এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২১ মে ২০১৬ ১৩:৩২678620
  • তারপর?
  • ranjan roy | 192.69.109.99 | ২৩ মে ২০১৬ ১৭:০৪678621
  • আচ্ছা, আগে বলতো তুই শালা কে? খোচড়? আইবির লোক? শুনে টুনে আমাকেই ফাঁসিয়ে দিবি না তো?
    ---- কেন এত আত্মশ্লাঘা? আজ ক্যান্সার ওয়ার্ডে শুয়ে আছে বলে নয়, অনেকদিনই কোন পুলিস টুলিস তোমার পেছনে নেই। কাজেই গল্প বল। পুরনো দিনের গল্প। তোমার বোকামি একচোখোমির গল্প।
    -- কেন?
    --- আর কেন? আচ্ছা, আজকের মত ওই দুটোই বল। বললে পরে নিজেই বুঝতে পারবে। আর না পারলে আমি বুঝিয়ে দেব খন।
    -- ও হো! বেড়ালেও পড়েছে 'ও শ্যামাদাস'!
    --- কেন পড়বে না? বেড়ালে পড়াশুনো করে না? হ-য-ব-র-ল খোল, শুরুতেই পাবে-- ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!
    -- বাস্‌ করো রামদাস!
    -- তুমিও ফালতু না বকে শুরু করো দিকি। লক্ষ্মীছেলে!
    --- স্বদেশী যুগের প্রারম্ভে বোমা নির্মাণের কৃৎকৌশল এই বঙ্গভূমিতে গোপন সূত্রে পহুঁছিয়া গেল। ইহাতে বাঙ্গাল অনুশীলন দলের চেয়ে অধিক কৃতিত্ব ঘটি যুগান্তরদলের ।
    --মানে? এর কোন প্রমাণ? তথ্য? রিসার্চ?
    --চুপ বে! মাঝে কোন প্রশ্ন করবি না। প্রশ্নোত্তরপর্ব শুরু হবে শেষে। আরে মুরারিপুকুর বোমার মামলা, মেছুয়াবাজার বোমার মামলা সব তো যুগান্তরদলের ছড়ানোর গল্প। অনুশীলনের বাঙালরা লাঠি-ছোরা-পিস্তলে বেশি বিশ্বাস করত।
    এমনকি ভগত সিংহের দলও কোলকাতা থেকেই বোমার ফর্মূলা পেয়েছিল। আর ক্ষুদিরাম বোস? গানটা ভাব --" কলের বোমা তৈরি করে, দাঁড়িয়ে ছিলাম লাইনের ধারে--"? সব ঘটির দল। বার খেয়ে ভুল টার্গেটে বোমা ছুঁড়েছে। ওদিকে চাটগাঁয়ে সূর্য সেন অনন্ত সিং প্রীতিলতা কল্পনা দত্ত গণেশ ঘোষ-- সব বড় স্বপ্ন দেখতেন। তাই আর্মারি রেড। সোজা স্টেনগান, ব্রেনগান, এলএমজি, মর্টার এইসব। অনন্ত সিং অবশ্য স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি জয়েন করেও এইসব করতেন-- তাই পার্টি থেকে হুড়ো খেয়েছিলেন। সে অন্য গল্প।
  • ranjan roy | 192.69.109.99 | ২৩ মে ২০১৬ ১৮:০৩678622
  • --- আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল। বলছি প্রেসি লিখতে, লিখছ "ভাব -সম্প্রসারণ"। মহা গোলা লোক তো! দেখ, তোমার মত অবস্থায় কেউ ঢপ দেয় না।
    -- শালা! তোর ইয়েতে--! আমি ঢপ দিচ্ছি?
    -- রাগ কর কেন? হয় তুমি বোমা বানাতে জান, নয় জান না। এতে লজ্জার কী আছে? তোমাদের চারু মজুমদার তো শ্রেণীঘৃণা থাকলে ছুরি-কাঁচি-দা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলতেন! সুকান্ত বোধহয় এঁর কথা ভেবেই 'আদিম হিংস্র মানবিকতা'র কথা বলেছিলেন!
    বেড়ালের মুখে সুকান্ত আর চারুদার কথা? হাত বাঁধা হলে কি হয়, পা তো খোলা। আর বেড়ালটা বেশ কাছে ঘেঁষে এসেছে। সজোরে চালানো লাথিটা খাটের লোহার পায়ায় একটু ছুঁয়ে গেল। না, বেশি ব্যথা লাগে নি। কারণ লাথিটা--মনে মনে যেমনই ভেবে থাকি না কেন-- 'সজোরে' চলে নি। পায়ে কোমরের পাওয়ার হাউস থেকে সেই শক্তিটা এল না। আর বেড়ালটা জানলার তাকে উঠে গা-জ্বালানো মুচকি হাসি হাসতে লাগল। বলল-- লক্ষ্মীছেলে!

    আমি ছাদের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলামঃ
    বোমা -- ইংরাজিতে ক্র্যাকার, বঙ্গীয় অপভাষায় মাল বা রুটি। কখনও চেহারা ও সাইজের কারণে নারকোল বা ঝুনো নারকোল।
    ইহা শুকনা মশলা কেরোসিন বা পাউডারে মাখিয়া তাহাতে পাথরকুঁচি, পেরেক বা গ্রামোফোনের পিন ভরিয়া গোলা পাকাইয়া দিলীপের মুস্কিপাতি জর্দার খালি কৌটায় ভরিয়া পাটের সুতলি দিয়ী বাঁধা হয়। এই বাঁধা ব্যাপারটাই শিল্পীসুলভ দক্ষতার দাবি করে। সুতলির একপ্রান্ত দাঁতে চাপিয়া বাম হস্তে মশলা ভর্তি গোলাটি কাগজে ঘিরিয়া দক্ষিণ হস্তে সুতলি ভূগোলের গ্লোবের দ্রাঘিমাংশের লাইনের অনুরূপ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া টাইট করিয়া বাঁধিতে হয়। মশলাটি ভাল করিয়া না ঠাসিলে ফ্রিকশন হইয়া বিস্ফোরণের আগাম সম্ভাবনা। তাই কেরোসিন বা পেট্রোলে ভিজাইয়া মাখিতে হয়। শুকাইলে দ্রুত বিস্ফোরণ।
    বড় বড় ওস্তাদ শুখা শুখা বাঁধিতে পারেন। পেট্রোল দ্রুত উবিয়া শুকাইয়া তোলে, তাই তাহার বড় কদর, কিন্তু শিক্ষানবীশদের জন্য কেরোসিনই শুভ।
    বিস্ফোরণ হইলে উহার গর্ভে রাখা পাথরকুঁচি, পেরেক, পিন ইত্যাদি স্প্লিন্টারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া লক্ষ্যবস্তুর বা ধারণকারীর শরীরে প্রবেশ করিয়া ক্ষত, রক্তপাত,অঙ্গহানি ও মৃত্যুর কারণ হইতে পারে।
    বাঁধিবার পর একটি ছোট জর্দার কৌটা দড়ি জড়ানো ঝুনা নারিকেলের রূপ ধারণ করে। পূর্বেই বলিয়াছি--- আসল বাহাদুরি ও নৈপূণ্য বাঁধিবার দক্ষতায়। উহা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া একই তাল ও লয়ে বাঁধিতে হয়। ঝটকা লাগিলে তৎক্ষণাৎ বিপদের সম্ভাবনা। তাই উহা যদি মধ্যলয়ে বাঁধা শুরু হয়, তো সেই লয়েতেই শেষ করিতে হইবে। দুনি বা চৌদুনের কোন সুযোগ নাই। তেহাই বা উঠানের প্রশ্নই নাই।
    তবু এই পদ্ধতিটি বড় বিপজ্জনক ও স্থুল, ইহাতে সন্দেহ নাই। শত সাবধানতা সত্ত্বেও প্রতিবছর বেশ কিছু তরুণ বাঁধার প্রক্রিয়ায় বোমা ফাটিয়া চোখ, হাত, পা , অন্ডকোষ ও প্রাণ হারাইয়া থাকে। এই অনুষ্ঠানের গত অর্ধশতাব্দীর রেকর্ড একই প্রকার।
    আশার কথা, বিপ্লবের জন্য নিবেদিত প্রাণ নারীদের এই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ নিষেধ। ইহা একমাত্র মেন ওনলি পেশা। তাই রক্ষা!

    এবার আমি পাশ ফিরলাম।
    কিন্তু ভবি ভোলে না।
    -- এখনও মশলার কথা বললে না। আর প্রোডাক্শানের সময় কোন সেফটি মেজার ?
  • ranjan roy | 192.69.109.99 | ২৩ মে ২০১৬ ১৮:৩৫678623
  • ওঃ, এই শালা জ্বালিয়ে খেলে! ( শালা না শালী? ঠিক দেখেছি তো?)
    কিন্তু একবার পা পিছলে গেলে আর থামা যায়?

    --- অ্যাই! দুটো যৌনরোগের নাম বলত!
    -- এ আবার কী?
    --- শালা, এদিকে মা-ষষ্ঠীর বাহন হয়েছিস আর দুটো ভিডির নাম বলতে পারছিস না? তুই শালা কেমন বেড়াল?
    -- বোমা বাঁধার সঙ্গে ভিডির কী সম্পর্ক?
    --আছে, আছে। সম্পর্ক আছে। আগে তুই নাম বল, তারপর আমিও মশলা বলছি।
    --- বড় দুটো হল সিফিলিস আর গনোরিয়া।এছাড়া আরাও কিছু ছুটকো-ছাটকা আছে, সেগুলো ধর্তব্য নয়।
    --- ঠিক ,ঠিক। পাশ। তেমনি বঙ্গের বোমা বা ক্র্যাকারকুলের মুখ্যতঃ দুইটি বংশঃ লাল-সাদা আর হলুদ--সাদা।
    --- আর নীল-সাদা?
    -- ভাগ শালা! ফালতু পেঁয়াজি না।
    দেখছিস তো, সাদাটা কমন ফ্যাক্টর-- এটা হল পটাসিয়াম ক্লোরেট। আর লাল হল আর্সেনিক সালফাইড , চালু নাম মোমছাল। হলুদ মানে সালফার বা গন্ধক। সাদার সঙ্গে লাল বা হলুদ সমান বা ১ঃ২ বা ১ঃ৩ ইত্যাদি সাপ্লাই ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে মেশানো হয়। এগুলো একটাও আলাদা করে বিস্ফোরক নয়, কিন্তু দুইয়ে মিললে একেবারে রাসলীলা। সোজা বিন্দেবন দেখিয়ে দেবে।
    যৌনরোগের সঙ্গে এগুলোর আর একটা মারাত্মক মিল আছে। দুটোতেই ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিত ; আজ নয় কাল, মৃত্যুও হতে পারে। তবু সব জেনেও লোকে বেপাড়ায় যায়, ভাবে সাবধানে গুটি গুটি যাব। চোখ নামিয়ে বেড়িয়ে আসব। কেউ টের পাবে না। কিস্যু হবে না। তবু টেরও পাওয়া যায়, ক্ষতিও হয়। দুটোতেই। সাবধান থাকলেও।
    -- সাবধান কী করে?
    -- বেপাড়ায় যাইনি, কী করে জানব?
    বেড়ালটা লজ্জা পেল, বলল- ধ্যেৎ!
    বুঝে গেলাম যে এটি হুলো নয় মেনি!
    --আমি বোম বানানোর কথা জিগ্যেস করছি।
    --শোন, অনেকেই বন্ধ ক্লাবঘরে, পোড়োবাড়ি বা নির্মীয়মাণ বহুতলের ঘুপচিতে বানায়। খুব রিস্কি। একটা ফাটলে হাওয়ায় ভাইব্রেশনে বেঁধে রাখা অন্যগুলোও ফাটতে থাকবে, একেবারে পুঁদিচ্চেরি কেস!
    নাকতলা পাড়ায় বামনা বিভাস নীচের তলায় গোটা দশেক বোমা বেঁধে বসেছিল। ওর চেলা দোতলা থেকে দুটো নারকোল নিয়ে ভারা বেয়ে নীচে নামছিল। ওভার- কনফিডেন্স! শেষরক্ষা হল না। শেষ পাদানিতে সিলিপ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল -- বোমা ধরা হাত পেটের তলায়। ওর নাড়িভুঁড়ি আর প্রাণ একই সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কিন্তু নীচের তলায় ঘরে হাওয়ার তীব্র কাঁপুনিতে বেঁধে রাখা বোমাগুলো পর পর ফাটতে লাগল। বিভাসের সাথী মরল। বিভাস বেঁচে উঠল একটা চোখ ও একটা হাত হারিয়ে।
    --- আর?
    -- আমরা বাঁধতাম খোলা জায়গায়, গঙ্গার পাড়ে। ফাটলেও কিছু হবে না। চাপ থাকবে না। আর সামনে থাকত গঙ্গামাটি বা বালি ভরা এয়ারব্যাগ , তখনকার ভাষায় কিটব্যাগ। মুখ থাকবে ব্যাগের থেকে একটু পিছিয়ে আর হাত দুটো ব্যাগের সামনে।
    --কেন?
    --- বুঝলি না! ফাটলেও মুখচোখ, পেট বেঁচে যাবে। মানে জান বাঁচবে। বড়জোর হাতের আঙুলের ওপর দিয়ে যাবে। আর কোন প্রশ্ন আছে, কমরেড ক্যাট?
    উত্তর নেই। আমি থামার আগেই বেটি পালিয়েছে।
  • aranya | 83.197.98.233 | ২৬ মে ২০১৬ ১১:২১678624
  • ভাল হচ্ছে। এটা যেন থেমে না যায়
  • Ela | 174.143.240.34 | ২৬ মে ২০১৬ ১৫:৩৭678625
  • একমত, থেমে না যায়
  • Ranjan Roy | ২৭ মে ২০১৬ ২৩:২১678626
  • ৫)
    বাড়িতে এসেছি। কিছুদিনের জন্যে ; একটু পরিবত্তোন! তা বেশ। সাতদিন পরে রক্তপরীক্ষা, হ্যানো ত্যানো, প্লেটলেট কাউন্ট। তারপর রিপোর্ট দেখে পরের কেমোর জন্যে দিনক্ষণ রাশিনক্ষত্র দেখা। তারপর "সে শুভলগনে জাগ গগনে " গেয়ে আবার এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
    আমার এক দাদা আছে। সে এক জিনিস। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা, নার্সের সঙ্গে কথা ওসবের ধারে কাছে নেই। সব ব্যাপারে বৌদিকে এগিয়ে দেয়। নিজে দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
    নাঃ, কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। স্পেসিফিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু আমার দায় তো ওই বইছে, হাসপাতালের খরচাপাতি সব ওই মেটায়। কী করে করছে কে জানে। হয়ত ধারকর্জ করছে আবার। বাড়ির লোন তো মাত্র গত বছর শেষ হল।
    বৌদি বলে-- তোমাকে এসব ভাবতে হবে না। ঠিকমত কথা শুনে ওষুধ খাও আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। ব্যস্‌!
    দাদা আবার আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না, বৌদির হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধগুলো কিনে এনে ওর হাতে তুলে দেয়। বাড়িতে বৌদি ওদের নিজের ঘরটা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সময়মত ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব, পথ্য দেওয়া সব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
    টিভিতে দেখাচ্ছে শচীন বলে একটা বাচ্চা ছেলে পাকিস্তানে গিয়ে ফাস্ট বোলারদের উদোম কেলিয়ে দিল। আবার নাকে লিউকো-প্লাস গোছের কিছু লাগিয়ে। দাদা তো ক্রিকেটের পোকা। সবার ঠিকুজি কুষ্ঠি জানে। ছোট বেলার থেকে দেখেছি--ও ছিল আমাদের পাড়ার উইসডেন। কিন্তু দাদা আমার ঘরে আসে না কেন? একটু ক্রিকেট নিয়ে আড্ডা দিলেও তো পারত!
    বৌদিকেই জিগ্যেস করলাম-- একটা কথা বল। দাদা কেন আমার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায় না? কেন এই ঘরে এসে আড্ডা মারে না?
    --- আমি কী বলব কেন? তোমাদের ভাইদের মধ্যের ব্যাপার আমি কী জানি?
    ---এড়িয়ে যাচ্ছ?
    বৌদি চুপ।
    --- আমি জানি কারণটা। দাদা জেনে গেছে আমি আর বাঁচব না। দিন ঘনিয়ে এসেছে। তাই--! আমি এখন বাতিলের দলে?
    বৌদি কোন কথা না বলে উঠে চলে গেল।

    দিন যে ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পারছি। আজকাল ডাক্তার রোজ রাত্রে মরফিন ইঞ্জেকশন নিতে লিখেছে। কমন পেইনকিলার আর কাজ করছে না।
    রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পাড়ার কমল ফার্মেসি থেকে কম্পাউন্ডার নুরুদ্দীন বা নুরু এসে মরফিন লাগিয়ে দেয়। বৌদি ওকে বকে।
    -- নুরু! আবার তুমি ফুল ডোজ লাগাচ্ছ? বলেছি না হাফ ডোজ দেবে? ফের!
    কিন্তু ওই মিনি ডোজে ঘন্টা তিনেক পরেই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
    ক'দিন ধরে বৌদিকে জপাই--- পুরো ডোজ মরফিন দিতে দাও বৌদি, নইলে ঘুম হচ্ছে না।

    --- শোন অলক! তুমি তো অবুঝ নও। বেশি নিলে অভ্যেস হয়ে যাবে। পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অসুবিধে হবে। সাইড এফেক্টে অনেক সময় পার্শিয়াল প্যারালিসিস হয়ে যায়। তুমি কি তাই চাও?
    --- তুমি কি ডাক্তার? বেশি ওস্তাদি কর না। উনি লিখে দিয়েছেন , তুমি কে হরিদাস পাল?
    --- অলক, রাগ কর না। একটু কোঅপারেট কর। আমি যে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। তোমার দাদাও দেখে। তুমি একদিন সম্পূর্ণ সেরে উঠে আবার--!
    আমি আর থামতে পারি নি।
    -- অ্যাই ফালতু সেন্টু দেবে না। খোদার ওপর খোদকারি ফলিও না। তবু যদি মেডিক্যালের জয়েন্টটা পাশ করতে!
    বৌদির মুখটা কেমন যেন হয়ে যায়। তারপর উঠে অন্য ঘরে চলে যায়। ওর সবচেয়ে বাজে জায়গায় খোঁচা দিয়েছি। আচ্ছা, আমি কেন এত খিটখিটে হয়ে গেছি?
    --- বৌদি! শোন। আমার আর বেশি দিন নেই। তাই হাতে গোণা যে ক'টা দিন আছি, একটু ঘুমিয়ে নিতে দাও। তোমার পায়ে পড়ি।
    বৌদি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল; কিছু বলল না। তারপর উঠে চলে গেল।
    প্রায় আধঘন্টা পরে ফিরে এসে ওষুধ রাখার ছোট টেবিলে একটা প্যাকেট রেখে বলল-- এতে ছ'টা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ আর মরফিনের অ্যাম্পুল আছে। নুরু এলে পুরো ডোজ লাগিয়ে নিও। আমি আর কিছু বলব না।
  • | ২৮ মে ২০১৬ ০৮:১৮678627
  • :-(
  • ranjan roy | 192.69.76.251 | ৩১ মে ২০১৬ ১৯:৩৪678628
  • ৬)
    আরে কী আশ্চর্য!
    আমি কথা বলতে পারছি! একটু নাকে নাকে, একটু ফ্যাসফেসে। কিন্তু পারছি তো! আর ব্যথা কমে গেছে। শুধু রাত্তিরের দিকে হয়।
    বৌদি খুশি; সেদিন দাদা এল। এসে বিছানার পাশে একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ গল্প করল,-- সেই আগের সব দিনের মতন। সচীনের নামের সঠিক উচ্চারণ, বানান সব বলল। উইসডেনই বটে!
    শুধু আমার অসুখ নিয়ে কোন কথা বলল না।
    কিন্তু বৌদি মারফত খবর পেলাম যে ওরা মনে করছে আমি সেরে উঠছি। রেডিওথেরাপি আর কেমোতে নাকি অনেকটা ঘা শুকিয়ে গেছে, এক্স-রে প্লেটে দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার নাকি আশা করছেন যে কিছুদিন পরে টিস্যুগুলোর অবস্থা দেখে সেখানে একটা অপারেশন হবে। তাহলেই অন্ততঃ দশবছর আয়ুবৃদ্ধি।
    টাকাপয়সা?
    -- এসব নিয়ে একটুও ভাবতে হবে না। সব দাদা দেখছে,।
    ---বৌদি, আমার ভাল লাগছে না।
    --- এত ঠুনকো আত্মসম্মান বোধ? আরে আমাদের কোন ছেলেপুলে নেই। তুমিই তো--!
    কিন্তু আর একটা ঘটনা ঘটেছে।
    দাদাবৌদির শোবার ঘর, মানে যেটা এখন আমার অস্থায়ী আস্তানা, সেখানে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ফ্রেমে বাঁধানো নেক যুগলের ফটো। পুরুষের সাদা দাড়ি গোঁফ ও মহিলাটির বড় বড় দাঁত, হাসিমুখ ও মাথায় খানিকটা মাদার টেরেসার মত ঘোমটা। উনিও মাদার-- পন্ডিচেরির।
    সেরেছে!
    আমি তবে বালিশের তলায় রাখা লকেটের প্রভাবে সেরে উঠছি। সেই চিত্রার দেওয়া পন্ডিচেরির শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমার লকেট!
    বৌদিকে বললাম-- কেন এত টাকা খরচ করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছ? সোজা পন্ডিচেরি থেকে আরও কিছু ছবি, জপমালা ও ধূপকাঠি কিনে আনলেই হয়।
    --রেগে যেও না, অলক। তুমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও দিকি! দেয়ালে ফোটো আর বালিশের তলায় লকেট, এতে তোমার গায়ে ফোসকা পড়বে কেন? যদি এগুলোর কোন প্রভাব না থাকে তাতে তোমার কি এসে যায়? চিত্রা দিয়ে গিয়েছে।
    -- মানে? চিত্রা এখানে আসে?
    --হ্যাঁ, পনের-কুড়ি দিন পরে একবার। বাইরের ঘরে বসে খোঁজখবর নেয়, উঁকি দিয়ে দেখে চলে যায়। তুমি রেগে গিয়েছিলে, তাই বলতে বারণ করেছিল।
    এর পর দু'দিন কেটে গেল।
    সেদিন বড় গুমোট; সন্ধ্যেয় ঝড়বৃষ্টি হল। কিন্তু গুমোট ভাবটা গেল না। পাখা ফুল স্পিডে চলছে।মাঝরাত্তিরে তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে গেল। মুখের ভেতরে যেন কেউ আগুনে লাল হওয়া লোহার শলা ঢুকিয়ে দিচ্ছে! উঃ, আর পারছি না।
    রায়পুরের সিআইডি পুলিশের টর্চার এর কাছে কিছুই না। সিগ্রেট দিয়ে পেটে ছ্যাঁকা, হাতের মধ্যে ব্লেডের পাতি দিয়ে হ্যান্ডশেক, হাত-পা বেঁধে মাঝখানে একটা ডান্ডা ঢুকিয়ে দুটো টেবিলের ফাঁকে উল্টো করে শূন্যে ঝুলিয়ে পায়ের তলায় মার--- না, এর কোনটাই ধারে কাছে আসে না।
    হটাৎ মনে হল কেউ একজন এসে আমার পাশে বসেছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শরীরে এক অপরিচিত গন্ধ। আমি অন্দকারে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু টের পাচ্ছি যে আগন্তুক এক নারী। তার শরীরে সিল্কের পোষাক, ঢিলেঢালা। উনি আমার গায়ে মাথায় শরীরের নানা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর-- আর ব্যথাবেদনা কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।
    শ্রীমা? মাদার!
    হ্যাঁ, উনিই তো!
    --- মা, আমি আপনার ছেলে! বোকা ছেলে! অবাধ্য ছেলে। আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমায় বাঁচিয়ে দাও।
    --- ছিঃ! মায়ের কাছে সব ছেলেই সমান।
    --- আমি সেরে উঠে পন্ডিচেরি যাব, মা! পারব?
    --- পারবে। আর কিছু চাও?
    ---- আমি সেরে গেলে বাকি জীবন তোমার আশ্রমে গিয়ে সারাদিন কুয়োর পাড়ে গাছতলায় বসে কাঠবেড়ালির খেলা দেখব।
    আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
  • ranjan roy | 192.69.76.251 | ০১ জুন ২০১৬ ২৩:৫৭678515
  • সেরে উঠছি। কথা বলতে পারছি। কিন্তু দুর্বল লাগছে। যদিও মুরগির স্টু ও অন্যান্য হাইপ্রোটিন খাবার সেই রাইল টিউবের মধ্যে দিয়েই পেটে যাচ্ছে। চিবিয়ে খাবার ক্ষমতা নেই।
    এই আংশিক সেরে ওঠা, একটু ভালো লাগা, ব্যথা কমে যাওয়া অন্য কিছুর লক্ষণ নয় তো?
    কিসের লক্ষণ অলক?
    প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে, জান তো!
    ছ্যাবলামি ছাড়; শ্রীমার উপর ভরসা রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।
    দাদা বৌদি মিলে আর একটা কাজ করেছে। আমাকে লিখতে বারণ করেছে। এনে দিয়েছে একটা মোবাইলের মত দেখতে টেপ রেকর্ডার। আমার যখন ইচ্ছে হয় ওটা অন করে কথা বলি; মানে নিজের স্মৃতিতে যা আছে তা উল্টে পাল্টে দেখি।
    বৌদি কথা দিয়েছে যে শেষে ওগুলো নিজে একটা খাতায় লিখে যত্ন করে রেখে দেবে। শেষে কোন একজন কমরেড এসে নিয়ে যাবে।
    আমি নিজের জীবনকে দেখছি যেন ডিরেক্টর বা এডিটর রাশ প্রিম্ট মনিটরে দেখছে,-- ব্যাক করে , ফরওয়ার্ড করে । আর কক্খনও কখনো পজ বাটন টিপে। ওদের মতই কড়া চোখে নিজেকে দেখি। ভুল ঠিক নয়, কোন অনুশোচনা নয়-- শুধু নেড়েচেড়ে দেখা জীবনটা অন্যরকম হতে পারত কী না !

    সেই যে স্কুল লাইব্রেরির বই পোড়াতে গেছলাম। প্রণব স্যার অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। --
    তুমি, তুমি অলক? তুমি রবীন্দ্ররচনাবলী মাটিতে ছুঁড়ে ফেললে!
    -- হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? উনি আপনাদের ঠাকুরঘরের পুতুল, কিন্তু আমার চোখে উনি শিলাইদহের জমিদার নন্দন। কড়া হাতে পাবনার কৃষক বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।
    --আর 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটা?
    --ওটা সেই অপরাধবোধ থেকে লেখা। দুর্ভিক্ষের সময় চাষীদের খাজনা মাপ করেছিলেন কি?
    ততক্ষণে হরি আর শ্যাম গোটা দুই খন্ড ছিঁড়ে তাতে দেশলাই ধরাচ্ছে। রবীনবাবু স্যার ফ্যাকাশে মুখে স্টাফ রুম থেকে চলে গেলেন।
    ভোলা আর ন্যাপলার রুস্তমী হাঁক! পুরো ওপরের তলা ফাঁকা।
    কিন্তু প্রণবস্যার হাল ছাড়েন নি।
    --শোন, অলক! তুমিতো প্রশ্ন কবিতাটা চমৎকার আবৃত্তি করতে। আর শ্রীবিদ্যাসাগর নাটকটা? সব ভুলে গেলে?
    -- আপনারা আমাদের সব সত্যি কথা শেখান নি স্যার। স্কুলের বইগুলো মিথ্যে কথায় ভর্তি। ওই বিদ্যেসাগর যে ব্যারাকপুরের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ওঁর মেট্রোপলিটান স্কুল বিল্ডিংয়ে গোরা পল্টনদের থাকতে দিয়েছিলেন সেটা কখনও কোন ইতিহাস বইয়ে লেখা হয়েছে?
    ---- অলক, আজ তুমি বড় উত্তেজিত হয়ে আছ। মনের এই অবস্থায় মতাদর্শগত বিতর্ক চলে না। বলি কি--আজ বরং তুমি বাড়ি যাও। ভাল করে ভেবে কাল আমার সঙ্গে কথা বল।
    আমার বেশ অসুবিধে হচ্ছে। সঙ্গের চ্যাংড়া ছেলেগুলো হাঁ করে স্যারের কথা গিলছে। আর বেশিক্ষণ এরকম চললে মুশকিল হবে। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। শশাংক বলেছেন-- এই সময়ে সমস্ত স্কুলে ছাত্র যুবদের এই প্রতিক্রিয়াশীল সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধামাধরা মতাদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালাতে হবে। এই আইকনগুলোকে ভাঙতে হবে। মার্ক্স কি ম্যানিফেস্টোর ভূমিকাতেই বলেন নি যে কোন কিছুই আর অনঢ় অটল পবিত্র বলে থাকবে না। সব ধ্বংস হয়ে যাবে।সমস্ত ট্র্যাডিশন আর সেকেলে ধ্যান -ধারণা এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে?
    আর চারুদা কথা দিয়েছেন -- এই বছর গরমের ছুটিতে ছাত্র ও যুবশক্তি তাদের কাজটি সম্পূর্ণ করলে বাংলার বিস্তীর্ণ সমতল দিয়ে গণমুক্তি ফৌজ মার্চ করে যাবে!
    ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।
    আর তো মাত্র একটা দুটো বছর। তারপর সেই গণমুক্তি ফৌজে আমিও নিশ্চয়ই একটা কম্যান্ডার হব। আমার ইচ্ছে পলিটিক্যাল কমিশার হওয়ার। কিন্তু সে ভারী কঠিন । অনেক পড়াশুনো করতে হবে। অ্যান্টি-ড্যুরিং আর ডায়লেক্টিস অফ নেচার গুলে খেতে হবে। বড় কঠিন ইংরেজি। স্তালিনের "দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ" পড়েছি। খুব একটা বুঝি নি, আর ওঁর "লেনিনবাদের ভিত্তি" ও "লেনিনবাদের সমস্যা" কিরকম আঁতলেমি লেগেছিল। বেড়ে লেগেছে মাওয়ের ' অন ক্ন্ট্রাডিকশন" আর " অন প্র্যাকটিস"।
    সে যাক গে, আমি প্ল্যাটুন কমান্ডার তো হতেই পারি,, অন্ততঃ একটা মিলিশিয়া কম্যান্ডার। পরে না হয় গণমুক্তি ফৌজে যোগ দেওয়া যাবে।
    মিলিশিয়া হলে নাকতলা-টালিগঞ্জ এলাকাতেই থাকা যাবে। গণমুক্তি ফৌজে গেলে তো কেন্দ্রীয় কম্যান্ডের আধীন, অন্য রাজ্যে যেতে হতে পারে।
    ততদিনে জি বিকে কনভিন্স করে সঙ্গে নিয়ে যাব। জি বি মানে গৌরী বোস, শ্যামলা রঙের মিষ্টি দেখতে। আচ্ছা, কালো মেয়েদের নাম কেন গৌরী হয়? আর ফরসাদের কৃষ্ণা?
    সেসব প্রশ্নের মীমাংসা পরে হবে। আপাততঃ আমি নাকতলা ইউনিটের ছাত্রদের কম্যান্ডার। আমার নয়া শোধনবাদী সিপিএম মাস্টারমশাই প্র্রণবস্যারের কথায় আমি যদি অ্যাকশন বন্ধ করে ফিরে যাই তাহলেই হয়েছে!
    উনি আমায় ভালবাসেন? স্নেহ করেন? ফালতু কথা। আজ উনি বিপ্লবের পথে বাধা, শ্রেণীশত্রু।
    শ্রেণীশত্রুর আবার কিসের ভালবাসা?
    চেষ্টা করে চোয়াল শক্ত করলাম।
    --স্যার, আপনিই বরং চলে যান। আমাদের কাজটা পুরো করতে দিন, আপনার সম্মান রক্ষার দায় আমার নয়।

    দেশলাই জ্বালালাম।
    সাদাদাড়ি রবীন্দ্রনাথ, ফ্রকপরা আন্না তড়খড়ে ( নলিনী) ও মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক বঙ্কিম একসঙ্গে পুড়তে লাগলেন। তাতে যোগ হল সীতার বনবাস ও প্রভাবতী সম্ভাষণ।
  • ranjan roy | 192.69.76.251 | ০৩ জুন ২০১৬ ১১:০৫678516
  • -- রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যেসাগর আর বঙ্কিম পোড়াতে কষ্ট হয় নি? মন থেকে করেছিলে ?
    -- সত্যি কথা বলতে কি, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছল। রাত্তিরে ঘুম হয় নি। আজও তার জন্যে একটা কাঁটা বিঁধে আছে।
    --- তাহলে কেন করলে? আদেশ পালন? পার্টির প্রতি আনুগত্য?
    --- ধর, খানিকটা তাই।
    --- খানিকটা মানে? বাবার সব কথা মেনেছিলে? তাহলে তো সময়মত পড়াশুনো করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতে! যার নিজের বাবার প্রতি আনুগত্য নেই , সে পার্টির অচেনা এক বুড়োর নামে আনুগত্য মারাচ্ছে!
    --- আরে তখন ভাবতাম দেশে একটা যুদ্ধাবস্থা চলছে। আমরা রণক্ষেত্রে আছি। সেখানে বেশি প্রশ্ন করলে মুশকিল। ধর, প্রত্যেক সৈনিক যদি লড়াইয়ের সময় গুলি চালানোর আদেশ বা ম্যানুভারিং এর ইস্যু নিয়ে বিতর্ক শুরু করে তাহলে তো দুশমন মেরে উড়িয়ে দেবে শুধু নয়, ওয়াক ওভার পাবে। তবে যতগুলো কাজ নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে করেছি তার জন্যে কাঁটা খচ খচ করে আজও।
    -- আর পরীক্ষা বয়কট? এদিকে ৭১ না ৭২ এ স্টেটসম্যান পত্রিকায় বড় করে বেরিয়েছিল যে শিলিগুড়িতে চারু মজুমদারের মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে আর ওনার স্ত্রী লীলা মজুমদার নিজে অন্য গার্জেনদের সঙ্গে বাইরে দাঁড়িয়ে। তাহলেই দেখ--তোমার মত ফুট সোলজাররা অনেকেই বার খেয়ে ক্ষুদিরাম।
    -- ওঃ শালা, আবার এসেছিস? এইসব ফালতু কোশ্চেন করার জন্যে?
    চারুদা চারুদা, ওনার মেয়ে ওনার মেয়ে। দুটো আলাদা সত্ত্বা। মেয়ে -বৌ বিপ্লবীদের পথেই চলবে এমন কোন কথা আছে? বা সব সন্তানই বাবার ক্লোন হবে? তাহলে ঢাকার বারুদী গ্রামের জ্যোতি বসু লোকনাথ বাবার শিষ্য হতেন বা চন্দন বসু শিল্পপতি না হয়ে শ্রমিক নেতা।
    -- ওসব বাতেলা ছাড়! পরীক্ষা নিয়ে তোমার মনে কোন কাঁটা নেই?
    --- এতদিন পরে এসব কথা তুলে কী লাভ?
    হ্যাঁ; আছে বই কি। সেই ১৯৭০ এর মার্চ। টালিগঞ্জ ইউনিটে নতুন এসেছেন সুকুমারদা। উনি প্রথম যৌবনে আর সিপিআই করতেন। সেই পান্নালাল দাশগুপ্তের দমদম--বসিরহাট আর্মড ইনসারেকশন প্রোগ্রামে উনিও সক্রিয় ছিলেন। একস্প্লোসিভ এক্সপার্ট।জেল খেটেছেন। পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।
    এতদিন পরে উনি সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন। সোজা টেকনিক্যাল কোরের দায়িত্বে। আমি ওঁর চ্যালা হয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে খাল পেরিয়ে ব্রহ্মপুরের কাছে রেনিয়া বুড়িয়া এইসব গ্রামে গেলাম। মাটির দেওয়াল আর খোড়ো ঘরের মধ্যে পুরো আর্সেনাল! বিরাট কর্মকান্ড। ওঁর ট্রেনিংয়ে কিছু ছেলে আর গাঁয়ের লোক মিলে তৈরি করছে মর্টার আর গোলাবারুদ। এক অমাবস্যার রাত্তিরে এমনি একটা দেহাতি ছোট কামানে ভরে একটি গোলা টেস্ট ফায়ার করা হল।
    অন্ধকার চিরে শাঁ শাঁ করে দূর আকাশে ছুটে যাচ্ছে একটি অগ্নিগোলক। আমি মুগ্ধ, আমি রোমাঞ্চিত। বললাম হাতে কলমে আপনার কাছে কাজ শিখব।
    উনি আমার দ্রোণাচার্য। ভালই চলছিল।
    এদিকে স্কুলে বোর্ড পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড এসে গেছে। আমি নিতে গেলাম না। কী হবে পরীক্ষায় বসে?
    পনের দিন পর । সুকুমারদার শরীর খারাপ। বাড়িতে যেতে খবর পাঠিয়েচেন। কোন গোপন খবর আছে।
    দোতলায় দুটো ভাড়ার ঘর। ভেতর থেকে রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে।
    কড়া নাড়তে যে দরজা খুলে দিল তাকে দেখে আমি অবাক! সৌম্যেন! আমার সঙ্গে ক্লাস ইলেভেন এ পড়ে! ও এখানে কী করছে? সুকুমারদা ঘর চালাতে টিউশন করেন নাকি?
    ও আমাকে দেখে ততটাই অবাক,
    -- তুই!!
    -- সুকুমারদা আছেন? ওর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
    -- বাবা তো বাথরুমে, এক্ষুণি বেরোবে। তুই ভেতরে আয়। এই চেয়ারটায় ভাল করে বোস।
    ইতিমধ্যে সুকুমারদা বেরিয়ে এসেছেন।
    -- আরে অলক , এসে গেছ। ভাল হয়েছে। কিছু ডকুমেন্ট তোমাকে একজায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।
    তারপর ওঁর চোখ গেল সুকুমারের দিকে।
    -- তুমি এখানে কী করছ? যাও, ভেতরের ঘরে গিয়ে পড়তে বস। বোর্ড পরীক্ষার আর দু'সপ্তাহ বাকি।
    -- না বাবা, আসলে অলক আমার সঙ্গে একই সেকশনে নাকতলা স্কুলে পড়ে, তাই--!
    -- ঠিক আছে, অলক আমার কমরেড। তুমি গিয়ে পড়ায় মন দাও।
    উনি অনেক কথা বলছিলেন।কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। শেষে ওঁর দাওয়া কিছু কাগজ জামার তলায় লুকিয়ে চলে এলাম।
    রেনিয়া বুড়িয়া গ্রামের কর্মশালায় আর যাইনি।
  • d | 144.159.168.72 | ০৩ জুন ২০১৬ ১৩:৩৩678517
  • পড়ছি
  • ranjan roy | 192.69.65.72 | ০৭ জুন ২০১৬ ২০:৫৮678518
  • ৭)
    --সব তো হল। বোমা বাঁধা, কামানের গোলা, এক ঘুসিতে একটা ছেলের ঠোঁট ফাটিয়ে দেওয়া, বই পোড়ানো , স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নেওয়া; আর কিছু বলার নেই?
    --- কিচ্ছু না। খালি ঘুমুতে চাই।
    -- ও বাবা! হটাৎ এ বৈরাগ্য? সন্ন্যাস নেবে নাকি? নাকি জনগণকে তোমাদের বালখিল্য বিপ্লবের ব্যথর্তার জন্যে দোষ দিচ্ছ?
    --- না, না! আমরাই জনগণকে মোবিলাইজ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
    -- যাক্‌, বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পায় নি! তোমাদের সেই নেতার মত জনগণকে শুয়োরের বাচ্ছা বল নি তাই রক্ষে!
    -- সে আবার কি?
    --- সত্যি মিথ্যে জানি না। তোমাদের ভাঙাহাটের এক নেতা ছিলেন মহাদেব মুখার্জি। সত্তরের দশকের শেষে উনি নিজেকে চারু মজুমদারের ও লিন পিয়াওয়ের ভাবশিষ্য বলে প্রচার করতেন শুনেছি।
    কুলোকে বলে-- শেষজীবনের হতাশায় উনি বিপ্লব থেকে সন্ন্যাস নেওয়ার আগে নাকি বলেছিলেনঃ
    শুয়োরের বাচ্চা জনগণ,
    বছর বছর নির্বাচন?
    রইল তোদের নির্বাচন,
    আমি চল্লেম বৃন্দাবন।
    -- অত খ্যা-খ্যা করে হাসার কিছু হয় নি। বেড়ালে অমন করে হাসে না। লাইনে এস। আজ কী কেস?
    --- বলছিলাম যে তোমার দাদা বৌদি যাই ভাবুন গে, তুমি তো বুঝতে পারছ?
    --হ্যাঁ হ্যাঁ, অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার দরকার নেই। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসছে, এই তো?
    -- তুমি বুদ্ধিমান!
    -- তা জানি না; তবে গান্ডু নই,অন্ততঃ জনগণকে মানুষ ভাবি, জানোয়ার নয়।
    --- ধ্যাৎ, সব্সময় এত লড়াইক্ষ্যাপা হয়ে থাক কেন?
    --- চুপ বে! কোন্‌ শালা শখ করে মরতে চায়? যে বলে সে মিথ্যে কথা বলে।
    --- শখ নেই? তো গেছলে কেন মরতে বিপ্লব মারাতে?
    --- মরতে নয়, বাঁচতে। আরও ভাল করে।
    -- তো বেশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকটা সত্যি কথা বলে যাও। যেটা বলতে তোমার অহংকারে লাগে।
    --- কী?
    --নারী।
    --- নারী? মানে মহিলা? মেয়েমানুষ? এটা কী গাঁড়্মাজাখি হচ্ছে!
    -- লাইনে আসছ। তোমাদের আরেক খিস্তিবাজ কবি লিখে গেছেন না? বের্টল্ট ব্রেখট!
    --- শালা! বেড়ালে আজ ব্রেখটের কোবতে শোনাবে? এই দিনও দেখতে হল?

    --- আঃ ! চুপ করে শোন দিকি!
    " এই তো দেখুন ফাঁসির আসামী দাঁড়িয়ে,
    লোকটা তো যাবে জীবনের মায়া ছাড়িয়ে,
    সামনে মরণ বাড়িয়ে চরণ থমকে,
    তবুও তাহার বুকের রক্ত গমকে।
    কারণ কী তার?-মেয়েমানুষ।"
    এবার ন্যাকামি না করে মুখ খোল।

    --- শোন। এই মুহুর্তে আমার জীবনে একজনই নারী বা মহিলা। মেয়েমানুষ বলতে আমার বাঁধে। উনি হচ্ছেন শ্রীমা। পন্ডিচেরীর। উনি রোজ রাতে আমার বিছানার কাছে এসে টুল টেনে বসেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমার সব ব্যথা চলে যায়।
    দেখছ না, আমার কষ্ট কত কমে গেছে। আমি আবার কথা বলতে পারছি। আমার সব অবিশ্বাস চলে গেছে। জানি আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু আমার কোন ভয় নেই। শেষ চৌকাঠটা পেরোনোর সময় উনি নিজে এসে হাত ধরে আমাকে ওনার বাড়ি মানে ভবনে নিয়ে যাবেন।

    -- তোমার কি ভর টর হচ্ছে নাকি? রোজ রাত্তিরে তো একজন মহিলা নার্স রেখে দেওয়া হয়েছে।বয়স্ক অভিজ্ঞ মহিলা। উনিই তো এসে টুলে বসেন। ওষুধ খাওয়ান, ড্রিপ চালিয়ে দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
    -- ছাই বুঝেছ। বেড়ালের আর কত বুদ্ধি হবে! তখন শ্রীমা ওঁর রূপ ধরে আসেন। উনি যা করেন তা কোন সাধারণ নার্স করতে পারে না।
    গত শনিবারের রাত। আমার সারাদিন পেচ্ছাপ হয় নি। লিকুইড খেয়ে খেয়ে তলপেটে প্রচন্ড চাপ। কত চেষ্টা করা হল, কিছুই হল না। ব্লাডার ফেটে যাচ্ছে। রাত সাড়ে দশটা। অসহ্য ব্যথায় চিৎকার করছিলাম। দাদাবৌদি দৌড়ে এলেন। ভাবছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
    কিন্তু উনি বল্লেন-- আপনারা শুতে যান।কিচ্ছু ভাববেন না। আমি আইস ব্যাগ আর হটব্যাগ দিয়ে পালা করে তলপেটে সেঁক দিয়ে দিচ্ছি, পেচ্ছাপ হয়ে যাবে।
    তাই হল। মা যেমন করে ছোট বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে পেচ্ছাপ করায়, উনি তেমনি যত্ন করে--। খানিকক্ষণ পরে আমি ওঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
  • Ranjan Roy | ২৮ জুন ২০১৬ ০১:১২678519
  • ৮)
    আজ চিত্রা এসেছিল। কতদিন পরে। সম্ভবতঃ ও বৌদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং আমার সব খবরাখবর নিচ্ছে।
    খুব খুশি খুশি মুখে ঢুকল।
    -- খুব ভালো দেখাচ্ছে অলক। দিব্যি সেরে উঠছ।
    -- মায়ের দয়া!
    মুহুর্তে ওর মুখের ভূগোল বদলে গেল।
    --এখনও এত অহংকার অলক? শ্রীমার লকেট ও প্রার্থনার শক্তি তো দেখলে। তারপরেও এত ব্যঙ্গবিদ্রূপ!
    --না, না সত্যি বলছি। কোন ইয়ার্কি না। শ্রীমা রোজ রাত্রে আমার কাছে আসেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন; ব্যথা চলে যায়।
    ওর মুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।
    -- লক্ষ্মীছেলে!
    বলে আমার গালে আলতো করে চুমু খায়। আমি চমকে উঠি। ওর শরীর থেকে চেনা সাবান ও বডি লোশনের গন্ধ আমার মন খারাপ করে দেয়। আমি হাত চেপে ধরি। ও ছাড়িয়ে নেয় না। শরীরের ছোঁয়ায় কি যে আনন্দ! বেঁচে থাকা কত সম্ভাবনাময়। কিন্তু আমি কি সেরে উঠবো?
    -- একটা কথা বলছি, একটু স্বার্থপরের মত।
    --বল।
    -- তুমি আজ অনেকক্ষণ থাকবে? মানে অনেক অনেকক্ষণ? অনেক কথা বলার আছে যে!
    ওর চেহারায় কি একটা মেঘের ছায়া? আমাকে এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ দেখে বলল--ঠিক আছে।
    এই সময় বৌদি ওর জন্যে চা নিয়ে ঢুকল। বলল- চিত্রা, ইচ্ছে করলে আজ রাত্তিরে থেকে যাও; কোন অসুবিধে নেই।
    -- আমার যে অন্য কাজ আছে বৌদি। ঠিক আছে সন্ধ্যে নাগাদ যাব'খন। অলক, বেশি কথা বল না। আমি বলি, তুমি খালি শোন।
    --- আবার বিয়ে করলে না কেন?
    -- সব কিছু সবার জন্যে নয়। এটা যেই বুঝতে পারলাম, ইচ্ছেটা চলে গেল। আমার নিজের প্রফেশনাল কাজ ছাড়াও অরবিন্দ আশ্রমের কাজে সময় দিই; মনটা ভাল থাকে।
    --- খালি মন আর মন! তোমার শরীর নাই চিত্রা?
    ও হেসে ওঠে। এই তো সেই পুরনো আগমার্কা অলক যে শরীর বাদ দিয়ে কোন মন বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাহলে তুমি সত্যি সত্যি সেরে উঠছ।
    --হ্যাঁ, তোমার ছোঁয়ায় আমার শরীর জেগে উঠছে, মানে সেরে যাচ্ছে।
    ও কপট রাগ দেখিয়ে বিছানা থেকে উঠে একটা টুলে গিয়ে বসে।
    -- শোন চিত্রা; রোজ একটা বেড়াল এসে বড্ড জ্বালায়। ওকে আর সহ্য করতে পারছি না। নানান হ্যানত্যান প্রশ্ন করে। তারচেয়ে তুমি এই রেকর্ডিং মেশিনটা অন করে কাছে বস। আমার কিছু স্বীকারোক্তি আছে। ওগুলো যত্ন করে ধরে রাখতে হবে।
    -- কী দরকার! ওসব ভুলে গেলেই ভাল নয়?
    -- না, না! আমার এই ফালতু জীবনেরও কিছু গল্প আছে। যেমন চাঁদের পাহাড়ের গল্পে পথ হারিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী গুহার দেওয়ালে কিছু খুদে লিখে যায়--খানিকটা সেরকম।
    বৌদিরা এসব থেকে লিখে একটা ডায়েরিতে তুলবে। তুমি কথা দাও আমি চলে গেলে সেটা তুমি একজনের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে? এই দায়িত্বটা আমি শুধু তোমাকে দিতে চাই, তুমি আমার এককালের কমরেড। বল?
    -- কী সব অলুক্ষুণে কথা! তুমি সেরে উঠছ, সেটা বিশ্বাস কর।
    --শোন চিত্রা। মায়ের দয়ায় আমি শান্তি পেয়েছি; ব্যথা চলে গেছে। কিন্তু দুদিন ধরে রোজ রাত্তিরে জ্বর আসছে। প্যারাসিটামলেও নামছে না। বৌদি জানে না। আমি বুঝতে পারছি, মা ডাকছেন, কোলে তুলে নেবেন বলে।
    চিত্রা ফুঁপিয়ে ওঠে।
    কাছে এসে আমার কব্জি ধরে নাড়ি দেখতে থাকে। তারপর একটি গ্লাসে ডেটল জলে ডোবানো থার্মোমিটার তুলে নিয়ে আমর মুখে গুঁজে দেয়।
  • Ranjan Roy | ২৯ জুন ২০১৬ ২১:০৮678520
  • ৯)
    অলকের অসমাপ্ত ডায়েরির শেষ কয়েক পাতা
    ===========================
    চিত্রা,
    আমি আমার শেষ দেখতে পাচ্ছি। তাই কয়েকটা কথা বলতে চাই।
    ওই কালো বেড়ালটা আর আসছে না। বাঁচা গেছে।
    তোমার আমার কোন আইন মেনে ডিভোর্স হয় নি--আজও তুমি আমার বৈধ স্ত্রী। আমার শরীরের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার তোমার। তাই বলছি কোন শ্মশান ক্রিয়া করতে হবে না। শ্রাদ্ধের দরকার নেই। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আমি জন্মেছিলাম। বডি সেখানেই দিয়ে দিও। আমি উপর থেকে কিছুই দেখতে পাব না, কিন্তু কাউকে ফাঁকি দেওয়া তোমার স্বভাবে নেই-- এটুকু ভাল করে জানি।
    কিছু আফশোস রয়ে গেছে। আমি ভাল স্বামী বা ভাল বাবা কোনটাই হতে পারি নি। পারলে ক্ষমা করে দিও।
    এই সময়ে আমার অকিঞ্চিৎকর গোটা জীবনটা বেশ দেখতে পাচ্ছি, অনেকটা যেন পুরনো সিনেমার মত।
    তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না, অত স্যাডিস্টিক নই। কিন্তু দুজনের কথা না বললেই নয়। আচ্ছা, চুপ করে থাকলে কি কিছু এসে যেত? কিচ্ছু না। আসলে এই সময় মাথায় কনফেশনের ভূত চাগিয়ে ওঠে।
    এই দুজন হল গৌরী বোস ও কোন এক মেজদি। দুটো গল্প? না, না; দুজনে মিলে একটাই গল্প। কেন তোমাকে বলতে চাইছি?
    শুনলে বুঝবে যে আমার মনে বরাবর মেয়েদের নিয়ে একটা অপরাধ বোধ কাজ করেছে। তাই বোধ হয় ভাল হাজব্যান্ড হতে পারি নি। হয়ত আমাকে মাপ করা একটু সহজ হবে।

    গৌরী বোস নাকতলার মেয়ে, ওর বাবা একজন এল এম এফ ডাক্তার। গৌরী ওদের বেশি বয়সের আদুরে মেয়ে। আমি যখন ইলেভেনে উঠলাম তখন এ'পাড়ায় প্রথম টিউটোরিয়ল শুরু হল, আজকের ভাষায় কোচিং ক্লাস। সেখানেই ওর সাথে আলাপ।
    সেই যে আমি স্কুলে স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়ে দু'টুকরো হয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, জানতাম না যে গল্পটা কাছাকাছি সবগুলো স্কুলে ছড়িয়ে গিয়েছিল, মায় নকতলা আর বাঁশদ্রোণীর মেয়েদের স্কুলেও।
    যা হয় আর কি, অনেকেই আমাকে অন্য নজরে দেখত, শুধু আমি জানতাম না। আমার আদর্শ তখন প্রায় আনন্দমঠের সন্তানদলের মত। ভাবতাম মেয়েরা বিপ্লবীদের দুর্বল করে দেয়। অনেক বিপ্লবী শুধু তাদের মা বা প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে পড়েছেন। কাজেই মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাথমিক ব্যবহার বেশ রূঢ়, প্রায় অভদ্র গোছের হত।
    খেয়াল কর, তোমার আমার পরিচয়ও ছত্তিশগড়ের কলেজে গুণ্ড্গর্দির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আন্দোলন থেকেই হয়েছিল। আমরা কমরেড হলাম।
    কোথায় যেন নারী ও আন্দোলন আমার জীবনে একসঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
    যাকগে, শ্যামলা রঙের ছোটখাট দীঘল চোখের মেয়েটির সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেল। সেসব দিনে নাকতলার কিছুটা গ্রামীণ পরিবেশে দুজন ছেলেমেয়ের মধ্যে খোলাখুলি মেলামেশা কথাবার্তা খুব সহজ ছিল না। আমরা দেখা করতাম নাকতলা স্কুলের মাঠে। আমরা জনা চারেক। কথা হত, আড্ডা হত; একদিন ও বলল-- আচ্ছা, তোমার কি আন্দোলন, বিপ্লব, ভিয়েতেনাম, কালচারাল রেভোলুশন ছাড়া অন্য কোন কথা নেই?
    অন্যেরা হেসে উঠল। আমি খুব রেগে গেলাম।
    -- আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হলে এগুলো বাদ দিলে চলবে না।
    ও মেনে নিল। ওকে বই পড়তে দিতাম। নানা ধরণের বই, সত্যি কতদূর পড়েছিল জানতাম না। তবে আমার চারমিনার ফোঁকার পয়সা ওই যোগাত। ছোট্ট পার্স বা রুমালের খুঁট থেকে দুটো দশ পয়সা। একবার বলেছিলাম-- খালি পয়সা দিয়ে যাবি নাকি? তুই ও টান মেরে দ্যাখ!
    ও ধ্যাৎ বলেও আমার কথা মেনে দুটো টান দিয়ে কাশতে কাশতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল-- ভালো লাগে নি।
    --- সত্যি বলছিস? তাহলে আমাকে চুমু খাস কী করে?
    উত্তরে গুমগুম করে ক'টা কিল মেরে বলেছিল-- ধোঁয়া টানতে ভাল লাগেনি। তবে ছেলেদের গায়ে নিকোটিনের গন্ধ বেশ ভাল লাগে।

    একটা সময়ের পর আমি সে সময়ের হিসেবে বেয়াড়া সাহসে ওর বাড়ি যেতে লাগলাম। ওর বাবা গোবেচারা গোছের ভদ্রলোক। খবরের কাগজ হাতে আমার সঙ্গে তর্ক জুড়তেন। বোঝাতে চাইতেন যে স্বাধীন দেশে বিপ্লব-টিপ্লবের কোন দরকার নেই। চেষ্টা করলে এই ব্যব্স্থার মধ্যেও মানুষের জন্যে কিছু ভাল কাজ করা সম্ভব।
    ওর মা আমার সঙ্গে একটা কথাও বলতেন না, শুধু ভেতর থেকে নিয়মিত চা পাঠিয়ে দিতেন।
    আমি উঠি উঠি করে শেষে উঠে পড়লে গৌরী বারান্দা অবদি এসে আমাকে কায়দা করে আঙুল দিয়ে চার বা পাঁচ দেখাত। ওটা আমাদের কোড, মানে ক'টায় স্কুলের মাঠে মিট করতে হবে।
    অন্ধকার নামলে বন্ধুরা মুখ টিপে হেসে চলে যেত। মাঠ খালি হত। অন্ধকার আরও গাঢ় হলে মাঠের মাঝখানে বা স্কুলের বারান্দায় চাঁদের হাট বসত--- জোড়ায় জোড়ায় উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। ধীরে ধীরে কথা বন্ধ হয়ে যেত, শরীর বেজে উঠত।

    একদিন ও এসে বলল-- পড়তে পড়তে কানে এল বাবা মাকে বলছে ' অলক ছেলেটা ভালই, স্বভাব চরিত্র বা যাই বল। কিন্তু পড়াশুনো করে কই? খালি রাজনীতির খই ফুটছে। এর কি কোন ভবিষ্যৎ আছে?
    তখন দুটো ঘটনা ঘটেছিল।
  • Ranjan Roy | ৩০ জুন ২০১৬ ১৭:৪৫678521
  • খবর এল বিজয়গড়ের কংগ্রেসি গুন্ডাদের ঠেক ডেমোক্র্যাসি ক্লাবের সঙ্গে হিন্টু লিন্টু বলে দুভাইয়ের ভালো ঝাড়পিট হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল একজন নকশাল তো অন্য জন সিপিএম।
    লোক্যাল ইউনিটে কথা হয়ে গেল যে চারদিকের বাম এলাকার মধ্যে ওই মোড়ে কংগ্রেসিদের মুক্তাঞ্চল অনেকদিন ধরে টিকে আছে, ইদানীং এরিয়া বাড়াচ্ছে। এবার ঘুঘুর বাসা না ভাঙলেই নয়। আর ওখানে একা ঢোকা কঠিন। সিপিএম ও নকশাল গ্রুপ দুদিক থেকে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ওই এলাকা দখল করবে, ক্লাবঘর ভেঙে দেওয়া হবে।
    আমার ছোট্ট ইউনিটের উপর দায়িত্ব বর্তাল চারদিনে গোটা কুড়ি লালসাদা পেটো সাপ্লাই দেওয়া। মশলা এসে গেল। আজকে চারটে স্যাম্পল বানিয়ে টেস্ট করতে হবে।
    সন্ধ্যে ছ'টার আধো অন্ধকার। আমরা চারজন হাজির অরবিন্দনগরের পেছনের বাঁশঝাড়ের কোণায়।
    এদিকটায় লোকজনের যাতায়াত নেই। কখনও কিছু ভাম খটাশ জাতীয় জন্তু চোখে পড়ে আর দু একটা সাপখোপ। প্রথম মালটা আমিই চার্জ করলাম। প্রচন্ড শব্দে ফাটল; বাঁশের ঝাড়ের আশপাশ থেকে কিছু কাক বা অন্য কোন পাখির ঝাঁক শব্দ করে উড়ে গেল। ন্যাপলা হাততালি দিয়ে উঠল।
    পরেরটা তাপস চার্জ করল আর কড়কড়াৎ শব্দের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই শোনা গেল একটা আর্ত চিৎকার, কোন মেয়ের গলায়।
    ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা ! কেউ আহত হয়েছে? কোন মেয়ে? কেন মরতে এই সময়ে এই অস্থানে কুস্থানে কেউ আসে?
    কিছু না ভেবেই দৌড়ে গেছি আর সামনের বটগাছের পেছনেই চোখে পড়ল একটা বডি, সাদা খোলের শাড়ি--নিঃস্পন্দ; নড়ছে না। স্প্লিন্টার কোথায় লেগেছে? কিন্তু এই টেস্টিং এর মালগুলোতে পাথরকুচি গোছের সামান্য কিছু নিরীহ স্প্লিন্টারই দেওয়া হয়। বেজায়গায় না বিঁধলে তেমন ভয়ের কারণ নেই।
    কাছে গিয়ে বডিটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসি আর ওকে ধরে উল্টে দেই। আরে, এ তো গৌরী! এ আমি কী করলাম?
    দুহাতে তুলে নিই ওর শরীর; বুকে জড়িয়ে ঝাঁকাতে থাকি।
    সোনামণি! তোর কী হয়েছে? কেন মরতে এখানে এসেছিলি? চোখ খোল, কোথায় লেগেছে বল। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যাব।
    গৌরী আসতে আসতে চোখ খোলে।
    না; স্প্লিন্টার লাগে নি। শুধু ভয়ে সাময়িক অজ্ঞান হয়ে গেছ্ল।
    গোটা ব্যাপারটার জন্যে আমিই দায়ী। ওকে বলেছিলাম যে আজকে ওই বাঁশবাগানে মাল টেস্ট করব। তাই আজ বিকেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারব না। ও চুপ করেছিল। মনে মনে জেদ চেপে গেছল যে মেয়েদের কেন বাদ দেওয়া হবে! আর মাল চার্জের টেস্টিং? নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে।
    -- হল তো? শখ মিটেছে? এবার বাড়ি চল। তোর পা কাঁপছে। হাত ধর।
    বাকি তিনবন্ধুদের বলি ঠেকে গিয়ে রিপোর্ট করতে --টেস্টিং সাকসেসফুল। তিনদিন পরে কুড়িটা পেটো ডেলিভারি দেওয়া যাবে। শুধু বিজয়গড় ইউনিটের লোক এসে নিয়ে যাক, এয়ারব্যাগ নিয়ে আসুক। আমরা ডেলিভারি দিতে ওপাড়ায় যাব না।

    আমরা দুজন অন্ধকারে হাতধরে হাঁটতে থাকি। একটু পরে ও হাত ছাড়িয়ে নেয়--বাড়ি এসে গেছে। বাগানের ছোট আগলটা খোলার আগে ও আমাকে বলে--একটু দাঁড়া। তুই কি জানিস যে তুই আজকে আমাকে একটা সুইট নাম দিয়েছিস?
    -- কখন আবার নাম দিলাম?
    -- সেই যে মাটিতে পড়া অবস্থায় ঝাঁকাচ্ছিলি? সোনামণি! এস এম!
    এবার ও ফিক করে হেসে ভেতরে চলে যায়।
  • ranjan roy | 132.162.125.198 | ২২ জুলাই ২০১৬ ২০:১৬678522
  • ১০)
    আচ্ছা, মর‌্যালিস্ট শব্দটা গালি কেন হবে?
    বিপ্লবীরা কেন এসেন্শিয়ালি মর‌্যালিস্ট হবে না? আরে মানুষের মনে বিপ্লবের আবেদন ঠিক কোন জায়গায়? একটা নৈতিক ভিত্তিতে নাড়া দেওয়া--তাই নয় কি?
    তাপস বলল--আসল ব্যাপারটা হল ক্ষমতা দখল করা।
    ধ্যেৎ, তাহলে আর চম্বলের ডাকাত আর আমাদের মধ্যে তফাৎ রইল কোথায়? বংকিম আনন্দমঠে ঠিক জায়গাটা ধরেছিলেন, তাই ভবানন্দকে মরতে হল।
    তাই নাকতলার মোড়ে নড়ার দোকানে নিরোধ নামে একটি পনের পয়সায় তিনটে বিক্রির বিরুদ্ধে অ্যাকশন করব ঠিক করেছিলাম। আমরা ইয়াং ছেলেমেয়েদের একটা গ্রুপ গিয়ে ওর দোকানের যে কয়টা বিক্রির জন্যে আছে সেগুলো নষ্ট করে দেব। টাঙানো বিজ্ঞাপনগুলো ছিঁড়ে ফেলব। তারপর সেখানে একটা স্ট্রিট কর্নার মিটিং করে লোকজনকে বোঝাব যে এইসব নতুন নতুন খেলনা প্রতিক্রিয়াশীল সরকার আমেরিকার ইশারায় বাজারে ছেড়েছে একটিই উদ্দেশ্য নিয়ে-- যুবছাত্রদের বেড়ে চলা বিপ্লবী চেতনাকে পঙ্গু করে দেওয়া।
    সবাই কিন্তু কিন্তু করে সমর্থন জানাল। গৌরী হাত তুলল-- একটা কথা, নড়া আমাদের পরিচিত ছোট দোকানদার। ওর কী দোষ? ও তো শ্রেণীশত্রু নয়। তাই ওর কেন লোকসান হবে? আমরা ওর দোকানে যে সামান্য কয়টা নিরোধ আছে তার দাম দিয়ে দেব। তাহলে আমরা সাধারণ লোকজনের সহানুভূতি পাব আর নরাকে বোঝাব যে ও যেন এসব জিনিস দোকানে না রাখে।
    সবাই সমর্থন করায় গৌরী উৎসাহ পেয়ে আরও বলল-- দেখ, এর একটা প্র্যাকটিক্যাল দিক আছে। আমরা দাম দিয়ে দিলে ও পুলিশে যেতে পারবে না। নইলে পুলিশ ডেকে আমাদের বিরুদ্ধে দোকান লুঠের চার্জ লাগাতে পারে।
    এটা ভাবিনি তো! নাঃ, মেয়েটার বুদ্ধি আছে। আগামী দিনে ভালো গেরিলা হবে।
    --শোন কমরেড্স্‌, আমাদের কাজ হল প্রচার অভিযান, গুন্ডামি নয়। আমরা অ্যাকশানের মধ্যে দিয়ে এইসব যৌনচেতনা নিয়ে সুড়সুড়ি, এইসব নতুন নতুন সেক্স ম্যাগাজিন --মানে "জীবন যৌবন", "সুন্দর জীবন" এগুলির ভেতরের রাজনীতি নিয়ে মানুষকে সচেতন করব।
    গৌরী আবার হাত তুলল।
    --তাহলে ব্যাপারটা এইভাবে হোক। আমরা প্রথমেই ওর দোকানের জিনিসগুলো, মানে কী যেন বলে ওইগুলো সবকটা কিনে নেব, দাম দেব। তারপর ওর দোকানের সামনে ওগুলো পুড়িয়ে দেব আর লোককে বোঝাব। এর জন্যে আমরা সবাই চাঁদা তুলে পয়সা জোগাড় করব।
    আমার কি গৌরীকে একটু একটু হিংসে হচ্ছে? এমন প্ল্যান আমার মাথায় কেন আসেনি?
    ঠিক হল, শনিবার দিন আমরা বিকেল চারটেয় নিজেদের তোলা পয়সা কড়ি নিয়ে নাকতলা স্কুলের মাঠে মিট করব, বিকেল চারটেয়।
    চারটে গড়িয়ে পাঁচট হল, তারপর ছ'টা। কেউ আসেনি। শুধু আমি আর গৌরী। আমি ছটফট করছি। গৌরী হাসছিল। বলছিল-- হবে , হবে সব হবে। অধৈর্য হোস না।
    তারপর হটাৎ বলল-- শোন্‌, একটা কথা আছে। আমি কিন্তু ওইসব নিরোধ পোড়ানো অ্যাকশনে থাকতে পারব না, পয়সা দিয়ে দেব।
    রাগে মাথায় আগুন জ্বলল।
    নিজের অজান্তেই ওর হাতটা কখন মুচড়ে ধরেছি।
    -- তোর পয়সাও চাই না; তোকেও না। সবাই গেছে, তুইও যা।
    --উঃ, ছাড় দিকি, লাগছে।
    আমি লজ্জা পেয়ে ছাড়তেই ও দেখাল জায়গাটা কেমন লালচে হয়ে উঠেছে।
    --শোন, তুই এত লড়াইক্ষ্যাপা কেন? এভাবে চললে তোকে দিয়ে কিস্যু হবে না। ব্যাপারটা বোঝ। আমি প্ল্যানটা মাকে বলেছিলাম। মা বলল প্ল্যানটা ভাল। মা সাপোর্ট করবে। অন্য মাসিমাদের সঙ্গেও সাপোর্টে বলবে। কিন্তু আমার থাকা চলবে না। আমি এখনও স্কুলে পড়ি। নিরোধ আন্দোলন করলে পাড়ায় নানান কথা উঠবে। এটা তোরা ছেলেরাই আগে শুরু কর।
    আমি চুপ। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। ওকে জিগ্যেস করলাম-- কিন্তু বাকি ছেলেগুলো কথা দিয়েও এল না কেন?
    গৌরী ফিক করে হেসে ফেলল-- ওরা আজ আসবে না। ওদের আজ রামগড়ের মাঠে মেজদি ডেকেছে যে!
    মেজদি! সে আবার কে?
    আছে আছে; রামগড়ের দিকে থাকে। এই আমারই বয়সী, বড়লোকের মেয়ে। দেখতে টপ! ওর কথায় রামগড় গাঙ্গুলীবাগান এলাকার শ'খানেক ছেলে ওঠাবসা করে।
    তুই ওদের ডেকেছিস, কিন্তু ঠিক ওই সময়েই মেজদি ডেকেছে যে! ওর ডাক একেবরে নিশির ডাকের মত, যেতেই হবে।
    --আমি বিশ্বাস করি না। আমার কোন কমরেডের ওপর কোন মেয়ের এমন জাদু চলতে পারে না।
    -- বেশ, বিশ্বাস করিস না; আগে বাজিয়ে দেখে নে। সবাইকে আরেকটা ডেট দে। এমন দিবি যেন সেদিন মেজদিও ডাকে। তারপর হাতে পাঁজি মঙ্গলবার।
  • Ranjan Roy | ১৪ আগস্ট ২০১৬ ১৮:০০678523
  • সেই ডেট এল, এক বৃহস্পতিবার।
    সেদিন মহাশিবরাত্রি। সকাল থেকে মেয়ের দল শাড়ি থেকে ফ্রকপরা সবাই দলে দলে হাতে বেলপাতা, দুধের ঘটি নিয়ে নাকতলার শিবমন্দিরে যাচ্ছে, শিবের মাথায় ঢালবে বলে। আর পাড়ার মোড়ে ফচকে ছোঁড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝারি করছে এবং মেয়েদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে-- অতদূরে মন্দিরে গিয়ে লাইন দেওয়ার দরকার কি? শিবপূজো তো এখানেই --।
    মেয়েরাও হাসি চেপে না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছে, বিশেষ করে সঙ্গে মা -কাকিমা থাকলে। কেউ কেউ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠছে-- হ্যাঁ হ্যাঁ, শিবের ষাঁড়গুলোকে এখানেই দেখতে পাচ্ছি।
    এইভাবেই বিকেল এল, --আবার সেই নাকতলা স্কুলের মাঠ, আবার বিকেল চারটে থেকে গড়িয়ে সাড়ে চারটে, শেষে পাঁচটা।
    মাঠে শুধু আমি আর গৌরী; আমি রাগে চিড়বিড় করছি আর ও মুচকি মুচকি হাসছে।
    এবার ও আমার হাত ধরল।
    চল। --আরে কোথায় যাব?
    চলই না; এখানে দাঁড়িয়ে মুখখারাপ করার চেয়ে ভাল হবে।
    আমরা পদ্মশ্রী সিনেমা হল পেরিয়ে দুটো কচুরিপানা ভরা পুকুর ছাড়িয়ে মেঠো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় ফাঁকা মাঠে এসে গেছি।
    না , ঠিক ফাঁকা নয়।
    মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে জনা পনের ইয়ংছেলে; অধিকাংশের পরণে হাফপ্যান্ট, এদের মধ্যে দেখি চারজন আমাকে দেখে ধরণী -দ্বিধা- হও ভঙ্গিতে মুখ লুকোচ্ছে। আমার সেই চার স্যাঙাৎ, যাদের জন্যে এতক্ষণ রোদ্দূরের মধ্যে মাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
    এদের সঙ্গে পরে হিসেব করব।
    আপাততঃ আমার চোখ এদের লীডার দেবী চৌধূরাণীর দিকে। এই তবে মেজদি! যার আদেশে ছেলেরা ওঠে বসে?
    মেয়েটিকে আগে কখনও দেখিনি। পানপাতার মত মুখ, পাঞ্জাবী মেয়েদের মত গড়ন, হাইট প্রায় আমারই কাছাকাছি। মেয়েটিও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
    সবাই চুপ। সবার চোখ আমাদের দুজনের দিকে। আমরাঅ একাগ্র । আমি চোখ নামাব না। দেখি, ও কতদূর যায়?
    -- কী রে গৌরী? এই তোর সেই বয়ফ্রেন্ড? যার কথা এত বলেছিস? এ তো পাতি গুন্ডার মত দেখতে। উঠতি বয়েসের মাস্তান!
    -- ভ্যাট! বাজে বকিস না তো? আয়, তোদের আলাপ করিয়ে দিই। এ হল আমার পুরনো বন্ধু--সুদর্শনা চক্রবর্তী, আমার জামরুল, মানে আমরা জামরুল পাতিয়েছি তো। একেই পাড়ার ছেলেরা মেজদি বলে ডাকে। কেমন দিদি -দিদি ভাব তো, তাই।
    --- আর ও হচ্ছে তোর বয়ফ্রেন্ড অলক, বা তোর ম্যাচো লাভার। যাকে সবাই ভয় পায়?
    --- তুই তো পাস না!
    -- আমি কোন পুরুষকেই ভয় পাই না। খামোকা তোর লাভার কে কেন--
    --- একদম ফালতু কথা বলবেন না!
    ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি গর্জে উঠেছি।
    আমি কারও বয়ফ্রেন্ড বা লাভার নই। আমরা কমরেড ! কমরেড মানে বোঝেন?
    -- কই না তো! এ তো একদম নতুন শব্দ শুনছি। তা আপনি বুঝিয়ে দিন না।
    আমার হাড়-পিত্তি জ্বলে গেল। এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা আমার একেবারে সহ্য হয় না।
    --- লাইনে আসুন। এইসব ছেলেপুলেদের মাথা খাচ্ছেন কেন?
    -- আমি? মাথা খাচ্ছি?
    -- হ্যাঁ, খাচ্ছেন। আপনি আপনার সৌন্দর্য্যের আপনার ব্যক্তিত্বের অপব্যবহার করছেন।
    সুদর্শনা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
    -- তাহলে মানছেন যে আমি দেখতে সুন্দর? আপনার চোখেও?
    --- আমি জানতে চাইছি এইসব জোয়ান ছেলেদের ভেড়া করে রেখেছেন, কেন?
    -- ওরে জামরুল! এ যে বেশ কথা বলে। তা আপনিও আমার ভেড়ার পালের মেম্বার হবেন নাকি? আপনাকেই কম্যান্ডার করে দেব। কী রে জামরুল? ছাড়তে পারবি তো? ভেবে দেখ।
    মেয়েটার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেবার উদগ্র ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলাম।
    --- আবার বলছি, কেন এমনি করছেন? কেন আমার মিটিং এর দিনই ওদের ডেকেছেন?
    -- আমি কি জানি আপনি কবে আপনার দোকানে গিয়ে চোটপাট করা গ্যাং এর মিটিং কবে এবং কোথায় ডাকবেন?
    -- তাহলে এটা কী? কো-ইন্সিডেন্স?
    --- তা কেন হবে? এবারের দিনক্ষণ তো জামরুল ঠিক করে দিয়েছে, মানে আপনার কমরেড গৌরী!
  • Ranjan Roy | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ০৮:৫৩678524
  • এসব কী হচ্ছে! গৌরী আর মেজদি বন্ধু? জামরুল! যত্তো সব গাঁইয়া কারবার! আর সেটা গৌরী লুকিয়েছে।

    --- দেখুন, আমরা সিরিয়াস। আপনাকে বলছি যে যেদিন আমাদের কাজ থাকবে সেদিন আপনি এদের ডাকবেন না। এইটুকু ভদ্রতা নিশ্চয় আশা করতে পারি?
    -- এটা কোন কথা হল? আপনারা বিপ্লব করতে চান? সেটা তো কোন অফিসের চাকরি না যে ক্যালেন্ডার আর ঘড়ি ধরে হবে?
    -- তাহলে আপনি কো-অপারেট করবেন না?
    আমি ছোট এবং সরু চোখে তাকাই।
    --- শুনুন; আমি কিছুই করব না। আপনি আপনার ছেলেদের ভাল করে বোঝান। যদি আপনার কথায় কোন সারবস্তু থাকে তবে ওরা এমনিই আমার কাছে আসবে না।
    -- নইলে বুঝতে হবে কোথাও গোড়ায় গলদ আছে; মানে আপনার বিপ্লবের থিওরিতে।

    এরপর আমাদের কোন অসুবিধে হয় নি।
    নড়ার দোকানের নিরোধ-পোড়ানো হেব্বি সাকসেস হল। অনেক লোকজন খোলাখুলি সমর্থন করলেন। নড়াকে আগেই দাম দিয়ে দেওয়ায় ও খুশি হল। এমনিতেই এইসব জিনিস পানের দোকানে কিনতে লোকে লজ্জা পাচ্ছিল। তাই রেখেও খুব একটা বিক্রি হত না।
    আর এতে দলের মধ্যে আমার ওজন খুব বেড়ে গেল। কথা হল, আগামী বছর আঠেরোয় পা দিলেই আমাকে পার্টি মেম্বারশিপ দিয়ে দেবে। এখন আমি ক্যান্ডিডেট মেম্বার!

    গড়িয়াহাট রোড ধরে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছি হটাৎ পেছন থেকে --শুনছেন? এই যে কমরেড!
    পেছন ফিরে দেখি--মেজদি!
    -- আরে আপনি! আপনাকে যে কী বলে--!
    --- যা দেবার সেটা ফুটপাথে লোকের ভিড় আর ধূলোবালির মধ্যে না দিলে বিপ্লব হবে না?
    মেজদির চোখের হাসিতে এসব কিসের আভাস?
    -- মানে?
    -- আর দশ'পা এগোলেই নির্মলা বলে একটা নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে---সাউথ ইন্ডিয়ান কুইজিন। একটু চেখে দেখবেন নাকি?
    -- হবে না। আমার পকেটের দৌড় কাঠের বেঞ্চিতে বসে কাঁচের গেলাসে ফোটানো চা আর চার্মিনার পর্য্যন্ত।
    --- আহা! ডেকেছি তো আমি,--।
    --- সে হয় না। আপনি পেমেন্ট করবেন আর আমি সাঁটাবো--!
    -- পার্টির হোলটাইমাররা সিমপ্যাথাইজারদের পয়সায় সাঁটায় না?
    -- ফালতু কথা বলবেন না! আমি কোন হোলটাইমার নই, আর আপনিও আমাদের সিমপ্যাথাইজার না।
    -- ও বাবা! আপনার পার্টিকে নিয়ে একটু মজা করতে পারব না? আপনি কি পাগলা জগাই না রামগড়ুরের ছানা?
  • Ranjan Roy | ১৯ আগস্ট ২০১৬ ০৯:১৪678526
  • ১১)
    এরপর ক্যালেন্ডারের তারিখের আর কোন তাত্পর্য্য রইল না।
    ঘটনা ঘটছিল দ্রুতগতিতে। সন্তোষ ও জয়শ্রী রাণা ধরা পড়েছেন। ডেবরা-গোপীব্ল্লভপুরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও কোলকাতায় সিআরপি দাঁতনখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
    নেট ঘিরে কুম্বিং এর সময় পাশের বাড়ির ঢ্যাঙা রবিদা পাঁচিলের ওপর থেকে গলা বাড়িয়ে উঁকি মারায় সিআরপির জাঠ জওয়ানরা পাঁচিল টপকে ঘরে ঢুকে ওকে টেনে বার করে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে বেদম পেটায়। রবিদা রক্তবমি করতে করতে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হয়।
    তারচেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পাড়ায় পাড়ায় সিপিএম-নকশাল সংঘর্ষ।
    ছোটবেলার বন্ধুরা হটাৎ করে শ্রেণীশত্রু জানী দুশমন সব হয়ে গেল। অল্প বয়েসিরা কেউ কাউকে দেখলেই সতর্ক চোখ, পকেটে হাত।
    আমি শ্রীকলোনি পাড়া দিয়ে শর্টকাটে আসছিলাম, একটু পরে দেখি চারজন ছেলে আমার পিছু নিয়েছে।
    চারটের সঙ্গে পারবো না।
    আমাদের এলাকা আসতে এখনও দুশো মিটারের মত পেরোতে হবে। ওরা স্পীড বাড়িয়েছে। কী করি?
    সোজা ঘুরে দাঁড়ালাম। পকেটে হাত -- ওরা দেখতে পায় পকেট ফুলে রয়েছে। আমার মুখে বাঁকা হাসি। ডাকি-- আয়! কাছে আয় ! দেখি তোদের ক্যাপা!
    ওরা এগোয় না। দাঁড়িয়ে যায়। ওরা ভাবছে। আমি নড়ি না। ওরা ভাবছে।
    এবার ওদের একজন এগিয়ে আসতে চায়। অন্যরা ওকে টেনে ধরে।--যাস না; দেখছিস না পকেটে মাল আছে। ওরা আজকাল দানাও রাখে।
    আমি চোখ সরাই না। ওরা পিছিয়ে যায়। আমি শান্ত পায়ে দশ কদম গিয়ে টেনে ছুট লাগাই । ওরা ভপকিটা বুঝতে পেরে গেছে। তাড়া করবে ভাবে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আমাদের এলাকার কাছে এসে গেছি।
    কবাড্ডির এই দানটা আমিই জিতলাম।
  • Ranjan Roy | ২৩ আগস্ট ২০১৬ ১৬:৪২678527
  • হল না। কবাড্ডি খেললেই হয় নাকি? দাবাটাও ভাল করে খেলতে হয়।
    কোথাও কেউ অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দূর থেকে স্ট্র্যাটেজিক চাল দিচ্ছে, যার আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। আমি শুধু সামনের ঢাল-তলোয়ার -বর্ম পরা শত্রুদের দেখছি। সে বয়সে জানতাম শত্রু খালি সামনেই থাকে।

    গত সাতদিন ধরে গৌরী আমাকে এড়িয়ে চলছে। বাড়ি গেলে ওর মা বলেন-কোচিং এ গ্যাছে। মাঠে এক-দুবার মাত্র এসেছিল। ঠিক মুখ ফেরায় নি, কিন্তু এমন ভাব করছিল যে অন্য বন্ধুরা আছে, শুধু আমি নেই।
    নান্টু বলল-- তুমি গিয়ে কথা বল গুরু, নইলে ইউনিটে একটা মাত্র মেয়েক্যাডার সে ও হাতছাড়া হবে।
    -- কী ফালতু কথা!
    -- না গুরু! সিরিয়াস কেস। তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে তা তোমরাই জান। তবে ও এসে তোমার দেওয়া সব বই প্যাম্ফলেট সব আমার কাছে ফেরত দিয়ে গেছে। বলেছে--এসব আর ও রাখতে পারবে না
    --- ঠিক বলছিস? ঠিক এই কথা বলেছে?
    -- তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে তোমার জিএফ এর বিরুদ্ধে কান ভাঙিয়ে আমার লাভ? আর মেজদির সঙ্গেও ওর কিছু হয়েছে। গৌরী কাল রামগড়ে গেছল, মেজদির বাড়ি বয়ে কী সব ফ্রেন্ডশিপ গিফট ফেরৎ দিয়ে কথা শুনিয়ে এসেছে।
    আমার গলা শুকিয়ে যায়।
    --- মেজদি ওকে কিছু বলে নি।
    -- একটা কথাও না; হ্যাঁ, না-- কিচ্ছু না।এবার তুমি যে করে হোক গৌরীকে পাকড়াও কর। দেখ কী কেস!
    দুদিন তক্কে তক্কে থেকে ওকে সন্ধ্যের মুখে মুদি দোকান থেকে কিছু নিয়ে ফেরার সময় ধরে ফেলি। বেশ জোর করে টেনে নিয়ে যাই স্কুলের অন্ধকার মাঠে , ওকে জড়িয়ে ধরি। আমার সোনামণি!
    ও বিরক্ত মুখে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
    -- গায়ে হাত দেবে না বলছি।
    --- তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
    --আমার কোন কথা নেই।
    --শোন, নিশ্চয়ই কোন ভুল বুঝছিস।
    -- কোন ভুল নেই। একজনকে নিয়ে টায়ার্ড হয়ে গেলে আরেকজন। বেশ।
    ওর গলা ধরে আসে; মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি পেছন থেকে ধরে জোর করে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আনি। ওর দুগাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে।
    আমি আগের মত সেই জল মুছিয়ে দিতে গেলে ও বেড়ালের মত থাবা মারে।
    -- নির্মলা রেস্টোরেন্টে নিয়মিত যাতায়াতটা বিপ্লবের প্রয়োজনেই? কী বল, ঠিক বলছি তো!
    আমার আর কিছু বলার নেই। শুধু হাত জোড় করছি--বেশি বাহাদুরি না দেখিয়ে কালকের মধ্যে নাকতলা ছেড়ে যাও। এই এলাকা আর তোমার জন্যে সেফ নয়।
    -- কী বলছিস?
    --- আমার কাছে পাক্কা খবর; তোমার উপর অ্যাকশন হবে; কাল বিকেল নাগাদ। সিপিএম এর বিজয়গড় স্কোয়াড আসবে।
    -- কেন ?
    --- তুমি রামগড় নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। আজ ভোরের দিকে মর্নিং ওয়াকে গিয়ে সুদেবস্যার আক্রান্ত হন। পেছন থেকে কেউ মাথায় লাঠির বাড়ি মারে। সবার সন্দেহ নকশালদের কাজ। আর তুমিই নাকি পালের গোদা। জেনে বুঝেই পাড়ায় ছিলেনা। কাজেই ওদের তোমাকে সরাতেই হবে।
    আর একটা কথা। মার ইচ্ছে নয় যে তুমি আর আমাদের বাড়ি আসো বা আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখ।
    এবার যাও।

    ( দ্বিতীয় ভাগ শেষ)
    চলবে
  • ranjan roy | 132.161.201.96 | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৫:১১678528
  • তৃতীয় ভাগ
    আঠের বছর বয়েসের গদ্য
    ================

    'তোমাতে নই, আমাতে নই বিষয়ে আমি লিপ্ত,
    লাগাম ছেঁড়া পাগলঘোড়া তিনটে ভীষণ ক্ষিপ্ত।
    বিজন মাঠ, বধ্যভূমি
    ধরতে গেলাম, তখন তুমি
    সরে দাঁড়াও অশ্ববাহন এবং বলদৃপ্ত,
    রক্তে নাচাও মাতাল ঘোড়া তিনটে ভীষণ ক্ষিপ্ত।'
    -----শক্তিপদ ব্রহ্মচারী

    (১)
    ডেকচিতে ফুটন্ত ভাত উথলে উঠেছে। বিজনদা উঠে গিয়ে ঢাকনা তুলে দুটো ভাত টিপে আবার ঢাকনা চাপিয়ে দিল।
    --আর দু-তিন মিনিট; তার পরেই নামিয়ে দেব।
    --ঠিক আছে; কোন তাড়া নেই।
    শংকর অন্যমনস্ক ভাবে বলে বিজনদার তামাকের প্যাকেট থেকে এক চিমটি তুলে হাতের তেলোয় ডলতে থাকে। আমি মাদুরের কোণা থেকে একটা কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাতে থাকি। দরজার ফাঁক দিয়ে জুন মাসের দুপুরের একচিলতে রোদ্দুর মেজেতে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসে আছে। উঠোনের জলের বালতির ওপর বসে একটা কাক ডাকছে।মাঝে মাঝে ঠোঁট দিয়ে খোঁচা মেরে জল খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
    ওটা বিজনদার বাসন ধোয়ার বা কাপড় কাচার জল। ভাবছি কাকটাকে তাড়িয়ে দেব কি না, ব্যাটা নিজেই বোর হয়ে উড়ে গেল।
    বিজনদা ভাত বাড়ছে, সেই মুসুর ডাল, বাগানের গন্ধলেবু, আলুসেদ্ধ আর ডিমের বড়া। আমার কোন অসুবিধে হয় না। আমাদের চিনেমাটির প্লেটে দিয়ে নিজে কাঁসার কানিওঠা থালায় নিল, বাঙাল ভাষায় বলে--কাঁসার বেলি। এই বয়সেও অনেকটা ভাত খায় বিজনদা-- আর কাঁসার থালায়।
    আমি জানি থালাটার গায়ে বিজনদার মায়ের নাম লেখা আছে--সরোজিনী। এই থালাটা ছোড়দি ওকে দিয়ে গেছে। মায়ের নাকি সেইরকমই ইচ্ছে। শেষকাজের সময় বিজনদা পুরুলিয়ার জেলে।
    শংকর খায় ভাল করে ডাল দিয়ে মেখে, লেবু চটকে, একটু হাপুস হুপুস করে। আজ কিন্তু খাওয়ায় মন নেই। কিছু একটা ভাবছে। অন্যদিন হলে আমার ডিমের বড়ার থেকে খামছে অন্ততঃ একটা তুলে নিয়ে নির্বিকার মুখে চিবোতে থাকত--যেন ওটাই স্বাভাবিক। আজকে আমি গোটা ডিমটাই খেয়ে নিলাম-- ও যেন দেখেও দেখছে না।
    হাত-টাত ধুয়ে আবার মাদুরে ফিরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছি কি বিজনদা গামছা এনে আমাদের হাত মুখ মুছিয়ে দিল।
    উঃ , এখনও সেই বড়পিসিমাগিরি!
    শংকর আবার তামাক ডলে কাগজ পাকিয়ে একটা সরু ফানেলের মত করে তাতে কাঠি দিয়ে ঠুসতে লাগল। আমি নিজের প্যাকেট খুলে একটা ধরিয়ে অন্যটা বিজনদার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
    আগে আমরা ইচ্ছে করে একটা কাঠির থেকেই তিনজন ধরাতাম-- কুসংস্কারের বেড়া ভাঙতে হবে যে!
    এখন ওসব নিয়ে ভাবি না। জানি, কোন লাভ নেই।
    বিজনদা একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল-- এবার?
    --এবার কী?
    -- তোরাই বল, আমি খালি জিগ্যেস করছি।
    -- রমেন হিসেব দেবে। ও ফেরারী ফৌজের আটজন ঘোড়সওয়ার চিত্রগুপ্তের লেজার খুলবে--শালা ব্যাংকের ফোতো ক্লার্ক!
    -- কেন? তুই বলবি না কেন?
    -- ফেরারি ফৌজ প্রোজেক্টটা ওর, আমার পিতৃদেবের নয়। ওই বলুক।
    আমি কাশতে থাকি, উঠে গিয়ে উঠোনে পেয়ারা গাছের গোড়ায় একদলা থুতু ফেলি। তারপর মাথা নেড়ে বলি--হক কথা। হিসেব আমইই দেব। সোজা হিসেব। শুনে নাও, ভুল হলে ধরিয়ে দিও।
    আটজন ঘোড়সওয়ার।
    দু'জন-- রণক্ষেত্রে শহীদ।
    একজন-- দলত্যাগী, রেনেগেড।
    একজন-- কর্কটরোগে প্রয়াত।
    একুনে চারজন।
    হাজির ও সাক্ষাৎ হইয়াছে-- বাকি চারজন।
    এই অবশিষ্টদের ব্যালান্সশিট নিম্নরূপঃ
    একজন--শিল্পপতি, বাড়ি গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালান্সের মালিক।
    একজন-- অবসরপ্রাপ্ত সংসারী; দুর্বল হার্ট। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বেপরোয়া।
    বাকি দুইজন-- পত্নীপরিত্যক্তা, এক্কাগাড়ির সওয়ার।
    --ব্যস্‌?
    --ব্যস্‌।
    --- তাহলে? ব্যাক টু স্কোয়ার এ?
    বিজনদা যেন খেলনা কেড়ে নেওয়া বাচ্চা।
    শংকর নড়ে চড়ে বসে। নিভে যাওয়া পাকানো সিগ্রেটটা মেজেতে ঘষে ঘরের কোণায় ছুঁড়ে দেয়।
    -- আমি বলি কি আমরা অতীত হাতড়ে দেখি--কেন আমরা পথে নেমে ছিলাম। গোড়া থেকে--মানে বিপ্লবের বুলি কপচেও কেন সেই ডাকাতের দলে ভিড়েছিলাম? সবাই নিজের নিজের কথা বলবে, আলাদা করে। রমেন শুরু করুক। আর খালি গল্প বললে হবে না। কোন যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করা না-পিওর ফ্যাক্ট বলবে আর শেষে বলতে হবে আজকে কে কী ভাবছে; নাকি ভাবাভাবির দিন শেষ?
    নে, শুরু কর শালা!
    আমাকে অবাক করে বিজনদা বলে ওঠে-ধ্যোর বাল!
    আমরা তিনজনেই হেসে ফেলি।
  • ranjan roy | 24.96.35.205 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ ২০:৪১678529
  • -- শংকর কী বললি? আমরা বিপ্লবের বুলি কপচে কেন ডাকাতের দলে ভিড়েছিলাম? ডাকাতের দলে? না তো।
    -- না বললেই হল? আমাদের খাওয়া পরা চলতে কী করে? বাপের হোটেলে? বাপের হোটেলে খেয়ে বিপ্লব? তোর, আমার, বিজয়দার জন্যে প্রতি মাসে একটা করে সাদা খাম ধরিয়ে দেওয়া হত না? তার উপর নাম ও নামের পাশে টাকার অংক লেখা থাকত না? যেমন আমার খামের উপর লেখা থাকত--" শংকর--১৩৫/-"। এগুলো তাহলে কী?
    -- আমরা ছিলাম প্রফেশনাল রেভোলুশনারি--পেশাদার বিপ্লবী। একেবারে লেনিনের ' কী করিতে হইবে' (What is to be done) মেনে। ওগুলো ছিল আমাদের মাসিক বেতন বা ওয়েজ।
    বিজয়্দা মুখ খোলে,-- এর মধ্যে লেনিনকে নিয়ে টানাটানি কেন?
    --বাঃ! সব ভুলে গেলে? তুমি ছিলে সেকশন কম্যান্ডার। তাই তুমি পেতে ১৫০/-।
    --সেটা কি লেনিন ঠিক করে দিয়েছিলেন ?
    -- কথা ঘুরিও না। "কী করিতে হইবে" লেখায় উনি বোঝান নি যে বিপ্লব করতে হলে আগে দরকার পেশাদার বিপ্লবী সংগঠন। কারণ বিপ্লব কোন অ্যামেচার ন্যাকামো ভাব-ভালবাসা নয়। এটা ফুল টাইম ব্যাপার আর --।
    --- আর জনতার অন্ধ ভীড় দিয়ে অরাজকতা হয়, বিপ্লব হয় না। এর জন্যে চাই প্রশিক্ষিত রেভোলুশনারি। তাই আমরা--।
    --তাই আমরা ডাকাতির পয়সায় হোটেলে খেতাম, এক কামরা ঘরের ভাড়া দিতাম, ট্রাম-বাস--ট্যাক্সি চড়তাম?
    --ডাকাতির পয়সায়? ওভাবে কেন বলছিস! আমরা তো মার্সেনারি নই। পেশাদার সৈনিক মজুরি নেবে না? মাওয়ের গণমুক্তি ফৌজের সৈনিকদের বেতন দেওয়া হত না? তাই কুয়োমিন্টাংদের সৈন্যরা দলত্যাগ করে লালফৌজে যোগ দেয় নি? আর তুই বলছিস ডাকাতের দল?
    --শোন শংকর! আজ আমরা অতীত; মানছি হেরে যাওয়া অতীত। তাই বলে নিজেদের ছোট করতে হবে কেন? আত্মগ্লানি আত্মকরুণা ভাল কথা নয়। খেয়াল করে দ্যাখ,--আমাদের সংগঠনের নাম আরসিসিআই বা রেভোলুশনারি কম্যুনিষ্ট কোঅর্ডিনেশন অফ ইন্ডিয়া। আমাদের নেতা যাঁকে তোমরা কোনদিন দেখনি-- আর দেখতেও পাবে না-- ছিলেন অনন্ত সিং। হ্যাঁ, সেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের খ্যাতিপ্রাপ্ত অনন্ত সিং-- মাস্টারদা সূর্য সেনের ডানহাত, মিলিটারি স্ট্র্যটেজিস্ট।
    বিজয়দাকে এবার লেকচারে পেয়েছে। টিউশনের ছেলেদের বোঝানোর মত করে বলতে থাকে।
    -- সূর্য সেনের ফাঁসি হল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে প্রাণ দিলেন। অনন্ত সিংয়ের কালাপানি হল। দেশ স্বাধীন হলে উনি আন্দামান থেকে অন্য অনেকের মত কমিউনিস্ট হয়ে ফিরে এলেন। পার্টির টেকনিক্যাল কোরের দায়িত্ব পেলেন।
    --হ্যাঁ হ্যাঁ; সবটা বল। উনি পার্টির মধ্যে একটি সমান্তরাল গোপন সংগঠন গড়ে তুললেন--নাম ছিল আওয়ার স্ট্যান্ড। কিছু ডাকাতি করলেন--স্বদেশী গুপ্ত সংগঠনের কায়দায়। কমিউনিস্ট পার্টি প্রমাদ গুনল। আসলে যদ্দিন পার্টি নিষিদ্ধ ছিল ততদিন এসেব কজে দিয়েছিল। কিন্তু যেই পার্টি অজয় ঘোষের নেতৃত্বে ১৯৫২র প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল তখন অনন্ত সিংয়ের কাজকম্ম হল গলার কাঁটা। তাই ওঁকে ওনার চেলাচামুন্ডা সমেত দল থেকে বের করে দেওয়া হল।
    কিন্তু অনন্ত সিং হলেন আদ্যপান্ত বাঙালী; নাহয় চাটগেঁয়ে বাঙাল। আর কে না জানে বাঙালীর লোহা দেখলেই গুয়া চুলকোয়। তাই কিছুদিন ঘাপটি মেরে কাটিয়ে যেই বাংলাবাজারে 'বন্দুকের নলই শক্তির উৎস' দেয়ালে লেখা দেখলেন অমনি আরেকটা ডাকাতের দল গড়লেন--- এমএমজি বা ম্যান-মানি-গান।
  • ranjan roy | 24.96.89.140 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০৯678530
  • --ফের ডাকাতের দল! ম্যান-মানি -গান নামটা বিদ্রূপাত্মক, আমাদের বিরোধীদের দেওয়া। আমাদের আসল নাম তো বললাম-- আরসিসিআই।
    -- সে যাই বল, বাংলাবাজারে আমাদের সবাই এম-এম-জি বলেই জানে। আর স্বদেশী যুগের মত ডাকাতির পয়সায় সংগঠন চালানো!
    -- কেন? খালি স্বদেশী কেন? লেনিনের পার্টি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের জন্যে , আর্মস এবং গোপনে ইসক্রা পত্রিকা চালাতে ডাকাতি করত না? এন বাউম্যানরা করেন নি? মন্তিস্লাভস্কির "বসন্তের দূত রুক" বইটি আমাদের অবশ্য পাঠ্য ছিল না? স্তালিন বাকু ও জর্জিয়ায় ডাকাতি করতেন না? অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থে নয়; পার্টি ও বিপ্লবের স্বার্থে; কোন সাধারণ মানুষের থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয় নি। ট্রেজারি ও জমিদারদের খাজনা --!

    --- হ্যাঁ, স্তালিনের প্রথম জীবনে ওইসব কাজকম্ম ওয়েল ডকুমেন্টেড। কিন্তু আজ মনে হয় ডাকাতিটা ডাকাতিই। নিজেরটা ছোঁচাও কি অন্যের; হাত নোংরা হবেই । তাই যদি বলি যে আমরা ভেড়ার পালের মত অনন্ত সিং নামের এক প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিপ্লবের ভাঁওতায় ভুলে ডাকাত দলের খোঁয়াড়ে ঢুকেছিলাম সেটা কি খুব ভুল বলা হবে?
    -- বিজনদা! শংকর কি ঠিক বলছে? আমাদের মাসিক ওয়েজ কি ডাকাতির টাকায়? আর অনন্ত সিং কোথায়? আমাদের সিক্রেট সংগঠনের চিফ তো "ওল্ড গার্ড" বা অবিনাশ।
    -- অনেকটা ঠিকই বলেছে। অবিনাশই অনন্ত সিং। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারত শুধু টপ তিন জন। সিক্রেসির উপর উনি খুব জোর দিতেন।
    আর আমাদের ওয়েজ আসত পার্ক স্ট্রিট পোস্টাপিস রবারির টাকায়-- যেটা ১৯৬৮ সালে হয়েছিল। পরে ১৯৬৯ সালে স্টেট ব্যাংক ডাকাতির সময় আমরা অলরেডি অনন্ত সিংয়ের দল থেকে আলাদা হয়ে গেছি।
    -- আচ্ছা? আমি এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। শুধু কিছু শুনেছিলাম, বীরুর কাছ থেকে। মনে হচ্ছে শংকর জানে, হয়ত ও ছিল। এখানে খুলে বলুক। পাপস্খালন বা আত্মার শুদ্ধিকরণ হোক!
    শংকর কিছু ভাবে। তারপর হঠাৎ উঠে বাইরে যায়।
    আমি আর বিজয়দা চুপ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকি। ও চায়ের জল চড়ায়।
    চা ছাঁকার আগেই শংকর ফিরে আসে। পাড়ার দোকান থেকে দু'প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছে। মাঝখানে একটা প্যাকেট রেখে ধোঁয়া ছেড়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বলে-- আজ এতদিন পরে সব গুছিয়ে বলা বেশ কঠিন। তবে চেষ্টা করব। ভুল হলে দাদা ধরিয়ে দেবে।
    প্রথমে পার্ক স্ট্রিট পোস্টাফিসের ডাকাতি।
  • ranjan roy | 24.99.59.199 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৬:১৯678531
  • ২)
    পার্ক স্ট্রীটের সেই সকালটা
    ==================
    বর্ষাকাল। কিন্তু গত দু'দিনে একফোঁটা বৃষ্টি হয় নি। ভ্যাপসা গরম আরও বেড়েছে। তাই ছেলেছোকরার দলটা যে একঘন্টার মধ্যে বার কয়েক কোল্ডড্রিংকে গলা ভেজাবে, তাতে আশ্চর্যের কি ?
    পার্ক স্ট্রিটের উল্টো দিকে কোণের দোকানটায় চা'-লেড়ো বিস্কুট, ঘুগনি, পাঁউরুটি আলুর দম, ওমলেট সবই পাওয়া যায়। আর কোণের দিকে রাখা আছে কোকাকোলার বোতল।
    কিন্তু পাঁচজন ছোকরার দলটি বসেছে দোকানের বাইরে ফুটপাথ ঘেঁষে রাখা বেঞ্চ আর দুটো কাঠের টুলে।
    --- এক প্যাকেট পানামা দিন তো?
    দোকানদার প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে ভাবে-- এরা ঠিক সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সিগ্রেট ফুঁকতে আসা ছাত্র নয়।আধঘন্টা ধরে বসে আছে। কিন্তু কথা কম। মুচকি চাপা হাসি আর কিছু অঙ্গভঙ্গী। এপাড়ায় কি কখনও আগে দেখেছে? মনে করতে পারছে না। দুজন এই গরমেও ফুলশার্ট পরে আছে। আর একজনের সোনালি চুল। তা এই সাহেব পাড়ায় অমন দু-একজন এখনও দেখা যায়।
    ওর পাশের ছেলেটি ঘড়ি দেখছে। বেলা সাড়ে নয়। এবার ও চোখ তুলে সোনালি চুলের দিকে তাকাল। সোনালি চুল আস্তে করে চোখের পাতা নামাল।
    অন্য একজন এর মধ্যেই দোকানাদারের পয়সা মিটিয়ে দিয়েছে।
    সোনালি চুল ও ঘড়িদেখা ছেলেটি এবার টুল থেকে উঠে রাস্তায় নেমেছে। একটু ক্যাজুয়াল ভাবভঙ্গী; রাস্তার এ'পাশ ও'পাশ দেখছে। কিন্তু বাঁদিকে তাকিয়ে হটাৎ ওদের ঘাড় টানটান। অন্ততঃ একশ ফুট দূরে একটি চশমা পরা ছেলে রাস্তার ধারে একটা খালি সন্দেশের বাক্স মত নামিয়ে দিয়ে আস্তে করে হেঁটে পাশের গলিতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
    ওরা জানে যে এর মানে ওই চশমুদ্দিন প্রায় একশ ফুট দূরে একজনকে একটা সবুজ রুমাল মাটিতে ফেলে আবার ঝেড়ে হুড়ে তুলে নিতে দেখেছে। আর সে দেখেছে রাস্তার ক্রসিং এ ধুতিপরা একজনকে ছাতা খুলে রাস্তা পার হতে হতে ছাতাটা আবার বন্ধ করতে। সে দেখেছে--। নাঃ, এই চিন্তার সূতোর লাটাই দ্রুত গুটিয়ে সোনালি চুল পেছন ফিরে বাকিদের দিকে তাকাল।
    অন্য ছেলেগুলোও যেন আড়মোড়া ভেঙে ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেল।
    দোকানদারের চোখে পড়ল যে দু'জন অনেকটা কোল্ডড্রিংক ছেড়ে গেছে। আরে, একটা বোতল তো খোলাই হয় নি। কিন্তু পুরো পয়সা তো আগাম দিয়ে দিয়েছে।

    নাঃ , ও এমন ভাবে দাঁও মারবে না। বারো আনার জন্যে এমনি করলে ধম্মে সইবে না। ও পয়সা ফেরত দিয়ে দেবে।
    -- ও মশাই! শুনছেন? এদিকে দেখে যান।
    কিন্তু মশাইরা কিছুই শুনছেন না। কারণ, একটা লালরঙা গাড়ি, পেছনে তারের জাল, এসে পার্কস্ট্রিট পোস্ট অফিসের সামনে থেমেছে।
    গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বন্দুকধারী একজন রক্ষী। আর পেছনে জাল ঘেরা জায়গায় একটা বড় ক্যাশবাক্সের সঙ্গে আরও দুজন সশস্ত্র গার্ড হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে।
    এবার ওরা প্রতিবারের মত ভেতর থেকে বন্ধ দরজাটা খুলে বাক্স নিয়ে নামবে। কিন্তু ওরা আর নামতে পারল না।
  • ranjan roy | 24.99.195.180 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:১৯678532
  • খালি দরজাটা খুলে একজন চেন ও তালা লাগানো বড়সড় ট্রাংকের মত বাক্সটাকে ঠেলে দরজার সামনে এনেছে তক্ষুণি দু'জন ছোকরা ওর পেটে ও গলায় ছোঁয়াল পাইপগান ছোঁয়াল। আর একটু হোঁৎকামত তৃতীয়জন ট্রাংকটা টেনে মাটিতে নামাল। সিকিউরিট গার্ডের কিছু করার নেই। এত কাছ থেকে বন্দুক চালানো যায় না।
    কিন্তু দ্বিতীয়জন অবস্থা এঁচে নিয়ে খাঁচাটার কোনার দিকে সরে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সোজা গুলি চালিয়ে দিল। গুলি সোনালি চুলের কম্যান্ডারের কানের পাশ দিয়ে সোঁ করে বেরিয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে পাইপগানের জোড়া গুলি লেগে রক্ষী গাড়ির ফ্লোরের মধ্যে ধপাস করে পড়ল। পিঠ দেয়ালে , জামাটা রক্তে ভিজে উঠছে।
    এদিকে সামনের গেটে ড্রাইভার কানের পাশে ঠান্ডা ধাতব নলের ছোঁয়ায় নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওর পাশে বিপরীত দরজার দিকে বসে থাকা রক্ষী জালি লাগানোর জানলার গায়ে ঠেকিয়ে রাখা মাস্কেটটি র ট্রিগারে সকলের অজান্তে চাপ দিল। ফল হল উল্টো।
    গুলি লাগল না।
    কিন্তু পেছনের গেট থেকে সোনালিচুলো কম্যান্ডার এসে জালির গায়ে নল ঠেকিয়ে ঘোড়া টিপল। রক্ষীর হাতে গুলি লাগতেই ও কাতরে উঠল। এই অভাবিত ঘটনায় রাস্তার দুধারের দোকানপাট নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল। পার্কস্ট্রীটে সাত সকালে শ্মশানের স্তব্ধতা।
    ইতিমধ্যে ডাকগাড়িটির হাত পাঁচেক দূরে থেমেছে একটি কালো অ্যাম্বাসাডর। তার চালক সিট থেকে নড়েনি, ইঞ্জিন বন্ধ করে নি। তবে সঙ্গীটি নেমে এসে খুলে ফেলল অ্যাম্বাসাডরের ডিকি।
    এই পাঁচজনের দলটি দ্রুত হাতিয়ে নিল তিনটি মাস্কেট। ডিকির মধ্যে উধাও হয়ে গেল ট্রাংক আর ওদের পাইপগান। তিনজন উঠে বসল অ্যাম্বাসাডরের পেছনের সিটে।
    কিন্তু গাড়িটি স্টার্ট নিয়ে আটকে গেল। কিশোর ড্রাইভার নার্ভাস হয়ে গেছে, ক্লাচ - একসিলেটর-ব্রেক এর কোঅর্ডিনেশন ঠিক হচ্ছে না। অভিজ্ঞ সঙ্গীটি ওকে সরিয়ে পাকা হাতে স্টিয়ারিং ধরল। গাড়ি একটু বাঁক নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টোদিকে বেরিয়ে গেল।
    রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজন--হাতে তিনটি দখল করা মাস্কেট,গুলির বেল্ট রয়ে গেছে আহত রক্ষীদের কোমরে। এভাবে গেল দেড় মিনিট। গলির মধ্যে থেকে উঠে এসেছে একটি ফিয়েট। তাতে চালান হয়ে গেল মাস্কেটগুলো। এবার পেছনের সিটে সওয়ার হয়ে মিলিয়ে গেল শেষ দুই অশ্বারোহী।
    গোটা অপারেশন সম্পন্ন হল সাড়ে চার মিনিটে।

    আধঘন্টা পরে যখন সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স ও বিশাল পুলিশ বাহিনী পোঁছল তখন পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসের সামনে লালচে গাড়িটিকে ঘিরে মানুষের জটলা।
    এম্বুলেন্স কর্মীরা দ্রুত হাতে দুই আহত সুরক্ষা গার্ডকে স্ট্রেচারে করে তুললেন। পুলিশের একটি দল পোস্ট আফিস ঘিরে ফেলল। চশমা পরা একজন অফিসারের নেতৃত্বে একটি ছোট দল ভেতরে পোস্ট মাস্টার, স্টাফ ও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নিতে ব্যস্ত হল। আর একটি দল ডাকগাড়ির ড্রাইভার, অক্ষত সুরক্ষা গার্ড ও রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানের মালিককে ইন্টারোগেট করবে বলে কালো গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেল।

    সেই সময় গড়িয়ার কামডহরির কাছে একটি ঝিলের পাশে বিশাল নির্জন বাগানবাড়িতে এক টাকমাথা ধবধবে গায়ের রং ষাট পেরিয়ে যাওয়া ভদ্রলোক ওঁর স্টাডি রুমে একা একা দাবা খেলছিলেন। ওঁর পরনে সাদা ফতুয়া ও বার্মিজ ধরণের লুঙ্গি। পায়ের কাছে একটি দেশি কুকুর অলস ভঙ্গিতে গা ছেড়ে দিয়ে থাবা চাটছে।
    বই দেখে বটভিনিক ও টালের একটি বিখ্যাত গেমের ওপেনিং গুলোকে বদলে বদলে নতুন ভাবে খেলছিলেন। কিন্তু আজ খেলায় মন নেই। মাঝে মাঝে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা। ঘন্টা দুই কেটে গেল।
    এমন সময় হঠাৎ পোষা কুকুরটা গরর্‌ করে উঠল। উনি প্রায় লাফিয়ে উঠে জানলা দিয়ে দেখলেন যে দারোয়ান গেট খুলে দিচ্ছে আর বাগান পেরিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে সোনালি চুল।উনি নিজেকে সংযত করলেন।
    গম্ভীর মুখে বললেন--রিপোর্ট!
    --- সাকসেসফুল। এভরিথিং ওকে।
    -- ভেহিকল্স্‌?
    -- ওকে, ইন দ্য হাভেন। নেমপ্লেট কালার চেঞ্জড্‌।
    -- এনি ক্যাজুয়ালটি?
    -- টু গার্ড্স ইন্জিওর্ড, নট ফ্যাটাল; নান অ্যাট আওয়ার সাইড।
    লম্বা মানুষটি বেঁটে সোনালিচুলোকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেলেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন