এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  বিবিধ

  • ভালোবাসার দিন

    দ্যুতি
    আলোচনা | বিবিধ | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৮১২ বার পঠিত
  • * দাদুর কাঁধে মাথা দিয়ে ছোটতে ঘুমিয়ে পড়তাম। দাদুর নিজের বানানো ছন্দের গান, সানাই বাজিয়ে বর আসছে, ভ্যাপ্পোর ভ্যাপ্পোর ডুম ডুম ডুম। আমার ঘুমন্ত চোখ দাদুর সানাই শুনছে আর বন্ধ হয়ে আসছে।সে ছিল রোজের ভ্যালেন্টাইন্স ডে আমার।

    *ভাই হবার পর কি করে যেন ঠাকুমার স্তনের শুকনো বোঁটা মুখে নিতাম। ঠাকুমার গায়ের গন্ধে কি ওম পেতাম, ঠাকুমার নরম শরীর,তড়বড় করে কথা, রোজের পুজোয় ঠাকুরের নাম ভোলা, চক দিয়ে মাটিতে লেখা, দ্যুতি বলে ডেকে সেই নাম মেলানো, ঠাকুরের গান গাইতে গিয়ে হাউ হাউ করে কান্না সে ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা।

    * বাবার সেই খুচরো পয়সা দেওয়া। অথচ আমাদের কালে পকেট মানি ছিল না। বাবা আজো ফিরি যখন খুচরো আছে কি না জিজ্ঞেস করে।

    * একটা প্রচন্ড রাগী মা ছিল আমার। সে কখন ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা বকবকমের সঙ্গী হয়ে গেল বুঝি নি।

    *ছোটপিসির বিয়ে হতে আমি ফোরে পড়ি। রোজ রাতে ঘুমের সময় কাঁদতাম বিছানায় পিসি নেই বলে।

    * ন কাকার সাথে কম্পিটিশন করে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠতে না পারাটাকে জীবনের কঠিন পরাজয় মনে হত রোজ নকাকার সাথে স্কুল যাবার জন্য খেতে বসার সময়।

    *ছোটকা মানেই খুনসুটি, ছোটকা মানে একজন বডি গার্ড, গঙ্গাস্নানে গেলে, সিনেমা গেলে ছোটকা ছাড়া অচল।

    *কালীপুজো, ভাইফোঁটা মানেই জ্যেঠু আসবে। জ্যেঠু আসা মানেই হুল্লোড়।

    * বাপ্পুদার সাথে কি করে আজো এক টান আছে, ওর ব্যাথা আমার চার গুণ হয়ে লাগে। তবু দেখা হয় না কত কত দিন।

    * বড় পিসি মানে একটু এক্সট্রা নজর। হাতে বালা নেই কেন, কপালে টিপ নেই কেন। সেদিন বুঝিনি, আজ বড়পিসি চলে যেতে বুঝলাম আর কেউ অরিন্দমের জন্মদিনে সবার আগে ফোন করে না। আর কেউ শুধু শুধু ফোনে টিক টিক করে না। ভালোবাসার লোক কমতে লাগে।

    *সংসার নিয়ে খুব ঘেঁটে, দুটো পিঠোপিঠি ছানা, সেবার পুজোয় দেখে এলাম। অরিন্দম রাগ করতো প্রতি পুজোয় মামার বাড়ি যাই বলে, বাইরে থাকি, নিজেদের দিন আর হয় না আত্মীয়ের ঠ্যালা সামলাতে গিয়ে। ছেলে যেন সেই মামাদাদুকে চিনলো, এত বড় দাবার ঘুঁটি দেখে অবাক হয়েছিল খুব। সেবার বছর শেষ হবার আগেই মামা চলে গেল। খুব অভিমান হয়েছিল। কলকাতা থেকে দূরে বসে খুব কাঁদি। তারপর কতকাল মামাবাড়ি যাইনি। আমার মামা নেই এটা আজো মানতে পারিনা। মামা মানে নড়াচড়া মাছ, মামা মানে এক টিফিন বক্স জেলি লজেন্স, মামা মানে সামনে বসে গান, মামা মানে রাতে গরম রসগোল্লা, বোঁদে, মামা মানে চপ, তেলেভাজা, প্যান্থারাস,ছাতু মুড়ি আরো কত কি।

    * ওই যে স্টেফি গ্রাস এসেছে- একমাত্র ছোটমামাই বলত।

    *ভাই মানেই খুনসুটি, সেই ভাই সেদিন রাগ দেখিয়ে কেঁদেছিল খুব দিদির জন্য, বিয়ের পর চলে আসছি যখন। ভাইকে ছেড়ে থাকতে হয় সেই জানলাম।

    * একটা লোক কে খুব স্মার্ট লাগত, আমার অনেক আবদার মেটাতো। বাপের বাড়ির থেকেও বেশি খাতির করত আমার। সেই শ্বশুরমশাইটাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। খুব আফসোস।

    * বিয়ের পর থেকে নিজে শাড়ি কিনি নি তেমন। দরকারের আগেই জিনিস জুটিয়ে দিতেন।শ্বশুরবাড়িতে সেই নতুন বৌটি হয়েই কুড়ি বছরের বেশি কাটে যখন আসি। সেখান থেকে আজ তার যাবতীয় দেখভাল আমার ঘাড়ে। কাছ থেকে এক মানুষের জীবনের এরকম পরিবর্তন আমায়, আমাদের এক ঝটকায় আরো বড় করে দিল। আমার ডিমেনশিয়ার স্বীকার শাশুড়ী মা।

    * ভাই কে ছেড়ে থাকার দু;খ মুছে গেল মেয়ে যখন দূরে পড়তে গেল। কুঞ্চুকে ছেড়ে থাকাটাই আমার...

    *বিশ্বাস হয় না ছোটনের বয়স একুশ। আজো মা মা করে একটু বেশি। হোস্টেল যাবার সময় একটু পপ্পি দিয়ে যায়। খালি বলি মানুষ হও। মানুষ। সবার পাশে থেকো।

    *রাতদিন কাটাতাম সোমাদির সাথে একসাথে হলেই। আজ হোয়াটস্যাপে টুংটাং চলতেই থাকে।

    * রয়েছে দুই মাসী। মেজমাসীর হাসি কথা আজো কি ভালো লাগে। কলকাতা গেলে চেষ্টা করি দেখা করার। ছোটমাসী সেদিন ফোনে বিয়ের দিন কি করলি, নতুন শাড়ি পরলি এসব প্রশ্ন। ও মা, সাজলি না? বললাম পরশু যাবো বাইরে খেতে তখন ছবি দেবো।

    *আর কিছু ধন্য আমার সব মামার বাড়ির ভাইবোনদের জন্য। প্রতিটা সম্পর্ক বড্ড নিজের।

    *বন্ধুদের কথা আর কি বলি। ওরাই বলুক আমার কথা। বন্ধু পেতে ভালো লাগে। আমি কতটা ভালো বন্ধু হতে পারি জানি না। খুব প্রচন্ড লেগ পুল করি সবার। বন্ধু বলেই ধাঁ করে বলে ফেলি এটা ওটা। জানি ওরা তো বন্ধু। আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ওরাই।

    *এবার আসি সেই লোকটায়, ওকে নাকি আমি ভালোবাসতে শিখিয়েছি। হা ভগবান, উল্টা বুঝলি রাম কেস এখন অরিন্দমের সাথে। জীবনে এতটা জানা চেনা হওয়া কি ভালো, খটকা লাগে বৈ কি।

    আমাদের বড় দুর্দশা মাঝে মাঝে মনে হয়। এভাবে ভালোবাসার দিন উদযাপন করতে হয়। মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে তাকে বলতে হয় আজ ভালোবাসো, আজ ভালোবাসার দিন। এসব পাশ্চাত্য সংস্কৃতি একটা সময় আমরা নিতে পারিনি, কিন্তু এমন বিজ্ঞাপনের ঘটা, হুজুগ যে আমরা সবাই আজ শামিল। একমাত্র ভালোবাসাই তো আমাদের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বইবার কথা। কই আমরা তো হিংসার দিন সেলিব্রেট করিনা। জানি এরপরই আসে স্ল্যাপ ডে, কিক ডে এসব। কিন্তু এ উতসবের যেন এখানেই ইতি। এই রেষ থেকে যায়। কিন্তু তার মাঝেই খবর হয় ধর্ষণ কিম্বা পুলওমার কালো দিনের মত ঘটনা। আমাদের চারদিকে হিংসার আধিক্য। আমরা কারো ভালো দেখি না, দেখতে পারিনা, চাই না। সেদিন এক রেস্টুরেন্টে শুনি মা বাবাকে নিয়ে এলে বিশেষ ছাড় খাওয়া দাওয়া করলে। মানে আমরা ভালোবাসাকে পণ্য করে ফেলছি। সব থেকে কাছের মানুষ বাবা মা। তাদের ভুলছি সবার আগে। মায়ের পেটের ভাই বোন দাদা দিদি মানেই বিষ, সম্পত্তির বিষ ঢালা হয় সেখানে। কি করুণ,ভাবা যায়! তবে সেই বলা হত, যা নেই ভারতে তাই নেই মহাভারতে বা উল্টে যা আছে ভারতে তা আছে মহাভারতে। সত্যি সব আছে সেখানে। আর আমরা যেন সেগুলোই লালন করছি।

    ভালোবাসার দিন বলতে তাই মনে হল আমরা কোথাও নিজেদের খামতি ঢাকতে এসবে শামিল হয়েছি। একদিন এত পসার দেখতে ভালোই লাগে। তবে সবটাই লোক দেখানো, সবটাই করতে হবে বলে নয়।আসলে প্রতিটা মুহূর্ত ভালোবাসার। ভালোবাসা বাঁচুক। আমাদের মত করে বাঁচুক সে।চিবুক ধরে জড়িয়ে ধরায় যে সুখ সেই সুখ কি হ্যাপী ভ্যালেন্টাইন্স বললে আসে? জানা নেই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:৫৫729740
  • দ্যুতিদিদি, এ মায়াময় লেখা পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হল।
    "চিবুক ধরে জড়িয়ে ধরায় যে সুখ সেই সুখ কি হ্যাপী ভ্যালেন্টাইন্স বললে আসে? জানা নেই।" - আসে, আসে, তাও আসে। ভালোবাসার রকমফেরের কি আর শেষ আছে? :-)
  • অপু | 172.69.134.188 | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২২:৫৪729751
  • মন খারাপ করা লেখা। খুব ভালো লাগলো
  • দ্যুতি | 172.68.146.169 | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:২৩729784
  • সেই ভালোবাসার রকম ফেরের শেষ নেই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন