[এবারের নির্বাচনে বিজেপি কি আসলে ছিল কাগুজে বাঘ।এত ঢাকঢোল পিটিয়ে,এত মণ তেল পুড়িয়ে মোদী-অমিত শাহর দল কেন লোক হাসানোর ফল করল তা নিয়ে ৩৩৩ রকমের অ্যানালিসিস হয়ে গেছে। বিজ্ঞজনেরা যে এ নিয়ে আরও কাটাছেঁড়া করবেন সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। তারই মধ্যে এলোমেলো কিছু ভাবনা নিয়ে হাজির হয়ে গেল এই লেখাটি।এ তথ্য কারও মানার যেমন দায় নেই তেমন কোনও দাবিও নেই। আসলে লেখাটা এক হরিদাস পালের ‘মন কি বাত’।]
২০২১ এর ভোটে বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক একটা শক্তিকে রুখে দিতে এই বিপুল পরিমাণ জনসমর্থন তৃণমূল কংগ্রেস কী ভাবে পেল সেটাই এই মুহূর্তে অন্যতম চর্চার বিষয়। পাশাপাশি এই ভোট বাজারে ঢাকঢোল পিটিয়ে জোট করেও বাম-কংগ্রেসের ভোটের ঝুলি কী ভাবে এমন ফাঁকা হয়ে গেল তা নিয়েও চলছে জোর জল্পনা। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনেক ভাবে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।সমাজকর্মী, শিল্পী, লেখক, ডাক্তার, মুদি দোকানদার থেকে শুরু করে নিয়মিত টিভিতে ঘন্টাখানেক খিস্তি খেউর দেখা বলরাম বটব্যালও পাড়ার চায়ের দোকানে বসে নানা ইকোয়েশনের জাল বুনছেন। ফ্যাশন ডিজাইনার থেকে ফলওলা, ব্লগার থেকে ব্যাংককর্মী সকলেই কোনও না কোনও ভাবে ঢুকে পড়েছেন এবারের সবচেয়ে দীর্ঘ, আলোচিত,চর্চিত,বিতর্কিত এই ভোট পক্রিয়ায় আলোচনায়। আসলে এবারের ভোট শুধুমাত্র পার্টি, দলীয় কর্মী, সমর্থক আর কিছু সুবিধেবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এবারের ভোটে বিপুল ভাবে সামিল হয়ে পড়েছিল সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ।বিজেপির মত আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে রুখে দেওয়ার প্রয়োজনটা অনুভূত হয়েছে সেই সিভিল সোসাইটির অন্দর থেকেই।
নো ভোট ফর বিজেপি
কোনও একটা বিশেষ দলকে ভোট দেবেন না – এমন প্রচার সম্ভবত ইতিপূর্বে বাংলার ভোটবাজারে হয় নি। এর আগে বিজেপি কখনও বাংলায় ক্ষমতাসীন থাকে নি। ফলে কংগ্রেস, বাম, তৃণমূলের মত দলকে শাসন ক্ষমতায় দেখলেও বিজেপি আসলে কি জিনিস তা বাংলার মানুষ দেখে নি। অনেকেই চাইছিলেন বাংলায় একবার হলেও বিজেপি ক্ষমতায় আসুক। মানুষের ভুল ভাঙাতে কাজে নামল সেই সিভিল সোসাইটি।‘নো ভোট ফর বিজেপি’র স্লোগানে একাত্ম বোধ করল বিজেপি বিরোধী প্রায় সব ধরণের মানুষ। তারা তুলে আনল হাথরসের ঘটনা, দিল্লির দাঙ্গার চিত্র, কৃষি আইনের বাস্তব ছবিগুলো।বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় কী রামরাজত্ব চলে তার চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠল সোশ্যাল মিডিয়া। যদিও বিজেপিকে না দিয়ে কাকে ভোট দিতে হবে সে চিন্তা/ দায়িত্ব সাধারণের উপরই ছেড়ে রাখা হল। এই ভোট বামেরা বা কংগ্রেসও পেতে পারত। কিন্তু বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকেই একমাত্র নির্ভরযোগ্য দল হিসেবে মনে করল মানুষ। তাই বাম – কংগ্রেস জিরো হলেও দলহীন সাধারনের ভোটে হিরো হয়ে গেল তৃণমূল।
বিপুল হারে ভোট দিয়েছে মানুষ
এবারের আট দফাতেই বিপুল হারে ভোট দিয়েছে মানুষ। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে গত ২৭ মার্চ প্রথম দফার নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮৪.৬৩ শতাংশ। ১ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ৮৬.১১ শতাংশ এবং ৬ এপ্রিল তৃতীয় দফায় ৮৪.৬১ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এইভাবেই প্রতিটি দফাতেই বিক্ষিপ্ত হিংসা সত্ত্বেও বিপুল হারে ভোটদানে সন্তোষ প্রকাশ করেছে কমিশন। তবে যত বেশী ভোট পড়েছে ততই তা শাসক দলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে আওয়াজ তুলেছিলেন একশ্রেণীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বলা হচ্ছিল বর্তমান জমানার বদল ঘটাতেই বিপুল হারে ভোট দিচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ মানুষ বদল চাইছে। এ নিয়ে বিজেপিওয়ালারাও কম হইচই করেন নি। তবে ফল বেরোতেই অসাড় প্রমাণিত হয়েছে এ তত্ত্বের সারবত্তা। আসলে এবার শুধুমাত্র বিজেপিকে হারাতেই ভোট দিতে গিয়েছেন অনেকে। সাধারণত নির্বাচনের সময় অনেক বামমনস্ক/ স্বাধীন ভাবনার মানুষ ভোট দেওয়া থেকে ১০০ হাত দূরে থাকেন। হয় তাঁদের ‘এই গণতন্ত্রে বিশ্বাস নেই’, নয়তো ‘এই সব প্রার্থী মোটেই পছন্দ/যোগ্য নয়’ অথবা আরও ১০১ টা কারন কাজ করে। বিবেকের তাড়নায় এবার ভোট দিয়েছেন এই সব মানুষেরাও। বাম, অতিবাম বা কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন হলেও তাঁরা এবার ভোট দিয়েছেন তৃণমূলে। কারন তাঁরা হয়ত এমনটা বুঝেছেন যে বাম/কংগ্রেসকে ভোট দিলে তা নষ্টই হবে – বিজেপিকে ঠেকাতে তা কোনও কাজে আসবে না। এছাড়া প্রয়োজন হলে বিজেপিকে রুখতে ভোটের পর বাম/কংগ্রেস যে মমতার দলকে সমর্থন করবে এমন কোনও ঘোষণাও করা হয় নি। বস্তুত বাম/কংগ্রেস একইসঙ্গে সমানতালে তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধিতা চলিয়ে গেছে – যা মোটেই ভরসা জোগায় নি ভোটারদের। তাই বিজেপিকে রুখতে এই প্রথম বিপুল হারে মমতার দলকেই ভোট দিয়েছে মানুষ।
বাম-কংগ্রেসের ভোট গেল কোথায়
এই রাজ্যে বাম- কংগ্রেসের একটা দলগত ভোট আছে। অর্থাৎ যাঁরা পার্টিটা করে অথবা পার্টি ঘনিষ্ঠ তাঁদের ভোট। এর বাইরে আছে বামমনস্ক মানুষের ভোট ও কংগ্রেসমনস্ক মানুষের ভোট।ভোট বিশ্লেষকদের দাবি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামমনস্ক ভোটারদের ৫ ভাগের ২ ভাগ গিয়েছিল বিজেপির দিকে। কিন্তু এবার তা উল্টে গেছে। এবার বামমনস্ক ভোট বেশির ভাগই তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গিয়েছে। হিসেব বলছে বামফ্রন্ট ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার সেটা কমে হয়েছে ৫.৬৭। কংগ্রেসের ভোট ৫.৫ থেকে কমে হয়েছে ২.৯৩ শতাংশ। ফলে একথা বলাই যায় যে সামাজিক প্রয়োজনের কথা ভেবেই বামমনস্ক মানুষের ভোট ও কংগ্রেসমনস্ক মানুষের ভোট এবার তৃণমূলের দিকে গেছে।
বাম মনস্কতাই কিন্তু ভবিষ্যৎ
এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বেনজির সঙ্কটের মুখে বামেরা। বিধানসভা নির্বাচনে কোনও আসনেই জিততে পারেনি তাঁরা। সিপিএমের তো ভরাডুবি হয়েইছে, একই দশা অন্য শরিকদেরও। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে, এবার নোটায় ভোট পড়েছে ১.০৮ শতাংশ। অন্যদিকে, সিপিআই পেয়েছে ০.২০ শতাংশ। আরএসপি পেয়েছে ০.২১ শতাংশ ভোট। অনেকেই গেল গেল রব তুলেছেন। এই হারের কারন নিয়ে মুখ খুলছেন একের পর এক নেতা। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় তো পরিস্কার বলেছেন, “ সংযুক্ত মোর্চা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিকে আটকিয়ে বাংলার মানুষর সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে।” আর এই কাজটা হয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই। কারন বিজেপির মত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রুখে দিতে এই মুহূর্তে তাঁর অবস্থানটাই সবচেয়ে বেশী বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেছে মানুষ। এবারের ভোটে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে হারাতে অন্তরাত্মার ডাকেই কবিতা লিখেছেন কবি, লাগাতার প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবন্ধকার, গান বেঁধেছেন অভিনেতা-শিল্পীরা, প্রতিবাদে-প্রতিরোধে ভরে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া। বাংলাকে বাঁচাতে ঐতিহাসিক সঠিক কাজ করেছে সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ। তবে ভবিষ্যতে বিজেপি- আরএসএসের মত শক্তির আগ্রাসন থেকে কী বাংলাকে বাঁচাতে পারবে একইসঙ্গে ‘ধর্ম ও জিরাফে’ থাকা তৃণমূল। প্রশ্নটা থাকছেই। এই অবস্থায় বাংলার মাটিকে দুর্জয় ঘাঁটি গড়ে তুলতে ভবিষ্যতে মানুষের এই আস্থাকেই ফের নিজেদের ঝুলিতে ফেরাতে হবে বামেদের। এবারের ভোটে বামেদের যে আধুনিক, সাহসী, শিক্ষিত নবীন প্রজন্মের দেখা মিলল তারা নিশ্চয়ই সে পথে হাঁটবেন,আশা থাকুক এমনটাই।