এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • এখন সন্ধ্যা নামছে

    bilkis mousumi লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ এপ্রিল ২০১৮ | ১৯৭১ বার পঠিত
  • মৌসুমী বিলকিস

    মেয়েরা হাসছে। মেয়েরা কলকল করে কথা বলছে। মেয়েরা গায়ে গা ঘেঁষটে বসে আছে। তাদের গায়ে লেপ্টে আছে নিজস্ব শিশুরা, মেয়ে ও ছেলে শিশুরা। ওরা সবার কথা গিলছে, বুঝে বা না বুঝে। অপেক্ষাকৃত বড় শিশুরা কথা বলছে মাঝে মাঝে। ওদের এখন কাজ শেষ। ওদের এখন আড্ডা দেওয়ার সময়। সূর্য এখন ডুবু ডুবু। কয়েকজন মেয়ে আদিগন্ত মাঠের দিকেও তাকিয়েছে। আখার মধ্যে কাঠের আগুন ফিকে হয়ে যায় যেমন, আকাশটাকে তেমনই মনে হয়েছে কারো কারো। আ! কেমন জ্বলছে কিন্তু তাপ উত্তাপ নেই। মেয়েরাও কেমন আগুন পেতেছে। এক চিলতে মাটির বারান্দায় জটলা পাকিয়ে ফুটছে কেউ কেউ। অথচ অসম্ভব ভালো লাগার সে উত্তাপ। নিজেদের মতন করে হাসা, নিজেদের মতন করে মন অনাবৃত করা। হাসির চোটে এই শীতেও কারো কারো কাপড় এলোমেলো। ঘোমটা খুলে যাচ্ছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। এ তো পাড়ার ভিতর আসুরা বুবুর দোকানের বারান্দা। কুন মিন্‌সেই বা দেখতে আসছে? যে যত পারো হাসো। কে কেমন করে লেংচে হেঁটেছিল, কোন মিন্‌সের পাজামার দড়ি খুলে পায়ের পাতার ওপর পুরো পাজামাটা লুটিয়ে পড়েছিল, কে হাটে গিয়ে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে গিয়ে ‘এক সের পেঁপে দেন’ বলতে গিয়ে ‘এক সের পেদে দেন’ বলেছিল সব্জিওয়ালাকে, কোন জামাই অন্ধকারে বউ ভেবে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরেছিল- সে সব ঘটনা টিকাসহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্তব্য প্রতি মন্তব্যে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। অপেক্ষাকৃত পুচকে শিশুরা হাসির কারণ পুরোপুরি ধরতে না পেরে একবার বক্তা, একবার অন্য মহিলা ও শেষে নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই হাসছে দেখে নিজেও বেশ জোরে হেসে উঠে হাসির সম্মিলিত মাত্রা আরো একদাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে কারো কারো কোলের শিশু কেঁদে দিচ্ছে ভ্যাঁ। ওমনি পিঠে থাবড়া দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে মা। না থামলে চূড়ান্ত ওষুধ মুখে স্তনের বোঁটা গুঁজে দেওয়া। শিশুর মুখ তখন বন্ধ। এর পরেও কান্না না থামলে বয়স্কাদের বকা ঝকাতে শিশু নিয়ে আসর পরিত্যাগ করতেই হবে। মা তখন রেগে দু ঘা দেবে শিশুটির পিঠে। শিশু আরো চ্যাঁচাবে এবং সেই ধ্বনি আসর থেকে ক্রমশ দূরবর্তী হতে থাকবে। মা কিন্তু গজগজ করবে। সন্তান সন্ততির জন্য কোথাও বসে শান্তি নেই বলে আক্ষেপ করবে। শিশুর দাদির কোলে ফেলে দিয়ে যে আসরে আবার যোগ দেবে সে উপায়ও থাকবে না। কারণ শিশুর দাদি স্বয়ং তখন আসরে গলা ফাটাচ্ছেন। তাঁর কোন বুবুর কোন নানি শাশুড়ির কটা মরদ ছিল এবং তিনি যে তাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতেন সে সব বৃত্তান্ত বলতে বলতে পুলকিত হয়ে উঠবেন। কোনো কোনো মেয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাসও ফেলবে। আহা! যদি একজনও পরপুরুষ থাকতো তবে অন্তত কিছু না হোক একটা সোনার মটর ডাল নাকছাবি গোপনে বাক্সে তোলা থাকতো। নিজের মিনসে তো কাচের চুড়িও কিনে দেয় না। শখের কথা তো দূরে থাক, দরকারি তেল নুন আলু পেঁয়াজের কথা বললেই মাঝে মাঝে খেপে ওঠে। যেন বউ একাই খেয়ে নিয়েছে সব। গায়ের কাপড় ন্যাতা হয়ে গেলেও নতুন কাপড় জোটে না। নিজে ফান্টুস মেরে যখন বের হয় কত মেয়ের দিল জ্বালিয়ে দেয় সেকি আর বোঝা যায় না? কেউ কিছু না বললেও ঠিকই বোঝা যায়। আসরে হঠাৎ ফিসফিস করে ওঠে কেউ। বে পাড়ার এক বউ এর কথা ওঠে। সে নাকি ভাসুরের সামনেও মাথায় ঘোমটা না দিয়ে কত কথা বলে। ভাসুর-বউ আপত্তি করলেও নাকি শোনে না। কী দেমাক! ভাসুরও প্রশ্রয় দেয়। ওই পাড়ার বদি কাহারের মেয়েটা না খেতে পেয়ে মরলো। আহা! কী ঢল ঢল মুখটা ছিল। মেয়ে বলে কি আমরা ভাগাড়ে ফেলে এসেছি? খেতে দিই নি? মেয়েটা নাকি না খেতে পেয়ে পেয়ে বিছানা নিয়েছিল। ঘরের মাটির মেঝের সাথে মিশে গিয়েছিল একেবারে। শেষে বিপদ বুঝে প্রতিবেশীরা ভাত দিয়ে গেলেও এক ফোঁটা গলা দিয়ে নামতো না মোটেও। কী কষ্ট! চোখে দেখা যায় না। আরেকজন বললো,

    : অর মা বাপই তো খ্যাতে পাতক না। অকে কী দিবে?

    আরেকজন,
    : খাওয়ার কষ্ট আমাধেরও আছে। তাও আমরা যা দুট্যে পান্তাভাত পারি মেয়েকে ভাগ করে দিই।

    বয়স্কা আর একজন,
    : কত লোকেই তো না খ্যাতে পায়ে মরে। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে আসছি। আসল কথা হল আমাধের জান দঢ়্‌হ বুলে এখুনো ব্যাঁচে আছি।

    দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে আসুরা বিবির দোকানের দাওয়া। এমনকি ছোট্ট শিশুরাও টু শব্দটি করে না।

    মেয়েটি পরেছে জিনস। মেয়েটির পায়ে স্নিকারস। হাফ স্লিভ শার্ট গায়ে। দুটো বোতাম খোলা। উঁকি দিচ্ছে জাপানি অক্ষরের আদল, সিলভার মেটালের লকেট। খাকি রঙের ব্যাক প্যাকে কয়েকটা বই, খাতা, পেন, ছোট টেপ রেকর্ডার, এস এল আর ক্যামেরা, ফিল্ম রোল, ক্রিম, গামছা, লিকুইড সোপের বোতল, দেশলাই ও একগুচ্ছ সিগারেটের প্যাকেট। ছোট করে ছাঁটা চুল। তার দৃপ্ত পায়ের ভঙ্গিতে পাড়াগাঁয়ের মাটি সন্ত্রস্ত, এবং কখনো কখনো বিরূপও হয়ে ওঠে। কাঠ পুঁথি দিয়ে গেঁথে গেঁথে চওড়া হ্যাণ্ডব্যাণ্ড শোভিত হাতে ফিতে ধরে ব্যাগটিকে এক কাঁধে নিয়ে নেয় সে। হাঁটা ছাড়া গতি নেই। দু পাশে ধীরে ধীরে সরে সরে যায় গাছপালা, ঘরবাড়ি, ল্যাংটো ছেলেমেয়ে, ঘোমটা বউ, একজোড়া গরুর পিছনে লাঙল কাঁধে লোকজন। নাজনিন নামটিতে কীসব মধুর গ্রাম্যতা মিশে থাকে। সেই টানে মাঝে মাঝে এখানে ওখানে। মাঝে মাঝে শিকড়ের সন্ধানে বের হওয়া। কতজন আপ্যায়ন করে। জুটে যায় ঘর বা খড়ের ছাউনি বারান্দায় এক চিলতে জায়গা, ডালের মধ্যে নালিতা শাকের ঝোল, শুকনো আমের চাটনি। আ! জিভে পানি চলে আসে। কখনো বা, ‘আপনার কী কাম ইখানে? চলে যান।’ ‘কী করবেন ইসব? আপনার কী কাজে লাগবে? টাকাপয়সা না পালে দ্যাশে দ্যাশে ঘুরে অই করে কেহু?’ প্রশ্ন, সন্দেহ, সংশয়, বিস্ময়, কটাক্ষ, ফ্যাল ফ্যাল চাহনি পিছু ছাড়ে না কোথাও। অন্দরে গ্রাম আর বাইরে শহর। গ্রামের লোকেরা দেখলেই বোঝে নিজেদের লোক নয়, শাড়ি অথবা সালোয়ারেও নয়। শহরের লোকেরা নাকি দেখলেই বোঝে গ্রাম থেকে আসা। সে ভালো কথা। শেকড়ের ছাপ থাকা ভালো। এভাবে না শহর না গ্রাম এক সত্তা, নাকি দুই, নাজনিনের ভেতরে বাসা বাঁধে। অথচ সে যে গ্রামেই থেকে যাবে, সেখানে নিজেকে গড়ে তোলার কিছু তো নেই। না আছে কলেজ, না আছে বিশ্ববিদ্যালয়, না আছে একটা ভালো লাইব্রেরি, না আছে সিনেমা বা নাটক দেখার যথাযথ ব্যবস্থা, না আছে সাজিয়ে গুছিয়ে বই প্রকাশের কোনো সংস্থা, না আছে স্টিল ফটো ডেভেলপের ল্যাব। স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বাদই দেওয়া গেল, কারণ তা উল্লেখ না করাই ভালো। অবশ্য শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবা মানে ডাক্তারি ও ডাকাতির মেলবন্ধন। আসলে ডাক্তারি পরিষেবার একটা বড় ভাগ দেখনদারিতে বা প্রতারণায় গিয়ে ঠেকেছে। শহরে সুবিধের ভাগটাই বেশি কিন্তু সমস্যাও কম নেই। অন্যদিকে কোনো একটি বিষয় নিয়ে কাজ করলেই হয় না। সেইসব বিষয়ের রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয়। তাঁদের তো নিরানব্বই জনই থাকেন শহরে। আবার দুই লবির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছো তো তুমি মরেছো। দুজনের সামনে দুজনের নাম মুখ ফসকে বলে ফেলেছো তো রক্ষা নেই। মাঝখানে পড়ে তোমাকে যাকে বলে কচু কাটা হতে হবে। ডিগ্রি নিতে চায়লে আরো সাংঘাতিক ব্যাপার। তুমি ভাবলে পি এইচ ডি-র জন্য একটা বিষয় তুমি খুঁজে পেয়েছো। সে নিয়ে আলোচনা করতে দৌড়লে কোনো একজন গাইডের খোঁজে। একজনকে পেয়েও গেলে। দু রকম হতে পারে। এক, তোমাকে গাইড করার পক্ষে তিনি যে একেবারে আদর্শ এবং শ্রেষ্ঠ গাইডের কাছে তুমি এসে পড়েছো তার জন্য তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ইত্যাদি ভালো করে বুঝিয়ে দিতে তিনি কসুর করবেন না। গবেষণা করার যোগ্যতা যে তোমার নেই এবং তা দ্রুত অর্জন করে নিতে হবে তোমাকে ইত্যাদি বুঝে নিতে নিতে একগাদা বইপত্রের নামও তুমি পেয়ে যাবে। দ্বিতীয় অবস্থানের গাইড উপরোক্ত সবই মৃদু করে বুঝিয়ে দেবেন কিন্তু একটি রেফারেন্স বইয়ের নামও দেবেন না। তোমার বিষয়ের বইগুলি তোমাকেই খুঁজে নিতে বলবেন আর সে তালিকা তৈরি করাই তোমার ক্রেডিট বলে মনে করবেন। তালিকাটি পেশ করলে তিনি এমন ভাব দেখাবেন যেন তিনি সব বইগুলির নামই জানতেন এবং সে বিষয়ে নিজের ক্রেডিট প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র ভুল করবেন না। উপরন্তু গবেষণার খরচের একটি লম্বা তালিকা দেবেন যা দেখে তোমার মনে হবে বাবা মার বসতবাড়ি ঘটিবাটি সব বিক্রি করতে হবে। গাইড নিজের গবেষক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটা দল বানাবেন। দল নিয়ে আজ হায়াত, কাল নলবন, পরশু স্বভুমি, তরশু গ্র্যাণ্ড হোটেলে আলোচনা চক্র ও সাংস্কৃতিক আসর, কারো সম্পূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশ। মানে ওই আর কী, তোমার কাছে এসব পাঁচতারা হোটেলে যাওয়ার মতোই ব্যাপার কারণ তোমার বাবা হয়তো সামান্য চাষি বা দিনমজুর আর প্রতি আউটিং, অনুষ্ঠান পিছু পাঁচশ থেকে হাজার টাকা মাথাপিছু। আর তুমি যদি মালদা জেলার হও এক ও দুই গাইড মালদা জেলার আমের এত প্রশংসা করবেন যে গরমের ছুটির পর বাড়ি থেকে আসার সময় সাঙ্ঘাতিক ভিড় ট্রেনের মধ্যে একঝুড়ি আম আনতে তুমি বাধ্য। আর ‘তোমার মায়ের হাতের বড়ি একদিন খাওয়াও তো দেখি। শহরে আটার বড়ি বড় বিস্বাদ’। কত বড় শিক্ষিত লোক তোমার মায়ের হাতের বড়ি চেয়েছেন জেনে তোমার মা আহ্লাদে আটখানা হয়ে এক পোঁটলা বড়ি তোমার ব্যাগের মধ্যে গুঁজে দেবেন। তারপর পলিটিক্স। তোমাকে পছন্দ হল তো তুমি অঘা বা মঘা যেই হও কবে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জি এস হয়ে এখনকার গাইডকে প্রবল গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে সাহায্য করেছিলে বলে তোমার পি এইচ ডি পেপারটা তিনি নিজে হাতে লিখে দেবেন এবং যে কোনো সুবিধাজনক কলেজে পড়াতে ঢুকতেও তোমাকে যার পর নাই সাহায্য করবেন। আবার কোনো গাইড অতি পরিশ্রমে সংগ্রহ করা তোমার ডেটা বা লোকগান, ছড়া ব্যবহার করে নিজেই প্রবন্ধ লিখে প্রকাশ করবেন যার মধ্যে তোমার কোনো অবদান স্বীকার করবেন না। তোমার নিজস্ব জিনিসগুলো কখনো ফেরতও দেবেন না। এইসব নানান মূর্তিমানদের দেখা পাবে তুমি যারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এক একটি স্তম্ভ হিসেবে এক একটি মহান দায়িত্ব পালন করছেন। এঁদের সবাইকে ছাপিয়ে আছেন কিছু প্রকৃত শিক্ষক, আসল গাইড। তুমি এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে গেলেও তিনি কুন্ঠা বোধ করবেন। উপরন্তু বাড়িতে গেলে এক প্লেট মিষ্টি, এক কাপ কফি বা চা নিজে সামনে বসে থেকে খাওয়াবেন। কী কী বই পড়তে হবে সব বলে দেবেন, নিজের কাছে থাকলে দিয়েও দেবেন তোমাকে। গবেষণার পুরো ক্রেডিট তোমাকে দেবেন তিনি। কিন্তু এঁদের সংখ্যা এত কম খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। নাজনিন শেষোক্ত গাইডদের একজনকে খুঁজে পেয়েছে বলে কাকে ধন্যবাদ দেবে বুঝে উঠতে পারে না।

    : কুন্ঠে যাবা গো?

    প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফেরে নাজনিনের। মাথায় আলতো ঘোমটা টানা মহিলার প্রশ্নে সে থমকে দাঁড়ায়। হাসি হাসি মুখ করে বলে,

    : আপনাদের কাছেই এসেছি।

    মহিলা তাকে আহ্বান করে,

    : তো আসো আমাধের বাড়ির দিকে।

    সে রাস্তা থেকে নেমে মহিলার পিছন পিছন খড়ের ছাউনি মাটির বাড়ির পাটকাঠি ঘেরা উঠোনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সুন্দর নিকানো উঠোন। মাটির উনুন একপাশে। উঁচু মাটির দাওয়ায় শীতল পাটি পেতে নাজনিনকে বসতে দেন মহিলা।

    : একটু পানি দেবে বুবু? খাবো।

    মহিলা মাটির কুঁজো থেকে কাচের গ্লাসে পানি ঢালেন। সাদা ফুলকাটা চিনা মাটির প্লেটে এক টুকরো খেজুরের পাটালি। নাজনিন পাটালি খেতে থাকে। মহিলা রান্নাঘরে ঢোকেন। উঠোনের মধ্যে একটি মোরগ একটি মুরগির পিছু পিছু ধাওয়া করে। বাকি মুরগিরা একটু তফাতে কিছু খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। ওপাশের আতা গাছের কাণ্ডে বাঁধা কালো ছাগলের সামনে বাঁশের টুকরিতে সবুজ কাটা ঘাস। খাচ্ছে সে। মুখ তুলে একবার নাজনিনকে দেখে নেয়। মোরগটি কঁ কঁ শব্দ তুলে মুরগিটির ঘাড়ের পালকের কাছে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মুরগিটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। মোরগটি তার পিঠের ওপর উঠে তাকে দু পা দিয়ে জাপছে ধরে। সামান্য সময় পিছনের দিকটা বাঁকিয়ে মুরগির পিছনে লেপ্টে দেয়। আবার নেমে আসে। মুরগিটি তখন কয়েক পা এগিয়ে যায়। আবার স্থির হয়ে দাঁড়ায়। মোরগটি আবার একইভাবে তার পিঠে উঠে পড়ে। নাজনিন পানিটা শেষ করে।

    : বুবু, তোমার কয় ছেলেমেয়ে?

    : দুই মেয়ের বিহে দিয়েছি উ পাড়ায়। এক ছেলের বিহে দিয়েছি। এই তো এই পাড়াতেই বোর বাপের বাড়ি। সকালে বাপের বাড়ি গেলছে, বিকেলে চলে আসবে। বোর দু খান ছেলেমেয়ে। অর সঙ্গেই গেলছে। আমার ছেলে মাঠে কাজ করতে গেলছে। ছেলের বাপও গেলছে লাঙল লিয়ে। সর্ষে বুনেছে ভুঁয়ে, সর্ষে তুলে গম বুনবে। বাপ ব্যাটার খাটনিতে সংসার চলছে। আমার আরো দুখান বাচ্চা হয়েছিলো। জন্মের পরপরই মরে গেলছে।

    মহিলার মুখে সামান্য বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।

    : পরপর দুট্যা বাচ্চা, ব্যাটা। প্রথম জনও গেল, দ্বিতীয় জনও বাঁচল না।

    : তোমার বয়স কত ছিল তখন?

    : ওই তেরো কী চৌদ্দ হবে প্রথম বাচ্চার সময়।

    নাজনিন প্রসঙ্গ পাল্টায়,

    : তোমার নাম কি গো?

    : লিজের নাম তো ভুলেই গেলছি। লোকে তো কামলার মা বুলে ডাকে। তুমি কতদিন পরে নাম শুধালে বুলে মুনে পড়লো। আমেজান বিবি। স্বামী মরে গেলে ব্যাওয়া হয়ে যাবো।

    : তুমি গান জান?

    : আমি আবার কী গান জানবো! দেখ ধিনি মেয়ের কথা! আমার ছেলে আর লাতি লাতনি গুলান রেডিওতে গান শুনে। উরা এক আধডা গান বুলতে পারে। ছিনেমার গান জানে অরা।

    : না না, সিনেমার গান নয়। তুমি বাচ্চা আদর করতে করতে গান কর না? আবার ওই যে বিয়ের গীত হয় না? ওইসব তুমি জান?

    একগাল হাসে আমেজান বিবি।

    : দেখ ধিনি! আমি ওই কী জানি? আমাধের পাড়ার মেয়ে বো গ্যালান ওই গান জানতোক্‌ তো। আমিও ছোটবেলায় কত গান করেছি। এখুন শরীলে গীদ্‌ হয়, মুনে কী আর আসে? কাজকাম সারে সন্ধ্যে বেলায় তুমাকে লিয়ে যাবো। আসুরা বুবুর দুকানে পাড়ার মেয়ে গ্যালান আসবে।

    নাজনিন একটু আশার আলো দেখে। কিছু গান অন্তত পাওয়া যেতে পারে। কী যেন দোনামোনা করে আমেজান বিবি। তারপর যেন কত অপরাধ করতে যাচ্ছে সেভাবে বলে,

    : দুট্যা কড়কড়ে ভাত খাবা?

    নাজনিন বুঝতে পারে তার দ্বিধার কারণ। সে ভেবেছে যদি প্রত্যাখ্যান করে নাজনিন। যদি নাজনিন চাষাভুষো নিরক্ষর লোকের বাড়ি ভেবে নাক সিঁটকায়। কড়কড়ে ভাত, জল না দেওয়া বাসি ভাত। শীতকালে জলে ভিজিয়ে না রাখলেও পরের দিনও দিব্যি সুন্দর থাকে। সজনে শাক ভাজা আর বাড়িতে তৈরি মাসকলায়ের বড়ি ও আলুর ঝোল দিয়ে নাজনিন তৃপ্তি করে খায়। এতক্ষণে বুঝতে পারে তার বেশ খিদে পেয়েছিলো।

    সন্ধ্যে। আসুরা বিবির দোকানের দাওয়া। মরদরা সব কাজ থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে পাশের গঞ্জ এলাকার চায়ের দোকানগুলোতে আড্ডা দিতে, কেউ ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে, কেউ কারো কাছে টাকা পাবে তাই তাগাদার নাম করে বেরিয়েছে। সাড়ে সাতটা আটটার মধ্যে, কেউ কেউ আরো পরে বাড়ি ফিরতে শুরু করবে। ছেলে ও স্বামীদের ভাত খাওয়াতে হবে বলে একে একে মেয়েরা উঠতে শুরু করবে। ফাঁকা হতে হতে একেবারে নির্জন হয়ে উঠবে বারান্দা। আসুরা বিবি আরো কিছুক্ষণ দোকান খোলা রাখবে। ঘরে ঘরে পুরুষরা ফিরছে, যদি কিছু দরকার হয়। খুব জোর আধ ঘন্টা। তারপর দোকান বন্ধ করে নিজের ঘরের পুরুষদের খেতে দিতে হবে, নিজেকেও খেতে হবে। দোকানের লাভ ক্ষতি হিসেব করতে করতে ঘুমিয়েও পড়তে হবে। আপাতত তার দোকানের বারান্দা সরগরম। পুরুষদের অনুপস্থিতিতে এবং কাজকর্ম নেই-এর এই সময়টুকু মন্থন করে অমৃত শুষে নিতে হবে। তাতে যা বিষ ওঠে উঠুক। একে একে আসছে মেয়েরা, খালি হাত ও কোলে কাঁখে বাচ্চা নিয়েও। ধীরে ধীরে জমে উঠছে আসর। আসুরা বিবির দোকানে টিমটিম করে জ্বলছে কেরোসিনের আলো। যে বউটির গত বছর চুল উঠে গিয়েছিল টায়ফয়েডে ভুগে ভুগে, এখন ছোট ছোট চুল গজিয়েছে তার। চুল সামলে নিতে নিতে সে সবে শুরু করেছিল আমেজান বিবি কিভাবে নেচে নেচে ঢেকিতে পাড় দেয় তার রসিকতার গল্প এবং অভিনয় করে দেখাবে বলে উঠে দাঁড়িয়ে একবার পা-ও সঞ্চালন করেছিল। হাসাহাসিও শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বার পা ফেলতে না ফেলতেই আমেজান বিবি স্বয়ং একটি টর্চ হাতে, যেটি নাজনিনেরই, নিয়ে আসরে আসছে দেখা গেল। সঙ্গে নাজনিন। আর মজা করা হল না মেয়েটির। এক পা শূন্যে থাকলো কয়েক সেকেণ্ড, তারপর ধপ করে বসে পড়লো সে। মেয়েরা আগেই খবর পেয়েছিলো পাড়ায় নতুন একজন মেয়ে এসেছে এবং তাকে নিয়ে একচোট আলোচনা সমালোচনাও আসরের প্রথম দিকে করে ফেলেছে কেউ কেউ এবং তাদের কারো বাড়িতে না এসে আমেজান বিবির বাড়িতে কেন মেয়েটি এসেছে তা নিয়ে আগ্রহী ও ঈর্ষান্বিতও হয়েছে। নেহাতই বাড়ির কাজ ছিল বলে মেয়েটিকে দেখতে ভিড় জমাতে পারেনি দুপুরবেলা। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু বাচ্চা উঁকি মেরে বা পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত লাজুক বা অত্যন্ত সাহসী ভঙ্গিতে নাজনিনকে বিকেলের আলোয় দেখে গেছে। তার মধ্যে দু একজন পাড়ার বউও ছিলো। নাজনিন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চায়লেও তা বেশিদূর গড়ায়নি। কাজ আছে বলে বা নেহাত লজ্জা পেয়ে কেটে পড়েছে তারা। তারাই আসরে নাজনিনের খবর পেশ করে। এখন এক দঙ্গল ছায়া যেন নিঃশব্দে দলা পাকিয়ে আছে। আসুরা বিবির দোকানের ভেতরে একটি মাত্র টিমটিমে কেরোসিন ল্যাম্পের আলো বারান্দায় এসে ভালো করে পড়ছে না। উপরন্তু আসুরা বিবির দোকান উঁচুতে এবং সবাই নাজনিনের দিকে তাকিয়ে আছে বলে মেয়েগুলির প্রেক্ষাপট হলদে আলোয় ভরে আছে। নাজনিনের মুখে খুব হালকা আলোর শিখার প্রতিচ্ছায়া কেঁপে কেঁপে পড়ছে, আমেজানের মুখেও। সবাই ছায়ার অবয়ব হয়ে আছে। খুব কাছেই ঝিঁঝি পোকারা উঁচু, নীচু, মধ্যম, নিম্ন মধ্যম, উচ্চ মধ্যম সুরে একটানা ডাকছে। ওদের এখন অর্কেস্ট্রা পার্টি। অন্য কোনো শব্দ নেই। বাচ্চারাও একেবারে চুপ। স্তব্ধতা ভাঙলো নাজনিন,

    : তোমরা ভালো আছো তো?

    সবাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। যার সম্পর্কে এতক্ষণ আলোচনা চলছিলো সে নিজেই তাদের সামনে হাজির বলেই হয়তো একটা অপরাধ বোধ থেকে চুপ করে গেছে সবাই।

    : আমার নাম কী বল তো?

    নিজেই উত্তর দিল,

    : নাজনিন।

    সবাই চুপ। এ ওর মুখে, সে তার মুখের দিকে দেখতে লাগলো। শেষে বৃদ্ধা জমেলা বেওয়া কথা বললেন,

    : বস গো মেয়ে। কথা হোক দুট্যা।

    নাজনিন আসরের মাঝখানে গিয়ে বসলো। আমেজানও মাটির মেঝেতে বসার জায়গা করে নিল।

    : তোমাদের নাম কী গো? আমার নাম তো বললাম।
    সবাই নিজের নিজের নাম মনে করতে লাগলো। কেবল জমেলা বেওয়া অত্যন্ত টানটান। সে কিছু বলার আগে আমেজান সবাইকে তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলে,

    : বুল না রে। নাম বুলতে আবা কী?

    জমেলা মৃদু প্রতিবাদ করে,

    : লিখা পড়্‌হা জানে যে নাম বুলবে? লিজের নাম তো দিনের মধ্যে একবারও দরকার হয় না। কেহু নাম ধরে ডাকেও না। ওই পঞ্চায়েত থেকে বা হাসপাতাল থেকে বছরে এক আধদিন লোক আলে তখুন নাম মুনে পড়ে। নাম তো কেহু খাতুন, কেহু বিবি, কেহু বেগম, কেহু বেওয়া, কেহু বুচির মা, কেহু পুঁটির মা, কেহু কামলার মা, কেহু বা দাদি, নানি- এই তো হল পরিচয়।

    নাজনিন অত্যন্ত অবাক হল বৃদ্ধার কথন ভঙ্গিতে। আগে যে এমন গুণি মানুষজনের সঙ্গে আলাপ হয়নি তা নয়। কিন্তু এই বৃদ্ধার কথন ভঙ্গিতে আশ্চর্য যাদু, আশ্চর্য নিটোল গল্প বলিয়ে যেন।

    : আচ্ছা দাদি, তুমি তো দাদি বুঝলাম, কিন্তু নাম কী?

    : নামটি আমার জমেলা, মিষ্টি আমি খাবো না।

    চিনতে ভুল হয়নি। এমন ‘না’ বোধক শব্দ দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক শব্দ তৈরির মুন্সিয়ানা। সাহিত্য ত্তত্বে কী যেন বলে একে? নাজনিনের অস্বস্তি হল। নাম বলার বিনিময়ে মিষ্টি খেতে চায়ছেন বৃদ্ধা। অথচ তার এমন সামর্থ্য নেই যে এতজন মানুষকে অনায়াসে অন্তত দুটো করে মিষ্টি খাওয়াতে পারে। অস্বস্তি কাটিয়ে দিলেন বৃদ্ধা নিজেই।

    : নাম বুল্‌রি তুরা। দেখি বিটি কত নাম মুনে রাখতে পারে!

    অল্প বয়সী এক লাজুক কালো মেয়ে, খুশিনা বিবি। মধ্য বয়সের গায়ে ছেঁড়া চাদর, লতিফা বিবি। ছেঁড়া নয়, পুরোনো চাদর, পঞ্চাশের কাছাকাছি নছিয়া বিবি। পেটানো চেহারার বেগম বিবি। সাদা কালো চুল, রং চটা নেভি ব্লু মেঝের পাড়ে বিবর্ণ হলুদ সুতোর কাজওয়ালা সস্তার তাঁত শাড়ি জড়ানো বেলেজান বেওয়া। পরিচয় পর্বে মিটি মিটি হাসছে মেয়েরা, বাচ্চারা। আরও ঘন হয়ে এসেছে দূরবর্তী মেয়েরা। সত্যিই এত নাম নাজনিনের মনে থাকবে না, থাকার কথা নয়, কিন্তু থাকাটা উচিত ছিল বোধহয়। জমেলা বেওয়া কথা বলে,

    : তা মেয়ে তুমার দরকারডা এবার বুল।

    নাজনিন খুব অপ্রস্তুত,

    : মানে, আপনাদের গান শুনবো বলে এসেছিলাম। ওই যে বিয়ের সময় যে গীত করেন, বাচ্চা ঘুম পাড়ানোর জন্য যে গান করেন, সেগুলো আমাকে শোনাবেন?

    জমেলা আকাশ থেকে পড়ে,

    : শুনো মেয়ের কথা!

    আসরের অনেকে মৃদু হেসে ওঠে।

    : শুনো লাতনি,

    বৃদ্ধা কী বলে যে তাঁকে সম্বোধন করবেন,

    : আগের কালে আমিই কত বিহের গীদ্‌ করেছি। ওই আমেজানকে শুধাও। তখুন সব বাড়িতে ঢিকি ছিল, যাঁতা ছিল। ঢিকি পূজার গীদ্‌ হোতোক। এখুন বউধের কষ্ট নাই। কলের ঢিকি আসে গেলছে। একটা বাড়িতেও এখুন ঢিকি খুঁজে পাওয়া সহজ লয়। ঢিকি পূজার গীদ্‌ হবে কী করে? এখুন ঠাকুর দিয়ে বিহের রান্ধন রাঁন্ধে সবাই। আগের কালে আমরাই কত বিহের খানা রান্ধেছি। আখা পূজার গীদ্‌ করেছি। এখুন তো বিহেতে কেহু গীদ্‌ গাহাতে ডাকেই না। আগে কত গীদ্‌ করেছি, লাচালাচি করেছি। এখুনকার বিহেতে আর আনন্দ নাই। এক দিনেই বিহে শেষ। আগের কালে পানসিন্নির দিন থেকেই গীদ্‌ গাহাতে লাগতাম। সাতদিন ধরে কন্যেকে হলুদ মাখানো চলতো। বাড়ির থুবড়ো বসতো একদিন, পরদিন পাড়ার থুবড়ো, তার পরদিন বিহে। বিহের দিন অব্দি কণেকে হলুদ মাখাইন্যে হোতোক। আগে কত আয়েন পাসের বিহে হত।

    : আয়েন পাসের বিয়ে কী?

    নাজনিনের প্রশ্ন।

    : তাও জান না? কী আমার শিক্ষিত লাতনি রে! আয়েন পাসের বিহে হল মায়ের কোখের দুধ খ্যাতে খ্যাতে বিহে। মানে কাঁচা ছেলের, জালি ছেলের বিহে।
    তাকে তিরস্কার করছেন বৃদ্ধা। নাজনিনের মজা লাগে।

    : তোমরা বিয়ের গীত গেয়ে টাকা নিতে না?

    : কী বুল্‌ছে মেয়ে! টাকা ক্যানে লিব? আমাধেরই তো গায়ের বিহে। পেট ভরে খাতুক, লাচতুক, কাজ করতুক। টাকা ক্যানে লিব? তবে শাড়ি গামছা দিতোক কুনু কুনু বাড়িতে।

    নাজনিন থামিয়ে দেয় বৃদ্ধাকে,

    : দাদি একটা গীত শোনাও।

    যেন আব্দার।

    : গীদ্‌ কী আর মুনে আছে যে শুনাবো? তুমাধের কাহুরির মুনে আছে? করত্যাক যে আগে?

    সবাই যেন লজ্জা পেল একসঙ্গে। কেউ হাসল, কেউ হেসে মুখ নামিয়ে নিল, কেউ জানালো মনে নেই।

    : আমার একখান গীদ্‌ মুনে পড়েছে।

    করুণ সুরে গান ধরলেন বৃদ্ধা। যে সুরে অন্তরের সমস্ত পানি চোখে এসে জমা হয়, টপ্‌টপ্‌ করে পড়তেও বাকি থাকে না। সমস্ত আসর স্তব্ধ হয়ে শোনে সে গীত।

    কাজল কাটা ঘরখানি বেতেরই বান্ধন
    তারই তলে শিশু বালি ধরেছে কান্দন
    আর কান্দ না আর কান্দ না
    বেলা হল সার
    আলতা পরহ্‌ সিন্দুর পরহ্‌
    চল আপন ঘর

    আগে যদি জানতাম
    আমার বাপ মা হবে পর
    শাড়ির আঁচ্‌লা গুঁজে লিতাম
    কাজল কাটা ঘর।

    কারো মুখে কথা নেই। নাজনিন কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তার ইমোশনাল হয়ে ওঠার থেকে কম সময়ে বেশি কাজ করা জরুরি। অথচ গানগুলো ইমোশনের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে তাও লক্ষণীয়।

    : কুনঠে গেলি রে সব? বাড়ি এত আন্ধার ক্যানে?

    খুশিনার বর চ্যাঁচাচ্ছে। এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। এটাই গ্রামের রীতি, কাউকে ডাকলে খুব চেঁচিয়ে ডাকা। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে গেল খুশিনা। একে একে উঠে যেতে লাগলো মেয়েরা। অন্ধকার পথ ধরে বাড়ির দিকে রওনা হল। অন্ধকারেই দিব্যি দেখতে পায় ওরা। স্বামীরা ফেরার সময় হয়ে গেছে। বাড়িতে না পেলে পিঠে কিল চড় পড়ার সম্ভাবনাও আছে কারো কারো। আমেজানও উশখুশ করে। একটি বাচ্চা ছেলে আসুরাকে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে বলে,

    : বিড়ি দ্যাও এক বাণ্ডিল। বাকি পয়সা আব্বা বুললো কাল দিয়ে দিবে।

    আসুরা পয়সা নিয়ে তাকে বিড়ির একটা বাণ্ডিল দেয়। জমেলা নাজনিনের দিকে তাকায়,

    : শুন লাতনি, কাল তুমি আগে আগে চলে আসো। মুনে করে ম্যালা গীদ্‌ বুলবো।

    নাজনিন মাথা কাত করে সম্মতি দেয়। আমেজানকে উঠতে দেখে নাজনিনও উঠে পড়ে। জমেলাকে সে বলে,

    : দাদি, রাতে ভালো করে ঘুমিও আর গীত মনে কোরো।

    নাজনিন শুয়ে। বাঁশের মাচার চৌকিতে। দুটো মোটা কাঁথা পেতে তার বিছানা করে দিয়েছে আমেজান, যাতে উঁচু নীচু বাঁশের মাচায় তার পিঠে না লাগে। আর গায়ে দেওয়ার জন্য দিয়েছে আরও দুটো নরম কাঁথা। দুটো কাঁথা মিলে ভেতরটা গরম হয়ে গেছে। গভীর রাত। ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। মাঝে মাঝে প্যাঁচার ডাক, বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি। পুরো পাড়ার মানুষজন ঘুমে কাতর। নাজনিনের চোখে ঘুম নেই। নিজের ঘরে থাকলে আলো জ্বালিয়ে পড়তো এতক্ষণ। এদের কেরোসিন নষ্ট হবে বলে আলো চাইনি। নিজের ঘরে হলে রাত আড়াইটে তিনটে নাগাদ ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে ঘুমোতে যায় সে। আসুরা বিবির দোকানের দাওয়ায় আড্ডা পাতা মানুষজন এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোর চারটে বাজতে বাজতে উঠে পড়বে সবাই। প্রাতঃকৃত্যের জন্য মাঠ বা ঝোপের আড়াল খুঁজে নেবে। বদনায় পানি ভর্তি করে মেয়েরা একে একে বেরিয়ে আসবে বাড়ি থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই এই কাজটি সারতেই হবে। তারপর নারকেল পাতার খিলের ঝাঁটা দিয়ে বাড়ির উঠোন সাফ করতে লেগে পড়বে তারা। নিকোনোর থাকলে গোবর গোলা দিয়ে উঠোন ও উনুন নিকিয়ে নেবে। পাড়ার মাঝখান দিয়ে, বাঁশ বনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা তাও ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে নেবে যতটা সম্ভব। শীতে রাস্তার যে কোনো সুবিধেজনক জায়গায় রোদে পিঠ দিয়ে বা গরমকালে বাঁশ বনের ছায়ায় সময় পেলেই অলস দুপুরে জটলা পাকাবে মেয়েরা। বিশেষ করে যে সব মেয়েদের সাংসারিক কাজ বেশি করার দরকার হয় না, ছেলের বউদের বা নিজের মেয়েদের কাজ ছেড়ে দিয়ে দিন দুপুরে জটলা পাকাবে। দিনের শেষে সে আড্ডা পরিণতি পাবে আসুরা বিবির দোকানের দাওয়ায়। ঘুম থেকে উঠে এরা যখন কাজে হাত দেয় শহরে থাকলে নাজনিন তখন গভীর ঘুমে। মেয়েরা রাতের এঁটো বাসনপত্র পুকুর পাড়ে বা কলতলায় মাজতে বসবে। নাজনিন ঘুমোবে। এরা রাতের ভাত তরকারি সকাল সকাল স্বামী ও ছেলেদের খেতে দেবে। নাজনিন তখনো ঘুমোবে। স্বামী ও ছেলেরা রাতের ভাত খেয়ে সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে পড়বে। মেয়েরা তখন নিজেও চাট্টি ভাত খেয়ে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাংসারিক কাজ করে খানিকটা বেলা করে উনুন ধরাবে। সারা দিন রাতের খাবার তৈরির ঝামেলা একসঙ্গে মিটিয়ে ফেলবে। গরমকালে ভাত গেঁজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে পানিতে ডুবিয়ে রেখে দেবে। পরের দিন সকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। পাটকাঠি, শুকনো ডালপালা, ঝরা পাতা উনুনে ঠেলে দিতে দিতে, মনের মধ্যে নানান চিন্তা তোলপাড় করতে করতে, তরকারি কাটতে কাটতে একসময় শেষ করবে রান্না। রান্না শেষ হলে পানি গরম করে সোডা দিয়ে ভিজিয়ে রাখবে একগাদা নোংরা কাপড়। কাচাকাচি করে স্নান শেষ করতে করতে বিকেল গড়াবে। যেদিন কাজ থাকবে না সেদিন নাজনিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে। উঠেই সোজা রান্নাঘরে। এক কাপ জল ফুটিয়ে গ্যাস অফ করে চা পাতা ভিজিয়ে পাত্রের ঢাকনি বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকে যাবে। র চায়ের সঙ্গে সামান্য চিনি নিয়ে কয়েকটি নোনতা বিস্কিট সহযোগে সকালের কাগজে চুমুক দেবে সে। চা শেষ করে টান দেবে সিল্ক কাটে। তারপর কুকারে ভাত বসিয়ে রাতের তরকারিগুলো ফ্রিজ থেকে বের করে বই বা কাগজ কলম নিয়ে বসবে। অন্যদিন ঠিকঠাক সময়ে রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশে দেবে দৌড়। ক্লাস নিতে হবে।

    আড্ডার মেয়েরা দু একটি পদসহ রান্না শেষ করবে। পদ বলতে বাড়ির আশপাশ বা কৃষি ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা শাকপাতা। কাঁটা নটে, বেথুয়া, সজনে, হাতি পা, কলমি, কচু, কচি লাউ বা কুমড়ো পাতা। কারো কারো বাড়িতে এক টুকরো সবজি বাগানও চোখে পড়তে পারে। শাকপাতা কমে আসছে ক্রমশ। প্রায় কোনো জমিই খালি পড়ে নেই। ঝোপ জঙ্গল নেই। পতিত জমি নেই। হয় ঘরবাড়ি না হলে বাগান বা কৃষি ক্ষেত হয়েছে। শাকপাতা হবে কোত্থেকে? গরু ছাগলেরই চরে বেড়ানোর জায়গা নেই। তার মধ্যেই চালাতে হয় দরিদ্র মানুষদের। কেউ কেউ দূরের বিল থেকে ধরে আনে ছোট ছোট মাছ। এখন শোনা যাচ্ছে বিলও নাকি ইজারা দেওয়া হবে। মানে ইচ্ছে করলেই আর বিলে নামা যাবে না, মাছ ধরা যাবে না। কোনো কোনো বাড়িতে যাঁদের সামর্থ্য আছে বাজার থেকে কিনে আনা মাছ হবে। পাড়ায় ভাগায় গরু কাটা হলে কম টাকায় কিছু কিছু মাংস আসে সবার বাড়িতে। সে সব বাড়ির বাচ্চাদের তখন খুব আনন্দ। নির্ধারিত সময়ের আগেই, মানে মাংস রান্না হলেই তারা বসে পড়বে খেতে। অন্যদিন ডেকে ডেকে পাত্তা পাওয়া যাবে না তাদের। কোন্‌ বনে বাদাড়ে, নদীতে ধুলো কাদা মেখে হয়তো তখন তারা খেলছে। আপাতত সে মাংস দিয়ে ভাত খেতে ব্যস্ত। মাংস-হয়নি-বাড়ির ছেলে তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে মাংস-খাচ্ছে ছেলেটিকে দেখছে। চোখ তার ঠিকরে বেরিয়ে আসছে মাংসের থালায়। মাংস-খাচ্ছে ছেলেটির মা অথবা দাদি সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির চোখ দেখবে। মায়াবশত বা নজর লাগার ভয়ে মা বা দাদি এক টুকরো মাংস দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দেবে। সে তখন সেই এক টুকরো মাংস চেটে চুষে তার সমস্ত রস শেষ করবে। রস শেষ হলে মুখের মধ্যে মাংস টুকরোটি নিয়ে চিবোতে থাকবে। ঘন্টা খানেক বা তার বেশি সময় ধরে টুকরোটি রেখে দেবে মুখের ভেতর। হাতে লেগে থাকা ঝোল চাটবে তারিয়ে তারিয়ে। সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে সে বন্ধুদের দেখিয়ে দেখিয়ে মহার্ঘ্য জিনিসের মতো মাংস টুকরোটি চাটতে চাটতে তাদের লোভী চোখ ও মাংস না পাওয়ার দুঃখ উপভোগ করবে। তৃপ্তি পাবে। অন্য ছেলেমেয়েরা তার মাংস খাওয়া দেখতে দেখতে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নেবে। এমনকি বেশি দুষ্টু ছেলেগুলো মাংস টুকরোটি কেড়ে খেয়েও নিতে পারে।

    রান্না শেষ। স্নান করে খেয়ে ও বাচ্চাদের, বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের খাইয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়, কেউ নক্‌সি কাঁথা নিয়ে সেলাই করতে বসে, কেউ খেজুর গাছের শুকনো পাতা জুড়ে জুড়ে শীতল পাটি বোনে, কেউ আসনের ক্রস স্টিচে সুতো মেলায়, কেউ বাচ্চাকাচ্চা ও নিজেদের ছেঁড়া জামাকাপড়ে পট্টি লাগায়, কেউ কেউ ছোট্ট বাচ্চাদের শান্ত রাখতে গান করে বা ছড়া কাটে। বড় বাচ্চারা তখন ঘটিং খেলে। নাজনিন তখন তার ক্লাসে লোক শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে লম্বা একটা লেকচার দিতে থাকে। তার সামনে অসংখ্য উৎসাহী মুখ মন দিয়ে শোনে।

    দিন গড়ায় বিকেলের দিকে। আশেপাশের বাঁশবন ও গাছগুলোতে চড়ুই ও শালিখ পাখিরা দল বেঁধে কিচির মিচির জুড়ে দেয়। সারাদিন পর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা সেরে নেয় যেন। মেয়েরা আবার ঝাঁটা হাতে নেয়। দ্বিতীয় বার ঘরদোর পরিষ্কার করে। বাতাসে মিশে যায় কিছু ধুলো। খানিক পরেই স্বামী, শ্বশুর ও ছেলেরা কাজ থেকে ফিরবে, খাবে, বেরিয়ে পড়বে। তারই প্রস্তুতি চলে এখন। অন্যদিকে সন্ধ্যে যতই এগিয়ে আসে আসুরা বিবির দোকানের দাওয়া নেশার মতো টানে।

    আসুরা বিবির দোকানের দাওয়ায় আসর জমে গেছে। বৃদ্ধা জমেলা কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন ‘হাউলে হাউলে’ নাচ কিভাবে নাচতে হয়।

    আমার রঙিলা সেন্দুর পরিবে রে
    আসলে সরু সুতা ডুরুয়া রে
    রঙিলা হাউলে হাউলে লাচে।

    আমার রঙিলা মাকড়ি পরিবে রে
    আসলে সরু সুতা ডুরুয়া রে
    রঙিলা হাউলে হাউলে লাচে।

    রঙিলা নামের মেয়েটি এভাবে গানের প্রতিটি স্তবকের প্রথম চরণে একটা করে নতুন গয়না পরে নেয়। আর ছোট্ট টেপ রেকর্ডারটি রেকর্ড করে সবকিছু। নাজনিন সতর্ক। কে কখন গান ধরছে তার দিকে এগিয়ে তার মুখের কাছাকাছি ধরে থাকছে রেকর্ডারের স্পিকার, এমনভাবে যাতে গায়িকা অস্বস্তি বোধ না করে। মাঝে মাঝে নোটও নিচ্ছে রাইটিং প্যাডে। কোন গান কারা গায়ছে তাদের নাম নোট করছে। কোনো কোনো গান সবার মনে নেই। কেউ কেউ বাবার বাড়ির গ্রাম থেকে শেখা গান করছে যা এ গ্রামের মেয়েরা জানে না। কিন্তু গানগুলির মধ্যে স্ট্রাকচার ও বিষয়ের অদ্ভুত একটা যোগাযোগ আছে। সে নিজে গ্রামের মেয়ে হলেও অনেক শব্দের অর্থ বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কোনো কোনো গানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশ প্রবল। এগুলি কি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন গান? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে নাজনিন। পরে ভালো করে পড়ে দেখতে হবে। কথা বলে নিতে হবে গাইডের সঙ্গেও। তিনি নিশ্চয় এ বিষয়ে এক বা একাধিক সমাধান সূত্র বের করে দেবেন। চট করে এসব ভেবে নেয় সে। এর মধ্যেই আর একটা নতুন গান ধরে মেয়েরা। সবাই গলা মেলায়। এ গান একা একা করা যায় না। সম্মিলিত কণ্ঠ ছাড়া এ গানের আসল রস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

    বালির সিতার উপর,
    ও বালির সিতার উপর
    কি বা সাপে দংশ্যালো,
    হে সদাগর।
    এ তো সাপ লয় হে
    এ তো সাপ লয় হে
    সেন্দুরের ঝিলিক মারে
    ও হে সদাগর।

    বালির লাকের উপর
    কি বা সাপে দংশ্যালো,
    হে সদাগর।
    এ তো সাপ লয় হে,
    লথের ঝিলিক মারে
    ও মোর সদাগর।

    বালি মানে বালিকাকে (বা আদুরে নাম প্রিয়ার) নানান উপহারে সাজিয়ে দিচ্ছে সওদাগর। সওদাগরের অগাধ ধন সম্পদ। সে সহজেই বালিকে সোনার গয়নায় ভরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এ সম্পর্কের মধ্যে সাপের দংশন থেকে যায়। অথবা সাপ কি যৌনতার প্রতীক এখানে? হতে পারে। হতেই পারে। যে মেয়েদের নাকছাবি ছাড়া কোনো সোনার গয়না নেই সেই মেয়েরাই মুখে মুখে বয়ে নিয়ে চলেছে এইসব গান। এখানকার সংস্কৃতিতে বিবাহিত মেয়েদের নাকছাবি পরতেই হয়। তাই নাকছাবি ছাড়া কল্পনাতেই পেতে হয় অন্য কোনো সোনার গয়না। নিজের গরীব স্বামী নয়, সে আকাক্ষা পূরণ করতে পারে একমাত্র রূপকথার সওদাগর। খুব বেশি ভাবার সময় এখন নেই। নাজনিন যতটা পারে রেকর্ড করতে করতে, নোট নিতে নিতে চটজলদি ভেবে নেয়। গানের মধ্যেই বোঝা যায় বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর লোকসংস্কৃতিগত সাধারণ সাদৃশ্য থেকে গেছে, যতই মৌলবাদীরা চোখ রাঙাক। এখন সব অঞ্চলের মুসলমান মেয়েরা সিঁদুর না পরলেও সিঁদুরের প্রসঙ্গ বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে গানে। বয়স্ক মহিলাদের কাছ থেকে নাজনিন জেনেছে এ সিঁদুর টকটকে লাল, হিন্দু মেয়েরা যেমন সিঁথিতে পরে ঠিক তেমনই। এ সিঁদুর আফসান-রঙা মোটেও নয়, মেটে সিঁদুরও নয়। ছোটবেলায় নাজনিন দেখেছে বিয়ের দিন কনের সিঁথিতে আফসান বা মেটে সিঁদুর পরানো হয়েছে এবং তা এসেছে বরের বাড়ি থেকে, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে লগ্নের বাক্সে। আর আছে পূজা প্রসঙ্গ। মুসলমান ধর্মে যে কোনো পূজা নিষিদ্ধ। তবু বিয়ের গানের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে পূজা প্রসঙ্গ। যেমন আছে আখা (উনুন) পূজা, মাছ পূজা, ঢেকি পূজার গান। মাছ পুজার গানে নরম রসিকতা শুনে অবাক হয় নাজনিন। জেলের ছেলে আর কাজীর স্ত্রীর সম্পর্ক বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় গানটি। মাছ কিনে জেলের কড়ি দেয় না কাজী। আর সে মাছ রাঁধতে গিয়ে রাঁধুনির কী অবস্থা!

    আষাঢ় শ্রাবণ মাসে রে
    গাঙে লতুন পানি রে
    ওই দ্যাখ না জ্যালের ছেলে
    লায়ে তুলে ইলশ্যা রে
    ও না ইলিশ যাবে রে
    কুন কুন কাজ্জের বাড়িতে?

    ও না ইলিশ যাবে রে
    ইছাহাক কাজ্জের বাড়িতে।

    ইছাহাক কাজ্জের বো ভারি রাধিকা সুন্দরী
    দেয় না তো ওই জ্যালেরই কড়ি
    সে ইলিশ কুটবো আমি কামারের বটিতে
    এ ইলিশ কুটিতে ভাঙল কামারের বটি রে।

    এ ইলিশ রান্ধিব আমি রে
    সিরাজগঞ্জের লবন দি’
    আর গোল মরিচের গুঁড়ো
    এ ইলিশ রান্ধিতে ভাঙিল কুম্ভারের হাড়ি রে।

    হা হা হো হো শুরু হল এক চোট। গান করে নিজেরাই মন্তব্য করে নিচ্ছে কেউ কেউ, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলারা। তাতে সুবিধা হচ্ছে নাজনিনের। অল্প বয়সী খুশিনা বিবি গান ধরল। সে গানে গলা মেলালো সবাই। হাত তালি দিয়ে তালও দিল কেউ কেউ। আর গানের মাঝখানে হেসে উঠলো অনেকে।

    বুড়্‌হে খাতে চাহালো ক্ষীর
    বুড়্‌হে আমার হল রে থির
    বুড়্‌হে আমার লটর পটর করে
    বুড়্‌হের আমার জনম গেল
    বুয়াস গেল না
    বুড়্‌হে আমার তালের মুড়্‌হে।

    গানের বৃদ্ধর অবস্থা দেখে বৃদ্ধা জমেলা ফোকলা দাঁতে বেশ করে হেসে নিলেন। দু হাত তুলে সবাইকে থামতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। সবাই চুপ করে জমেলার দিকে তাকিয়ে। জমেলা বেওয়া গান ধরলেন। বাকিরা গলা মেলালো।

    পান পান করে আমার জ্বলে গেল জান
    ও লীল বরজের পান।
    পান যদি না পাস তো বটের পাতা আন
    ও লীল বরজের পান।

    সুপারি সুপারি করে আমার জ্বলে গেল জান
    ও লীল বরজের পান।
    সুপারি যদি না পাস তো ছাগলের লাদি আন
    ও লীল বরজের পান।

    চুন চুন করে আমার জ্বলে গেল জান
    ও লীল বরজের পান।
    চুন যদি না পাস তো বঘের (বকের) গু আন
    ও লীল বরজের পান।

    ছুঁড়া ছুঁড়া করে আমার জ্বলে গেল জান
    ও লীল বরজের পান।
    ছুঁড়া যদি না পাস তো বুড়্‌হা ভাতার আন
    ও লীল বরজের পান।

    এবার বলাই বাহুল্য হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে ফেললো মেয়েরা। নাজনিনেরও পেট গুলিয়ে হাসি পেল। কিন্তু রেকর্ডারটা ঠিকঠাক ধরে থাকলো জমেলা দাদির মুখের কাছে। জমেলা নিঃশব্দে হাসছেন গান করতে করতে আর অন্যদের হাসি উপভোগ করছেন। আসুরা দোকানের ভেতর বসে বসেই হাসছে। হাসতে হাসতেই বলে,

    : ছুঁড়া হোক আর বুড়্‌হা, ভাতার চাই!

    তার হাসির দমকে শব্দগুলো হারাচ্ছে তাদের স্বাভাবিকত্ব। জমেলা গান শেষ করেন। বলেন,

    : লে লে, কত লিবি লে। এরকম কত গান আছে।

    খানিক থেমে তিনি কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নেন এবং আবার গান ধরেন।

    মোধ উঠানে জায় ফলের গাছটি
    আর কি জায়ফল ধরে
    ও মোর আল্লা
    তারই তলে বসে রে রঙিলা
    বিহের সাজন সাজে, রে আল্লা
    কুথায় গেল রঙিলা, রে বাপজান
    রঙিলা বিদায় চাহে, রে আল্লা।

    আঁধার মাখানো পাড়াটি করুণ সুরে ভরে ওঠে। ঝিঁঝি পোকারাও সেই সুর অনুসরণ করে। কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারে না। নিজের নিজের বাপের বাড়ি, কুমারী জীবনের কথা মনে পড়ে প্রত্যেকের। কারো বা মনে পড়ে নিজের মেয়েদের কথা যাদের বিয়ে হয়েছে সদ্য। কিন্তু গানের বিষাদের মধ্যেও কোথাও একটা আনন্দ থেকে যায়। অনেক, অনেকদিন পর আবার সবাই গান করছে। সাংসারিক ঝামেলা, আর্থিক সমস্যা, স্বামীদের অকথ্য ভাষা ও মার, আধপেটা থাকতে থাকতে সবাই ভুলে গেছিলো গীত। আবার, আবার কোনো মন্ত্রবলে জেগে উঠেছে সে গান। মনে হয়েছিলো আর কোনোদিন গলা বেয়ে গীত উঠবে না। কিন্তু না, সে ধারণা ভুল। নাজনিন যে এসেছে এবং তাদের গীত শুনতে চেয়েছে তাতে প্রাথমিকভাবে নানান সন্দেহ, সংশয় থাকলেও মনে মনে তার এ গ্রামে আসার উপলক্ষটিকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারে না মেয়েরা। মেয়েদের বুক ঠেলে উঠে আসছে আনন্দ। কোন বিস্মৃত অতীত থেকে এ আনন্দের অংশীদার তারা। আরও একবার মেয়েরা ঝালিয়ে নিচ্ছে সে অতীত। হয়তো নাজনিন চলে যাওয়ার পরেও প্রতিদিন সন্ধ্যায় গান গায়বে মেয়েরা। হয়তো মনে পড়ে যাবে বিস্মৃত গানগুলি। নাজনিনের এখানে আসা একটা উপলক্ষ মাত্র। আর নাজনিনের চমক ভাঙছে না। গানের পরতে পরতে চমক যেন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সমস্ত বিষাদ কাটিয়ে আবার গান ধরে মেয়েরা। ফ্রয়েড ও তাঁর অনুগামীরা স্বপ্নের ভেতর যৌনতা খুঁজেছিলেন। কিন্তু এ তো স্বপ্ন নয়। গীতের মধ্যে নিজেদের মনের ইচ্ছে, কল্পনা অবদমিত করে রাখতে চায় নি মেয়েরা। নাজনিন আবারো একবার চমকিত হয় যখন সমবেত গান গেয়ে ওঠে মেয়েরা,

    ওই পাড়াতে দেখে এলাম কালো ধল ব্যাড়্‌হা
    না ব্যাড়্‌হা নারে কী?
    সেই ব্যাড়্‌হার ভিতরে আছে কালো ধল ছুঁড়া
    না ছুঁড়া না রে কী?
    সেই ছুঁড়ার হাতে আছে লুহা লকড়ের বালা
    না বালা না রে কী?
    সেই বালার ভিতরে আছে কাল্‌ খরিসের ড্যাফা
    না ড্যাফা না রে কী?
    সেই ড্যাফায় কামড়িয়েছে সাহান্নারির মাঞ্জায়
    না মাঞ্জায় না রে কী?
    সবাই ঝাড়ে আঞ্জর পাঞ্জর
    সবারই ঝাড়নে সব্ব শরীল জ্বলে
    আর জাহান্নারির বাপ ঝাড়ে সব্ব শরীল ঠাণ্ডা
    না ঠাণ্ডা না রে কী!

    মেয়েরা গায়ছে গীত। মেয়েরা কলকল করে গায়ছে। আজ তাঁদের সমস্ত বাঁধন খুলে গেছে। নাজনিন পরিতৃপ্ত। এই এক সাক্ষাতে অনেককিছু পেয়ে গেছে সে। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ঊর্ধ্বে কোথাও কি একটা যোগসূত্র গড়ে ওঠে না এই জমেলা, আমেজান বা বাকি মেয়েদের সঙ্গে? এঁদের ছেড়ে যাওয়ার সময় মনে কি হয় না, আসবো, আবার এদের কাছে ফিরবো, ফিরতেই হবে? মেয়েরা হাসছে। মেয়েরা কলকল করে কথা বলছে। মেয়েরা গায়ে গা ঘঁষটে বসে আছে। নাজনিন এঁদের পিছনে ফেলে পা বাড়িয়েছে। আসলে নিজেকেই সে ফেলে যাচ্ছে এঁদের কাছে।

    প্রকাশিত: সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই-অগাস্ট ২০০৯, তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা

    একাকী কয়েকটি জীবন ও অন্যরা গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত; প্রকাশক বাংলায়ন, ঢাকা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২২ এপ্রিল ২০১৮ | ১৯৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 144.159.168.72 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ০৬:২৬62352
  • কি অদ্ভুত ভাল!!
    এখনও বোধহয় আর কেউ পড়ে নি। অসম্ভব সুন্দর। আরো কয়েকবার পড়তে হবে।
  • সিকি | 158.168.40.123 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ০৭:০০62353
  • অসামান্য সুন্দর! পরে বিস্তারে আবার পড়ব।
  • ফরিদা | 181.78.237.11 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:৫১62356
  • আহা, বড্ড ভালো লেখা।
    লেখনীর জয় হোক।
  • | 144.159.168.72 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৮:৫৫62354
  • আরো একবার বলে যাই, বড্ড ভাল
  • Ekak | 11.39.142.231 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৯:৫০62355
  • ভালো ছোপি।ভালো লেখা।
  • i | 131.44.233.22 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ১১:৩২62357
  • খুব ভালো লাগল। আপনার আরও লেখা পড়তে চাই।
  • i | 131.44.233.22 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ১১:৪৩62358
  • বি প্রভার আঁকা কিছু ছবি ছোটোবেলায় দেখেছিলাম; লেখাটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ল। বিশেষতঃ লেখার শেষটি ।
  • pi | 24.139.221.129 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:০৩62359
  • কী ডিটেইলিং ভরা ছবি! আরো চাই!
  • pi | 24.139.221.129 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:১৬62360
  • কিন্তু প্রথম দু শ্রেণীর গাইডের কথা পড়ে একটু হুব্বা হলাম, কিছু কিছু কথায়। এইসব চলে কোলকাতার ইউনিগুলোতে? কোথায় হায়াত নলবন ইত্যাদিতে অনুষ্ঠান, তার খরচ ও গবেষকের!! বা, গবেষণার খরচই বা গবেষকের কেন! সেটা তো গাইডের ফান্ড থেকে আসার কথা, গবেষকের স্টাইপেন্ড সহ!
  • র২হ | 132.172.220.162 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৬:৩১62361
  • খুব ভালো লাগলো, ছবির মতন দেখা গেল যেন।

    আর ‘ইছাহাক কাজ্জের বো ভারি রাধিকা সুন্দরী’।

    ওদিকে গোলমরিচ দিয়ে ইলিশ পড়ে ডিডিদার রেসিপি মনে পড়লো!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন