পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
বোকা বাক্সর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় গেছে বাঙালির ভদ্রতা, শিষ্টাচার। দুপুর থেকে মাঝ রাত, টিভি চলছে তো চলছেই। একটার পর একটা সিরিয়াল। একটা এপিসোড মিস করলে গল্পের খেই হারিয়ে যাবে।কাজেই, বাড়িতে লোকজনের আসা যাওয়া একরকম বন্ধ। এখন প্রায় সব বাড়িতেই একাধিক টিভি সেট। কর্তা গিন্নি, ছেলে মেয়ে আলাদা ঘর, আলাদা সেট। কোনো বিবাদ নেই। সন্ধের পর সবাই ব্যস্ত। সোপ অপেরার দুর্নিবার আকর্ষন এড়ানো কঠিন। বেশিরভাগ গল্পের কাহিনী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চেনা ছক, খুবই পরিচিত। বিচ্ছেদ ছাড়াছাড়ি প্রেম হীনতা, আটপৌরে গল্পের করুণ পরিণতি! তাই এতো দেখার জন্যে টান। অবশ্যই শেখার কিছু আছে। সিরিয়াল অনেক নাম খুঁজে দিয়েছে। নামকরনের জন্যে যথেষ্ট। যেমন, সৌজন্য বা সঙ্কল্প! ভাঙা ঘর জুড়ে দিয়েছে আশ্চর্য ভালোবাসার জোরে! হানাহানি কেউই দেখতে চায় না। তাই দর্শক দের মন পছন্দ গল্পের খোঁজ। নিত্য নতুন প্লট। সিরিয়াল মিস করার উপায় নেই । বাড়িতে গেস্ট নট আলাউড। পায়রার খোপের মতো ঘর , আসবাব পত্রে ঠাসা। ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই। দেওয়ালেরও কান আছে। তাই প্রাইভেসি উধাও। চোখের ইশারায় কাজ সারতে হয়। অধিকাংশ পরিবারের এখন বিনোদন বলতেই টি ভি। কেউ কেউ যাকে বিদ্রুপ করে বলেন - বোকা বাক্স!
অতি সাবধানীরা যেখানে সেখানে মুখ খোলেন না। পাছে কথাটা পাঁচ কান হয়ে যায়। কেন না কে না জানে, দেওয়ালেরও কান আছে। সত্যিই আছে! এই যেমন, সেদিন এক হেভিওয়েট মন্ত্রী মাঝ রাতে ছুটলেন এক ডাক সাইটে নেতার বাড়িতে তার গোঁসা ভাঙাতে। ডিনার সেরে গাড়িতে উঠতে যাবেন, ছুটে এলেন একজন। জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিলেন – “কি দাদা, বরফ কি গললো? উনি কি দলের কাজে ফিরছেন?” মন্ত্রী দেখে হতবাক। খবরটা ফাঁস হলো কি করে? মিডিয়ার কানে খবরটা পৌছলো কি করে? ওদের জানার তো কথা নয়! কিন্ত মিডিয়ার কানে খবরটা আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছিল রহস্য জনক ভাবে।
মিডিয়ার জাল কোথায় নেই? সর্বত্র বিছানো। “প্রেস” লেখা গাড়ি দেখলে সবাই একেবারে তটস্থ।এই বুঝি সব কিছু ফাঁস হয়ে গেল!
এতো দিন শুনে এসেছি - শতং বদ মা লিখ। আজকের জমানায় বলতে হয় – শতং লিখ, মা বদ। মুখ খুললেই বিপদ। কে না জানে, বোবার শত্রু নেই। দেওয়ালের যেমন কান আছে, বোবার তেমনই শত্রু নেই। মুখ খুললেই মিডিয়া তিল কে তাল করে বসবে! অতএব মুখ খুলে কাজ নেই। প্রেস কে ভয় করে না, এমন লোক পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয় না। সত্যি বলতে কি, প্রেস ই তো দেশ চালাচ্ছে। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন, কলকাতায় শিক্ষকদের অবস্থান বিক্ষোভ, সংবাদ প্রকাশ হওয়া মাত্র দেশ তোলপাড়। সরকারি ফতোয়া জারি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিবেচনার আশ্বাস। কানে জল ঢোকাতে প্রেসের জুড়ি মেলা ভার! কাজটা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই আনন্দের।
নিন্দুকেরা প্রেসের লোকদের মনে করেন, ধর্মের ষাঁড়। ওরা যাকে খুশি গুঁতবে, কিন্ত ওদের কেউ কিছু বলতে পারবেন না । তাহলেই গেল, গেল রব! সংবাদ পত্র গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তার গায়ে হাত তুলবে, এমন সাহস কে দেখাবে? “প্রেস কার্ড” সঙ্গে থাকা মানেই দুনিয়া ঘোরার ছাড়পত্র। সর্বত্র প্রবেশাধিকার নিরঙ্কুশ। ঢুঁ মারা মানেই খবরে ছোঁ মারা। সকালে উঠে কাগজের হেড লাইন দেখে নেতার চোখ কপালে ওঠে । এতো কারোর জানার কথা নয়। খবরটা ফাঁস হলো কি ভাবে? খবরটা বেরুনো মাত্র পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। গদি থাকবে তো? অপসারণের ঘটনা ঘটেছে একাধিক। কাগজে কিছু বেরুনো মানেই অবধারিত ভাবে সত্যি।
“অসির চেয়ে মশি বড়”! এই প্রবাদ বাক্য আজকের দিনে একেবারে খাঁটি কথা। লেখালিখির ঠেলায় গদি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দেশে, বিদেশে। আকছার না হলেও একেবারে বিরল নয়। সত্যি ঘটনা ফাঁস হলে ঘোর বিপদ। বিশেষ করে, আর্থিক তছরূপের ঘটনা লোকের মুখে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তখন সমাজে মুখ দেখানো দায় হয়! জনসেবার হাজার বিপদ। জেলের ভাত যাবজ্জীবন। বোবার শত্রু নেই। যারা বাচাল, তাদের হরেক দুর্গতি! বেফাঁস কথার মূল্য চোকাতে হয় জীবন দিয়ে।
নতুন কনে বৌয়ের একটাই গুণ – “সাত চড়ে রা নেই”। ননদের মুখ ঝামটা, শাশুড়ির গঞ্জনা, দেওয়ের বোলচাল সব কিছুই নীরব থেকে হজম করে রাতদিন। ফলে, অশান্তি নেই। কেননা, এক হাতে তালি বাজে না। শকুন্তলার পতিগৃহ যাত্রা কালে কন্বমুনির উপদেশ, নতুন বৌ শিখা মনে রেখেছে। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। “থাকো সয়ে, পাবে রয়ে”। বেদ বাক্য শিখা তার দিদিমার মুখে খুব ছোট বেলায় শুনেছে। দুঃখ কষ্ট তাই গায়ে মাখে না। বাচাল মেয়েরা জানেই না – “সংসার সুখের হয়, রমনীর গুণে”!
সবলা নারী দেশের গর্ব। একাই দশভূজা। সাত চাল রক্ষা করে সবাইকে চমকে দিয়ে। এইসব নারী ভোটে দাঁড়ায়, মন্ত্রী হয়। বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে। আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কিন্তু সেই মেয়েই তো দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন! ছেলেরা যা পারে, মেয়েরাই বা কম কিসে? অথচ এই একুশে দাঁড়িয়ে তিন কন্যা সন্তানের মাকে চতুর্থ কন্যা জন্ম দেওয়ার অপরাধে পুড়িয়ে মারার খবর কাগজের পাতায় পড়তে হয়, এরচেয়ে পরিহাসের, পরিতাপের আর কি আছে? আমাদের আর কবে বুদ্ধি পরিপক্ক হবে?
কুড়ি সালটা যদি করোনার হয়, একুশ সালটা অবশ্যই মিডিয়ার। সামনে নির্বাচন। ভোটের হাওয়া শনশন করে বয়ে চলেছে। মিডিয়ার কাজ বেড়েছে তিন গুন। জেলা শহরে স্টুডিও খোলা হয়েছে। খবর দেখার দর্শক এখন রান্না ঘরেও। কে দল ছাড়ল, কে কোন দলের পতাকা হাতে তুলে নিল, তা জানতে বাড়ির মা জননীও টিভির পর্দায় চোখ রেখেছেন।
স্কুল কলেজের দরজায় এখনও তালা। ছেলে ছোকরারা এখন স্পষ্টতই দুভাগ। সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে একদল দিন রাত এক করে খেটে চলেছে। অন্য দল উন্নয়নের ধারা অটুট রাখার স্বপ্ন দেখছেন রাতদিন। এই মুহূর্তে লাস্ট মিনিট আর আহামরি ভোটের চমক কি? সিবিআইয়ের তালিকায় কাদের কাদের নাম আছে? পাচার চক্রের রাঘব বোয়ালরা কি আদৌ ধরা পড়বে কোনো দিন? এই মুহূর্তে কৌতুহল আর কৌতূহল! পরিবর্তনের পরিবর্তন কতজন চাইছেন? সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে যারা এগিয়েছেন, তাদের পক্ষেই বা আছেন ক'জন? গত দশ বছরে উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থাকলেও, কাজকর্ম কিছুই হয়নি, অতি বড় শত্রুও এমন কথা বলতে লজ্জা পাবেন। হাওয়া এখনই বেশ গরম। ইতিমধ্যেই দু চার জনের প্রাণ গিয়েছে। না জানি, আরও কতো জনকে আমাদের হারাতে হবে! আশার আলো এখন একটাই,খুব শীঘ্রই বাজারে করোনার টীকা আসছে। মানুষ অতিমারি ঠেকাতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসা দমনের উপায় কি? ষোল আনা নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। তবে কম কথা বলাই একমাত্র দাওয়াই। কথার পিঠে কথা বেরিয়ে আসবে। ঢিলের বদলে পটকা। অবশ্যই মন্ডা মিঠাই নয়। রসগোল্লা তো নয়ই!
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |