এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • তিন পাতার বই

    achintyarup
    অন্যান্য | ২০ জানুয়ারি ২০১৬ | ৪৬৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • de | 24.139.119.173 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১৮:০৩692772
  • ক্ষী ভালো হচ্চে!! - একসাথে পুরোটা পড়লাম আজগে-
  • Atoz | 161.141.84.176 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৬692773
  • ওহ্হ্হ্হ, কিছু আর বলতে পারছি না! আপ্লুত।
  • kumu | 132.161.224.237 | ২৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৮:৩৬692774
  • কী রূপময় অচিন্ত্য শৈশব।
  • achintyarup | 125.111.242.12 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ২২:০৭692775
  • ওরকম আলুভাজা আর খেলুম না। মদনদার (আসল নাম ভুলে গেছি) দোকানে পাওয়া যেত সে আলুভাজা। চৌকো চৌকো, কিন্তু কটকটে। আর কী একটা মশলা মেশাতো তাতে। নিজেই বানাত দোকানে বসে। ছোট্টমতো মুদির দোকান। ডাকাতি ছেড়ে দেওয়ার পর খুলেছিল। আমাদের বাড়ির বাঁ দিকে, রাস্তার ধারের প্রথম দোকান। হস্টেলের উল্টোদিকে। দস্যু মদন হয়ে গেল দোকানদার মদন। বাল্মীকী ঠিক নয়, কিন্তু বাল্মীকী আর বিশেষ কীই বা করেছিল, একটা রামায়ণ লেখা ছাড়া? আর মদনের আলুভাজা যে গুণে বা মানে রামায়ণের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না, সে আমি বলতে পারি। মদনদার ছিল এক মেয়ে আর দুই ছেলে। মেয়ের নাম দীপালি, সে বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতে কাজ করত, মা-র কাছে পড়াশুনাও করত। ছেলেদের নাম টোলো আর জোলো। তারা ছোট ছোট ছিল। মদনের বৌকে দেখতে মন্দ ছিল না। তার নাম ভুলে গেছি।

    মদনের বৌয়ের কথা লিখতে গিয়ে রতনের বৌয়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। কিন্তু তার নামও মনে নেই। আমাদের বাড়ির ডানদিকে, কোণাকুণি,রাস্তার ওপারে পুকুরের পরে ওদের বাড়ি ছিল। কয়েকটা ছাগল ছিল ওদের। সে ছাগলগুলি আমাদের বাড়ির আশেপাশে বাঁধা কিম্বা ছাড়া থাকত। বাঁধাই থাকত মনে হয়। একফোঁটা বৃষ্টি পড়ল কি পড়ল না, তারা তারস্বরে ম্যা-হ্যা-হ্যা ম্যা-হ্যা-হ্যা করে চেঁচাতে থাকত। আর রতনের বৌ তাদের বকতে বকতে আসত দৌড়ে দৌড়ে। বলত, দাঁড়া বাবা দাঁড়া, আর চেঁচাসনি। কত করে বলি এদিক ওদিক যাসনি, কোনো কতা যদি শুনবে। এইভাবে ছাগলদের সঙ্গে তার দীর্ঘ কথোপকথন চলত।

    মদনের কথায় ফেরা যাক। মদনের সম্ভবত শেষ ডাকাতিটার কথা আমার মনে আছে। একা না, দলের একজন ছিল সে। দলে আমাদের পাড়ার পাশের পাড়ার ছেলেও ছিল। সেই ডাকাতিটা হয়েছিল গরমকালে। মনে হয় ইস্কুলের গরমের ছুটি পড়ার দিন। মাস্টারমশাইদের ফিস্টি ছিল সেদিন হস্টেলে। ফিস্টি মানে মাংস-ভাত এইসব। মাস্টারদের পরিবার পরিজন সেখানে নিমন্ত্রিত থাকত না। তখন আমাদের ওখানে বাস-টাস চলত না। পাকা রাস্তাই ছিল না। বাস ধরতে গেলে কাঁচা রাস্তা দিয়ে তিনটি মাইল হেঁটে বা সাইকেলে বা রিক্শয় করে পাঁতিহাল যেতে হত। আর একটুখানি বৃষ্টি হলে অগম্য হয়ে যেত সেই রাস্তা। কতবার মনে আছে, ছুটিতে কলকাতায় যাওয়া হবে, রিক্শ-টিকশ বলা আছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। কলকাতায় যাওয়া মাথায় উঠে যেত। কী যে দুঃখ হত তখন, সে বলে বোঝাতে পারব না। তারও আগে, যখন মার্টিন ট্রেন চলত হাওড়া আর আমতার মধ্যে, তখন বাবা এবং বাবার সহকর্মীরা বিচিত্রভাবে ওই পথে যাতায়াত করত বর্ষাকালে। বলতে বলতে আবার মার্টিন ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। লেডি রানু মুখুজ্যের স্বামী স্যার বীরেন ছিলেন সেই ট্রেন কোম্পানির মালিক। এবং আমিও সেই ট্রেনে চাড়েছি। খুব ছোটবেলায় হলেও, সে মনে আছে আমার। মানে ট্রেনের ভেতরের চেহারাটা আবছা মনে আছে। কামরার ভেতরে দেওয়াল বরাবর টানা কাঠের সিট ছিল, খয়েরি রঙের, সে কথা মনে আছে। হয়ত একবার বা দু বারই সে ট্রেনে চড়েছি। ন্যারো গেজের ওই ট্রেন আমার খুব ছোটবেলাতেই বন্ধ হয়ে যায়। বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় মশাইও ওই লাইনের ট্রেনে করে যেতেন মাস্টারি করতে। জাঙ্গিপাড়া না কোথায় যেন পড়াতেন। বোধ করি বিষ্ণু দে-ও যেতেন। পাঁতিহালে পৈতৃক বাড়ি ছিল বিষ্ণুবাবুদের। তিনি মারা যাওয়ার পর সেখানকার লোকাল থিয়েটার ক্লাব সেই বাড়ির সামনে নাটক করার জন্য বিষ্ণুমঞ্চ নাম দিয়ে একটা স্টেজ বানায়। ভাল নাটক করত তারা সেখানে।

    বেশ কিছু ভাল গ্রুপ থিয়েটার তৈরি হয়েছিল ওই অঞ্চলে। সবচেয়ে ভাল দল ছিল মহম্মদ সাদিকের, তার নাম পিএটি। পিপল্‌স অ্যালবাম থিয়েটার। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিল সাদিককাকু। বছর বিশেক আগে পর্যন্ত পিএটির প্রোডাকশন কলকাতার যে কোনও থিয়েটার গ্রুপের চেয়ে ভাল বই মন্দ ছিল না। মাঠের মাঝখানে এক পেল্লাই মাটির হলঘর বানিয়ে সেখানে রিহার্সাল করত। রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা সাদিককাকুর। আর গলার আওয়াজ ব্যারিটোন। নিখুঁত ডিকশন। আবার সেই লোকই যখন সাজানো বাগানের বাঞ্ছারাম, তখন তার কাঁপা কাঁপা গলা আর চলন-বলন মেক-আপ দেখলে বোঝার উপায় নেই, এই লোকটা আসলে থুত্থুড়ে বুড়ো নয়, জোয়ান লোক। কিন্তু কলকাতায় এসে কিছুতেই নাটক করল না সাদিককাকু। গ্রামে নাটককে জনপ্রিয় করার জেদে রয়ে গেল সেখানেই। পাঁতিহালে ছিল পল্লবকাকু। ওদের গ্রুপটার নাম ভুলে গেছি। সেও বেশ ভাল গ্রুপ। ওই যারা বিষ্ণুমঞ্চ বানিয়েছিল। আরেকটা গ্রুপ, বালিটিকুরির থেকে আসত যদ্দূর মনে পড়ছে, খুবই উন্নত মানের কাজ করত। বাবার ছাত্র অরুণ মালিক (এই নামটাও আসল নয়) ছিল সেই দলে। এই অরুণও আবার নাকি ডাকাতি করত। ডাকাতি আর গ্রুপ থিয়েটার এক সঙ্গে, ভাবা যায়?
  • Atoz | 161.141.84.176 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৮692776
  • খুব ভালো লাগছে।
  • ranjan roy | 24.96.107.112 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৬:০৬692777
  • মদনদা। হাফ শার্ট ও পাজামা। পেটানো চেহারা। অচিন্ত্য তখনও জন্মায় নি। ছোটকা কি করে যেন ওকে বাম কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
    একবার পার্কসার্কাস বাসায় এসে ছোটকা সম্ভবতঃ জন্ডিস হয়ে শয্যাশায়ী হল, দশ দিনের জন্যে। তখন আমাদের টেলিফোনই ছিল না, মোবাইল দুরস্ত। আমি কাকার ছুটির দরখাস্ত ডাকে দিয়ে এলাম।
    কাকা বলল--- এতদিন ধরে গাঁয়ে আমার পাত্তা নেই, মদন ঠিক আসবে খোঁজ নিতে।
    তখন রাজনৈতিক খুনোখুনি মাত্র শুরু হয়েছে। আমরা বাঁকা হাসলাম। ওমা, ন'দিনের মাথায় সকাল আটটা নাগাদ দোরের কড়া নড়ে উঠল। দরজা খুলে দেখি --মদনদা।

    সেই মদনদাই ষাটের দশকের শেষে বলেছিল--- মাস্টারমশাই, আর তো পারি নে! এতগুলো পেট! ইচ্ছে করে একদিন বৌ-বাচ্চার মুখে ফলিডল ঢেলে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই।

    ছুটিতে দিনচারেকের জন্যে ছোটকার গাঁয়ের হোস্টেলে গেলাম। মদনদাকে দায়িত্ব দিল আমায় সাঁতার শেখাতে। আমি ভীতুর ডিম। পারলাম না।
    কিন্তু মদনদা আমাকে গুরুমন্ত্র দিল। পুকুরে মেয়েদের স্নানের সময় কিছু ছেলেদের উঁকিঝুকি মারা নিয়ে বলল-- ক্যামন ব্যাটা ছেলে রে ওরা! মেয়েটা চানের জন্যে জামা খুলছে তো সেখানে উঁকি? আরে তেমন বাপের ব্যাটা হলে একটা মেয়ের সঙ্গে ভাল করে পীরিত কর দিকি নি, দেখবি সে নিজেই--।
  • achintyarup | 125.187.53.68 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ১২:৫২692778
  • আমি যার কথা লিখেছি, সে অবশ্য অন্য লোক
  • ranjan roy | 24.99.72.39 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ২৩:৪০692779
  • হ্যাঁ, আজ জানলাম দুজন মদন ছিল। কিন্তু চায়ের দোকান ও বর্তমানে লেদ মেশিনের দৌলতে কোটিপতি মদন? ইনি তিনি নন?
  • achintyarup | 125.111.242.141 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৭:২৪692780
  • একাঙ্কী কাকে বলে বল দেখি? মোটামুটি গোল গোল চ্যাপ্টা, একটু বড় কোনও ওষুধের ট্যাবলেটের মত দেখতে হয় সে জিনিস। আমার ধারণা ছিল কোন গাছের বীজ বুঝি। এখন দেখলুম বীজ নয়, গাছের ছাল। মিষ্টি একরকম মশলা মশলা গন্ধ তাতে। আর শুকনো খোলায় ভাজা যখন হ্ত, সুগন্ধে মাত হয়ে যেত পাড়া। মনে হত খেয়েই নিই একমুঠো। কিন্তু ও জিনিস আমাদের খাওয়ার জন্যে মোটেই নয়। ও হল মাছের খাবার। চার। সে চার তৈরির কত তরিবত, সে যদি দেখতে। সর্ষের খোল ভাজা, একাঙ্কী ভাজা, এসব ছাড়াও আরও নানা জিনিস অতি যত্নে বানানো হত বাড়িতে। যেমন হাঁড়িয়া। ভাতের মধ্যে জল এবং ইস্ট দিয়ে (সেই ইস্টের বড়িরও কী যেন বাংলা নাম ছিল, ভুলে গেছি) সেই মিশ্রণ ডালডার কৌটোর মধ্যে এয়ার টাইট করে রেখে দেওয়া হত বেশ কয়েকদিন। তা ছাড়াও বানানো হত পোলাও। একেবারে প্রপার পোলাও। তার মধ্যে দেওয়া হত শুকনো মহুয়ার ফুল। সে জিনিস কিনে আনা হত, বোধ করি বড়বাজার থেকে। পোলাও রান্না হয়ে গেলে তাকেও ডালডার কৌটোয় ভরে পচতে দেওয়া হত। কখনও কখনও উঠোনে গর্ত করে মাটির তলায় পুঁতেও রাখা হত কয়েকদিন। সেই সব জিনিস যখন বেশ গেঁজে উঠত, তখন তাই নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া হত। এই ছিল কয়েক বছর আমার বাবার শখ। বহু বছর পর পার্টি ছেড়ে দিয়েছে তখন, নিশ্চয়ই কোনও উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম হচ্ছিল, সেই কারণেই মনে হয় নতুন নেশা ধরা। এত কিছু মালমশলা লাগলেও বিশেষ খরচসাপেক্ষ ছিল না এই নেশা, যদি হত তা হলে বাবার পক্ষে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। হ্যাঁ খরচের জিনিস ছিল। ভাল হুইল, ভাল ছিপ, ভাল বঁড়শি। ফাতনা তৈরি হত ময়ূরের পালকের বোঁটার দিকের অংশটা দিয়ে। হুইল-ফুইল বাবার ছিল না। নাকি একটা ছোটমত ছিল, কেউ দিয়েছিল বোধ হয়। তারপর একবার বাবার ছোটবেলার বন্ধু অরুণকাকু বিদেশ থেকে ভাল ছিপ, হুইল, সুতো, বঁড়শি, এইসব নিয়ে এল বাবার জন্যে। সে সব হুইল এ দেশে কেউ চোখেই দেখেনি, কী করে চালাতে হয় তা-ও ভাল বোঝা যায় না। শেষে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক রকম স্থির করা গেল। তবে ওই হুইল-ছিপ ইত্যাদি বাবা খুব একটা ব্যবহার করেছিল বলে মনে হয় না।

    অরুণকাকু মস্কোয় থাকত তখন। রুশ ভাষা থেকে বই অনুবাদ করত বাংলায়। বিয়ে করেছিল ওখানকার মহিলাকে। কাকীমার নাম ল্যুদমিলা। ডাকনাম লুসিয়া। ওদের দুই মেয়ে ঋতা আর স্মিতা। ভারি মিষ্টি দেখতে ছিল ওরা। ঋতার চোখের মণি একটু নীলচে, গভীর, চুলে হাল্কা সোনালীর ছোঁয়া। স্মিতার চেহারা আরেকটু বেশি মেমসায়েবি। রুশি তো বলতই, চমৎকার বাংলাও বলত ওরা। মানে, এখনও বলে। বাংলা পড়ত, লিখতও। এদিকে কাকীমা রুশি ছাড় অন্য কোনও ভাষা একবর্ণও জানত না। একটা-দুটো বাংলা শব্দ কখনও বলত। একটু একটু বুঝত। তো দুই মেয়ে আর কাকীমাকে নিয়ে অরুণকাকু যখন আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে গেল, তাদের দেখার জন্য ভিড় জমে গেল আমাদের দরজার সামনে, জানালার সামনে। রাস্তায় বেড়াতে বেরোলে পেছনে আদুড়-গা উৎসাহী ছেলেপুলের লম্বা মিছিল। কিন্তু ভারি অসুবিধা হয়েছিল ওদের। আমাদের বাথরুম তো ছিল খুব খোলামেলা, ছাদ দরজা ইত্যাদির বালাই ছিল না। কাকীমা আর মেয়েরা সেখানে যেতে পারত না। অগত্যা, বাড়ির ভেতরে যে ছোট্ট কলঘর ছিল, সেখানেই ওরা ছান-টানও করত। সেখানে কমোড তো ছিলই না (আমাদের ছিল কুয়ো পায়খানা, বর্ষাকালে বা কোনও কারণে কুয়ো ভরে গেলে সে বেশ মনোহর চেহারা নিত), এমনকি চানের জল বেরোনোরও ব্যবস্থা ছিল না কোনও। মেয়েরা তখন বেশ ছোট। এরকম ভেজা বাথরুমে যাওয়া তাদের অভ্যেসে ছিল না। সব মিলিয়ে বেশ একটা অস্বাস্থ্যকর অবস্থা তৈরি হল। মনে পড়ল, সে সময় বর্ষা ছিল। কেননা এক একেক বার ঝেঁপে বৃটি আসছিল, আর কাকীমা বলছিল, ব্রিস্তি, ব্রিস্তি।

    কিন্তু সেই কাহিনী বলতে গিয়ে এদিকে মাছ ধরার গল্প থেকে সরে এসেছি। বাবা মাছ ধরতে যেত সাধারণত চেনা লোকেদের, বন্ধুবান্ধবদের পুকুরে। অনেক নেমন্তন্ন থাকত মাছ ধরার। বহু দূরে দূরেও যেত। সাইকেলে করে পনের কুড়ি কিলোমিটার চলে যেত সকালবেলায় উঠে, ছিপ-চার সব সঙ্গে নিয়ে। রোদে পুড়ে, কখনও কখনও বৃষ্টিতে ভিজে ফিরত সন্ধে পার করে। কদাচিৎ সঙ্গে থাকত একটা-দুটো মাঝারি সাইজের মাছ।

    বন্ধুদের পুকুর ছাড়াও ছিল পাস-পুকুর। অর্থাৎ মাছ ধরার পাস দেওয়া হত যে সব পুকুরে। তার জন্য পয়সা দিয়ে টিকিট কাটতে হত। সেখানে সব বড় বড় মাছও থাকত। পাস দেওয়ার আগে একদিন জালে করে সে সব মাছ তুলে দেখানো হত মেছুড়েদের। তারপর পুকুর ঘিরে জলের ওপর ছোট ছোট মাচা বাঁধা হত। তার ওপরে চার দিকে সারি সারি লোক বসে সারা দিন মাছ ধরত। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে আসত কেউ কেউ। আর সে কি গোপনীয়তা। একজনের চার যাতে আরেকজন জানতে না পারে। টোপও তৈরি হত নানা রকম। একেক ধরণের মাছের জন্য একেক রকম চার আর টোপ। কোনো একটা টোপ বানানোর জন্য একবার মাংসের দোকান থেকে রক্ত নিয়ে আসা হয়েছিল মনে পড়ছে। সেই রক্ত ফুটিয়ে টুটিয়ে কী যেন সব করা হল। উৎকট তার গন্ধ। তবে কাঠপিঁপড়ের ডিম নাকি বেশিরভাগ মাছের জন্যেই খুব ভাল টোপ। বাজারে কিনতে গেলে তার দাম ছিল মন্দ না। কলাপাতায় মুড়ে সেই ডিম আনা হত। বোলতার চাকও ভেঙ্গে আনা হত। সেই চাকের ভেতর থেকে লার্ভা বের করে এনে তাকে পাঁউরুটির সঙ্গে মেখে টোপ হত।

    পুকুরে চার দেওয়ার পদ্ধতিও ছিল নানা রকম। একেক ধরণের মাছের জন্য একেক গভীরতায় চার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে হত। রুই-কাতলা জাতীয় মাছ খুব বেশি গভীরে থাকে না, তাদের চার তাই পাড় থেকে খুব বেশি দূরে দেওয়া হত না। আবার মৃগেল মাছ থাকে একেবারে পুকুরের তলায়, পাঁক ঘেঁষে। তাদের জন্য পুকুরের প্রায় মাঝখানে ছুঁড়ে দেওয়া হত চার। অনেক সময় যত্ন করে বঁড়শিতে গাঁথা টোপ খেয়ে যেত কাঁকড়ায়। টুক-টুক করে ফাতনা নড়ত, কিন্তু ডুবত না। একটু পরে সুতো তুলে দেখা যেত টোপ নেই। কাঁকড়াকে টোপ থেকে দূরে রাখার একটা টোটকা ছিল মুসুরির ডাল। যেখানে চার দেওয়া হয়েছে তার থেকে একটু দূরে কিছু মুসুরির ডাল ছুঁড়ে দিলে কাঁকড়ারা তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকত।

    একেক রকমের মাছের জন্য একেক রকমের সুতো, একেক রকমের বঁড়শি এবং একেক সাইজের টোপ। ছোট মাছ ধরতে গেলে তার বঁড়শির সাইজ ছোট্ট, টোপও ছোট। বড় মাছের জন্য বড় বঁড়শি, বড় টোপ। সব মিলিয়ে নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিংই ছিল ব্যাপারটা।
  • I | 192.66.22.76 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২১:৫৮692782
  • অরুণ সোম?
  • I | 192.66.22.76 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:০৪692783
  • নিশ্চয় অরুণ সোম।বেঁচে আছেন ?আর ওঁর পরিবার?
  • san | 11.39.40.118 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:১৩692784
  • আর কে হবেন ?

    ল্যুদমিলা পড়েই মনে হল রুস্‌লান আর ল্যুদ্‌মিলা । সেই বইটাতেও লেখা ছিল মূল রুশ থেকে অনুবাদ - অরুণ সোম।
  • hu | 140.160.143.215 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২২:২১692785
  • কি অপূর্ব লেখা!

    ইন্দোদা, অরুণ সোম এখন কলকাতাতেই থাকেন যদ্দুর জানি।
  • achintyarup | 125.187.53.68 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:৪৩692786
  • হ্যাঁ, ইনি তিনিই
  • Atoz | 161.141.84.176 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৩692787
  • ওহ্হ্হ, কী যে ভালো লাগে এই টই পড়তে! অচিন্ত্যদার লেখাগুলো একেকটা রত্নখন্ড।
  • ranjan roy | 24.96.62.247 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫১692788
  • অরুণ সোম আছেন গড়িয়ায়,বহাল তবিয়তে। ল্যুদমিলা কাকিমার চুলে পাক, চেহারায় কাঠিন্য। মেয়েরা কৃতী, বিবাহিত। সম্ভবতঃ দিল্লি ও উত্তরবঙ্গে।
    কাকিমা বলেন-- লেনিনের মূর্তি নামিয়ে দেওয়ার সময় অরুণ রুশীদের থেকেও বেশি কেঁদেছিল।
    অরুণ সোমের করা শেষ অনুবাদ বেরিয়েছে বছর দুই আগে, বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে-- তলস্তয়ের ওয়র অ্যান্ড পিস, চার খন্ডে।
    বছর দুই ধরে বুলগাকভের 'মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিতা'র অনুবাদ করছিলেন -নবারুণ ভট্টাচার্যের ভাষাবন্ধন পত্রিকায়। ইদানীং বোধহয় একটু অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

    অচিন্ত্যর পিতৃদেব এখনও নিয়মিত সাইকেলবাহনে বন্ধুর বাড়ি আড্ডা মারতে যান।
  • achintyarup | 125.111.242.12 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২১:০৯692789
  • অন্য টইতে লেখা কটা টুকরো এখানে তুলে রাখলামঃ

    কাঁঠালিচাঁপা ফুল আর দেখতে পাই না। ছোটবেলায় কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ নাকে এলেই ঠিক জানতাম মানবকাকু এসেছে। মানবকাকুর ঘিয়ে রঙের টেরিকটের পাঞ্জাবীর পকেটে প্রায়দিনই থাকত কাঁঠালিচাঁপা। উগ্র মিষ্টি গন্ধ। সবুজ রঙের গুটি পাঁচেক মোটা পাপড়ির ফুল। একটু অদ্ভুত দেখতে। বর্ষাকালে সে ফুল বেশী ফুটত কি? নাকি শুধু বর্ষাতেই ফুটত? মসৃণ পাপড়ির গায়ে লেগে থাকত জলের ফোঁটা।

    বর্ষার সন্ধ্যায় তখন হয়ত ঘরে বিজলি নেই, হারিকেন লণ্ঠনের সামনে বই নিয়ে বসে আছি, রাশি রাশি বাদলা পোকা ফরফর করে উড়ছে আলোর চারদিকে, কয়েকটার ডানা খসে পড়েছে বিছানার চাদরের ওপর, বাইরে ঘুটঘুট্টে অন্ধকার, ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তার মধ্যেই হয়ত সাইকেল চালিয়ে এক হাতে ছাতা ব্যালান্স করে খানাখন্দ বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরছে কেউ, সামনের রডে বসা সঙ্গীর সঙ্গে গল্প করছে, খোলা দরজা দিয়ে টুকরো কথার আওয়াজ কানে আসছে, রান্নাঘরে রুটি বেলতে বেলতে বেলতে মা হয়ত গুনগুন করছে -- সে দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবা নদীর তীরে। সব সময় গুনগুন করে গান গাইত মা। রান্না করতে করতে, কাপড় কাচতে কাচতে, চুল বাঁধতে বাঁধতে।
    বাবা হয়ত গল্প করছে মানবকাকুর সঙ্গে।

    ছোট্টখাট্টো চেহারার লোক ছিল মানবকাকু। পুরো নাম মানব মোহন মিশ্র। রোগা, বেঁটে, মাথায় টাক নয়, কিন্তু পাতলা চুল পেতে আঁচড়ানো। গাঁয়ের লাইব্রেরি সবুজ গ্রন্থাগারের বুক পিয়ন ছিল। সবুজ গ্রন্থাগার -- কেমন অদ্ভুত নাম, না? ছোটবেলায় কিন্তু সে রকম মনে হয়নি কখনো। এখন মনে হয়, খুবই সামান্য কয়েকটা টাকা পেত হয়ত মানবকাকু, লাইব্রেরি থেকে বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাঁধা চাকরি তো ছিল না সেটা। তা ছাড়া পুরুতগিরিও করত। অল্প কিছু জমিজমাও ছিল হয়ত। পরে কখনো কানে এসেছে মানবকাকু পুলিশের ইনফর্মারও ছিল। হতেই পারে। টাকাপয়সার দরকার তো ছিলই, আর বই হাতে নিয়ে নানা বাড়িতে অবাধ গতি। সে কারণেই হয়ত ঘন ঘন আসত আমাদের বাড়ি। কে জানে।

    আমাদের দুটো কার্ড ছিল সবুজ গ্রন্থাগারের। দুটো করে বই আসত। আমি তখনও বড় ইস্কুলে ভর্তি হই নি, বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে হয়ত গেছি স্কুলের লাইব্রেরিতে, অথবা বাবা আমার পড়ার মত বই এনে দিয়েছে সেখান থেকে, তাই মানবকাকু বাড়িতে এলে একটু উৎসুক থাকতাম। যদি ছোটদের বই কিছু আনে। আনতও কখনো সখনো। বেগনি কি খয়েরি কাগজে বাঁধানো। বইটা খুললেই কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ। নতুন বইয়ের গন্ধ নয়, খুব পুরোনো বইয়ের গন্ধও নয়, বার বার ব্যবহার করা বহু লোকের হাত ফিরে আসা বইয়ের গন্ধ।

    আমার খুব ছোটবেলা থেকেই মানবকাকু আসত আমাদের বাড়ি। সঙ্গে নিয়ে আসত কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। হদ্দ পাড়াগাঁয়ে থেকেও কাঁঠালিচাঁপা ফুল মানবকাকুর পকেটে ছাড়া আর কোথাও বিশেষ দেখিনি আমি। এক-দুবার হয়ত সে ফুলের গাছ দেখেছি। এখন দেখলে চিনতেও পারব না। কে যেন বলেছিল কাঁঠালিচাঁপার গন্ধে সাপ আসে। কাঁঠালিচাঁপার গাছের কাছেও নাকি সাপ থাকে। তাতে আমার কি? সাপকে বিশেষ ভয় পেতাম না তো। আমাদের উঠোনে, বাথরুমে, রান্নাঘরে, খাটের তলায়, বিছানাতেও কতবার সাপ উঠে আসত। লাঠি দিয়ে মেরে দিত বাবা। তারপর পুড়িয়ে ফেলত বাড়ির থেকে দূরে। সাপের হাড় পায়ে ফুটলে নাকি সেপটিক অবধারিত।

    মানবকাকু মূকাভিনয়ও করত। আমার ধারণা ছিল শব্দটা মুখাভিনয়। কারণ মুখে নানা রকম রং মাখত। অভিনয়ের মধ্যে গ্রাম্য রসিকতা থাকত বেশি। কখনো কখনো শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে যেত হয়ত। আর স্টেজের সামনে মাধ্যে পেতে দেওয়া চটের ওপর বসে হেসে গড়াগড়ি যেতাম আমরা। মাঠে পাতার ঐ চটেরও একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ থাকত। শুকনো ঘাস আর ধুলোর গন্ধ।

    -----------------------------------------------------------------------------

    আজকাল কেন জানি মিনির কথা খুব মনে হয়। অথচ তার সঙ্গে না ছিল আমার ভাব-ভালোবাসা, না ছিল কোনো টান, না ছিল বন্ধুত্ব। ক্লাস টু কিম্বা থ্রি-তে পড়ি যখন, বড় ইস্কুলের দু খানা ঘরে আমাদের ক্লাস হয়, সেখানে মিনি আমাদের সঙ্গে পড়ত। চাষীর বাড়ির মেয়ে, এই তালঢ্যাঙা মনে হত তখন, হবে না-ই বা কেন, এখন মনে হয় সেই ক্লাস টু কিম্বা থ্রি-তেই বারো-তেরো বছর বয়েস ছিল তার। কিম্বা হয়তো আরও কম ছিল। ছোট ইস্কুল ছেড়ে বড় ইস্কুলে সে গিয়েছিল কিনা তা মনে নেই। যদ্দূর মনে হয় পড়াশুনো তার দু-তিন বছরের মধ্যেই শেষ হয়েছিল। সুশ্রী নয়, কালো, দাঁত-উঁচু, ময়লা লাল ফ্রক পরা। কালো কালো চামড়া-ফাটা পা ফ্রকের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকত। ফ্রকের কোঁচড়ে করে মুড়ি নিয়ে আসত, টিফিনে খেত, গায়ে গন্ধ। অবশ্য বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই অমনি ছিল। তবে অত বড় না। খুব নিষ্ঠুর কথা বলেছিলুম একদিন তাকে ওই সময়। এই লিখতে গিয়ে মনে পড়ল। রাশিয়ান বইতে, দেশ-বিদেশের রূপকথায় ডাইনির গল্প পড়ি, তারা সব কল্পনার জগতের প্রাণী তা-ও জানি, একদিন কি দারুণ রসিকতায় অন্য কোনো সহপাঠীকে বলেছিলুম, ও বোধ হয় ডাইনি। লুকিয়ে বলিনি। ভারি মজা করে মিনির সামনেই বলেছিলুম। মুহূর্তের মধ্যে দাঁত-নখ বের করা বিড়ালীর মতো ফ্যাঁশ করে উঠেছিল। দেখে আমি হাঁ। ভয়ও পেয়েছিলুম। অত বড় মেয়েটা যদি মারে। কী এমন ভয়ঙ্কর কথা বলেছি বুঝতেও পারিনি। কে জানে বাবা। তারপর তো এই নিয়ে কোনো কথাও হয়নি, এখন দেখছি ভুলেও গিয়েছিলুম। তার মুখখানাও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে তার কয়েক বছর পর, পা আগে করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল যখন, লাল রঙের নোংরা জামা পরেছিল, আর পায়ের তলাদুটো এক্কেবারে হলুদ। অমনি কোনো মানুষের পা আর দেখিনি। ফলিডল খেয়েছিল তো। আমাদের গাঁয়ে হামেশা শোনা যেত ফলিডল খাওয়ার কথা। চাষী-বাসী ঘরে সহজলভ্য বিষ। কী তার মনে হয়েছিল, বাপে মেরেছিল, কি মায়ে বকেছিল, অথবা আরও অন্য ভয়ঙ্কর কিছু, জানতেই পারিনি। হয়তো পনের-ষোলো বছর বয়েস ছিল তার তখন। হয়তো আরও কম। তারপর কতদিন পেরিয়ে গেল। পঁয়তিরিশ কি ছত্তিরিশ বছর। হয়তো দু-এক বছর কম বা বেশি। আজকাল অকারণেই যখন মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বেশি সময় নেই আর, হাতে-গোনা কয়েক দিন হয়তো, তখন সে আসে। অমনি নোংরা লাল রঙের ফ্রক, খাটিয়ায় দুলতে দুলতে যায়, পায়ের তলাদুটো অমনি হলুদ।

    ------------------------------------------------------------

    লাল ধুলোর রাস্তার উল্টোদিকে যে পুকুরটা, তার নাম তেলিপুকুর। বাঁধানো ঘাট, ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমেছে জলে। আর বাড়ির পাঁচিলের ঠিক গা ঘেঁষে যে পুকুর, বুনো ঝোপঝাড়ে ঘেরা, তার নাম পানাপুকুর। পানাপুকুর ডাইনে রেখে একটু এগোলে ডান হাতে মালপাড়া। খুব গরীব সেখানকার লোক। তারা নামাজও পড়ে, আবার কালীপুজোও করে। সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়। তার আগে দেখায় পুতুল নাচ। লম্বা ঘাঘরা পরা কাপড়ের দুই পুতুল-- দুই সতীন তারা-- দুই হাতে দুটো গলিয়ে নিয়ে, গান গাইতে গাইতে পুতুল নাচ। খাঁদি নাচবি ভাল, রসের বিনোদিনী খাঁদি নাচবি ভাল। তাদের ঝগড়া, ভাব, কান্নাকাটি, তারপর এক সঙ্গে রিকশ চড়ে হেমা মালিনীর সিনেমা দেখতে যাওয়া -- কত গল্প। তারপর পুতুল সরিয়ে রেখে একটা লম্বা বাঁখারি হাতে গান গাইতে গাইতেই সাপের খেলা।

    সেই পাড়ার ছেলে ছিল হাসান। ছোট্ট। আমারই বয়সি প্রায়। আমাদের বাড়িতে আসত পাখি নিয়ে। মুনিয়া পাখি, টিয়া পাখি, চন্দনা, শালকি পাখি। শালিককে শালকি বলত আমাদের গাঁয়ের লোক। হাটবারে রথতলার হাট থেকে কেনা ছোটবড় মাটির পুতুল তাকে দিয়ে দিতুম। সেরম পুতুল বাড়িতেও বানানো যেত। উনুনে পুড়িয়ে নিলে লাল রং ধরত বেশ।

    কিন্তু হাসান আমাকে বাঁখারি দিয়ে পাখি-ধরা ফাঁদ বানাতে শেখায়নি। সে শিখিয়েছিল আরেকজন। অবশ্য অমনি শক্তপোক্ত বড় বাঁখারি যোগাড় করে ফাঁদ বানানো আর হয়ে ওঠেনি। কী করে পাখি ধরিস রে হাসান? কেন, গাছে চড়ে বাসা থেকে পেড়ে আনি। আর আব্বা ধরে আঠাকাটি দিয়ে। আঠাকাটি আবার কী? সে জিনিস চোখেই দেখিনি কোনোদিন। হাসান বলে, লম্বা লম্বা সরু বাঁশের কি নলখাগড়ার ফাঁপা টুকরো, একটার ভেতরে একটা বসে যায়। জুড়ে জুড়ে লম্বা লাঠি। লাঠির একেবারে ওপরে আঠা মাখানো। সে শিরিষের আঠা কিম্বা অন্য কোনো কায়দায় বানানো মনে নেই, কিন্তু সেই আঠায় আটকালে পাখি আর পালাতে পারে না। গাছের ওপর পাখি দেখলেই আস্তে আস্তে নিচে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। তারপর চটপট আঠাকাটির টুকরো জুড়ে জুড়ে পাখি পর্যন্ত লম্বা করে দিতে হয়। পাখি আটকে যায় তাতে। কিন্তু আঠাকাটি জোড়ার সময় বিড়বিড় করে সমানে বলতে হয়, উড়ে যা উড়ে যা উড়ে যা... ও হাসান, পাখি ধরবে যদি তো উড়ে যা উড়ে যা কেন বলে? গম্ভীর মুখে খাঁচা-টাচা গুছিয়ে নিয়ে হাসান বলে, বলতে হয় গো দাদা অমনি। নইলে পাপ লাগে

    -------------------------------------------------------------------------------

    জিমিস কিচেনের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট্ট একটা টেবিল। তার দু দিকে দুটো চেয়ার। একটায় আমি বসি। অন্যটা খালি থাকে। আমি একটা বীয়ার খাই। স্ট্রং। সময় থাকে না। তাড়াহুড়ো করি। ফোনটা টেবিলে রাখি, পিঠের ব্যাগ হাত গলিয়ে ফেলে দিই চেয়ারের এক পাশে। যে চেয়ারটাতে আমি বসব। চট করে ঘুরে আসি টয়লেট থেকে। ফাঁকা রেস্তোরাঁ। আমি একমাত্র খরিদ্দার। ওয়েটার নাইজেল এসে হেসে জিগ্যেস করে, ভালো আছেন? আমি অন্যমনস্ক থাকি। আমি শুকদেববাবুর কথা ভাবি। লেখার কথা ভাবি ওঁকে নিয়ে। আমার মাথার মধ্যে সুর পাক খায়। টেবিলে ন্যাপকিন নেই, আমি ন্যাপকিন চাই। শুকদেববাবু আমাদের বাড়ি আসতেন। বাজনা শেখাতে। বাজনার কথা ভাবি। সুর পাক খায়। ফাঁকা রেস্তোরাঁয় আমি একলা খরিদ্দার। আমার মাথার ভেতর সুর ঘোরে। মনে হয় গান গাইছে কেউ। খুব আস্তে। ইমন। দূর থেকে ভেসে আসছে যেন সুর। না। আমার মাথার ভেতর বাজছে। আমি মাথা ঝাঁকাই। সুরটা বের করে দিতে চাই। বেরোয় না। মাথার ভেতর গেয়ে চলে কেউ। আমার অস্বস্তি হয়। দিশেহারা লাগে। চেনা ওয়েটার এগিয়ে আসে, শরীর খারাপ স্যার? জিগ্যেস করি, হ্যাঁ গো, তোমাদের এখানে কেউ গান গাইছে, কিচেনের ভেতর? প্রশ্নটা করেই লজ্জা পাই। চীনে রেস্তোরাঁর কিচেন থেকে ভর দুপুরে ইমনের সুর ভেসে আসতে পারে না। হেসে ফেলি। ওয়েটার হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে, আমতা আমতা করে। তারপর একটু থেমে বলে, সরি স্যার। বাচ্চা ছেলেটা, নতুন এসেছে, বারণ করে দেব স্যার? আশ্চর্য হয়ে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে থাকি। বলি, একবার ডাকতে পারবে ওকে? খানিক পরে কিচেন থেকে হাত মুছতে মুছতে ছেলেটি এসে দাঁড়ায়, কাঁচুমাচু। কাছাকাছি আসতে ভয় পায়। একটু মঙ্গোলীয় চেহারা। নাম আদিত্য। দার্জিলিং সে নয়া আয়া হুঁ স্যার। বঙ্গালি সমঝ লেতা হুঁ, লেকিন বোলনা নহি আতা। জিগ্যেস করি, কী গান গাইছিলে? বিড়বিড় করে কী বলে, বুঝতে পারি না। আবার প্রশ্ন করে কান পেতে থাকি। বলে, রেওয়াজ করছিলাম স্যার। পিয়া কি নজরিয়া। শুধু কিচেনের কাজ ভালো লাগে না। আমি গান শিখতে চাই। হালতুতে একজনের খোঁজ পেয়েছি। কয়েক হপ্তা হল যাচ্ছি। ইমন দিয়ে শুরু করেছেন শেখাতে। রেওয়াজ করার সময় পাই না তো, তাই কাজ করতে করতেই করি। আপনার ডিস্টার্ব হচ্ছে স্যার? আমার মুখ দিয়ে কথা ফোটে না। সামলে নিয়ে বলি, এখানে গান শোনাতে পারবে আমাকে? ছেলেটি এদিক ওদিক তাকায়। রেস্তোঁরার ম্যানেজার মানা করে। অন্য খরিদ্দররা আসবে, এখানে গান করা যাবে না স্যার। সামনে বসে গান শোনা হয় না, কিন্তু ভারি ভালো লাগে আমার। বাচ্চাটার চুল ঘেঁটে আদর করে দিই। বীয়ারটা শেষ করে বেরিয়ে আসি রেস্তোঁরা থেকে। মাথাটা হাল্কা লাগে।
  • Manish | 127.242.168.53 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১১:২১692790
  • কোনো ভাষা দিয়েই এই লেখাকে প্রকাশ করা যাবে না। কুদোস
  • achintyarup | 125.111.242.12 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২০:৫২692791
  • সামন্তকাকু গান করত, তবলা বাজাত চাটুজ্জেবাবু। এক সঙ্গে নয়, যে যার নিজেদের মতো করে। টানা লম্বা ঘরের পর ঘর জোড়া এক বিল্ডিং-এ পাশাপাশি কোয়ার্টার ছিল দুই মাস্টার পরিবারের। সন্ধের পর তাই সারা পাড়া গমগম করত। এক ঘর থেকে ভেসে আসছে হয়ত পথ চলিতে যদি চকিতে তব দেখা পাই। পাশের ঘর থেকে ধা ধি না/ ধা তু না। এদিকে দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখি নেই। সন্ধের পর কারেন্ট থাকত না সাধারণত, হারিকেন লণ্ঠনের আলো জ্বেলে পড়তে বসেছি, সুরে এবং তালে ভরপুর চারদিক। সব সময় যে শ্রুতিমধুর, তা-ও না।

    চাটুজ্জেবাবুর আর এক বাতিক ছিল। আধুনিক কবিতা। বেশি কথা বলতেন না, এবং ওঁর বাড়িতে আমাদের যাতায়াতও ছিল না বিশেষ, কিন্তু স্কুলের ম্যাগাজিনে কঠিন কঠিন কবিতা লিখতেন, সে আমার বেশ মনে আছে। প্যান্ট-শার্ট পরা, পাতলা চুল টাকের ওপর দিয়ে পেতে আঁচড়ানো। কয়েক বছর পর চলে গিয়েছিলেন কলকাতার কোনও ইস্কুলে।

    আমাদের ইস্কুলে সরস্বতী পুজো হত। যেমন হয়। একটা হস্টেল ছিল। এক তলা। গোটা আট-দশ ঘর তাতে। তারপরেই ধান জমি। তারপর খেলার মাঠ। তারপর ইস্কুল বিল্ডিং। পুজোর দিন ওই হস্টেলে সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হত। লুচি, ছোলার ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, শুকনো ঝুরঝুরে বোঁদে। সে বোঁদের জন্য এখনও মনটা হু হু করে। কারণ ওই রকম জিনিস পরে আর পাইনি কোথাও। হস্টেলের লম্বা ছাদে খাওয়া দাওয়া হত।

    আমার জ্ঞানত হস্টেলে কোনও ছাত্রকে থাকতে দেখিনি আমি। দু তিন জন বাইরে থেকে আসা মাস্টারমশাই থাকতেন। ব্যাচেলর বা পরিবার থেকে দূরে থাকা। পরের দিকে এক দু জন থাকতেন ফ্যামিলি নিয়েও। তবে আমি তার আগের কথা বলছি।

    সেবার পুজোর কার্ডের লেখাটা লিখেছিলেন চাটুজ্জেবাবু। কবিতায়। কাছাকাছি গঞ্জের প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছিল। ছাপাখানা থেকে যখন এল, তাতে টাটকা রঙের গন্ধ। ভাঁজ করে করে খামে ভরা হল কার্ড। লেখাটা যত দূর মনে পড়ে, ছিল এই রকমঃ

    মহাবুধ!

    দিন ঘুরে যায়, মাস ঘুরে যায়
    আবার আসে এ কোন মায়া-শ্বেতহংস।
    কিংশুক আর অশোকে তার প্রতিচ্ছায়া,
    শুভ্র মেঘে চরণ তাঁর, জীবন-বীণায় পাণি
    অবিদ্যা আর অহংকারের শুনি হা হা ধ্বনি।

    ওই যে তিনি সিতাঙ্গিনী, মা সারদা,
    শ্রদ্ধা ভক্তি দিব্যজ্ঞান সর্ব শুভ ফলপ্রদা।

    মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে
    মা-কে আমরা এবারও যে
    ভক্তি-অর্ঘ্য চাই দিতে।
    আপনি আসুন, সঙ্গে আসুন
    বান্ধব আর আপনজন।
    শুদ্ধা ভক্তি মন্ত্রোচ্চারে
    উদ্বেল হোক এ প্রাঙ্গণ।

    পাশের পাতায় লেখা থাকত, পরের দিন সকাল কিছু একটা ঘটিকায় প্রতিমা নির্মঞ্ছনান্তে জলসাৎকরণ। আমাদের পণ্ডিতমশাই মৃগাঙ্কশেখর কাব্য ব্যাকরণতীর্থের ভাষা। জলসাৎকরণটা অবশ্য সকালে হত না। সন্ধে গড়িয়ে যেত। সেখানে খুব বেশি লোক থাকত না। স্কুলের পুকুরে প্রতিমা ভাসিয়ে দেওয়ার পর তখনও রয়ে যাওয়া কিছু ঝুরো বোঁদে দিয়ে মিষ্টিমুখ। ইস্কুল বিল্ডিং-এর গায়ে লাগানো বাতির হলদে আলো পাম গাছের সারির ফাঁক দিয়ে তেরছা হয়ে এসে পড়ত মাঠে। মাঠের পরে পুকুর পর্যন্ত সে আলো এসে পৌঁছত না। হ্যাজাক নিয়ে যাওয়া হত। হাল্কা ঠাণ্ডার ভাব তখনও বাতাসে।
  • r | 125.111.242.141 | ০৬ মার্চ ২০১৬ ২২:২৬692793
  • থামলে কেন?
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন