এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ

  • বলপূর্বক উচ্ছেদ- বারংবার রাষ্ট্রের নিশানা হয় প্রান্তজনেরা

    পার্থ সিংহ
    আলোচনা | সমাজ | ২৩ আগস্ট ২০২১ | ১৮৯১ বার পঠিত

  • খোরিগাঁও-এর লক্ষাধিক গরিব মানুষের নারকীয় উচ্ছেদ

    ভয়াবহ গণসংক্রমণ, করুণ চিকিৎসা পরিকাঠামো, ওষুধ, অক্সিজেনের হাহাকার, সেই সাথে দেশের সরকারের চূড়ান্ত অকর্মণ্যতা, ক্রমাগত মিথ্যাচার, বিধ্বস্ত অর্থনীতির ফলশ্রুতিতে আম-মানুষের রোজগার হারানো, অকল্পনীয় মূল্যবৃদ্ধি আর তোবড়ানো গণতন্ত্র – এমনই বিপন্ন সময়ে প্রায় অলক্ষ্যে হরিয়ানা সরকার অকথ্য অত্যাচারে উচ্ছেদ করল খোরিগাঁও-এর লক্ষাধিক গরিব মানুষকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল – দরিদ্র মানুষের প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের চূড়ান্ত হৃদয়হীন এবং বৈষম্যমূলক আচরণ। জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে অল্পই জায়গা পেয়েছে এ হেন ব্যাপক রাষ্ট্রীয় উৎখাত। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক বৃত্তেও তেমন গুরুত্ব পায়নি প্রান্তবাসী বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর উপর ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রের এই নৃশংসতা।

    ঘটনাটিতে ঢোকার আগে জায়গাটির পরিচয় জানিয়ে রাখা যাক। খোরিগাঁও বস্তিটি অবস্থিত আরাবল্লি পাহাড়ের উত্তর পাদদেশে হরিয়ানার ফরিদাবাদ এবং দেশের রাজধানী দিল্লির সীমান্তে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সময়কালে এই জঙ্গুলে জায়গায় বসতি করতে থাকে আরাবল্লির বেআইনি পাথর খাদানের চুক্তি শ্রমিকেরা। ২০০২ সালের মধ্যেই সুপ্রিমকোর্টের একাধিক রায়ে খাদানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৪-এর পর থেকে পেটের দায়ে মূলত ইউপি, হরিয়ানার গ্রামগঞ্জ আর দিল্লির নানান বস্তি থেকে উৎখাত হওয়া লক্ষাধিক গরিব, প্রান্তিক মানুষ, বসবাসের অযোগ্য, পাণ্ডববর্জিত জায়গাটিতে ডেরা বাঁধতে থাকে। কেউ ঠিকা নির্মাণ-শ্রমিক, ছোট কারখানার শ্রমিক, গাড়িচালক, কেউ বা গৃহ-সহায়িকার কাজ করে। দিল্লি ও ফরিদাবাদের সীমানা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত না থাকায় অঞ্চলটি জমি-মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য।

    সুপ্রিমকোর্ট আরাবল্লি বনাঞ্চল সন্নিহিত বিধিবদ্ধ এলাকায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙ্গার জন্য নির্দেশ দেয় গত বছরের গোড়ার দিকে। এ বিষয়ে আদালতে অনেকদিন ধরেই একাধিক মামলা চলছে। ইতিপূর্বে, বাসিন্দাদের করা দু’টি মামলায় চণ্ডীগড় হাইকোর্ট হরিয়ানা সরকারকে পুনর্বাসনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী খোরিগাঁও রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন সরকারকে সার্ভে করে বাসিন্দাদের সরকারি নিয়ামানুসারে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত উচ্ছেদ স্থগিত রাখতে আবেদন জানায়। কিন্তু, আইনকে চতুরতার সঙ্গে পাশ কাটিয়ে, সরকার বাসিন্দাদের কাছে বসবাসের প্রমাণপত্রের বদলে জমির দলিল দেখাতে বলে – যেটি কারুর কাছেই থাকার কথা নয়। কোভিড সংক্রমণের চূড়ান্ত সময়ে, গতবছর সেপ্টেম্বরে ১৭০০টি, এবছর এপ্রিলে বিনা সতর্কীকরণে ৩০০টি ঘর ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। ৭ই জুন সুপ্রিমকোর্টের চূড়ান্ত নির্দেশিকার প্রেক্ষিতে, ১৪ই জুন থেকে ধারাবাহিক উচ্ছেদ শুরু করে মনোহরলাল খট্টরের সরকার। স্থানীয় বাসিন্দা ও গণ-আন্দোলন কর্মীদের প্রতিবাদ রুখতে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। ৩০শে জুন আম্বেদকর পার্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের মহাপঞ্চায়েত আটকে দিয়ে, বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ কেটে দেওয়া হয়েছে। বহির্জগতের সাথে স্থানীয়দের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে আশপাশের মোবাইল ফোনের টাওয়ারগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়, অন্তত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাংবাদিকদেরও পুলিশি বর্বরতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। খোরিগাঁও এখন এক উন্মুক্ত জেলখানা। কোনও রাজনৈতিক দল নয় – ভগত সিং ছাত্র একতা মঞ্চ, মজদুর আবাস সংঘর্ষ সমিতি, বস্তি সুরক্ষা মঞ্চ, এনএপিএমের ঐক্য সমন্বয়ের পক্ষ থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিবাদ, আন্দোলন জারী রাখা হয়েছে। জুরি হিসেবে পরিবেশবিদ আশিস কোঠারি ও ক্লডি আলভারেজ, সমাজকর্মী অঞ্জলি ভরদ্বাজসহ ৬ অগ্রণী ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে ১৭ই জুন এনএপিএম একটি গণ-শুনানি করে।

    উৎখাত হওয়া মানুষেরা জানিয়েছেন, জমি মাফিয়াদের কাছ থেকে জমি কিনে ঘর গড়তে হলে, পুলিশ এবং বনবিভাগের কর্মীদের নিয়মিত উৎকোচ দিতে হত, অর্থাৎ সরকারের অজ্ঞাতসারে বস্তিটি তৈরি হয়ে যায়নি। ক’দিন আগেই আত্মহত্যা করেছেন নির্মাণ শ্রমিক ৭০ বছরের গণেশিলাল, জীবনের যৎসামান্য সঞ্চয় নিঃশেষ করে তিনি বানাতে পেরেছিলেন তাঁর ঘরটি। আর একজন হতভাগ্য রজনী, বুলডোজার চালানোর সময়ই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সংক্রমণ পরবর্তী বিপন্ন সময়ে কাজ হারানো, আয় হারানো, বিপর্যস্ত মানুষকে ত্রাণ দেওয়ার বদলে, হরিয়ানা সরকার তাদের উৎখাত করার মহান ব্রত নিয়েছে। সংক্রমণকালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, “ঘরে থাকাই সংক্রমণ রুখবার প্রাথমিক প্রতিরোধ। এঅবস্থায় সাধারণ মানুষকে তার বিধিবহির্ভূত বাসস্থান / উপনিবেশ / শিবির থেকে উৎখাত করা যাবে না”। কনসার্নড সিটিজেন ফর খোরিগাঁও এবং এনএপিএম-এর গণ-শুনানির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ১৫ই জুলাই থেকে হরিয়ানা পুলিশের নৃশংসতার এক ভয়াবহ চিত্র। উচ্ছেদ হওয়া মানুষকে খাবার ও জল বিতরণ করতে অ-সরকারি ত্রাণকর্মীদের বাধা, গ্রেফতারের হুমকি দিচ্ছে পুলিশ। অসুস্থ মানুষের প্রয়োজনে ওষুধের দোকানে যেতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই নারকীয় উচ্ছেদের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে অন্তত ৫০০০ গর্ভবতী মা ও ২০০০০ শিশুর উপর, তাদের জন্য ন্যূনতম আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক, তাদের বিতরণ করা খাবারের পাত্রও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পুলিশ।

    আরাবল্লির অরণ্যাঞ্চলের অন্তর্গত এই এলাকাটি, পাঞ্জাব ল্যান্ড প্রিজারভেশান আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে পড়ে। ভারতীয় বন আইন ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, এই এলাকায় বিনা অনুমতিতে কোনও রকম স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করা যায় না। অথচ, খোরিগাঁও-এর আশেপাশেই রয়েছে অনেক বিলাসবহুল, অত্যাধুনিক বহুতল ইমারত, তাজ ভিদান্ত হোটেল, সরোবর পোর্টিকো হোটেল, পিনাকল বিজনেস টাওয়ার, সুরজকুণ্ড ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স, কান্ত এনক্লেভ, রাধাস্বামী সৎসঙ্গ সেন্টার এবং অজস্র রিসর্ট আর ফার্মহাউস। সরকারের জ্ঞাতসারেই, বনাঞ্চলের জমি বেদখল করে, এই বৃহৎ নির্মাণগুলো গড়ে উঠেছে। ২০১৮ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে রাজ্য বনবিভাগ তাদের পেশ করা রিপোর্টে জানিয়েছিল, অরণ্যাঞ্চলের বিধিবদ্ধ বহু জমি বেদখল করে ১২৩টি বেআইনি স্থায়ী নির্মাণ গড়ে উঠেছে। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশের প্রেক্ষিতে তালিকার অন্তর্গত ২৩টি ফার্মহাউসকে তারা ‘কারণ দর্শানোর' নোটিশ পাঠিয়েছে এবং আরও ৬২টিকে নোটিশ দেওয়া হবে বলে গতবছর ডিসেম্বরে জানিয়েছিল হরিয়ানার বন দফতর। কিন্তু আজ অবধি এমন কোনও ইমারতের একটি ইঁটও ভাঙ্গা হয়নি। সরকার নয়, একটি ব্যক্তিগত মামলার সুবাদে ২০১৮ সালে সুপ্রিমকোর্ট ১৬০০ প্লটের বিশালাকার কান্ত এনক্লেভ ভেঙ্গে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল। তবে, সেক্ষেত্রে, প্রোমোটার কান্ত অ্যাসোসিয়েটস এবং হরিয়ানা সরকার উভয়কেই ৫০ লক্ষ টাকা করে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। সেটি ভাঙ্গার কাজ এখনও শেষ হয়নি।

    রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন ১৯৯৩/৭৭ সংখ্যক রেজোলিউসনে বলপূর্বক উচ্ছেদকে মানবাধিকারের উপর জঘন্যতম আঘাত বলে অভিহিত করেছে। জবরদস্তি উচ্ছেদ শুধু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদকেই (২৫/১ ধারা) লঙ্ঘন করে না, এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র (১১/১ ধারা), নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র (১৭, ২৩, ২৭ ধারা), শিশু অধিকারের নীতি, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসানের নীতি, জাতিগত বৈষম্যের অবসানের নীতিসহ একাধিক নীতিকেও লঙ্ঘন করে। আন্তর্দেশীয় উৎখাতের ক্ষেত্রে, ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের গৃহীত ৩০ দফা নির্দেশিকাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য এবং দায়িত্ব হচ্ছে – উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের সুরক্ষা ও সবরকম মানবিক সহায়তার বন্দোবস্ত করা। উৎখাত হওয়া মানুষদের সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে ধর্ম, বর্গ, ভাষা, শ্রেণি, লিঙ্গ, আইনি/সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক বিশ্বাস ইত্যাদি কোনও বিষয়ে বৈষম্য করা যাবে না। ঘরহারা মানুষদের কার্যকর বিকল্প বাসস্থান, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে অঙ্গিকার বদ্ধ থাকবে সরকার। উচ্ছেদের সময় কোনও রকম নিপীড়ন, নির্যাতন, মানবাধিকার ভঙ্গ যাতে না হয় – তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। পরবর্তীকালে, রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০০৪/২৮ সংখ্যক রেজোলিউসনে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রকে বলপূর্বক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে এবং আইনসঙ্গত কারণে উচ্ছেদ করতে হলে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে আলোচনা ও সম্মতি সাপেক্ষে, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, সম্মানজনক, বসবাসযোগ্য বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, যতদূর সম্ভব মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে, বাসস্থান তাদের থেকে সরাতে হবে বলে। সেই সাথে উৎখাত-বিরোধী উপযুক্ত কার্যক্রম ও কার্যকরী পদক্ষেপও নিতে হবে সরকারকে। ২০১৬ সালে ইউএন কনফারেন্স অন হাউসিং অ্যান্ড সাসটেনেবল আরবান ডেভলাপমেন্ট (হ্যাবিট্যাট ৩, ফোর্সড এভিকশন, ২০১৪)-এ সহনশীল উন্নয়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল সমস্ত দরিদ্র, প্রান্তিক, গৃহহীন মানুষকে বসবাসযোগ্য, সুরক্ষিত, সহনশীল বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম সদস্য দেশ হিসেবে এই সনদ, চুক্তি এবং নীতিমালা গ্রহণ করেছে, এগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও সেসব খাতায় কলমেই থেকে গেছে।

    ভারতের ন্যায়ালয়ের বক্তব্যেও বারবার উঠে এসেছে বিষয়টি। চামেলি সিং বনাম ইউপি সরকারের মামলায়(১৯৯৫) এবং আহমেদাবাদ পুর নিগম বনাম নবাব খান মামলায়(১৯৯৬) সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, সভ্যসমাজে জীবনের অধিকারের মধ্যেই বিধৃত থাকে খাদ্য-পানীয়ের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের, স্বাস্থ্যের, শিক্ষার অধিকার। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব, সমাজের প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। একই ভাবনা থেকে, দিল্লি হাইকোর্টের বক্তব্য ছিল, উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই যুগ্গী থেকে উচ্ছেদ করলে সংবিধানের ২১ ধারার মৌলিক অধিকার এবং বুনিয়াদি মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন করা হবে (সুদামা সিং বনাম দিল্লি সরকার এবং পি কে কল বনাম এসস্টেট অফিসার, ২০১০)।

    দুঃখের কথা, রাষ্ট্রপুঞ্জের সমস্ত নীতি-নির্দেশিকা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, আইনকানুনকে অবমাননা করে, খোরিগাঁও-এর দশ হাজার পরিবারকে উচ্ছেদের অমানবিক রাষ্ট্রীয় নৃশংসতায় নেতৃত্ব দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। বাসিন্দাদের পক্ষের আইনজীবী কলিন গনজালভেজ, উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের আবেদন জানালে, মহামান্য বিচারপতি এ এম খানউইলকর ও দীনেশ মহেশ্বরীর রূঢ় তিরস্কার ছিল, “Land grabbers can’t take refuge under rule of law and talk of fairness.” পরবর্তীকালে (২৩শে জুলাই), আদালত, আইনজীবী গনজালভেজকে, হরিয়ানা সরকারের খসড়া পুনর্বাসন নীতির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানাতে অনুমতি দেয় মাত্র। ফরিদাবাদ পুর নিগমের পেশ করা পুনর্বাসন নীতির ভিত্তিতে, গত ৪ঠা আগস্ট, বিচারপতিদের মন্তব্য, “উপযুক্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই পুনর্বাসন পাবেন, কিন্তু যারা উপযুক্ত নয় তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্র কেন বহন করবে? তারা তো জবরদখলকারী।” উচ্ছেদ হওয়া মানুষের বাধ্যতামূলক পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের মূল ভাবনাটিকেই নস্যাৎ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। অথচ এই আদালতই বেআইনি কান্ত এনক্লেভের ধনী বাসিন্দাদের মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু, এক্ষেত্রে আগে উৎখাত – পরে সরকারের দয়ায়, তাদের ঠিক করা শর্তে পুনর্বাসনের প্রশ্ন। কিছুদিন আগে, হরিয়ানা সরকার তাদের তথাকথিত পুনর্বাসন দেওয়ার অদ্ভুত এক পরিকল্পনায় জানিয়েছিল, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর জন্য তৈরি করা ১৮০০ ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে শুধুমাত্র হরিয়ানার ভোটারদের জন্য। তবে প্রতি ফ্ল্যাটের জন্য মূল্য দিতে হবে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। আদালতের বেঁধে দেওয়া ২৩ আগস্টের মধ্যে উচ্ছেদের কাজ শেষ করতে হবে। এই রায়ে, ন্যায়ালয়ের চৈতন্যে প্রান্তিক মানুষের জীবনের অধিকারের বিষয়টিই মূল্যহীন হয়ে গেছে। বস্তুত, যে বিচারে মানবিকতার স্পর্শ না থাকে তা কখনই ন্যায়বিচার হতে পারে না। সমাজের দরিদ্র, নিঃসহায়, প্রান্তজনদের প্রতি রাষ্ট্রের, বিশেষত ন্যায়ালয়ের আচরণের কুৎসিত বৈষম্য প্রকট হয়ে পড়েছে।

    বলপূর্বক উচ্ছেদে ভারতের শীর্ষ-আদালত নেতৃত্ব দেওয়ায় অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। মানবাধিকার সংক্রান্ত ৭ জন স্পেশাল রিপোর্টার গত ১৬ই জুলাই ভারত সরকারের কাছে উপযুক্ত বসবাসের ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন ছাড়া এই জবরদস্তি উচ্ছেদ বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে বলেছে, “সরকার তার নিজেরই ঠিক করা ২০২২ সালের মধ্যে গৃহহীনতার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য স্মরণ করে এই ১ লক্ষ গরিব মানুষদের অবিলম্বে ঘরের ব্যবস্থা করুক। ভারতীয় শীর্ষ আদালতের রায়ে এই মারাত্মক সংক্রমণ সময়ে অন্তত ২০০০০ শিশু গৃহহীন হবে। ভারতীয় আদালতের উচিত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ডের আলোকে বিচার করা”।

    রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল, বলপূর্বক উচ্ছেদে অসাম্য, সামাজিক সংঘাত বৃদ্ধি করে এবং প্রান্তিক মানুষ বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসীদের জীবনকে চরম দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করে দেয়। আর নারীদের যৌন নিপীড়ন এবং পাচারসহ জঘন্যতম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়। সম্প্রতি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, বলপূর্বক উৎখাতের কারণে শিশু ও মায়েদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘস্থায়ী এবং বহুমাত্রিক ভয়াবহ প্রভাব। অধিকাংশ মায়েরা অবসাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয় এবং শিশুরা হয় স্থায়ী দুর্বল স্বাস্থ্য ও মানসিক অস্থিরতার শিকার, তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যায় (Eviction’s Fallout: Housing, Hardship and Health, Desmond & Kimbro, Harvard University, 2015)। একই প্রতিফলন পাওয়া গেছে অসরকারি সংস্থা ইন্দো গ্লোবাল সোশাল সার্ভিস সোসাইটি (IGSSS)-এর গবেষণায়। দেখা গেছে, গৃহহীনদের মধ্যে ৮০% দলিত আর অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষ। ৪১.৬% গৃহহীনরা ন্যূনতম সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পান না। মাত্র ১৮% গৃহহীনেরা গণসরবরাহ ব্যবস্থার সুযোগ পান। ২০১১ সালের জনগণনায় ১৭.৭ লক্ষ মানুষ গৃহহীন ছিল। অসরকারি গবেষণায় প্রাপ্ত সংখ্যাটি বর্তমানে বেড়ে ৩০ লক্ষেরও বেশি। ভারতের বুকে প্রতি দিন ৫১৯ জন অর্থাৎ ঘণ্টায় ২২ জন দরিদ্রকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে উৎখাত করা হচ্ছে। খোরিগাঁও-এর লক্ষাধিক মানুষের সামান্য কয়েকজন ভাগ্যবান মানুষ মাথার উপর ছাদ জোটাতে পারবেন আর অধিকাংশই আশ্রয়হীন, পরিচয়হীন, অস্তিত্বহীন নেই-মানুষ হারিয়ে যাবেন বহু অনাগরিকের ধূসর জনারণ্যে; দেশের গৃহহীন মানুষের সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়বে এই মাত্র। জীবনের নিশ্চয়তাটুকুও হারিয়ে ফেলা নিম্নবর্গের প্রান্তজনদের এই আতঙ্ক, অসহায়ত্ব, সংবিধানের প্রতিপালক, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেওয়া উচ্চবর্গের এলিট সমাজের প্রতিনিধি রাজনীতিক, বিচারপতি, প্রশাসক, আধিকারিকদের দৈনন্দিন যাপনে, চৈতন্যে দাগ কাটবে না এতটুকু।

    মানবাধিকার রক্ষার বিভিন্ন আইন, চুক্তিপত্র, নীতিমালা, প্রতিশ্রুতি কাগজেকলমে থাকলেও বাস্তবে পৃথিবীজুড়েই ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে অধিকারের সংজ্ঞা ভিন্নতর। ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে মেনে পেটের দায়ে শহরে আসা দরিদ্র, প্রান্তজনেরা বিবেচিত হয় বহিরাগত আর জবরদখলকারী হিসেবে, অন্যদিকে সমাজের উচ্চবর্গের স্বচ্ছল, ধনীরা স্বাগত হয় শহুরে উন্নত জীবনে। আর, শহরের উন্নয়নে কখনো খালপাড়ের ঝুপড়িবাসী, কখনো নোনাডাঙ্গার বস্তিবাসী কখনো লক্ষ মানুষের খোরিগাঁও বস্তিবাসীদের বেদখলকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে হৃদয়হীন নির্দয়তার সঙ্গে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র।



    তথ্য সূত্রঃ দ্য ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য হিন্দু, লাইভ ল, এনডিটিভি, দ্য ওয়্যার, The Unsang Citymakers, IGSSS, Understanding Homeless in delhi, IGSSS, Report on Eviction Impact, HRLN, 1.77 Mn Indians Are Homeless. 40% of Them Are Getting No Lockdown Relief, India Spend, UN Committee on Human Rights Resolution 1993/77, UN Committee on Human Rights Resolution 2004/28, UN Guiding Principle on Internal Displacement 1998, UN Habitat for Better Urban Future (Forced Eviction)1914, Eviction’s Fallout: Housing, Hardship and Health, Desmond & Kimbro, Harvard University, 2015.
    ছবি: The Economic Times


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৩ আগস্ট ২০২১ | ১৮৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন