পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
অনেক অনেক বছর আগের কথা। সে যে কতগুলো বছর কেউ জানে না। গাঁয়ের বুড়োরাও জানে না, তাদের ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দাদেরও জানা ছিল না। কিন্তু সব্বাই এটুকু জানে যে সেই সময় এ গাঁয়ে থাকতো পেপিতা, এক ছোট্ট, মিষ্টি মেয়ে। মেক্সিকোর নায়ারিত তটরেখায় প্যাসিফিকের নীল জল যেখানে সান পাঞ্চো পাহাড়ের পায়ের তলায় আছড়ে পড়ে, সেইখানে ছিল তাদের চাষের ক্ষেত। বাবা আর মা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাষ করতো। পেপিতা তার ছোট ছোট ভাইবোনগুলোকে দেখেশুনে রাখতো। গরীব হলেই বা, হাসি আর খুশিতে কাটতো দিন।
একসময় বাবা-মা দুজনেই পড়লো অসুখের কবলে। এমন অসুখ কেউই কোনোদিন দেখেনি, শোনেওনি। বছর গড়িয়ে যায়, হেমন্তের ফসল পাকে। নতুন ধানের গন্ধে ম'ম' করে বাতাস। শুধু বিছানার সঙ্গে মিশে যায় বাবা আর মা।
সংসারটাকে দুটি ছোট্ট হাতে কুড়িয়ে নেয় পেপিতা। সাধ্যমতো চেষ্টা করে সবাইকে দেখেশুনে রাখতে। ক্ষেতের কাজ, বাড়ির কাজ, রান্নাবান্না - কিছুই বাদ দেয় না। অসুস্থ বাবা-মাকে দেখতে হয়। ছোট্ট পেপিতার কষ্ট হয়, পেরে ওঠে না, কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করে না।
এই করে করেই একসময় ডিসেম্বর মাস এসে গেল।
গ্রামের ছোট্ট চার্চটা সেজে উঠছে, সবাই বেবি জেসাসের জন্যে সাধ্যমতো উপহার জোগাড় করছে। ক্রিসমাসএর আগের দিন সবাই মিছিলে হাঁটবে, মোমবাতি নিয়ে, গান গাইতে গাইতে। ক্রিসমাস ক্যারল।
চার্চের প্রার্থনা ঘরে রাখা আছে ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার মাটির পাত্র। পাদ্রী গঞ্জালেস বেবি জেসাসের মূর্তি এনে সেই পাত্রে রাখবেন।
যদি শুধোও জেসাস ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার পাত্রে কেন? তাহলে মনে করিয়ে দিই, সেই সরাইখানায় জায়গার খুব অভাব ছিল যে। জেসাসের জন্মের পর মা মেরি শিশুটিকে শেষে ওই পাত্রেই শোয়ালেন।
সেই পুণ্য রাতটির কথা মনে করে চার্চে বিশেষ সার্ভিস হবে। সবাই তাঁদের যত্নে-বানানো উপহারটি নিয়ে গিয়ে রাখবেন ঈশ্বরের পুত্রের কাছে। ক্রিসমাস ট্র্যাডিশন।
পেপিতার বাবা-মা বরাবর বেবি জেসাসের জন্যে কিছু না কিছু উপহার তৈরী করেছে। ক্রিসমাসের আগের রাতে তারা সবাই মিলে উপহার নিয়ে চার্চে গেছে। বিছানায় শুয়ে দুজনেই চোখের জল ফেলে, এবার আর জেসাসের উপহার হলো না।
পেপিতা বলে, "কেন? আমি তৈরী করবো উপহার। বেবি জেসাসের জন্যে।"
বাবা বলে, "তুই কি পারবি মা?"
"পারবো। তোমার চরকাটা তো রাখাই আছে। তাতে সুতো কেটে বেবি জেসাসের জন্যে একটা রঙীন কম্বল বুনে দেব আমি। শীতে যাতে জেসাসের কষ্ট না হয়।"
যে কথা সেই কাজ। বাবার পুরোনো চরকাটা নিয়ে পেপিতা বসে। কিন্তু সে যে বড্ড ছোট। অতবড় চরকা ঘুরিয়ে সুতো কি সে কাটতে পারে? তাও দমে না। ছোট ছোট হাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
বেশ কিছুদিন পর কিছু রঙীন সুতো বুনেও ফেলে। কিন্তু কম্বল বুনতে গিয়ে সুতো যে জড়িয়ে যাচ্ছে হাতে, পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সে সুতোর জট খুলতে পারছে না। পেপিতা কেঁদে ফেলে। কম্বল তৈরী হবে কী করে?
বিছানায় শয্যাশায়ী মা সব দেখছে। এবার বললো, "পেপিতা, তুই বরং বেবি জেসাসের জন্যে একটা বুটজুতো বানিয়ে দে। রাস্তায় চলতে-ফিরতে সুবিধে হবে।"
মা’র উপদেশ মনে ধরলো। পরদিনই গেল মিগেল কাকুর বাড়ি। মিগেল কাকু গরু আর ঘোড়ার চামড়া শুকিয়ে রাখে। তা থেকে বানায় গায়ে পরার কোট, পায়ের জুতো। পেপিতাকে ভালোই বাসে মানুষটা।
মিগেল কাকুর কাছে চেয়েচিন্তে খানিক চামড়া নিয়ে এলো। বসেছে এবার চামড়া নিয়ে। কিন্তু হায়! চামড়া যে খুব শক্ত! পেপিতার ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাত চামড়া ফুঁড়ে ছুঁচ ঢোকাতে প্রাণপণে চেষ্টা করে। কিছুতেই হয় না। হাতে ছুঁচ ফুটে যায়, আঙ্গুল কেটে রক্ত বেরোয়। পেপিতা দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। জেসাসেরও তো রক্ত বেরিয়েছিল। জেসাস তো কাঁদেন নি? সেও কাঁদবে না। জুতো সে তৈরী করবেই।
দিনের বেলায় সে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটে। ক্ষেতের কাজ করে, বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখে, রান্নাবান্না করে ছোট দুটো ভাইবোনকে খাওয়ায়, বাবা-মাকে খাওয়ায়। আর রাতে বসে জুতো নিয়ে।
দিন যায়, পেপিতার হাজার চেষ্টাও বিফলে যায়। না তৈরী হয় জুতো, না বোনা হয় কম্বল। পেপিতার চোখে এবার জল আসে। এতো কষ্ট করেও সে যে কোনোকিছুই তৈরী করতে পারছে না। তাহলে কি এ বছর বেবি জেসাসকে কোনো উপহার দেওয়া যাবে না?
মা সান্ত্বনা দেয়, "কাঁদিস নে পেপিতা। জেসাসের ওপর ভরসা রাখ। দ্যাখ না, একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।"
কী ব্যবস্থা হবে ভেবে পায় না পেপিতা।
এবং এই করতে করতেই একদিন চলে আসে ক্রিসমাস ইভ। ঈশ্বরের পুত্র জন্ম নেবেন। তাই সূর্য ডোবার পর, কিন্তু পরদিন সূর্য ওঠার আগে, মধ্যরাতে চার্চে বিশেষ সার্ভিস। সারাবছরের সবচেয়ে বড় সার্ভিস - Christ Mass - যা থেকে ক্রিসমাস কথাটি এসেছে। সান পাঞ্চো গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষ এই বিশেষ সার্ভিসটির অপেক্ষায় আছেন।
মোমবাতি নিয়ে পথ হাঁটছেন তাঁরা। হাতে উপহার। ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার পাত্রে রেখে আসবেন। ছোট্ট পেপিতা লুকিয়ে আছে অন্ধকারে। কাঁদছে। দেবার মত তার যে কিছুই নেই!
হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধ।
"তুমি কি পেপিতা?"
"হ্যাঁ।" উত্তর দেয় পেপিতা। কিন্তু চিনতে পারে না তাঁকে।
"আজ এমন আনন্দের দিনে চোখে জল কেন তোমার?"
"আমার কাছে যে কিচ্ছু নেই, কোনো উপহার জোগাড় করতে পারিনি আমি। কী দেব বেবি জেসাসকে?" ফুঁপিয়ে ওঠে পেপিতা।
"ওহ, এই কথা?" হাসেন বৃদ্ধ। "পেপিতা, তুমি ভালোবেসে যা দেবে, তাতেই বেবি জেসাস খুশি হবেন।"
পেপিতা তাও ভরসা পায় না। কী আছে তার দেবার মত?
বৃদ্ধ আবারও বলেন, "চারদিকে চোখদুটো খুলে একবার তাকিয়ে দেখো। দেখো, কত কী ছড়ানো পথের ধুলায়। তার একটি কণা তুলে নিয়েও যদি জেসাসকে দাও, তিনি বড় খুশি হবেন।"
"সত্যি?"
"হ্যাঁ গো মেয়ে। আর শোনো, তোমার জন্যে সুখবর নিয়ে এসেছি আমি। তোমার বাবা আর মা খুব শিগগিরই সেরে উঠবেন। আবার আগের মত হবে সবকিছু।"
"আগের মত হবে? সবকিছু?"
বৃদ্ধ হাসেন, "এখন তাড়াতাড়ি চার্চে যাও দেখি? তোমার ছোটছোট ভাইবোনদুটো তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।"
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পেপিতা চারদিকে চোখে বোলায়। বৃদ্ধ বলেছেন, কত কী ছড়ানো আছে পথের দুধারে। তাই সে খুঁজেত থাকে আর খুঁজতেই থাকে। ভাবে, কী উপহার দেবে।
হঠাৎ থমকে যায় দৃষ্টি। পথের ধারে বিরাট সবুজ মাঠ। বুনোগাছের ঝোপে ছাওয়া। তাড়াতাড়ি মাঠে নেমে বুনো গাছের একগোছা ডাল ছিঁড়ে নেয়।
"দ্যাখো, গাছের পাতাগুলো কী সুন্দর দেখতে, ঠিক যেন আকাশের তারা। এগুলো পেলে জেসাস নিশ্চয়ই খুশি হবেন, তাই না?"
ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয় পেপিতা। ওমা,কোথায় গেলেন মানুষটা? এইমাত্র ছিলেন তো এখানে!
নাঃ, কোত্থাও নেই।
আস্তে আস্তে চার্চের দিকে এগোয় পেপিতা।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মোমবাতির আলো। বাচ্চারা ক্রিসমাস ক্যারল গাইছে।
ওদের মধ্যেই নিশ্চয় ভাইবোনদুটো আছে। জোরে জোরে পা চালায় পেপিতা। হাতে বুনোগাছের ডালপাতা।
"ওটা কে রে? পেপিতা না?"
"তাই তো দেখছি। কোথা থেকে আসছে ও? হাতে ওগুলো কী?"
গ্রামের লোকজন গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। পেপিতা চার্চে ঢুকে পড়েছে। আইলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে।
গুঞ্জন দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে।
"ও মা গো, দ্যাখ দ্যাখ, বুনোগাছের ডালপালা নিয়ে চার্চের মধ্যে ঢুকে এসেছে!"
"কী সর্বনাশ, ওকে আটক কর এক্ষুণি। অপবিত্র হয়ে যাবে সবকিছু। আজ এই পুণ্যরাতে এ কী অলক্ষুণে কাণ্ড!"
বলতে বলতেই পেপিতা সোজা জাবনা রাখার পাত্রের কাছে গিয়ে হাজির। পাত্রে শুয়ে আছেন পরমপিতার পুত্র। মণিমাণিক্য খচিত শয্যায় তাঁকে মানায় না। তিনি মাটির মানুষ, মাটির পাত্রে শুয়ে থাকেন। গরুবাছুর তাঁকে জিভ দিয়ে চেটে চেটে আদর করে দেয়। জন্মের পর দূরদেশ থেকে জ্ঞানী মানুষরা উপহার বয়ে আনেন।
পেপিতা বুনোগাছের ডাল পাত্রটি ঘিরে সাজিয়ে দেয়। তার ভালোবাসার উপহার। সেই বৃদ্ধ মানুষটি বলেছিলেন ভালোবেসে দিতে। পেপিতার বুনোগাছের উপহার নেবেন না তিনি? নিশ্চয়ই নেবেন। অসীম বিশ্বাসে সে মাথা নোয়ায়, প্রার্থনায়।
চারদিকে নৈঃশব্দ্য। চোখের পলক পড়ে না কারোর।
হঠাৎ চারদিকে ফিসফাস। "সামনে দ্যাখ, সামনে দ্যাখ,কী আশ্চর্য!"
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ।
পেপিতা মাথা তুলে দেখে তার সাজিয়ে দেওয়া বুনোগাছের সবুজ ডালপালার কী আশ্চর্য পরিবর্তন। প্রতিটি সবুজ ডালের মাথায় একটি করে টুকটুকে লাল তারা। ঠিক যেন জেসাসের বুকের রক্তের মতোই লাল। সবুজের ওপর গাঢ় লাল মিশে সে কী অপূর্ব শোভা!
পেপিতার চোখে জল, মুখে আশ্চর্য হাসি। তার ভালোবেসে দেওয়া উপহার তিনি নিয়েছেন। সবুজ পাতায় ওই লাল তারার সাজ তার সাক্ষী দিচ্ছে।
বিস্ময়ের তখনো বাকী ছিল।
প্রার্থনার শেষে সবাই বাইরে এলেন। যতদূর চোখে যায় শুধুই লাল। লালে লাল চরাচর। বুনোগাছের প্রতিটি ডালের মাথায় একটি করে উজ্জ্বল লাল তারা।
সেই থেকে প্রতি ডিসেম্বরে মেক্সিকোর বুনোগাছটির সবুজ পাতা সেজে ওঠে লাল তারা দিয়ে। পয়েনসেটিয়া। গাঢ় সবুজের ওপর উজ্জ্বল লালরঙের পাতা। ক্রিসমাসের রং। মেক্সিকো আর মধ্য আমেরিকার স্থানীয় গাছ। এখন সারা পৃথিবীতে এর চাষ হয়। ডিসেম্বরে ধু ধু সাদা বরফের মাঝে বাড়ি সাজে লাল রঙের পয়েনসেটিয়া গাছে। ক্রিসমাস ট্র্যাডিশন। এ গাছ ক্রিসমাসের গাছ। ''Flowers of the Holy Night'. এ গাছ ছাড়া ক্রিসমাসের সাজ সম্পূর্ণ হয় না।
বড় সুন্দর দেখতে এর সতেজ সবুজ পাতাগুলি। প্রতিটি ডালে সুন্দর করে সাজানো। শুধু একদম ওপরের কয়েকটি পাতা টুকটুকে লাল। ঠিক যেন একটি লাল তারা। সেগুলিকেই ফুল বলে ভুল হয়। একদম মাঝমধ্যিখানে একটি হলদে রঙের ছোট্ট গুচ্ছ, তাতেই আছে ফুলের পরাগ। ছোট্ট পেপিতার উমনো-ঝুমনো চুলেরই মত।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি, পেপিতার বাবা-মা সুস্থ হয়েছিল। আবার সুখের দিন ফিরেছিল তাদের ছোট্ট সংসারে। তারপর থেকে পেপিতা প্রতি ক্রিসমাসে জেসাসকে উপহার দিয়েছে একটি করে পয়েনসেটিয়া গাছ, তার ভালোবাসার পয়েনসেটিয়া।
**মেক্সিকোর উপকথা অবলম্বনে
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
বাঃ জানা ছিলোনা, জানলাম l