এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • করুণা তব অবিশ্রাম জননে মরণে

    Abhishek Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ মার্চ ২০২১ | ১৪২৮ বার পঠিত
  • রত্নাকর অনন্ত সম্পদে চিরকাঙ্ক্ষিত, সাগরের টানে টানে কত কত যে হৃদয় পাগলপারা হয়!


    কালিদাস রঘুবংশমের প্রারম্ভে বলছেন, সুমহান রঘুবংশ প্রায় দুষ্প্রবেশ্য, বুদ্ধি আর জ্ঞানের সূক্ষ্মতায় তাকে উপলব্ধি করতে হয়। সেই বংশভূত খ্যাতনামা নৃপতিরা সাগরের মতই ক্ষেত্রবিশেষে করাল ও চির আকর্ষণীয়। তাই তো কালিদাসের মতো কবিরা তাঁদের মায়ায় বাঁধেন বারবার। 


    রত্নাকর বনের পথে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করছিল। হাতে শাণিত দাত্র। জঙ্গল এখানে ঘন, নিবিড়। ঘনায়মান অন্ধকার ছেয়ে ফেলছে বনভূমি। ক্রমে ক্রমে জেগে উঠবে অন্ধ তমিস্রা। তমঃ। মানুষের অন্তঃকরণের মতই যেন দুষ্প্রবেশ্য এই অরণ্য। এখানে একস্থানে পোঁতা আছে লুঠের ভার। ভূমির গভীরে সুপ্ত আছে মাণিক্যের দীপ্তি। কী দুর্দম তার আকর্ষণ অথচ এক নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা প্রতি মুহূর্তে।


    আজ যদি রত্নাকরের জীবনে কোনও দুর্ঘটনা নেমে আসে, এ ধন ভাণ্ডার ডুবে যাবে কালের অতলে। কিন্তু রত্নাকর মরণোত্তর জীবনেও কি কাটাতে পারবে এ গুপ্তধনের মায়া। কী জানি। রত্নাকরকে বোঝা ভার। তার হৃদয় বজ্রকঠিন। স্নায়ু ইস্পাততুল্য। সুকুমারবৃত্তির স্ফুরণ তার ব্যক্তিত্বে নেই, দয়াধর্ম তার কাছে দূর অতীত, ক্ষমাগুণ সুদূর অনাগত ভবিষ্যতের মতোই অকল্পনীয়। সহৃদয়রা বলেন বটে, ক্ষমা বীরধর্ম। কিন্তু যে অন্যায় আক্রমণে মানুষের জীবনদীপ নিভিয়ে দেয় নিমেষে, নির্বিশেষে - - - তার কাছে এসব অর্থহীন। রত্নাকর দস্যু। জীবনহরণ তার পেশা। সে কালান্তক যম। জীবনের মরীচিকা তার জন্য নয়। পথিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবনদীপ নিবিয়ে দেওয়াই তার কাজ। চরম বাস্তব এটাই। একমাত্র সত্যসার।


    নিদ্রাদেবী যখন দিনের শেষে আলিঙ্গন করেন সুষুপ্তির বেশে, কেউ যেন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে, "জীবন যদি দিতেই না পারো, জীবনহরণের কী অধিকার তোমার?" হৃদয়ের গোপন কোন্ পুর থেকে কী যেন নিঃশেষে নির্গত হতে চায়! কী তা রত্নাকর বোঝে না, বাহ্য জীবন নিয়ে তার কারবার, পরিবারের প্রতিপালন, জীবধর্মের যাপন - - - এই-ই তো পুরুষের করণীয়, তা-ই বোঝে রত্নাকর, কিন্তু কোথায় যেন একটা ঝঙ্কার তোলে কিছু। শঙ্কুলায় যেন বিখণ্ড হতে তার সত্তা। ধীরে ধীরে।


    রত্নাকর সমুদ্রের মতই দুরধিগম্য, নিঃসীম।


    তার আয়ত দুই নেত্র যেন অতলে আহ্বান জানায় - - "এস, ভয় কি?" কোন্ মায়া শক্তি আর মোহপাশ আছে যেন সে দুটি নয়নে, গ্রীষ্মদিনের কাকচক্ষু দীঘির মত স্থির, কিন্তু অতল। ক্ষণে ক্ষণে সে নয়নে বাড়বানল জ্বলে, আগ্নেয়গিরির মত স্ফুরিত হয়, আবার হিমানীর প্রবল শৈত্য নেমে আসে। 


    দস্যুদলের বাকিরা তাকে সর্দার মানে। দস্যুতা তার রক্তে উষ্ণস্রোতপ্রবাহ আনে। সমুদ্রের জলে নদী মিশে যেমন আলোড়ন তোলে, শাণিত অস্ত্রের দ্যুতি আর চিকন শোণিতপ্রবাহ তাকে উত্তেজিত করে। শোণিত-পিশিতের হোলিখেলায় সে কি জীবনকে দ্বিখণ্ডিত করে করে অন্বেষণ করতে চায়? কী খোঁজে সে?


    রত্নাকরের গোপন ধনভাণ্ডার তাকে যেন বিদ্রূপ করে। লাশের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কে যেন বলে, তোমার অর্থ ও কাম উভয়ই অধর্ম। জীবনে ধর্ম না থাকলে আর তার অস্তিত্ব কোথায়?


    রত্নাকর এত কিছু বোঝে না। বুঝতে চায় না। চ্যবন ঋষির পুত্র সে। ভাগ্যচক্রে সে দস্যু। আর পাঁচটা বৃত্তির মতই দস্যুবৃত্তি। ব্যাধ তো জীবিকার জন্য প্রাণহনন করে, তার দোষ কোথায় তাহলে?


    রত্নাকর নিঃসাড়ে বৃক্ষতলে ঘনায়মান অন্ধকারে এসে দাঁড়ায়। এখানে অরণ্য তত গভীর নয়, বনপথ এসে মিশেছে জনপদের প্রান্তে। বণিকরা এ পথে তাদের পণ্যভার নিয়ে নগরের দিকে যায়। এখন সন্ধ্যা আসন্ন। এ সময় যাতায়াতের পক্ষে নিরাপদ নয়। কিন্তু সংবাদ আছে, গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে বণিক সর্বার্থসিদ্ধি এ পথে যেতে পারেন। সঙ্গে রাজরক্ষীর দল থাকবে। কিন্তু সম্মুখসমরে রত্নাকর অজেয়।তার অনুচরগণ আশেপাশেই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। অশ্বের পদধ্বনি শোনা গেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে একযোগে।


    অন্তরের কথা অন্তর যার সে হয়ত বোঝে না, কিন্তু অন্তর্যামী জেগে থাকেন অনুক্ষণ।


    তা নাহলে, বণিক সর্বার্থসিদ্ধির পরিবর্তে পথের প্রান্তে অপর কে দেখা দেয়? প্রশান্তকায়, অচঞ্চলচিত্ত এক যোগী বীণা হাতে এসে দাঁড়ান। রত্নাকরের উদ্যত খড়্গ স্তব্ধ হয়। 


    "কী আছে আপনার কাছে?"


    "শ্রেষ্ঠ ধন" উত্তর আসে।


    "শীঘ্রই রিক্ত করে দিন কোশ, যদি জীবিত থাকতে চান।" 


    "পুত্র! এ ধন নিঃশেষিত হওয়ার নয়, দানে এ শতসহস্রগুণ বৃদ্ধি পায়।"


    "ছলনা করে লাভ নেই। দেখান আপনার কোশ।"


    অন্তরে যে ধন আছে, তাকে দেখতে গেলে অন্তর্দৃষ্টি লাগে যে। তুমি আমার অন্তেবাসী হও। নিঃশেষে উজাড় করে দেব জ্ঞানভাণ্ডার। অন্তরে যে অচিন পাখির বাসা, তার রোদন কি শুনতে পাও না? শ্রবণ কর, ঐ যে দেখ বৃক্ষশাখায় উপবিষ্ট দুটি পক্ষী, তাদের একটি হলে তুমি। ভোগতৃষ্ণাতুর, জ্ঞানহীন। জেগে ওঠ রত্নাকর! ফিরে তাকাও অন্য পাখির পানে। দেখ! সে কেমন অবিচল আর নিঃস্পৃহ। ঐটি তোমার চিরকালের মিতা, তোমার অন্তরাত্মা। তাকে জান। শান্তি পাবে। পাবে পরম জ্ঞান। ঐটিই তোমার পরম ধন। বনভূমির গভীরে সঞ্চিত মাণিক্য তার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ।"


    চমকে ওঠে রত্নাকর। ইনি কি গ্রহবিপ্র?


    দীঘল কালো অচঞ্চল আয়ত আঁখিদুটি বিস্তার করে মেপে নিতে চায় আগন্তুককে।"কে আপনি?"


    " আমি দেবর্ষি নারদ। তোমাকে পাপমুক্ত করতে এসেছি।"


    "পাপ? কীসের পাপ? "


    "অগণ্য নরমেধের। এর একমাত্র শাস্তি নরকগমন। এ পাপের ভার বহন করবে কীভাবে তুমি জন্মজন্মান্তর?"


    মৃদু হাসে রত্নাকর - -" ক্ষুধার উদ্রেক হলে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়। আপনি তো অন্তর্যামী। অপার জ্ঞানী। পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় না? আমি পরিবারের প্রতিপালনের জন্যই পাপাচার করি। কোনও কঠিন কাজ এককভাবে সাধ্য না হলে সঙ্ঘশক্তিতে সাফল্য আসে। আমার পাপের ভাগ বহন করবে আমার ভার্যা-অপত্য-জননী-পিতা। তারা সকলেই তো আমার অন্নেই প্রতিপালিত।" আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে রত্নাকর।


    " বেশ। তবে যাও। জেনে এস তারা এই ভাগ স্বীকার করবে কিনা।"


    ভগ্নদূতের মত ফিরে আসে রত্নাকর। এ কী হল আজ? যে পরিবার তার জীবনের প্রতিরূপ, সেখান থেকে এমন নির্মম প্রত্যাখ্যান আসা তার কল্পনাতীত। পরিবারে সে ভর্তা, পিতা, পুত্র, পালক, রক্ষক। যে অর্ধাঙ্গিনী তার জীবনের মিতা সেও বলে দিল - - পরিবারের রক্ষণের ভার যার তার কর্মের ফলও একান্তই তার। তার কোনও অপচ্ছায়া পরিবারকে ক্ষতিপূরণ স্পর্শ করবে না। হা বিধি! পুণ্যফল প্রদেয়। কিন্তু পাপকর্মার পাপের ফল কেউ স্বীকার করবে না। রাজার পাপ কখনও প্রজাকে স্পর্শ করে না। রাজাই সে পাপে বিনষ্ট হয়।


    আজ যেন পৃথিবীকে নতুন করে চিনতে পারে রত্নাকর। তারপর এক অবশতা তাকে গ্রাস করে। অন্তর কি এই বার্তাই পাঠাত শয়নে-স্বপনে? কার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে তার সুষুপ্তি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছে? এক ব্যাকুল রোদন আর্তনাদ হয়ে নির্গত হতে চায়। 


    "ঠাকুর!!!" 


    স্মিত হাস্যে পতিত রত্নাকরকে আলিঙ্গন করেন নারদ। 


    "বুঝলে তো এবার? কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ?" 


    " হে দেব! আমার মুক্তির কি কোনও উপায় নেই?" নিরূদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে রত্নাকর। তার অন্তঃকরণে কে যেন তরঙ্গ তুলে দিয়েছে। অপার সংসারে ভেলার মত দোল খাচ্ছে জীবন, পদ্মপত্রে বারিবিন্দুর মত অস্থায়ী।"


    তার মনের কথার অনুরণন করে নারদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় - - - "একমাত্র সত্য কর্ম। সুকৃত অথবা দুষ্কৃত, নির্ধারণ করবে তোমার ভবিষ্যত। সোনার তরী এসে নিঃশেষে নিয়ে যাবে তোমার শোভন কর্মরাজি। জগতের দিকে চাও একবার রত্নাকর। তার আনন্দধ্বনি কি গভীর রবে তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করে না? মধু বাতা ঋতায়তে। সময় থাকতে সাধন কর। বাঁধন ছেঁড়ার সাধন। পাবে পারানির কড়ি।"


    " কীসে আমার পাপক্ষালন হবে? "


    তুমি মানুষরতনের শরণ নাও। পৃথিবীতে যিনি নরচন্দ্রমা তিনি নিঃশেষে কলুষহরণ করবেন। নিজের হৃদয় খুঁড়ে পাবে তাঁকে। চক্ষুষঃ চক্ষুঃ তিনি, তোমার প্রাণের অন্তরালে তাঁর বাস। তাঁকে খোঁজ। তিনি তোমার মনের মানুষ।


    অতল সমুদ্রে হাতছানি দেয় রত্নরাজি। সে পার্থিব মরীচিকা নয়, অপার্থিব তার দ্যুতিতে সকল অবিদ্যার নাশ ঘটে বিদ্যার পুণ্যপ্রকাশ।


    বাল্মীকি আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। কতদিন কেটে গেছে? পক্বশ্মশ্রু, পলিতকেশ, আনত জটাভার, অজিনবাস। পরিবার? যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি। আজ তিনি উপলব্ধি করেছেন দস্যু রত্নাকরের হৃদয়ের গোপন বাণী। কী যে এক অব্যক্ত নিরুদ্ধ বোধ উচ্চকিত হয়ে প্রকাশ পেতে চাইত। এখন বুঝি বসন্ত। কুহুরবে তারই অভিজ্ঞান। কী সেই অভিব্যক্তি রত্নাকর বুঝত না। বাল্মীকি বোঝেন। শোক। পুঞ্জীভূত কারুণ্য। এই অনুভূতি অর্জন করেই রত্নাকর আজ বাল্মীকি। ক্রান্তদর্শীর হৃদয়ের কোন অতলের দুর্মর মর্মগাথা তিলে তিলে জমে জমে বেদনার ভার বাড়িয়ে তোলে। অনু-পরমানু প্রবল বিক্ষোভে স্ফুরিত হয়। ক্রান্তদর্শী হন কবি। সকলেই কবি হয় না। কেউ কেউ কবি হন। আজ বুঝি সেই ক্রান্তিকাল সমাগতপ্রায়।


    এখন মধুঋতু। সমাগত রোদনভরা জাগ্রত বসন্ত। প্রকৃতির রূপে এক পরিপূর্ণ মাধুর্য, এক অনির্বচনীয় দীপ্তি। ছন্দ যেন বন্ধনরহিত হয়ে সুরধুনীর মত বহমান হতে চায়। অনাদিকালের সঞ্চিত বার্তা যেন প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে, তার অভিঘাত এসে ঝঙ্কার তুলছে ঋষির হৃদয়তন্ত্রীতে। জন্মান্তরীণ বেদনার মধুধারা যেন প্রকৃতির নীরব আনন্দপ্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠছে পরমাস্বাদ্য, সেই ফল্গুধারার তীব্র বেদন যেন পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে মুক্তধারা হতে চায়। বাগ্দেবীর মানসসরসে হংসবধূর কলধ্বনি হৃদয়ের কমলবনে তুলছে কলতান, অনাদি-অনন্তকালের রুদ্ধ বাণীর ছন্দোময়ী তনু বুঝি আত্মপ্রকাশ করতে চায়... করধ্বনি করে জিহ্বায়, হৃদয়ে, মস্তিস্কে। গোপন রেখ না। তোমার বীণাধ্বনি শতধারায় উত্সারিত হোক। 


    কি হল আজ?


    অকস্মাৎ আচ্ছন্নতা যায় ঘুচে। তীব্র আর্তনাদ কর্ণকুহরে যেন বজ্রাঘাত করে। কোনও এক ব্যাধের শাণিত তীর গিয়ে বিঁধেছে মিলনোন্মুখ এক ক্রৌঞ্চের বুকে। মরণ এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রাণ, বিহ্বল ক্রৌঞ্চীর হৃদয় বিদীর্ণ করে নির্গত হতে থাকে আর্তরব। বনভূমি শোভা নিমেষে যায় ঘুচে, কী এক অপার্থিব কারুণ্য মুহূর্তে আনন্দ থেকে পরিণত হয় শোকে। শোক! শোক! অন্তর বিদীর্ণ করে উদ্গত হয় শোক, ধরিত্রীর প্রতি কণায় ঝরে পড়ে শোক, বৃক্ষের পল্লবে, পল্লবিত পুষ্পে, পুষ্পিত কাননে এক পুঞ্জীভূত শোক পাক খায়, অনাদিকালের বেদন, শোক হয়ে ঝরে পড়ে বনভূমির ঘাসে ঘাসে।


    মূর্তিমান ব্যাধ যেন জান্তব জিঘাংসা, রিরংসা আর আক্রোশ নিয়ে প্রতীয়মান হয়। যেন সেই বিস্মৃত অতীতের রত্নাকর মুহূর্তের জন্য অট্টহাস্য করে ওঠে। বিদ্রূপ করে ওঠে শ্বাপদবৃত্তি পার হয়ে মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ এক নবজাতককে। সেই উচ্ছল উদ্বেল অশান্ত রত্নাকর আজ স্নিগ্ধ, স্থির, অচঞ্চল ।তবু কি অশান্ত ঢেউ ওঠে আবার সমুদ্রে? বাল্মীকি অতীত প্রতিচ্ছবিকে সম্মুখে দেখে বিমূঢ় হন, ক্রোধে, আত্মধিক্কার উঠে আসে, এবার বুঝি প্রকৃত আত্মসাক্ষাত্কার হল। নিজেকে জানা হল বুঝি শেষ। হল পাপক্ষয়। আত্মানং বিদ্ধি। পাপের পারাবার থেকে উঠে এসে আলোকধারায় পুণ্যস্নাত হল দেহ। হৃদয় হল বুঝি নিষ্কলুষ। তখনই পুঞ্জীভূত শোক ক্রোধের স্ফূলিঙ্গের নমস্কার স্পর্শে বিস্ফোরিত হল, বিদীর্ণ হল হৃদয়, জিহ্বা পেল প্রাণ, অনাদিকালের সঞ্চিত বেদনা মুক্ত হল জাড্য থেকে। নির্গত হল আদি বাণী। আদিকবি বলে উঠলেন... "মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং...." এ যেন যুগসঞ্চিত যন্ত্রণার মূলে কুঠারের অভিসম্পাত, পশুবৃত্তির ঊর্ধ্বে মানবের অনন্ত যাত্রাসঙ্গীত। সুরের আলো বুঝি ভুবন ছেয়ে ফেলল। নির্মল বিশুদ্ধ শোক প্রাণ পেয়ে হয়ে উঠল ছন্দোময়ী বাণী, শ্লোক। বিধাতার এ কী লীলা!! সৃষ্টির পরমাকাঙ্ক্ষিত এই শুভক্ষণে চরাচর যেন অমিতপ্রভায় অবগাহন করল। বিধাতা স্মিত হাস্যে যেন বলে উঠলেন---


    "যাবত্ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে, তাবত্ রামায়ণী কথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি।"


    আরও একটা অন্ধরাত। গহন তমিস্রা ঘিরে ধরেছে আরও এক অরণ্যভূমি। সূচীভেদ্য অন্ধকার। রত্নাকরের অতীত জিঘাংসা আবার যেন মূর্ত হয়ে উঠল। শব্দভেদী বাণ হাতে নিঃশব্দে ছায়াতরুর তলে জমে ওঠা অন্ধকারে এসে দাঁড়ালেন দশরথ। অযোধ্যাপতি। সারা দিনমান মৃগতৃষ্ণিকায় যেন বিভ্রান্ত হয়েছেন। ধরা দেয়নি কোনও শিকার। কোন্ দুর্নিবার মোহপাশ করাল হাতছানি দেয়, হৃদকন্দরের গহন অন্ধকারে কোন মায়ামৃগের স্বর্ণদ্যুতি চোখ ধাঁধিয়ে দেয় বারবার, জীবন বড় রহস্যময়। জীবনের ঘন অরণ্যে এভাবেই দিক্ভ্রান্ত হয় মানুষ, তমসাচ্ছন্ন ঘনান্ধকারে প্রবঞ্চিত হয়। কীসের শব্দ আসে ঐ? উদ্ভাসিত হয় দশরথের মুখমণ্ডল, হরিণ!! পিপাসার্ত হরিণ নদীকুলে শান্ত নীরে আলোড়ন তুলে পান করছে জল। আকণ্ঠ। জীবনে এমন করুণাধারা আসবে কবে? অকরুণ অনায়াস লক্ষ্যে দশরথ ক্ষেপণ করলেন শব্দভেদী বাণ। অভ্রান্ত নিশ্চিত লক্ষ্য, বাণ ছুটে যায় শব্দের উত্স মুখে।


    অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধু এসেছিল পানীয় জল আহরণে। কুটিরে অন্ধ অসহায় পিপাসার্ত পিতা। অকরুণ জীবন নিঃশেষে ছিনিয়ে নেয় প্রাণ, হাহাকার করে ওঠে বনপ্রকৃতি। বিদ্ধ ক্রৌঞ্চের মত ছটফট করে সিন্ধু, তারপর স্থির হয়ে যায় নিঃশেষে। সকল লীলাচঞ্চল জীবনজ্যোতি নিশাবসানের স্বপ্নের মত বিলীন হয়ে যায়। জেগে থাকে অনন্ত শোক, উদগ্র মৃত্যু। 


    ভগ্নমনোরথ দশরথ মৃত বালককে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন বিনষ্টির প্রান্তে। অন্ধমুনির শোক ক্রোধ হয়ে যেন সাগর ছাপিয়ে উঠল। বর্ষিত হল অভিশাপ। শাপে বর হল। ঈশ্বর সেদিনও অন্তরাল থেকে ঈষত্ হাস্য করলেন। বাল্মীকি তার বাঁধলেন বীণাযন্ত্রে। ক্রমে রূপ নেমে অমৃতনিষ্যন্দী আদিকাব্য। সঙ্গীত হয়ে ঝরে পড়বে শোকগাথা, নিশীথরাতের বাদলধারা হয়ে। 


    দূর অতীতে হারিয়ে গেছে রত্নাকর। বাল্মীকিও ইতিহাসে প্রবেশ করেছেন। ব্যাধ, ক্রৌঞ্চযুগল, দশরথ, অন্ধমুনি, সিন্ধু - - - সবাই মিশে গেছেন কালস্রোতে, অন্ধকারে। রত্নাকর সমুদ্র আজও উচ্ছ্বল হয়, আবার নেমে আসে স্থির নীরবতা। পৃথিবীতে কাল কাটে, যুগ অতিক্রান্ত হয়। কিন্তু অনন্ত আনন্দধারার পাশেই বয়ে চলে অনন্ত শোকের ফলল্গুধারা। শ্বাপদবৃত্তি থাকে, জাগ্রত থাকে মানবতাও। কিছু শোক শুধু নিমজ্জিত হয় মরণসাগরে, কিছু শোক অনন্ত হয়ে ছুটে চলে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ করে, পাগলপারা হয়ে, মৃত্যু থেকে জেগে উঠে ছন্দোময়ী বাণী হয়ে অমৃতময় জীবনের দিকে, সৃজনোন্মুখ পরনির্বৃতির পানে।


    ©️অভিষেক ঘোষ
    সহকারী অধ্যাপক
    সংস্কৃত বিভাগ
    বাগনান কলেজ
    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন