এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  ছবি

  • ছবির গল্প

    Ishani
    ছবি | ১২ আগস্ট ২০১৩ | ২১৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ishani | 233.239.152.30 | ১২ আগস্ট ২০১৩ ১০:১৩620078
  • মুখবন্ধ
    .................

    ছবি আঁকি না আমি . একটু মিথ্যে কথা বলা হল . আঁকতে পারি না . এ নিয়ে প্রচুর হীনমন্যতা আমার . স্কুলে পড়তাম যখন , বিচ্ছিরি নম্বর , কিঞ্চিত নিগ্রহ এসব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক. এরপর বিজ্ঞানের বিষয় আশয় , ছবিটবি এঁকেছি বটে বা ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রইং , তবে তা আর যাই হোক "ছবি" আঁকা নয় . মেপেজুপে কিছু সরলরেখা বক্ররেখার কারিকুরি . ছবিটবির জগত সযত্নে পরিহার করি . ভালই আছি . হঠাত বরাত পেলাম ভাষান্তরের . ডাচ চিত্রী ভিনসেন্ট ভ্যান গখ .জীবনের বিচিত্র টানাপোড়েন . "লাস্ট ফর লাইফ". লিখতে বসে দেখি, ভাষান্তর তো করছি দিব্যি, কিন্তু উপলব্ধির খাতায় যে বেবাক ফাঁকি ! কিছুই জানি না . কী এঁকেছেন , কী ভেবেছেন, কীভাবে চোখ মেলে দেখেছেন...লিখছি, কিন্তু নিজের কাছে নিজের এক অদৃশ্য দায়বদ্ধতা . না জেনেই, না বুঝেই শুধুই কি লেখার জন্য লেখা ? তখন আমার শরীরে নতুন কলেজের গন্ধ . আর ঝোলা ব্যাগে বইপাড়ার পুরনো বইয়ের গন্ধ নিশ্চিন্তে সহাবস্থান করে . খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই সামান্য দামে চিত্রীর আঁকা ছবির বই . পুরনো , কিন্তু পাতা উল্টাতেই চোখ ধাঁধিয়ে দেয় উজ্জ্বল সতেজ হলুদ সূর্যমুখীর দল. আমি প্রেমে পড়ে যাই. এই অস্থিরমতি , প্রায়- উন্মাদ শিল্পীর . একদিকে বই পড়ে জানছি, কী নিদারুণ দু:সহ কষ্টের জীবন , অন্যদিকে ছবি দেখে ভাবছি...সত্যি সত্যি কি খুব কষ্টে থাকলে এমন ছবি আঁকা যায় ? নাকি সত্যি খুব কষ্টে থাকলেই এমন ছবি আঁকা যায় !
    ধীরে ধীরে জীবন এগোয়. গল্প এগোয়. আসে পারী পর্ব. এই সেই পারী. শিল্পীদের স্বর্গ. আবার বিফল জীবন যখন, সে এক রৌরবও বটে . পেটে জন্মের খিদে নিয়ে শিল্পচর্চা ? আমি ডুবে যাই ভ্যান গখ ছাপিয়ে পিসারো , সিউরা , মোনে, মানে, সিসলে , লোত্রেক , সেজান , গগ্যাঁয় . বাদ যান না দেলাক্রোয়া , বতিচেলি , রেনোয়া বা রেমব্রাঁও . আমার যাত্রা শুরু হয় . অন্য এক আলোর জগতে .
    ছবি আঁকতে পারি না ? তাতে কি ? ভালো তো বাসতেই পারি . জানতেই পারি..কিছু কিছু কথা..এঁদের চিন্তা ভাবনা আলাপচারিতার মাধ্যমে . ইম্প্রেশনিজম থেকে পোস্ট ইম্প্রেশনিজম ....এই আলোছায়ার জগত, রঙিন আলপনা যেন..আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে আজও .
    ছবি দেখেছি..বইতে, আন্তর্জালে, প্রিন্টে , এমনকি বিভিন্ন গ্যালারিতেও . যতবারই দেখেছি , ততবার মনে পড়েছে টুকরো কথা , নানা ঘটনা..যা জেনেছি লেখার মাধ্যমে, চিঠিপত্র পড়ে . তাই এমনই কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি আর সংলাপ...ভাগ করে নেওয়া..কয়েকটি পর্বে... সকলের সঙ্গে.

    প্রথম পর্ব
    .................

    প্রভু, অন্ধ হয়ে যাই...
    ......................................

    যেহেতু বিদেশী ছবির জগতে ভ্যান গখের হাত ধরে প্রবেশ করেছিলাম, তাই ভ্যান গখকে দিয়েই শুরু করা ভালো.

    সারা ইওরোপকে উত্তাল করে ১৮৭০-১৮৮০তে শিল্পের দুনিয়ার দখলদারি নিতে এসেছিল ইম্প্রেশনিজম . একদল নবীন যুবক . আস্তানা পারী নগরী . তারা চঞ্চল , তারা উদ্দাম , হাতে রং আর তুলি . চোখে উজ্জ্বল আলোর স্বপ্ন . "ইম্প্রেশন , সানরাইজ ". শিল্পী ক্লদ মোনে . এই শুরু ইম্প্রেশনিজমকে জনসমক্ষে উপস্থাপনার. ছবি দেখে শিল্প সমালোচক লুই লেরয় খবরের কাগজে একটি তির্যক সমালোচনা করেছিলেন , ব্যবহার করেছিলেন এই শব্দটি.. "ইম্প্রেশনিজম".
    ইম্প্রেশনিজম রীতিটির বৈশিষ্ট্য হল অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট পাতলা, সূক্ষ্ম অথচ দৃশ্যমান তুলির টান , উন্মুক্ত কম্পোজিশন ,সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলোর রকমফেরের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া ..এবং তা একেবারে নিখুঁত দক্ষতায়. এই যে ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে দুপুর পেরিয়ে আসে গোলাপী গোধূলি, মিশে যায় রাত্রির ঘন নীল রঙে...এই আলোর মায়া ধরে রাখা...ক্যানভাসে .সাধারণ, রোজের বিষয়বস্তু. আমরা যা দেখি..কিন্তু মনে দাগ কাটে না..তাকে এক অন্য আঙ্গিকে অন্য আলোয় উপস্থাপন করা. ইম্প্রেশনিজম সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে দেখার চোখকে অন্য মাত্রায় অন্য উত্তরণে সামিল করা যায়. আর পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম . ঠিক এর পরের পর্যায়ে আলোছায়ার খেলা আছে. কিন্তু তাতে অন্য কিছু পরিণতমনস্কতা অন্যতর মাত্রা সংযোজিত করেছে . ভ্যান গখের ছবি যেমন.

    " লোকের চোখে আমি কী ? স্রেফ একটা বাতিল জঞ্জাল , পাগল , দেখলেই বিরক্তি এসে যায়. সমাজে কোনো সম্মানজনক জায়গায় নেই. থাকবেও না কখনো. একেবারে কীটস্য কীট . আমি ..আমি একদিন সব্বাইকে দেখিয়ে দেব এই অস্থির উন্মাদ সত্তা নিয়ে বেঁচে থেকেও কী প্রবলভাবে বেঁচে থাকা যায় ! আমি ডুবে যাই দু:খে, ব্যথায় ..তবুও ভেতরে যে কী অদ্ভুত এক আলোর মতো প্রশান্তি... সব কিছু সুরে বাজে, তাল লয় ভঙ্গ হয় না . আমি ছবি দেখতে পাই জীর্ণ কুটিরে , নোংরা আবর্জনার গাদায়. আমার মন ছুটে চলে যায় সেই অদেখা আলোর দিকে . আমি আঁকার স্বপ্ন নিয়ে থাকি. আমি স্বপ্নে রং ছড়াই সাদা ক্যানভাস জুড়ে. "
    এই ভিনসেন্ট. ছবি আঁকা শুরু ,বয়স তখন বিশের কোঠার শেষে . ছবি আঁকার মেয়াদ কতদিনের ? বছর দশেক. তার মধ্যে এঁকেছেন ২১০০ -র বেশি ছবি. আছে ৮৬০ টি তেল রঙের কাজ, ১৩০০-রও বেশি জলরং .এবং বেশিরভাগ কাজই জীবনের শেষ দু'বছরে. চলেই তো গিয়েছিলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ! এছাড়া কাঠকয়লার কাজ , পেন্সিল স্কেচ. ফিরে ফিরে এসেছে সেল্ফ পোর্ট্রেট, স্টিল লাইফ, ল্যান্ডস্কেপ . এসেছে সাইপ্রেস কুঞ্জ, সোনালী শস্যক্ষেত , সূর্যমুখী আর অন্যান্য ফুল-ফল. প্রথম ছবি আঁকা শুরু বরিনেজে, কয়লাখনি অঞ্চলে. প্রথম বিখ্যাত ছবি "দ্য পটেটো ইটার্স."তখন ছবিতে শুধুই কালো আর মেটে রং , ম্লান. সেই খুনখারাপি রঙের বাহার নেই . থাকার তো কথাও নয়. কারণ তখন যে ভিনসেন্ট নিজেকে খুঁজেই চলেছেন. ডাচ চিত্রী ভিনসেন্ট এবার অস্থির . এভাবে তো কিছুই হয় না. ছবি আঁকা চলছে...কিন্তু আত্মার আরাম কই ? চঞ্চলতা বেড়েই যায় ক্রমাগত. কোথায় যাওয়া যায় ? নিজেকে খুঁজে পেতে ? চল পারী . সঙ্গী থিও , ছোট ভাই আর অভিন্নহৃদয় সখা.

    এবার গল্পের শুরু .

    পারী. স্বপ্নের দুনিয়া. শিল্পী সাহিত্যিকদের স্বর্গ. থিও আর ভিনসেন্ট পারীতে . থিও নাম করে ইম্প্রেশনিস্টদের . মোনে, দিগা, পিসারো, মানে . ভিনসেন্ট তো এদের নামই শোনেনি ! থিও ভিনসেন্টকে নিয়ে যায় এদের ছবি দেখাতে . দুজনে গ্যালারিতে .
    থিও চাপা হেসে বলে, " যাও, বারান্দায় গিয়ে ছবিগুলো দেখে এস. আমি এখানেই আছি."
    " থিও, তুমি হাসছ কেন ?"
    "যাও, দেখে এস..."

    ভিনসেন্টের দু'টি চোখ বুঝি অন্ধ হয়ে যায় ! শৈশব থেকে সে ছবিতে মজে আছে. সে চেনে ঘন গম্ভীর রং, তুলির বলিষ্ঠ টান , রুক্ষতা এড়িয়ে চলা , এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া...কিন্তু এ কী ! যুগ যুগ ধরে ঘন বাদামী রঙের প্রলেপ মেখে ইওরোপের ছবির জগত নিত্য স্নান করেছে , সেই রং কোথায় ? সেই ছায়াময় শিল্পের মাধুরী নির্মম হাতে ছিঁড়ে খুঁড়ে ছিনে ধুনে ধুলোয় লুটিয়ে দিল কারা ? সব ছবিতে শুধু জেগে আছে কী ভয়ংকরভাবে সূর্যস্নাত রং মাতাল দৃশ্য সব !
    প্রথম ছবি...ব্যালে নাচের . উজ্জ্বল লাল-নীল-সবুজের ঝমঝমানি . মেয়েদের চোখে মুখে নির্লজ্জ স্পষ্টতা . শিল্পী দিগা .
    পরের ছবিতে নদীতীর . প্রগলভ শিল্পী ছড়িয়ে দিয়েছেন সূর্য, বসন্ত আর আকাশের রং . ছবির রেখায় রেখায়. মোনে. এতদিন সবাই যাকে হালকা রং বলে ভাবত, মোনে দেখিয়ে দিয়েছেন, সেটাই ছবির গভীরতম রং.
    পরের ছবি . ছোট্ট একটা নৌকো. একটিমাত্র লোক. গায়ে পশমী শার্ট, হাতে দাঁড়. পাশে নিবিষ্টমনা স্ত্রী. ছুটির দিনের খুশি ছড়িয়ে আছে. শিল্পী : মানে . আরও দুটো ছবি আছে মানের . প্রান্তরে পিকনিক আর অলিম্পিয়া . দর্শকরা নাকি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল এই ছবি দেখে ! মানের ছবি দেখে ভিনসেন্টের কেন জানি মনে পড়ে সাহিত্যিক এমিল জোলার কথা. দুজনেই চিন্তাধারায় বৈপ্লবিক, সত্যনিষ্ঠ. অঙ্কনশৈলীজাত সম্পূর্ণতা নেই কোনো ছবিতে, কিন্তু আভাসে কী অসামান্য পরিপূর্ণতা !
    ঠিকই তো ! প্রকৃতিও তো সব কিছু একসঙ্গে উজাড় করে বলে দেয় না. আমরা আভাসটুকু নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকি ! প্রতিটি ছবিতেই উজ্জ্বল রোদ্দুর, খোলা আকাশ..শরীরে যেন বয়ে যায় হিমেল বাতাস...একটু কি শিরশিরিয়ে ওঠে গা ?
    ভিনসেন্ট মাতালের মত টলতে টলতে সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছিল. পারীর পথে পথে . ফিরে এসে ছ' বছর ধরে আঁকা ছবিগুলো বিছিয়ে দিয়েছিল মেঝেতে . এত রং, এত পরিশ্রম, এত সময়...সব নষ্ট হয়ে গেল ! ভিনসেন্টকে তখন থিও বলেছিল, ' তুমি থেকো তোমার মতোই . নিজস্বতা নিয়ে . ইম্প্রেশনিস্টদের থেকে শিখে নাও শুধু আলো আর রঙের খেলা. অন্ধ অনুকরণ করবে কেন ? তুমি যে তুমিই. তোমার চেতনা, স্পর্শ , অনুভবের সূক্ষ্মতা ছড়িয়ে দিও নিজের মতো করে . তুলির টানে. পেন্সিলের আঁচড়ে . তোমার ছবিতে আনো সূর্যের উজ্জ্বল বিভা , আনো আকাশের মুক্তি . ক্যানভাস ভরিয়ে দিও তোমার অবরুদ্ধ আর অবদমিত যত আবেগের রঙে ."

    "এখন আমি তারা ঝিলমিল আকাশ আঁকতে চাই. রাতের সৌন্দর্য, অন্ধকারের আলো অনেকই বেশি , দিনের শোভার চেয়ে. আমি দেখি তো...হরেকরকম বেগনী , নীল আর সবুজের বাহার .তুমিও চেষ্টা করে দেখো. দেখবে কোনো কোনো তারা যেন একটু বেশি লেবু রং ঘেঁষা হলুদ , কোনটিতে ঝিনুকের গোলাপী আভা, কোনটি কেমন ঝিমধরানো নীলাভ . শুধু কালচে নীল ক্যানভাসে সাদা বিন্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেই কি আর রাতের আকাশ আঁকা যায় ?"

    (প্রথম পর্ব সমাপ্ত )

    দ্বিতীয় পর্ব.
    .....................

    প্রথম আলো
    .....................

    ভিনসেন্ট ভ্যান গখ আর তুলোস লোত্রেক . আগে খুব সংক্ষেপে বলে নিই লোত্রেক সম্পর্কে.

    লোত্রেক . আক্ষরিক অর্থেই মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম . বাবা "কাউন্ট " খেতাবধারী . বাবা মা বিবাহবিচ্ছিন্ন হবার পর আট বছর বয়স পর্যন্ত ধাত্রী , তারপর আবার মায়ের জিম্মায় . মা নিয়ে আসেন পারীতে . স্কুলের খাতায় স্কেচ , ক্যারিকেচার, অজস্র আঁকিবুকি . বা: , বেশ হাত তো !

    বাবা মা ছিলেন "ফার্স্ট কাজিনস" . ফলে কিছু জেনেটিক ত্রুটি . শরীরের বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয়. বয়স মাত্র ১৩ , ডান উরুর হাড় ভেঙে গেল . ১৪ বছরে বাঁ পায়ের . ঠিকঠাক জুড়ল না. এই অস্থিদৌর্বল্যজনিত ব্যাধিটির নাম তাই " তুলোস লোত্রেক সিন্ড্রোম ". পায়ের বৃদ্ধি বন্ধ. তাই পূর্ণবয়স্ক লোত্রেক আশ্চর্যজনকভাবে খর্বকায় . অথচ শরীরের উপরিভাগ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক .

    এভাবে কি পারা যায় ? স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে ? লোত্রেক তাই ডুবিয়ে দেন নিজেকে . ছবির জগতে . পারীর বোহেমিয়ান জীবনযাপন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর তুলির জাদুতে.

    "ছবি আঁকব ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত. তারপর শুধু ক্যানভাস শুকোনোর পালা."

    "তুলোসের মন পড়ে থাকে মমার্তে . এ যে শিল্পীর স্বর্গ ! এই সময় বন্ধুত্ব হয় এমিল বার্নার্ড আর ভিনসেন্টের সঙ্গে . শিক্ষাগুরু করমেন. তিনি আবার অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী. ছাত্র ঘুরে বেড়ায় অলিতে গলিতে . ছবির রসদ খুঁজে পেতে. তুলোস আঁকেন এক বারবনিতার ছবি. এভাবেই পারীর গণিকারা বারবার উঠে এসেছে লোত্রেকের ছবিতে. ক্যানভাসে জায়গা পেয়েছে মমার্তের ল্যান্ডস্কেপ. মুল্যা রুজ . সেই বিখ্যাত কাফে ও ক্যাবারে . লোত্রেক সাজিয়ে দেন নিজের আঁকা পোস্টার দিয়ে . এখানে পরবর্তীকালে তাঁর বহু ছবি প্রদর্শিত. গায়ক ইভেত গিলবার্ট থেকে ক্যানক্যান নৃত্যের পথিকৃত লুইস ওয়েবার . তুলোস আঁকেন সুহৃদ অস্কার ওয়াইল্ডের ছবিও.

    লোত্রেককে কত লোক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে. চেহারা নিয়ে. সুরা ছাড়া আর কি আছে ? আশ্রয় ? নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল সেই বিখ্যাত ককটেল "আর্থকোয়েক". লোত্রেক বানিয়েছিলেন প্রথম .. সমপরিমাণ আবসাঁত আর কনিয়াক মিশিয়ে.
    কিন্তু এভাবে কতদিন ? এর সঙ্গে কি সিফিলিসের জীবাণু বাসা বাঁধল শরীরে ? সুরার নেশা এতই বিষম বস্তু যে হাতের ফাঁপা লাঠির অভ্যন্তরেও সুরা !

    মাত্র ৩৬ বছর বয়সে চলে গেলেন লোত্রেক . শোনা যায় , বাবার উদ্দেশ্যে শেষ কথা বলেছিলেন , "আমি জানি, এ মৃত্যু তোমার কাছে কোনো নতুন অভিঘাত আনবে না ."

    ছবি আঁকার সময়কাল ? ২০ বছরেরও কম . আছে ৭৩৭ টি ক্যানভাস , ২৭৫ টি জলরং , ৩৬৩ টি প্রিন্ট ও পোস্টার , ৫০৮৪ টি ড্রইং , কিছু সিরামিক আর স্টেইনড গ্লাসের কাজ . কত কাজ যে হারিয়েই গেছে ! লোত্রেকের ছবিতে প্রভাব দেখা যায় মানে আর দিগার . এমনকি জাপানী উড প্রিন্টের প্রভাবও স্পষ্ট . তাঁর নারীর অবয়বে মানের নারীদের দেহের আদল, বা দিগার ব্যালে নর্তকীদের বিভঙ্গ . লোত্রেকের ক্যানভাসে মানুষ এসেছে তাদের কাজের পরিবেশে , এসেছে রাতের পারী নগরীর প্রেক্ষাপটে . কিছু অবয়ব আবার শুধুই সিল্যুয়েট . লম্বা, সরু সরু তুলির টানে এমনই সে সব ছবি , যে ছবিতে রঙের স্তরগুলি যেন স্বচ্ছ ; তার ভেতর দিয়ে ক্যানভাসের জমি ভেসে ওঠে .

    " আমাদের সময়ে আমরা নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেম. নিজেদের মূল্যবোধ আর তার যাথার্থ্য প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম এই নবীকরণের মাধ্যমে. আমরা কি নিজেদেরই প্রবঞ্চনা করেছিলাম ? কী জানি !"

    " প্রেম তো তখনই সম্পূর্ণতা পায় , যখন কেউ তোমাকে কামনা করুক..এই আকাঙ্ক্ষা এতই তীব্র হয়ে ওঠে যে তোমার মনে হয় ..সেই আকুতির যন্ত্রণায় যদি মৃত্যুও আসে...ক্ষতি কী !"

    এবার আবার ফিরে যাই কথোপকথনে.

    " আপনার নামটি জানতে পারি ?"
    "ভ্যান গখ. আপনার ?"
    " অঁরি তুলোস লোত্রেক .."

    লোত্রেককে ভালো করে নজর করে ভিনসেন্ট . চ্যাপ্টা মাথা , ভারী নাক, মুখ , চিবুক. গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি .

    " বুঝলে ভিনসেন্ট, কেন যে করম্যানের স্টুডিওতে এসে জুটলাম. ! গত মাস থেকে মমার্তের একটা পতিতালয়ে আছি . সব ক'টা মেয়ের পোর্ট্রেটএঁকেছি . ওটাই আসল কাজ. এখানে এই খুটখুট করে স্কেচ করা ! দূর দূর..ও তো ছেলেখেলা ! "
    " ওই মেয়েদের স্টাডিগুলো দেখা যায় না ?"
    " দেখাবো . সকলে ভাবে, আমি পাগল. কারণ নাচঘরের মেয়ে , পতিতা, ভাঁড় ..আমি খালি এদের আঁকি. কিন্তু জানো , সত্যিকারের চরিত্র ওদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে. সেদিন আমায় করম্যান কী বলেছেন জানো ? আমার ছবি নাকি অতিরঞ্জনের ঠ্যালায় ভাঁড়ামিতে পৌঁছে গেছে ."
    "তুমি নির্ঘাত বললে, ওটা অতিরঞ্জন নয়. ওটাই চরিত্র."
    লোত্রেকের ঝকঝকে কালো চোখের তারায় নতুন আলো ফুটে উঠল কি ?
    " আমার আঁকা মেয়েদের ছবি দেখবে ভিনসেন্ট ? সত্যি ? নাকি নিছক ভদ্রতা ?"
    ভিনসেন্ট হাঁটে নতুন বন্ধুর সাথে . কোমর পর্যন্ত স্বাভাবিক..পা দুটো ? কী শীর্ণ !
    " ভিনসেন্ট, তুমি শুনবে না, আমার পা দুটো এমন কেন ?"
    "থাক না লোত্রেক , নাই বা বললে !".
    " দূর, সব্বাই জানে . জন্মেইছিলাম অপুষ্ট হাড় নিয়ে. ১২ বছর বয়সে নাচঘরের মেঝেতে পরে গিয়ে ডান উরুর হাড়, তারপর পরের বছর খাদে পড়ে বাঁ উরু ..."
    "খুব কষ্ট তোমার...না?"
    " আরে না . ধরো , চেহারাটা যদি ঠিকঠাক হত .তাহলে কি আর ছবি আঁকতে পারতাম ? বাবা তুলোসের কাউন্ট . তাঁর মৃত্যুর পর ওই খেতাব আমাতেই বর্তাবে. পা থাকলে কী হত ? ফ্রান্সের রাজার পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে পারতাম . কিন্তু সে রাজাও নেই, আমার পা -ও নেই . সুতরাং আমার ছবি আঁকা বন্ধ করে, সাধ্যি কার ? আর শিল্পী হতে পারলে কি কেউ কাউন্ট হতে চায় ?"

    লোত্রেকের আস্তানায় ভিনসেন্ট. গাদা গাদা ক্যানভাস. ফ্রেম, টুল . ছড়িয়ে আছে মদের বোতল , ডিক্যান্টার , গ্লাস. টেবিল উপচে পড়েছে মেয়েদের জুতো , কাঁচুলি, দস্তানা, স্কার্ট , মোজা, নকল গয়না আর অশ্লীল ফোটোগ্রাফে . এর সঙ্গে আবার একগোছা চমত্কার জাপানী ছবির প্রিন্ট !

    " জানো ভিনসেন্ট , এ বাড়িতে মোট ২৭ টা মেয়ে আছে. প্রত্যেকের স্কেচ করেছি আমি. এক ছবিওয়ালা আমাকে সেদিন বলল, ' লোত্রেক , যা কিছু কুশ্রী , তোমার তাতে এত আসক্তি কেন ? এই সব মেয়েদের মুখে পাপের ক্লেদ. এই কি আধুনিক শিল্প? যা কিছু সুন্দর, মাধুর্যময়..তা কি তোমরা আর দেখতে পাও না ? ' আমি বললাম , " আপনার কথা শুনে, ইস, আমার কেমন বমি আসছে . আমি যাই. আপনার কার্পেটটা বড় সুন্দর. নোংরা করা ঠিক হবে না ."

    দু'হাতে পানীয়র গ্লাস তুলে ধরে লোত্রেক বলল, " অসুন্দরের জয় হোক !"

    মমার্তের ২৭ টি গণিকার স্কেচ এঁকেছে লোত্রেক. ভিনসেন্ট দেখছিল. ছবির মৌলিকত্ব তার বাস্তবতা. শিল্পীর সার্থকতা এইখানেই, যে সে যা দেখেছে , তাই এঁকেছে . রুচিবোধ, নীতিকথা দিয়ে ছবির স্বচ্ছতাকে আবিল করে তোলা হয়নি. প্রতিটি ছবিতে ফুটে আছে কামুকতা, লাম্পট্য আর শরীর সর্বস্বতা ! আছে অন্তহীন অভাব আর অনাসক্তির রূপ.

    " তোমার ভালো লাগছে ভিনসেন্ট ?"
    " খুব. এ তো নগ্ন সত্য যে জীবন, তার ছবি. সৌন্দর্যের চরম প্রতীক. তুমি যদি এদের মুখে আদর্শ আর নীতির মুখোশ পরাতে, তাহলেই তা অসুন্দর আর অসত্য হত. আমার কেমন যেন দ্যমেয়ারের কাজ মনে পড়ছে ."

    জ্বলে উঠেছিল লোত্রেকের চোখ .
    " ঠিক দ্যমেয়ার . জীবনে যদি কিছু শিখে থাকি, তা ওই একজনের কাছ থেকে. ঘৃণা করার কী তীব্র ক্ষমতা ছিল লোকটার !"
    " একটা কথা বুঝি না, লোত্রেক . যাকে ঘৃণা করব , তাকে আঁকব কেন ? যাকে ভালোবাসি , তাকেই তো আঁকতে ইচ্ছে করে."
    " না. মহৎ যা কিছু শিল্প, তার জন্মই ঘৃণা থেকে ."

    ভিনসেন্ট প্রতিবাদ করেনি. কিন্তু ভাবছিল . খুব ভাবছিল . শুধুই ঘৃণা ? তীব্র যন্ত্রণা থেকেও কি নয় ?

    ( দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত )
  • de | 190.149.51.68 | ১২ আগস্ট ২০১৩ ১৮:২৫620088
  • সুন্দর হয়েছে --
  • Lama | 126.193.136.218 | ১২ আগস্ট ২০১৩ ২০:০৬620089
  • খুব সুন্দর! এঁদের সম্পর্কে অনেকেই লিখেছেন কিন্তু ঠিক এইরকম করে লেখা একটাও পাই নি, বিশেষতঃ বাংলায়। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল ঠিক এইতকম করে কেউ বাংলায় লিখুন।

    আরো পর্ব আসছে আশা করি।
  • nina | 22.149.39.84 | ১২ আগস্ট ২০১৩ ২১:৩৪620090
  • খুব সন্দর লেখা----অন্যভাবে আঁকা ছবির ছবি!
  • Ishani | 233.239.152.244 | ১৫ আগস্ট ২০১৩ ১১:৩৯620091
  • তৃতীয় পর্ব
    .....................

    বিন্দুর বর্ণালী
    ...................

    " চিত্রকলার মূল বস্তুটি রং নয় , আলো. বস্তুর কোনো নিজস্ব রং নেই . তার ওপর আলো পড়ে যে রং ফুটে ওঠে , তাই তার প্রকৃত রং . সেই রংকে আবার অসংখ্য বর্ণ-বিন্দুতে ভাগ করা যায় ".

    জর্জেস পিয়ের সিউরা . পয়েন্টিলিজম -এর জনক.

    এইসব শিল্পীরা এত স্বল্পায়ু কেন ? সিউরা . জীবনের মেয়াদ মাত্র ৩১ টি বসন্ত ! প্রথম ছবি আঁকতে শেখা অঁরি লেম্যানের কাছে . ঠিকঠাক নিয়ম মেনে রং, তুলি, ক্যানভাসে . নামী দামী ছবির নকল করে করে হাত পাকানো .

    প্রথম উল্লেখযোগ্য ক্যানভাস " Bathers at Asnieres”. এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ সীন নদীতে . পারীর সন্নিকটে এক মফস্বলী অঞ্চল . খেটে খাওয়া সাধারণ জীবন তাদের . যদিও এই ক্যানভাসে সিউরা স্পষ্টই প্রভাবিত ইম্প্রেশনিজম -এর রং আর আলোর ব্যবহারে , আমরা কিন্তু নজর করলে দেখতে পাই কী নিখুঁত রেখে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অবয়বগুলি. আর কী মসৃণ আর সরলীকৃত বিন্যাসশৈলীতে .এ যেন কোথায় মনে করিয়ে দেয় চিত্রকলায় সেই প্রাচীন ভাবধারার পুনরভ্যুদয়কে. কিন্তু পারীর বাত্সরিক চিত্রকলা প্রদর্শনী এটিকে গ্রহণ করতে অপারগ.

    এবার তাহলে নতুন কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাক. পয়েন্টিলিজম . " A Sunday Afternoon on the island of La Grande Jette “. বিস্তীর্ণ পার্ক . তাতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ . বিভিন্ন বিনোদনে ব্যস্ত. ছোট্ট ছোট্ট বিন্দু..ঘনসন্নিবিষ্ট , বিভিন্ন রঙের বিন্দু এমনভাবে সাজানো, যে আলো পড়লে রঙের রকমফের বোঝা যায় চমত্কারভাবে. আলাদা করে রঙের সঙ্গে রং প্যালেটে মিশিয়ে নতুন আভা আনতে হয় না ! এই ক্যানভাসটি ছিল ১০ ফুটের . শেষ হয়েছিল দু' বছর পর. এটি আঁকার আগে পার্কে বসে প্রাথমিক পর্যায়ের স্কেচ হয়েছিল অন্তত ষাটটি . এছাড়াও আছে সঙ্গিনীকে মডেল করে আঁকা ছবি " Jeune femme se poudrant” . ৪ টি অন্য ক্যানভাস, যাতে আছে The channel of Gravelines , Petit Fort Philippe . এরপর ৮ টি তেলরঙের প্যানেল আর কিছু ড্রইং . সিউরা নিজে রঙের ভাষা তৈরী করেছিলেন . রেখা, রঙের তীব্রতা আর রঙের ব্যবহারের প্রণালী নিয়ে চিন্তাভাবনা করে . এই পদ্ধতিটি স্বীকৃতি পেয়েছে " Chromoluminarism” নামে.

    সিউরার ভাষাতেই বলি, " শিল্প মূলত সমন্বয় ও সঙ্গতি . সদৃশ ও বিসদৃশ উপাদানের. তাতে আছে রং আর রেখার প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহার . আলোর যথাযথ প্রভাবে . কখনো তা প্রকাশ করে আনন্দ , কখনো প্রশান্তি , আবার কখনো বা বিষণ্নতা . "

    সিউরা দেখিয়েছেন যে আনন্দ বোঝাতে ব্যবহৃত হবে ঝলমলে রং , উষ্ণ আর অপেক্ষাকৃত ঘন . রেখার ব্যবহার হবে উর্ধ্বমুখী . প্রশান্তি বোঝাতে গেলে সমপরিমাণে বা সুষমভাবে বন্টন করতে হবে হালকা আর গাঢ় রং . রেখা অনুভূমিক. আর বিষণ্নতায় মিশে যায় যা যা শীতল রং আছে , রেখার ব্যবহার অধোমুখী .

    আবার ফিরে যাই আলাপচারিতায় .

    ভিনসেন্টের মনে হল , এইরকম ছবি আঁকা কী আর এমন শক্ত কাজ ! মনের মতো কিছু হালকা রং কিনে নেওয়া শুধু . তাহলেই ইম্প্রেশনিজম হাতের মুঠোয় . প্রথম দিন চেষ্টার পর কিন্তু খানিক ঘাবড়ে গেল সে. যত দিন যায় , ততই হতাশা . ক্যানভাসে রং ধরবার চেষ্টা করে . গাঢ় নিষ্প্রভ চটচটে রঙের আস্তরণ পড়ে শুধু !

    ভিনসেন্ট অধৈর্য...

    " আর কোনো আশা নেই আমার . কুড়িটা ক্যানভাস শেষ করলাম. কাজের কাজ কিছুই হল না. এবার আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব . সর্বনাশ হয়ে গেল আমার. এদের মতোও হতে পারছি না, আবার হল্যান্ডে গিয়ে শান্তিতে গরু ভেড়ার ছবিও আঁকতে পারব না . আমার দু'কুল গেল ."

    এপ্রিল মাস. পড়ন্ত গোধূলি. পাথরের উঁচু উঁচু বাড়ির মাথায় অস্তমিত সূর্যের রক্তিমা. কাফেগুলোতে পথচলতি ঘরমুখ মানুষেরা , রাস্তায় রাস্তায় হলুদ গ্যাসের আলো জ্বলে উঠেছে...রোজ সন্ধ্যায় পারী এমনিভাবেই সাজে. মোহিনী মায়ায় .

    ভ্যান গখ আর গগ্যাঁ নিশুতি রাতে সিউরার বাড়িতে. ভ্যান গখ এই প্রথমবার. আলাপ করতে .

    বাড়ির প্রায় সারা তিনতলাটা জুড়ে বিশাল ঘর . চারিদিকে নানা মাপের ক্যানভাস আর মই . মাঝে উজ্জ্বল আলো . টেবিলের ওপর একটা ভিজে ক্যানভাস চিত করে শোয়ানো .

    " একটু অপেক্ষা করুন, আপনার সঙ্গে আলাপ করার আগে ছোট্ট একটা চৌখুপী ভর্তি করে নিই . "

    একটা ছোট্ট টুলের ওপর বসে সিউরা ঝুঁকে পড়ে ক্যানভাসের ওপর. পাশে সারি দিয়ে রাখা নানা মাপের গোটা কুড়ি রঙের বাটি . সূক্ষ্মতম একটি তুলি রঙ্গে ডুবিয়ে একটা সাদা চৌখুপী সিউরা বিন্দুর পর বিন্দু বসিয়ে ভরতে লাগলো. যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে তার হাত . মুখ ভাবলেশহীন .

    ভিনসেন্ট ছবি দেখছে অপলকে . এত বিচিত্র দৃশ্য কি আগে দেখেছে সে? শিল্পে বা প্রকৃতিতে ? গথিক চার্চের চূড়ার মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটি মানুষ . তাদের গঠন অপরিমেয় ক্ষুদ্র বর্ণবিন্দুর সমন্বয়ে . প্রান্তর, নদী, আকাশ , গাছ , নৌকো...সব কিছুই উজ্জ্বল আলোকবিন্দুর সমষ্টি . উদ্ভাসিত . এত উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার তো সাহস করে মানে, দিগা, গগ্যাঁও করতে পারেনি. রংগুলোর শুরু বা শেষ নেই , প্রতিটি রং কী অনায়াসে মিশে গেছে একে অন্যের শরীরে. প্রাণ আছে, আলো আছে; কিন্তু বাতাস বইছে না, শ্বাস নেই. জীবন ওই বিন্দুতে এসে নিবাত নিষ্কম্প স্থির .

    সিউরা বলে চলে, "এই শিল্পরীতি জগতে বিপ্লব আনবে. এতদিন পর্যন্ত শিল্প ছিল শিল্পীর বিমূর্ত কল্পনা . আমি তাকে নিয়ে যাব বিজ্ঞানের দিকে . সমস্ত ব্যক্তিগত অনুভবকে বাক্সবন্দী করে রেখে মনকে বাঁধতে হবে সূক্ষ্ম নির্ভুল গাণিতিক নিয়মের গণ্ডিতে . প্রতিটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন রঙে ধরা পড়ে . এই যে রঙের বাটি, প্রতিটিতে আছে একটি করে অনুভূতি . এরপর থেকে আলাদা আলাদা ভাবে এদের দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে. শিল্পীরা দোকানে যাবে , কিনবে ছবির বিষয় ও অনুভূতি অনুযায়ী রং . "

    ভিনসেন্ট আমতা আমতা করে বলে, " শিল্পের মূল কথায় তো ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি. তাকে কি ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বিজ্ঞানে পরিণত করা সম্ভব ?"

    এবার সিউরা একবাক্স ক্রেয়ন হাতে.

    " এই দেখুন , একটা সার্কাসের দৃশ্য আঁকছি. এই একজন ঘোড়সওয়ার , এদিকে সার্কাসের ম্যানেজার আর এখানটায় দর্শকের দল . কী অনুভূতি ? ফুর্তি, উত্তেজনা ... ছবি আঁকার মূল উপাদান লাইন , টোন আর রং . এখানে উর্ধ্বমুখী রেখা, উজ্জ্বল রং আর আবেশতপ্ত টোন . আমি তাহলে কী পেলাম ? ফুর্তি বলে উপলব্ধিগ্রাহ্য বস্তুটির অমূর্ত ধারণা ."

    এতক্ষণে মুখ খুলল ভিনসেন্ট .

    " তা পেলাম. কিন্তু ফুর্তিটাকে পেলাম কি ?"

    সিউরা তাকাল ভিনসেন্টের দিকে.

    সিউরা বলল, " অনুভূতি নয়, শিল্পীর মাথাব্যথা অনুভূতির পেছনে যে সারাত্সার , তাকে আয়ত্ত করা. প্লেটো পড়েছেন ? শিল্পীরা বস্তু আঁকবে না. বস্তুর নির্যাস আঁকবে . আপনি ঘোড়া আঁকতে চেয়ে যদি সেই ঘোড়াই আঁকেন , তাহলে তো ছবি তুললেই হয় ! শিল্পী হওয়ার দরকার কী ? মানুষ আঁকতে গেলে রাস্তার ওই চৌকিদারকে আঁকলে চলবে না. তুলির টানে ধরতে হবে অবিনাশী মানবাত্মাকে . শান্ত প্রকৃতি আঁকতে চান ? সব সমান্তরাল আর অনুভূমিক রেখা টানুন . টোনে গরম-ঠাণ্ডার সুষম সমন্বয় . সমান সমানভাবে গভীর আর হালকা রং. দু:খের অনুভূতির জন্য রেখা টানুন ওপর থেকে নীচে ,টোন কিন্তু ঠাণ্ডা. ক্যানভাসে কীভাবে জায়গা ছাড়তে হবে, কোথায় কী বসাতে হবে..তার নির্ভুল জ্যামিতিক নিয়ম বইতে দেওয়া থাকবে. শিল্পীর কাজ শুধু বই পড়ে নিজেকে তৈরী করে নেওয়া . আপনি আসবেন আবার. আমরা এক সঙ্গে কাজ করব. আপনি কি আমাকে পাগল ভাবছেন ?"

    ভিনসেন্ট বলল, " ছি ছি, তা কেন ? আমাকেই তো কতজন পাগল বলে. আপনার এই ধ্যান ধারণা খুব অভিনব."

    গগ্যাঁ হেসে উঠলো, " ওহে, বুঝলে তো ? ভিনসেন্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে শুধু পাগল বলল না...বলল, তুমি বদ্ধ পাগল.."

    সত্যিই কি উন্মাদ ছিলেন সিউরা ? দেলাক্রোয়ার পর এমনভাবে কেউ আর রঙের জগতকে অনুভব করতে পেরেছিলেন কি ? এই মানুষটিই তো বলেছিলেন " এস, আমরা আলোর নেশায় মাতাল হই . আর কীই বা আছে..দু:খে যা দেয় চন্দনপ্রলেপ ?"

    ( তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত )

    চতুর্থ পর্ব
    ......................

    আলোছায়া দোলা
    ...............................

    "ছায়ারও কিন্তু রং আছে . আলোর মতোই . শুধু একটু নিষ্প্রভ , এই যা . আলো আর ছায়া আসলে বর্ণের জগতে কিছু তারতম্যজনিত বৈসাদৃশ্যমাত্র ."

    পল সেজান . মাতিস আর পিকাসো যে শিল্পীর সম্বন্ধে বলেছিলেন , " সেজান আমাদের সকলের জনক. "

    সেজান বলতেন , " শিল্পের প্রতিভা এক এমনই দেবদত্ত দুর্লভ বৈশিষ্ট্য , যা আবেগকে প্রকাশ করার স্পর্ধা বা ক্ষমতা দেখায় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার ক্যানভাসে . "

    সেজান তুলির টানে ঝড় তুলেছিলেন ক্যানভাসের বুকে . নানা স্তরে রঙের ব্যবহার , ছোট ছোট ব্রাশ স্ট্রোক ...তাই দিয়ে কত অনায়াসে স্পর্শ করেছিলেন প্রকৃতিকে আর জীবনকেও .

    " যখন আমি নিজেকে যাচাই করতে চাই , নিজের আঁকা ছবিকে রাখি কোনো ঈশ্বরদত্ত বস্তুর পাশে. এই যেমন গাছ , ফুল . যদি দেখি, বৈসাদৃশ্য আছে কিছু, বুঝতে পারি, আমার ছবিটা আর যাই হোক, "ছবি" হয়নি . ইম্প্রেশনিস্ট যখন প্রকৃতিকে উপজীব্য করে ছবি আঁকেন , তখন তা বিষয়নির্ভর নয় , রোমাঞ্চকর অনুভূতিনির্ভর হওয়াই কাম্য ."

    সমসাময়িক অন্য অনেক শিল্পীর তুলনায় সেজানের জীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছিল . খুব অল্পবয়সেই সখ্য গড়ে ওঠে এমিল জোলার সঙ্গে . জোলা আশ্রয় করেছিলেন কলম আর সেজানের ছিল তুলি. পরে অবশ্য এই বন্ধুত্ব ভেঙে যায় . সে গল্প আসবে ...আলাপচারিতা প্রসঙ্গে .

    সেজানের সঙ্গে সৌহার্দ্য গড়ে উঠল ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী ক্যামিল পিসারোর . সখ্য ...বা বলা ভালো , প্রথমদিকে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক . সেজানের শিল্পীজীবনের সকালবেলায় পিসারোর ভূমিকা ছিল সূর্যের মতোই . তারপর দুজনে একসঙ্গে কাজ করেছেন . তখন গুরু-শিষ্য সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়েছে বন্ধুতায় .

    সেজানের প্রথমদিকের কাজে মানুষ বা প্রকৃতি এসেছে কল্পনার রং চড়িয়ে . পরের দিকে ধীরে ধীরে শিল্পী বাস্তবের মাটিতে পা রেখেছেন . তখন ছবিতে এসেছে বেশ হালকা ফুরফুরে ভাব .

    " ইম্প্রেশনিজমকে এমন জায়গায় পৌঁছে দেব, যাতে আলো আর রঙের খেলা নিয়ে এই রীতি স্থায়ী জায়গা করে নেয় শিল্পের আঙিনায় ."

    সেজানের ছবিতে যখন গাছের গুঁড়ি আঁকা, তখন তা চোঙ -এর আকারে , আপেল বৃত্তাকার...অর্থাত জ্যামিতিক গঠনের ব্যবহার . সেজানের আকাঙ্ক্ষা ছিল , কল্পমূর্তির সত্যতা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে . ফলে তিনি নিজের দু'টি চোখের দৃষ্টিসীমাকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন . সেই দৃষ্টি সাধারণ জগতের দিগন্তরেখাটি বড় অনায়াসে পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছিল সেই কল্পলোকে, যেখানে মানুষ বহিরঙ্গে যা দেখে, সেই আলোয় সেই রঙে অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভাস মিশিয়ে দিতে জেনে যায় . এই মনশ্চক্ষু কি আর সবার থাকে ?

    পারীর বাত্সরিক চিত্র প্রদর্শনীতে একটানা নিজের ক্যানভাস জমা দিয়েছেন সেজান. ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৯ . প্রতিবার বাতিল . তারপর প্রতি বছর না হলেও মাঝে মাঝেই. ভাগ্য বিরূপ. অবশেষে একটি পোর্ট্রেট..সেজানের বাবার. নির্বাচিত হল ১৮৮২ তে ! সেই প্রথম , সেই শেষ ! আর কখনো এখানে তাঁর ছবি জায়গা পায়নি .

    সেজানের প্রথম একক প্রদর্শনী ১৮৯৫ সালে. সেজান তখন একা একা নিজের মতো থাকতে, নিজের মতো আঁকতে ভালোবাসেন . চলে গেছেন নির্জনে, দক্ষিণ ফ্রান্সে . পারী থেকে অনেকই দূরে .

    পছন্দ করেন স্টিল লাইফ , পোর্ট্রেট , ল্যান্ডস্কেপ আর স্নানদৃশ্য আঁকতে . তখন ন্যুড মডেল পাওয়া খুব সহজ ছিল না. অগত্যা ক্যানভাসে এসেছে ছেলে, স্ত্রী, স্থানীয় চাষীরা, এমনকি তাঁর ছবির ডীলারও . স্টিল লাইফগুলি চমত্কার সাজানো গোছানো , মোটা সমতল ক্যানভাসে আঁকা . সেজান মারা যান অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে. ৬১ বছরে.

    সেজানের কাজের সালতামামি করতে গিয়ে দেখা যায় ,
    ১৮৬১-১৮৭০ : কৃষ্ণাভ রঙের আধিক্য . কখনো ছবি নিষ্ঠুর, কখনো লাজুক. কখনো বা ক্রুদ্ধ. সময়ে সময়ে হতাশা . জীবনের একেবারে শুরুতে যেমন জলরঙের কাজ ছিল, তার থেকে আলাদা.
    ১৮৬৬-১৮৬৭ : কুর্বে তাঁকে প্রভাবিত করেন "প্যালেট নাইফ " ব্যবহার করে ছবি আঁকতে. এই প্যালেট নাইফ ব্যবহার দিয়েই ইম্প্রেশনিজম-এর জগতে এক নতুন দিক উন্মোচিত হল .

    সেজান কিছু পোর্ট্রেট আঁকেন , যাতে কিছু কামোত্তেজক বিষয় , কিছু হিংস্রতা এসেছিল. যেমন নারীর জামাকাপড় পরার ছবি , ধর্ষণ , হত্যা.

    ১৮৭০-১৮৭৮ : এই সময় সেজান দক্ষিণ ফ্রান্সে আর পারীতে ভাগাভাগি করে থাকেন .

    আঁকেন ল্যান্ডস্কেপ, পিসারোর সঙ্গে .

    রেনোঁয়ার সঙ্গেও ছবি আঁকেন ১৮৮২ তে. রেনোঁয়া আর মোনের সঙ্গে দেখা করেন, আলোচনা করেন ছবি নিয়ে ১৮৮৩ তে . এরপরের ক্যানভাসে ঘন রঙের , কৃষ্ণাভ রঙের আধিক্য কমে আসে . ছবিতে উজ্জ্বল রঙের ঝর্ণা .

    ১৮৭৮ -১৮৮০ . আবার দক্ষিণ ফ্রান্স . জোলার সঙ্গে বিচ্ছেদ. তিক্ত হয় সম্পর্ক ! জোলার উপন্যাস L ' oeuvre কে কেন্দ্র করে. সেই গল্পও আসবে এরপর .

    এরপর এক ঝাঁক ছবি. এস্তাকের সেন্ট ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের , বাগবাগিচার , প্রকৃতির অকৃপণ দাক্ষিণ্যের .

    ১৮৯০ -১৯০৫ : একেবারেই আড়ালে , স্বেচ্ছা-নির্বাসনে. ছবিতে এই তো ত্রিমাত্রিক অঙ্কনশৈলীর
    ভ্রূণের আভাস . সেও ওই পাহাড়ের ছবিতেই . যে কারণে পিকাসোর ওই স্বীকৃতি !

    এবার ফিরে যাই আলাপচারিতায় .

    সেজান , গগ্যাঁ , ভ্যান গখ . খানাপিনার সঙ্গে আড্ডা চলছে . কথায় কথায় এমিল জোলা প্রসঙ্গ .
    গগ্যাঁ বলল, " আরে সেজান , জোলার "লে ঈভর" বইখানা নাকি হাজারে হাজারে বিকোচ্ছে ?"

    সেজান রেগে লাল. " ভিনসেন্ট , তুমি কি পড়েছ বইটা ?"

    "না তো , সবে জার্মিনাল শেষ করেছি . "

    সেজান উত্তেজিত . " এই বইটা হীন , অসত্য . বন্ধুত্বের নামে চরম বিশ্বাসঘাতকতা. একজন শিল্পী বইটার মুখ্য চরিত্র. সেই লোকটা হলাম আমি. জানো, ও আমার শুধু বন্ধু নয় , নিজের ভাইয়ের থেকেও আপন ছিল ! আমি শিল্পী হব , ও লেখক..এ স্বপ্ন কি আজকের ?"

    ভিনসেন্ট তাজ্জব ." কী করেছে জোলা ?"

    " কী না করেছে ও ? সারা পারীর চোখে আমাকে হেয় করেছে . বন্ধুর মুখোশ পরে সব কথা আমার পেট থেকে টেনে বের করেছে আর তারপর তা বইতে লিখে আমাকে মূর্খ প্রতিপন্ন করেছে . আবার কী কারসাজি করেছে শোনো . আমার সঙ্গে আরও দুটো চরিত্র মিশিয়েছে . একটার নাম বেজিল , আর অন্যটা একটা হতভাগা ছেলে যার কাজ মানের স্টুডিও ঝাড়ু দেওয়া . শিল্পী হবার অদম্য বাসনা ওই ছেলেটার . শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে. জোলা লিখেছে, আমি মূর্খ, কল্পনাবিলাসী . নিজেকে বৈপ্লবিক শিল্পী বলি, কারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে আঁকার ক্ষমতায় নেই আমার ! শেষ পর্যন্ত বইটাতে আমাকে দাঁড় করিয়েছে আমার আঁকা ছবির সামনে . তারপর কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে মেরেছে আমাকে . আবার আমার পাশাপাশি খাড়া করেছে পুরনো বস্তাপচা ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী এক শিল্পীকে, যে নাকি জিনিয়াস !"

    গগ্যাঁ বলল, " সে তুমি যতই রাগ কর সেজান , মানের বৈপ্লবিক শিল্পরীতিকে সমর্থন করে এত জোরালো কথা আর কেউ বলেনি. "

    " তা তো বলবেই তোমরা ! মানে যখন প্রাচীনপন্থীদের বিরুদ্ধে, জোলা তখন আনন্দে গদগদ . আর সেই বিরুদ্ধাচরণ আমি করলেই যত দোষ ! জোলাকে আমার চেয়ে বেশি চেনো তুমি ? প্রতিভা নেই একরত্তি. মানুষদের ও ঘেন্না করে. মানের ধামাধরা . দুজনেই বুর্জোয়া . প্রচণ্ড বিলাসিতায় থেকে গুচ্ছের টাকা কামায় দু:স্থ শ্রমিকদের কাহিনী লিখে ."

    " আমরা যে শুনেছিলাম, তোমার একটা প্রদর্শনীর ব্যাপারে ও খুব সুন্দর একটা পরিচিতি লিখেছিল?"

    " লিখেছিল ! তারপর যেই ওটা ছাপাবার সময় এল , সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে দিল..পাছে বন্ধুর উপকার হয়. আমার ছবি যে হাসির খোরাক ! আমি থাকবই না এখানে. ঘেন্না ধরে গেছে. নির্জন পাহাড়ে গিয়ে থাকব.. যেখানে রোদ্দুর, প্রকৃতি.. রং... আপেল বাগান করব . পাথরের দেওয়াল ঘেরা স্টুডিও . কাউকে ঢুকতে দেব না. সারাক্ষণ শুধু ছবি আঁকব....."

    তাই কি সেজানের বারে বারেই দক্ষিণ ফ্রান্সে স্বেচ্ছা- নির্বাসন ?

    এবার দেখি জোলা কী বলছে বন্ধুর কথা.

    জোলা আর ভিনসেন্ট . প্রসঙ্গে: সেজান.

    " ভিনসেন্ট, তুমি দেখলাম সেজানের সঙ্গে এলে. ও নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে অনেক কথাই বলেছে ?"

    " ওকে নিয়ে যে বইটা লিখেছ..ও খুব মর্মাহত. "

    " পলকে নিয়ে ওই বই লিখতে আমিও কিছু কম কষ্ট পাইনি. কিন্তু এই বইয়ের প্রতিটি কথাই নির্মমভাবে সত্যি . যদি তুমি কোনো বন্ধুর ছবি আঁকো , আসল চেহারাটাই তো আঁকবে ! নাকি মিথ্যে ভোলাবে ? পল আমার অনেককালের বন্ধু. ছবি আঁকিয়ে হিসেবে একেবারে ব্যর্থ. আমার বাড়িতে ওর আঁকা ছবি আছে. অতিথি আসার কথা থাকলে টিপ্পনির ভয়ে আমি আগেই সে ছবি নামিয়ে রাখি. "

    " ওর কাজ কি এতই খারাপ ?"

    " একটা পাঁচ বছরের শিশুও ওর থেকে ভালো আঁকে . ওর মাথাটাই গেছে. ইস, কীভাবে জীবনটা নষ্ট করে দিল . শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা না করে !"

    কী অদ্ভুত , না ? এত সখ্য...সেখান থেকে এত বৈরিতা ?

    সেজানের সেই যে..আপেলের বাগান ? এই প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট কাহিনী আছে. হয়ত অনেকেই জানা.

    পিয়ের ট্যাঙ্গি . রং আর ক্যানভাসের দোকানদার. শিল্পীদের অগাধ প্রশ্রয় আর আশ্রয়ের জায়গা. ধারে সরঞ্জাম কেনার স্বর্গ . যদি না মাদাম জ্যানতিপে থাকে দোকানে. সে আবার এক্কেবারে এই সব ট্যাঁকখালির জমিদার বাপের কুপুত্তুর শিল্পীদের আহ্লাদ দেয় না . ফেল কড়ি , মাখো তেল .

    দোকানে ঝুলছে সেজানের আঁকা ক্যানভাস. চারটি লাল টুকটুকে আপেলের ছবি. একজন লোক এল . খদ্দের .

    "সামনের জানালার ধরে ওই ছবিটা কার আঁকা ?"

    "পল সেজান ".

    " সে আবার কে ? নাম শুনিনি তো ! বিক্রির জন্য "

    পিয়েরের ইচ্ছেই নেই ছবিটা বিক্রি করার. ছবি তার প্রাণ . সে বলল, " না , মানে ওটা আগেই..."

    পিয়েরের বউ ঝাঁপিয়ে পড়ল . আচ্ছা আহাম্মক তো ! একেই দিন আনি , দিন খাই. সে বলল , " না না . বিক্রি হবে বই কী ! আপেলগুলো দেখুন. কী টাটকা..যেন আসল ! "

    " কত দাম ?"

    বউ তাকাল পিয়েরের দিকে .

    " দাম কত পিয়ের ?"

    দূর, পিয়েরের তো বিক্রির ইচ্ছেই নেই.

    সে তাই বলল, " তিনশ ' ফ্রাঁ " .

    বউ চোখ রাঙালো . পিয়েরের মতলব তার খুব চেনা. পিয়ের ঢোঁক গিলে বলল, " দু'শ . না না..একশ ' ফ্রাঁ."

    বিরস গলায় খদ্দের বলল, ' একজন অনামা শিল্পীর জন্য একশ ' ! মেরেকেটে পঁচিশ দিতে পারি. "

    লাফিয়ে উঠে পিয়েরের বউ একটা কাঁচি এনে কচকচ করে ক্যানভাস কেটে একটা আপেল খদ্দেরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, " বেশ তো, তাই দিন. এই নিন. একটা আপেল নিয়ে যান..."

    এভাবেই এই শিল্পীদের জীবন কেটেছে . এভাবেই অহরহ যুদ্ধ করে . এভাবেই শিল্পের সঙ্গে, নিজেদের ইচ্ছের সঙ্গে সহবাসে . কখনও কখনও হতাশার অন্ধকারে হয়ত ..কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই ভালোবাসার অমল আলোয়.

    সেজান সত্যিই বিশ্বাস করতেন , " আমাদের বসতি এক ছড়ানো ছিটানো বিশৃঙ্খল রামধনুর আলোর দুনিয়ায় ."

    ( চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত )
  • lcm | 118.91.116.131 | ১৫ আগস্ট ২০১৩ ১২:৩৮620092
  • বাহ! চমৎকার লেখা। খাসা কলম।

    লিজিয়ন অফ অনার (স্যান ফ্র্যানসিস্কোর মিউজিয়াম)-এ এখন চলছে একটি বিশেষ প্রদর্শনী - "ইমপ্রেশনিস্ট্‌স অন দ্য ওয়াটর" - মোনে, রেনোয়া, পিসারো... (যাদের অনেক কথা, গপ্পো এখানে ঈশানী লিখেছে ) দের আশিটার মতন ছবি নিয়ে.... আর ছিল এমিল জোলা-র ডিঙি, যাতে বসে লিখতেন জোলা... গত সপ্তাহে গেছিলাম.... আর এ সপ্তাহে এই টই.... কি সমাপতন...
  • lcm | 118.91.116.131 | ১৫ আগস্ট ২০১৩ ১৩:০১620093
  • বিশেষ প্রদর্শনীর ছবি তোলা বারণ ছিল, শুধু এমিল জোলা-র ডিঙি (নানা)-র ছবি তোলা যাচ্ছিল -
  • anirban basu | 146.152.13.156 | ১৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:২৮620094
  • বাহ! খুব ভালো লাগলো ishani র লেখা। এই SF এর প্রদর্শনীটা দেখতে হবে তো। শিকাগোর আর্ট ইন্স্টিটিউটেও ইম্প্রেশনিজমের গ্যালারী খুব ভালো। কয়েকটা ভ্যান গখ আর মনে-র ওয়াটার লিলি আছে।
  • S | 81.191.58.111 | ১৭ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৩৩620095
  • ভিনসেন্ট মানেই স্টারি স্টারি নাইট।
  • Ishani | 233.239.152.244 | ১৭ আগস্ট ২০১৩ ১১:৪৩620079
  • পঞ্চম পর্ব
    .................

    তোমাকেই যেন ছুঁয়ে থাকি আমি , আলোয় অন্ধকারে .
    .............................................................................

    সমারসেট মম . তাহিতি গিয়েছিলেন খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করতে . পল গগ্যাঁ সম্বন্ধে কিছু লেখার অদম্য তাগিদে . আর সেই বিখ্যাত উপন্যাস " The Moon and six pence ." এই পর্ব শুরু করব সেই উপন্যাসের নায়ক চার্লস স্ট্রিকল্যান্ডকে দিয়ে . শিল্পী . পরিবার পরিজন সব কিছু ছেড়েছুড়ে এসে এখন থাকেন তাহিতিতে . চার্লস স্ট্রিকল্যান্ড এ বইতে পল গগ্যাঁর নাম .

    স্ট্রিকল্যান্ডের প্রিয় শিল্পী ছিলেন ব্রুগেল দ্য এল্ডার . একবার কথা প্রসঙ্গে স্ট্রিকল্যান্ড বললেন , " ব্রুগেল ঠিকঠাকই আঁকেন ; তবে নিশ্চয়ই আঁকতে আঁকতে ওঁর ঘেন্না ধরে গেছে." পরে লেখক যখন ভিয়েনায় ব্রুগেলের বেশ কয়েকটি ছবি দেখেন , তখন তিনি এই বইতে বলেছেন , " আমি বুঝতে পেরেছিলাম কেন উনি চার্লস স্ট্রিকল্যান্ডের মতো মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন . এখানেও এই মানুষটি নিজের মনের মতো পৃথিবী গড়ে নিয়েছিলেন আর ছবিতেও তারই প্রকাশ . ব্রুগেল এক দরজা থেকে অন্য দরজায় অন্ধের মতো হাতড়ে বেরিয়েছেন...কী হলে ছবি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, সেই আশায় . সেই অধ্যবসায় আকৃষ্ট করেছিল স্ট্রিকল্যান্ডকে . দুজনেই তুলির রেখায় সেইসব ধ্যানধারণাকে বন্দী করে রাখতে চেয়েছিলেন , যা কলমের আঁচড়ে খাতায় ফুটিয়ে তোলা হয়ত অনেক সহজ ছিল. "

    লেখক জানতে চেয়েছিলেন ," ইওরোপের জন্য কষ্ট হয় না আপনার ? পারী , লন্ডন ..আলো ঝলমল , কাফে, বন্ধুবান্ধব , সিনেমা , থিয়েটার ...মন কেমন করে না একটুও ?"

    অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে চার্লস বলেছিলেন , " আপনি বোধ হয় শিল্পীদের হালচাল, পছন্দ অপছন্দ তেমন বোঝেন না ! .'

    সৌন্দর্য ! কেউ কখনও কোনো কিছুতে সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ পেলে অন্য সব কিছুকে তার তুচ্ছ বলে মনে হয় . সে তখন আর নিজের মধ্যে থাকে না . ওই ভালোবাসার ক্রীতদাস হয়ে যায় . যে আকর্ষণে চার্লস স্ট্রিকল্যান্ড সারা জীবন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অন্ধের মতো ছুটে বেরিয়েছেন , তাও এক ধরনের ভালোবাসাই . সেই আকুতি , সেই ভালোবাসা সৌন্দর্যসৃষ্টির. এ শুধু যেন এক অপার্থিব ঈশ্বর অন্বেষণের তাগিদ . কত মানুষই তো আছে, যারা সত্যের সন্ধানে নিজের জীবন , পৃথিবী ওলটপালট করে দেয় ! চার্লসও সেইরকমই .

    পল গগ্যাঁ .

    " সব কিছু ঠিকঠাক দেখতে পাওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করে থাকি . "

    " রং তো সুরের মতোই ঝঙ্কারমাত্র . আমাদের পৌঁছে দেয় এমন এক গন্তব্যে, যা ব্যাখ্যার অতীত এক অলৌকিক অনুভব . এ এক আশ্চর্য মোহিনী শক্তি ."

    উজ্জ্বল রং , কিঞ্চিত বিসদৃশ আর বিচিত্র শরীরী রেখা , অতুলনীয় নিসর্গ , সহজ সুর , বলিষ্ঠ আঁচড়...এ সব কিছুর ব্যবহার যে সাহসী শিল্পীর ক্যানভাসে, তাঁর নাম পল গগ্যাঁ . কোনো শিক্ষকের ছত্রছায়া ছিল না . সম্পূর্ণ নিজের দেখার চোখ ব্যবহার করেছিলেন তিনি . এক অদম্য তাগিদ ছিল শুধু...রং ছড়ানোর ...ক্যানভাসে. তাই চলে এলেন ঘর, পরিবার, পরিজন সব ছেড়ে. কত অনায়াসেই .

    প্রথম জীবনে কাজ করতেন মার্চেন্ট মেরিনে , ফরাসী নৌবহরে . অবসর সময়ে তখন ছবি আঁকা চলত . কিন্তু অল্প কিছুদিন বাদেই এই আকর্ষণ যে কী দুর্নিবার ! পারীর বাত্সরিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে একটি কাজ গৃহীত হল ১৮৭৬ সালে. আলাপ হল ক্যামিল পিসারোর সঙ্গে . পলের ছবি আকৃষ্ট করেছিল ক্যামিলকে . এমনকি দিগা আর মোনেকেও. এঁদের আমন্ত্রণে ১৮৭৯ -এ এক প্রদর্শনীতে এঁদের ছবির পাশাপাশি পলের ছবি জায়গা করে নেয় .

    পল তখন নৌবহরের কাজ ছেড়ে স্টকব্রোকার . ১৮৮৩ তে এই কাজটাও ছেড়ে দিলেন তিনি . এখন থেকে শুধুই ছবি আঁকা . ছাড়লেন নিরাপদ জীবন, স্বজন..সব কিছু. চলে গেলেন ব্রিটানিতে . ১৮৮৮ সাল . আঁকেন বিখ্যাত ছবি “ Vision of The Sermon. “বলিষ্ঠ রেখায় তুলির টানে উজ্জ্বল রঙে বাইবেলের গল্প. জেকব আর দেবদূতের মল্লযুদ্ধ . ১৮৮৯ . এক অদ্ভুত ছবি . ক্রুশবিদ্ধ যীশু . " The Yellow Christ ."

    শিল্পীমহলের অন্যতম বর্ণময় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব . নিজেকে বলতেন " বন্য , আদিম মানুষ . শরীরে বইছে ইনকাদের রক্ত . " সুরা আর নারীতে তীব্র আসক্তি . ১৮৮৮ . দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধু ভ্যান গখের সঙ্গী. আর্লে . তারপর মনান্তর আর বিচ্ছেদ . সে এক করুণ কাহিনী. আসবে এরপর. আলাপচারিতা পর্বে.

    ১৮৯১ . ভালো লাগছে না শহুরে হট্টগোল . এবার তাহিতি. সেখানে প্রকৃতি অকৃপণ . নিসর্গ ছুঁয়ে থাকে সূর্যালোক আর চন্দ্রমা . একা থাকতে হবে . স্বাধীন বেপরোয়া জীবন ,এবং ক্যানভাসে তার প্রতিফলন . নতুন কিছু আঁকতে হবে .

    "La Orana Marie ." মেরী আর যীশুকে আঁকলেন অন্যভাবে..তাহিতি রমণীর কোলে এক নিষ্পাপ শিশু . এই সময়ে একটি খোদাই করা ভাস্কর্যও . " Oviri "( তাহিতি ভাষায় এর অর্থ " বুনো মানুষ ") ; যদিও পল বলেছিলেন , এটি এক দেবীমূর্তি .

    এই সময়ে পলের সঙ্গিনী ছিল একটি ১৩ বছরের তাহিতি কিশোরী . তাকে মডেল করে অনেক ছবি আঁকেন তিনি .

    ১৮৯৩ সাল . আবার পারী. তাহিতিতে আঁকা ছবি নিয়ে . শিল্পীসমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া . এত বন্য ছায়া কী সকলের পছন্দ হয় !

    এবার তাই গন্তব্য ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া এবং সেই বিখ্যাত ক্যানভাস “ Where do we come from ? What are we ? Where are we going ?” এক অনন্য মানবজীবনচিত্র .

    ১৯০১. আরও প্রত্যন্ত নির্জনতায় . মার্কুইসা অঞ্চলে . শরীর জীর্ণ , রোগগ্রস্ত . ৩ রা মে, ১৯০৩ -এ মাত্র ৫৫ বছর বয়সে চলে গেলেন পল গগ্যাঁ . আর জীবদ্দশায় যা পাননি, সেই বিপুল খ্যাতি, স্বীকৃতি বাঁধভাঙা জলস্রোতের মতো শিল্পের দুনিয়াকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মৃত্যুর পর .

    "শিল্প হয় বৈপ্লবিক আর নয়তো স্রেফ চুরি !".

    পল বলতেন , " খুব বেশি প্রকৃতির অন্ধ অনুকরণ কোরো না . চিত্রকলা মূলত এক বিমূর্ত ও অলীক অনুভব. সারা জীবন শুধু অন্বেষণ ... নিজস্ব ধারাটিকে খুঁজে পাওয়ার . নিজেদের ভাবনাগুলো যদি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে , এলোমেলো ছাই হয়ে ..তাকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে কি আর আগুন জ্বালানো যায় ? "

    ভিনসেন্ট প্রসঙ্গে পল :" ওর বড্ড ওই হলুদ রঙের দিকে ঝোঁক . আমরা যখন একসঙ্গে ছিলাম আর্লে , দুজনেই তো বদ্ধ পাগল ! সব সময়েই চুলোচুলি..রঙের জাদু নিয়ে. কোন রঙের আবেদন কতটা . আমার আবার লাল রঙ খুব পছন্দ. সে কী ঝামেলা...ঠিকঠাক সিঁদুরে লাল পাই কোথায় ! রং ! রং ! কী অপার রহস্যময়তা ! স্বপ্নের ভাষা .. যদি মনের চোখে দেখো..গাছের রং নীল, তবে তা নীল রঙেই এঁকো . প্রকৃতি তার আদিম বন্য উজ্জ্বল রংবাহারে আমার দু’টি চোখ অন্ধ করে দেয় . আমি কী ভীষণ অনিশ্চয়তায় ভুগি !

    আচ্ছা, আমি কেন সূর্যের সব বর্ণ সব দীপ্তি ক্যানভাসে উজাড় করে দিতে ভয় পাই ? আমি তো এভাবেই যেতে চাই..সত্যের জগতে , আলোর গভীরতায় .

    তারযন্ত্রে একটি একটি করে সুর বাঁধা হয় . ক্যানভাসে যে কী খুনখারাপি !

    এই নির্জনতা ! আমি অনুভব করছি সমস্ত সত্তা দিয়ে তাহিতির নির্জন রাত . একদিন না একদিন মানুষ স্বীকৃতি দেবে আমার এই উন্মাদনাকে . ক্যানভাসে কী করে রং ভরাবে, তাই নিয়ে ঘাম ঝরিও না. যা আসার , যদি আসার হয়, তা এমনিতেই আসবে . শুধু স্বপ্ন দেখো...দেখবে কাজ অনেকই সহজ হয়ে গেছে . সমালোচকদের মন্তব্যে মাথা ঘামিও না . যা ওদের এক্তিয়ারের বাইরে, তাই নিয়ে কূটকচালি করা ওদের অভ্যেস !

    প্রকৃতিকে উন্মুক্ত করে দিও তোমার স্বপ্নে . সে এক অধরা মাধুরী .... নিজেই ধরা দেবে তোমার তুলির টানে ."

    এবার ফিরি আলাপচারিতায় .

    ভিনসেন্টের সঙ্গে পলের আলাপ সবে জমে উঠেছে . স্থান : পারী . ভিনসেন্টকে পল নিয়ে গেছে তার স্টুডিওতে . একটা ইজেল, পিতলের খাট , একটা চেয়ার , টেবিল আর একটা খুপরিতে অত্যন্ত অশ্লীল কয়েকটা ফটোগ্রাফ .

    " পল, ফটোগুলো দেখলে মনে হয় , প্রেম সম্বন্ধে খুব একটা উঁচু ধারণা নেই তোমার. "

    " প্রেম ? রূপের অনুভূতি আমার আছে ; কিন্তু আসক্তি নেই . প্রেম আমি বুঝি না, জানি না. কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলতে আমার দাঁত ভেঙে যাবে . মাংস মাংসই , তার সঙ্গে আত্মাকে টেনে এনো না . মাংসের খিদে কয়েকটা টাকা থাকলেই মিটিয়ে ফেলা যায় . সেই তো ভালো . আত্মা থাকুক শান্তিতে . দেহানুভূতির সঙ্গে তুমি হৃদয়কে জড়িও না. হৃদয় থাক শুধু সাধনার জন্য , সৃষ্টির জন্য . "

    "কয়েকটা স্টাডি দেখাবে ?"

    " স্টাডি নয় . ওটা গোপন জিনিস . ব্যক্তিগত চিঠির মতোই . তবে কয়েকটা ছবি দেখাতে পারি ."

    খাটের নীচ থেকে কয়েকটা ক্যানভাস টেনে বের করলো পল . কিছুটা আশ্চর্য হবার জন্য মনে মনে তো প্রস্তুতই ছিল ভিনসেন্ট . কিন্তু এ যে এক অনাস্বাদিত বিস্ময় .! রোদ্দুরে জ্বলজ্বল করছে রং-মাতাল প্রবাল , বিচিত্রদর্শন সব গাছ , জীবজন্তু, মানুষ , আগ্নেয়গিরি থেকে উত্সারিত হয়েছে সমুদ্র , সীমাহীন আকাশ . সবুজ -বেগনী -ঘন লালে আঁকা রূপকথার স্বপ্নদৃশ্য , হলুদ উত্তপ্ত সূর্যালোক!

    এরপর আর্ল . ভিনসেন্ট থিওকে বলেছিল , " আমি সূর্যের আলো চাই . আলো আর তাপ আমার প্রাণশক্তি . আমি এমন কোথাও যাব, সে দেশ হবে সূর্যের মতো চোখধাঁধানো . পারীর জীবন অসম্পূর্ণ . এ যেন অপরিপক্ব ফল. প্রখর সূর্যের আলো পেলে তবেই তো ফল রসালো হয়ে উঠবে সুপক্ব পরিপূর্ণতায় . "

    সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রোজ ছবি আঁকা শুরু করে দেয় ভিনসেন্ট . সপ্তাহে অন্তত তিনটে দিন ঝড়ের তাণ্ডব . মাটিতে খুঁটি পুঁতে ইজেল বেঁধে রাখতে হয় , তবু ছিটকে ছিটকে পড়ে ক্যানভাস, রং, তুলি. টুপি পরার অভ্যেস নেই, আর্লের সূর্য তার মাথার চুলগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে. দৃষ্টিশক্তিও কি জ্বলে পুড়ে ছাই ? শস্যক্ষেতের সবুজ আর আকাশের ঘন নীল যেন একই ঠেকে চোখে ! ছবি আঁকে ভিনসেন্ট . লাল রঙের বেড়া , গোলাপী দুটি পীচ গাছ আর জ্বলজ্বলে নীল আকাশ . আঁকে প্লামগাছের বাগান. পুষ্পমঞ্জরীতে দেয় সাদা রং, ক্যানভাস ভরে স্বর্ণাভ হলুদ, আকাশী নীল আর বেগনী রঙে . আর ক্যানভাস জুড়ে থাকে দামাল ঝড় .

    ধীরে ধীরে বাড়ে গ্রীষ্মের তেজ . প্রকৃতি জ্বলে পুড়ে খাক . ঝলসানো তামা রং , নাকি পুরনো সোনার ? আকাশের উজ্জ্বল নীলে কেমন সবজেটে আভাস . সূর্যের আলো নেশা ধরানো হলুদ. এই হলুদ রং অকৃপণ হাতে ক্যানভাসে ব্যবহার করে ভিনসেন্ট . রেনেসাঁর পর ইওরোপীয় চিত্রকলার জগতে এতদিন এই রং অচল ছিল . ভিনসেন্ট কিন্তু ব্যবহার করে টিউবের পর টিউব. হলুদ ছাড়া রং কই ? আর্লের সূর্যকে কি হলুদ রং ছাড়া ক্যানভাসে ধরে রাখা যায় ?

    আর্লে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে ভিনসেন্ট . চিঠি পেল পলের কাছ থেকে. নিদারুণ দারিদ্র্য আর অসুস্থতা সম্বল করে পল ব্রিটানিতে . বিল মেটানোর ক্ষমতা নেই হোটেলের. হোটেলের মালিক ক্যানভাস বাজেয়াপ্ত করে তালাচাবি দিয়ে রেখেছে. ভিক্ষে করার মানসিকতাও যে নেই পলের ! আচ্ছা, পলকে এখানে নিয়ে আসা যায় না ? এত বড় বাড়ি ! দুজনে দুটো ঘরে স্টুডিও করে প্রাণভরে ছবি এঁকে যাবে.

    একদিন সত্যি সত্যি আর্লে চলে এল পল .

    একদিন দু'দিন পরেই স্যুপ খেতে খেতে পল নাক কুঁচকে বলে উঠল , " কী যে ছাই রান্না কর তুমি ! সব উল্টোপাল্টা . ঠিক তোমার ছবির রংগুলোর মতো . "

    " কেন ? আমার ছবির রং খারাপ ?"

    " তুমি এখনও ওই অন্ধকারেই হাতড়ে মরছ ! এই উজ্জ্বল হলুদ রংটা... কী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে !"

    ভিনসেন্ট বলল, "আমার সূর্যমুখী সম্বন্ধে তাহলে এটাই তোমার প্রথম আর শেষ কথা ?"

    " আরও আছে . এগুলোর মধ্যে কোনো ছন্দ নেই , রূপ নেই. ভীষণ একঘেয়ে আর অসম্পূর্ণ . প্রথমেই তোমার ওই বস্তাপচা ধ্যানধারণাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল . মন্তিচেল্লির প্রভাব থেকে বেরিয়ে এস ."

    " উনি বিরাট শিল্পী. রঙের ব্যবহার দেখেছ ?"

    " উনি স্রেফ এক মূর্খ, মাতাল ."

    " একদম চুপ করে থাকো পল . কোনো মাতাল অমন ছবি আঁকতে পারে ? রঙের সুষম ব্যবহার, তা নিয়ে অকল্পনীয় চিন্তা, পরিশ্রম..আর যাই বল, ওঁকে মাতাল বা অপ্রকৃতিস্থ বোলো না. "

    এমন ঝগড়া, তর্ক ..নিত্যনৈমিত্তিক . এভাবে কি খুব বেশিদিন চলে ? একজন ধূমায়মান আগ্নেয়গিরি , অন্যজনের চাপা ক্ষোভ . দুজনেই যুদ্ধে উন্মুখ . আর্থিক অবস্থা খারাপ . বিলাসিতা ..সে তো স্বপ্নমাত্র . দুজনেই দুজনকে আঘাত করে অন্য সব দু:খ ভুলে থাকতে চায় .

    ভিনসেন্ট যখন ছবি এঁকে চলেছে পাগলের মতো , সেই সময়ে পল একটি ছবি আঁকে বন্ধুর . পোর্ট্রেট . এই প্রথম সেই ছবি দেখে ভিনসেন্ট বুঝতে পারল, পল তাকে ঠিক কী চোখে দেখে !

    " পল , এ তো আমারই ছবি . আমি কি একেবারেই ঠিক এই ছবির মতোই উন্মাদ হয়ে গেছি ?"

    ভিনসেন্ট কখনও শান্ত , কখনও উন্মাদপ্রায় . একবার তর্কাতর্কির পর খোলা ক্ষুর নিয়ে পলকে তাড়া করে সে . অবশ্য কোনো অঘটন তেমন ঘটেনি. কিন্তু ঘটেনি কি ? বন্ধুত্বের কফিনে সেদিন শেষ পেরেকটি পোঁতা হয়ে যায়. ফিরে যায় পল. আর্ল ছেড়ে . আর এর পরেই ভিনসেন্ট নিজের কান নিজেই কেটে ফেলে উন্মাদ হয়ে. সে গল্প পরে .

    ফিরে যাই পল গগ্যাঁর গল্পে. একেবারে শিল্পীর অন্তিম সময়ে . তাই আবার চার্লস স্ট্রিকল্যান্ড ফিরে আসেন .

    ছবির জগত . এ এক অদ্ভুত মায়াবী পৃথিবী. আদিম অরণ্য , নগ্ন মানুষেরা হেঁটে যায় গাছের নীচ দিয়ে . রং আর রং . কী অপার সৌন্দর্য আর রহস্যময়তা ! নি:শ্বাস পড়ে না . পড়ে না চোখের পলক . ভয় হয় খুব . চোখের পলক ফেললেই যদি মিলিয়ে যায় এই অপার্থিব স্বপ্নদৃশ্য ! আদম আর ইভ কি এই চোখেই প্রথম তাকিয়েছিল পৃথিবীর দিকে ? যে মানুষ এই ছবি আঁকতে পারে , সে জেনে গেছে প্রকৃতির সৃষ্টিরহস্য . সব কিছু তার নখদর্পণে . একই সঙ্গে এত কিছু জানা ! চরম পুণ্যফল, নাকি পাপ ? ইন্দ্রের সুরসভায় ঝংকারের মতো এই ক্যানভাসের অন্তর্লীন ভাবটি. প্রকৃতির পাতায়, ফুলে, ফলে এক অনামা আমন্ত্রণের ইঙ্গিত . সারা জীবনের সব ব্যর্থতা, সব গ্লানি, সব অপ্রাপ্তি ধুয়ে মুছে গেছে সৌন্দর্যের অমৃতধারায়. সেই ক্যানভাসের কথায় বলছি...যার শীর্ষক " Where do we come from ? What are we ? Where are we going ?”

    ( পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত )

    ষষ্ঠ পর্ব
    .................

    ভেসে যাই ...সবুজ অন্ধকারে
    .......................................

    এবার একটু পরিবর্তন আসুক . আগে আলাপচারিতা , পরে পরিচিতি .

    থিও নেমন্তন্নর চিঠি দিল ভিনসেন্টের হাতে . পার্টি দিচ্ছে অঁরি রুসো . কার্ডে সুন্দর একটা কবিতা লেখা, আর ফুলের গুচ্ছ আঁকা .

    " এ কে থিও ?"

    " চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত খাজনা আদায়ের সামান্য চাকরি করত . মফ:স্বলে থাকত. রবিবার রবিবার ছবি আঁকার খেলা. কয়েক বছর আগে পারীতে এল , আর ফিরল না . এখন থাকে শ্রমিক পল্লীতে . কাগজে কলমে ছবি আঁকা শেখেনি. তবু আঁকে, কবিতা লেখে, সুর দেয় . ছোট বাচ্চাদের পিয়ানো আর বেহালা শেখায় , কয়েকটা ড্রইং -এর মাস্টারি করে . "

    "কী ধরনের ছবি আঁকে ?"

    " অদ্ভুত জঙ্গলে কিম্ভূতকিমাকার জানোয়ার . আদিম বন্যতা ওর রক্তে . "

    " আঁকে কেমন ?"

    " বুঝি না. সবাই বলে মাথামোটা , পাগল . তবে ওর মনটা একেবারে শিশুর মতো সরল ."

    " পার্টি দিচ্ছে . অনেক রোজগার ?"

    " সারা শহরে ওর চেয়ে গরীব শিল্পী আর নেই . বেহালাটাও ভাড়া করা . যেখানে থাকে , দিনমজুরের আস্তানা . "

    দরজা খুলল রুসো . হৃষ্টপুষ্ট চেহারা , চৌকো মাথা, থ্যাবড়া নাক আর কী শিশুর মতো সরল একজোড়া চোখ ! কয়েকটা বাচ্চা বেহালার ছড় টানতে তৈরী . রুসো নিজেই বানিয়েছে কিছু কেক , পেস্ট্রি .

    রুসো বলল , " সমালোচক গীলুম পিলে এক্ষুনি আসবেন দলবল নিয়ে."

    গাড়ির আওয়াজ . রুসো দরজা খুলে দিল শশব্যস্তে .চপল নারীকণ্ঠ.

    " আরে একটা হাত রেলিঙে দাও, অন্যটা নাকে... উফ ..."

    কথাগুলো কানে এসেছিল রুসোর . সে ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে সরল চোখে হাসল .

    সুবেশা সুন্দরী নারীরা , দাম্ভিক কয়েকটি পুরুষ .

    এক পিঙ্গলকেশী তরুণী বলল, ' সকলের সঙ্গে আলাপ করব না ? আপনি বুঝি মহান শিল্পী রুসো ?আমার হাতটিতে চুমো খাবেন না ?"

    চারজন বালক কাঁপা কাঁপা হাতে বেহালায় ছড় টানল . সরল গ্রাম্য সুর. পিয়ানোয় রুসো. অতিথিদের ঠোঁটে বাঁকা হাসি . এবার কী গান ? রুসোর কথায় , সুরে ? কিন্তু রুসোর কন্ঠ ! ফলে সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই . শ্রোতারা অট্টহাস্য করে উঠলেন.

    এরপর পানভোজন .

    পিলে বললেন " নতুন কী আঁকলে রুসো ? ল্যুভরে যাবার আগে একবার চক্ষু সার্থক করে নিই .'

    সবাই ছবিগুলো ঘিরে দাঁড়িয়ে . এবং উড়ো মন্তব্য ভেসে আসে .

    " কী দারুণ ছবি !"

    " এমন সৃষ্টি অবিনশ্বর !"

    " এটা কিনব. কত দাম ?"

    রুসো বিগলিত . " পঁচিশ ফ্রাঁ .'

    " এই অমর শিল্পের দাম এত কম ? আপনি নীচে একটা সই করে দিন প্লীজ ."

    দেওয়াল থেকে ছবি নামিয়ে আনে রুসো.

    " আপনার জন্য এটি আঁকলাম .."

    পিলে বললেন , " সত্যি ? আহা, এটাই তোমার আঁকা সেরা ছবি . "

    রূপকথার জঙ্গল . প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী . সবাই হট্টগোল করছে.

    " এটা কী ?"

    " সিংহ নাকি ?"

    " না না , বাঘ "

    " যা: , এটা আমার ধোপানীর মুখ. "

    " না না. এটা আমার পাওনাদার . দেখছ না, কেমন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে ."

    রুসো আমতা আমতা করে বলল , "ইয়ে , মানে এটা একটু বেশি. তিরিশ ফ্রাঁ."

    পিলে বললেন , " আরে বেশি বলছ কী হে ! এই ছবি তো আমার বংশধর তিরিশ হাজারে বিক্রি করবে. "

    রুসো গুনছে. একশ' পাঁচ ফ্রাঁ .

    রুসো মুখ তুলে তাকাল ভিনসেন্টের দিকে. শিশুর চোখে .

    ভিনসেন্ট নিষ্কম্প গলায় বলল, " মুখোশটা এবার খুলে ফেল রুসো . আমি শহুরে আদমী নই. আমিও ছবি আঁকি. তোমার মতোই অবুঝ তাগিদে. রুসো, ওরা তোমাকে পাগল ভাবে. "

    "জানি. তোমাকেও. ওরা যা খুশি ভাবুক. দিন আমাদেরও আসবে. একদিন আমার ছবি ঝুলবে ল্যুক্সেমবার্গ গ্যালারিতে .."

    " আর আমারটা ল্যুভরে ."

    বিধাতা অলক্ষ্যে নড়েচড়ে বসেছিলেন . অভয়বাণীও.

    " তথাস্তু ."

    এবার রুসোর জীবন .

    " প্রকৃতিকে উপভোগ করব দু'চোখ ভরে আর ভরিয়ে দেব ক্যানভাস...এই সুখ আমাকে আর কোনো কিছুই দেয় না . সৌন্দর্যই তো শ্রেষ্ঠ সুখের প্রতীক. যে নিসর্গদৃশ্য আঁকে, তাকে নিস্তব্ধতার মধ্যে থাকতে জানতে হয়. "

    অঁরি রুসো . চাকরিজীবনের শুরু উকিলের কেরানিগিরি করে. এরপর ১৮৬৩-১৮৬৮...ফরাসী সেনাবাহিনীতে . তারপর ১৮৬৯-১৮৯৩..একটানা শুল্ক আদায়ের কাজ. তাও পাতি দ্বিতীয় শ্রেনীর কর্মচারী . তবে কিনা মায়নেপত্তর কম হলেও দিব্যি ছুটিছাটা মেলে. একটা অনুমতিপত্র আদায় করে সোজা ল্যুভর . ১৮৮৪ সাল. নিজে নিজেই মকশো করা. মাস্টারপীস দেখে দেখে. বয়স যে অনেকই হল , চল্লিশ পার . পরামর্শ মেলে জ্ঞানী গুণীশিল্পীদের কাছ থেকে. উল্লেকযোগ্য নাম জাঁ লিওঁ জেরোম .

    জঙ্গল বড় টানে রুসোকে . রেস্ত নেই , তাই বইপত্র ভরসা, ছবির বই যত. আর আছে বড় বড় গাছে ভরা বোটানিকাল গার্ডেন . কল্পনায় সাত সমুদ্র সাতাশ নদী পেরোনো যায়. তাই ক্যানভাসে একসঙ্গে জায়গা করে নেই বিভিন্ন মহাদেশের জীবজন্তু . রুসোর ছবিতে কল্পনার সৌন্দর্য, আদিম, বন্য. তাই ফুটপাথে পড়ে থাকা বাতিল ক্যানভাস যত্নে তুলে নিয়েছিলেন পিকাসো.

    খুব কি শিশুসুলভ ? খুব বন্য আর আদিম ?

    ১৮৮৬ থেকে প্রতি বছর পারীর বার্ষিক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে রুসোর ক্যানভাস...সিউরা আর গগ্যাঁ আর আর্মান্দ গিলেমিনের পাশাপাশি ?

    সমালোচকের ব্যঙ্গ ? দূর, রুসো হাসেন শিশুর সারল্যে. এই ইতিবাচক মনোভাব রুসোকে মদত দিয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে , ছবি আঁকা চালিয়ে যেতে .

    ১৯০৫ . সেই বিখ্যাত সুবৃহৎ ক্যানভাস " The hungry lion throws itself on the antilope.”

    ১৯০৮. পিকাসো কিনে নিলেন রুসোর আঁকা অনেক ছবি আর আয়োজন করলেন রুসোর সম্মানে এক বিশাল ভোজসভার. রুসোকে পরবর্তীকালে স্বীকৃতি দেওয়া হয় surrealistic চিত্ররীতির অন্যতম পুরোধা হিসেবে . রুসোর আয়ুষ্কাল ৬৬ বছর .

    সমালোচকদের বক্রোক্তি গ্রাহ্য করেননি রুসো. শেষ হাসি হেসেছিলেন তিনিই.

    রুসোর সমাধিতে লেখা আছে :" আমরা তোমাকে শেষ নমস্কার জানাই. স্বর্গের দরজায় তোমার জন্য আমরা নিয়ে যাব কিছু নি:শুল্ক উপহার..তোমার রং, তুলি আর ক্যানভাস . তোমার অবসরের বিনোদনের যে ওই একটিই পন্থা . সত্যের আলোয় রেখো তোমার মনন, তোমার দৃষ্টি, তোমার ক্যানভাস . আর ছবি এঁকো . যেমনটি তুমি আজীবন... নক্ষত্রের দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে ."

    ( ষষ্ঠ পর্ব সমাপ্ত )
  • pharida | 192.64.40.129 | ১৭ আগস্ট ২০১৩ ২১:৫৩620080
  • ভারি সুন্দর লেখা। যত্ন নিয়ে। সময় লাগে পড়তে। ভাবতে। বুঁদ হয়ে যেতে। সার্থক।
  • I | 24.96.38.227 | ১৮ আগস্ট ২০১৩ ০০:০৪620081
  • পড়ছি। বেজায় ভালো লিখছেন।
  • শিবাংশু | 127.197.241.112 | ১৮ আগস্ট ২০১৩ ০০:০৭620082
  • সরস, শ্রমসংকুল ও সার্থক লেখা। অপেক্ষায় থাকা যায়।
  • nina | 78.34.162.175 | ১৮ আগস্ট ২০১৩ ০১:৪৬620083
  • ছবির কথা , কথার ছবি --অনবদ্য।
  • Ishani | 233.239.152.244 | ১৯ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৩৫620084
  • সপ্তম পর্ব
    .....................

    ক্যানভাসে রঙিন সংলাপ
    .......................................

    " শিল্প সুন্দর হতে বাধা কোথায় ? এমনিতেই তো পৃথিবীতে অনেক কিছুই অসুন্দর . দু:খ , ব্যথা , বিবাদ বিসম্বাদ . এ সবই আসে যায়. শেষ পর্যন্ত শুধু রয়ে যায়...যা কিছু সুন্দর ."

    পিয়ের অগ্যুস্তে রেনোয়া .

    নিতান্ত সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবার . রুজি রুটির ধান্দায় বালকটি কাজ জুটিয়েছে এক চিনেমাটির কারখানায় . উদয়াস্ত খাটুনি .. হঠাত একদিন কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে সে . বা:, ছোকরা বেশ আঁকে তো ! শুরু হল নতুন কাজ . ওই কারখানাতেই . চিনেমাটির জিনিসপত্রে ছবি আঁকা . এরপর খুব কষ্টে টাকাপয়সা জমিয়ে আর্ট স্কুল . ততদিনে সে কৈশোর প্রায় পেরিয়ে গিয়েছে . ছেলেটিকে ল্যুভর বড্ড টানে . তাই সুযোগ পেলেই ছুটে যায় সেখানে . কত যে ছবি ! একবার গেলে যেন আর আসতেই ইচ্ছে করে না .

    ১৮৬২ . পারীতে ছবি আঁকা শিখছে ছেলেটি . মোলাকাত হয় সিসলে , বেজিল আর ক্লদ মোনের সঙ্গে . তখন যে কী দুরবস্থা ! ছবি আঁকার জন্য রং কেনারও পয়সা নেই . অথচ প্রদর্শনীতে ছবি দিতে হবে . সেই ১৮৬৪ সাল থেকেই তো বার্ষিক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ . সাফল্য ? কই ! ভাগ্যলক্ষ্মীর কৃপা পেতে কেটে যায় আরও দশটি বছর . ততদিনে বেধে গেছে ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধ.

    ১৮৭১ . প্রথম সফল শ্রমিক আন্দোলন. পারীতে . রেনোয়া ছবি আঁকেন সীন নদীর তীরে . পারী কমিয়ুনের কেউ কেউ সন্দেহ করে , কে জানে..লোকটা গুপ্তচর কিনা ! জলে ফেলে দিলেই ঝামেলা চুকে যায় . সলিল সমাধি . সেই সময় রাওল , এক দুঁদে নেতা চিনতে পারেন রেনয়াকে.

    " আরে, এই লোকটাই তো একবার আমায় বাঁচিয়েছিল !"

    নিছক কপালগুণে প্রাণ বাঁচে রেনোয়ার.ভাগ্যিস !

    ১৮৭৪ সালে ভেঙে গেল জ্যুল রেক্যুরের সাথে বন্ধুত্ব . সে ছিল দীর্ঘ দশ বছরের সখ্য . শুধু সম্পর্কই নষ্ট হল না , চলে গেল যখন তখন তাদের ফন্তেব্লুর বাড়ি গিয়ে নিরিবিলিতে ছবি আঁকার সুযোগও .

    প্রথম সাফল্য এল ১৮৭৪ -এই . ছ'টি ক্যানভাস প্রদর্শিত হল ইম্প্রেশনিস্টদের প্রদর্শনীতে . ওই একই বছর লন্ডনে ড্যুরান্ড রুয়েলের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় আরও দু'টি ছবি .

    ১৮৮১. রেনোয়া আলজেরিয়ায় . এ তো রঙের জাদুকর দেলাক্রোয়ার স্বপ্নের দেশ ! তারপর মাদ্রিদ . স্পেন. ভেলাস্কের প্রেক্ষাপট . ইতালি বাদ যাবে ? ফ্লোরেন্সেই তো তিশিয়ানের যত মাস্টারপীস . রোমে সদর্পে বিরাজমান রাফায়েল-এর অজস্র কাজ .

    ১৮৮২ র ১৫ ই জানুয়ারী . রেনোয়ার পরিচয় হল বিখ্যাত সুরসাধক ভাগনারের সঙ্গে . সিসিলির পালেমোতে . মাত্র ৩৫ মিনিটে ভাগনারের পোর্ট্রেট এঁকে দেন রেনোয়া .

    সেই বছরই নিউমোনিয়া রোগে ছ'সপ্তাহ শয্যাবন্দী . আলজেরিয়ায় . আর তখনই স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধল শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি .

    ১৮৮৩ . মাত্র এক মাসের মধ্যে রেনোয়া আঁকলেন ১৫ টি ছবি . বেশিরভাগ ছবিতেই ম্যুলা হিউ . ইংলিশ চ্যানেলের এক মনোরম দ্বীপ . পাগল করা নিসর্গ. সমুদ্রের নীল জলে, আকাশের রংবাহারে , পাহাড় , জঙ্গলে .... রেনোয়া দু'হাতে এঁকে যেন কুল পান না. প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ তে এই ছবিগুলির ক্ষুদ্র সংস্করণ ডাকটিকিটে ব্যবহার করা হয় .

    এরপর মমার্ত . সুজান ভালাদঁকে মডেল করে সেই বিখ্যাত ক্যানভাস " The Bathers” ( ১৮৮৫-১৮৮৭) . আর " Dance at Bougival” ( ১৮৮৩). এই সুজান বহু নামী দামী শিল্পীর মডেল. কালক্রমে নিজেই এক বিখ্যাত চিত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন.

    ১৮৮৭ তে রাণী ভিক্টোরিয়ার অনুরোধে তিনি ফরাসী ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টিং ক্যাটালগে নিজের অনেকগুলি ছবি দান করেন .

    ১৮৯০ . বিয়ে করলেন " Luncheon of The Boating Party”( 1881)-র মডেল ভিত্তোরাইনকে. অবশ্য ততদিনে ভিত্তোরাইনের গর্ভে একটি পুত্র জন্মেছে রেনোয়ার . এরপর পরিবারের সদস্যদের অনেক ছবি আঁকেন তিনি .

    ১৮৯২ .রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস . হাত প্রায় অচল . জীবনের শেষ কুড়ি বছর তো হুইলচেয়ারে বন্দী হয়েই কেটে গেল ! সেভাবেই ছবি আঁকা. হাতে পক্ষাঘাত , আঙুল অসাড় . আর সেই অসাড় আঙুলে তুলি বেঁধে ছবি এঁকে চলেছেন রেনোয়া .

    ১৯১৯-এ ল্যুভরে গেছেন রেনোয়া. আ:, কী শান্তি ! তাঁর ক্যানভাস জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ববন্দিত চিত্রীদের ক্যানভাসের পাশে. এবার তো মৃত্যুকে ডেকে নেওয়াই যায় !

    রেনোয়ার ছবি মানেই ঝকঝকে আলো , সংপৃক্ত রং , নরনারীর নিবিড় অন্তরঙ্গ মুহূর্তের নিখুঁত কম্পোজিশন . নগ্নিকা চিত্রণে তিনি সিদ্ধ . ইম্প্রেশনিজমের সার্থক শিল্পী রেনোয়া ক্যানভাসে রং ছড়িয়েছেন অকৃপণ হাতে , পরম নৈপুণ্যে আর ক্যানভাসের চরিত্ররা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে , একে অন্যের সঙ্গে লীন হয়ে গেছে অনায়াস আলোয় আর রঙের বৈভবে .

    রেনোয়ার প্রথমদিকের ছবিতে ইউজিন দেলাক্রোয়ার খুনখারাপি বর্ণবৈচিত্র্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব . আছে ক্যামিল করোর অত্যুজ্জ্বল আলোর প্রভাবও . রেনোয়া যে কুর্বে আর মানের চিত্রশৈলীর অনুরাগী ছিলেন , তাও বোঝা যায় . তাই হয়ত প্রথমদিকের ছবিতে এসেছে কৃষ্ণ বর্ণের নিপুণ ব্যবহার . পছন্দের তালিকায় ছিল দিগার তুলির টান . কারণ তাতে কেমন সুন্দর ফুটে ওঠে নরনারীর চলাফেরার সহজাত ভঙ্গি .

    ১৮৬৭ সালে আঁকা ছবি " Diana " . কুর্বের ছবিতে যে বাস্তবতার প্রকাশ, সেই ছায়াটি এখানেও স্পষ্ট. খুব স্বাভাবিক প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির আলোছায়াময় পরিবেশে বলিষ্ঠ চেতনার রঙে ক্যানভাসে তুলির টান দিয়েছেন রেনোয়া . এটি পৌরাণিক চরিত্র আধারিত. হয়ত ছবি হিসেবে রেনোয়ার অন্য অনেক ছবির মতো মাস্টারপীস নয় ; কিন্তু এতে নারী অবয়বের শরীরী আবেদনকে অস্বীকার করা যায় না. এই ছবির মডেল ছিলেন লিস ত্রেহ , রেনোয়ার সেই সময়ের রক্ষিতা এবং অন্য বহু ছবির মডেল .

    ১৮৬০ সালে খোলা আকাশের নীচে আলো আর জলের খেলা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা শুরু হল . রেনোয়া আর ক্লদ মোনে . কী আশ্চর্য ! ছায়ার রং তো মোটেই বাদামী বা কালো নয় . বস্তু থেকে যে রঙের আলো প্রতিফলিত হয়, বিশেষ মুহূর্তে ...সেই মুহূর্তটিতে ছায়ার রংও তাই . এই অন্তর্দৃষ্টির ফসল অনেক ক্যানভাস, পাশাপাশি বসে আঁকা এবং একই নিসর্গদৃশ্য উপজীব্য করে , যেমন “ La Grenouillere” (1869).

    ১৮৭৬ . বিখ্যাত ছবি " Dance at Le Moulin de la Galette”... খোলা আকাশের নীচে এক ঝাঁক নারীপুরুষ .

    দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবি , বাস্তব সব দৃশ্য চোখ ঝলসানো রঙের বাহারে এঁকেছেন রেনোয়া . আর আলোরই বা কী রকমফের ! ১৮৮০-র মাঝামাঝি সময় থেকে অবশ্য রেনোয়া অনেক বেশি সংযত রেখা ও রঙের প্রয়োগকৌশলে . এই সময়েই ছবি ওই "The Bathers ". এরপরের পর্যায়ে রাফায়েল আর রেনেসাঁ যুগের অন্য চিত্রীদের ছবি দেখে নিজেকে আবার খানিক অন্যভাবে তৈরী করে নেবার চেষ্টা . ফিরে যাওয়া ক্লাসিসিজম -এ . তখন আবার অবয়বের রেখাগুলি আরও যেন স্পষ্ট আর বলিষ্ঠ .

    ১৮৯০ . আবার নিজেকে বদলানো দরকার. এবার তুলিতে রঙের প্রলেপ অপেক্ষাকৃত লঘু . বাইরের রেখাগুলি কেমন যেন আবছা, ধুয়েমুছে গেছে... এই সময়ে প্রচুর ন্যুড স্টাডি আর গার্হস্থ্যের ছবি . যেমন " Girls at the piano” (১৮৯২) আর " Grandes Baigneuses” (১৯১৮-১৯১৯)

    রেনোয়া ক্লান্তিহীন উদ্যমে এঁকেছেন কমপক্ষে কয়েক হাজার ছবি . প্রতিটি রঙে , রেখে, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল .

    লরেন্স গোয়িং লিখেছিলেন " আর এমন কোনো সম্মানীয় আধুনিক চিত্রকর আছেন কি , যাঁর ক্যানভাস আলোকিত করে আছে সুদর্শন পুরুষ আর সুন্দরী রমণীকুল ? সেই সঙ্গে চিত্তাকর্ষক রম্য অনুভব ? এই সব ক্যানভাস দেখার পর যা মনে রয়ে যায় তা শুধুই এক মধুর অভিজ্ঞতা নয় ; ব্যাখ্যাতীত এক সুরভিত জীবনবোধও বটে ! রেনোয়ার ছবির নারী পুরুষ..স্পর্শ করতে সাধ জাগে ! মনে হয় রক্তমাংসের , এতই জীবন্ত ! এতই আবেদনময়, এতই স্বাভাবিক, এতই মালিন্যহীন. "

    রেনোয়া বলতেন , " শিল্পের আকুতি যেন তোমাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলে . তোমাকে জড়িয়ে ভরিয়ে রাখে...সেই আশ্লেষ, সেই মমতা...সারাটি জীবনের সম্বল হয়ে থাক . তা না হলে শিল্পী হিসেবে নিজের অদম্য আবেগ তুমি ফুটিয়ে তুলবে কেমন করে ? এই আবেগ তোমার দর্শকদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তোমারই সঙ্গে সঙ্গে...আলোকিত অনুভবের উজানগঙ্গাজলে ."

    এবার আর আলাপচারিতা নয়. একটি গল্প বলব.

    ক্লদ মোনে আর রেনোয়া . দুই বন্ধু . একসঙ্গে একই বিষয়ে অনেক ক্যানভাস . মোনের প্রথম প্রেম অষ্টাদশী সুন্দরী ক্যামিল দঁসিয়ু . মোনের ইচ্ছে বিয়ে করার. বাবা বিরূপ. বহু মনান্তরের পর প্রণয়িনীর পাণিগ্রহণ করেন ১৮৭০ সালে. ইম্প্রেশনিজম নিয়ে শতেক পরীক্ষা নিরীক্ষা দুই বন্ধুর. বন্ধুপত্নী ক্যামিলকে মডেল করে রেনোয়া আঁকলেন তেলরঙের ছবি ". ১৮৭৪-এ . ছবির মাপ ৬৫.৫ সে.মি X ৫৪.৪ সে.মি. ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৫...দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর অটুট সৌহার্দ্যে একসঙ্গে শিল্পচর্চা করেছেন দুই চিত্রী . এরপর ১৮৭৯-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা গেল মোনের স্ত্রী ক্যামিল.

    মোনের দ্বিতীয় স্ত্রী এলিস . ঈর্ষাকাতর নারী. সে সব নষ্ট করে ফেলল নির্মম হাতে. ক্যামিলের সব আলোকচিত্র , সব স্মৃতি . যা যা ছিল বাড়িতে . শুধু কোনভাবে এলিসের আগ্রাসী কোপ থেকে রক্ষা পায় একটিমাত্র আলোকচিত্র. ১৮৭১-এ তোলা . এটি এলিস খুঁজে পায়নি ! ইম্প্রেশনিজম -এর ইতিহাসে অসংখ্য মডেল . স্ত্রী ও পুরুষ. ক্যানভাসে অনেক মুখ, অনেক শরীর. তাদের আলোকচিত্রও উদ্ধার করা হয়েছে অগুণতি . কিন্তু ক্যামিল সম্ভবত একমাত্র মডেল, ওই বিবর্ণ , প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া আলোকচিত্রটি বাদ দিলে যে প্রবল উপস্থিতি নিয়ে ভীষণভাবে বেঁচে আছে দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর একাধিক বর্ণময় ক্যানভাসে .

    ( সপ্তম পর্ব সমাপ্ত )

    .....................................................................................................................................................................

    অষ্টম পর্ব
    ....................

    আলোয় আকাশ ভরা
    ......................................

    প্রতিভা . যার থাকে , তার থাকে . আর যার থাকে না ? তাকে নিজেকে ঘষে মেজে তৈরী করে নেবার অন্তত একটা চেষ্টা করতে হয় ! তবে এদুয়ার্দ মানের দরকার হয়নি নিজেকে খুব ঘষে মেজে তৈরী করার . কারণ তিনি প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন.

    তথাকথিত বুর্জোয়া পরিবারের সন্তান. বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ বিচারক . মা কূটনীতিবিদ -দুহিতা এবং সুইডেনের রাজকুমারের ধর্মপুত্রী. এমন পরিবারে জন্মালে বাবা মায়েদের ছেলের ভবিষ্যতের জন্য উচ্চাশা তো আকাশছোঁয়া হবেই ! কিন্তু ছেলের আবার সাধ আহ্লাদ অন্য . তার পছন্দ কলম পেন্সিলের বদলে রং তুলি, অঙ্ক খাতার বদলে ছবি আঁকার কাগজ . বাবা মা খুব চেয়েছিলেন , ছেলে আইনজীবী হোক. কিন্তু ছেলে একবগ্গা.

    মানের মামা তবু খানিক ভাগ্নের মন বোঝেন . মাঝেমাঝেই ল্যুভরে যাবার ব্যবস্থা করেন . বাবা কিন্তু নিজের ইচ্ছের কথা জানান দেন বারেবারেই. অবশেষে তিতিবিরক্ত হয়ে মানে ১৮৪৮ সালে নৌবহরের জাহাজ চপে ব্রাজিল . বাবা নিশ্চিন্ত . ছেলে নৌবাহিনীতে যাবে. এক বছর বাদে দেশে ফেরেন মানে . নৌবাহিনীতে যোগদানের পরীক্ষায় ডাহা ফেল . এবং পরপর দশটি বচ্ছর . বাবা মা অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করে দেন আর্ট স্কুলে.

    ১৮ বছর বয়স . শিক্ষক থমাস ক্যুতুর . রেখায় , রঙে প্রাথমিক শিক্ষালাভ . কয়েকটা বছর কেটে গেল শুধু ল্যুভরে বসে একটানা কপি করার কাজে .

    ১৮৫৩-১৮৫৬ . ইতালি, জার্মানি , হল্যান্ড ভ্রমণ . দেখতে হবে তো...ভেলাস্কে , গয়ার ছবি !

    একটানা ছ'বছর শিক্ষানবিশী . তারপর নিজের স্টুডিও . তখন জনপ্রিয়তম চিত্ররীতি...রিয়ালিজম . আঁকলেন " The Absinthe Drinker ". দিব্যি সফলও হলেন . কিন্তু এবার ঝোঁক হল ইম্প্রেশনিজম নিয়ে কাজকর্মের . চ্যাটালো তুলির টানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি . কে নেই তাতে ? গায়ক , পথিক , ভিখিরি , ভবঘুরে . বিষয়বস্তু প্রথাগত বা চিরাচরিত নয়. অঙ্কনশৈলী প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত. ছবি দেখে দর্শক নড়েচড়ে বসল .

    “ Concert ( or, Music) in The Tuileries Garden”. মানে ছবি আঁকছেন খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা . লোকজনের ছবি , রাস্তার ছবি . যখন সকলে ছবিটি দেখল, কেউ ভাবল অসমাপ্ত; আবার কেউ বুঝে নিল শিল্পী কী বলতে চেয়েছেন .
    ১৮৬৩ . মানের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যানভাস " The Luncheon on the grass” . ছবিতে দু'টি যুবক পরিপাটি পোশাকে , পাশে এক নগ্নিকা . এই ছবিটি মানে পাঠিয়েছিলেন পারীর বাত্সরিক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে , যেটির আয়োজক Academie des Beaux-Arts.

    নির্বাচকরা বিচলিত . এই ছবি ? ছি ছি , এ তো অশ্লীল ! অবশ্য মানে একা নন , সেবছর ৪০০০ ছবি বাতিল করা হয় . মানের এই ছবিটির সঙ্গে আরও কিছু শিল্পীর কিছু বাতিল ছবি যোগ করে তৃতীয় নাপোলিয়ঁ প্রতিষ্ঠা করলেন The Salon des Refuses .

    এই সময়েই মানে বিবাহ করলেন তাঁর পিয়ানো শিক্ষয়িত্রী সুজন লীনহফকে . গুজব , এই ডাচ মহিলা নাকি মানের পিতার একদা-রক্ষিতা . বিবাহের আগে অবশ্য প্রণয় পর্ব চলেছিল এক দশক ধরে . মানের শিশুপুত্র ১৮৬১-র ছবি " Boy carrying a sword” আর " Balcony” তে খুদে মডেল ; আর সুজান তো অনেকই ছবিতে , যেমন “ The Reading.”

    ১৮৬৫ . চিত্রপ্রদর্শনীতে গেল " Olympia ". নজরকাড়া পোর্ট্রেট . তিশিয়ানের "Venus of Urbino " দ্বারা প্রভাবিত . অর্ধশয়ান নগ্ন নারী এক. সরাসরি চোখ রেখেছে তার দর্শকদের দিকে . আবার সেই এক অশ্লীলতার অভিযোগ . নির্বাচক, দর্শক...সহমত . শুধু সমসাময়িক শিল্পীরা বরণ করে নিল মানের এই নব্য দৃষ্টিভঙ্গি . রিয়ালিজম থেকে এল ইম্প্রেশনিজম . ল্যুভরে স্থান পেতে অলিম্পিয়ার লেগে গিয়েছিল ৪২ বছর !

    এই ছবি দর্শক বা সমালোচকদের সমাদর পেল না ? হতাশ মানে স্পেনে . আঁকলেন " The Spanish Singer ".

    ১৮৬৬ . বন্ধুত্ব হলো সাহিত্যিক এমিল জোলার সঙ্গে . ১৮৬৭ তে ফরাসী কাগজ "Figaro " তে মানের জন্য জোলা লিখলেন বিশেষ শংসাপত্র . জোলার মতে, এভাবেই তো প্রথা ভেঙে শিল্পীরা বিপ্লব আনবে ! মুগ্ধ হলেন শিল্প সমালোচক ল্যুই দ্যুরান্তি . মুক্তকন্ঠে সমর্থন করলেন মানেকে . মানের বন্ধুতালিকায় তখন সেজান, দিগা , মোনে
    প্রমুখ .

    মানের আঁকা ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ক্যাফের ছবি . বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে স্কেচ করা . তা থেকে পরে কত ক্যানভাস ! ঊনিশ শতকের পারী ধরা পড়েছে “ At the café”, “ The beer drinkers”, “ The café concert”- এ .

    মানের ছবিতে পাশাপাশি উঠে এসেছে বুর্জোয়া সমাজ আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনের ছবি . আবার কিছু যুদ্ধের বিধ্বংসী তাণ্ডবলীলার ছবিও আছে .

    পারী অবরোধের সময় মানের স্টুডিও প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়. তখন এক ডীলার অবশ্য ৫০০০০ ফ্রাঁ -র বিনিময়ে কিছু ছবি অক্ষত অবস্থায় সংগ্রহ করে রাখেন.

    ১৮৭৪ . মানেকে প্রথম ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির প্রদর্শনীতে ক্যানভাস দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান সমসাময়িক চিত্রকর বন্ধুরা . মানে এই চিত্ররীতির সমর্থক হলেও অংশগ্রহণে অসম্মত হন . এভাবে পরপর এমন ৭ টি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি . কী অদ্ভুত আচরণগত বৈপরীত্য , তাই না ? অবশ্য আচরণেই বা বলছি কেন ? ৪২০ টি ছবিতেও তো তাই . বারেবারেই. শোষক-শোষিত, প্রথামাফিক- মৌলিক....ক্রমাগত বিপরীতধর্মিতার আলোছায়া .

    ১৮৮১ . ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান “ Legion d’ honour-এ ভূষিত .

    এবার একটি ছোট সংশয় . এক শিল্পীর চোখ কি অন্য শিল্পীর প্রতিভা চিনে নিতে পারে না ? নাকি নিছক অসূয়া ?
    মানে একবার কথা প্রসঙ্গে রেনোয়া সম্পর্কে ক্লদ মোনেকে বলেছিলেন , " এই ছেলেটার তো কোনো প্রতিভায় নেই. তোমার তো বন্ধু . ওকে বুঝিয়ে বল না... ছবি আঁকাটা ছেড়ে দিতে !"
    আবার ভেলাস্কের ছবি দেখে কী উচ্ছ্বাস, " উনি শিল্পীদের শিল্পী."

    একটি মজার কাহিনী বলি. মানে একটি তেলরঙে আঁকা ক্যানভাস বিক্রি করেছেন চার্লস এফ্রুসিকে. দাম ঠিক করা হয়েছে ৮০০ ফ্রাঁ. ছবির নাম " A bunch of asparagus ". এফ্রুসি পাঠিয়েছেন ১০০০ফ্রাঁ . মানে তো শালীন , ভদ্র, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে সিদ্ধবাক . একটি চিরকুটে লিখে পাঠান , " আপনাকে পাঠানো ক্যানভাসে ফুলের গুচ্ছটিতে কিন্তু একটি ফুল কম আঁকা আছে. "

    মানে সারা জীবন বিশ্বাস করে গেছেন, প্রকৃতিতে কোনো পৃথক রেখার অস্তিত্ব নেই. শুধুই নানা রঙের বুনন , যা একে অন্যের সঙ্গে মিশে গেছে . আর এই রংকে অনুভব করতে হবে মনন দিয়ে .
    আক্ষেপ করেছেন, সমালোচনা তাঁর ওপর আছড়ে পড়েছে শিলাবৃষ্টির তীব্রতা নিয়ে . বলেছেন , " কেউ কি বিশ্বাস করবে , একটিমাত্র অবয়বকে ক্যানভাসে ধরে রাখা কতটা কঠিন ? সেই শরীরটির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিভঙ্গ কতটা মনোযোগ দাবি করে শিল্পীর কাছে ? আর কতখানি পরিশ্রম আর কল্পনার স্বচ্ছতা মিশে আছে সেই অবয়বে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে ? "

    ( অষ্টম পর্ব সমাপ্ত )
  • nina | 78.34.162.175 | ২০ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৩২620085
  • বাহ! কত যত্ন নিয়ে আঁকছ তুমি ছবি-----খুব ভাল লাগছে।
  • Ishani | 233.239.152.244 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৩০620086
  • নবম পর্ব
    .................

    আলোকে মোর চক্ষু দু'টি.
    ......................................

    দিগা .

    বাবা ফরাসী , মা আমেরিকান. মধ্যবিত্ত পরিবার . বাড়িতে গানবাজনার চর্চা চলে খুব . মা শখের অপেরা গায়িকা , বাবা মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসর বসান . ছেলে আঁকতে ভালোবাসে . তা ক্ষতি কী !

    ১৮৫৩ . দিগার বয়স ১৮ বছর. অনুমতি মেলে ল্যুভরে গিয়ে নামী দামী শিল্পীদের ক্যানভাস নকল করার . নকল করেন নিপুণভাবে রাফায়েল, ইনগ্রিস আর দেলাক্রোয়ার ছবি. ১৮৫৫ তে আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ . কিন্তু মন বলে, "পালাই , পালাই .' তাই একবছর পরেই তিন তিনটি বছর শুধু ঘুরে বেড়ানো . ইতালিতে তো যেতেই হবে. সেখানে মিকেলেঞ্জেলো , ভিঞ্চি...এই সব প্রাচীন বিখ্যাত চিত্রীদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে দেন দিগা .

    পারীতে ফিরে আসেন ১৮৫৯ সালে. শুধু পোর্ট্রেট আঁকা তখন . সে এক পর্ব . বাড়ির লোকজনের ছবি যত. আবার কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক দৃশ্যও আছে . " The daughter of Jephtha” , " Semiramis building Babylon” , আর " Scene of war in the middle ages”.

    পারীর বাত্সরিক প্রদর্শনীতে জমা দিলেন ছবি . নির্বাচকরা তেমন নড়েচড়ে বসলেন না.

    ১৮৬২ তে ল্যুভরে আলাপ হল মানের সঙ্গে. সখ্য আর প্রতিযোগিতা হাত ধরে পথ হাঁটে পাশাপাশি . দিগা গ্রহণ করেন মানের দৃষ্টিভঙ্গি . নতুন শৈলী , নতুন বিষয়বস্তু বেছে নিতে হবে .

    ১৮৬৮ . ঘনিষ্ঠতা বাড়ে . মানে, রেনোয়া , মোনে , সিসলের সঙ্গে .

    ১৮৭০ . শুরু হল ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়া যুদ্ধ . দিগা যোগ দিলেন জাতীয় সুরক্ষা বিভাগে . পারী অবরোধের সময় অবশ্য ঝামেলা এড়াতে তিনি দীর্ঘদিনের জন্য চলে যান নিউ অর্লিয়েন্সে .

    ফিরে আসেন ১৮৭৩ -এর শেষে . মোনে, সিসলে ...সবার সঙ্গে শুরু করেন নিজেদের প্রদর্শনী. আর সেই সঙ্গে শুরু হয় নতুন চিত্ররীতির. ইম্প্রেশনিজম .

    এপ্রিল ১৫, ১৮৭৪ . ইম্প্রেশনিস্টদের প্রথম প্রদর্শনী. দিগার তরফ থেকে জমা পড়ল আধুনিক নারীদের পোর্ট্রেট . কেউ টুপি বিক্রি করে, কেউ কাপড় কাছে , কেউ বা ব্যালে নর্তকী. পরের ১২ বছর ধরে এমন আরও আটটি প্রদর্শনীতে দিগার ছবি দেখানো হয়েছে. " The dancing class”( 1871), “ The dance class”( 1874), “ Woman ironing”(1873) , “Dancers practicing at the bar”(1877).

    ১৮৮০ . এবার একটি ভাস্কর্য. " The little fourteen year old dancer”.কী ভীষণ মন তোলপাড় করা ! কেউ বলল "কী প্রতিভা !" কেউ তকমা সেঁটে দিল নিষ্ঠুরতার . দিগার ছবি খুব বিশদে যে রাজনৈতিক বাতাবরণকে আশ্রয় করেছে , তা নয়. তবে ফ্রান্সে যেভাবে রাজনীতিকে আশ্রয় করে সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও..সে সবই ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার সচেতন প্রয়াস আছে . এভাবেই এসেছে বুর্জোয়া সমাজের মানুষজন , শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের নারীপুরুষ আর ধীরে ধীরে কর্মজগতে নারীদের প্রবেশের সূচনা.

    ১৮৮৬ . এই বছরেই অষ্টম ও শেষ ইম্প্রেশনিস্টদের প্রদর্শনী . দিগা দিলেন ১০ টি ক্যানভাস . বিভিন্ন ধাপে স্নানদৃশ্য . নগ্ন রমণীদের . আবার ঝড় বয়ে গেল বিতর্কের . কেউ বলল "অশালীন " , আবার কেউ বলল "সৎ প্রচেষ্টা " . দিগা এমন নগ্নিকা এঁকেছেন কয়েক শ' . একই সঙ্গে চলছে নর্তকীদের নিয়ে আঁকা . কী নিপুণ তুলিতে এঁকেছেন , সাজঘরে তাদের মুখে অপমানের রং , আবার মঞ্চে তারাই যখন সম্রাজ্ঞী...তখন যে কী উজ্জ্বল অহঙ্কারের দ্যুতি !

    বিয়ে করেননি দিগা . তবে নারীরা তো আনাগোনা করেইছে . নারীচরিত্রের আলোছায়া এমন অনায়াস দক্ষতায় খুব কম শিল্পীই ধরতে পেরেছিলেন . শরীরী সৌন্দর্য যে এত মোহময় এত বিভম জাগানো হতে পারে, আগে কেউ হয়ত সেভাবে ভাবেইনি ! দিগা তাঁর অধ্যবসায়ী তুলি , নিপুন ঝকঝকে উপস্থাপনার জন্য পাশ্চাত্য চিত্রকলার ইতিহাসে ধ্রুবতারার মতোই জ্বলজ্বল করবেন.

    অনেক খুঁজেও দিগার কোনো ব্যক্তিগত রোজনামচা পানি. কিছু উক্তি শুধু . তবে মানুষ যা ভাবে, তাই তো ভাষায় প্রকাশ করে. আমিও নাহয় সেটুকুই এই পরিসরে ভাগ করে নিই .

    " আসল কথাটা হল , পূর্বসূরীদের অনুসরণ কর . তবে অন্ধ আনুগত্যে নয় . চেষ্টা কর সেই নির্যাসটুকু গ্রহণ করে স্বকীয়তা প্রমাণ করার .
    পঁচিশ বছর বয়স ! তোমার প্রতিভা থাকলে সবাই স্বীকৃতি দেবেই . কিন্তু পঞ্চাশে তা ধরে রাখতে পারা খুব সহজ কাজ নয় .
    ছবি হল সত্যের হদিস দেওয়া, মিথ্যের আবরণে . নিসর্গের সত্য র্রপ্তি কি তুলির টানে ধরা যায় ? আমরা মিছিমিছি চেষ্টাই করে যাই.
    দিনের আলো ফুটিয়ে তোলা সহজ . আমি খালি ছুটি কঠিন যা কিছু..তার পিছু পিছু. তাই প্রদীপের আলো কিংবা জ্যোত্স্না !
    শিল্প . তুমি যা দেখছ, তা নয় . তুমি যা অন্যকে দেখাও..সেটাই . "

    আর মৃত্যুশয্যায় সেই করুণ কথা ক'টি.." একী ! আমি আর বাঁচব না ? দিন ফুরিয়ে এল ? আমি যে সবে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছি . এই তো সবে আঁকতে শেখার শুরু!"

    (( নবম পর্ব সমাপ্ত )

    দশম পর্ব
    .................

    বাতাসে কুসুমগন্ধ ভাসে
    .....................................

    ক্লদ মোনে .

    মোনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিখুঁত গঠন আর আলো . আর সেই তাগিদেই সরে এসেছিলেন রিয়ালিজম থেকে ইম্প্রেশনিজম -এর দিকে . মোনে একবার বলেছিলেন ," আমার যেটুকু ক্ষমতা, তা শুধু নিসর্গকে একেবারে সামনাসামনি রেখে তা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলায় . আমার প্রকৃতিকে দেখার পর যে বোধটি হয় , যথাসম্ভব তাকে প্রকাশ করা. "

    মোনে ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের তালিকায় রয়েছেন একেবারে প্রথম দিকেই .

    বাবা ছিলেন জাহাজের ব্যাবসাতে , আর মা ? গান গাইতে পারতেন ভালো, কবিতা ভালোবাসতেন . মোনের ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ঝোঁক . চটপট স্কেচ করেন, আর ব্যঙ্গচিত্র . মার সমর্থন পেলেও বাবা কিন্তু চান , ছেলে পারিবারিক ব্যাবসায় আসুক . তা কপাল মন্দ . মা মারা গেলেন যখন, মোনে তখন নেহাত ছেলেমানুষ . স্কুলে যান, অজস্র ব্যঙ্গচিত্র . চেনা জানা কেউ আর বাদ নেই !

    আলাপ হল ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী ইউজিন বদ্যাঁর সঙ্গে . ইউজিন মোনেকে শেখালেন প্রকৃতিকে ভালোবাসতে .

    ১৮৫৯ . মোনে এলেন পারীতে . পরিচয় হল পিসারোর সঙ্গে. পরিচয় সহজেই গড়িয়ে গেল বন্ধুতায়.

    ১৮৬১-১৮৬২ . আলজেরিয়ায় চলে গেলেন মোনে . যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে. কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে সেখান থেকে ছাড়া পান . আবার পারি. এবার বন্ধু তালিকায় রেনোয়া, বেজিল. মোনে নিসর্গদৃশ্য আঁকেন . নানা উপদেশ দেন নিসর্গচিত্রী জোহান জংকাইন্ড . মোনে আমৃত্যু যোহনের ঋণ স্বীকার করে এসেছেন .

    ১৮৬৫ . বার্ষিক প্রদর্শনীতে দু'টি ক্যানভাস নির্বাচিত হল মোনের . নৌ -জীবনের ওপর . কিন্তু অর্থকষ্ট সেই আগের মতোই . পরের বছর আবার দু'টি ছবি. ওই পারীর বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীতেই . এবার একটি ল্যান্ডস্কেপ আর একটি পোর্ট্রেট . পোর্ট্রেটটি " Camille - Woman in green " . মডেল ছিলেন তাঁর ভাবী স্ত্রী ক্যামিল .

    বাবা বিরূপ . কোনো অর্থসাহায্যের আশাই নেই . গুজব আছে, এই সময় তীব্র হতাশায় মোনে নাকি সীন নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেন . ফ্রাঙ্কো- প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে মোনে চলে যান লন্ডনে. ওখানেই পরিচয় পল ড্যুরান্ড রুয়েলের সঙ্গে ; যিনি মোনের প্রথম আর্ট ডীলার .

    যুদ্ধ শেষে আবার পারী . আবার রেনোয়া , মানে ও অন্যান্য বন্ধুরা . মোনে ও বন্ধুরা মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন “ Societe Anonyme des Artistes , Peintres , Sculpteurs , Graveurs”. মাঝে মাঝেই হতাশা এসে দানা বাঁধে বুকের গভীরে . কিছুই কি করে ওঠা গেল না জীবনে ? শোনা যায় , মোনে নাকি ৫০০-র ওপর ক্যানভাস ছিঁড়ে, পুড়িয়ে নষ্ট করে দেন !

    এই সোসাইটির ১৮৭৪-এর প্রদর্শনীটি বৈপ্লবিক . এটিতে মোনের ছবিটি ছিল " Impression :Sunrise” (1873)... Le Havre’s Harbour in the morning fog . সমালোচকরা ওই ছবির প্রেক্ষিতে ইম্প্রেশনিস্ট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন. এ কথাও বলা হয়, এগুলিতে স্কেচ বেশি, রং তুলির ব্যবহার নাকি কম ! বেশ তো ! ওই শব্দটি কিন্তু থেকে গেল. অমর হয়ে.

    মোনে সারাজীবন চেষ্টা করেছেন সুন্দর আর স্বাভাবিক নিসর্গকে ঠিক ঠিক আলো, ছায়া আর রঙের বৈচিত্র্যে ধরে রাখতে তাঁর বলিষ্ঠ তুলির টানে . একটু একটু করে সরে গেছেন প্রাচীন শৈলী, রীতি আর ভাবনা থেকে. এসেছে নাগরিক জীবনের টুকরো টুকরো বিষয়...ক্যানভাসে আধুনিকতা আনতে.

    ক্যামিল মারা গেলেন বড় অসময়ে. দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেবার অব্যবহিত পরেই . সেই মৃত্যুদৃশ্যও ধরা আছে মোনের ছবিতে.

    ক্যামিল মারা যাবার পর মোনে আঁকলেন " Ice drift " সিরিজ . এগুলিতে কোমলতার ছোঁয়া অদৃশ্য. অন্তরঙ্গতা হল এলিসের সঙ্গে . আর এলিস পর্ব কিছু লিখেছি আগেই . যেখানে আছে রেনোয়ার কথা .

    ওয়াটার লিলি . এই জলজ ফুলটি মোনের বড় প্রিয় . অনেকগুলি ছবি এঁকেছেন এই ফুলটিকে বিষয় হিসেবে নয়ে . ক্যানভাসে আছে জাপানী সাঁকোর ছবি . " Cathedral in Ronen " আঁকার সময় গীর্জার ঠিক উল্টোদিকেই একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন শিল্পী..যাতে গীর্জাটিকে আঁকবার সময় ঠিকমতো দেখা যায় . অনেকগুলি ক্যানভাসে এই গীর্জা আছে...দিনের বিভিন্ন সময়ে . আলোর তারতম্যে . ভোরের আলোয় , কাঠফাটা দুপুর রোদে , মেঘলা আকাশের পটভূমিতে. আলোর খেলা পাগল করে দিত মোনের শিল্পীমনটিকে . এই আলো বারবার ঘুরেফিরে এসেছে গাছের পাতায় , খড়ের গাদায় , নদীর জলে.

    এরপর তো কিউবিজম . মোনে একটু কোণঠাসা . তবুও কিন্তু জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও . আঁকলেন ১২ টি ছবির সিরিজ . ওয়াটার লিলি. এবার বেছে নিলেন অনেক বড় মাপের ক্যানভাস.

    মোনে লিখেছিলেন , " এই জল আর জলে যত প্রতিবিম্বআমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয় . বয়স হয়েছে, ক্ষমতা কমে এসেছে..তবুও এই জল আর আলোর খেলা... এই আকর্ষণ যে কী অমোঘ !"

    "আমি এখন আর আগের মতো ছবি আঁকতে পারি না . বয়স তার নখ দাঁত বের করে আমাকে আক্রমণ করেছে . আমার সারাটা জীবন শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা. মারা যাবার আগে সব নষ্ট করে দেব আমি. সব ছবি ."

    " খুব স্বচ্ছ জল. জলের একেবারে নীচে শ্যাওলা , জলঝাঁঝি কেমন তিরতির করে নড়ে . দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় . কিন্তু আঁকার চেষ্টা করি যেই, উফ, আমার শুধু পাগল হতে বাকি থাকে! .;

    " নিসর্গ নিজের সৌন্দর্যে স্থির থাকে না . প্রতি মুহূর্তে আকর্ষণ বজায় রাখার জন্য তাকে নিজেকে বদলাতে হয় !''

    " আর রং ? আমায় পিছু পিছু তাড়া করে ফেরে . এমনকি স্বপ্নেও ."

    এবার একটি গল্প বলি . তবে গল্প হলেও সত্যি .

    তরুণ চিত্রী জন সিঙ্গার সার্জেন্ট . আট স্কুলে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র . ল্যুভরে দেখা মোনের সঙ্গে. কিন্তু কিন্তু গলায় জিজ্ঞেস করলেন ," আপনিই কি ক্লদ মোনে ?" মোনে তখন ৩৬ . আলাপ হল . টুকিটাকি কথাবার্তা. এবার কফি খেতে যাবার ইচ্ছে. সার্জেন্ট বললেন , "চলুন . cafe de le Paix " তে যাওয়া যাক . মোনে বললেন , "তার চেয়ে cafe du helder ভালো ." বেশ , তবে তাই ! মোনে পরে বলেছিলেন, " ছি ছি কী লজ্জা ! গিয়ে দেখি ওই কাফের দেওয়া ভর্তি শুধু আমার আঁকা ছবি ! কী ভাবল ছোকরা ? আমি নিজের ঢাক পেটাতে নিয়ে গেছি ." এ কথা স্বপ্নেও ভাবেননি সার্জেন্ট. তিনি ছিলেন পোর্ট্রেট শিল্পী . আমৃত্যু মোনের ছবির মুগ্ধ সমঝদার . দুজনের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন ছিল ৫০ বছর . কোনো বৈরিতার ব্যাপারই ছিল না ; যদিও সার্জেন্ট দারুণভাবে সফল ত্রিশ বছর বয়স পেরোতে না পেরোতেই অথচ মোনে পঞ্চাশ বছরে পা দেবার আগে কোনো স্বীকৃতিই পাননি ! মোনে ছবি আঁকছেন...এটি সার্জেন্ট নিজের তুলিতে ক্যানভাসে ধরে রেখেছিলেন . তাঁর বাড়ির দেওয়ালে মোনের আঁকা ৪ টি ক্যানভাস . সার্জেন্ট একটি চিঠিতে মোনেকে লিখেছিলেন , " বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা. নিজের ঘরে. আপনার আঁকা ছবির সামনে . আমার এই পর্ণকুটিরে রংমশাল জ্বালিয়েছেন আপনি. একটা কথা, যদি কখনও অর্থের প্রয়োজন হয় , এই যে ব্যাঙ্কের নামটি আপনাকে দিলাম..এখানে সবাই আমার সই চেনে. কাগজটি দেখাবেন . আমার খোলা নির্দেশ দেওয়া আছে, আপনার যে কোনও ঋণপত্রের অংশীদার হিসেবে আমি নিজের দায় সানন্দে বহন করতে স্বীকৃত হয়েছি. আর একটা কথা, আমি কিন্তু নেশার ঝোঁকে একথা লিখছি না ." বন্ধুত্ব এমনটাই . শর্তহীন , , আন্তরিক , মনসিজ .

    মোনে লিখছেন , " খুব বৃষ্টি . আমি ছবি আঁকছিলাম. তাড়াহুড়ো করে ইজেল, ক্যানভাস সরিয়ে দিলাম একপাশে . পাছে ভিজে যায় . দেখছি . দু'চোখ মেলে . আমার চারপাশে কী অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি . ছবি আঁকার জন্য আমার যত দুর্বিনীত সাহস হেলায় তুচ্ছ করে . আমার ক্ষমতায় নেই এই সৌন্দর্য বেঁধে রাখি তুলির বন্ধনে, ক্যানভাসের ছোট্ট পরিসরে. প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, আমি কেন জন্মান্ধ হলাম না ! তারপর হঠাত করে একদিন দৃষ্টিমান হতাম যদি . তাহলে শুধুই আলো আর রং আঁকতাম. কোনও বস্তু আর চোখের সামনে এসে আমার মন:সংযোগে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত না ."

    ( দশম পর্ব সমাপ্ত )

    অন্তিম পর্ব
    .....................

    যে আঁধার আলোর অধিক
    .........................................

    " আমরা , আর্লবাসীরা , হলফ করে বলছি , ভিনসেন্ট ভ্যান গখ এক বিপজ্জনক উন্মত্ততার শিকার . একে জনসাধারণের মধ্যে অবাধে ঘোরাফেরা করতে দেওয়া উচিত নয় . আমাদের শহরের কর্তৃপক্ষের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ , এই উন্মাদকে কারাগারে বন্দী করে জনজীবন নিরাপদ করা হোক ."

    ভিনসেন্টের কানের ক্ষত শুকিয়ে এসেছে. কিন্তু মনের ঝড় ? তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেন্ট রেমিতে . আর্ল থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূরে এক মানসিক চিকিত্সালয় . একেবারে শান্ত জীবনযাত্রা চাই তার . কোনো উত্তেজনা নয় .

    সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে. ধূসর সবুজ প্রান্তর, নীলচে আকাশ, দিগন্তে পাইন গাছের ছায়া . নিকষ কালো অন্ধকার শুষে নেয় প্রকৃতির সবটুকু আলো আর রং. এখন শুধু নিজের আত্মার মুখোমুখি বসে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা . কিন্তু এখানে সবাই তো বদ্ধ উন্মাদ ! এদের সঙ্গে কী করে থাকবে ভিনসেন্ট ?

    কিছুদিন পর অনুমতি মেলে বাইরে গিয়ে ছবি আঁকার. সারাটা দিন পাহাড়ে , জঙ্গলে. সাইপ্রেস কুঞ্জ. সোনালি দৃশ্যপট . সারাদিন অবিশ্রান্ত ছবি এঁকে যায় . তার রক্তে নেশা ধরিয়ে দেয় ওই সাইপ্রাস . ছবি আঁকা শুরু হয় . ছবির সামনের দিকে নানা গুল্ম, পেছনে বেগনী পাহাড় , গোলাপী সবুজে মেশা আবছা আকাশ , বাঁকা চাঁদ .

    তিন সপ্তাহ ধরে জ্বরে আচ্ছন্ন ভিনসেন্ট . আবার কিছুদিন পর বাইরে বেরোতে শুরু করলো সে. আঁকল উজ্জ্বল হলুদ সূর্যের নীচে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সাইপ্রেস কুঞ্জ , জলপাই সংগ্রহ করছে মেয়েরা , বেগনী মাটি আর হলুদ চাষের জমি , ব্রোঞ্জ রঙের গাছে ধূসর সবুজ পাতা , নীলচে আকাশ .

    শরতের শেষ . প্রকৃতি অপরূপা . মাটি ভ'রে যায় ভায়োলেটে , গোলাপ গাছের নীচে ঘাসের রং এখন লালচে সবুজ , গাছের পাতা কেমন রোদ্দুরের রঙ্গে রং মিলিয়ে সোনালি সবুজ, আকাশ নির্মেঘ . এই সেন্ট রেমি আর্লের মতো তাকে মাতাল করে দেয় না. সূর্যের তেজ অপেক্ষাকৃত কম . প্রকৃতি তার মনকে দিব্যি বেঁধে রাখে .

    আবার অসুস্থতা. ছবি আঁকতে গিয়েছিল মাঠে. গভীর রাতে তাকে পাওয়া গেল অজ্ঞান অবস্থায় . সাইপ্রেস কুঞ্জের গায়ে .

    পাঁচ দিনের দিন জ্ঞান ফিরল তার . সে শোনে নার্সরা আলোচনা করছে , " লোকটা ছবি এঁকে এঁকে পাগল হল, নাকি পাগল বলেই ছবি আঁকে ?" তার মনে পড়ে যায় দেলাক্রোয়ার উক্তি, '' যখন আমার বুকে নেই শ্বাসপ্রশ্বাসের জোর , মুখ নিদন্ত .. তখন আমি আবিষ্কার করলাম এই অঙ্কনশিল্পের জাদু ."

    ভিনসেন্ট খেয়াল করে দেখেছে , তার মানসিক উন্মত্ততার আঘাত আসে তিন মাস অন্তর. এবার আগে থেকেই সাবধান হতে হবে.

    তৃতীয় মাস . গভীর আট. ভিনসেন্ট বিছানা ছেড়ে উঠে আসে . সারা মুখে লেপে দেয় কয়লা . ভোরবেলা হাসপাতালের লোকজন খুঁজে পায় তাকে .কখনও বিড়বিড় করে বকছে , কখনও বা একেবারে চুপ .

    আবার সুস্থ হয় সে. ছবি আঁকে . ওয়ার্ডের , বাগানের. নিজের প্রতিকৃতিও ..আয়নায় দেখে দেখে. সময় হয়ে এল রোগের আক্রমণের . তিন মাস কাটতে চলেছে . থিওর কাছে নিজেই চলে যাবে সে. এখনও তো সুস্থ আছে . অভারে গিয়ে পৌঁছলেই সে ভালো হয়ে যাবে .

    ঠিকঠাক নিরাপদে থিওর বাড়ি পৌঁছে গেল ভিনসেন্ট. থিও, জোহানা , ফুটফুটে বাচ্চাটা... খুব আনন্দ হচ্ছে তার . জোহানা একেবারে তার মায়ের মতো . দেখা করতে আসে বন্ধুরা. হই হই করে জুটে যায় লোত্রেক . আ: , আবার সেই পুরনো চেনা জীবন !

    থিওর ডেস্কে এগুলো কী ? যত চিঠি লিখেছে সে..থিওকে..সব গুছিয়ে তারিখ অনুযায়ী কেমন সুন্দর সাজিয়ে রাখা . নিজের সব ক্যানভাস দেওয়াল জুড়ে সাজায় ভিনসেন্ট. ডেকে নেয় জোহানা আর থিওকে . ভিনসেন্ট বলে ," আমি ছবি আঁকতে পারতাম না. বাবা বলেছিলেন , খারাপ থেকে কখনও ভালোর জন্ম হতে পারে না. আমি বলেছিলাম, শুধু যে জন্ম হয়, তাই নয়. শিল্পের ক্ষেত্রে এ জন্ম অবশ্যম্ভাবী. আমি কি আঁকতে পারি এখন ? তোমরা কী বল ?"

    থিও চায় ভিনসেন্ট ভালো হয়ে উঠুক. সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাইকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে . স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ . এখানে কিছুদিন থাকুক ভিনসেন্ট. প্রতি রবিবার আসবে থিও. জোহানা আর বাচ্চাটাকে নিয়ে .

    কিছু কিছু ছবি আঁকে সে . ক্যাথলিক গীর্জাটা আঁকতে পারলে বেশ হয় ! কিন্তু কী ক্লান্তি . মাটিতে শুয়ে পড়ে ভিনসেন্ট . শুয়ে শুয়েই আঁকে শস্যক্ষেতের ছবি , মাদাম দ্যবিনির বাড়ির ছবি . আঁকে দিনান্তের হলুদ আকাশের পটভূমিতে দুটি ন্যাসপাতি গাছ.

    আজকাল তার আঁকে আগের মতো রং আছে. কিন্তু রস নেই . শুধু আগের তীব্র আকুতির সামান্য কিছু রেশ . মনে যে আগুন দশ বছর ধরে জ্বলেছিল , তার প্রতিটি স্ফুলিঙ্গ ছবির রেখায় রেখায় ফুটিয়ে তুলে আজ সে ক্লান্ত . শুধু পড়ে আছে খানিক শুকনো ছাই .

    কিছুদিন কাটে . আবার আসে জুলাই মাস . দুপুরে জ্বলন্ত সূর্যের নীচে ফাঁকা ক্ষেতে শুয়ে থাকে ভিনসেন্ট . জীবনেও তুলি ধরতে শিখল না সে ! শুধুই ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা .

    ভিনসেন্ট . চোখে মুখে এ কী অপ্রকৃতিস্থতা ! ও কি কোটের পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘোরে ? কেঁপে ওঠেন ডাক্তার .

    মাথার ওপর আগুন ঝরায় সূর্য . ধেয়ে আসছে অগুণতি কালো পাখি. আর দেখা যায় না সূর্যকে . ভিনসেন্টের সমস্ত চৈতন্যকে ডানার ঝাপটানিতে আচ্ছন্ন করে দেয় তারা . " সোনালি শস্যক্ষেতে কালো পাখিরা ."
    ঘন্টা বেজে গেছে . শেষ প্রহরের . এই ঘন্টাধ্বনি প্রথম সে শুনেছিল আর্লে. এই শেষবার . পৃথিবী মধুময়. অন্ধকার ছিল বৈকি ; কিন্তু আলোও তো ছিল অসীম. .

    এবার আর কোনও ভুল নয়. গুলিটা ঠিক জায়গায় লাগাতেই হবে. আর মাত্র দিন দুয়েক বেঁচে ছিল ভিনসেন্ট .

    এসেছিল থিও , পিয়ের ট্যাঙ্গি , রুসো , এমিল বার্নার্ড , অরিয়ার . ছিলেন ডাক্তার নিজেও. লোত্রেক ? তখন উন্মাদাশ্রমে. মৃত্যুর অপেক্ষায় . কাফে রাভোঁ টে ভিনসেন্টের কফিন. কোনও ধর্মযাজক ছিলেন না. শুধু দেওয়াল জুড়ে সাজানো ছিল তার সব ক্যানভাস. কাফেটে ছিল না বিজলিবাতি . প্রয়োজনও ছিল না .ভিনসেন্টের ছবিগুলো আধ অন্ধকার কাফেতে হাজার ঝাড়বাতির রোশনাই এনে দিল .

    ক'দিন বাদে সমাধিক্ষেত্রে ডাক্তার ছড়িয়ে দিলেন সূর্যমুখীর বীজ .

    যন্ত্রণার অন্য নামটি সৃষ্টি. শিল্পী ভিনসেন্টের সেই সৃষ্টির আনন্দবীণায় সুর বেঁধে দিয়েছিল থিও. যে কাঁচা লোহা দু:খের আগুনে ঝলসে ঝকঝকে ইস্পাত হয়ে চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বের , থিও ছিল সেই আগুনের দীপ্তি . আড়ালে থেকে বিধ্বস্ত ক্লান্ত এক সৈনিকের শাণিত তরবারির মুখ সে বারেবারে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই অদৃশ্য আততায়ীর দিকে ..যার অনেক নাম... দারিদ্র্য, বেদনা, বিদ্রূপ, অভিশাপ.

    থিও পথ বেঁধে দিয়েছিল ভিনসেন্টের . সৃষ্টির উল্লাসে প্রমত্ত বিভ্রান্ত ভিনসেন্টের , যে ভিনসেন্ট তার তুলির রেখায় শোনাতে চেয়েছে জীবনের গান আর আঁধার ঘিরেছে তাকে বারবার...যে আঁধার আলোর অধিক....

    ( সমাপ্ত )

    আমার কথা
    .................

    এই আখ্যান এখানেই শেষ . ভিনসেন্টকে দিয়ে শুরু . তাই ভিনসেন্টকে দিয়েই শেষ . আর কলেবরে বাড়ালাম না কারণ যতই লিখি ...ততই লেখার ইচ্ছে বাড়ে আর অন্য অনেক নাম ফিসফিস করে বলে, " আমাকে ভুলে গেলে " ? তাই যতি টানাই শ্রেয় .এটি উপন্যাস বা গল্প নয়. তাই মৌলিক রচনা হিসেবে দাবী করতে পারি না . কারণ তথ্য আর তত্ত্বনির্ভর লেখার ক্ষেত্রে প্রামাণ্যতা খুব জরুরী . বইপত্রের সাহায্য নিয়েছি যা কিছু..সবই বিদেশী ভাষায় . মাতৃভাষায় লেখার যদি কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে থাকে , সেই দায় একান্তভাবেই আমার একার . বিদেশী ভাষার বইগুলির সূত্র দিলাম .

    1 . Encyclopedia Britannica
    2. The Colour Library of Art ( Standard Literature)
    3. Lust for Life (Irving Stone )
    4. The Moon and Six Pence ( William Somerset Maugham )
    5. Germinal ( Emile Zola)
    6. Letters to Theo ( Vincent Van Gogh )
    7. Louvre ( A complete guide comprising of photographs of each and every exhibit alongwith a brief history.)

    আর তিনটি বাংলা বইয়ের থেকে কিছু অংশ তুলে ধরেছি লেখার প্রয়োজনে. তিনটিই ভাষান্তরিত . "লাস্ট ফর লাইফ", "দ্য মুন এন্ড সিক্স পেন্স " এবং "জার্মিনাল ". তবে তিনটি ভাষান্তরই আমার নিজের করা এবং প্রকাশিত গ্রন্থ. কাজেই নিজের কাছে নিজের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দায় থাকে না আশা করি . তিনটি বঙ্গানুবাদেরই প্রকাশক ছিল "পত্রপুট ".
  • ঐশিক | 213.200.33.67 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ১০:৫৩620087
  • ঈশানী দি ,
    খুব ভালো লাগলো এতদিন পড়িনি একসাথে পড়ব বলে, ভালো থাকবেন আরো লিখবেন
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন