এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নক্ষীসরা

    Samarjit Jana লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ অক্টোবর ২০২০ | ৬৫১ বার পঠিত
  • ।। *লক্ষীসরা* ।।


    বিজলি আজ খুব ব্যস্ত। তাহেরপুরে সক্কালবেলাতেই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা নীহর পড়ে আজকাল। কাল নক্ষীপূজো, সরাগুলান আজ কালিনারায়নপুর হাটে নিয়ে যেতি হবে। এই নক্ষীপূজোতেই সরা বেচি দুপয়সার মুখ দেখতি পায় বিজলিরা। শান্তিপুরী সরা, জটূলিদাদুর মুখে শুনেছে বিজলি কত রকমের সরা আছে, ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা আর বিজলীর মা খুড়িমারা যেটা আঁকে সেই শান্তিপুরী সরা। আগে ঘরে ঘরে নক্ষী'মার মুর্তি পূজো হতো না, সরাপূজোই হোত বেশি ঘরে। ফরিদপুরী সরা চৌখুপি, মা নক্ষীর চিত্র আঁকা সবেতেই, এই সরা বেচেই দু পয়সা এই কোজাগরী পূজোর আগে। 


    বাপটাকে বলতি হবে দুলাল কাকার ভ্যানটা নিয়ে সরাগুলান পৌঁছে দিতে। রাতে কি ছাঁইপাঁশ গেলে দিনভর বাপটা পড়ি পড়ি ঘুমায়। কালিনারায়নপুর ইষ্টিশানের পাশের বিলে জলসিঙারার তুলার ইজারা নিছে ঠিকাদার, জলের উপর লতিয়ে আছে পানি ফলের লতাপাতা, ডুব দিয়ে এক নিঃশ্বাসে তুলতি হয় সিঙারাফল, এক কুড়ি দশ টাকা দেয়, ভাইটা এখন সকাল হলিই চলি যায় সিঙারাফলের চক্করি; কোন সুবিস্তা ভাইয়ের থেকে হবিনি। 


    এখুন তো ইসকুলও বন্দ, আগে তাও খেতি দিত বলি তাও ইসকুল যেত। পড়ার চেয়ি যায় বেশি প্যাটের টানে। ইসকুলির খাবার পর ঘন্টা ঢং ঢং হলিই দে ছুট বাড়ি বলি ব্যাগ বগলে।


    এখন শাকসবজি ফল মূলের আগুনপারা দাম, কি এক রোগির জন্যি কারুর কোন কাজ নাই, বিপিএল কাডের চালটুকুই পায় বিজলিরা, চারটে প্যাট, মাসের রেশন চালে দশ দিনও চলে না।  গোপালদাদা, ভীমখুড়োরা আর টেরেনে হকারি করতি যায় না। টেরেন বন্ধ। কবে চলবে কে জানে ?


    এখন বাড়িতি বিজলিই ভরসা, মা'টা সরা আঁকে ভালই, কিন্তু হাঁপিয়ে যায় একটুকুতেই, কয়দিন শরীরটাও খারাপ, বিজলি পয়সা জমালি একবার কেষ্টনগরি নে যেয়ি বড় ডাক্তার দেখাবে। সরার সাথে ধানের শীষের ছড়া, দুই কুড়ি ডিজাইন ছড়া  নিয়ে এসিচে বিজলি গোকুলদাদার কাছ থিকি, বিক্কিরি হলি আজকেই পয়সা ফিরট দিতি হবে। আর নাল শাপলা, খরিদ্দার বাবুরা বলে পদ্ম। সেটা তুলে নিয়ে আসে দুলকি বিলের থেকে। ওর পাশে হাটে বসে বেচে, লগনসা ২০  ট্যাকায় বিক্কিরি এক একটা ফুল।  


    গেরামে বাপটার বদনাম আছে, লোকে বলে চোর, বার দুই পুলিশও ধরে নে গেছিল, তাহিরপুরির থানাতে মা গিয়ে পুলিশবাবুদের হাতে পায়ে ধরি ৫০০ ট্যাকা দিয়ে ছেইড়ে নে এসছে বাপটাকে দু দুবার। তবুও শিক্ষা হবেনি। কাল রেতে বলছেল, নক্ষীপূজোর রাইতে যখন ফটফটি জ্যোস্নায় দিগ্বিবিদিক ভেসি যায় তখন গেরস্থির ঘরি  চুরি করতি পারলি তাকে বলে উস্তাদ চোর। 


    বিজলিকে সক্কাল সক্কাল হাটে পৌঁছতি হবে, ভ্যানে বসি বিজলি দ্যাখে চখাচখির ওড়াউড়ি, শাপলা ফোটা বিল, কচুরিপানা আর কুচোশ্যাওলা ভরা জমিদারী পুকুর, রোদ তেতি উঠছি, হাটে গি তিরপল টানাতি হবি, বিজলি কোমরে একবার পয়সার থলিটা পরখ করে। মা বাপটার জন্যি এক পয়সা ঘরেতে রাখেনি, হালদারজেঠির কাছে জমা রাখে। 


    বেচাকিনা শেষ, দিনের আলো মরি আসছে, সারাদিনে একবারও ভাত খেতি পারেনি বিজলি, শুধু পাউরুটি ঘুঘনি, এখনও দুটো সরা পড়ি আছে; আজ নক্ষীপূজো কাল তো আর কেউ সরা কিনবেনে। তিরপল গুটোতি গুটোতি ভাবে বিজলি আজ সরা দুটোতে মা নক্ষীর পূজো চড়ালি কেমন হয় ?


    তাদের ঘরি কি মা নক্ষী আসবিনি ?  কি মনে করি একটা বাতাসার প্যাকিট, আর ২০০ গেরাম খই নিলে বিজলি হাটের দুকান থিকে, লাল শাপলা ও একটা দিয়ে গ্যাছে দুলকি, আস্তে আস্তে গাঁয়ের পথ ধরে বিজলি। রাত হই গ্যাছে। কোমরের পয়সার থলিটা ভারিই লাগছে।


    আজ নক্ষীপূজো। সাদা ফটফটে জ্যোস্নায় খাল বিল ভেসি যাচ্ছে, তাহিরপুরি ঢোকার মুখে লাইটপোষ্টটাতে হলুদ আলো। ঐ তো ওদের ঘর, খাপরা ছাওয়া। কিন্তু উঠোনে এত লোক কেন ? কমলার মা, জোচনজেঠা, রাঙি টুনিরা, দেখে মা'টা শুয়ি আছে বারান্ডায়, একটা সাদা চাদর  ঢাকা, বাপটা মাথা ধরে বসি, কি হোল কি ? দিন তিনেক ধরি জ্বর হইছিল বটে, আশাদিদিরা ওষুধও দিইছিল, কিন্তু এমন জ্বরজালি তো বিজলিরও হয় কখনোসকনো।  


    বিজলিরে...... বলে ডুকরি উঠল বাপটা তোর মা' আর নাই রে, চলি গেল কোজাগরী তে; নক্ষীঠাকুরির কাছে ঘরের নক্ষী চলি গেল। 


    নক্ষীপূজোর খই-বাতাসা ফুল হাতে নিয়ে এক নক্ষীর শোকে পাথর হই বসি থাকল ভবিষ্যতের নক্ষী বিজলি সেই নক্ষীর সরা দুটো সামনে রেখি।।


    *সমরজিৎ জানা*


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন