এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • একটি দাঙ্গার ধারাবিবরণী

    শমীক মুখোপাধ্যায়
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ জানুয়ারি ২০০৮ | ৬১৯ বার পঠিত
  • ভারতে জাতিগত দাঙ্গা বা কম্যুনাল রায়ট নিয়ে কথা উঠলেই আমাদের মনে প্রথমেই আসে হিন্দু আর মুসলমানে লাঠালাঠি আর কাটাকাটি। তেইশ বছর আগের শিখ নিধনযজ্ঞ বা ঐ মাপের দু একটা ঘটনা বাদ দিলে ভারতের ইতিহাসে জাতিগত দাঙ্গার মূল ভিত্তি কিন্তু হিন্দু আর মুসলমানে পারস্পরিক অবিশ্বাস, অসন্তোষ, এবং একের অন্যকে দাবিয়ে রাখার একটা সুপ্ত প্রচেষ্টাকে জাগিয়ে তোলা।

    দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে, ঘটানো হয়, অনেক পাকা মাথার সক্রিয় সহযোগিতায়, অনেক নিপুণ হাতে বোনা হয় তার জাল, ঘৃণা, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আর জাতিতত্ত্বের নিজস্ব ব্যাখ্যার মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয় এর বারুদ ঠাসা বেস, তারপর সময় ও সুযোগ বুঝে সেখানে কেবল চকমকি ঠুকে দেবার কাজ করে দূরে দাঁড়িয়ে উত্তাপ নেয় সেই সব মাথার দল। পুড়ে মরে অনেক উলুখাগড়ার ঝাড়।

    প্রচলিত ব্যাখ্যা থেকে সরে, আজ আমরা একটু নজর দিই আমাদের দেশের পূবপ্রান্তে। ওড়িশায়। খুব ছোট ব্যাপ্তিতে, একটি মাত্র জেলার কয়েকটি গ্রামে, মূলত আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলে এই মুহুর্তে জ্বলে চলেছে দাঙ্গার আগুন। দাঙ্গাটা যেহেতু হিন্দু মুসলমানে নয়, আর যেহেতু প্রচারের লাইমলাইট থেকে অনেকটাই দূরে, আমরা অনেকেই খুব একটা কনসার্নড হচ্ছি না, অনেকে হয় তো ভালো করে জানি-ও না কী হয়েছে, হয়ে চলেছে সেখানে।

    একটু নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক ওড়িশার কান্ধামাল জেলায়। গ্রামের নাম ব্রাহ্মণীগাঁও। শুরুটায় কিন্তু তেমন কোনও পাকা মাথার ইনভল্‌ভমেন্টও ছিল না। বিশে ডিসেম্বরের দিন থেকে যীশুবাবার জন্মদিন পালনের জন্য সেখানকার ক্যাথলিক চার্চ কিছু সাজসজ্জার আয়োজন করে। চার্চ থেকে ব্রাহ্মণীগাঁও হাট পর্যন্ত রাস্তা তারা ডেকোরেশনের কাজে নামে।

    এখন, এই রকম ডেকোরেশন তারা প্রতি বছরেই করে থাকে, না এই বছরেই প্রথম করল, তা আমাদের জানা নেই, যদিও প্রথমবারের জন্য করলেও আপনার আমার কিছু যাবার আসবার কথা নয়, কিন্তু এল গেল।

    স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কিছু চেলাচামুন্ডার পছন্দ হল না খ্রিষ্টধর্মের নামে এই ডেকোরেশন। তারা হুমকি দিয়ে এল, এই ভাবে ক্রিসমাস পালন করলে "ফল ভাল হবে না'।

    যীশুবাবার শিষ্যরা নিশ্চয়ই কিছু অশান্তির আশংকা করেছিল। একুশে ডিসেম্বর ২০০৭, ভায়োলেন্সের আশঙ্কা করে খ্রিস্টান কম্যুনিটির মুখপাত্ররা, এবং ব্রাহ্মণীগাঁও, ঝিঞ্ঝিরিগুড়া, কাটিঙ্গিয়া, গাদাপুর, হাতিমুন্ডা আর সারামুলি গ্রামের সরপঞ্চেরা মিলে জেলার কালেক্টর আর পুলিশ স
    ¤পারকে একটি ফ্যাক্স পাঠায়। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার অনুরোধ জানায় প্রশাসনের কাছে।

    কিন্তু সরকারি প্রশাসকের কাছে অত সময় কোথায়, এই সব এঁদো গ্রামে কিছু খেশ্চান আদিবাসীর কথায় কান দেবার? অশিক্ষিত সাবঅল্টার্ন গেঁয়ো ভূত সব, এদের আবার প্রোটেকশন। হুঁ:। অতএব, মামা-কাকা ঘুরতে হল না। ফ্যাক্সবার্তা মামা থেকে সরাসরি হারিয়ে গেল আকাশে।

    ভিএইচপি কার্যকর্তারা বাইশ আর তেইশে ডিসেম্বর, পুরো দু দিন ধরে খোলাখুলি হুমকি দিয়ে গেল স্থানীয় খ্রিস্টানদের, স্লোগান দিল, খ্রিস্টানদের উচিৎ শিক্ষা দেবার কথা বলে। তারা সমস্ত স্থানীয় হাট আর দোকান বন্ধ করার আদেশ দিয়ে দিল যাতে ক্রিসমাস ইভের আগে খ্রিস্টানরা কোনওরকম কেনাকাটি করতে না পারে।

    গণতন্ত্রের দেশে সবই সম্ভব! খ্রিস্টান কম্যুনিটি পুনরায় জেলা কালেক্টর সাহেবকে অনুরোধ করল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য।

    জমি তৈরি হয়ে চলেছিল আস্তে আস্তে। চব্বিশে ডিসেম্বর, আমরা যখন দিল্লি বম্বের মহানগরের রাস্তায় অফিস ফেরৎ ক্রিসমাক কেক কিনে ধর্মনিরপেক্ষতার সুমহান ঐতিহ্যে মশগুল হয়ে বাড়ির পথ ধরেছি, তখন ব্রাহ্মণীগাঁওয়ের হাটে ভিএইচপির লোকেরা লাঠি হাতে সব বিক্রেতাকে হুমকি দিচ্ছিল দোকান বন্ধ করার জন্য। খ্রিস্টান তরুণ ছেলেরা এর প্রতিবাদ করে, এবং সেটাকেই মশলায় আগুন হিসেবে ধার্য করা হয়। প্রথমে বাদানুবাদ, তারপর পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি, তারপর বেরিয়ে পড়ে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের নখ দাঁত।

    বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তৈরি হয়েই এসেছিল। বন্দুক পিস্তল বেরোয়, গুলি চলে, ভিএইচপির গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে দুই খ্রিস্টান তরুণ; অবিনাশ নায়ক (১৫) আর শিলু সেনাপতি (১৪)। উল্টোদিকে পাথরের আঘাতে ভিএইচপির এক ক্যাডার দীনবন্ধু প্রধানীও আহত হয় ভালোরকম।

    গুলি চলতে শুরু হবার পর, এবং দুই তরুণ গুলিতে আহত হবার পর ভয় পেয়ে খ্রিস্টান জনতা পালাতে শুরু করে। ফাঁকা মাঠ পেয়ে ভিএইচপি সমর্থকের দল এবার গুছিয়ে র‌্যানস্যাক শুরু করে। হাটে যত দোকান দলিত খ্রিস্টানদের ছিল, একে একে লুঠ হয়, চুরমার হয়, আর ভস্মীভূত হয়। রবীন্দ্র সিংয়ের ওষুধের দোকান, সাবেরিয়ান দন্ডসেনার চায়ের দোকান, হর্ষ বাৎসারিয়ার কম্পিউটারের দোকান, ঘাসিরাম মন্ত্রী আর কিশোর সিংয়ের মুদিখানার দোকান একে একে মিশে যায় মাটিতে, বিক্রম রাউত, চিত্রসেন পাত্র, মনোজ সাহু, জওহরলাল সেনাপতি, ধানু প্রধানী, দীনবন্ধু প্রধানী আর জাপানি সাহু প্রমুখ ভিএইচপি নেতাদের নির্দেশে।

    ফুলবনীর সাংবাদিকরা এই খবর পায় ওড়িশা জন অধিকার মোর্চার প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোহান্তির কাছ থেকে, এবং তারা আবারও খবর পাঠায় জেলা কালেক্টরের অফিসে। যেহেতু এরা সাংবাদিক, অবশেষে তাই, বেলা দুটো নাগাদ পুলিশ ফোর্স নিয়ে বালিগুড়ার এসডিপিও আর জেলা কালেক্টর ঘটনাস্থলে আসেন। এসপি ব্রাহ্মণীগাঁও পৌঁছন বিকেল পাঁচটা নাগাদ। খ্রিস্টান কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সাথে তাঁদের মিটিংও হয় স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে, কিন্তু পুলিশ কোনও রকম স্টেপ নিতে তাদের অপারগতার কথা জানায়। ফ্রি হ্যান্ড পেয়ে যায় ভিএইচপি। রাতের দিকে একটি চায়ের দোকান ও একটি মদের দোকান, যা কিনা হিন্দুদেরই ছিল, তারা ভস্মীভূত করে, এবং চাউর করে দেয় যে খ্রিস্টানরা হিন্দুদের দোকান জ্বালিয়ে দিয়েছে।

    পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে পুলিশ অবশেষে হস্তক্ষেপ করে এবং বিক্রম রাউত, প্রকাশ সেনাপতি, সন্তোষ সেনাপতি, তারিণী সেনাপতি, জাপানি সাহু এবং বিপিন সাহু; এই ছয় ভিএইচপি নেতাকে ব্রাহ্মণীগাঁও পুলিশ স্টেশনে আটক করে। পঁচিশে ডিসেম্বর, সকাল সাতটায়।

    খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না ছোট্ট গ্রামে। নটা নাগাদ দলে দলে ভিএইচপি সমর্থকেরা থানা ঘেরাও করে নেতাদের মুক্তির দাবিতে। তাদের স্লোগানে জানানো হয়, নেতাদের অবিলম্বে ছেড়ে না দিলে গ্রামে একটাও খ্রিস্টান আর বেঁচে থাকবে না।

    পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না, গ্রামে খ্রিস্টানদের কোনওরকম সুরক্ষার ব্যবস্থা তখনও হয় নি, কেবল কয়েকজন লাঠিধারী কনস্টেবল থানা পাহারার কাজে ছিল। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে থানার অফিসার ইন চার্জ জনতাকে জানান, তারা যা ইচ্ছে করতে পারে।

    পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে না, ২০০২এর গুজরাত দাঙ্গার শুরুর দিকের সঙ্গে? বেলা ১১টা নাগাদ উলিপাদার গ্রামের চার্চ ভস্মীভূত হয়। দিনটা পঁচিশে ডিসেম্বর। সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ি-ঘর ছেড়ে খ্রিস্টানরা দলে দলে পালাতে শুরু করে। তাদের বাড়িঘর একে একে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ভিএইচপি-র নেতৃত্বে। বেলা একটা নাগাদ আগুন লাগানো হয় ব্রাহ্মণীগাঁও চার্চে।

    আগুন জ্বলে, জ্বলতে থাকে। আগুন এখনও নেভে নি। দুদিন ধরে এই তান্ডব চলার সময়ে পুলিশ উন্মত্ত জনতাকে পুরো ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে রেখেছিল "যা-খুশি-তাই' করার জন্য। সাতাশে ডিসেম্বর, অবশেষে কার্ফু জারি করা হয় ব্রাহ্মণীগাঁওয়ে। দুই কোম্পানি সিআরপিএফ জওয়ান পাঠানো হয় আক্রান্ত এলাকায়।

    কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি অনেকটাই হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। সব হারিয়ে ক্ষিপ্ত খ্রিস্টানরাও বেশ কিছু হিন্দুদের দোকান ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লুঠ করে। পাশাপাশি খ্রিস্টানদের নিরাপত্তার দাবিতে তারাও থানা ঘেরাও করে। ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক এসে ঘুরে যান উপদ্রুত এলাকা, ডিজিপি গোপাল নন্দের সাথে তাঁর বৈঠক হয়, পুলিশ আর সিআরপিএফের সক্রিয়তায় পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্বে আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরোপুরি শান্ত হয় না ব্রাহ্মণীগাঁও ও আশপাশের এলাকা। ২৭শে ডিসেম্বরের মধ্যে কান্ধামাল জেলার ১১টি চার্চ ভস্মীভূত হয় গেরুয়াবাহিনীর হাতে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ৪১টি বাড়ি পোড়ানো হয়। পুলিশের সামনেই।

    ২৮শে ডিসেম্বর পুড়ে যাওয়া চার্চের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২তে। উল্টোদিকে খ্রিস্টানরাও নেমে পড়ে প্রতিরোধে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদেরও প্রচুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বছরের শেষদিন পর্যন্ত ধ্বংস হয় ১৯টি চার্চ। অবশ্য এদের বেশির ভাগই ছিল মাটির তৈরি, খড়ে ছাওয়া উপাসনাস্থল।

    হিংসা প্রতিহিংসায় জ্বলে যায় স্থানীয় এক এমপি-র বাড়ি, যিনি আবার ধর্মে খ্রিস্টান। ভেঙে ফেলা হয় ব্রাহ্মণীগাঁও থানার দেওয়াল।

    এখনও পর্যন্ত ইন্টারনেট ঘেঁটে এই দাঙ্গার ওপর যা যা লেটেস্ট তথ্য পেলাম, তা হল এই:

    ১। এই দাঙ্গায় এখনও পর্যন্ত, সরকারি ভাবে নিহত তিন। তিনজনেই খ্রিস্টান। আহত শতাধিক। দুপক্ষেই। (সম্ভবত এত কম সংখ্যক মৃত্যুর জন্যই এই দাঙ্গার খবর হাইলাইটে আসে নি এখনও)।

    ২। এখনও পর্যন্ত যাবতীয় কমিশন, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু ইত্যাদি ইত্যাদি, মায় কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত ওড়িশা রাজ্য সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কোনও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এখনও পর্যন্ত জমা পড়ে নি।

    ৩। বিজু জনতা দলের নেতা পদ্মনাভ বেহেরা, যাঁর বাড়ি ঐ দাঙ্গাবিধ্বস্ত জেলাতেই, এবং যিনি ওড়িশা সরকারের লৌহ ও আকরিক মন্ত্রী, তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন এই ঘটনার প্রতিবাদে।

    ভিএইচপির বড়মাপের নেতা টেতারা সাধারণত স্বামীজি টামিজি হন। তেমনই একজন স্বামী লক্ষ্মণানন্দ সরস্বতী, স্থানীয় ভিএইচপি নেতা, খ্রিস্টনদের হতে আক্রান্ত হন। ৮০ বছর বয়স্ক এই স্বামী-নেতা এক ভিএইচপি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। মিছিলটি ছিল ধর্মান্তরকরণের প্রতিবাদে।

    ধর্মান্তরকরণ। আপাতদৃষ্টিতে এই দাঙ্গার ধারাবিবরণীতে খ্রিস্টানদের কেবলই আক্রান্ত আর উগ্র হিন্দুদের কেবলই আক্রমণকারী বলে মনে হলেও, এই দাঙ্গার জমি তৈরির পেছনে এক ও একমাত্র বড়মাপের অনুঘটক ছিল, এই ধর্মান্তরকরণ। কনভার্সন।

    কনভার্সন ভারতে নতুন কিছু নয়। ভালো জীবন, ভালো থাকা খাওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রলোভন দেখিয়ে নিজের ধর্মে টেনে আনার ইতিহাস খ্রিস্টধর্মে বহুদিনের। ইসলাম যেমন ধর্মান্তরণ করত তলোয়ারের ডগায়, খ্রিস্টান তেমনি করত প্রলোভনের মাধ্যমে। সেই মুঘল আমল থেকে, যেদিন থেকে খ্রিস্টান ব্যবসায়ীদের সাথে সাথে এ দেশে পা রাখে খ্রিস্টান ধর্ম-ব্যবসায়ীরাও। তুমি খ্রিস্টান হও, প্রতি রবিবার মাস প্রেয়ারে হাজির থেকো, চার্চ থেকে তোমাকে তেলটা, সাবানটা, চিরুণিটা দেবে, বছরে একবার নতুন কাপড় দেবে, তোমার ছেলে চার্চের দারোয়ানের কাজ পাবে, তোমাদের খাওয়ার কষ্ট থাকবে না।

    প্রলোভনে পা দিত তারাই, যারা তাদের বর্তমান ধর্মসমাজের মধ্যে ব্রাত্য, অপাংক্তেয়, সবার পিছে, সবার নিচে। গরীব, দলিত, অস্পৃশ্য, সভ্যতার গন্ডীতে থেকেও সভ্যতার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়া আদিবাসীর দল। সাঁওতালের দল। এক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ তাদের ভাষা কেড়ে নিয়েছে, আরেক ধর্মব্যবসায়ীর দল কেড়ে নিচ্ছে তাদের নিজস্ব জীবনযাপনের ধর্ম, ভালো থাকার লোভে।

    দিত বলছি কেন, এখনও দেয়। ব্যান্ডেলে আমার বাড়ি থেকে সামান্য দূরত্বে বিখ্যাত ব্যান্ডেল চার্চ। কেওটা সাহাগঞ্জ বলাগড় মিলে চার্চের আশপাশের এলাকায় প্রচুর ঘর খ্রিস্টানের বাস। এদের বেশির ভাগই কনভার্টেড খ্রিস্টান। নেহাৎ জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গ, তাই সেখানে দলিত, অস্পৃশ্য ফ্যাক্টরগুলো তেমন কয়েনেজ পায় না, যে কয়েনটা একমাত্র কাজ করে, তা হল দারিদ্র্য। এদের অধিকাংশই ছিল গরীব, নুন আনতে পান্তা ফুরোত। চার্চ এদের দৈনন্দিন জিনিসপত্রের জোগান দিয়েছে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে, তার ফলে আজ তাদের অবস্থা ফিরে গেছে, কিন্তু সমস্ত কিছুই হয়েছে ধর্মান্তরণের বিনিময়ে।

    এঁরা হিন্দুধর্মের শোষণের শিকার। নিজের পালিত ধর্ম এঁদের জীবনযাপনের নিরাপত্তা দেয় নি, ছেলেমেয়ের মুখে ভাত তুলে দেয় নি, ইন ফ্যাক্ট ধর্মবিশ্বাস যে দৈনন্দিন বেঁচে থাকার পাথেয় হতে পারে, সেটাই তাঁরা কোনওদিন ভাবেন নি। ভাবতে শেখাল চার্চ। কী দিচ্ছে তোমাদের ভগবান, তোমাদের মন্দির? আমার ভগবানের শরণ নাও, খেতে পরতে পাবে। মানুষের ধর্মবিশ্বাস আগে, না জীবন আগে? মন্দির গির্জা আগে, না সন্তানের ভবিষ্যৎ আগে? চুপচাপ তারা শরণ নিয়ে নেয় যীশুবাবার, মেরিবাবার, আর তারপরে সত্যিই কিন্তু আলোর মুখ দেখে। শিড্যুল্ড কাস্ট, শিড্যুল্ড ট্রাইবের তকমাও তাদের যা দিতে পারে না সরকারিভাবে, খ্রিস্টধর্মের ক্রুশ ঝোলানো লকেট তাদের তাইই দেয়। পৃথিবীতে হিন্দুধর্ম বাদে আর কোনও ধর্মে জাতপাতের বালাই নেই, নিচু জাত তকমা নিয়ে বেঁচে থাকার বদলে তারা শ্রেয় মনে করে জাতহীন এক ধর্মের অংশীদার হয়ে বেঁচে থাকা। আর এই তথ্যগুলোই ধর্মব্যবসায়ীদের আরও আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করে সেই সব মানুষদের প্রলোভিত করতে, তথাকথিত হিন্দু সমাজ যাদের অন্ধকারে ফেলে রেখেছে। এইভাবেই দলিত হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে যান এ আর রহমান, অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক থেকে বাঁচতে বৌদ্ধধর্মের শরণ নেন বাবাসাহেব আম্বেডকর। আমরা যারা নিজেদের অজ্ঞাতেই হিন্দু, তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু, কখনও লক্ষ্য করি নি অস্পৃশ্য হয়ে বেঁচে থাকা কী ভয়ঙ্কর, দলিত হয়ে উচ্চবর্ণের লোকের থুতু আর লাঠি খাওয়ায় কত কষ্টের, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা কত সাঙ্ঘাতিক, তারা হয় তো সহজে বুঝতে পারব না ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পৌঁছে মানুষ এইসব ধর্মের প্রলোভনে পা দেয়। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকার পরিচয়েই প্রভূত শ্লাঘা অর্জন করি।

    আমাদের ছাত্রজীবনে একটি লোককে দেখতাম ব্যান্ডেল বালির মোড়ের রেশন দোকানের সামনে মাঝে মাঝে যিশুর মহিমা-ওলা লিফলেট বিলি করত। ঐ একই বক্তব্য, প্রভূর শরণ নাও, তিনি পরম ক্ষমাশীল, তাঁকে প্রণাম করলেই তোমার মুক্তি, তাঁকে বিশ্বাস করলেই তোমার মোক্ষ ইত্যাদি। কাউকে কখনও প্রতিবাদ করতে দেখি নি, কারণ তখনও হয় তো আমরা পরস্পরকে সেভাবে অবিশ্বাস করতে শিখি নি। কিংবা অন্য কোনও কারণ থাকলেও থাকতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের মফস্বলের শিক্ষিত লোক ধর্ম বা ধর্মান্তর নিয়ে কখনওই সে রকম মাথা ঘামায় না, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ব্যান্ডেল লোকাল আর বর্ধমান লোকালের টাইমিং মনে রাখা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সেখানে কোনও অস্তিত্বই নেই। সেখানে লোকে দুর্গাপুজোতেও শহর সাজায়, বড়দিনেও সাজায়। আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না কারুর। সকলেরই আনন্দের, উপার্জনের সময় এইসব উৎসব।

    কিন্তু সব জায়গা তো ব্যান্ডেল হয় না। নিজেদের জমি হারিয়ে যেতে দেখতে কে-ই বা ভালোবাসবে? দিনে দিনে এই ধর্মান্তরণ ঘটে চলেছে ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে, যেখানে সরকারি সাহায্য পৌঁছয় না, চাকরি পাওয়া যায় না, খরা আর সাইক্লোনে এমনিই মরে শয়ে শয়ে মানুষ, না না, মানুষ নয়, আদিবাসী, দলিত; সেখানে মিশনারিদের দল সুযোগ তো নেবেই। পরিস্থিতি বিচার করে দেখা যাচ্ছে সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরও শক্ত ঘাঁটি ছিল আগে থেকেই, কিন্তু নিজের ধর্মের লোকেদের সুরক্ষা সাচ্ছন্দ্যের জন্য তাদের কখনোই মাথা ঘামাতে দেখা যায় নি, দলিত অস্পৃশ্যরা আবার মানুষ নাকি?

    ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৫% লোক খ্রিস্টান। ১৪% মুসলিম। ফলে খাতায় কলমে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও আসলে ইহা একটি হিন্দু ডমিনেটেড রাষ্ট্র, সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। সেখানে ওড়িশা হল দেশের একমাত্র রাজ্য, যেখানে ধর্মান্তরিত হতে গেলে পুলিশের অনুমতি লাগে। এতশত বেড়াজাল পেরিয়েও ওড়িশায় হিন্দু থেকে খ্রিস্টধর্মের দিকে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের থেকে বেশ বেশিই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তা শির:পীড়ার কারণ হবে বৈকি! আইন, কানুন, হুমকি সমস্ত কিছু দিয়েই যখন ধর্মান্তরণ রোখা যাচ্ছে না, তখন তার causal analysis করার থেকে তো অনেক সোজা ঐ সামান্য টু পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্টকে পিটিয়ে সিধে করে দেওয়া। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা আশা করা যায়? আফটার অল, তারা এ দেশের মরাল গার্জিয়ান, দেশের, দশের ও দেশধর্মের ভালোমন্দ রক্ষার দায়িত্ব তো তাদের হাতেই!

    জয় শ্রীরাম!!!

    জানুয়ারী ৬, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জানুয়ারি ২০০৮ | ৬১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন