এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জন্মশতবর্ষেও নীরবতার অলিন্দে সঙ্গীতসাধক

    SOUMEN MUKHERJEE Official লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জানুয়ারি ২০২১ | ৬০৯ বার পঠিত
  • আমরা একজন নিভৃত নীরব শিল্পীর জন্মশতবর্ষ তারই স্বভাবপ্রকৃতির  মতো নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম। অতিমারি আমাদের কতকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার মতো এমন একটি সঙ্গীতসাধকের জন্মশতবর্ষও ভুলিয়ে দিল, এটা ভাবতেই একজন সঙ্গীতানুরাগী মানুষ হয়ে অন্তর্দহনে দগ্ধ হতেই হচ্ছে। জানিনা, আর কতদিনই বা আমরা এমনই আত্মবিস্মৃত থাকবো।


    এই অসামান্য নিভৃত সঙ্গীতসাধকের জন্ম ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর। তার আদি বাড়ি নদিয়ার রানাঘাট আর বড় হওয়া চাকদার মামাবাড়িতে। মামা কালিদাস গুহ-র জন্যেই সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক, একনিষ্ঠতা। কয়েক বছর পর, কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসা। সেখান থেকেই শিল্পী হয়ে ওঠার সূচনা। প্রথম সঙ্গীতশিক্ষক মামা কালিদাস গুহ। কলকাতায় এসে তালিম পেলেন একে একে নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর মতো গুণিজনদের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গভীর দক্ষতা অর্জন করার জন্যই হয়তোবা, পরিবেশনায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তাঁর ছায়াসঙ্গীই হয়ে রইলো, সেভাবে প্রকাশ পেল না। কিন্তু, তাতে কি, নিজস্ব গায়কীতে বাংলা আধুনিক গানে তিনি হয়ে উঠলেন অনন্য।


    কলকাতা বেতারে গান গাওয়া দিয়ে (১৯৪৪-৪৫) শুরু হয় তার সঙ্গীতযাত্রা। ১৯৪৭-এ প্রথম রেকর্ড। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানদু’টি — ‘একটি কুসুম যবে’ এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’। প্রথমটির গীতিকার অখিলবন্ধু নিজেই, দ্বিতীয়টি ব্যোমকেশ লাহিড়ীর লেখা। এর পর কয়েকটি রেকর্ড পেরিয়ে ছ’নম্বর রেকর্ডে (১৯৫৩) উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন তিনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় গাইলেন, ‘মায়ামৃগ সম’ এবং ‘কেন প্রহর না যেতে’, সুরকার যথাক্রমে দুর্গা সেন ও দিলীপ সরকার। এই রেকর্ড থেকেই তার প্রতিভার জাত চেনালেন শিল্পী। 


    ‘শিপ্রা নদীর তীরে’, ‘কবে আছি কবে নেই’, ‘এমনি দিনে মা যে আমার’, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়’... প্রতিটি জনপ্রিয় গানই তাঁর নিজের সুর করা। কয়েকটি গানের সুরনির্মাণ ও গায়কিতে এমনই এক অভিনবত্ব এনেছিলেনন, যা তাঁর আধুনিকমনস্কতা ও স্বকীয়তার পরিচায়ক। যেমন— ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে ওঠে’, ‘ওই যে আকাশের গায়’, ‘যেন কিছু মনে কোরো না’ (সুর: দীপালি ঘোষ)।


    বাংলা রাগপ্রধানের জগতে অন্যতম এক নক্ষত্রও ছিলেন তিনি। ‘আজি চাঁদিনি রাতি গো’ (কেদার), ‘জাগো জাগো প্রিয়’ (ভাটিয়ার), ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’ (সুরদাসী মল্লার), ‘আমার সহেলী ঘুমায়’ (মারু বেহাগ)— এমন আরও অনেক রাগপ্রধান গান হয়ে উঠেছিল অনেকের গান। 


    শুধুমাত্র ‘শ্রীতুলসীদাস’ (১৯৫০), ‘মেঘমুক্তি’ (১৯৫২) ও ‘বৃন্দাবনলীলা’ (১৯৫৮) ছবিতে তার নেপথ্য কণ্ঠ শোনা গেছে, যে ছবিগুলির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে অনুপম ঘটক, উমাপতি শীল ও রথীন ঘোষ। 


    চিরকালই ছিলেন প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন এক সঙ্গীতসাধক। ধ্যানমগ্ন সাধকের মতো চোখ বন্ধ করেই গান গাইতেন।  সঙ্গীতজীবনে প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদার প্রায় কিছুই তিনি পাননি। সে কারণেই হয়তো তাঁর ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম, এই মায়াভরা পৃথিবীতে' তারই নিভৃত অভিমানের আত্মপ্রকাশ। অখিলবন্ধু ঘোষের জন্মশতবর্ষেও আমরা তাকে ভুলে রইলাম কীকরে, এটাই সবচেয়ে বড় বিস্ময়, যা তার জীবন, সঙ্গীত, সাধনা, আত্মনিবেদন সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে।


    হয়তো কোনওদিন, কোনও বিনম্র নিবেদনের সন্ধ্যায়, ছায়াবৃত অখিলবন্ধুও গ্রীনরুমে, আপনমনে, নীরবে, নিভৃতে, স্বভাবসুলভ অভিমানে গেয়ে উঠবেনই 'যেন কিছু মনে কোরোনা, কেউ যদি কিছু বলে, কত কি যে সয়ে যেতে হয়, ভালোবাসা হলে'- সঙ্গীতকে ভালোবাসার প্রতিদান হয়তো এভাবেই দিতে হয়, তা না হলে যে, অখিলবন্ধু হওয়া যায়না। 


    সশ্রদ্ধ নমস্কার ও প্রণাম তার জন্মশতবর্ষে। তিনি আমাদের হৃদয়েই থাকবেন, শিল্পী, অজাতশত্রু-অখিলবন্ধুই হয়ে, চিরদিন, চিরজীবন। 


    (তথ্যঃ সংগৃহীত)।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন