এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • এখানেও থাক

    kiki
    অন্যান্য | ১৫ জুন ২০১৪ | ৭৪৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kiki | 53.230.133.194 | ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৭642381
  • 6.

    এছাড়াও দেখলাম লোয়ার ড্যাম, আপার ড্যাম যা কিনা পুরুলিয়া পাম্প স্টোরেজের অংশ (এটা একটা হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট, যা কিনা জাপান আর WBSEB এর কোলাবরেশনে তৈরী। আর লোয়ার ড্যামের পাশ দিয়ে ঘুরে (পাওয়ার প্রজেক্টের ভিতরে ঢুকতে গেলে পার্মিশন লাগে, কাজেই সেটা দেখা হয়নি) একটা মন্দির আছে, সেখানে যাওয়া হলো। তারপর আপার ড্যামে। এই জায়গাটা ভারী সুন্দর। গাড়ীচালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এখানে রাত্রেও যাওয়া যায়। যদি নিজেদের গাড়ী সঙ্গে থাকে তো অবশ্যই রাত্রে যাবেন। যদিও মা খুব রেগে গেলো আমার উপর, রাত্রিতেই ঘুরতে আমার ভালো লাগে বলে। কি করে বোঝাই কোনো জায়গাকে পুরো অনুভব করতে রাতের বেলার জুড়ি নেই। দিন বড্ড আমিময়, তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে দেখতে দিতে চায় না, এতই পজেসিভ।কিন্তু রাত্রি এত স্নিগ্ধ আর নিজেকে আড়ালে রাখতে ভালোবাসে.................. যাগ্গে, জানি জানি, আমার মাথায় ছিটের বোঝা আছে।

    দুপুরে লাঞ্চাবেন কিনা সেটা অবশ্যই জানিয়ে যাবেন, আমরা ভেবেছিলাম অনেক ঘুরতে হবে, তাই বলে যাই নি, শেষে খাবার দোকান খুঁজে মরতে হয়েছিলো। এছাড়াও গিয়েছিলাম মুখোশ গ্রামে। এখানে ওরা প্রথমে মাটির ছাঁচ বানায়। তারপর কাগজ পচিয়ে মন্ড করে , সেটা দিয়ে ছাঁচ তোলে মুখোশের। তারপর তাতে রং করে, প্রয়োজনে জরি , ইত্যাদি ব্যবহার করে দারুন সব মুখোশ বানায়। পশু, দেবদেবী, রাবন, আদিবাসীদের মুখ, এরকম নানান মুখোশ পাবেন সেখানে, সাথে বাবু হয়ে বসে আরাম করে ফ্রীতে দারুন গল্প করতেও পারবেন। আমরা দেদার গল্প করে ( এর মধ্যেই মা কাদের সাথে আলাপ জমিয়ে আমাদের বেড়ানোর সময় বাড়িয়ে বিষ্ণুপুর জুড়ে ফেলেছে) বিষ্ণুপুর কিভাবে যাবো তাও জেনে ফেললাম। একবার কেবল জিগিয়ে ফেলেছিলুম এই কাগজের মুখোশের এত দাম কেন? তাতে বিক্রেতা ভারী কিন্তু করে বললো, মাগো, আমাদের পরিশ্রমের ও তো দাম আছে, খুব লজ্জা পেয়েছিলুম তখন। সত্যি ই তো। আবার একটা কার্টুনে সেসব ভারী যত্ন করে বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি।

    ফিরে আবার খানিক বিশ্রাম নিয়ে সবাই মিলে খুব আড্ডা হলো গাছেদের মাঝে খোলা চালার নীচে বসে। পটকা আর ঋভু গান শোনালো, মা গল্প শোনালো। আমরা ও রাতেই বিল মিটিয়ে রাখলাম , পরদিন ভোরবেলাতে যেতে হবে। এবং এই প্রায় আড়াইদিনের খাবারের বিল হলো নশো কিছু টাকা মাত্র । আর বাগানের সব্জি ওরা বিক্রি করে কিনা জিগাতে সেও খানিক এমনিই সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছিলো, কি ভাগ্যি যে শেষ মুহুর্তে প্ল্যান চেঞ্জ হওয়ায় আর সেখান থেকে বাজার বয়ে আনতে হলো না, নইলে হয়তো সে তাজা সব্জির মায়া কাটানো যেত না। যে বাসে গিয়েছিলাম, তাতে করেই ফিরে এলাম পুরুলিয়া। বাচ্চারা খুব মন খারাপ করে ফেলেছে, তারা আবার পুজোর সময় আসবেই এমনটাই জানিয়ে আসলো। আবার পুরুলিয়া থেকে বাসে বাঁকুড়া এবং সেখান থেকে বাসে বিষ্ণুপুর এলাম। বাস স্ট্যান্ডের গা ঘেঁষেই এখানে দুটো লজ পেয়ে যাবেন। কিন্তু পুরুলিয়া আর বাঁকুড়ায় বেশ তফাৎ আছে। এখানে অত উষ্ণতা নেই মানুষের মধ্যে।

    আমরা উঠেছিলাম মল্লভূম (তাই বোধ হয় নামটা) লজ এ। এটাও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। তবে থ্রী বেডরুমের ভাড়া সাড়ে আটশো পরলো। আর বেশ ছোট দমবন্ধ হওয়া রুম। খাটের দুদিকে অল্পই জায়্গা। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো একটা কাঁচের পার্টিশনের আড়ালে এক শালিখ ফ্যামিলি রয়েছে, যারা আমাদের এপাশে খুব একটা পছন্দ করে নি, বেশ বিদ্রোহ করছিলো। আমরা সকাল ছটার অযোধ্যা পাহাড়ের বাসে চড়েছিলাম আর বিষ্ণুপুর পৌঁছাতে প্রায় বেলা একটা বেজে গিয়েছিলো। এখানে ফ্রেস হয়ে বাইরে খেতে যেতে হলো, কারন এটা কেবল থাকার ব্যবস্থা। তবে রাতে খাবার ওরা আনিয়ে দেয় ঘরে। আর বাস স্ট্যান্ডের খাবার হোটেল (হোটেল বলে কেন?) গুলোতে গিয়ে খবরদার জিজ্ঞেস করবেন না, ঝুলেরা খাবারে পরে নাতো জাতীয় কিছু, লোকজন ভারী রাগ করে, পাঁচটাকা করে যে দারুন পোস্তবড়া গুলো দিয়ে যাচ্ছিলো, সেগুলো হঠাৎ নেই বলে দেবে, চাইলেও পাবেন না।

    এখানে আমরা একটা অটো ঠিক করে নিই লজের লোকটির কথায়। তার প্যাকেজ ছিলো সাড়ে তিনশো টাকার। কিন্তু আপনারা বিষ্ণুপুর গেলে অবশ্যই গরম কালে যাবেন না আর এরকম প্যাকেজ নেবেন না। এরা মোটামুটি আড়াই ঘন্টার সময়ের বেশি আপনাকে ঘোরাবে না, ইনসিস্ট করবে মিউজিয়াম না দেখানোর, যেটা না দেখলে অনেক কিছু মিসাবেন। আর খুব ছোট জায়গা, কাজেই রিক্সা করে প্রথম স্পটে পৌঁছালে বাকিটা হেঁটেই ঘোরা যাবে। খুব গলি ঘুঁজি দিয়ে যেতে হয়, কাজেই গাড়ী অ্যাভয়েড করাই ভালো। আর প্রচুর সময় নিয়ে না ঘুরলে মন ভরে দেখা যাবে না।
  • kiki | 53.230.133.59 | ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ১৭:৪৯642382
  • 7.

    মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর এ আমরা প্রথমে গেলাম রাসমঞ্চ দেখতে। এখানে আপনাকে টিকেট কেটে নিতে হবে, সেটা (মনে হয় পাঁচটাকা পার হেড বা দশটাকা, ছোটদের লাগে না।) দিয়ে তিনটে না কটা মন্দির দেখা যায়, মানে যাদের ক্ষেত্রে টিকেট লাগে। কাজেই টিকেট ফেলবেন না। আর রাসমঞ্চে ঢোকার গেটেই বিক্রি হচ্ছে গাইড বুক। ইংরাজি তে লেখা গুলো ফটোকপি করা, বাংলারটা চটি বই। সব দশ টাকা করে দাম। ছেলেদের দুজনের জন্য দুটো ইংরাজি আর নিজের জন্য একটা বাংলা বই নিয়ে নিলাম ঝটপট। আমরা রোদ্দুর এড়ানোর জন্য চারটে নাগাত বেরিয়েছিলাম আর পাঁচটার মধ্যে নাকি মন্দির সব বন্ধ হয়ে যায় (তখন ই জানলাম), কাজেই সেই মুহুর্ত থেকে অটোয়ালা তাড়া দেওয়া শুরু করলো, টোটাল বিরক্তিকর ব্যাপার। এইখানেই গাইড নেবার জন্য চাপাচাপি করা হয়, গাইড আপনার সাথেই ঘুরবে এবং ঘুরে দেখাবে। প্রথমে গাইড নিতে চাইছিলাম না, কিন্তু তাড়াহুড়োতে দেখতে হবে বলে একজন গাইড নিলাম। এখানে রেট শুনলাম আড়াইশো, তবে দুশোতে গাইড ঘুরে দেখাতে রাজি হয়ে গেলেন। এবং যিনি আমাদের গাইড ছিলেন তিনি দারুন মানুষ, এত প্রশ্ন করেছি, কিন্তু বিরক্ত হতে দেখিনি। খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

    মল্লরাজা বীরহাম্বির আনুমানিক ষোলোশো খ্রীষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মল্লরাজাদের আমলে বার্ষিক রাস উৎসবের সময় বিষ্ণুপুরের যাবতীয় (এখানে বেশিরভাগ মন্দির ই রাধা কৃষ্ণের) রাধাকৃষ্ণের মুর্তি জনসাধারনের দেখার জন্য এখানে নিয়ে আসা হত। অসাধারন স্কয়ার বেসের এই মঞ্চটি তে অনেক আর্চ শেপের ঢোকার ব্যবস্থায় পুরো ভুলভুলাইয়া করা আছে। এর বেস তৈরী মাকড়া পাথরের (এখানে প্রায় সব মন্দিরেই তাই) আর দেওয়াল টেরাকোটার ইঁটের। মাকড়া পাথর যা বুঝলাম , সেটা হচ্ছে লাভা দিয়ে তৈরী পাথর, যার ভিতরে প্রচুর হাওয়া ঢুকে গেছে তৈরী হওয়ার সময় , ফলে এটা হালকা কিন্তু পোক্ত। কালচে রঙের অমসৃন গায়ের দেখতে । রাসমঞ্চে তিন ধর্মের স্থাপত্য দেখা যায়। একেবারে মাথার উপরে পিরামিদের মতন, যা কিনা বৌদ্ধধর্মের প্রতিক(ব্যাপারটা কেমন ধোঁয়াশা লেগেছে, পিরামিডের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের মিল ঠিক বুঝতে পারিনি।)মাঝে হিন্দুদের মতন গোল চালা, আর ঢোকার খিলানগুলো মুসলিমদের মতন। মজার ব্যাপার অনেক রাজা বাদশাই চেষ্টা করেছিলেন ধর্মের সমন্বয় আনার। অত বছর আগে এই ভাবনা বেশ ভালো লাগলো।

    এরপরে খুব সম্ভবতঃ গেলাম মদনমোহন মন্দিরে। এখানেও মন্দিরের গায়ে নানান দৃশ্য খোদাই করা। নীচের দিকে পশুপাখি, কৃষ্ণলীলা, দশাবতার আর উপরের দিকে যুদ্ধদৃশ্য। আমরা অবশ্য গাইডের মুখে শুনে এদিক সেদিক তাকালাম মাত্র, মরমে পশিবার সময় নাই।
    আবার দৌড়ে অটোতে আর তারপরে রাধাশ্যাম মন্দিরে। দারুন এই মন্দিরে একটা নহবতখানা আছে ঢোকার মুখে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দিরটির বেস মাকড়া পাথরের। এখানেও দেয়ালে ফুলকারি, মহাভারত ও পুরান কাহিনী খোদাই করা আছে। এই মন্দিরের মাথাটা গম্বুজের মতন। এখানে কালো কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ ও অষ্টধাতুর রাইয়ের মূর্তি রয়েছে। আরো আছে নিমকাঠের তৈরী নিতাই-গৌড় ও জগন্নাথের মূর্তি। এইগুলিই রাসের সময় রাসমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হত শুনলাম। এখানে এখন ও পুজো হয়। এই মন্দিরটিতে পংখের কাজ আছে, অবশ্য সে প্রায় যেতে বসেছে। পঙ্খ,সাদা রঙের, অনেকটা প্ল্যাস্টার অফ প্যারিসের মত দেখতে, তেঁতুলের বীজ, আরো কিসব মিশিয়ে এই কাজ হত , ভুলে গেছি এখন। এখানে একটা ঢাকা তুলসী মঞ্চ আছে। এই প্রথম কোথাও ঢাকা তুলসী মঞ্চ দেখলাম। কৃষ্ণরাইয়ের মূর্তি যেদিকে আছে , তার সামনে রয়েছে নাটমঞ্চ। আর তুলসীমঞ্চের গা ঘেঁষে পুবদিকে বেঁকে গেলে রান্নাঘর দেখা যাবে।

    আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে মিউজিয়াম দেখবার, আর অটোয়ালার ও কিসের এক প্রবল তাড়া, কোন মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে। গজগজ করতে করতে সে চলেছে, না দেখালে তো আমাকেই বলবে, এখন সময়ে না পৌঁছালে কি করে দেখাবো। হায়! সে তো এটাই বুঝেছে যে ঝপাং করে গিয়ে ফেলে দিলেই দেখা হয়ে যাবে। দেখতে যে হয় মন দিয়ে, প্রান দিয়ে প্রতিটা গরাস অনেকক্ষন চিবিয়ে স্বাদ নেবার মতন , একথাটা তাকে বোঝাই কি করে!
  • kiki | 53.230.133.59 | ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ২০:১৩642383
  • 8.

    প্রায় শুকিয়ে আসা পরিখাকে পাশকাটিয়ে বড় পাথর দরজা দিয়ে বিষ্ণুপুরের এই প্রাচীন গড়ে ঢুকতে হয়। পুরো গা ছমছমে দোতলা এই বিরাট দরজা পথ ও মাকড়া পাথরের তৈরী। এখানে বাঁকানো গর্ত রয়েছে, মানে সোজাসুজি গর্তের দিকে তাকালে দৃষ্টি বাধা পাবে। সেখান থেকে অতর্কিতে আঘাত হানার ব্যবস্থা ছিলো।এরপরে ছোট পাথর দরজা। আজ ও এরা গর্বিতভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা বিরাট মাঠে খেলা হচ্ছিলো, তার পাশে কোনো মন্দির ছিলো, যা রবিবারে বন্ধ। কাজেই তাকে দুর থেকেই দেখতে হলো।
    এরপর আমরা গেলাম জোড়বাংলায়। সেখানে বাইরে একজন বাউল বসে গাইছিলেন। ঋভু এমনিতেই অতিষ্ঠ ছিলো লাফঝাঁপের চোটে। কাজেই সে ওনার পাশেই সেঁটে গেলো। আমরা হুড়োহুড়ি করে জোড়বাংলা দেখতে ঢুকলাম ও বেরিয়ে এলাম। এখানে দুটো দোচালা কুটির গা ঘেঁষে রয়েছে বলে এমন নাম। এখানেও দারুন টেরাকোটা কাজ রয়েছে, কিন্তু আমাদের সময় নাই, শ্যামরায়ের মন্দির বন্ধ হয়ে যায় যায়।

    শ্যামরায়ের মন্দিরটির তিনটি নাম রয়েছে। রাধাকৃষ্ণের মন্দির বলে শ্যামরায়(রাই হওয়া উচিত ছিলো না?) , পাঁচখানা চুড়ার জন্য পাঁচচুড়া এবং পঞ্চরত্ন (এটা কেন ভুলে গেছি)। সারা দেওয়ালে অসাধারন সমস্ত কাজ রয়েছে। এখানে রাসচক্র এবং দশমহাবিদ্যার মুর্তি ও দেখলাম। এই দশমহাবিদ্যা নিয়ে তখন আমার তুলকালাম আগ্রহ, কারন চন্ডিমঙ্গল নিয়ে একটা বই পড়ছি। আমাদের গাইড বললেন যে কোনো যজ্ঞে দেবী (কে সেটাও ভুলে মেরে দিয়েছি, লক্ষ্মী মনে হয়) যিনি শিবের কন্যা, নিমন্ত্রন পাননি, তাই তাকে যেতে বারন করা হয়েছিলো, তার ই বিভিন্ন রূপ ঐ দশমহাবিদ্যারা গেছিলেন। তাতে উনি বললেন তিনটে জায়গায় নিমন্ত্রন ছাড়া যাওয়া যায়, ১। পিতার বাড়ী, ২। গুরুর বাড়ী আর ৩। বন্ধুর বাড়ী। এদিকে আমার আবার বন্ধুর ছড়াছড়ি। সেদিন একজনের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, বন্ধুটি আমার ছেলের স্কুলে ইনভিজিলেটর হিসেবে এসেছিলো। পরে ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে , তোর কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়! কি আর বলি, আমার তো চলতে ফিরতে বন্ধুদের সাথে ধাক্কাধাক্কি লেগেই থাকে। আর রাস চক্রে মাঝখানে কৃষ্ণের সাথে দুই সখি আছে, রাই নেই। তাতে বললেন , তখন রাধা রাগ করে কৃষ্ণের থেকে দুরে থাকছেন নাকি, কেষ্টা ব্যাটার ইসে সমূহ নির্ঘাত বেচারী মেয়েটা আর নিতে পারেনি।

    এরপরে মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে। এখানে মায়ের মুর্তিটি গঙ্গামাটির তৈরী এবং নিয়মিত সেটি মাটির প্রলেপ, রঙ করে ঠিক রাখা হয়। এখানে মহা অষ্টমীর সন্ধিক্ষনে তোপ দাগা হয়। এই মন্দিরের পিছনেই রয়েছে রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। এর থেকে একটু এগোলেই দেখা যাবে গুমঘর। চারদিকে খাড়া দেওয়াল দেওয়া ছাদখোলা বিরাট উঁচু ব্যাপরটা কি ভয়ঙ্কর। ওর ভিতরে অপরাধিকে নাকি ফেলে দেওয়া হত। কি ভয়ঙ্কর তিলে তিলে মৃত্যু হত তার ভাবলেই ভয় লাগে।

    অবশেষে আমাদের মন্দির দেখানো প্রায় শেষ করে অটোয়ালা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার আর কোথাও বন্ধ হয়ে যাবার তাড়া নেই(মানে মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেলে তার কিছু আসে যায় না) আমরা এরপর গেলাম লাল বাঁধে। বাঁধ বলতে বিরাট দীঘি বা লেক ও বলা যায়। মল্লরাজারা জলকষ্ট দূর করার জন্য সাতটি বাঁধ খনন করে এই বিষ্ণুপুরে। এটি সবচেয়ে কন্ট্রোভারসিয়াল, তাই মনে হয় এটা দেখাতে নিয়ে এলো। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথের আমলে মনে হয় লক্ষনৌ থেকে লালবাই কে নিয়ে আসা হয়। তার সঙ্গে রাজা এইখানে নৌকাবিহার করতেন। লালবাই এর ছেলে হয়, যে রাজার ঔরসজাত বলে সিংহাসনের দাবীদার হতে পারে, তাই রানী ষড়যন্ত্র করে নৌকা ডুবিয়ে লালবাই আর তার ছেলেকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেন। এইরকম গল্প শুনিয়েই আমাদের গাইড (তিনি আবার নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব এবং ব্রাহ্মন , আচ্ছা, এটা আমার গোলায়, বৈষ্ণব ধর্মে তো উঁচু নীচু ভেদ ভোলার কথা ছিলো, সেখানে ব্রাহ্মন কোথা দিয়ে আসে!) বললেন, আমাদের তা মনে হয় না, একজন বাইজির নামে কেন এই বাঁধের নাম হবে, কৃষ্ণের নাম ও তো লাল, সে থেকেও হতে পারে। আমি এত্ত রেগে গেলাম যে বিয়ে টিয়ে নিয়ে কিসব কথা উঠলো এরপরে ,মানে বাইজিকে বিয়ে করা হয়না বলেই তার ছেলের সম্পত্তি পাওয়া উচিত নয় টাইপের। তো ঋভুকে খামোকা মাতৃশাসিত সমাজ কেমন ভালো ছিলো, সেখানে কত সাম্য ছিলো ইত্যাদি বহু জ্ঞান দান করে দিলাম, বেচারী সেসব কপাত করে গিলে নিলো। কখন কিভাবে ওগরাবে কে জানে! অলরেডি মনু বিয়ে আবিষ্কার করে ছিলো বলে তার চাট্টি পিন্ডি চটকানো হলো। মা কেবল হাঁ করে সেসব দেখলো, আজকাল আমাকে যা ভয় পায়, বলার নয়। কেবল পটকা মনের আনন্দে খানিক ছোটাছুটি করছিলো।

    এরপরে আমরা প্রায় ছুটে মিউজিয়ামে ঢুকলাম। অসাধারন এই মিউজিয়ামটা ভালো করে দেখা হলো না। প্রচুর প্রাচীন মুর্তি, এমনকি পুরানো প্রস্তর, নতুন প্রস্তর যুগের অস্ত্র, গয়নাও রয়েছে। আবার এসে সময় নিয়ে দেখতে হবে। এর ছাদের ঘরে যেতে গেলেই পাশেই বিরাট বালুচরি শাড়ীর দোকানটিও দেখা যাবে। শাড়ী কেনাটাও ডিউ রইলো।

    আর দেখলাম দলমাদল কামান। তিনশো মনের এই কামানটি থেকে একবার ই মাত্র গোলা ছুটেছিলো। সেই গল্পই শুনলাম। তখনকার রাজা বুড়ো হয়েছিলেন। আর নগর তখন বর্গী দ্বারা আক্রান্ত। উপায় না দেখে শ্রী কৃষ্ণ এসে কামানটি থেকে গোলা ছোড়েন যার আওয়াজেই বর্গীরা ভয় পেয়ে পালায়। দল মর্দ্দন মানে শত্রুদমনের জন্য এর ব্যবহার, তাই এর নাম দলমর্দন, পরে যা লোকমুখে দলমাদল হয়ে যায়।

    শেষে আমরা গেলাম ছিন্নমস্তার মন্দিরে। কি ইয়াকি দেখতে। মুন্ডু হাতে নিয়ে নিজের রক্ত খেয়ে ফেলছেন। কেন রে বাপু! একদম ভালো লাগে নি। ডার্ক কিছু আমি মোটে নিতে পারিনা।

    এরপর ফিরে আসার পালা। সকালের ট্রেন ধরতে হলো, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে বলে, এই ট্রেন আসছে পুরুলিয়া থেকে। কাজেই বেশ খানিক ভোগান্তি হল। পরে অবশ্য জায়গা মিলেছিলো। আবার সাঁতরাগাছি( কেন যে ভুল করে এখানে নেমে পরলাম) থেকে ট্যাক্সি নিয়ে তুমুল লড়াই করে বাড়ী ফেরা। কিন্তু সবার বেজায় খুশী হওয়া, এটা বিরাট পাওয়া, যার জন্য এটুকু কষ্ট করাই যায়। মুস্কিল হলো, মাকে বুড়ো বয়সে আমার মতন কথা না শোনা মানুষ বানাতে গিয়ে কেলো হলো এই, যে বাবার একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেলো। এরা কিছুতেই কেউ কাওকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ভাবছি হাতে রইলো ছেলে দুটো, মাকে বাদ্দিয়ে ও দুটোকেই বইয়ে দেব। অবশ্য দুজনে আবার অযোধ্যা পাহাড়ে যাবে বলে রেখেছে, সুন্দরবনের টোপ দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা দেখি।অবশ্য পটকার মা বাপ আর ঋভুর বাপ না এবার বেঁকে বসে।
    (শেষ)
  • Nina | 80.215.4.147 | ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:৩৯642384
  • কিকিয়া দুধ যত জ্বাল দিবি তত ঘন ক্ষীর হবে তেমনই তোর বাবা মার টান -- সবার হয়না যার হয় তার হয় ঃ-)
    বড্ড ভালো লাগে তোর কলমের ঝর্ণাধারা
  • kiki | 53.230.133.199 | ২০ এপ্রিল ২০১৫ ১৩:২৮642385
  • দিদিয়া,'ঝর্ণাধারা যে নয় তা আমিও জানি, কিন্তু তোমার স্নেহটাও দারুন লাগে। অ্যাটলিস্ট তুমি তো পড়লে.............................
  • de | 69.185.236.55 | ২০ এপ্রিল ২০১৫ ১৪:৪৮642386
  • দারুণ ঘুরেছো কিকি - লেখাটাও খুব সুন্দর হয়েছে!

    দুদিন কানেক্টিভিটি ছিলো না - লেখাটা এখনই দেখলাম।

    আবার বেরিয়ে পড়ো!
  • kumu | 11.39.35.115 | ২০ এপ্রিল ২০১৫ ১৫:৪৮642387
  • কিকি খুব ভলো লীডার।চমৎকার লেখা।বলে, শুরু থেকে ৩/৪ বার পড়ে যাই প্রতিটা পর্ব আর এ কয় শুধু নীনা পড়ে।
    নীনাও তো বেড়াতে যায়,লেখে না কেন?
  • kiki | 53.230.133.9 | ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ২১:৩০642389
  • দে, কুমু, শুচিস্মিতা,
    থেঙ্কু। ঃ)

    আমি ফেবু তে ফটো লোডিয়েছিলাম। কিন্তু সাধারনতঃ আমি বেশিদিন অ্যালবাম শেয়ার করে রাখি না। ঃ(

    পিকাসোটা আস্ত থাকলে আবার লোডিয়ে দেব।
  • Nina | 80.215.25.132 | ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:০৫642391
  • কিকিয়ার লেখয় আছে এক চুম্বক -- একেবারে সোজা আটকে যাবে ঃ-)

    অ কুমু, এই পহরায় যদিও গুরু ও চন্ডা৯ দুই ল্যাখে তদিও ল্যাখার মান এত উচু যে আমার লেখার সাহস হয়না গো
    আর হগ্গলে লিখলে পথবে কেডা কও

    আছি আজ এক হপ্তা ধরে বার্কশায়ার মাউন্টেন এ জিমিনিস পিকে
    আমেরিকান দার্জিলিঙ্গ সম ক্ষণে ক্ষণে ঋতু রঙ্গ বদ্ল এই ঝিরিঝিরি স্নো তো পরক্ষনেই রোদ ঝলমল তো এই মেঘপরীরা নেমে এল বারান্দায়
    এ যে বড় রঙ্গ যাদু কি যে কই ভাষা নাই
    কুমু গো তোমারা ল্যাখো আমি পড়ি
  • Nina | 80.215.25.132 | ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:০৮642392
  • অদ্ভুতুরে বানানের জন্যে দায়ী মুঠোফোন
  • aranya | 83.197.98.233 | ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৮:১৭642393
  • দারুণ সব লেখা, খুবই উপভোগ্য
  • kiki | 55.250.51.122 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২০:৪৪642394
  • কালনাঃ

    1.

    কিছুদিন আগে ফেসবুকে বন্ধু সুমেরুর শেয়ার করা একটা পোষ্ট দেখলাম , কালনার কিছু মন্দিরের। তখন ই সেসব ছবি দেখে মাথায় কালনা গেঁথে বসে গেলো।

    আমার মাথায় প্রচুর ক্যাড়াপোকা আছে। তার ঠ্যালায় মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠি, আর বাড়ীর লোকজন তঠস্থ হয়ে যায়। ঐ রে আবার ক্ষেপেছে!! এরকম। তা তাদের বিরক্তি দেখে বড় দুঃখু ও হয়। এই কি আমার আপনার জনেরা!! এরকম। তাই মাঝে মাঝেই একা একা এদিক সেদিক করে বেড়াই বা ফেবুতে হ্যাজাই। তাতে খানিক শান্ত হওয়া যায়।

    প্রচুর সখ ছিলো একসময় যে লাসা, পেরু, মিশরে একা একা ঘুরে বেড়াবো। খুব করে প্রাচীন সভ্যতার গন্ধ নেব। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবো সেই পুরানো রহস্যময় সময়্টাকে। সেসব স্বপ্ন আজকাল আর আসেনা। বাবা বলতেন কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ । আর মানকে বলে ভাবনা না বড় হলে এগোনো যায় না। আর আমি কিনা তথাকথিত মেয়েমানুষদের মতন প্রথমে ড্যাডের, পরে পতিদেবের এবং শেষ বয়সে সম্ভব্তঃ ছেলের অধীনে থাকবো। তাই আর সেভাবে নিজে কিছু ভাবতে পারিনা। এবং চাপে পুরো ঘেঁটে গেছি, তাই যখন যেটা সুবিধা লাগে সেভাবে ভেবে নি। অথচ এই আমিই একসময়ে ভাবতাম, আমার মায়ের মতন কিছুতেই হবনা, নিজে আয় করবো, নিজের মতন ভাবে চলবো, পরাধীনতা আমার জন্য নয়। যাগ্গে, সেসব দিন বহু আগে অতীত হয়ে গেছে। এর পরে ভাবতাম, ঠিক আছে অরুনাচল প্রদেশ, লাদাখ, কেরালা, আন্দামান আর নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এসব তো রইলোই হাতের কাছে। বর্ষাতে মান্ডুর রূপ দেখা যেতেই পারে বা অজন্তার গুহাচিত্র দেখতে যাওয়াটা কি খুব ই এমন কঠিন কিছু!! সময়ের সাথে সাথে সেও মনে হচ্ছে আর বুঝি হলো না। পুরো বিপরীত ভাবনার মানুষের সাথে পথ চলা যে কি কঠিন। তো আমার আবার অত দুঃখী হয়ে বসে থাকা পোষায় না, তো চলো বাংলার ঘরে কি সম্পদ রয়েছে তাই খুঁজি গিয়ে এসব । তাতেই মনে হলো, কালনা যাওয়া যেতেই পারে। বিশেষ করে ছবির টেরাকোটা গুলো দু হাত বাড়িয়ে আমায় ডাকছে।

    এই টেরাকোটার প্রেমে প্রথমে পড়েছিলাম হংসেশ্বরীর মন্দিরে গিয়ে। তাবলে আবার ভাববেন না আমি বিরাট কিছু শিল্প বুঝি। এক্ষেত্রে আমার ঘরের লোকটির একটি বাক্য দিনের পর দিন শুনে মাথায় গেঁথে নিয়েছি এবং মেনে নিয়েছি,"মামের জন্য সুক্ষ কিছু নয়, গোদা ব্যাপার গুলো ই ঠিক আছে।" সত্য মেনে নেওয়াই ভালো। যেটা বলছিলাম, রাজা নৃসিংহদেব রায় ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে স্বপ্ন দেখে এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকের মতে নিজের মায়ের কথা ভেবে। আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রানী শঙ্করী ১৮১৪ সালে এই মন্দিরটি কমপ্লিট করেন। এই মন্দির আর রাজবাড়ীটি একটা পরিখা দিয়ে ঘেরা। রাজবাড়ীটি এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে আর মন্দির টি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দ্বারা এখন সংরক্ষিত হচ্ছে। এর পাশেই রয়েছে অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। অসাধারণ টেরাকোটার কাজের মন্দিরটি দেখেই আমি এর প্রেমে পড়ে যাই। প্রথমে আমার মাকে নিয়ে গেছিলাম, পরের বার এক ননদের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার অনেকক্ষনের জন্য সেখানে ছিলাম। তখন মন্দির বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের অনুরোধে , আমাদের দুজনকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো। এরপরে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা দেখার সৌভাগ্য হলো। কিন্তু আমাদের যে অটোয়ালা নিয়ে ঘুরে দেখাচ্ছিলো, তার তাড়ার চোটে সময় নিয়ে দেখা আর হয় নি।

    যেটুকু টেরাকোটা সম্পর্কে জানি, তা এরকমঃ
    এটি একটি ইটালিয়ান শব্দ, মানে বেকড আর্থ, আমাদের বাংলায় পোড়ামাটি। মাটি ছেনে, কাঁকর ইত্যাদি বেছে, সেই মাটি দিয়ে তৈরী স্ল্যাবে কাজ করা হয়, তারপর সেগুলো রোদে শুকানো হয়। এবং এই শুকনো কাজ গুলোকে ইঁট ভাটির মতন চেম্বারে রেখে আগুন জ্বালা হয়। মোটামুটি ৬০০থেকে ১০০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায়। এই তাতে মাটি পুড়ে শক্ত হয় এবং মাটির মধ্যে মিশ্রিত খনিজ পদার্থের পরিমান বা ভিন্নতা অনুযায়ী এর রঙ কমলা থেকে লাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শেডের হয়। পটারির সাথে টেরাকোটার পার্থক্য হলো পটারি কুমোরের চাকায় ঘুরে তৈরী হয়।টেরাকোটা সম্পুর্ণ হাতে তৈরী। এবং খুব সম্ভবতঃ মাটির মধ্যে থাকা জল সব বাষ্প হয়ে উবে যাওয়ার জন্যই টেরাকোটা পোরাস হয়। কী অসীম ধৈর্য্যে গল্পের রূপ তুলে ধরা হয় ভাবতে অবাক লাগে। কত গল্প যে এই মন্দিরগুলোর গায়ে আঁকা রয়েছে। কী অদ্ভুত না, ভীম বেটকা বা এরকম গুহা গুলোতে আমাদের বহু প্রাচীন অ্যানসেস্টররা এরকম ই তাদের জীবনের গল্প এঁকে গেছিলেন। সাধারণ মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী সব থেকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস এঁকে রেখে যাচ্ছে তাদের ই অজান্তে।
  • kiki | 55.250.51.122 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২০:৪৭642395
  • কালনাঃ

    2.

    কালনা যাবার আগে একটু কালনা নিয়ে নেট ঘেঁটে নিয়েছিলাম। কুঁড়ে মানুষের সাধ্যে যতটুকু কুলায় আর কি। ইতিহাস বলতে শুধু কালনা নয়, মোটামুটি বর্ধমানের ইতিহাস। বেশ ইন্টারেস্টিং। ইতিহাস এত ভালো লাগে এখন, অথচ যখন বাধ্যতামূলক ভাবে ইতিহাস পড়তে হয়েছিলো তখন ঐ বইটা দেখলেই আমার জ্বর আসতো। এত এত মুখস্ত, যা ফাঁকিবাজ মানুষদের পক্ষে বেজায় কষ্টকর। মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষার বিভীষিকাময় সকাল মনে হয় সারাজীবন মনে থাকবে। তার উপর বাবা আবার গল্প বলেছিলেন যে, তিনি নাকি বাইশটা বড় প্রশ্নের উত্তর শেষ মুহুর্তে কোনক্রমে গাঁতিয়ে ছিলেন, আর হলে গিয়ে দেখেন তার একটাও আসেনি। কি করে যে পাশ করেছিলেন সেটা আজ ও ভেবে পান না। মিলিয়ে গুছিয়ে তাদের থেকে নিয়েই উত্তর লিখে এসেছিলেন। আর আমাদের সময় একমাত্র পনেরো নম্বরের প্রশ্নে এসেছিলো গান্ধীজীর অবদান নিয়ে কিছু। এবং যথারীতি এমনকি ইতিহাসেও আমার কোন এক্স্ট্রা পেজ লাগে নি, চারিদিকে পেজ বন্যা বয়ে যাচ্ছে তখন। তা আমি আবার শেষ বাক্যে(মনে হয় বাক্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই) লিখে এলাম ভারতের স্বাধীন হওয়ার অর্ধেক কৃতিত্ব গান্ধীজীর, এই মনে করেই যে গান্ধীজীর সাপোর্টার হলে খুশী হয়ে নাম্বার দেবে আর বিরোধী হলেও বাকি অর্ধেকের জন্য ছাড় দেবে। আর সেই শুনে বাবা বলেছিলেন, করেছিস কি!! সাপোর্টাররা রাগের চোটে তোর নাম্বার কেটে নেবে আর বিরোধীরাও ক্ষেপবে ঐ অর্ধেক কৃতিত্ব দিয়ে দেবার জন্য। সে কি চাপ!! আবার ঋভু তখন পৈলান ওয়ার্ল্ডে। ওদের একজন টিচার এসেছিলেন , যিনি ইংলিশ আর ইতিহাস পড়াতেন। ঋভু-র এই ভাগ্যটা বড় ভালো, বেশ কিছু প্যাশনেট টিচার ও পেয়েছে। তিনি এরিয়ানদের সম্পর্কে গল্প বলে ঋভুকে ইতিহাস ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। ছেলে গোগ্রাসে ইতিহাস গিলতো তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যা যেখানে পেত পড়ে ফেলতো। আমার সেই ছেলেও টেন বোর্ডের সময় ইতিহাস নিয়ে ভয় পেলো। ঐ টিচারের দোষেই। সাবজেক্ট টা তখন ওর কাছে প্রচন্ড ভয়ের।

    সে যা হোক, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনা সাব ডিভিশনের অংশ অম্বিকা কালনা এক সময়ে বন্দর নগরী ছিলো। ভাগীরথীর পশ্চিম পারে অবস্থিত এই মন্দির নগরটির অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারন বর্ধমান সীমান্তে অবস্থিত নগরটি হুগলী ও নদীয়া জেলার সীমান্তের খুব কাছেই অবস্থিত। সেই জন্যই মনে হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাব এখানে বেশ দেখা যায়। তাছাড়া মহাপ্রভু নিত্যানন্দের শ্বশুর বাড়ী ও এখানেই অবস্থিত।
    খুব সম্ভবতঃ এখানকার প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ীর দেবীর নাম অনুযায়ী এর নাম অম্বিকা কালনা হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন এখানকার বিখ্যাত আম বাগান 'অম্বুয়া' থেকে এই অম্বিকা নাম এসেছে। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ফাউন্ডার জেনারেল আলেক্জান্ডার কানিংহামের মতে সপ্তম শতকের তাম্রলিপ্ত রাজত্বের সীমান্ত নগর ছিলো এটি। এখানে ফা হিয়েন ও ঘুরে গেছেন।

    ভুগোল তো হলো, এবার একটু ইতিহাস, পুরো বর্ধমান জেলার রাজাদের ইতিহাসের ছোট্ট এক টুকরো। উইকি থেকে নেওয়া, আগ্রহীরা খুঁজলে আরো তথ্য সেখানে পাবেন।বর্ধমানের মহারাজারা ১৬৫৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। প্রথমে তারা ছিলেন মোঘলদের ডিক্রিধারী জমিদার, মানে নিজের জমি নয়, মোঘলদের দেওয়া জমি নিয়ে থাকতেন ও তাদের কর দিতেন। এবং পরে বৃটিশরাজের ছাতার তলায় একই ভাবে রাজত্ব করেন নজরানা দিয়ে। মোট ৫০০ স্কয়ার মাইল বা ১৩,০০০ স্কয়ার কিলোমিটার ছিলো তাদের জমির পরিমান। এই রাজাদের পুর্বপুরুষরা ছিলেন লাহোরের (পাঞ্জাব) কাপুর বংশের । ভাগ্য অন্বেশনে এই ব্যবসায়ী পরিবার বাংলায় আসে। প্রথম রাজা ছিলেন সঙ্গম রাই। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের পার্মানেন্ট সেটলমেন্টের আওতায় এসে এঁরা জমির মালিকানা পান। ফলে এরা রাজা, মহারাজা এই শব্দ গুলো ব্যবহার করলেও চেম্বার অফ প্রিন্সে এদের নাম নেই। এদের রাজারা এরকম ভাবে পর পর ছিলেনঃ

    মোঘল আমলে--

    সঙ্গম রাই-- বঙ্কু বিহারী রাই-- আবু রাই-- বাবু রাই-- ঘনশ্যাম রাই-- কৃষ্ণরাম রাই-- জগত রাম রাই-- কীর্তিচাঁদ রাই-- চিত্রসেন রাই-- ত্রিলোকচাঁদ রাই

    বৃটিশ জমানা থেকে স্বাধীন সময় পর্যন্ত রাজারাঃ

    তেজচন্দ্র-- মহতাব চাঁদ বাহাদুর-- আফতাব চাঁদ মহতাব-- বিজয়চাঁদ মহতাব-- উদয়চাঁদ মহতাব --সদয়চাঁদ মহতাব এবং প্রনয়্চাঁদ মহতাব

    এখানে কিছু কনফিউসন আছে, অনেক জায়গায় ই উল্লেখ রয়েছে অম্বিকা কালী মন্দিরটি চিত্রসেন রাই প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ওনার রাজত্বকাল ১৭৪০-১৭৪৪। এবং মন্দিরটির প্রতিষ্ঠার সময় অনেক জায়্গায় ই রয়েছে ৬৮৮ সাল এবং ঋষি অম্বরিষ তার প্রতিষ্ঠাতা। মনে হয় ঋষি অম্বরিষ প্রথমে ঘট পুজো করতেন, তার পরে সম্ভবতঃ চিত্রসেন মন্দিরটির সংকার করেন এবং এক কাঠের (নিম কাঠ) বামাকালি মূর্তিটি বানান।

    বঙ্কু বিহারী রাইয়ের সময় এখানে শের আফগানের সাথে মোঘলদের লড়াই বাধে। বাংলা চিরকাল ই ভারতবর্ষের একটি একটেড়ে জায়গা এবং দিল্লীকে বড় বেগ দেয়। সে মহাইরা বাংলার লোকজনকে যতই সিউডো লিবারাল ইত্যাদি বলে গালি দিন না কেন, এ বরাবরই একটু আলাদাই তার স্বদেশভক্ত ভাইবোনেদের থেকে। (একটু সিনিকাল হয়ে গেলো কি? হোগ্গে) তখন ই শের আফগানের সুন্দরী বেগম মেহেরুন্নিসাকে নিয়ে যাওয়া হয় মোঘলদের হারেমে। জাহাঙ্গীরের বিবি হন তিনি, এবং তার নাম দেওয়া হয় নূর জাঁহা বা জগতের আলো, এতই রূপসী ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে এরকমটা লাগে, সুন্দর হওয়া বুঝি কার্স, কাশ্মীর যদি এত সুন্দর জায়গা না হত, তাহলে হয়ত সেখানকার মানুষ একটু শান্তিতে থাকতে পেত। আর একটা ঘটনা মনে পরে গেলো, আমরা লেক মলের পাশ দিয়ে আমার এক ননদের বাড়ী যাচ্ছিলাম, তখন একটা বিকট চিৎকার শুনে চমকে যাই, আর্ত চিৎকার আক্ষরিক অর্থেই। ঋভু আবিষ্কার করে একটা বাড়ীর তিনতলার চিলেকোঠায় একটা ম্যাকাও ঐ চিৎকার করছে আর বেচারা প্রানপনে মুক্ত হবার চেষ্টায় রয়েছে, পাশের গাছে কাক , শালিখের হুড়োহুড়ি সে সইতে পারছে না। তখন ঋভু খুব দুঃখিত হয়ে বলেছিলো, মা , বেচারা যদি অত সুন্দর না হত।।।।।।।।।।।।

    চিত্রসেন রাইয়ের সময়ে বর্গী হানা ঘটে। এই হলো মোটামুটি এখানকার ইতিহাস। কাজেই এখানে কখন কখন ও মন্দিরের মাথায় গম্বুজের মতন দেখা যাবে। এবং আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, মুসলমান, খ্রীষ্টান , হিন্দু তিন ধর্মের লোকজন বেশ গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই ছিলো অনেকদিন ধরে, এবং সুশাসনের জন্য হয়তো তেমন বড় কোন ধর্মীয় গন্ডোগোল এখানে হয়নি। অন্ততঃ আমি তেমন উল্লেখ কোথাও পেলাম না। উল্টে হিন্দু সাধকদের দেখলাম ধর্মের গোড়ামি যাতে না আসে সেই প্রচার তাঁরা সহজ ভাবে করে গেছেন। আর শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর তো প্রভাব ছিলোই।
  • Prativa Sarker | ০৭ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:৩৫642396
  • খুব ইন্টারেস্টিং লেখা। পরের কিস্তির অপেক্ষায়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন