এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রোবট ত্রিকাল

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ মার্চ ২০২০ | ১৪২০ বার পঠিত
  • ত্রিকাল এবং অমূল্য
    ******************
    গোপাল সাঁতরা চামড়ার থলেতে করে হরেক যন্ত্রপাতি নিয়ে সাতসকালে বেরোয়। তার দু:খু অনেক। কিন্তু শোনবার লোক নেই। সে কাজে যাবার পথে সকালবেলায় একবার করে মহাদেববাবুর উঠোনে ঢুঁ মারে। সেখানে তখন ত্রিকালসহ মহাদেব এবং দীনবন্ধু বাবু চা পানে ব্যস্ত।সে এসে সেখানে থলে নামিয়ে রেখে উবু হয়ে বসে।তার দু:খু অনেক। তিন তিনটে সোমত্ত ছেলে। সবাই বেকার। কেউ এক পয়সা কামায় না। দুটো বারো তেরো বছরের মেয়ে।বেওয়ারিশ যত্র তত্র চরে বেড়াচ্ছে। এত বড় সংসারের ভার তার একার ঘাড়ে। এই বুড়ো বয়সে সে আর খেটে খেটে পারে না। ছোটখাট কলকব্জা যন্ত্রপাতি সারিয়ে বেড়ায় সে। একরকম ফ্রি-ল্যান্সার মিস্ত্রি বলা যায়। বড় হাঁফ ধরে আজকাল। পেরে ওঠে না। সে মাঝে মাঝে ত্রিকালেরও কলকব্জায় টাইট মেরে দেয়। আগেকার ঘড়িবাবুরা যেমন সময়মতো এসে ঘড়িতে দম দিয়ে যেত। তেমনি মহাদেববাবু তাকে ভার দিয়েছেন মাঝে মাঝে এসে ত্রিকালের শরীরের নাটবল্টুগুলো টাইট মেরে দেবার জন্য। দুটো পয়সা পাইয়ে দেওয়া আর কি। এভাবে মহাদেববাবু অনেককেই কিছু না কিছু পাইয়ে দেন তার সাধ্যের মধ্যে। তবু কারোই দু:খ ঘোচে না। এইসব বিপুল দু:খ কি আর সহজে ঘোচবার। যাই হোক, গোপাল সাঁতরা এসে হাঁটু মুড়ে বসে গালে হাত দিয়ে ত্রিকালের দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাদেববাবু এবং দীনবন্ধু আলোচনায় মগ্ন থাকেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে জল ভরে আসে। সে আর পারে না এই দুর্বহ সংসার ভার বইতে। লোকে যেমন ঠাকুর দেবতা আশ্রয় করে সে তেমনি ত্রিকালকে সব ভার সমর্পন করতে থাকে মনে মনে।
    বর্ষা গেল বুঝি। আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। ত্রিকাল বিছানা বালিশ বের করে রোদ্দুরে দিচ্ছে। নতুন রঙ করা ঘরদোর যেন হাসছে। ত্রিকাল পকেট ঝেডেঝুডে কাগজপত্র বের করে ওয়াশিং মেশিনে জামাকাপড় ফেলছে। তার আগে মহাদেববাবুর কফির কাপ নামিয়ে দিয়ে গেছে সামনের টেবিলে। কাল রাত্তিরেই ওকে বলে রেখেছেন ভাত, কাঁকরোল ভাজা, মুসুর ডাল, আলুপোস্ত আর মাছ ভাজা বানাবার জন্য। রান্নার আইটেমগুলো আগের দিন বলে না দিলে ত্রিকাল ওর মগজের ডিস্কে সঠিক স্টোর করতে পারে না। হাজার হোক, ওতো মানুষ না।ওতো এক রোবট। অবশ্য ওকে রোবট বললে মহাদেববাবু মনক্ষুণ্ণ হন। তিনি ওর মধ্যে অনুভূতিশীলতার মাইক্রো রেসিপ্রোকেটার সংযোজন করেছেন।
    মহাদেববাবু ওর নাম রেখেছেন — ত্রিকাল।
    মহাদেববাবু সপ্তাহে দুদিন ত্রিকালকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করতে বেরোন। দরকার মতো তরিতরকারি, মশলাপাতি, মাছ মাংস সবকিছু ত্রিকালই গুছিয়ে কেনে। মহাদেববাবু শুধু সঙ্গে থাকেন। দোকানদারেরা ত্রিকালের সঙ্গে লেনদেনে রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই দু তিন বছরে। ত্রিকাল অদ্ভুত সুন্দর মনোরম গলায় পৃথিবীর প্রায় এক ডজন ভাষায়, যে কোন বিষয়ে অনর্গল কথা বলতে পারে। যত জটিল হিসেবই হোক তার করতে পাঁচ সেকেন্ডের বেশি লাগে না। ত্রিকাল নারী ও পুরুষ দুরকম কন্ঠেরই অধিকারী। কখন কোন কন্ঠ ব্যবহার করতে হবে তা তার জানা। সুন্দর কন্ঠবিশিষ্ট এক পুরুষ আর মহিলার গলার আওয়াজ রেকর্ড করে তার ফ্রিকোয়েন্সি অতি যত্ন সহকারে আলাদা আলাদা করে ভরেছেন ত্রিকালের মগজের মাইক্রোরিসিভারে।
    সাধারণ রোবটের মতো ত্রিকালের সারা শরীর মোটেই কিম্ভুতকিমাকার নয়। তার বহিরাঙ্গ, মানে পোশাক আশাক মহাদেববাবু সাধারণ মানুষের মতোই বেশ স্বাভাবিক করে দিয়েছেন। হাতের কনুই এবং পায়ের হাঁটুও স্বচ্ছন্দে মুড়তে পারে। মোটেই জড়সড় কোন কাঠিন্য নেই তার চলাফেরায়। শুধু গলার কাছটায় ম্যানেজ করা যায়নি। ভেতরে বলবেয়ারিং ফিট করে মাথা এদিক ওদিক ঘোরাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু গলার ওপরের দিককার প্লাস্টার শক্ত মতো দেখায়। তাই ওখানে একটা মাফলার গোছের কিছু জড়িয়ে রাখতে হয় বারোমাস। রাত্তিরে সে বাড়ির পিছনের দিকের জমি— যেখানে মহাদেববাবুর ল্যাবরেটরি, সেখানে সে বসে, দাঁড়িয়ে বা শুয়ে থাকে। বসা, দাঁড়ানো এবং শোওয়া তিনরকম প্রক্রিয়াতেই সে অভ্যস্ত। সে জানে না শুধু ঘুম। সে সারা বছর জেগে থাকে— দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।তার কোন খাদ্যেরও প্রয়োজন নেই। তার খাদ্য শুধু ইনফরমেশন বা তথ্য। যত খাওয়াবে সে ততই পরিপুষ্ট হবে। মানে, তার মস্তিষ্ক পরিপুষ্ট হবে। কিন্তু মহাদেববাবু তো শুধু তার মস্তিষ্কের পরিপুষ্টিতেই খুশি নয়। তিনি তার হৃদয় তৈরী করার নেশায় মেতেছেন। দিবারাত্রি তিনি বিচিত্র সব ডেটা ইনপুট ম্যানোভারিং করে চলেছেন। মাঝে মাঝে ত্রিকালের জামার বোতাম খুলে, বুকের খাঁচা খুলে বুকের ভেতরে একটা আলপিনের মতো কাঁটায় সেগুলো ট্রান্সফার করে দেন। তারপর আবার জামাটা পরিয়ে দেন। শুনতে যত সোজা কাজটা মোটেই তত সোজা নয় । এসব কাজে দীনবন্ধুবাবুও মহাদেবকে যথেষ্ট সাহায্য করেন। মহাদেববাবুর জীবনের ধ্যান জ্ঞান এখন ওই একটাই।
    ***** ****** ******
    অমূল্য লাহার মনে সবসময় বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে নানাবিধ ভয় আর দুশ্চিন্তা । দুর্ভাবনা আর উদ্বেগ লালন পালন করার জন্যই যেন তৈরি হয়েছে তার বুকের খাঁচা ।
    রাস্তার ওই তেমাথা পেরোতে গিয়ে তার হৃদপিন্ডে রক্তের ফোয়ারা অতি দ্রুত ছুটতে থাকে।ওই মোড়ের এক কোনায় একটা দোকানের লাগোয়া রকে বসে থাকে চার পাঁচজন। আশপাশের দোকানদার এবং লোকজন সন্তর্পনে সিঁটিয়ে থাকে। যতদূর পারে এডিয়ে এডিয়ে চলে ওদের।অমূল্যর বাড়ি যাবার রাস্তা ওই একটাই। যখনই যায় অশ্রাব্য অশ্লীল আওয়াজ শোনে। তার মেয়ে দীপাকে নিয়ে চাপা রিরংসাসিক্ত উক্তি । অমূল্যর কিছু করার নেই। প্রাণের মায়া বড় মায়া।বোবা কালা হয়ে যেতে হয় বাধ্য হয়ে। কোনরকমে দমবন্ধ করে জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়া।
    মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালের বিছানায় আধোজড় অচেতন তার স্ত্রী মৃত্যুর জলধিতে তলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ: । ব্রেন ক্যানসার। অপারেশানের পর পরিস্থিতি আরও জটিল দিশায় মোড় নিল।
    অমূল্য বড় মৃত্যুর কথা ভাবে আজকাল।এতদিন সে তেমন করে কোনদিন মৃত্যুর কথা ভাবেইনি। বনে জঙ্গলে পাহাড়ে জলে কোথাও কোন মৃত্যুর কথা লেখা নেই। ছাদের কার্নিশের ছায়া এবং রোদ্দুর এমন করেই পড়তে থাকবে আরো কতকাল ধরে কে জানে। শুধু এই মায়াভরা পৃথিবী থেকে এক একজন কোথায় উধাও হয়ে যায়। জানলার পাশে পেঁপে গাছের পাতা উত্তুরে হাওয়ায় যেমন কাঁপছিল তেমনি কেঁপে যায়, সামনের মাঠে যেমন ক্রিকেট খেলছিল ছেলেরা খেলে যায়, ছাদে বারান্দায় লেপ তোশক বিছানা বালিশ যেমন রোদ খাচ্ছিল তেমনি খেতে থাকে। শুধু থেকে থেকে এক একটা মানুষ এই মাটি, এই ঘরদোর সংসার থেকে কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। আর বাকি পাঁচজন যেমনি পড়ে ছিল তেমনি পড়ে থাকে। যে গেল সে আর কিছু দেখতেও আসে না, বুঝতেও আসে না।
    পরের দিন অমূল্য লাহার বউ সরমা মারা গেল। সারারাত ধরে বাতাসের অক্সিজেন খুবলে নিতে চেয়েছে তার ফুসফুস। পারেনি। ঢেউয়ের মতো উথাল পাথাল বুক তার। সিলিন্ডারের সামান্য হাওয়ায় তার ফুসফুসের ভয়ঙ্কর ক্ষিদে মিটবে কেন। সারাটা রাত কেউ ছিল না ধারে কাছে। সেই কুলগাছিয়ায় আমবনের ছায়ায় ছায়ায় কত মৌমাছি উড়ছে তখন। তারপর কত দিন, কত মানুষ, কত কথা, কত ঝণ্ঝাট, কত টান, কত মান সন্ধের ছায়ার মতো, জলের টানের মতো জীবনের বালু তীর থেকে সরে যেতে লাগল এবং গেল......।

    ‘আরে ভাই, পৃথিবীতে সবার পাওনা মাপা আছে। সেই মাপের বাইরে কেউ কিছু পেতে পারবে না।সুখও মাপা আছে, যন্ত্রনাও মাপা আছে ভাই ..... ‘ মোহনলালবাবু বললেন।
    — ‘ আরে দূর, তোমার ওসব দর্শন তত্ত্ব এখন রাখ। সকাল থেকে বাঁ চোখ নাচছে। কোথায় কি হয় কে জানে ! ‘ সুভাষ ঘোষ বিরক্তি প্রকাশ করে।
    ঠিক সেই সময়ে খবর এল অমূল্য লাহার বউ মারা গেছে।
    ছেলেমেয়ে দুটো বড্ড কাঁদছিল। অমূল্য হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। মোহনলালবাবু নিবিড় স্নেহে অমূল্যর ছেলে এবং মেয়ের মাথা দুটো নিজের বুকে চেপে ধরলেন।পিতৃসুলভ মমতায় বললেন, ‘ কাঁদিস না, বাবা কাঁদিস না। এই তো দেখ না, আমার বাপ মা সেই কবেই মরে গেছে। এখন আর কিছুই মনে পড়ে না। তোরা এমন করলে তোদের বাবাটাকে কে দেখবে বল। ‘ কিন্তু এইসব মুহুর্তে মানুষের দু:খ মুছে নেওয়ার মতো সান্ত্বনা কি আজও তৈরি হয়েছে ? ওদের মা যে কত উদ্বেগ, কত ব্যথা, কত অনটনের সঙ্গে জীবনভর লড়াই করতে করতে এ জীবন থেকে অন্য কোথাও চলে গেল, সেই তিল তিল ব্যথার অনুভব কার বুকেই বা আর তেমন করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ঘুরবে — যেমন ঘুরছে ওই ছেলে মেয়ে দুটোর বুকে।
    আর অমূল্য লাহার মনে এখন শুধু তার ষোল বছরের মা মরা মেয়ে দীপাকে শেয়াল কুকুরের গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে রাখার জটিল চিন্তা।

    ত্রিকাল ঠি ক ঠাক রেসিপ্রোকেট করছে। মহাদেববাবু দেখলেন ত্রিকালের উদ্ভাবনি ক্ষমতা আরো অনেক বেড়েছে ।ত্রিকাল বাজারে, রাস্তায়, পুকুরধারে, ল্যাবরেটরির আশেপাশে কি যেন খুঁজে বেডায়, মানুষের মতো ওপর দিকে মুখ তুলে কিসের যেন গন্ধ শোঁকে। অন্য কোন বিশ্ব থেকে মহাকাশে কোন সুগন্ধ ভেসে আসছে তা কে জানে ! বাতাসে ইলেক্ট্রন কনায় কনায় ত্রিকাল কোন গন্ধ খুঁজে বেডায় তা ত্রিকালই জানে।
    কে যেন অতি মধুর স্বরে গজল গাইছে। গমগমে মিঠে আওয়াজে আশপাশ ভরপূর। জগজিৎ সিং বোধহয়। কিংবা অন্য কেউ হবে হয়ত।
    অমর পালিত মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের দিকে যাচ্ছিল সাইকেল চালিয়ে। সাইকেলে যেতে যেতে পাঁচিলের ওপর দিয়ে দেখতে পেল অমর, মহাদেববাবুর রোবট আপনমনে তেঁতুলতলায় পায়চারি করছে। অমর পালিত ভাবে, এ এক অদ্ভুত যন্তর। সে ভাবে, আচ্ছা এরও কি মানুষের মতো মৃত্যু হবে একদিন ! তা কি করে হবে ? ও তো যন্ত্র । ওর কি আর মানুষের মতো মৃত্যু ধরাবাঁধা আছে জীবনে একবার। ও তো আর জীবন কিংবা মৃত্যু কারও কাছেই পোষ মানা পাখি নয় — কোন দায়বদ্ধতা নেই ওর। আবার এও ভাবে অমর -আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে এই রোবটটা হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে রইল। এক সম্পূর্ণ রূপান্তরিত এক অদ্ভুত বিশ্বে এইভাবেই আপনমনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে । একটা ছবি ভেসে ওঠে অমরের চোখের সামনে - নির্জন নিথর পৃথিবীতে এক মহা সমুদ্রের তীরে একাকী পদচারণারত মহাদেববাবুর রোবট ত্রিকাল।
    গজল গানে আশপাশ গুন্জরিত, সুরে ভরভুর। অমর রাস্তার মোড়ে পৌঁছে বাঁ হাতে সাইকেল ঘোরাল। ঘুরিয়েই দেখল — অমূল্য লাহা তিনটে চিমডে ছেলের হাতে মার খাচ্ছে। আর সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।
    অমূল্য মার খাচ্ছে বলা যায় না, বলা যেতে পারে অপমানের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। একজন দুটো কান ধরে কসকস করে মুলে দিল। একজন প্যান্টের বোতাম ধরে অসভ্যের মতো টানাটানি করছে। আর একজন মাঝে মাঝে পটাং পটাং করে চাঁটি মারছে মাথায়। অমূল্য ঘেন্নায় লজ্জায় ভয়ে অপমানে জড়বৎ হয়ে গেছে। আশপাশের একটা লোকেরও এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করার বুকের পাটা নেই। ভয়ে সব কেঁচো একেবারে। দেখে যাচ্ছে কেবল। যেন দেখাই ওদের কাজ। অমর পালিত অকুস্থলে ঘটনার একেবারে কেন্দ্রস্থলে গিয়ে মাটিতে পায়ের ভর রেখে সাইকেল থামাল। তিনজনই একটু থতমত খেয়ে গেল। ঘাবড়াল না কিন্তু। অমূল্যর পিঠে ধাক্কা দিয়ে একজন বলল, ‘ যা:, শালা .... ভাগ।’ অমর পালিত সাইকেল থেকে নেমে পড়েছে ততক্ষণে। একহাতে সাইকেল সামলে আর এক হাত দিয়ে অমূল্যকে আগলে দাঁডায় । তারপর একসঙ্গে তিনজনের দিকেই তাকিয়ে বলল, ‘ মারছিস কেন ? ‘ একজনের নাম পরেশ সিনহা। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , ‘ আরে শালা ..... দেখনা অমরদা , এমন ঢ্যামনা না....’ অমর আবার তাকে বলিষ্ঠভাবে থামাল মাঝপথেই, ‘ চুপ... চুপ... ভদ্রভাবে কথা বল। তোমাদের হিসেব নেবার দিন এসেছে....।‘ একথার প্রতিক্রিয়া হল সরাসরি। দুষ্কৃতিরা নিজমূর্তি ধরল। তুমি থেকে সরাসরি তুই-তে নেমে যায় ওদের সম্বোধন— ‘ আরে যা বে শালা....চামচা কোথাকার। শালা রেন্ডির বাপের সঙ্গে দোস্তি হয়েছে শালার.... । ‘
    অমর পালিত অমূল্যকে সাইকেলের রডে বসিয়ে নিয়েছে। সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘ শুয়োরের বাচ্চা তোমাদের ব্যবস্থা হচ্ছে । ‘
    সাইকেলে যেতে যেতেই কথা হল দুজনে। অমর পালিত জিজ্ঞেস করে, ‘ কতদিন ধরে ওরা এরকম করছে ? ‘
    — ‘ অনেকদিন । আসলে আমার মেয়েটার জন্যেই ওরা....মা মরা মেয়েটাকে এই পরিবেশে কি করে যে আমি রক্ষা করব.... হায় ভগবান.... ও:হো , কি যে করি আমি.... হায় ভগবান.... ‘ অমূল্যর শরীর এত কাঁপতে লাগল উদ্বেগে আবেগে যে সাইকেল টলমল করতে লাগল।
    অমর পালিত ব্রেক চেপে কোনরকমে সাইকেল সামলে বলল, ‘ আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হোন শান্ত হোন..... একটু সামলে বসুন .... অত নড়বেন না.... দেখছি আমি কি করা যায়। ‘
    অমূল্য আবার একটু থিতু হয়। সাইকেল তিরতির তিরতির করে গড়াতে গড়াতে একসময়ে অমূল্যর বাড়ির দরজায় পৌঁছে যায়। অমূল্যকে নামিয়ে দিয়ে অমর বলে, ‘ আচ্ছা... আপনি একটু বিশ্রাম করুন এখন।আমি পরে আবার দেখা করব’খন..... কিছু চিন্তা করবেন না.... ও শালারা ভেড়ুয়ার দল.... আ-চ্ছা আসি এখন। ‘
    অমরের সাইকেল বেরিয়ে গেল। অমূল্য মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে গেল।

    সেদিন রাতেই ঘটনাটা ঘটল। লোকজন জানতে পারল পরদিন সকালে। রাত্তিরবেলা বারোমাসই জানলা খুলে শোওয়া অমরের অভ্যাস। সেই খোলা জানলা দিয়ে কে বা কারা দুটো হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছে অমরের মশারি ঢাকা বিছানায়। নিদ্রামগ্ন অমর জানতেও পারল না যে ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ । সম্পূর্ণ বিনা ভূমিকায় সে প্রস্থান করল এ জীবন থেকে। নিজের বাড়ির মধ্যে না হলে তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত ।

    ঠান্ডাটা হঠাৎ জেঁকে বসেছে। ঝিম ধরা সন্ধেবেলা কখন যেন ফুরিয়ে গেল। তারপর নেমে এল রাত।গাছের পাতায় পেঁচা কিংবা বাদুড় সড়সড় করছে।বাকিরা সব ঘুমের কোলে । দরজা জানলা সেঁটে অমূল্য লাহার ষোল বছরের মেয়ে দীপা আর তের বছরের ছেলে বাবলুকে নিয়ে শুয়েছিল।দীপা আর বাবলু অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বেচারারা কত আর মানসিক লড়াই দেবে এই কাঁচা বয়েস থেকে। দুনিয়াদারি বড় তাড়াতাড়ি শুরু করতে হল ওদের। অমূল্যর চোখে কোন রাতেই ঘুম থাকে না।ভয়ের পাথর চেপে থাকে সারারাত ধরে তার বুকের ওপর। নিস্তব্ধ রাতে সামান্য খুটখাটই বিকট শোনায়। কোথাও মৃদু আওয়াজ উঠলেই অমূল্যর বুক ধড়াস করে ওঠে। গায়ে ঘাম ছুটতে থাকে। তড়িঘড়ি উঠে বসে মেয়েটার দিকে দেখে নেয়, কি অবস্থায় আছে। সে তখন ঘুমিয়ে কাদা। দেখতে দেখতে ষোল বছর বয়েস হয়ে গেল। এখনও কি নিশ্চিন্ত নির্ভার হাবভাব। সব ভার এই পলকা এই পলকা নড়বড়ে বাপের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে আছে। হা ঈশ্বর । বাপের যে কি ক্ষমতা ! ঝুরঝুরে বালির বাঁধ ছাড়া যে আর কিছুই নয় সে কথা বেচারিকে কে বোঝাবে ! বাপের তো কিছু নেই , শুধু পর্বত প্রমাণ আকুলতা ছাড়া।
    অমূল্যর হয়ত বা একটু তন্দ্রা আসে কখনও। বিকট কোন স্বপ্ন দেখে সে তন্দ্রা ছুটে যায়। ঘামতে থাকে কুলকুল করে। উঠে বসে বিছানায়। বিড়ি ধরায়। ঘড়িতে সময় দেখে। রাত আড়াইটে বা তিনটে। বাকি রাতটুকু জেগে বসে থাকে ঠায়। ভোরের পাখি ডাকলে বুকের জমাট বরফ গলে জল হয়ে যায়। নীল দিগন্তে আলোর রেখা ফোটে। অমূল্যর হাল্কা মগজে এই সময়ে ঢুলুনির মৌতাত লাগে। ভোরের বেলায় শিশির ধোয়া পত্রালিতে যখন চড়াই পাখি নাকোর চাকোর করে নেচে বেড়াচ্ছে, তখন অমূল্য তার উদ্বেগ জর্জরিত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়।
    সেদিনও অমূল্যর চোখে ঢুলুনি এসেছিল। তবে একটু তাড়াতাড়ি । রাত তখন প্রায় দুটো হবে।
    বন্ধ জানলার বাইরের দিকে কিসের যেন শব্দ পাওয়া গেল। অমূল্যর ঘুমের ঘোর ছুটে গেল এক নিমেষে। বুকের রক্ত চলকে উঠল । ঘরের বাইরে কাদের চলাফেরার আওয়াজ হচ্ছে। ফিসফিসে গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আচমকা জানলার ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো ফেলল কে ঘরের মধ্যে। অমূল্য লাহার হৃৎপিন্ড তার গলার কাছে এসে আটকেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তার। ঘামে জবজব করছে সারা শরীর। হাত পায়ের পাতা ঠান্ডা বরফ। ওরা, মনে হচ্ছে, দরজা কাটার চেষ্টা করছে কিছু একটা যন্ত্র দিয়ে। হাল্কা ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ উঠছে কোন ভয়াবহ জন্তুর ডাকের মতো। ঝিঁ ঝিঁ ডেকে চলেছে একটানা। ছেলেমেয়ে দুটো এখনও ঘুমোচ্ছে। অমূল্য আধোমৃত আধোজীবিত অথবা প্রায় জড় কোন জন্তুর মতো নিষ্পন্দ অবস্থায় বিছানার ওপর বসে বসে বিষ্ফারিত চোখে একসময়ে দেখল যে পলকা বাঁধের মতো তার বদ্ধ দরজার আগল ভেঙে পড়ল। খুলে গেল দরজা। বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। এতক্ষণে দীপা আর বাবলুও ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে। দরজার বাইরের হিম বাতাস এবং ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকারের ভেতর থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল দীপার গায়ে। দুজন এগিয়ে আসতে লাগল ঘরের ভেতরে ঢোকবার জন্য। অমূল্য এবং তার সন্তানদ্বয় চলৎশক্তিহীন নি:সহায় উদ্ভিদের মতো স্থির হয়ে আছে বোবা দৃষ্টিতে। ঠি ক সেই সময়ে.....
    একটি ছায়া ওই তিন মূর্তির পেছনে এসে দাঁড়াল। ছায়া ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল মুহূর্ত কয়েক, অবিনশ্বর এক মহা প্রাচীন বৃক্ষের মতো। তারপর ....
    লম্বা মাংসহীন দুটো ইস্পাত কঠিন হাত টেনে নিল তিনজনকে একসঙ্গে পেছন দিক থেকে। তিন তিনটে সা জোয়ান মানুষ সেই দু হাতের দুর্নিবার পেষণে হাঁসফাঁস করতে লাগল। হাতের মুঠো আলগা হয়ে টর্চ, ভোজালি এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঝরা পাতার মতো ঝরে গেল। ত্রিকালের হাতের চাপ ক্রমশ বাড়তে লাগল।তিনজন সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে। ছটফট করছে ডাঙায় তোলা মাছের মতো। নিশ্বাস প্রশ্বাস ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে। ত্রিকাল তার যান্ত্রিক দুটি বাহুর চাপ আরও প্রবল করে তুলল। কঠিন নিষ্পেশনে, সারা লোকালয়ে যন্ত্রণার উৎস তিনটি শরীর অবশেষে তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করল নিজেদের। ওদের জিভ বেরিয়ে এসেছে প্রায় একহাত করে। চোখের তারা যেন ছিটকে বেরিয়ে আসছে। এলিয়ে গেল তিনটে দেহ......
    বাতাসের ইলেকট্রনে ইথারের তরঙ্গ দোল খাচ্ছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ দোল খেতে থাকে। ত্রিকাল তাতে মুখ তুলে গন্ধ শুঁকে শুঁকে কোন কোন ঘটনার বোধ হয় আগাম ইঙ্গিত পায়। নইলে সে কেমন করে জানল যে এই সময় এই জায়গায়......
    গভীর কালো কৃষ্ণ পক্ষের হিম নিশীথে একাকী তিনটে শবদেহ টেনে নিয়ে চলেছে ত্রিকাল অদূরে গঙ্গাবক্ষে জলাঞ্জলি দেবার জন্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন