকের আশ্রয়দাতা। কিন্তু তিনি থাকতেন দোতলায়, আমরা একতলায়। ফলে আক্রমণের ধাক্কাটা সহ্য করতে হয় আমাদের। সেই স্মৃতি বড় রক্তাক্ত, সেই অভিশপ্ত রাত আজও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে। অথচ আক্রমণকারীরা আমাদের শান্তিপ্রিয় পরিবারটিকে চিনত, আমরা কোনও দলীয় রাজনীতির বৃত্তে কখনও যুক্ত ছিলাম না, আজও নেই। তবু জ্যোতিবাবুর পার্টি আমাদের শোওয়ার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ধারালো বর্শা, যে জানলার সংলগ্ন বিছানায় পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। বর্শা এসে বিঁধে গিয়েছিল পাশ বালিশে, চেষ্টা করেছিল আমার সেদিনের ছোট্ট হৃদয়টাকে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেওয়ার। জ্যোতিবাবুর পার্টির লোকেরা আমাদের উঠোনে ছুড়েছিল বোমা, সোডার বোতল, কাচ, পাথর। বাড়ি ঘিরে ধরে চালিয়েছিল উন্মত্ত তান্ডব। প্রাণভয়ে ভীত আমরা সপরিবারে উঠে এসেছিলাম দোতলায় বাড়িওয়ালার আশ্রয়ে। তারও কিছু পর ওই বাড়ি ছেড়ে সাময়িক অন্য এক আত্মীয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল আমাদের। সেদিন জ্যোতিবাবুর ওপর আমার খুব রাগ আর অভিমান হয়েছিল। যেমন হয় বিধাতাপুরুষের ওপর। আপনি তো ঈশ্বর ছিলেন জ্যোতিবাবু! সেদিন আপনার দামাল ভক্তদের বারণ করতে পারেননি? আমি, আমার বাবা-মা-ভাই, আমার বৃদ্ধা ঠাকুমা কি আপনাদের শ্রেণিশত্রু ছিলাম?

    এর পরের পর্বে আমাদের স্কুলের সামনের বিরাট মাঠ যা জনসভার জন্য ছিল সেরা বাছাই, সেখানে দেখলাম এই বিধাতাপুরুষ জ্যোতি বসুকে। গট গট করে হেঁটে মঞ্চে উঠে যাওয়া, জলদ গম্ভীর ‘বন্ধুগণ’ সম্বোধনে উপস্থিত জনতার সামনে রাখা রাজনৈতিক ভাষণ, যার অধিকাংশ বাক্যই অসমাপ্ত --- কিন্তু জনগণের তার বার্তা বুঝে নিতে অসুবিধে নেই। ইংরাজি বর্ণমালার এক্স, ওয়াই, জেড তখনও প্রাইমারের গন্ডি ছাড়িয়ে নিরাপত্তার ক্যাটাগরিতে এসে পৌঁছায় নি, ফলে বেশ কাছ থেকেই দেখার সুযোগ ছিল প্রবাদপ্রতিম জননেতাকে। যদিও আমার এক পিসেমশায়, যিনি মনে প্রাণে কংগ্রেস অনুগত ছিলেন, তিনি আমাদের গল্প বলতেন ---- জ্যোতি বসুর সঙ্গে তিনি একবার রাইটার্সে দেখা করতে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে; জ্যোতিবাবু তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আপনি কার রেফারেন্সে এসেছেন? এই আচরণে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট সেই পিসেমশাই ছিলেন ঘোর জ্যোতি বসু-বিদ্বেষী। কিন্তু আরও নানা গল্পের মতো এও হয়তো আর একটা গল্প। যেমন বাবা প্রায়ই বলত, কমিউনিস্ট পার্টি দু-টুকরো হওয়ার সময় একদল নেতা প্রথমেই কোনও নির্দিষ্ট পক্ষে যোগ দেন নি, এদের বলা হত সেন্ট্রিস্ট বা মধ্যপন্থী। জ্যোতিবাবু ছিলেন এই দলে। পরে তিনি সিপিআই থেকে সিপিআইএম এ যোগ দেন। সেই ছেলেবেলাতেই বাবা বা তার মতন বড়রা কেউ কেউ আমাদের বলেছিল, জ্যোতি বসু কেন এত বড় নেতা জানিস? আমরা জানব কী করে? তাঁরা বলেছিলেন, আসলে কী জানিস, পার্টি ভাগ হওয়ার পরে ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, হীরেন মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখার্জী, সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখ বড় বড় নেতারা সবাই থেকে গেলেন সিপিআইতে, কিন্তু সিপিআইএমে প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার ছাড়া বাংলার আর কোনও বড় নেতা ছিলেন না, পরে এলেন জ্যোতিবাবু। ফলে তিনি খানিকটা ফাঁকা মাঠ পেয়ে যান, বলতে পারিস। এইসব গল্প বা বিশ্লেষণের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমরা কোনও প্রশ্ন তুলি নি, তার জোরও আমাদের ছিল না। কিন্তু স্মৃতির ভিতর এইসব গল্পগুলো আজও নড়াচড়া করে যখন ভাবতে বসি রাজ্যের সবথেকে দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রিত্বের ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই পুরোধা পুরুষটিকে নিয়ে।

    ৩.

    কিন্তু ব্যক্তি জ্যোতি বসুকে নিয়ে এমন অজস্র স্মৃতি ছড়িয়ে আছে প্রচুর প্রচুর মানুষের মনে। আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিসরে সেটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরমহলে থেকে ব্যক্তি হিসেবে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর দলের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক খুঁজে বার করা, যা কমিউনিস্ট পার্টি তার নিজের কার্যক্রমে ও মূল্যায়নে কোনোদিনই করে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক মহলে নানা বিতর্ক বিসম্বাদ আছে --- কিন্তু অন্তত জ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত প্রভাব রীতিমতন সামাজিক এষণার বিষয় হতে পারে।

    এখানে বাঙালির রাজনৈতিক মানসের একটা প্রবণতা ইতিহাস থেকে একটু ধার করে দেখা যায়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় পর্বে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির যে রাজনৈতিক কার্যক্রম সেখানে একটা ধরণ খুব স্পষ্ট। ইউরোপীয় শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত, আর্থিক কৌলীন্যে ও মেধায় বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়া একদল ঝকঝকে তরুণই কিন্তু বাঙালির বা জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় ছড়ি ঘুরিয়েছেন। উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় থেকে আরম্ভ করে পরে অরবিন্দ ঘোষ, প্রমথনাথ মিত্র বা চিত্তরঞ্জন দাশ হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পর্যন্ত এই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিক পায়ের ছাপ। এরা প্রত্যেকেই অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং রাজনীতির নির্ণায়ক শক্তি হয়ে থেকেছেন বরাবরই। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমান্তরালে কমিউনিস্ট নেতাদের যে বেড়ে ওঠা ও জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা --- সেখানেও এই ঘরানার কোনও ব্যতিক্রম নেই। এই কুলীন সম্প্রদায়ভুক্তরাই গোড়ার দিকের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, তাত্ত্বিক, সংগঠক --- জ্যোতিবাবু তাঁদেরই একজন। যার বাবা একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক, কলকাতার অভিজাত পল্লীতে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়ি। জ্যোতিবাবু আশৈশব বাড়ির গাড়ি চেপেই স্কুল কলেজে গেছেন, বাংলা ভাষাটা কোনোদিনই তেমন ভাল জানতেন না। কারণ, বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়াই ছিল তাঁর পরিবার নির্ধারিত গন্তব্য। হলও তাই। অবশ্য বিলেতে গিয়ে তিনি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে দীক্ষিত হলেন, তাঁর জীবনের গতিপথই পালটে গেল। এর পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভূপেশ গুপ্ত, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, অজয় ঘোষ প্রমুখ এক ঝাঁক মেধাবী ও নিবেদিত তরুণের উঠে আসা, জ্যোতি বসু নিজের যোগ্যতাতেই সেখানে জায়গা করে নিলেন। এবং সংগঠক হিসেবে দলীয় নেতৃত্বের আস্থাভাজন হয়ে উঠবার পাশাপাশি স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের রাজ্যের আইনসভাতে তাঁর অন্তর্ভুক্তি যা মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল ছিল। এই কথা সবাই জানেন, সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁদের ঠিক কী ভূমিকা হওয়া উচিত, স্বাধীনতার পর থেকে কমিউনিস্ট পার্টি এই বিষয়ে বারবার নানা রকম তাত্ত্বিক দোলাচলে ভুগেছে । রণদিভে-পর্ব থেকে এর সূত্রপাত হয়ে অন্তত পার্টি বিভাজনের পর ষাটের দশক পর্যন্ত এই অভ্যন্তরীণ বিতর্ক জারি ছিল। কিন্তু শেষমেশ যে তাঁরা একটা স্থায়ী সিদ্ধান্ত হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজিত করে ফেললেন, এর পেছনে ব্যক্তি হিসেবে জ্যোতি বসুর অবদান আছে বলেই আমার বিবেচনা।

    একটু ফিরে দেখলেই দেখা যাবে ১৯৬৭ তে যুক্তফ্রন্ট তৈরি ও মন্ত্রীসভায় যোগদানের আগে সিপিএম এর একদল অতি-বিপ্লবী নেতা বিপ্লব দরজায় কড়া নড়ছে বলে প্রচার করতেন। কিন্তু জ্যোতিবাবু যুক্তফ্রন্টের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে আসার অল্প পরেই নকশালবাড়িতে কৃষকবিদ্রোহ ঘটে এবং স্বয়ং জ্যোতিবাবুর পুলিশই সেই বিদ্রোহ দমন করে, কয়েকজন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে মারাও যান, যার মধ্যে কৃষকরমণীও ছিলেন। এই কৃষিবিদ্রোহের পেছনে দার্জিলিং জেলার সিপিএম এর কিছু নেতার ভূমিকা ছিল, যারা অল্প পরেই দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সিপিআইএমএল দল গঠন করেন। যদিও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই পঞ্চাশ দশকে খাদ্য আন্দোলন, ট্রামভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে নানা আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি এবং এইসব আন্দোলনগুলি দমনে কংগ্রেস সরকারের চরম নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাঁদেরই অজস্র কর্মী সমর্থক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, সকালবেলা ডাক্তার বিধান রায় ওয়েলিংটনে নিজের বাড়িতে বিনা ভিজিটে রোগী দেখে মুমূর্ষু মানুষের প্রাণ বাঁচান আর বিকেলবেলা তারই বাড়ির সামনে সমবেত জনতার ওপর গুলি চালিয়ে তাঁরই পুলিশ বাহিনী মানুষ মারেন! জ্যোতিবাবু এইসব দমনপীড়নের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যার প্রতিবাদে তিনি বিধানসভায় জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন এবং মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তাঁর এই স্নেহাস্পদ বিরোধী নেতার প্রতিবাদী কণ্ঠকে কক্ষনও বাধা দিতেন না। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সংসদীয় ব্যবস্থার ট্র্যাডিশন মেনে জ্যোতিবাবু কিন্তু প্রথমেই নকশালবাড়ির কৃষিবিদ্রোহ সশস্ত্র পথেই দমন করে দেন। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এই কথা স্বীকার করা উচিত, নকশালবাড়ি এলাকায় কৃষিজমি নিয়ে বিরোধের একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য যুক্তফ্রন্টের ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর বাংলায় যাবেন এমন একটা পরিকল্পনা ফ্রন্টের ছিল। দার্জিলিং এর জেলা নেতৃত্ব সেই সময়টুকু না দিয়েই অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করেন । সম্ভবত এই কাজে জ্যোতি বসুর অনুমোদন ছিল না ।

    কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর পর্বের প্রথম কুড়ি বছর বিরোধী শিবিরের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আইনসভার ভিতরে ও বাইরে নানা আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটা জরুরি অভিজ্ঞতা সম্ভবত জ্যোতিবাবু নিজের মতো করে আত্মস্থ করেছিলেন। মাত্র ন-মাসের উপ-মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদকালে সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে উপলব্ধির যে কিনারায় নিয়ে আসে তা হল ---- প্রথমত কমিউনিস্ট পার্টির মূলস্রোত হিসেবে মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে তাঁর দলকে সংসদীয় রাজনীতির আবর্তে যুক্ত থাকতেই হবে আর দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার অলিন্দে স্থায়ী আসন নিতে হলে সমমনোভাবাপন্ন বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির একটা জোট দরকার। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ র যুক্তফ্রন্ট সরকারে এই সমমনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক শক্তির অভাব তিনি বুঝেছিলেন। সেই সময়কার রাজনৈতিক পালাবদলের নানা দলিলপত্র নাড়াচাড়া করে আমার মনে হয়েছে ওই বিশৃঙ্খলতার পর্বে যদি কেউ অবজেক্টিভলি একটা সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন তিনি একমাত্র জ্যোতি বসু। এমনকি তাঁর দলেও অনেকেই সেই সময় এতদূর বিচক্ষণতা দেখাতে পারেন নি।

    সিপিআইএম ভেঙে সিপিআইএমএল তৈরি হওয়ার পর যখন একটা সময় বিপ্লবের অর্থ দাঁড়াল পুলিশহত্যা আর সিপিএম-নকশালপন্থীদের নিজেদের খুনোখুনি তখনও কিন্তু জ্যোতি বসু তাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে আসেন নি। অথচ রাজনৈতিকভাবে বিরোধী হিসেবে নকশালদের সম্বন্ধে প্রকাশ্যে কোনও বিরূপ মন্তব্যও করেন নি, যেমনটা করেছিলেন তাঁরই সতীর্থ প্রমোদ দাশগুপ্ত (সেই সময়ে তাঁর স্মরণীয় উক্তি : পুলিশের গুলিতে নকশালরা মরছে না কেন? পুলিশের বন্দুকে কি নিরোধ লাগানো আছে?)। একটা মুষলপর্ব পেরিয়ে এসে যখন নকশালবাদীরাও বুঝতে পারলেন বহুল বৈচিত্র্যের এই দেশের অধিকাংশ মানুষকে নিজেদের মতাদর্শের নিচে জড়ো করতে গেলে সংসদীয় ব্যবস্থার কোনও বিকল্প নেই, তখন জ্যোতিবাবু হয়তো একটু মুচকি হাসিই হেসেছিলেন! আপাতকঠিন মানুষটার মুখে যে হাসি জনসাধারণ বড় একটা দেখে নি। আর, নকশালপন্থীরা যখন এই সিদ্ধান্তের কিনারায় ঝুঁকে পড়ছেন ততদিনে জরুরি অবস্থার কালো থাবা পেরিয়ে রাজ্যে বামফ্রন্টের ক্ষমতালাভের পদধ্বনি খুব স্পষ্ট। আর ওই নির্বাচনে পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রফুল্ল সেনের জনতা পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা সময়মতন ছিন্ন করে সিপিআইএম যে মাস্টারস্ট্রোক দিতে পেরেছিল তাঁর নেপথ্য নায়ক ছিলেন সম্ভবত জ্যোতিবাবুই, যা তাঁকে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে স্থায়িত্বের বিশ্বখেতাব এনে দেয়। সেই সঙ্গে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জ্যোতিবাবু ও তাঁর দল অন্যরকম প্রাসঙ্গিকতা পেতে আরম্ভ করে। জাতীয়স্তরে কংগ্রেস বিরোধী শক্তির অবিসংবাদী নেতাও হয়ে ওঠেন তিনি --- যার সূত্রে সারা ভারতের অকংগ্রেসি সব নেতা তাঁকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্বের ব্ল্যাংক চেক পর্যন্ত লিখে দিতে রাজি হয়ে যান। এখানে দল নয়, ব্যক্তি জ্যোতি বসুর ক্যারিশ্মাই প্রধান বিবেচ্য ছিল যা তাঁর দল সম্ভবত কোনও দিনই স্বীকার করতে পারবে না ।

    কিন্তু এই প্রথম তিনি দলের কাছে পরাজিত হলেন। অবশ্য তার আগে দলই বারবার তাঁর কাছে পরাজয় স্বীকার করে এসেছে। জ্যোতিবাবু তাঁর দলকে শিখিয়েছেন অধিকাংশ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে একটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার চালানো যায়। সরকারে থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কীভাবে তৈরি করা যায় বিপুল সাংগঠনিক ও নির্বাচনী মেশিনারি। তৈরি করা যায় দলের অনুগত ও বশ্য আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, অধ্যাপক, উপাচার্য ও প্রশ্নহীন ক্যাডার বাহিনী। এবং এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির একটা মার্কসবাদসম্মত নামকরণ ও করা যায় ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’। যেখানে গুরুত্বহীন বিরোধীদের উপহাস করেই দাবিয়ে রাখা যায় বিধানসভায় বা রাজনীতির লড়াইয়ের মঞ্চে। সত্যি সত্যি সিপিআইএম দলের অনেক তাবড় তাবড় নেতাই ক্ষমতায় টিকে থাকার এই মহৌষধি প্রথমে অনেকদিন বুঝে উঠতে পারেন নি। কেরালায় ১৯৫৯ সালে নাম্বুদ্রিপাদ সরকার ও এই রাজ্যে ১৯৬৭ র যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের ঘোর সন্দেহ ছিল কেন্দ্রের কংগ্রেস দল খুব বেশিদিন এই কমিউনিস্ট পরিচালনাধীন সরকারকে টিকে থাকতে দেবেন না। কিন্তু জ্যোতি বসু তাঁর দূরদৃষ্টিতে এটা বুঝেছিলেন কেন্দ্রে কংগ্রেস দলের একচ্ছত্র শাসনের সুদিন খুব বেশি সময় স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। সারা ভারতেই সাতের দশকের আশেপাশে রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তিগুলি মাথা চাড়া দিতে আরম্ভ করেছিল, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এরা ভূমিকা নিতে আরম্ভ করবে। এই অনুমান অভ্রান্ত ছিল।

    তাই প্রথম ও দ্বিতীয় বামফ্রন্টের সময়কালের এক দশকে আমরা জ্যোতিবাবুকে দেখতে পাই কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনের রাশ হাতে নিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে অকংগ্রেসি দলগুলির জোটের স্বাভাবিক নেতৃত্বে চলে আসতে। রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার ইস্যুটাকে এই সময়েই সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে আসেন। রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার ইস্যু পাবলিক ডোমেনে বা সংবাদপত্রের পাতায় কখনও মজার খোরাক হলেও তথ্যগতভাবে বিষয়টাকে যদি বিবেচনা করা যায় তাহলে স্পষ্ট হবে কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক বৈষম্যের যে দাবি বারবার বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন তাতে কোনও ভুল ছিল না। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধী পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারেই পক্ষপাতমূলক।খুব নির্দিষ্ট তথ্য দিয়েই প্রমাণ করা সম্ভব, বঙ্গসন্তান তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা পরবর্তী সময়ের বাঙালি রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সেই সময় মোটেও প্রশংসনীয় ছিল না। জ্যোতিবাবুর নেতৃত্ব, সন্দেহ নেই, এই কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল, পরে রাজনৈতিক জোটবদ্ধতার একটা প্রেক্ষিত হ্য়তো এখান থেকেই তৈরি হয়েছিল বলে সিদ্ধান্ত করা যায়।

    দ্বিতীয় বামফ্রন্টের সময়কালে রাজ্যে সিপিআইএম এর প্রথম সারির সংগঠক প্রমোদ দাশগুপ্ত ও হরেকৃষ্ণ কোঙার এর অনুপস্থিতি জ্যোতিবাবুকে বলতে গেলে রাজ্য পার্টির অঘোষিত অভিভাবক হিসেব প্রতিষ্ঠা দেয়। তাঁর ওপর দিয়ে কথা বলা বা তাঁকে প্রশ্ন করার মতো কেউ দলে ছিলেন না। সবাই জ্যোতিবাবুর কাছে তখন লিলিপুট, ফলে তাঁর খেলার মাঠটা ক্রমে আরও বড় হয়ে যেতে থাকে। পাল্লা দিয়ে আড়ে বহরে বাড়তে থাকে পার্টির বিস্তার। জ্যোতিবাবু এটা উপভোগ করতেন। প্রায় বিরোধীহীন পশ্চিমবাংলায় বারবার মানুষ ভোটে জেতাচ্ছেন তাঁর দলকে আর ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে উঠছেন তিনি। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র একবার জ্যোতিবাবুকে বলেছিলেন, এই পাঁচ সাত বছর ক্ষমতায় থেকে আমরা কি সত্যিই মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সফল? চলুন, আমরা সবাই পদত্যাগ করে সরকার ছেড়ে আবার জনগণের দরবারে যাই! অশোক মিত্রের এই প্রস্তাব, শোনা যায়, জ্যোতিবাবু ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেন। এর অল্প পরেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আনুগত্য বনাম দক্ষতার দ্বন্দ্বে অশোক মিত্রের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর মতান্তর হয় এবং মিত্রমশায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে চলে যান। মৃত্যুর অল্প আগে আরেক প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা তথা রাজ্যের ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির পুরোধাপুরুষ বিনয় চৌধুরী বামফ্রন্টের সরকারকে ‘ঠিকাদারদের সরকার’ বলে জ্যোতিবাবুর বিরাগভাজন হন। জ্যোতিবাবু সাংবাদিকদের বলেছিলেন উনি (বিনয় চৌধুরী) তাহলে এই সরকারে আছেন কেন? ক্ষুব্ধ পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি বিষয়ে জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে মুখ খোলায় তাকেও কার্যত ফ্রন্টছাড়া করে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের দফারফা করা হয়েছিল। যদিও ওই তথাকথিত কেলেঙ্কারি বিষয়ে তদন্ত করে জ্যোতিবাবুর কোনও ভূমিকা প্রমাণ করা যায় নি। আর নিজের দলের উত্তরপুরুষ যখন জ্যোতিবাবুর মন্ত্রীসভাকে ‘চোরেদের ক্যাবিনেট’ বলে মন্ত্রীসভা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, জ্যোতি বসু আড়ালে বোধহয় সেই মুচকি হাসিটাই আবারও হেসেছিলেন! যার অনতিকাল পরেই ‘বিদ্রোহী’ মন্ত্রী, ক্যাবিনেট আলো করে ফিরে আসেন, সাধুসঙ্গের অভিলাষেই হয়তো বা! এই হলেন জ্যোতিবাবু যাকে টপকে যাওয়া খুব কঠিন, ডমিনেট করা প্রায় অসম্ভব।

    মনে রাখতে হবে, নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্ব শুরু হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যে মরিচঝাপিতে গণহত্যার কুকীর্তি একা জ্যোতিবাবুই কিন্তু প্রকাশ্যে আসতে দেন নি। কেন্দ্রের জনতা পার্টির পরিচালনাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই যখন মরিচঝাপির ঘটনা নিয়ে রাজ্যে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর উদ্যোগ নেন তখন জ্যোতিবাবুই প্রথম আঁচ করেন রাজ্যের জনতা পার্টির নেতাদের চাপে এই সংসদীয় প্রতিনিধিদল মরিচঝাপিতে যেতে চাইলে রাজ্যের প্রধান হিসেবে তিনি তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারবেন না, অথচ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁদের চোখে এমন অনেক কিছুই আসবে যা তাঁরা প্রকাশ্য করলে সর্বভারতীয় স্তরে সরকারের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হতে বাধ্য। রাজনৈতিকভাবে সেই সময়ের সদ্য নির্বাচিত একটি বামপন্থী সরকারের পক্ষে যা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। গুরুত্ব বুঝে জ্যোতিবাবু নিজে দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বুঝিয়ে (শোনা যায় কিছুটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়ে) তিনি সংসদীয় দলের রাজ্যসফর বাতিল করেন। এমন কী ওই মরিচঝাপি অঞ্চলে আর এস পি দলের এক গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান এই হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতিবাবুর কাছে ডেপুটেশন দিতে গেলে জ্যোতিবাবু তাঁকে এমন দাবড়ানি দেন যে বামফ্রন্টের মধ্যে বেশি বিপ্লবী বলে পরিচিত আরএসপি দল তারপর এই নিয়ে ঘুণাক্ষরেও কোথাও মুখ খোলে নি। দলের সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিবাবুও এইভাবে মহীরুহ হয়ে উঠেছেন। ক্রমশ যার চেহারা হবে লারজার দ্যান লাইফ!

    কিন্তু সিপিআইএম দলকে রাজ্যের একচ্ছত্র ক্ষমতার আধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়ার পাশাপাশি অন্য একটা সমস্যাও চোরাপথে বাসা বাঁধতে আরম্ভ করেছিল। আসলে সেটাকে রাজনীতির পরিভাষায় বলা যেতে পারে মেদবৃদ্ধির সংকট। ক্ষমতাসীন দল, ক্রমশ ক্ষমতার সমস্ত কেল্লা তাঁদের দখলে --- ফলে নিবেদিত আদর্শবান কর্মীর পাশাপাশি পরান্নভোজী উমেদারদের ভিড় এবং আস্তে আস্তে দলের মধ্যে তাঁদের মৌরসিপাট্টা। সাম্যবাদী আদর্শে পার্টির ঘোষিত অবস্থান, পার্টির তাত্ত্বিক কর্মসূচিতে তার বিনীত বিঘোষণা অথচ জেলায় জেলায় একশ্রেণির জায়গিরদারদের ধারাবাহিক উত্থান, যাদের দাপটে বাঘে-গরুতে তোলাবাজ-প্রোমোটার-পুলিশ একঘাটে জল খায়! পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দলের নিবিড় প্রতিবাদ কিন্তু এইসব নব্য জমিদারদের মধ্যে সামন্ততন্ত্রের প্রগাঢ় ছায়া, এদের হুকুমে জনগণ কার্যত প্রজায় পরিণত। উস্কোখুস্কো চুল, মলিন পাজামা পাঞ্জাবি আর লজঝড়ে সাইকেল পেরিয়ে এলাকার পার্টি অফিসে জাঁকিয়ে বসা কমরেডের গলায় মোটা সোনার চেন, বাইরে দাঁড় করানো ঝা চকচকে মোটরবাইক। লোকাল বা জোনাল কমিটির কর্তাদের চকমিলানো বাড়ি, বিল্ডিং মেটিরিয়ালের ব্যাবসা। এইসব আঞ্চলিক তালুকদাররা চাইলেই বাস-লরি দিয়ে ব্রিগেড ভরিয়ে দিতে পারেন। এঁদেরই আশ্রিত দামাল কমরেডরা কখনও দুষ্টুমি করে বসেন, কেউ কেউ এমনকি দলের সম্পদ তকমাও পেয়ে যান। জ্যোতিবাবু এইসব জানেন না তা নয়, কিন্তু গায়েগতরে বেড়ে যাওয়া বিশাল দলের খুটিনাটি দেখার তাঁর সময় কই? পরের প্রজন্মের নেতারা ততদিনে আলিমুদ্দিনের দখল নিয়েছেন --- জ্যোতি বসু তাঁদের অবিসংবাদিত অভিভাবক, কারোর কাছে ‘মনীষী’।

    কিন্তু ইতিহাস আসলে বড় নিষ্ঠুর। চব্বিশ বছরের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছেড়ে ২০০১ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সগৌরবে পদ ছেড়ে যখন তাঁর অবসর তখন কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে বিপুল কলেবরে বেড়ে ওঠা দল দেশের প্রধান বামপন্থী শক্তি, মাত্র তিন বছরের মধ্যে ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনে যারা কেন্দ্রে সরকার গঠনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে দেখা দেবে। অথচ সেই একই দল মেদবৃদ্ধির এই প্রকোপে আদর্শচ্যুতির রক্তহীনতায় ভেতরে ভেতরে ফ্যাকাশে, রাজনৈতিক সংগ্রামের নিখাদ আবেগের বিচারে আপোষকামী, নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রান্তেই অন্তঃসারহীন। সংসদীয় ব্যবস্থাকে মানুষের স্বার্থে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন জ্যোতিবাবু, কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থার নিজস্ব রসায়ন যে তাঁর অন্তর্গত দলকেও পালটা ব্যবহার করে, তাঁকে পালটে দেয় ক্ষমতার ছাঁচে ফেলে, মানুষের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি করে --- এই জটিল দ্বন্দ্ব হয়তো মেধাবী জ্যোতিবাবু বুঝতেন, কিন্তু এই উপলব্ধি তিনি দলের শিরা উপশিরায় চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন কি?

    প্রশাসনিক স্তরে ধানতলা, বানতলা, আনন্দমারগী হত্যা জ্যোতিবাবুর সমালোচক সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে লিখেছে, আবার চুরাশির শিখনিধন যজ্ঞে বা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী দাঙ্গায় তাঁর প্রশাসনিক দূরদৃষ্টিকে সবাই বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো তো রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁর আলো বা অন্ধকারের কাহিনি। রাজনৈতিক স্রোতের কান্ডারী হিসেবে জ্যোতি বসুর সব থেকে বড় সাফল্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদীর নেতৃত্বে একটা ফ্রন্ট সরকারকে এতদিন ধরে পরিচালনা করা। পাশাপাশি তাঁর দলকে মহীরুহে পরিণত করে তোলা। সম্ভবত জ্যোতিবাবুর ব্যর্থতার ভ্রূণও এইখানেই। নয়তো তাঁর আড়াই দশকের তিল তিল করে গড়ে তোলা ইমারত তার পরের মাত্র এক দশকের মধ্যে এমন পথের ধুলোয় মলিন হয়ে উঠল কেন? তবে কি জ্যোতিবাবু হেরে গেলেন?

    ৪.

    না, আমার বিচারে তিনি কোথাও হেরে যান নি। বরং ব্যক্তি ও দলের যে আবহমান দ্বৈরথের প্রেক্ষিতে এই লেখার সূচনা হয়েছিল তার নিরিখে জ্যোতি বসু বারবারই তাঁর দলের থেকে নিজে বড় হয়ে দেখা দিয়েছেন সাধারণ মানুষের চোখে। যে অভিজাত পরিমণ্ডলে তাঁর আবাল্য অবস্থান কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁর সংযুক্তি সেই আভিজাত্যের কোথাও এতটুকু ফাটল ধরাতে পারে নি। যে শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর দলগত ও আদর্শগত সম্পৃক্তি তাঁদের শ্রীহীন জীবনযাপনের পাশে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবিতে তিনি স্বচ্ছন্দ থেকেছেন, তারাও মেনে নিয়েছেন এই ব্যতিক্রমী নেতাকে। যিনি ইংরিজি বই ছাড়া পড়েন না, বাংলা বাক্য উচ্চারণে যার প্রবাদপ্রতিম জড়তা তবু তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য অগুনতি মানুষ ভিড় করেছেন মাঠে ময়দানে। সংবাদপত্র সজাগ নজর রেখেছে তাঁর চলাফেরায়, সোজাসাপটা সমালোচনা করেছে। তিনিও পালটা স্ট্রেট ব্যাটে খেলে জানিয়ে দিয়েছেন, কয়েকটি সংবাদপত্র তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে খবর বানাচ্ছেন। খাদ্য আন্দোলনে সারা বাংলার ক্ষুধার্ত মানুষদের নিয়ে তিনি যখন লড়াই করছেন তাঁর সান্ধ্য পানভোজনের রুটিনে কোনও ছেদ পড়ে নি। দক্ষিণ কলকাতায় আরেক কমিউনিস্ট নেতা ও আইনজীবী স্নেহাংশু আচার্যের বাড়িতে সেইসব সন্ধ্যার কথা পাওয়া যায় সমর সেনের ডায়েরিতে, কারণ সমর সেন নিজেও তার শরিক ছিলেন। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে পয়লা নম্বর শত্রু ঠাউরালেও জ্যোতিবাবুর পুত্রকে জামাই করে নিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি পরিবার। দল তাঁকে কিছু প্রশ্ন করার অবকাশ পায় নি। বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর এর কংগ্রেসি সন্ত্রাসে দলের অগণিত কর্মী-সমর্থকের নিপীড়ন নিয়ে জ্যোতিবাবু সোচ্চার হয়েছেন সর্বত্র, জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার নিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেছেন; কিন্তু কী এক অলক্ষ্য যোগাযোগে এই সময় জ্যোতিবাবুকে কারারুদ্ধ করার স্পর্ধা কারোরই হয় নি। তার বাড়ি পরিবার একবারের জন্যও আক্রান্ত হয় নি। যদিও এই একই সময় হাজার হাজার পার্টিকর্মী ঘরছাড়া হয়ে থেকেছেন, শিকার হয়েছেন বিরোধী দল বা পুলিশি সন্ত্রাসের।

    একটি প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায় থেকে যে সাধারণভাবে সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় কাজ করতে হয় এই কথা বারবার মেনে নিয়েছেন জ্যোতিবাবু এবং বামফ্রন্ট সরকার যে আসলে রিলিফের সরকার এটা মেনে নিতে তাঁর কোনো কুন্ঠা ছিল না। তাঁর দলের কমরেডরা যখন দেওয়াল জুড়ে প্রচার করেছেন ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ এবং সরকারিভাবে প্রাথমিকে ইংরিজি তুলে দেওয়া হয়েছে জ্যোতিবাবুর বাড়ির নাতি নাতনিরা তখন নামী ইংরিজি স্কুলেই পড়েছেন। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে যখন দেশের অগ্রগতির প্রধান শত্রু হিসেবে পার্টির দলিলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে তখন তারই পাশে পাশে গ্রীষ্মের ছুটিতে জ্যোতিবাবু তাঁর সরকারি দলবল নিয়ে পুঁজি মৃগয়ায় বেরিয়েছেন ইউরোপে আমেরিকায়। পুজিবাদী অপসংস্কৃতির প্রচার প্রসার নিয়ে যখন তাঁর দল যখন দুশ্চিন্তায় ন্যুব্জ এবং রুচিশীল সংস্কৃতিকে সরকারি প্রশ্রয় দেওয়ায় উন্মুখ --- ঠিক তখনই শীত রাতে মাথায় টুপি পরে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে হোপ ছিয়াশির জলসায় জ্যোতিবাবু উপস্থিত থেকেছেন। কই, কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে শোনা যায় নি!

    ১৯৯০ সালে বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে এসইউসিআই দলের এক তরুণ সমর্থক রাণী রাসমণি রোডে পুলিশের গুলিতে মারা যান। নানা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা জ্যোতিবাবু তার অদূরেই দলীয় সভা থেকে বলেছিলেন, ওরা নিরামিষ আন্দোলন আমিষ করে দিতে চেয়েছিল, তাই পুলিশ গুলি চালিয়েছে! অথচ জ্যোতিবাবুর পুরনো দল সিপিআই এর রাজ্য কমিটির অফিসের অদূরে কলেজ স্ট্রীট ও বউবাজার স্ট্রীটের সংযোগস্থলে এক আন্দোলন মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় ১৯৪৯ সালের এক অভিশপ্ত বিকেলবেলা যাতে চারজন মহিলাকর্মী শহিদ হন। বক্সার জেলে আটক কমিউনিস্ট কর্মীদের রাজবন্দি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতেই ছিল সেই আন্দোলন। সেই চারজন শহিদের স্মারকবেদিটি আজও সেখানেই রয়েছে, যেখানে কাপড় শুকোতে দেন ফুটপাথবাসীরা। কিন্তু ওইদিনের ঘটনায় পুলিশকে বোমা-পাথর নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাকশন ফ্রন্টের নেতারাই করেছিলেন। বর্তমান ‘যোগাযোগ ভবন’ এর পেছনে একটি বাড়িতে সেই বোমা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র মজুত করা হয়েছিল। এই তথ্য প্রকাশ করেছেন সেই সময়ের কমিউনিস্ট কর্মী ও পরে নবপত্র প্রকাশনের কর্ণধার প্রসূন বসু। কিন্তু জ্যোতি বসুর ওই ধরণের উদ্ধত বক্তব্যের প্রতিবাদে তাঁর দলের সংগ্রামী নেতারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেন নি। যেমন তাঁরা চুপ ছিলেন ১৯৯৩ এর ২১ জুলাই কলকাতার রাজপথে পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যু নিয়ে। ওরা সমাজবিরোধী নিয়ে রাইটার্স দখল করতে এসেছিল বলে জ্যোতিবাবু সাংবাদিকদের সেই সন্ধ্যায় বলেছিলেন। কিন্তু গুলিতে নিহত ১৩ জনের কারোরই এমন কোনও অতীত ছিল বলে পুলিশ আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেন নি। ভারতের সব থেকে বড় কমিউনিস্ট পার্টির কেউ এই হত্যার নিন্দা করেন নি। সে তো একরকম জ্যোতিবাবুরই জন্য ।

    কিন্তু মনে রাখতে হবে, গত শতকের নব্বই দশকের শেষের দিকে যখন রাজ্যে কংগ্রেস দল দু টুকরো হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয় এবং বিরোধী রাজনীতি সংহত হতে আরম্ভ করে জ্যোতিবাবু তখন কিন্তু নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় বুঝতে পেরেছিলেন সতর্কভাবে পা ফেলার সময় এসে গেছে। যে ভোট ব্যাঙ্কের ওপর বামফ্রন্টের মূল সমর্থন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সামান্য পরিবর্তন ক্ষমতার বিন্যাসকে পালটে দিতে পারে। সেই অবস্থান থেকেই তিনি বলেছিলেন, যারা আমাদের ভোট দেয় না তাঁদের কাছেও আমাদের পৌছাতে হবে। তাঁদের সমর্থন সুনিশ্চিত করতে হবে। সংসদীয় রাজনীতির নিরিখে এই কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু অবসৃত মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরসূরিরা এই গুরুবাক্যে তেমন গুরুত্ব দেন নি। এমনকি ২০০১ এর বিধান সভা নির্বাচনের পরের পর্বে নতুন রাজ্যপাট সামলাতে আসা যুবরাজ যখন উন্নয়নের অতি পাগলামিতে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে আরম্ভ করেছেন, স্নেহভাজন নবীন মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর পূর্বসূরি বারবার বলেছেন অধিকাংশ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। সম্ভবত তিনি শুনেও শোনেন নি। সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ পর্বে তাই জ্যোতিবাবকে বলতে হয়েছিল, স্থানীয় কৃষক সভাকে অন্ধকারে রেখে কেন এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যায় নি।

    ২০০৬ এর সপ্তম বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর অল্প সময়ের মধ্যেই যখন সরকার-বিরোধী আন্দোলনের তাপে প্রশাসন ও দল কোণঠাসা, নবতিপর জ্যোতিবাবু তখন অসুস্থ ও অশক্ত। কিন্তু তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন তাঁর সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল বলে। ফলে খানিকটা নিরাসক্ত ভূমিকায় তাঁর অবস্থান। নন্দীগ্রামে গুলি চালনার ঘটনাতেও তিনি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। সব থেকে বড় কথা, এই সব কিছুর আবর্তে বিরোধী শক্তি যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এটা তিনি বিলক্ষন বুঝেছিলেন। কারণ সুদীর্ঘ আড়াই-তিনদশক বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করে রাখাই ছিল জ্যোতিবাবুর সব থেকে বড় সাফল্য, সারা ভারতে যার তুলনীয় উদাহরণ আর নেই। এখানে আবারও এই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি তিনি দলের কাছে হেরে গেলেন!

    না, তিনি হারেন নি। তাঁর রাজ্যপাটের শেষ দিনে যুবভারতী স্টেডিয়ামে তাঁকে এক রাজকীয় বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। লাল কার্পেট বিছিয়ে পুষ্পবৃষ্টি করে তাঁকে বরণ করে নেওয়া হয় মঞ্চে। আর মঞ্চে তিনি পা রাখা মাত্র সম্মেলক কন্ঠে গান শুরু হয় : জয় যাত্রায় যাও গো! সেইদিন সত্যি সত্যি তাঁর নতুন করে কোনও জয়রথে ওঠার অবকাশ ছিল না। কিন্তু তাঁর ফেলে আসা পথটা তো আসলে পশ্চিমবাংলার ইতিহাসে বামপন্থী আন্দোলন, বামপন্থী চেতনা ও সংস্কৃতি বিকশিত করারই একটা সঞ্চার রেখা।

    ২০১১ এর ১৩ মে, যখন তিন দশকের বামফ্রন্ট সাম্রাজ্যের পতন ঘটল, সেদিন আমি জীবিকাসূত্রে চন্দননগরে। দেখেছিলাম গঙ্গাপারের এক প্রাচীন মহীরুহ থেকে একঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে গেল পূর্বদিগন্তের দিকে। আমার মনে হয় সেইদিন বামফ্রন্ট বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও, জ্যোতিবাবু আবার নতুন করে জিতলেন। অন্তত সমকালের আড়াল থেকে হলেও তাঁর দলকে এই বার্তাই তিনি দিলেন, দ্যাখো, আমার অবর্তমানে তোমরা দু বছরও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে না! আর দশ বছর পেরিয়ে আসা আরেকটা মে মাসে (২মে ২০২১) যখন তাঁর দল বিধানসভায় একটিও আসন না পেয়ে উরুভাঙ্গা দুর্যোধনের চেহারায়, তখনো বোধহয় জ্যোতিবাবু আরেকবার মুচকি হাসি হাসলেন, যা তিনি জীবদ্দশায় কোনোদিন হেসেছেন, এমন দেখা যায় নি। বলেছিলাম না, আমায় ছাড়া তোমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন!

    ব্যক্তি না দল, কে বড়? ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে যদি এই প্রশ্ন আবার ঘুরে আসে, আমরা বলতেই পারি, পলিটিক্স ইজ এ লিডারস গেম! অন্তত জ্যোতিবাবুর জীবনের সঞ্চারপথের বাঁকে বাঁকে এই কথাগুলোই লেখা আছে।

    ** ২০১২ সালে একটি পত্রিকা জ্যোতি বসুকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এই লেখাটি সেইসময় লেখা। পরে আর সেই পত্রিকা বাস্তবে প্রকাশিত হয় নি। আগামীতেও হবে এমন সম্ভাবনা নেই। তাই সেই লেখাটিই কিছুটা সম্পাদনা ও আপডেট করে এইখানে দেওয়া হল।।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন