এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ৷৷ আ ব্যয়েল মুঝে মার ৷৷

    Milton Paul লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ নভেম্বর ২০২০ | ৯৫৯ বার পঠিত
  • নবু বলল, “বাঙালির হিন্দি শেখায় প্রধান বাধা কোথায় জানিস, নীরেন ?”
    বললাম, “তুইই বল ৷”

    নবু বলল, “অ্যখবারের অ্য উচ্চারণে ৷ কেমনটা বুঝেছিস ? ওই যেমন গ্যধা, ম্যন্দবুদ্ধি, শ্যয়তান – দেখবি, এই সব শব্দের অ্য উচ্চারণে বাঙালির জিভ পেটে সেঁধিয়ে যায় ৷”

    বললাম, “হতে পারে ৷ তবে, আমি এই নিয়ে কোনো গবেষণা তো করিনি ৷ তুই যা বলবি তাই সই ৷”

    নবু বলল, “না, না, ৷ বিষয়টা খুব গুরুগম্ভীর ৷ তোকে আমার জীবনের কিছু সত্যি ঘটনা বললে তুই বুঝতে পারবি সমস্যাটা কত গভীর ৷”

    বললাম, “তোর জীবনের ?”
    নবু বলল, “মানে, আমার পটলা মামার জীবনের – কিন্তু, অনেকটাই আমার জীবনে চাক্ষুষ দেখা ৷”

    বললাম, “ও ! ভাবছিলাম সকালটা নিরামিষ-নিরামিষ কাটছে ... যাকগে ! বল তাহলে, বিশদে, সবিস্তারে, বেশ ফেঁদে-ফাঁপিয়ে ৷”

    নবু বলল, “শুনবি কিন্তু, মন দিয়ে – দেখবি, ক্রায়িং উলফ এর ঘটনাটা কী সেটাও পুরো পরিষ্কার হয়ে যাবে ...

    “হয়েছে কী, একদম ছোটবেলায় একটা হিন্দি কথা পটলা মামার খুব ভালো লেগে যায় – যেটা হল, ‘আ ব্যয়েল মুঝে মার’ ৷ আর, ছোটদের যা হয়, একটা নতুন কথা শিখলে সেটাকে ইন্টার্ন্যলাইজ় করার জন্য, রপ্ত করার জন্য সারাক্ষণ কথাটা আওড়াতে থাকে ৷

    “তো, ছোট পটলা মামা সারাক্ষণ তাই বলছে, কিন্তু, উচ্চারণের দোষে সেটা শোনাচ্ছে, ‘আ বয়েল মুঝে মার’ ৷ যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো প্রসঙ্গে, যে কোন প্রশ্নের উত্তরে মামা কথাটা ব্যবহার করছে ৷ কেউ মানা করলেও মামা শুনছে না ৷ বাচ্চারা অবুঝ হয় তো ...

    “শেষে সেই ক্রায়িং উলফের ঘটনাই ঘটল – সেবার গরমে আম কাঁঠাল খেয়ে মামার সারা গায়ে এমন ফোড়া, ফুসকুড়ি, বিষফোড়া হল, বসতে পারে না, শুতে পারে না, প্রায় যায় যায় অবস্থা ৷ তখন, গ্রামের ইংরেজি জানা কোবরেজ রায় দিলেন যে, ‘হবেই তো, কেন না ‘আ বয়েল’ মানে তো ফোঁড়াকে ডেকে আনা !’ কী বুঝলি, নীরেন ?”

    প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, “সে কী রে ? তার মানে ঈসপের উপকথা তাহলে সত্যিই ফলে ?”

    নবু বলল, “ফলেই তো ! তখন সবাই কোবরেজকে ধরে বলল, ‘তাহলে উপায় ?’ তো, কোবরেজ বললেন, ‘বলা ছাড়তে যখন পারছে না তখন বয়েল না বলে বেল বলুক ...’

    “তাতেও, যা যাওয়ার তাই হল ৷ পটলা মামা সারাদিন আওড়ায়, ‘আ বেল মুঝে মার’, ‘আ বেল মুঝে মার’ ৷ এই অসময়ে পটলা মামার এক জ্যাঠা মারা গেল ৷ আর, পটলা মামা মাথা ন্যাড়া করে বেল তলা দিয়ে যাওয়ার সময় উপর থেকে একটা পাকা বেল মাথায় পড়ে ...

    “বেলটা তো ফাটলই, মামার চাঁদিও ফেটে চৌচির, ঘিলু উপচে উঁকি মারছে, খবর পেয়ে হাজার মাছি এসে ভনভন করছে ৷ এদিকে, কলেরার চোটে সদর হাসপাতালে জায়গা নেই ৷ খবর পেয়ে সেই কোবরেজ সেই ফাটা বেলের আঠা দিয়েই ফাটা খুলি জোড়া দিয়ে কোনমতে মামার প্রাণ বাঁচাল ৷”

    বললাম, “সিরিয়াসলি ... ফোড়ার পরেই সির ফুটনে কা ফাঁড়া ! কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড, রে !”

    নবু বলল, “তাতেও অবশ্য মামার সিরিয়ালের সিজ়ন শেষ হল না – গ্রামে ক্রিকেটের সিজ়ন এসে গেল ৷ তদ্দিনে মামা বলতে শুরু করেছে, ‘আ বল মুঝে মার’, ‘আ বল মুঝে মার’ ৷ এবার এলো নেক্সট এপিসোডের পালা ...

    “একদিন এই আওড়াতে-আওড়াতে মামা ব্যাট করছে, আর বোলার জোরসে বল ফেলেছে, পুরো বাউন্সার – ব্যাস, সেই বল মামার কপালে লেগে মামা কুপোকাত ৷ সেবার সদরে নিয়ে গোটা দশেক সেলাই দিয়ে মামাকে বাঁচানো হল ... তবে মামার কপালের রেখায় কোনো পরিবর্তন হল না ৷”

    এবার নবুকে থামিয়ে বললাম, “তোর এই ব্যয়েলের শব্দরূপের থেকে বয়েল, বেল, বল তো উঠে গেল ... এরপর, আর কী বাকি থাকে ? বাল, বিল, বুল, বোল ... তোর মামা নিশ্চয় এইসবও যাচাই করে দেখেছে ৷”

    নবু বলল, “সে আর বলতে ? তবে বুলটা মামা পছন্দ করেনি – কেন না, মামার প্রাণের পণ হচ্ছে হিন্দি মানে পুরো হিন্দি – তাই, ব্যয়েলকে বুল বললে হিন্দি আর ষাঁড়, দুটোকেই ছোট করা হবে ... বুঝলি ?”

    বললাম, “কিন্তু, তোর মামা তো ইংরেজির বয়েল দিয়ে শুরু করেছিল !”

    নবু বলল, “আরে, তখন মামা একদম ছোট, হাতেখড়িই হয়নি – ইংরেজির এ্যামাজ়ন কিস্সু জানে না ৷”
    ( বুঝলাম, আজকাল নবু আর এ টু জ়েড বলা পছন্দ করে না ৷ ওর ‘লেটেস্ট’ হচ্ছে এ্যামাজ়ন )

    “যাকগে, শোন,” নবু বলতে থাকল, “বিল নিয়েও মামা চিন্তা করে দেখেছে – ইন ফ্যাক্ট, বাবার সাথে আলোচনাও করেছিল ৷ তো, বাবা বলল, ‘দেখো, পটলা, সদ্য চাকরি ধরেই বিয়ে করেছ ৷ এখন তোমার টাকা-পয়সা জমানোর সময় ৷ একগাদা বিল ডেকে এনে গুঁতো খেলে পয়সার অপচয় হবে, সংসার ভেস্তে যাবে ৷ বৌ আলাদা হয়ে খোরপোষের দাবী করতে পারে – তখন দেউলিয়া হয়ে তুমি কি জেলে গিয়ে পচে মরবে না ?’ ”

    আমি বললাম,”তাও তো বাল আর বোল বাকি থাকে রে, নবু ৷”

    নবু বলল, “বলিস না ৷ মামা ক’দিন ‘আবাল মুঝে মার’, ‘আবাল মুঝে মার’ এই বোল ধরে মহড়া দিতেই মামিমার কাছে একচোট মুখ ঝামটা খেয়েছে ৷ মামিমা বলেছে, ‘শুধু আবাল নয়, আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই তোমাকে ধরে পেটাবে ৷ সবাই আজকাল ঘুরে-ঘুরে যো খুঁজছে, ফন্দি আঁটছে কাকে কোন সুযোগে পেটানো যায় ৷’ তাহলে, হাতে রইল ইয়ে ...

    বললাম, “ইয়ে ! সেটা আবার কী ?”

    নবু বলল, “ইয়ে মানে বাকি বোলটা ৷ তো, মামাকে আমিই একদিন বললাম, ‘মামা, বলা যখন ছাড়তে পারছই না – তাহলে ‘আবোল মুঝে মার’ বললেই হয় ৷’ মামা বলল, ‘দেখ নবু, তাহলে বলতে হয় ‘আবোল মুঝে মার – তাবোল মুঝে মার’, কেননা আবোল তাবোল সবসময়ে একসাথে চলে, যেমন ফুচকা আর খাট্টা-পানি, যেমন এগরোল আর বাঁটা লাউয়ের লাল সস, যেমন ... আমি আর তোর মামিমা ৷”

    আবার নবুকে সামলে বললাম, “থাক-থাক, নবু ৷ তুই এক কাজ কর – মামাকে বল বলতে, ‘আ বাইল মুঝে মার’, ‘আ বাইল মুঝে মার’ ৷ ওই একটাই রাস্তা খোলা আছে ৷”

    নবু ভুরু কপালে তুলে, চোখদুটো গোল্লা-গোল্লা করে বলল, “কী মারাত্মক কথা বলছিস, নীরেন ! মামার কত বয়স হয়েছে জানিস ? এই বয়েসে বাইলের মার ! তার মানে বুঝিস ? নির্ঘাত ন্যাবা, মানে জন্ডিস হয়ে মামা মারা যাবে !”

    বললাম, “অ ! তার মানে এখানেই তোর গল্পের সমাপ্তি ৷ বেশ ! কিন্তু, তোর এই গপ্পের মূল বক্তব্যটা কী ?”

    নবু বলল, “মোদ্দা কথা, আমাদেরকে হিন্দি ভাষাটা হেলাফেলা না করে সমীহ করে চলতে হবে ৷ অনেক বেশি গভীরে গিয়ে, অনেক বেশি আন্তরিক ভাবে নিতে হবে ৷ নইলে আমাদের সকলের ‘অ্যন্তিম দ্যশা’ ওই পটলা মামার মত হবে !”

    #নবু_বলল
    -----------------------------------
    © ইন্দ্রনীর / ০১ নভেম্বর ২০২০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৩ নভেম্বর ২০২০ ২৩:৪৬99606
  • বেশ লাগল। আসলে হিন্দিতে "ঐকার" এর উচ্চারণটা যে "এ্যায়" -- বাঙালি এটা বোঝেনি। তাই নজরুল লেখেন 'দারোয়ান গায় গান  শোন ঐ  'রামা হৈ'। যদিও কোন দারোয়ান রামা হৈ না গেয়ে আসলে গায় রামা হ্যায়।


    " আ ব্যল , মুঝে মার" এর কাছাকাছি বাঙলা হবে "বাঁশ কেন ঝাড়ে, আয় আমার গাঁড়ে"।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন