এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • গুরু বলি কারে

    কল্লোল দাশগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৩ মে ২০১১ | ১১৪৭ বার পঠিত
  • সেই কবে কোন নাম না জানা ধূলোট মূলের মানুষ গেয়ে ওঠেন
    আমার দেহ ছিলো শ্মশানের সমান / গুরু তুমি মন্ত্র দিয়ে করলে ফুলবাগান
    তারেই গুরু মানি
    মাতব্বর মুরুব্বিরা বলে গেছেন
    তেমন তেমন গুরু পাওয়া সহজ কাজ নয়
    বহু পূণ্যফলে / তেমন গুরু মেলে / যারে পাওয়া গেলে / ধন্য হয় অধম
    তাই হাহাকরে গেয়ে ওঠেন ঈদম শা
    মাঝি তর নাম জানি না / আমি ডাইক দিমু কারে
    ভাটির বিস্তার আর কালসীমা ছড়িয়ে সে ডাক আছড়ে পড়ে চেতন অবচেতনের সাঁঝে
    আর কোন অচিন পাখী আজও তার ডানা ঝাপটে যায় অন্তরের অন্তস্থলে
    মন তরে কে বা পার করে
    গুরু বিনে আন্ধার দশদিশা কোন পথে যাই কি কথা কই
    তখন পাশের বাড়ি নাকি ছায়াপথের ওপার হতে কিশোরী আমনকরের গলায় য়মন হয়ে ওঠেন শা ভিখন
    গুরু বিণা ক্যায়সে গুণ গাওয়ে
    কত আলোকবর্ষ দূর সময়কাল থেকে ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ পাথর যার ছোঁয়া পেলে ফুল ফোটে ধূ ধূ বালুচরে
    আমি ক্যামনে পাই কেথায় পাই যার জন্য অপার হয়ে বসে থাকেন লালন সাঁই আমি একা রইলাম ঘাটে / ভানু সে বসিলো পাটে / আমার তুমি বিনা ঘোর সংকটে / কি হবে উপায়
    আমি কোথায় পাবো তারে............. সর্প হৈয়া দংশন করো / ওঝা হৈয়া ঝাড়ো / মরিলে জিয়াইতে পারো / তোমার দয়া হৈলে
    আনাথের নাথ সে গুরু কে বলে দ্যায় তার ঠিকানা মাঝি তর নাম জানি না
    তবে এসব গুরু মুর্শিদরা কয়ে গেছেন। আমরা কিনা চ্যালা চাপটি মুরিদ মানুষ, আমাদের কি আর অত বাছাবাছি করলে চলে! আমাদের তো অথিক গুরু পথিক গুরু / গুরু অগণন।

    সেই কোন কিশোরবেলায়, বাতাসে যখন একই সাথে খেলা করছে বারুদ গ্রীষ্ম এবং ফুল না ফোটা বসন্ত, তখন এক অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা আমায় দারিদ্র শিখিয়েছিলো। ওয়াগন ভেঙ্গে নামানো চিনির বস্তা হাপিস করতে তিনটে জিআরপিকে ব্রিজের তলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলো বউ আর বোনের সাথে। বলেছিলো,
    - এট্টু খেলিয়ে লিবি, এট্টু সোময় লিবি।
    আমার পশুপতি গুরু।
    তারপর ইতিহাস হয়ে যাওয়া বারুদের গন্ধ ফুরাতে ফুরাতে মুছে গেছে কখন। বসন্ত কথা দিয়ে আসে নি। তাইতে গুরু গান বেঁধেছেন, কথা দিয়া বন্ধু ফির‌্যা না আইলা। ওদিকে সময় তখন অজস্র প্রশ্ন, দোলাচল আর খুঁজে বেড়ানোর সুড়ঙ্গে মাথা কুটছে। তীব্র এক অসহায়তা বুকে চেপে বাতাসে ফিসফিসে শিরশিরানি, আন্ধারে কে গো আন্ধারে কে, বসি একা ফেল চোখের জল। সেই সব অসহায়তা আর চোখের জল আমায় নিয়ে এলো তার ডেরায়।
    - গান বন্ধ করে দিলে কেন ? চলো আবার গান গাই।
    মিটিমিটি হেসে তামুকে আবিল গুরু হাতে একটা ছ'তারের যন্তর ধরিয়ে দিয়ে বল্লে,
    - যা দেবার ছিলো তা দেওয়া হয়ে গেছে। এবার থামতে হবে। এখন পাড়ি অন্য দিশায়। এবার তোরা গা। প্রাণ যা বলে তাই গা। - সে সব ঠিক আছে। তোমরা গাইবে না কেন? তোমাদের তো মানুষ ঠিকঠাক শুনলোই না। শুনলে মাথায় তুলে রাখতো।
    গুরু গান ধরলেন, আমরা গাইবো শুধু গান / আমরা চাই না ভুয়ো নাম / হতে চাই না শিরোনাম / থাকো ইচ্ছে হলে কিংবা কেটে যাও........
    আমার মণিগুরু।

    তখন পাগলপারা খুঁজছি তারে। সে কোই। পশ্চিমে মুখ ফেরাই। ভেসে আসেন এলভিস, বিটলস, ডিলান, লেনন আর বেলাফন্তে, পিট সিগার, জোন বায়েজ। সে এলোমেলো বেলায় বড়ো আপন লাগে ওঁদের। আমার নতুন পথের বাঁকে বাঁকে জুড়ে থাকে ঐ উচ্চারন। তবু খোঁজ থামেনি কেন কে জানে।
    পথ কবে নিয়ে গেছে সোনামুখীর খৈরবনিতে সনাতন গোঁসাইয়ের আশ্রমে, সে আর খেয়াল নাই। সে এক অনন্ত গানের মেলা। গোঁসাই, মা-গোঁসাই আর শিষ্য-পুত্র-কলত্র নিয়ে গোটা চল্লিশ জনের সংসার। সে সংসারে গান ঘুরে বেড়ায় চৌপর রাতদিন।
    কোন ভোর সক্কালে গোঁসাই সকলরে নিয়ে মাধুকরীতে বের হন। গান গাইতে গাইতে ঘুরে আসেন আশে পাশের গ্রাম। যে যা দেয়, কলাটা মুলোটা হাত পেতে নেন তিনি। তখন বয়স কম, ফলে তক্কো করা প্রায় নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই বিনা আয়াসে চলে আসতো।
    - বেশ তো বাপু গান গেয়ে পয়সা কড়ি হয়। আবার এ সব ভিক্ষে টিক্ষে কেন?
    গোঁসাই হাসেন।
    - বেশ মজা না? গান গাইতে গাইতে বের হলে, আর লোকে ওমনি এটা ওটা সেটা দিয়ে দিলো। বিনা খাটনিতে রোজগার।
    গোঁসাই হাসেন।
    - শুধু হাসলে হবে? উত্তর দাও।
    গোঁসাই হাসেন।
    - আবার নাম দিয়েছে মাধুকরী!
    গোঁসাই হাসেন। বলেন, আজ রাতে আসিস।
    রাত এলো। মাথার পর সহস্র কোটি তারা রাত জেগে বসে আছে। তার নীচে বসেছেন গোঁসাই । হাত ধরে পাশে বসালেন পুত্র প্রতিম এক অবোধকে।
    - বল তো পৃথিবীতে কতো মানুষ?
    - ঠিক জানি নে।
    - তবু কতো হবে?
    - ঐ তারাদের মতো হাজার হাজার কোটি কোটি।
    - তবে বল, এই যে এতো মানুষ, তার মধ্যে গান গায় কতটি?
    - এ বলবো কি করে!
    - আন্দাজ করেই বল।
    - হয়তো কয়েক লক্ষ।
    - তার মধ্যে কতটি এই তোর আমার মতো গান গেয়ে বেড়ায়, যাদের লোকে গায়ক বলে?
    (এখন লিখতে বসে লজ্জায় হাত সরছে না। গোঁসাই তারে আর আমারে একাসনে বসিয়েছিলেন। কতো বড়ো মূর্খ ছিলেম যে, তারপরেও গোঁসাইয়ের চোখের পানে তাকিয়ে কথা বলেছি। )
    - কতো আর হবে! লাখ খানেক।
    - তবে ভেবে দ্যাখ দিনি, এই জগত সংসারের হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষদের মধ্যে তুই লাখে এক।
    - তা বটে।
    - কেমন গর্ব হয় বল?
    - তা হয়।
    - হয়ে গ্যালো। তোরে অহম ধরলো। তোর দ্বারা আর কিছু হবে না।
    - সে তো তুমিও।
    - অ্যায়, ধরেছিস এক্কেরে ঠিক।
    - তবে?
    - তাই তো মাধুকরী।
    - সে আবার কী?
    - সে ভিক্ষেই তো। ভিক্ষে করলে সবার কাছে মাথা নীচু করতে হয়। মাথা নীচু করতে শেখ, তবে পার পাবি। রোজ তিন জনের কাছে ভিক্ষে করবি। পয়সা চাইবি না। এই যেমন চা খাওয়াতে বলবি, একটা বিড়ি চাইবি, তাতেই হবে। সক্কলের কাছে মাথা নীচু করতে শিখবি।
    সেই যে মাথাটা নামিয়ে দিয়েছিলেন।
    অমাবস্যায় চাঁদের উদয়। সে তো গুরুই পারেন। যিনি অ¡ন্ধার (গু) দূর করেন (রু)।
    আমার সনাতন গুরু।

    সেবার বই মেলায় আমাদের বড়ো হৈ হৈ। ৯১ কি ৯২ সাল হবে। আষ্টে পৃষ্টে ললাটে বাঁধন, আর তা নিয়েই গেরস্ত পথচলার মাঝে মাঝে ক্ষ্যাপা হাওয়া আসে। সকলের তাল উঠলো কালাদার গানের ক্যাসেট বের করতে হবে। কালাদা মানে কালাচাঁদ দরবেশ। উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়িতে বসে আছেন উনি। মন করলে ইদিক সিদিক যান, নয়তো ডেরার দাওয়াতেই পিথিমী গো পিথিমী।
    তারে রাজি করানো কি চাট্টিখানি ব্যাপার। সে ক্ষ্যাপা বলে,
    - দূর ও দিয়ে কি হবে
    সে এক যুদ্ধ বটে। শেষমেশ রাজি হলে, তাকে নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। দিব্যি রেকর্ডিং হলো। তাপ্পর বইমেলার আগে সে ক্যাসেট তৈরী। এবার বেচা হবে বইমেলার চত্বরে। তখনো বই মেলায় স্টল ছাড়াই মাটিতে বসে কতো কি বিক্কিরি হতো। ক্যাসেট, ছোট পত্রিকা, মাটির গয়না, ছবি। বইমেলা তখনো মেলাই ছিলো, বই শিল্পের মেলা হয়ে ওঠেনি।
    তা, গোটা চারেক দোতারা, একটি শ্রীখোল, আর একখান গিটার এবং কালাদা স্বয়ং। খুব কষে গান বাজনা চালছে। কালাদা গাইছে আমরা ধুয়ো ধরছি। মাঝে মাঝে আমরা নাচিজরাও গান টান গাইছি আরকি। ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে, যেমন হওয়ার। তখনো তো কালাদারে এতো লোকে চেনে না।
    আগের দিন একদল ছেলেপুলে কিছু ক্যাসেট কিনেছিলো। তারা আবার এসেছে। গান শুনছে, ধুয়ো ধরছে। এর মধ্যে একটি কালাদারে কয়,
    - কাল সারারাত আপনার ক্যাসেট শুনেছি। ভীষণ ভালো লেগেছে।
    কালাদা কেমন চোখ টোখ বড়ো বড়ো করে বল্লে
    - কার কেছেট?
    - কেন আপনার!
    - আমার কেছেট? সেডা কি বস্তু?
    ছেলেটির সাথে সাথে আমাদেরও হৃদপিন্ড প্রায় একবার ধুকপুক করতে ভুলে গেছিলো। কালাদা বলে কি! তবে কি, ততোদিনে কিঞ্চিত কম গাধা হয়েছি, তাই বুজুর্গের কাথার মাঝে ফোড়ন না কাটার শিক্ষে পাওয়া হয়েছে। ফলে সক্কলের মুখে দ্রিঘাংচু গাম্ভীর্য।
    ছেলেটি অসহায়ের মতো কালাদাকে বললো,
    - এই যে আপনার ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে। এই যে কালাচাঁদ দরবেশ। সে আপনিই তো!
    - অ এই কথা। আমিউ কালাচাঁদ, হেও কালাচাঁদ। তয় কি আমি তো হেই কেছেটের কালাচাঁদ নই। হ্যায় অন্য কালাচাঁদ।
    ওদের দলটা কেমন আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে উঠে গেলো। আর আসে নি।
    কালাদাকে জিগালাম
    - এইডা কি হইলো?
    দরবেশ হাসেন।
    - না না, তুমি এমন অস্বীকার করলা ক্যান?
    - দূর ছ্যামড়া, বুঝেউ না। আত্মপ্রশংসা শুনতে নাই।
    আমার কালাগুরু।

    তার সাথে আলাপ ৭৮এর বন্যায় ডোবা ময়না মহকুমার এক গ্রামের ইস্কুল বাড়িতে। চমৎকার গান গাইতো। তার তিনকূলে কেউ নেই, এমনটাই বলতো সে।
    বন্যা মিটে গেলে, কলকাতায়। এর ওর তার বাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে থেকে গেলো আমাদের সাথে। মাস তিনেক গানে আড্ডায়, কবিতায় ভেসে যাচ্ছি আমরা। হঠাৎই একদিন সে নিরুদ্দেশ। এরকম ভাবে চলে যাওয়ার মধ্যে হতচকিত হয়ে যাওয়া ছাড়াও একটা অনতিক্রম্য রোমান্টিকতা থাকে, যা আমাদের আবিষ্ট করে রেখেছিলো কয়েকদিন। তারপর ধীরে ধীরে বহু কুন্ঠায় আবিষ্কৃত হলো, অমুকে তার জামাটা পাচ্ছে না বা তমুকে তার ঘড়িটা। এর বাড়ি থেকে তিরিশ টাকা নিয়ে গেছে - মাসীমা, খুব দরকার - বলে; ওর ট্রানজিস্টার রেডিওটি নিপাত্তা। একটা ছিঁড়ে খাওয়া রাগ আমাদের ঝলসে দিচ্ছিলো।
    শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা গেলো। মাঝে কেটে গেছে দু দুটি বছর। এলাকায় তুলে এনে বেধড়ক মার। এক ফোঁটা বাধা দেয় নি সে। সমস্ত অভিযোগ আর মার মুখ বুঁজে মেনে নিলো। তারপর চলে গেলো।
    তারও অনেক বছর পরে দেখা অপিস পাড়ায়। আমি দেখতে পাই নি। দেখতে পেলে হয়তো এড়িয়েই যেতাম। সেই ডাকলো নাম ধরে।
    - কি রে, চিনতে পারছিস?
    আমার সারা চেতন জুড়ে দ্বিধা, রাগ আর গ্লানিবোধ।
    - চল চা খাই।
    চা খাওয়া আর কথা চলছে। মূলত: সেই কথা বলছে। বন্ধুদের খবর জানতে চাইছে। আশ্চর্য, অনেকের খবরই তার জানা।
    আর না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম
    - তোর খারাপ লাগে না? লজ্জা করে না এই ভাবে লোককে ঠকাতে?
    সে আমায় চোখে চোখ রেখে বল্লে
    - কোনদিন মিথ্যা কথা বলেছিস?
    - তা বলেছি, কিন্তু........
    - আমিও তাই বলি। তফাৎ হলো তুই মিথ্যা কথা বলে রোজগার করিস না, আমি করি।
    আমরা বন্ধু হলাম।
    মাঝে মাঝে দেখা হতো। আবার কোথায় উধাও হয়ে যেতো। ফিরেও আসতো। তেমনি একবার কোথা থেকে যেন ফিরে এসে প্রথমেই বল্লে
    - সব জেলখানা পাহাড়ে হওয়া উচিৎ।
    - হঠাৎ?
    - পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এতো ছোট মনে হয়, যে তারপর এই সব চুরি-চামারী-মিথ্যা সব অবান্তর লাগে রে!
    একটা আস্তো উপন্যাসের মতো মানুষ। আমার মংগু গুরু।

    হেমাঙ্গ বিশ্বাস একটা চীনা গান গাইতেন, তাতে দুটো পংক্তি ছিলো, জল ছাড়া থাকেনা মাছ / লতাহীন থাকে না আঙ্গুর...........
    চ্যালা ছাড়া গুরু হয় সে ক্যামনে? মুরিদ ছাড়া মুর্শিদ? গুরু-কিস্যা, সে তো আধেক চাঁদ। শিষ্য-সংবাদ বিনা তার পূর্ণিমা পূর্ণতা কোথায়? সাধে কি আর সন্ত কবীর বলে গেছেন , গুরু মিলে লাখে লাখ / চেলা মিলে না।
    সে ছিলো সুরে ডোবা মানুষ। সুরের দেবতা তারে নিজে হাতে তৈরী করেছিলেন। সুর আর ভাগ্যের দেবতা নিশ্চই আলাদা, তাই........
    সে যাক।
    তার সেতারের হাতটি ছিলো বেলাকার খেজুর রসের মতো মাতাল করা, অথচ মেজাজে পারস্যের গালিচার মতো ধ্রুবপদী। কতোদিন রেওয়াজের সময় চুপটি করে তার ঘরের কোনায় বসে থেকেছি, কখনো আহীর ভৈরোঁ, কখনো শ্যাম কল্যান, কখনো ছায়ানটে ডুবে ভেসে ডুবে।
    সেবার অনেকদিন পর পন্ডিত রবিশংকর বাজাচ্ছেন কলকাতায়। সকলে মিলে শুনতে যাওয়া। সারা রাতের রবীন্দ্রসদনে সেদিন বান ডেকেছিলো। বানভাসি আমরা ফজরের বাতাসে ভাসতে ভাসতে কেওড়াতলার চায়ের দোকানে। আমাদের মুগ্ধতার কলরবে সে ছিলো অদ্ভুতভাবে শান্ত, কিছুটা আনমনা। খেয়াল হতে জিজ্ঞাসা করলাম,
    - কি হলো, এতো চুপ মেরে আছো?
    - উনিই গুরু। উনি শেখালে শিখবো, নয়তো আর বাজাবো না।
    আমরা তড়িতাহত। এ বলে কি!
    - তুমি তো দিব্যি বাজাও.............
    - আমি তারে হাত রাখতেই শিখিনি এখনো। কোথা থেকে কিভাবে যোগাযোগ হয়েছিলো আজ আর মনে নেই। তবে, দ্যাখা করতে রাজি হয়েছেন পন্ডিতজী। সেদিন বিকালে সময় দিয়েছেন। আড্ডা তারে দূগ্গা দূগ্গা বলে রওনা করিয়ে, হাপিত্যেশে বসে আছে, কি হয় কি হয়। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। সে এলো।
    - রাজি হয়েছেন শেখাতে। বলেছেন যা শিখেছি সব ভুলে যেতে। আর একটা সাপাট দিয়েছেন, এক বছর পরে শুনবেন।
    - কেমন সাপাট?
    - স র গ ম প দ ন স / স ন দ প ম গ র স
    - ব্যাস!
    - ব্যাস।
    আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম তার উজ্জ্বল চোখের দিকে। অনেক দূরে দৃষ্টি ছিলো তার। আমরা সে দূরত্বের হদিশ পাই নি।
    এক বছর কাটলো, যেমন কাটে। শুধু আমাদের রেওয়াজ শোনা চুলোয় গেছে। কি শুনবো! ধ্যাররররৎ - ধ্যাররররৎ চলছে রাতদিন-সাতদিন।
    বছর ঘুরে সেদিন এলো। আবারও আড্ডা তারে দূগ্গা দূগ্গা বলে রওনা করিয়ে, হৃদপিন্ডের আওয়াজ গুনছে। এবারে কিঞ্চত সন্দেহে থাকা। ঐ ধ্যাররররৎ - ধ্যাররররৎ শুনে কাউকে কী বিচার কে করবে, তাতে আমাদের ঘোরতর দ্বিধা ছিলো।
    দূর থেকে দেখা গেলো ওই সে আসছে।
    মস্তো একটা হলঘরে তিনি বসে। সেতারটি বাঁ দিকে একটু বেশী হেলিয়ে ধরা। ঘর ভরে আছে তাঁর শিষ্যকুলে। একে একে এসে তারা বসছে ওঁর সামনে। বাজিয়ে শোনাচ্ছে গত বছরের "পড়া"। খুশী হচ্ছেন, অখুশীও, কখনো বিরক্ত। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে বোঝাচ্ছেন, দেখিয়ে দিচ্ছেন সকলকে। যন্ত্র মিলিয়ে বসে আছে সে, এক দৃষ্টে তার আরাধ্য দেবতার পানে চেয়ে। দেবতার ফুরসৎ কোই!
    শেষ পর্যন্ত নয়নে নয়ন মিললো, শেষ বেলায়। সকলে যার যার যন্ত্র গুছিয়ে নিচ্ছে তখন।
    - এসো।
    সে বসলো এসে তাঁর সামনে।
    - কি যেন দিয়েছিলাম তোমায়?
    পা ছুঁয়ে প্রণাম সেরে, ডান হাতটি লাউয়ের উপর রাখলো সে। তার ছুঁলো মেরজাপ, আর বাঁ হাতের আঙ্গুল ছুঁলো - সা।
    যে সুরের ফলা জ্যামুক্ত হয়েছিলো তার পরমুহুর্তে , তা নি:শেষে মুছে নিয়েছিলো পারিপার্শিক শব্দসমূহ। শুধু চরাচর জুড়ে রয়ে গেলো এক অলৌকিক সাপাট। তাঁর হতচকিত ভ্রুযুগল সামান্য কুঞ্চিত হয়েই চকিতে চেতনে।
    - ভালো। আমি বলে দিচ্ছি, আমার কোন পুরোনো ছাত্রের কাছে এক বছর শেখো। তারপর আমি দেখবো।
    - আপনি শেখাতে রাজি হলে শিখবো। নইলে সেতার তুলে রেখে দিয়ে ভালো শ্রোতা হবো।
    পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি তার দিকে। রবির প্রসন্ন কিরণ দীপকের দীপ জ্বেলে দিলো সেই সন্ধ্যাকালে।
    - যাও, মা-বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে এসো। আজ থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে, আমার সাথেই ঘুরবে, যেখানেই আমি যাই। আমার কাছেই শিখবে তুমি।
    কোথাও অসময়ে উচ্চারিত হলো ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং............

    সূয্যি পাটে যাবার সময় হলো গুরুগো।

    আমার হেলায় ফেলায় দিন গড়ালো
    অনেক হলো খেলা
    অপার হয়ে বসে আছি
    ফকির সন্ধ্যাবেলা............
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৩ মে ২০১১ | ১১৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • I | 24.99.97.106 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪২89012
  • আহা ! অসাধারণ! এই লেখাটা কিছুটা তো আগে পড়া ছিল। পুরোটা মিস করে গেলাম কিভাবে !!
  • I | 24.99.97.106 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪৩89013
  • কল্লোলদা, এই লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার করবো? তোমার নাম দিয়ে, অবশ্যই!
  • কল্লোল | 125.242.143.11 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:৪৩89014
  • বড়াই। ধন্যবাদ। লেখাটা ফেবুতে শেয়ার করলে আমাত তো আপত্তি নাই।
    ক্ষ্যাপা। এই তো টুক টুক করে লিখি গান গাই। আলসে মানুষ এর বেশী আর কিই বা কত্তে পারি।
  • শিবাংশু | 127.201.150.197 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:৫১89015
  • গুরু জগত উদ্ধারো
    গুরু, কাঙাল জানিয়া পার করো....

    এই লেখাটি পারের কড়ির দাম পাবে।

    পন্ডিতজির সঙ্গে তাঁর শিষ্যের গল্পগুলো এবার আসুক।
  • Ishani | 69.92.194.98 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৫:০২89016
  • এই লেখাটা ....আগে পড়লে একরকম লাগত | আজকে সন্ধেবেলা কল্লোলদার সঙ্গে আড্ডার পর , গানের পর ...অন্যরকম আমেজ ছড়াল | এক্কেবারেই অন্যরকম |
  • সৌমিত্র বসু | 120.224.222.201 (*) | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১১:২৯89011
  • দুর্ধস্য লেখা টা তো মাইরি । তুমি তো লেখা ধরতে পর, সেটা করো না ক্যানো । যেটা ভালোবাসো বোঝো না যে তার থেকেও তোমাকে নিরবে ভালবাসে অন্য এক জনা ।
  • kiki | 125.124.41.34 (*) | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৪৩89017
  • আহা! ভাগ্গি ইন্দোদাদা ফেবুতে শেয়ারিয়েছিলো।
  • | 172.136.192.1 (*) | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:৪৩89018
  • *
  • ranjan roy | 24.98.55.35 (*) | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:০৫89019
  • আমার নাস্তিক গলায় এই ভোরবেলায় বেজে উঠলো--- ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং---

    হ্যাঁ, পারের কড়ির দাম পাবে।
  • ধুরন্ধর ঝাঁট | 127.194.26.48 (*) | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:৪১89020
  • লা জবাব
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন