এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • শো কজের চিঠি

    Arkady Gaider লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ জুলাই ২০১৮ | ১৭১১ বার পঠিত
  • প্রিয় কমরেড,

    যদিও তুমি আমার একদা অভিভাবক ছিলে, তবুও তোমায় কমরেড সম্মোধন করেই এই চিঠি লিখছি, কারন এটা সম্পূর্নভাবে রাজনৈতিক চিঠি।

    এই চিঠির মারফত আমি তোমায় শো কজ জানাচ্ছি। তুমি যে রাজনীতির কথা বলে এসেছো, যে রাজনীতি নিয়ে বেচেছো, যে রাজনীতির স্বার্থে নিজের জীবনের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করেছো, আজকে সেই রাজনীতির চাহিদা পূরন করতে তুমি ব্যর্থ হয়েছো। তবে এখন যদি ভাবতে বসি, তাহলে হয়তো তোমার ব্যর্থ হওয়ার কারন খুজতে গেলে অনেক পিছিয়ে যেতে হবে। যেদিন তুমি আমায় বলেছিলে - 'সোভিয়েত আমাদের জন্যে একটা বাস্তব ছিলো, যাকে সামনে লক্ষ্য হিসেবে রেখে লড়া যেতো। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর আসলে সবাই মনে মনে হেরে গেছে।' বলেছিলে - 'একবিংশ শতাব্দীতে লড়বে কারা? পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, ভোগের দর্শন তো জিতে গেছে সবার মাথায়।' তখনও বুঝিনি, বা বিশ্বাস করিনি, যে তোমার মিটিং, মিছিল, স্লোগান, সেমিনার আসলে হয়তো খালি নিয়মানুবর্তিতা ছিল।

    জানো, কলেজে কলেজে যখন ওরা তোলা তুলছিলো, এডমিশন করাচ্ছিলো পয়সা নিয়ে, কৃতি ছাত্রদের ভর্তি হতে দিচ্ছিলো না, আশা করেছিলাম এবার তোমার - না শুধু তোমার না, তোমাদের, মানে যে প্রজন্মের উত্তরাধিকারের ভার আমরা বইছি, তাদের - অস্থির হওয়ার সময় এসেছে। এতো শুধু ঘুষ নেওয়া না, শুধু দুর্নীতি না। গোটা শিক্ষাব্যাবস্থা, আমাদের আগামী প্রজন্ম, আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে চোখের সামনে। একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। ভেবেছিলাম কলেজের গেটগুলোর সামনে অভিভাবকরা ব্যারিকেড গড়বে, তোমরাও থাকবে তাদের মধ্যে, যেমন জলের মধ্যে মাছ থাকে, প্রজন্মের হিসেব বুঝে নেবে তোমরা, বুক পেতে আগামীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করবে।

    কিন্তু না। তোমরা হেরে গেছো। আজকে না। ভোটে হারবার সময়েও না। তার অনেকদিন আগে হেরে গেছো। মনে মনে হেরে গেছো।

    জানো, কারা হারেনি? যাদবপুরের কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ওরা না খেয়ে, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, ভুখা পেটের ব্যারিকেড গড়ে ওদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করেছে। দেখো, প্রেসিডেন্সির বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও শিরদাঁড়া সোজা রেখে লড়ছে। এক পা এক পা করে জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। দেখতে থাকো, মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১০০ ঘন্টা অনশন চালাচ্ছে। ওরাও হারবেনা। কেন জানো? কারন ওরা মনে মনে জিতে গেছে। ভালো করে দেখো, তোমাদের নৈরাশ্য, তোমাদের হতাশা, তোমাদের জড়তা, তোমাদের এই যে বীভৎস কুঁকড়ে যাওয়া, কোনটাই ওদের মধ্যে সংক্রামিত হয়নি। ওদের মতন লড়ছে মালদহ, মেদিনীপুর, হুগলী, কুচবিহারের ছাত্ররা। ওরাও হারবে না।

    মনে আছে, একদিন তোমায় বলেছিলাম - 'বন্ধু আর শত্রু, দুপক্ষই মজা করে যাদবপুরকে স্তালিনগ্রাদ বলে।' তুমি হেসে বলেছিল, 'তাতে তো তোর প্রজন্মের খুশি হওয়ার কথা না খুব একটা। তোরা তো স্তালিনকে পছন্দ করিস না।'
    আমিও হেসেছিলাম। আজকে একটা গল্প বলি শোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প। তবে গল্পের শুরু আরও আগে। জার্মান কমিউনিষ্টরা হিটলারের হাত থেকে পালিয়ে এসে মস্কোতে আশ্রয় নিয়েছে। তারপরেই সেই সোভিয়েত-জার্মান চুক্তি। চুক্তির শর্ত মেনে বেছে বেছে জার্মান কমিউনিষ্টদেরকে তুলে দেওয়া হলো হিটলারের হাতে। অধিকাংশকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। কমিউনিষ্ট পার্টির একজন মহিলা নেত্রীকে জার্মান ডাক্তাররা মেরে ফেললো নানারকম মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে। তার ছেলে, হান্স, আশ্রয় পেলো অনাথাশ্রমে। সেখান থেকে বাধ্যতামূলকভাবে হিটলার ইয়ুথের সদস্য হলো। লুফতওয়াফে যোগ দিলো। সামরিক বিমানের পাইলট হলো। তারপর এলো স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। পেটভর্তি বোমা নিয়ে হান্সের বিমানকে পাঠানো হলো স্তালিনগ্রাদে হামলা করতে। কিন্তু হান্সের বিমান থেকে একটাও বোমা পড়লো না। হান্স কি করে বোমা ফেলবে? এ তো স্তালিনগ্রাদ। সমাজতন্ত্রের শেষ দূর্গ। স্তালিনগ্রাদে বোমা ফেলা যেন তার কাছে নিজের হাতে নিজের মা কে খুন করবার সমান মনে হলো। শহরের বাইরে খোলা মাঠে বিমান ফাকা করে সে ফিরে গেলো। কারন, ওটা স্তালিনগ্রাদ।

    তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমাদের সামনে কোনদিন সোভিয়েত ছিলো না। তাই তোমাদের মত সোভিয়েতের স্বপ্নও ছিলো না। তোমাদের সোভিয়েতের জন্যে আমরা লড়িনি কোনদিন। কিন্তু আমাদের নিজেদের সোভিয়েত আছে। একদম নিজস্ব। আমাদের স্তালিনগ্রাদ আছে। একদম আপন। আমাদের মাথায়, আমাদের গোটা শরীরে, প্রতিটা রোমকূপ জুড়ে আছে। সেই সোভিয়েত এখনো রুপ পায়েনি, তার নির্মাণ চলছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাদের সোভিয়েতের থেকে তা অনেক অনেক ভালো। তোমাদের যাবতীয় ব্যার্থতা, তোমাদের হার মানা, তাকে ছুতে পারবে না। আমরা এই শতাব্দীর সন্তান। আমরা হারবো না। ১০০ ঘন্টা ভুখা পেটে থেকে আমরা প্রত্যেকটা ভুখা পেটের হিসেব চাইবো কলার ধরে। তোমরা যদি সত্যি হেরে গিয়ে থাকো, তাহলে রাস্তা ছাড়ো। আর যদি আরেকবার বাঁচতে চাও, তাহলে চোয়াল শক্ত করে কাধ মেলাও। আমরা তোমাদের হারতে দেবো না। কারন আমরা হারবো না। আমাদের সোভিয়েত হারবে না।

    কি বললে? রাজনৈতিক চিঠি ব্যাক্তিগত হয়ে গেলো কেন? বোধহয় তোমার শিক্ষা থেকেই - যা ব্যাক্তিগত, তাই রাজনৈতিক। এই শিক্ষাও তোমার দেওয়া উত্তরাধিকার ধরে নাও।

    ইতি,
    তোমার কমরেড।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ জুলাই ২০১৮ | ১৭১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Abhijit Majumder | 340112.21.782312.60 (*) | ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৬:২৩64970
  • সিকি | 781212.96.562323.161 (*) | ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৬:৫০64971
  • বিপ্লব রহমান | 340112.231.126712.74 (*) | ১৯ জুলাই ২০১৮ ০৭:১১64972
  • "কোন কোন প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়। যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান, তাই হয়ে যান, উত্‍কৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়। . . . "
  • dc | 127812.49.896712.232 (*) | ১৯ জুলাই ২০১৮ ০৯:১২64973
  • যাকলা! আমি ভাবলাম পেজের নীচে যে নীল চিঠিটা দেখাচ্ছে এই টইটাতে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কাকে কাকে শো কজ করা হয়েছে ইত্যাদি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন