এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ত্রিকাল ও সোমসত্ত্ব

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ মার্চ ২০২০ | ৮৯৩ বার পঠিত
  • রূপকথা পুনের সেমিনার শেষ করে কলকাতায় ফিরেছে পরশুদিন। চাইল্ড অটিজম-এর দুদিনে মোট ছটা সেশান হয়েছে ওখানে। এসে চয়নকে ফোন করেছিল তিনবার।তিনবারই মোবাইল বেজে গেছে । কেউ ধরেনি। চয়নের বাবা চল্লিশ লাখ টাকা কোর্স ফি-তে বোস্টনের একটা ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছে তাকে। বোধহয় সেখানে চলে গেছে সিয়াটেল থেকে। কিন্তু ফোন রিসিভ না করার কারণ কি ? রূপকথা বেশ অবাক হয়। কিন্তু অবচেতন মনে এক ধরণের স্বস্তি অনুভব করে। তার মনে হয় চয়নের সঙ্গে তার সম্পর্কটা বোধহয় টিকে থাকার নয়। সিয়াটেলে চয়নের লজের রুমে তার একেবারেই যাওয়া উচিৎ হয়নি। কি যে মতিভ্রম হয়েছিল। সে ইদানীং উপলব্ধি করতে পারে যে, চয়নের সঙ্গে তার মনের ওয়েভ লেংথ একেবারেই মেলে না। রূপকথা ভাবে, চয়ন যদি তার সঙ্গে সম্পর্কটা নিজে থেকে কেটে দেয় তা হলে খুব ভাল হয়।টি চ ফর ইন্ডিয়া জোনাল ডেটাবেস থেকে তিনটে নাম এবং
    ঠি কানা পাঠিয়েছে তার কাছে। তিনটে অটিস্টিক বাচ্চার অভিবাবকের ঠি কানা ।তিনটে অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে হবে দশ দিনের মধ্যে। তারপর প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা দিতে হবে পনের দিনের ভেতর। সুতরাং রূপকথার এখন নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। এটা এই সংস্থার ফেলোশিপ প্রোগ্রাম। ভালো পারফরমেন্স হলে ইউনেস্কো থেকে এদের বিদেশে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়। যদিও রূপকথা এই সবে বিদেশ থেকে ফিরেছে।আবার ওখানে যাওয়ার কোন আকর্ষণ নেই ।
    অটিস্টিক শিশু ভিজিটের প্রথম নাম সোমসত্ত্ব দত্ত চৌধুরী। মায়ের নাম অর্না দত্ত চৌধুরী। বাবা নেই। কেন নেই তা আপাতত: জানে না রূপকথা। বাড়ি বৌবাজারে।পি সি চন্দ্রের শোরুমের কাছে।

    সোমসত্ত্বের বয়েস চার। একটা গদিওয়ালা আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল সোমসত্ত্ব। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। কোন কিছু দেখেও যেন দেখছে না। রূপকথা ওর কাছে গিয়ে আলতো করে একটা হাত ধরল। বাচ্চাটা যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। মাথা নীচু করে তাকাল অবশ্য রূপকথার হাতের দিকে। রূপকথা হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল ‘কেমন আছ বাবু ?’ বাচ্চাটা চোখ বড় বড় করে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল রূপকথার মুখের দিকে। সুদূর কোন শূন্য থেকে ভেসে আসা জট পাকানো শব্দগুচ্ছ যেন প্রাণপণ ধরার চেষ্টা করতে লাগল। অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, সংক্ষেপে এ এস ডি ।
    অর্না বলল, ‘আগে আলো জ্বললেও বুঝতে পারত না। এখন সেটা পারে । কিছুদিন ক্যামাক
    স্ট্রি টের একটা ইনস্টিটিউটে থেরাপি করিয়েছিলাম। তাতে কিছুটা কাজ হয়েছিল। কিন্তু ওখানে এত খরচ যে কনটিনিউ করতে পারিনি। আমার দিদি আমার সঙ্গে থাকে আমার হাসব্যান্ড মারা যাবার পর থেকে। দু বছর আগে হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে....’
    — ‘ ও: হো.... মাই গড !’ রূপকথা অকৃত্রিম সমবেদনা প্রকাশ করে।
    অর্না ফের ছেলের প্রসঙ্গে আসে।
    — ‘ জানেন, এখন ও টাচ ফিল করতে পারে ভালই । বছরখানেক আগেও পারত না। ওই থেরাপি সেন্টারে গিয়ে ভালই ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছিল। কিন্তু... খরচ চালাতে পারলাম না বুঝলেন ....’
    রূপকথা সসংকোচে বলে, ‘অর্নাদি, প্লিজ... আমাকে আপনি বলবেন না। আমাকে বোনের মতো ভাবুন।’ অর্নার কারুণ্যমাখা মুখে অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে— ‘ হ্যাঁ নিশ্চই ....’
    — ‘ও হাঁটাচলা করতে পারে প্রপারলি ?’ রূপকথা সমস্যার ভেতরে যেতে উদ্যোগী হয়।
    — ‘ হ্যাঁ অন্য বাচ্চাদের মতো দৌড়োদৌড়ি করতে পারে না
    ঠি কই, তবে হাঁটাচলা করতে কোন অসুবিধে হয় না। মেন প্রবলেম হল, কথা বুঝতে না পারা। আপনাদের ‘টি চ ফর ইন্ডিয়া ‘র এক তামিল ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার যোগাযোগ হয়েছিল। কিন্তু তিনি মুম্বাই চলে যাওয়ায় যোগাযোগ কেটে যায়।’
    রূপকথা হেসে বলে, ‘ চিন্তা করবেন না, এখন তো আবার যোগাযোগ হল । খরচের চিন্তাও করবেন না।সে দায়িত্ব আমাদের। এ এস ডি, অ্যাজ পার জেনারেল পারসেপশান হয়ত পুরোপুরি কিউরেবল নয়, কিন্তু অন্তত সিক্সটি পারসেন্ট কিউরেবল।’
    — ‘ তা-ই ? ‘ , অর্নার মুখ নতুন আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
    — ‘ হ্যাঁ অর্নাদি। এ এস ডি-র জন্য অনেক রকম থেরাপি আছে। যেমন স্পীচ থেরাপি, লাইট থেরাপি, কগনিটিভ থেরাপি, রিফ্লেক্স থেরাপি, বিহেভিয়ারাল থেরাপি,অ্যানিম্যাল থেরাপি ....আরো অনেক কিছু। এটা তো ব্রেন আর নার্ভের কনজেনিট্যাল ডিসঅর্ডার, তাই বেশ কিছুটা সময় লাগে। তবে চিন্তা করবেন না। শেষ পর্যন্ত, চলাফেরায় একটু স্লো হলেও নর্মাল লাইফ লিড করতে পারবে।’
    এ ক’ বছরের অর্জন করা শিক্ষা পুরোপুরি ঢেলে দেয় রূপকথা ।
    — ‘ একটু দেখ না ভাই। আমার কি যে দুশ্চিন্তা বলে বোঝাতে পারব না। ওর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আরো বিপদে পড়েছি।কি যে যাচ্ছে আমার.... ভগবান কেন যে এত কষ্ট দেন.....’ অর্না কোনরকমে কান্না চেপে রেখেছে।
    রূপকথা ওর কাছে গিয়ে বসল।একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরে রইল।’ কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আপনি একা নন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আমাদের ‘হোম ফর অটিস্টিকস’ অ্যাকাডেমিতে ওকে অ্যাডমিট করে দেব। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না দেখবেন।ডেফিনিটলি প্রগ্রেস হবে।’ রূপকথা আন্তরিকতম কন্ঠে বলতে থাকে।
    অর্না একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা , ওই অ্যানিম্যাল থেরাপি না কি বললেন.... ওটা কি জিনিস ?’
    রূপকথা হেসে বলল, ‘ ওটা আমিও ঠিক জানি না....সেমিনারে শুনেছিলাম।ইনস্টিটিউটের ডক্টররা জানেন। মনে হয়, বিহেভিয়ারাল থেরাপির একটা পার্ট হবে।’
    — ‘ এত কম বয়সে কত কি শিখে গেছ তোমরা।কত কাজ করছ। আমরা তো কিছুই করতে পারলাম না।’ রূপকথার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অর্না স্নেহময় ভঙ্গীতে।
    সোমসত্ত্ব একইভাবে আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে।অর্নার হঠাৎ চোখে পড়ল । সোমসত্ত্ব মুখটা কেমন কুঁচকে আছে। অর্না বুঝতে পারল যে ও টয়লেটে যাবে। সে উঠে গিয়ে সোমকে কোলে নিল.....
    সোমকে নিয়ে অর্না ফিরে আসার পর রূপকথা বলল, ‘ ওকে যতটা সম্ভব নিজের ক্লোজ টাচে রাখবেন। এটাও একধরণের থেরাপি। এতে ওদের কগনিটিভ এবিলিটি বাড়ে।’
    বেরোবার মুখে অর্না বলল , ‘আবার তা’লে কবে আসবে .... মনের বেশ খানিকটা জোর পেলাম তোমার সঙ্গে কথা বলে ।’
    —‘ চিন্তা করবেন না।আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখব আপনার সঙ্গে। খুব তাড়াতাড়ি সোমকে এ এস ডি অ্যাকাডেমিতে অ্যাডমিট করাব। আমার ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখুন। ও: , এই যে আমার কার্ডটা রাখুন। কোন হেল্প দরকার হলে ফোন করবেন। আজ তা’লে আসি....কেমন ‘

    রাস্তায় বেরিয়ে রূপকথার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা চিন্তা খেলে গেল।সে আবার অর্নাদের ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে কলিং বেলে আঙুলের চাপ দিল।
    ়়়়়়়়়়়়়়়়়়়

    মহাদেববাবুর অগননযোগ্য ইনপুট ইনসারসান সত্যিই ভেল্কি দেখাচ্ছে। দীনবন্ধুবাবুও খুব খুশি। মহাদেব ত্রিকালকে রাজ্যের মিউজিক এবং সুর খাইয়েছেন । একটা আলপিনের ডগার মতো সূক্ষ্ম জায়গায় অ্যাটমিক ম্যানোভারিং করে এত বিচিত্র সব অনুভূতির বাজনা এবং সুর সদৃশীকরণ ঘটিয়েছেন। খুবই অবাক করা কাজ। এই তো সেদিন দুপুরবেলায় আকাশ ঢেকে ঘন কালো মেঘ ধেয়ে আসতে ত্রিকাল বিস্ময়করভাবে তার মেমারির ডালা খুলে ‘ শ্রাবণ ঘন গহন মোহে’-র সুর চমৎকারভাবে শিস দিতে লাগল। ত্রিকালের অদ্ভুত সব নিজস্ব উদ্ভাবনী দক্ষতা সৃষ্টি হয়েছে। সে ধরে ফেলতে পারে কে ভাল আর কে বদ লোক।
    মহাদেববাবু এই নিয়ে বড় লজ্জায় পড়লেন একদিন। এক ফরাসী প্রযুক্তিবিদ এসেছিলেন কোথা থেকে ঠি কানা খুঁজে খুঁজে, মহাদেববাবুর সঙ্গে দেখা করতে। একবর্ণ ইংরীজি জানে না।
    — বঁ জুর মঁশিয়ে। জে সুই শারমে দ্য ফ্যার ভোতর্ কন্যায়স্যাঁ।
    — মারসি মারসি । দ্যবিয়েঁ ।
    — কমেঁ অ্যালে ভু ?
    — ট্রে বাঁয়ে । মারসি ।
    — ভুলে ভু বিয়েঁ মি প্রেজেঁতের অ্যা ভোতর্ রোবত্ ?
    — আভে প্ল্যাসার। এঁত্ রে ।
    — মারসি ।
    — অ্যাসেইয়ে— ভু ।
    এইভাবে কিছুক্ষণ মহাদেব এবং সেই ফরাসী ভদ্রলোকে অনর্গল ফরাসী ভাষায় বাতচিত হল। তারপর ল্যাবরেটরি ঘরে ঢুকে ত্রিকালকে পরম উৎসাহে নেডে চেড়ে দেখতে লাগলেন । বিভিন্ন এক্সটারনাল প্লাগ খুলে পরিয়ে, এখানে ওখানে আঙুল ঢুকিয়ে। ইন্টারনাল সার্কিট ঘুরিয়ে দেখে দেখে তার আর আশ মেটে না। মহাদেব ভীষণ বিব্রত এবং বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছিলেন না। অবশেষে ইনপুট প্রসেসিং ডিস্কে হাত দিতে আঁতকে উঠলেন তিনি।এটি তার অক্লান্ত পরিশ্রম, অপরিসীম নিষ্ঠা এবং অধ্যাবসায়ের ফসল। লোকটা ব্যাগ থেকে ইলেকট্রনিক স্ক্রু-ড্রাইভার বের করল।সর্বনাশ। ক্যাবিনেট খুলে দেখবে নাকি ! মহাদেব ছটফট করে উঠলেন। হাজার হোক ত্রিকাল তার সন্তানের মতো। তিনি বাধা দিতে যাচ্ছিলেন।তার আগেই ত্রিকাল একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসল। তার ডান হাত দিয়ে সাহেবের গালে সপাটে এক চড় মেরে চোস্ত ফরাসী ভাষায় যা বলে উঠল তার তর্জমা করলে দাঁডায়— তফাত যা বদমাশ কাঁহিকা।
    কি লজ্জা, কি লজ্জা ! মহাদেববাবু সাহেবের হাত ধরে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন।বলতে লাগলেন, ‘ জে ভু দিম্যাদে পাদঁ মঁশিয়ে....’ , মানে মাফ করে দিন দাদা । ও বড্ড ছেলেমানুষ। এক অবোধ শিশু।এদিকে সাহেবের কিন্তু কোন বিকার নেই। সে শুধু একটু গালে একটু হাত বুলিয়ে বলল, ‘ না না, তাতে কি হয়েছে । ও কিছু নয়। যাই হোক, আমি চলি আজ। আবার পরে একদিন আসার ইচ্ছে রইল।’ মহাদেববাবু করজোড়ে বললেন— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’
    সাহেব চলে গেল। একথা বুঝেই গেল যে, ত্রিকাল অবোধও নয়, শিশুও নয়।তার বাজার দর অনেক। আর মহাদেব বুঝে গেলেন, লোকটা কোন বিদেশী রোবট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির এজেন্ট।

    রূপকথা, সম্পর্কে মহাদেববাবুর ভাইজি হয়। মামাতো ভাই নিখিলেশের মেয়ে। অনেকদিন বিদেশে ছিল। ইউনেস্কো অধীন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সংক্রান্ত কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত । শিশুদের অটিজম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করেছে। শেষ তিনবছর আমেরিকার সিয়াটেলে ছিল। মহাদেববাবু তার কাছ থেকে জানলেন, বউবাজারে একটা অটিস্টিক বাচ্চার সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়েছে তাদের সংস্থার তরফে। একটু অ্যাকিউট কেস। থেরাপি এখন কিছুদিন বন্ধ আছে। আবার শুরু হবে। বাচ্চাটাকে একবার ত্রিকালের কাছে নিয়ে আসতে চায়।
    — ‘ সে কিরে... ডাক্তার বদ্যি ছেড়ে শেষে ত্রিকাল ! তোরা কি পাগল হলি।’ মহাদেববাবু হাসতে হাসতে বলেন।
    — ‘ না জেঠু, তুমি আপত্তি কোর না। তোমার রোবটের হিলিং পাওয়ার সম্বন্ধে অনেক কথা আমার কানে এসেছে। আমি বাচ্চাটাকে একবার ওর কাছে নিয়ে যেতে চাই .... প্লিজ...তুমি না কোর না ।’
    — ‘ আচ্ছা ঠি ক আছে রে বাবা । অত রিকোয়েস্ট করতে হবে না।চলে আয় একদিন। ফোন করে আসিস।আর হ্যাঁ, একটা কথা বলছি, কিছু মনে করিস না।ত্রিকালকে প্লিজ রোবট বলিস না। ও আমার ছেলের মতো।’
    — ‘ ও: , ভেরি সরি.... জেঠু ভেরি ভেরি সরি। এক্সকিউজ মি প্লি...জ ... ‘ ।

    শরতের রূপোলি রোদ্দুরে ভরা দিন। জলরঙে আঁকা ছবির মতো আকাশ । শুভ্র গাভীর মতো চরে বেড়াচ্ছে অলস মেঘের পাল। উন্মনা খামখেয়ালি ঝিরঝিরে হাওয়া। একটা ‘উবের’ ক্যাব থেকে
    অর্না, রূপকথা এবং সোমসত্ত্ব নামল মহাদেববাবুর বাড়ির সামনে। মহাদেব বেরিয়ে এসে তাদের সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আজ রবিবার, ছুটির দিন। অনুপমাও বাড়ি ছিল। রূপকথার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হল তার। ‘ কিরে, কেমন আছিস ? কতদিন পর দেখা....’ , রূপকথা জড়িয়ে ধরে অনুপমাকে। অনুপমাও খুশিমাখা গলায় ডগমগ হয়ে বলে, ‘ ইশ্ শ্ সত্যি, কতদিন পর দেখা.....তা দশ বারো বছর তো হবেই.... এখন কলকাতাতেই থাকবি তো ? ‘
    — ‘ হ্যাঁ , আপাতত কলকাতাতেই।জানিনা আবার কখন ডাক আসে...’
    — ‘ বেশ আছিস কিন্তু তোরা। কেমন বৈচিত্রপূর্ণ জীবন।কত বিদেশে ঘুরিস। কত অভিজ্ঞতা হয়।’ , অনুপমা বলে।
    — ‘ নারে , ওরকম মনে হয়। ভীষণ মেন্টাল স্ট্রেন পড়ে একবার এদেশ, একবার ওদেশ করতে।তবে আমার প্রফেশনের ব্যাপারে আমি হানড্রেড পারসেন্ট স্যাটিসফায়েড এটুকু বলতে পারি।’
    — ‘ সেতো নিশ্চই । খুব নোবল্ প্রফেশন... ‘ অনুপমা সহমত হয়।

    মহাদেব এবং দীনবন্ধু ইতিমধ্যেই অর্না এবং সোমসত্ত্বকে নিয়ে ল্যাবরেটরি ঘরে ঢুকে গেছেন। সেখানে ত্রিকাল বসে রয়েছে তার বেতের চেয়ারে। ছেলেকে নিয়ে অর্না প্রায় ছ ফুট দূরে একটা গদি আঁটা বেঞ্চে বসেছে।অর্না ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছে। সোমের পরণে ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট, বুটজুতো। ওকে বাইরে কোথাও নিয়ে গেলে ডায়াপার পরানো থাকে। সোমসত্ত্ব মায়ের গা ঘেঁসে বসে নির্বিকারভাবে ত্রিকালের দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রিকালের অক্ষিগোলক তীরের মতো সোজা নিবদ্ধ সোমের দিকে।

    দীনবন্ধুবাবু অর্নাকে বলছিলেন —আমাদের শরীরে ফিফটি ফাইভ ট্রি লিয়ন সেল বা কোষ আছে। ফিফটি ফাইভ ট্রি..লিয়ন .... চিন্তা করতে পারছেন ! প্রতিটি সেলের মধ্যে কোটি কোটি জিন ভাসছে ডি এন এ বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডে।এই কম্বিনেশনটাই আমাদের শরীর স্বাস্থ্য মন বুদ্ধি মেধা এবং জীবনযাপনের যাবতীয় গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে। এই পঞ্চান্ন ট্রি লিয়ন কোষের কয়েক বিন্দুর বেশি আমরা অ্যাকটিভ রাখতে পারি না, মানে জাগিয়ে রাখতে পারিনা। ঘুমিয়ে থাকে। এর আরো পাঁচ পারসেন্টও যদি জাগিয়ে তোলা যায় তা’লে যে এনার্জি জেনারেটেড হবে তাতে কোন নিউরোটিক ইমব্যালান্সকে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসা যায়। সে অবস্থায় পিনিয়্যাল গ্ল্যান্ডের সুনিয়ন্ত্রিত হর্মোনক্ষরণ মস্তিস্কের নিউরনগুলোকে সুস্থির বা স্টেবল অবস্থায় আনতে পারে। তার ফলে মস্তিষ্কের গভীরে স্থিত ‘সাইনাপস’-এর সঙ্গে নিউরনের একটা ফ্লুইড চ্যানেল তৈরি হতে পারে।যেটা নিউরোটিক স্টেবিলিটির জন্য জরুরী ব্যাপার।অ্যালঝাইমার পেশেন্টের কেসও প্রায় একইরকম। কাজটা খুবই কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই করবার চেষ্টা করবে ত্রিকাল। আমি অবশ্য ডাক্তার নই, তবু যেটুকু জানি বললাম। ভুলও হতে পারে। আমি তো আবার সর্বঘটে কাঠালি কলা ।
    মহাদেববাবু ত্রিকালের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন।
    একমাত্র শেষের কটা কথা ছাড়া দীনবন্ধুর বাকি কথাগুলো অর্নার মাথার অনেক ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। কোন ডাক্তার তাকে এসব কথা বলেনি।
    এই সময়ে রূপকথাও ঘরে এসে ঢুকল।
    ত্রিকাল অচঞ্চল। ভাবলেশহীন দুটি অক্ষিগোলক স্থির হয়ে আছে সোমসত্ত্বের ওপর।মাঝে প্রায় ছ ফুটের দূরত্ব। সে নিশ্চিতভাবেই বুঝে গেছে তার দায়িত্বটা। মস্তিষ্কের ঘুমন্ত কোষ জাগানোর দায়িত্ব তার।ত্রিকাল উঠে দাঁড়াল।
    শারদীয় আলোয় ধোয়া আকাশের নীল চাতালে মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে । ঘরের জানলার বাইরে একটা ভ্যাগাবন্ড গরু এসে দাঁড়াল। বোধহয় এখান থেকে প্রাপ্য খাদ্যের নিয়মিত বরাদ্দের প্রত্যাশায়।
    ত্রিকাল উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে হেঁটে গেল সোমসত্ত্বের কাছে। দুটো হাত দিয়ে সোমের মাথার দুপাশ আলতো করে ধরল। বাচ্চাটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মায়ের কোল ঘেঁসে বসে রইল। ত্রিকাল অনন্ত গতিতে তার নিউরোমিটার চিপস থেকে মনোরম বার্তা পাঠাতে লাগল।পাঠিয়ে যেতেই লাগল প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে।
    মহাদেববাবু মৃদুস্বরে দীনবন্ধুকে বললেন, ‘ এটা কোন মেকানিক্যাল থেরাপি ডিভাইস নয় কিন্তু ।’ দীনবন্ধু সংক্ষেপে বললেন ‘ হুঁ.... ‘।
    ভোরের বেলায় কিংবা বিকেলবেলায় কোন বাগানের গাছ গাছালি পত্রালিতে জল সিঞ্চন করার মতো। অবারিত বারি সিঞ্চন , আর কিছু নয়। ত্রিকালের নিজের বুকের ভেতরের চিপস থেকে সুষমা মাখা বার্তা প্রবাহিত হচ্ছে অনন্ত জিগাবাইট ডেটা মাত্রায়।
    অর্না হতবাক হয়ে একবার সোম, একবার ত্রিকালের দিকে তাকাতে লাগল। সোমের মস্তিষ্কের কোষগুচ্ছে নীরব পরশ বোলাতে লাগল ত্রিকাল প্রেরিত ঘুম ভাঙানিয়া গান। দীনবন্ধু বলেছিলেন অন্তত ফাইভ পারসেন্ট ঘুমন্ত কোষ জাগাতে হবে । এখন মহাদেবের দিকে তাকিয়ে বললেন জাস্ট থ্রি পারসেন্ট হলেও চলবে।

    দশ মিনিট পর ত্রিকাল তার হাত সরিয়ে নিল সোমসত্ত্বের মাথা থেকে । পেছিয়ে এসে ফের তার চেয়ারে গিয়ে বসল। সোমসত্ত্বের দুচোখে যেন ঘুম নেমে এল। মায়ের কোলে মাথা নামিয়ে দিল সে।অর্না বিহ্বলভাবে মহাদেবের দিকে তাকাল। মহাদেববাবু একহাত তুলে তাকে আশ্বস্ত ও নিশ্চিত করলেন। মনের মধ্যে নানা আলোড়ন আন্দোলন নিয়ে রূপকথা চুপ করে বসে রইল। রাস্তা দিয়ে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে একজন সাইকেল চালিয়ে গেল। গোপাল সাঁতরা তার যন্ত্রপাতির থলে নিয়ে ঘরের দরজায় উঁকি দিল। মহাদেব তাকে ইশারায় বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন।
    এইভাবে আরো মিনিট সাত অাট কাটল। জানলার বাইরে দাঁডিয়ে থাকা গরুটার বোধহয় প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শেষ হয়েছে। সে তার উপস্থিতি জানান দিল — হা..ম্বা... রবে ।
    সোমসত্ত্ব হঠাৎ চমকে উঠে ধড়মড় করে উঠে বসল । উৎসুক চোখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে হাম্বারত গরুটার দিকে তাকিয়ে রইল।তার মুখে হাসি ফুটে উঠছে।
    দীনবন্ধুবাবু বলেছিলেন ঘুমন্ত কোষের শতকরা তিনভাগ জাগলেই যথেষ্ট। তা কি জাগল ?

    দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়ার সময়ে মহাদেববাবু অর্না এবং রূপকথাকে বললেন, ‘ স্পীচ থেরাপির জন্য অন্তত তিনদিন সময় দিতে হবে। এ ক’দিন এখানে থেকে যাওয়াই ভাল।’

    অর্না দেখতে পেল গরুটা তার প্রাপ্য বরাদ্দ পেয়ে সরে গেছে ওখান থেকে। একটু পাশে একটা মুদির দোকানের পাশে গিয়ে নিশ্চিন্তে পা মুড়ে বসে
    চোখ বুজে রোমন্থনে মগ্ন হয়েছে। শরতের আকাশ এখন অমল, অনাবিল।
    দুপুর দুটোর অলস বেলা। ত্রিকাল তার বেতের চেয়ারে একাকী ধ্যানস্থ ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন