এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ফেলে আসা দিনগুলো

    Sambuddha Acharyya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ এপ্রিল ২০১৪ | ১৬৩২ বার পঠিত
  • কালবৈশাখী

    অনেক অনেকদিন হয়ে গেল, কিন্তু সেরকম ঝড় আর দেখলাম না। সেই সব অদ্ভুত, সারা আকাশ কালো করা, নারকেলগাছ নুইয়ে, মাটিতে ঠেকানো ঝড়। অনেকদিন আগে যখন সাইকেল করে চূর্ণী নদীর ধারে সিগারেট খেতে যেতাম, যখন বৈশাখ মাসের শেষ, যখন সারা দুপুরের গরমে সেঁকতে থাকা রানাঘাট শহরতলি পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কমলা-হলুদ রং মাখত, যখন পিচে ঢাকা ধুসর রাস্তায় খালি পা ঠেকানো যেত না, যখন চূর্নির ধারের ছোট ছোট ঝোপের পাশে সাইকেল স্ত্য্যান্ড করার সময় বুনো গন্ধ ভেসে আসত, ঠিক তখনি অনেক দূরে, চুর্নী যেখানে বাঁক নিয়ে বাঁদিকে চলে গেছে, সেখানে, আকাশের কোনায় ছোট্ট একটা কালো মেঘ দেখা দিত। অনেকসময় এরকম ও হয়েছে, সিগারেট এর অভাবে বিড়ি ধরিয়ে সেই কালো মেঘ এর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। তখন মাধ্যমিক শেষ করা যৌবন, হাতের কাছে একটা সাইকেল আর চোখে সহপাঠিনীদের স্বপ্ন। প্রাইভেট টিউশন ক্লাসে স্যার বসতেন ঘরের মাঝে একটা শতরঞ্চি পেতে, তাঁর বাঁদিকে মেয়েদের দল আর ডানদিকে ছেলেরা. মুখোমুখি বসে কখনো চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থেকেছি, মেয়েরা খুব বেশি লাজুক ছিলনা, তারাও তাকিয়ে থেকেছে সমানে। কখনো মাটিতে ঝুঁকে নোট নেওয়ার সময় অব্যর্থ দৃষ্টি চলে গেছে কারো ক্লিভেজে, আর সেই মুহুর্তের দীর্ঘশ্বাস হয়ত সবাইকে ই বুঝিয়ে দিত যে তারা ও কিছু একটা মিস করেছে মুহুর্তের ব্যবধানে। অনেক স্বপ্ন তখনো দেখা হত, যেগুলো আজ অনেক দিন পরে, অদ্ভুত বা অসাংবিধানিক মনে হয়, কিন্তু প্রাকযৌবন বেড়ে উঠেছে সেই সব স্বপ্ন ঘিরেই। শহরতলির গরম,ঘাম ঝরানো দুপুরে একলা ঘরে কোনো বিশেষ সহপাঠিনীকে চুমু খাওয়ার স্বপ্ন, স্কুলের সবচেয়ে ফাস্ট বোলার কে স্টেপ আউট করে লং অন এর উপর ছক্কা মারার স্বপ্ন, প্রি টেস্ট এর অঙ্কের পেপারে পাশ করার স্বপ্ন অথবা কেমিস্ট্রি ল্যাব এ টাইট্রেশানে প্রথম চান্সেই সফল হওয়ার স্বপ্ন। বলা বাহুল্য বেশিরভাগ ই এখনো স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে, এখন চেষ্টা করে ও সেরকম স্বপ্ন দেখতে পারি না. হয়ত এখন অবচেতন মন অনেক সেয়ানা, অনেক বাস্তববাদী, অথবা এখন আর অবচেতন মন বলে কিছু নেই, যা আছে সেটা প্রাকযৌবনের সযত্নে দেখা স্বপ্নগুলোর একটা নস্ট্যালজিক হ্যাং-ওভার.

    সে যাই হোক, ফিরে আসা যাক ঝড়ের কথায়। সেই ঝড়, যেটা শুরু হত চূর্নির বাঁকের আকাশে ছোট্ট কালো মেঘের কোনায়, সিগারেট বা বিড়ি শেষ হতে না হতে ই সেই মেঘ ছড়াত গত আকাশে, পুরো দুনিয়া তখন অদ্ভুত থমথমে, কোথাও কোনো হওয়া বইত না, কোনো মেঘ ডাকত না। ঠিক তখনি আমরা বুঝে যেতাম - কালবৈশাখী। সাইকেল ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ানোর প্রস্তুতি করতে করতে ই বুঝে যেতাম যে সেসব করার আর সময় নেই, সিগারেট এর ঠেক থেকে বাড়ি ছিল প্রায় ৫-৬ কিমি। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয়ে যেত ধুলোর ঝড়, প্রথমে বইত গরম হাওয়া,কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে চূর্নির ওপারে। ঝাপসা হয়ে যাওয়া নদীর অন্য পার একটা অদ্ভুত রোমান্টিক অনুভূতি নিয়ে আসতো, ঠিক যেমন অনুভূতি হয় দু:খ বিলাসে, ঠিক যেমন প্রথম বিরহের সময় বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে ভালো লাগে, ঠিক যেমন অনুভূতি হয় সেই মেয়েটিকে অনেক বছর বাদে হঠাত বাজারের মধ্যে মুখোমুখি দেখলে, যাকে ভালো অনেক বেসেছি, কিন্তু সাহস করে কোনদিন বলতে পারিনি। চুর্নী কে ও কোনদিন সাহস করে বলতে পারিনি যে ঝড়ের সময় তাকে কতটা সুন্দর, কতটা রোমান্টিক লাগে। অভিসারিনী নদী, যার ওপার ঘেঁষে বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টি র ফোঁটা জলের উপর কার্পেটের মত ছড়িয়ে পড়ছে। যারা নদীর উপরে কালবৈশাখী দেখেনি, তারা কোনদিন বুঝতে পারবে না এই অনুভূতি.

    ঝড় শুরু হয়ে যেত তুমুল ধুলো আর গাছের শব্দে। নারকেল গাছ নুয়ে পড়ে মাটি ছুঁতো। ইলেকট্রিক পোস্ট তার সমেত কোথাও নুয়ে পড়ত, কোথাও তারের উপর গাছ পড়ত। গোটা এলাকা অন্ধকার। শহরতলির লোডশেডিং একটা অদ্ভুত আবহ নিয়ে আসত। তখন তো আর ফেসবুক ছিল না, না ছিল বাড়িতে বসে ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নিয়ে সময় নষ্ট করার অজুহাত. আমাদের বাড়ি ছিল অর্ধেক পাকা আর অর্ধেক টালি আর এসবেস্টস দেওয়া। বাড়ির সামনে ছিল বড় উঠোন আর উঠোনের দুপাশে অনেক অনেক গাছ. কাঁঠাল, আম, জাম, নারকেল আর জবাগাছ. রোজ ভোরবেলায় সেই জবাগাছে ফুল ফুটত, কোথাও লাল, কোথাও ফ্যাকাশে লাল. একটা পঞ্চমুখী জবাগাছ ও ছিল, যেটায় ফুল কম ফুটত কিন্তু যখন ফুটত তখন দেখে মনে হত শিশিরমাখা গাছে লাল রঙের চুনি ধরেছে। ভোরবেলায় ঠাকুমা একটা গামছা পরে, দাঁতে নস্যি নিয়ে, সাজি হাতে ফুল তুলতেন। বৃষ্টির সময় রাত্রিবেলা এসবেস্টস এর ছাদে জলের ফোঁটা পড়ার করকর আওয়াজ, উঠোনের জঙ্গল থেকে বেরোনো সাপ দেখা জানলা দিয়ে, উঠোনে জমা জলে কাগজের আর পিচ বোর্ড এর নৌকা ভাসানো, রান্নাঘরে কেরোসিন এর কুপির আলোয় মাটির উনুনে ঠাকুমার বেগুন ভাজা - এসব আর ফিরে পাওয়ার নয়, শুধুই ফিরে দেখার। লোড শেডিং এর সময় জ্বালানো হত পেটমোটা কাঁচের ল্যাম্প, তার উপরে থাকত টিনের চিমনি। সেই ল্যাম্পের মায়াবী হলুদ আলোয় কখনো পড়া হত হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি, কখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল আবার কখনো ল্যাভয়্শিয়ের এক্সপেরিমেন্ট। গুগল বলতে তখন জানতাম একটা সংখ্যা, এক এর পিঠে ২৩ টা শূণ্য। কম্পিউটার ছিল আনন্দমেলার ছবি, ল্যাপটপ শোনা হয়নি তখনও, চাকরি বলতে জানতাম দশটা পাঁচটার সরকারী অফিস, ধুলোপড়া ফাইল আর বাবার টিফিনবাক্সে রুটি-তরকারী প্যাক করে নাইট-ডিউটি তে যাওয়া। সেই আনন্দমেলা ভোল বদলে আজ আছে, ল্যাম্পগুলো র চিমনি পড়ে আছে বাড়ির কোনো কোণে, বাবার নাইট-ডিউটি র ব্যাগ বা টিফিন বাক্স অনেকদিন গত হয়েছে, ঠাকুমার ফুলের সাজি ও আর নেই, যা আছে তা শুধুই কারসাজি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিন্ত সুদৃশ্য ঘরে বসে ল্যাপটপে আবর্জনা বানানো আর ইমেইল করার কারসাজি, দিনের শেষে বাড়ি ফিরে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার কারসাজি - সুখে আছি।

    ঝড় যখন শুরু হয়ে ক্লাইম্যাক্স এ পৌছাত, তখন শুরু হয়ে যেত বৃষ্টি, কখনো শিল পড়ত। বাড়িতে থাকলে সেই শিল বাটিতে ধরে রুটি দিয়ে খাওয়া হত। আমরা ভিজতাম সাইকেল চালাতে চালাতে, আমার চোখের চশমা জলে ভিজে ধোঁয়াটে হয়ে যেত, গায়ের জামাকাপড় চুপসে ভিজে লেপ্টে যেত। ঢালের রাস্তায় একদঙ্গল ছেলে ভিজতে ভিজতে হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতাম, তাতেই শিভালরীর অনুভূতি, যুদ্ধ জয় করার আনন্দ। আকাশের কালো ভাব তখন চোখে অভ্যস্ত হয়ে যেত, জানতাম বাড়িতে খিচুরী রান্না হবে, সাথে ডিম আর বেগুনভাজা। রাস্তায় জমা জলের উপর তীব্রবেগে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত আনন্দ এখন গাড়ি চালিয়ে পাওয়া যায় না, এখন বৃষ্টি তে ভিজতে দেখি রবিনা ট্যান্ডন দের, আমার ছেলে কোনদিন এসবেস্টস এর ছাদ, কুপির আলো, মাটির উনুন, হারকিউলিস সাইকেল দেখবে না। আমার ছেলে কোনদিন হয়ত জানবে না বৃষ্টির দিনে খিচুরী আর বেগুনভাজা খাওয়ার আনন্দ, কোনদিন সাইকেল নিয়ে সহপাঠিনীদের রিক্সার পেছনে যেতে যেতে কিশোরকুমার এর গান গাওয়ার টেম্পারামেন্ট রাখবে না। ডিজিটাল যুগ আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, আমাদের গোটা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। কিন্তু ছোটবেলার সেই কালবৈশাখী ফিরিয়ে দেওয়ার টাইম মেশিন এখনো কোনো প্রযুক্তি দিতে পারেনি, না পেরেছে দিতে সেই হ্যাং ওভার কাটানোর প্রতিষেধক।

    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    ফেলে আসা পয়লা বৈশাখ

    একটা পইলা বৈশাখ এসে গেল, হই হই করে, ফেসবুক কাঁপিয়ে. এই ডিজিটাল যুগে আমরা কিন্তু সেটুকু ই মাতি, যেটুকু সুযোগ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং আমাকে দেয়. মানে এই একটু স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম: "শুভ নববর্ষ, সকলের ভালো হোক" বা দু লাইন কবিতা.একটু বিদ্রোহী যারা বা ফেসবুক এ নতুন, কিম্বা যারা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর নামে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন, তারা লিখবেন একটু বাঙালি হায় হায় জাতীয় বাক্য. অনেকে ই আছেন যারা ফেসবুক ইত্যাদি দু-চোখের বিষ বানিয়ে রেখেছেন, কিন্তু সুযোগ পেলেই একটু সমালোচনা, একটু কড়া ভাষায় স্ট্যাটাস আপডেট দিতে ভোলেন না. অনেকে আবার একটু মিষ্টি, একটু দই এর ছবি লাগাবেন. অনেক লাইক পড়বে, অনেকে কমেন্ট ছাড়বেন "জিভে জল এসে গেল". অনেক প্রবাসী বাঙালি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন আর পিপিটি বানাবেন অফিসে বসে. মোটের উপর, বেশ একটা সাজো সাজো রব, একদিনের জন্যে. অনলাইন কবিতা কম্যুনিটি আর লিটিল ম্যগাজিন এর সাইট গুলোতে কবিতা দেওয়ার ধুম পরে যাবে. কেউ লিখবেন রাবীন্দ্রিক ছন্দে, কেউ জীবনানন্দের ট্রামে কাটা পরা স্টাইলে আবার কেউ বা ভয়ানক বিদ্রোহ দিয়ে, তৃনমূল-সিপিয়েম এর গুষ্টি উদ্ধার করে, একটু কাঁচা খিস্তি দিয়ে ক্ষুধার্ত জেনারেশন কে ফিরিয়ে আনতে চাইবেন. ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে নতুন পোশাক টোশাক পরে ছবি লাগাবেন. ছেলেদের ছবিতে বন্ধুরা খিস্তি মেরে যাবে, মেয়েদের ছবিতে হাজার বিশেক লাইক আর কমেন্ট পড়বে. একটা দিনের উত্সব, বাঙালির নববর্ষ.ফিরে যাই বছর কুড়ি আগে. যেদিন ১৩৯৯ থেকে ১৪০০ সন এলো. এই সময়টা আমার বিশেষ করে মনে আছে. কারণ নতুন শতাব্দিতে পা রাখার দিন. আমাদের স্কুলে এর আগের দিন একটু বিশেষ অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিল, প্রধানশিক্ষক এর বক্তৃতা, সহ-প্রধানের স্মৃতিচারণ, গান, কবিতা পাঠ এইসব. মনে আছে সে সময়টা ছিল ভয়ানক গরম. আমাদের মফস্বল শহর, অদূরে কর্কটক্রান্তি রেখা গেছে কৃষ্ণনগর এর উপর দিয়ে. তাই চরম-ভাবাপন্ন আবহাওয়া. এই সময় স্কুল এর কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া র ছায়ায় ঢাকা চত্ত্বর, পুরনো মত কালো করিবর্গা দেওয়া ঠান্ডা আর অন্ধকার ঘর, পাশের চুর্নী নদীর ঠান্ডা বাতাস, আমাদের ঘরের চেয়ে স্কুল ই বেশি আকর্ষণ করত. আর সে সময় সোশ্যাল নেট\ওয়ার্কিং দুরে থাক, কম্পিউটার এর নাম ই পরেছি শুধু আনন্দমেলায়. আমাদের সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল খেলা. কাদা মাঠে ফুটবল, স্কুল শেষ হওয়ার পর স্কুল এর লম্বা করিডোর এ ৫০ গ্রাম বল এর ক্রিকেট আর কখনো স্কুল থেকে পালিয়ে হ্যাপী ক্লাব এর মাঠে "ফুল হ্যান্ড" ক্রিকেট. এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমাদের ক্রিকেট ছিল দু রকম. ছুড়ে বল করে ছোট করে খেলা হত "শর্ট হ্যান্ড". এখানে ৬ মারলে আউট হতে হত. আর লেদার বা টেনিসের ভারী বলে পরিপূর্ণ ক্রিকেট ছিল "ফুল হ্যান্ড". আরেকটু ছোটবেলায় খেলা হত সলিড রাবারের বলে, যাকে বলা হত "রাবার ডিউস". রাস্তায় খেলার সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল ড্রেনে বল পড়া. সচরাচর ছোট ড্রেন হলে যে কেউ বল তুলে আনত. কিন্তু একটু বড় ড্রেনে বা ঘন ঝোপে বল গেলে তা খুঁজে তুলে আনার দায়িত্ব ছিল ব্যাটস্ম্যান এর, অর্থাত বলটার দুর্দশার যে কারণ, তার. আর বলাই বাহুল্য, রাবারের বলের সাথে ড্রেন এর পাঁক এর অদ্ভুত দুর্গন্ধ মিশে একটা খোলতাই গন্ধ বার হত, পরবর্তীকালে যে গন্ধ সচরাচর পেয়েছি দক্ষিনভারতীয় কুন্দরি দেওয়া রসম খাওয়ার সময় অথবা যে কোনো রোড সাইড অন্ধ্র ভাতের হোটেল এ.সেই কুড়ি বছর আগের কথা, এখন স্মৃতিচারণ করতে গেলে একটু নস্টালজিক লাগে. সে বাড়িতে গরমের দুপুরে বসে বিকেলের কালবৈশাখীর জন্যে অপেক্ষা করাই হোক বা হালখাতায় সোনার দোকানে বাবার সাথে সাইকেল চরে গিয়ে কিছু ভালোমন্দ খাওয়াই হোক. তখন বছরের ছটা ঋতু আলাদা করে বোঝা যেত, আর দেখা যেত কালবৈশাখীর ঝড়. যারা নদীর উপরে কালবৈশাখী দেখেছেন, তারা জানেন যে সেরকম দৃশ্য শুধু বাংলাতেই দেখা যায়. আর হত শিলাবৃষ্টি. অ্যাসবেসটস আর টালির চালে চটর পটর শব্দ, মাঝে মাঝে মনে হত এই বুঝি চাল ভেঙ্গে মাথায় পড়ল. আবার কখনো স্টিলের গামলায় শীল ধরে সেটা রুটি দিয়ে খাওয়া, এখন সে সব ই স্বপ্ন মনে হয়. নস্টালজিক হতে হতে একটা ভিশন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ চলে গেছিল. পইলা বৈশাখ এর সাথে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত. সেটা হলো নতুন জামাকাপড়. আমার নতুন জামাকাপড় তখন সব ই আসত দাদু আর ঠাকুরদার কাছ থেকে. জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে পইলা বৈশাখ এর কথা প্রথম মনে আছে, সেটা ছিল বোধ করি বছর ২৭ আগে. আমার বয়েস তখন ৪. তখন সকলের মুখে শুনে শুনে পয়লা বৈশাখ আমার নিজের মস্তিষ্কে পরিচিত বস্তুসমূহের সাথে সাদৃশ্য খুঁজতে গিয়ে পরিনত হয়েছে কয়লা বৈশাখে. প্রায় আরো দুই বছর আমি পয়লা বৈশাখ কে কয়লা বৈশাখ বলতাম, এবং শেষ বছর শুধু বাড়ির সকলকে নির্মল আনন্দ-প্রদানের জন্য. এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে. তো সেই কয়লা বৈশাখে, ২৭ বছর আগে, আমার দাদু আমাকে দিয়েছিলেন একটা নীল রঙের জামা. সেই জামার কাপড়টা ছিল অত্যন্ত কড়কড়ে আর মোটা. অত গরমে বার দুয়েক পরেই ওই জামার প্রতি আমার ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মেছিল. আমি বলতাম কুটকুটে জামা, আর মা জামাটা বের করলেই ছুটে পালিয়ে যেতাম, যাতে পড়তে না হয়. দাদু বোধ হয় আমার এই বিসদৃশ ব্যবহারে কিছুটা বিব্রত হয়ে কিছুদিন বাদে আমাকে একটা লাল নোটবই, একটা চেল্পার্ক এর নিবপেন আর একটা স্টিলের জগ কিনে দিয়েছিলেন.দাদু চলে গেছেন আজ প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল. চাকরি পাওয়ার পর, বিদেশে যাওয়ার পর, বাংলা ছাড়ার, নিজের বাড়ি ছাড়ার পর অনেক গুলো পয়লা বৈশাখ কেটে গেছে. অনেক সুন্দর, আরামদায়ক জামা ও কিনেছি আর উপহার পেয়েছি. কিন্তু সেই নীল কুটকুটে জামা আমৃত্যু ভোলা সম্ভব নয়. আজ আমার ছেলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে দেখিনি. কারণ জানি, এটা আলাদা সময়, যে দূরত্ত্ব, যে জেনারেশন গ্যাপ তৈরী হয়, সেটাকে জোর করে মুছে ফেলার বা অস্বীকার করার চেষ্টা না করে, সেটাকে প্যরালাল ওয়ার্ল্ড এ রেখে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ, বিচক্ষনতাও বটে.আজ যে ফেসবুক নিয়ে পয়লা বৈশাখে মেতে আছি, আমাদের আগের জেনারেশন বা আমাদের ছোটবেলায় তা কল্পনাতীত ছিল. আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষণে জন্মেছি, যারা দুটো বিশ্বকেই দেখেছে. ডিজিটাল হওয়ার আগের মানবিক সময় আর ডিজিটাল ভার্চুয়াল একটা সময়ের বিশ্ব. কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এর বিচার করার কোনো প্রয়োজন বা সার্থকতা দেখিনা. শুধু মনে মনে আগের সেই সময়গুলো বড় বেশি করে টানে. হয়ত ঠিক সেই কারণেই, যে কারণে শিশুরা মাতৃগর্ভে থাকার সময় বা জন্মানোর পর বিচিত্র মুখভঙ্গি করে হাসে, যাকে বলে দেয়ালা, আগেকার দিনে ঠাকুমা বা দিদিমা রা বলতেন "আগের জন্মের কথা ভেবে হাসছে". আমরা ও ঠিক সেইরকম ফেলে আসা সময়ের কথা ভেবে স্বস্তি পাই, নস্টালজিক হই, হাসি বা ভালোলাগার অনুভূতি নিই. আজ পয়লা বৈশাখের দিনে সেই সময়ে ফিরে যেতে পারলে মনে হয় বেশ ভালো হত. কুড়ি বছর আগের সেই পয়লা বৈশাখ, সেই স্কুল এর মাঠ, সেই চুর্নী নদী, সেই কালো করিবর্গার ঘর, সেই গরমের দুপুরে বেল এর সরবত, সেই চৈত্রের সেল, সেই সব মানুষগুলো, যাদের বেশিরভাগ ই হারিয়ে গেছেন.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ এপ্রিল ২০১৪ | ১৬৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | 132.177.232.238 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৪২72660
  • বাহ।
  • শ্রী সদা | 127.194.198.81 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৫72661
  • "আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন একটা সন্ধিক্ষণে জন্মেছি, যারা দুটো বিশ্বকেই দেখেছে। ডিজিটাল হওয়ার আগের মানবিক সময় আর ডিজিটাল ভার্চুয়াল একটা সময়ের বিশ্ব" - একেবারে মনের কথাটা বলে দিয়েছেন।
  • sosen | 125.242.166.180 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩২72662
  • সদাকে ক। ভালো লাগলো
  • Mridha | 226.239.45.80 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৪ ১২:৪৬72659
  • দারুন, একটা ঝড় বয়ে গেলো মনে।
  • ঐশিক | 133.252.160.213 (*) | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৭72664
  • বেশ ভালো লাগলো
  • Tim | 188.91.253.21 (*) | ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:৩৪72663
  • খুব ভালো লাগলো।
  • Biplob Rahman | 212.164.212.61 (*) | ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ১০:২৬72665
  • সেদিন রাতে ঝড় উঠেছিলো এই প্রেতপুরীতে। আমি বারান্দায় বসে বজ্রবৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। অনিবার্যভাবে হলো বিদ্যুত বিভ্রাট। হঠাৎ কোথা থেকে যেনো উড়ে এলো এক শুকনো বটপাতা। ...আমার অবসরপ্রাপ্ত কেরানী কাম আপার ক্লার্ক মা ভয় পেয়ে বলেন, কোথায় যেনো পাহাড়ে ভাঙছে, শুনতে পাস?...আমি ঝড়া পাতাটিকে মাথায় গুঁজে রাখি, যেনো পাখির পালক।...আমার মা অন্ধকারে খুব ভয় পান। চিৎকার করে আমায় বলেন, একটা মোম জ্বেলে দিতে।...আমি মরা পাতাটিকে এবার মুঠোবন্দী করি। যেনো মুঠোবন্দী করে ফেলেছি, আমার প্রেম!...

    #

    নোটটি খুব ভালো। দ্বিতীয় পর্বটিতে ছোট ছোট প্যারা থাকলে চোখের আরাম হতো। সদাকে ক। চলুক...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন