এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • achintyarup | 59.93.243.119 | ০৯ অক্টোবর ২০১১ ০৫:২০480408
  • আদমপুর তালুকের কথা। (চ)

    আদমপুর আমাদের বাটী হইতে ৩০ মাইলেরও উপর দূরে ঠিক পূর্ব্বদিকে জয়নসাহী পরগণার পূর্ব্ব সীমান্তে এবং ময়মনসিংহ জেলারও পূর্ব্ব প্রান্থে, জেলা শ্রীহট্টের পশ্চীম সীমান্তস্থিত প্রসিদ্ধ "মাদনা' ষ্টিমার ষ্টেশনের পশ্চিম দক্ষিণ কোণে অবস্থিত। আদমপুর ও মাদনার মধ্যস্থলে প্রায় ১।। মাইল পরিসর মেঘনা নামক সুবৃহৎ নদের উর্দ্ধতন শাখা ""ভেরা মোহানা'' নামে অভিহিত হইয়া আদমপুরের তলদেশ বাহিয়া প্রবাহিত। আদমপুর অষ্টগ্রাম পোলীশ ষ্টেশনের এলাকায় স্থিত। আদমপুরের উত্তর, পূর্ব্ব ও দক্ষিণ তিনদিক্‌ বেষ্টন করিয়া উক্ত নদের বিশাল জলস্রোত অষ্টগ্রামাভিমুখী হইয়াছে। আদমপুর হইতে ক্রমে পশ্চীম দক্ষিণ কোণের দিকেই লোকের বসতী গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে চলিয়াছে। আদমপুরে ঢাকার নবাব, মূক্তাগাছার মহারাজা ও ধান-কুড়ার প্রসিদ্ধ জমীদারবাবুরা আধিপত্য বিস্থার করিয়া সাশন পরিচালনা করিতেছেন। আদমপুর বাজারে নবাব সাহেব ও মহারাজার কাছারীবাটী বর্ত্তমান আছে। বাজারের উত্তর পশ্চীম কোণে সুবৃহৎ মঠ ও মন্দিরাদি সমন্নিত সিদ্ধ সাধক সর্ব্বজন মান্য কৈবর্ত্ত কুলোদ্ধারকারী প্রসিদ্ধ ""রামকৃষ্ণ গোসাইর'' আখ্‌ড়া নামক দেবমন্দির। আদমপুরের দৃশ্য অতি মনোরম। তিনদিকে ভেরা মোহানা নদের বিশাল জলস্রোত প্রবাহিত। অদূরে জলস্রোতের অপরদিকে সুদৃশ্য মাদনা ষ্টিমার ষ্টেশন, তাহার কোলে জল পোলীশের সুবৃহৎ জলযানোপরি ষ্টেশনগৃহ শোভা পাইতেছে। প্রাতে প্রত্যহ মাদনা বাজারের কোলে নদের সৈকত সংলগ্ন জলে স্থলে দুধ মাছের হাট বসে। সন্ধ্যাকালে ষ্টেশনে যে দীপাবলী প্রঙ্কÄলিত হয়, আদমপুর হইতে তদ্দৃশ্য গঙ্গাতীরবর্ত্তী সমৃদ্ধ নগরের সান্ধ্য শোভা হইতে ন্যূন নহে। মাদনাতে ডাক বাঙ্গলা ও পোষ্টাফিস আছে। আদমপুরের তিনদিকেই জল বেষ্টিত থাকায় মাদনা হইতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে উপদ্বিপের ন্যায় প্রতীয়মান হয়। আখ্‌ড়ার মঠ মন্দির ও বাজারের বহুল টিন গৃহ এবং বৃক্ষবহুল গ্রামের শোভাও অপর দিক হইতে সুন্দরতরই দৃষ্ট হয়। স্থানটী স্বাস্থ্যকর এবং জলমগ্ন ভাটী প্রদেশের অন্তর্গত হইলেও উচ্চতায় অন্যান্য নিকটবর্ত্তী গ্রাম হইতে ভূমির অবস্থা উন্নত হেতু মশক ও মাছি ও সর্পাদি প্রভৃতি ভাটী অঞ্চলের উপদ্রব বিরহিত।

    আদমপুর পূর্ব্বে ""ঘাঘরা'' গ্রামের প্রসিদ্ধ দেওয়ান বংশের অধিকারে ছিল। কালক্রমে দেওয়ান সাহেবদের হস্তচ্যূত হইয়া নবাবত্ত (?) ও ধানকুড়া ষ্টেট এবং অন্যান্য কতিপয় ছোট২ তালুকদারের অংশ বাহুল্যে পরিণত হইয়াছে। আদমপুরে দেওয়ান বংশের এক আবাসবাটী ও খামার এবং বাগানবাটী ছিল। বাগানে সুরসাল সুমিষ্ট আম্রবৃক্ষের প্রাচুর্য্য থাকায় তাহার প্রসিদ্ধি এখনও লোকমুখে শুনা যায়। এখনও একটী কি দুইটী মাত্র পুরাতন জীর্ণশীর্ণ কলেবর আম্রবৃক্ষ বর্ত্তমান থাকিয়া সে বাগানের পরিচয় দিতেছে। দেওয়ান বংশের কোনও সুপুরুষ গ্রামের উন্নতীকল্পে উত্তর দিকে ভেরা মোহানা নদ হইতে এক জলপ্রণালী খনন করাইয়া দক্ষিণ দিকে উক্ত নদের জলস্রোতে মিশাইয়া দেওয়ায় যেমন গ্রামের শোভা ও সুবিধা বর্দ্ধিত হইয়াছে, তেমনি দস্যু তষ্করের হস্ত হইতে নৌকাপথে গমনশীল বণিক্‌, মহাজন ও পণ্যজিবী নৌকা রাত্রিকালে রক্ষা করার আশ্রয়স্থান হইয়াছে। বড় নদের কোলে নৌকা রাখা বিপদসঙ্কুল বলিয়া, রাত্রিযোগে বহু নৌকা উক্ত জলপ্রণালীর ভিতর আশ্রয় লইতে দেখিয়াছি। রাত্রিতে দীপাবলী সংবলীত নৌকাশ্রেণীর শোভাও মনকে আকর্ষণ করে।

    এখন দেওয়ান বংশের সেই সমৃদ্ধির পরিচয় আদমপুর হইতে বিলুপ্ত হইয়াছে। আমিও নীলাম খরিদাদি উপায়ে দেওয়ান বংশের অবশীষ্ট কতক হিস্যা আদমপুরে প্রাপ্ত হইয়া কালেকটরীতে বহুল বাদ প্রতিবাদ ও বিঘ্ন বাধা অতিক্রমে বাটওয়ারার ছাহাম গ্রহণে দখলাদি প্রাপ্ত হইয়া তথায় ১০ বৎসর কাল বিশেষ আধিপত্য ও সম্মানের সহিত তালুকদারী করিয়াছি। আদমপুরের হিন্দু মোশলমান নানা শ্রেণীর প্রজাগণ আমাকে দেওয়ান সাহেবের ন্যায়ই মনে করিয়াছে; ও সর্ব্বপ্রকারে বশ্যতা স্বীকার করিয়া করাদি প্রদান করিয়াছে।

    প্রজাগণের অনুরোধে প্রায় প্রতি বৎসরই জলপথে বর্ষাকালে আমাকে একবার করিয়া আদমপুর যাইতে হইত। তাহাতে প্রজাদের ও মেয়ে ছেলে পর্য্যন্ত সকলের আনন্দ বর্দ্ধন হইত এবং আমারও জলপথ ভ্রমণসুখের চরম পরিতৃপ্তি ঘটীত। রাত্রিতে নৌকায়ই নৈশ কাছারীর কার্য্য হইত, প্রজাগণ সকলেই নিজ২ নৌকারোহণে আসিয়া যোগ দিত, গ্রামের মধ্যস্থল দিয়া জলপ্রণালী প্রবাহিত। দুইধারেই প্রজাদিগের বাড়ী, জলপ্রণালীতে আমার নৌকা থাকিত, প্রজাগণকে বিশেষ ডাকিতে হইত না। কাছারির নৌকা দেখিলেই তাহারা আসিয়া জুটীত। দিবাতে কোন২ সময় কাহারও বাড়ীতে উঠিয়া কাছারীর কার্য্য হইত। ভাটী স্থান, মাছ দুধের অভাব ছিল না, প্রজারাই তাহা যোগাইত। নৌকায় রান্না হইত, কাছারির কার্য্যও চলিত। কখনও পাচক ঠাকুর, কখনও মহরের প্রকাশ, কখনও বা ভাণ্ডারী ভৃত্যই পাক কার্য্য সমাধা করিত। কোন২ যাত্রায় দুইজন ভাণ্ডারী ভৃত্যও সঙ্গে রহিয়াছে। সে এক আনন্দের খেলা ছিল। চন্দ্রকরোঙ্কÄল জ্যোৎস্নাময়ী নিশায় অদূরে মাদনা ষ্টেশনের দীপাবলী শোভিত শোভা সন্দর্শন ও নদের জলস্রোতের কল২ ধ্বনী ও সময়২ সুবৃহৎ বাষ্পীয় জলযানের গমনাগমনের কর্ণভেদী নিনাদ শ্রবণ ও তদীয় আলোকমালায় পরিশোভিত জলরাশীতে চন্দ্ররশ্মির মনোরম আভা পতনে ""ভেরা মোহানার'' জলরাশীর যে কি এক অভূতপূর্ব্ব শোভাই সন্দর্শন হইত তাহা যে দেখিয়াছে ও শুনিয়াছে সেই অনুভব করিতে পারিয়াছে, লেখনীমুখে তাহা বর্ণন করিবার যোগ্যতা আমার নাই। এই যে সংসার পরিত্যাগে পূণ্যধাম শ্রীবৃন্দাবনে আসিয়া সন্ন্যাস গ্রহণে কালাতিপাত করিতেছি, তাহাতেও সে সুখদ স্মৃতি ভূলিতে পারি নাই।
  • achintyarup | 59.93.244.9 | ১০ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৫৫480409
  • যাহা হউক সে সাধের ও সুখের এবং কর্ম্মজীবনের প্রধানতর কর্ম্মের স্মরণীয় নিদর্শন আদমপুরকে ১৩২৪ বঙ্গাব্দে হস্তচ্যূত করিতে হইল। সে কল্পনা পূর্ব্ব হইতেই মনে জাগিয়াছিল, কিন্তু এমন সাধের সামগ্রীকে -- এমন পুত্র বাৎসল্য সম্পর্কীত প্রজাপুঞ্জকে কাহার হাতে নিক্ষেপ করিয়া বিড়ম্বিত করিব? এই চিন্তা মনকে আলোড়িত করিতেছিল। এহেন সময়ে আমার অতীব শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র ধর্ম্মপ্রাণ, স্বীয় ধর্ম্মে সুদৃঢ় আস্থাবান, কর্ম্মী, অষ্টগ্রাম থানা কোয়ার্টারের একমাত্র গৌরবস্থম্ভ ও স্বনামধন্য পেন্‌সন্‌প্রাপ্ত ডিপুটী মাজিষ্ট্রেট সাহেববাহাদূর শ্রীযুক্ত সৈয়দ মৌলবী ফয়েজউদ্দিন হুসেন সাহেব অগ্রগণ্য হইয়া আদমপুরের ক্রয়েচ্ছু হইলেন। আমি অম্লানবদনে তাঁহার হস্তে সে আদরের ধনকে অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। উপযুক্ত মূল্যলাভ ও সৎপাত্রে ন্যস্ত দুইই হইল, আত্মপ্রসাদের আর অভাব রহিল না।

    এমন সুখ ও লাভজনক সম্পত্তিকে হস্তচ্যূত করায় আমার বাটীস্থ অনেকেই অসন্তোষ জ্ঞাপন করিলেন এবং সুহৃদপ্রতিম কেহ২ বিস্মিত ও দু:খিত হইলেন। তাহাদের দু:খ ও বিস্ময় দূর করার জন্য ""কেন বিক্রয় করিলাম''? এ প্রশ্নের উত্তর এখানেই দেওয়া সঙ্গত মনে করি।

    আমি ময়মনসিংহে থাকিয়া মোক্তারী কার্য্য পরিচালন ব্যপদেশে এই শতাধিক মাইল দূরবর্ত্তী জমীদার বহুল অংশী সংসৃষ্ট মহালটী ক্রয় করায় ও তাহার বাটওয়ারা দ্বারা সর্ব্বপ্রকারে নিষ্কণ্টক করায় এবং তাহার সাশন ক্ষমতা পরিচালনে যে পারদর্শীতা লাভ করিয়াছিলাম; আমার অভাবে কেহই তৎসম্পর্কে আমার স্থান পূর্ণ করিতে পারিবে বলিয়া আমার ধারণা ও প্রতীতি নাই। প্রজাগণ মধ্যে অনেককেই বলিতে শুনিয়াছি -- ""যে ব্যক্তি ময়মনসিংহ সহরে থাকিয়া জমীদার ও গবর্ণমেন্ট সহ লড়াই করিয়া এই মহাল বাটওয়ারা দ্বারা নিজের অধিকার স্থাপন করিল তাঁহাকে উপেক্ষা করিলে মঙ্গল হইবে না, তাঁহাকে দেওয়ান সাহেব মনে কর।'' এই যে ভয় ও সম্মান্সূচক উক্তি ইহা দ্বারা কি এই অনুমান হয় না যে আমাকে যেরূপ ভয়, সম্মান তাহারা করিয়াছে, অন্যের তাহা দুÖপ্রাপ্য। অবশ্য কেবল প্রজার সহ খাজানা পাওয়ারই সম্পর্ক থাকিলে বাকী করের নালীশেও সে সাধ পূর্ণ করা যায়। কিন্তু আমি যে গৌরবটুকু লাভ করিয়াছি তাহাতে তাহা সুদূর পরাহত হইবে। তালুকদারী ও জমীদারী কেবল কর আদায়ের জন্য নহে। তাহাতে আরও সুখভোগের সামগ্রী আছে এবং আরও শিক্ষণীয় বিষয় আছে।

    যাহা হউক আমার একমাত্র ছেলে, সে ওকালতী ছাড়িয়া সুদূর পল্লীতে গিয়া আমার ন্যায় তেজস্বীতা প্রদর্শন ও কষ্ট স্বীকার করিতে পারিবে ইহাই সম্ভবপর নহে ভাবিয়া ও পরে মহালের উচিত মূল্যে বিক্রয়ও দুষ্কর হইতে পারে এই আশঙ্কা করিয়াই, তাহা ছাড়িয়া দিয়া তদ্‌বিনিময়ে নগদ মুদ্রা আমার জীবন থাকিতে হস্তগত করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম।

    যাহারা আমার কার্য্য ভ্রমপ্রমাদশূণ্য বলিয়া মনে করেন ও আমার কার্য্যে শ্রদ্ধা রাখেন এমন অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছেন আদমপুর ছাড়িয়া দেওয়া সুবিবেচনার কার্য্যই হইয়াছে, দূরের সম্পত্তি কখন কি হয় বলা যায় না। সময় থাকিতে সাবধান হওয়া বুদ্ধিমানের কার্য্য।

    দু:খের সহিত লিখিতেছি, আমার আদমপুর বিক্রয়ের কথা জানিয়া প্রজারা কান্দিয়াছিল। আমি সান্ত্বনা দিয়াছিলাম ডিপুটীসাহেব আমাপেক্ষাও ভদ্র এবং ধার্ম্মিক লোক, তাঁহার অধীনে কোনও অসুখ হইবে না, ভয় নাই। এখনও নাকি প্রজারা আমার জন্য আক্ষেপ প্রদর্শন করে।

    সুহৃদসমাগম। (ছ)

    বাল্য জীবনে যাহাদের সহিত সৌহৃদ্দি জন্মে কর্ম্মজীবনে যদি তাহাদের সাক্ষাৎ ও সাহায্য লাভ হয় তবে বড়ই সুখের বিষয় হয়।

    বাল্য সুহৃদ বাবু নবীনচন্দ্র রায়, যিনি বর্ত্তমানে দিঘাপাতীয়া রাজ ষ্টেটে চিপ্‌ ম্যানেজারী পদে অভিষিক্ত আছেন, তাঁহার মহত্ব সৌজন্য ও কৃতোপকারের পরিচয় পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি।

    বাবু প্রসন্নকুমার মজুমদার নানাস্থানে শিক্ষকতা করার পর বি, এল পাস করিয়া আমার মোক্তারী কার্য্যের ১ম সময়েই দেখা দিলেন। কয়েক বৎসর সহরে একত্রাবস্থানে উভয়েই বাল্যজীবনের সুখস্মৃতির পুনরাভিনয় করিলাম। অত:পর প্রসন্ন নিজ বাড়ীর এলাকাস্থ ঈশ্বরগঞ্জ মুন্‌শেফী ওকলতীতে যোগ দিয়া বিশেষ প্রতিষ্ঠাবান্‌ হইল। সেখান হইতে সময়২ ময়মনসিংহ সহরে আগমন করিলেও উভয়ে দেখা সাক্ষাৎ ও পরস্পর সুখ দু:খের বিনিময় হইত। এখন সে কি অবস্থায় কালযাপন করিতেছে সংবাদ রাখি না। কিন্তু তাঁহার স্মৃতি হৃদয়ে জাগরুক আছে।

    বাবু মহেশ্বর চক্রবর্ত্তীও কয়েক বৎসর নানাস্থানে শিক্ষকতা করিয়া বি,এ, পাসের পর ময়মনসিংহ নগরস্থ মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে অভিষিক্ত হইয়া আসিল, আমার মোক্তারীকার্য্যের মধ্য সময়ে তাহার দেখা পাইলাম। পরস্পরের বাসা নিকটেই ছিল, যাতায়াত ও দেখাসাক্ষাতে বাল্যজীবনের সুখস্মৃতি জাগরিত হইত ও সুখ দু:খের বিনিময় হইত। মহেশ্বর এখন স্বর্গগত:; তাহাকে বাবু লিখিলাম, জীবিত থাকিলে সে এই বহী পাঠ করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলীত ও আমাকে ধিক্কার দিতেও ছাড়িত না। তাহার অকৃত্রিম ভালবাসার কথা আজীবন ভূলিতে পারিব না। তাহার অমর আত্মা চিরশান্তীলাভে জয়যুক্ত হউক, ইহাই সেই শান্তীদাতা ও পরিত্রাতা ভগবানের নিকট একমাত্র প্রার্থনা।

    ঢাকায় অধ্যয়ন কালের বাল্যবন্ধু বাবু হরকিশোর বিশ্বাসকে হঠাৎ কর্ম্মক্ষেত্রে একবার সাক্ষাৎ পাইয়াছিলাম। হরকিশোরবাবু তখন জেলা বরিশালের সেটেলমেণ্ট অফিসারের পদে অভিষিক্ত। কার্য্যব্যপদেশে ময়মনসিংহ নগরে আসিয়াছিলেন; সুখ দু:খের অনেক কথা হইয়াছিল, বাল্যজীবনের সেই নিরহঙ্কার ভাবই বর্ত্তমান আছে অনুভব করিয়া সুখী হইয়াছিলাম।

    আমার বাসায় থাকিয়া, ত্রিপুরা জেলার পত্তন গ্রামের প্রসিদ্ধ দত্ত চৌধুরী বংশের ""যোগেশচন্দ্র চৌধুরী'' নামক যে ছেলে বিদ্যাভ্যাস করিয়াছিল বলিয়া ইতিপূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি, সে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল হইতে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করিয়া ২০্‌ টাকা বৃত্তি নিয়া যায়। যোগ্যতা ও প্রশংসার সহিত ক্রমে, এফ,এ, বি,এ ও এম,এ পাশ করিয়া "ল' পরীক্ষা পাস করে এবং কলিকাতা হাইকোর্টে ওকালতী আরম্ভ করে। এই ওকালতী কার্য্যকালে সে একবার ময়মনসিংহ নগরে আগমন করিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করে; দেখিলাম তাহার বাল্যজীবনের সেই অমিয় মাখা বিনম্র ভাবই বর্ত্তমান আছে। পায় ধরিয়া অভিবাদন ও ভক্তি শ্রদ্ধার কিছুই হ্রাস হয় নাই। সে আমার বাল্য বন্ধু না হইলেও সুহৃদদিগের অগ্রগণ্য বলিয়া তাঁহার কথা এখানে উল্লেখ করিলাম। সে এখন প্রথ শ্রেণীর ডিপুটী মাজিষ্ট্রেট ও উচ্চ সম্মানের অধিকারী হইয়া আমাদের ও দেশের মুখ উঙ্কÄল করিয়াছে। তাহার স্মৃতিতে এখন আমার যে সুখ হয় তাহার তুলনা নাই।
  • achintyarup | 59.93.243.2 | ১১ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩৩480410
  • আমার মোক্তারী কার্য্যকালের চরম সময়ে আর একটী উঙ্কÄল রত্নকে আমি সুহৃদরূপে প্রাপ্ত হই। তৎসম্বন্ধে ২/৪ টী কথা বর্ণন করার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। তাঁহার নাম বাবু অতুল চন্দ্র রায় বি এল্‌। অতুল জাতীতে ব্রাহ্মণ হইলেও আমাকে পিতার ন্যায় মান্য ও শ্রদ্ধা করিয়াছে। কোন দিনও ঘুণাক্ষরেও আমার সাক্ষাতে কি অসাক্ষাতে কোন বিষয়ে চপলতা কি চঞ্চলতা প্রকাশ করিতে দেখি নাই কি শুনি নাই। আমার বাসায় অনেকগুলী ঘর থাকায় অতুল যখন ময়মনসিংহ নগরে ওকালতী করিতে প্রবৃত্ত হইল তখন ৪ খানা টিনের গৃহ তাহাকে ভাড়া দেওয়া হইল। সে এক পৃথক খণ্ড। আমিও তৎসংলগ্ন অপর খণ্ডে রহিতাম। অতুল বি এল্‌ পরীক্ষায় বঙ্গদেশের আইনসংক্রান্ত বিদ্যাপীঠে (University তে) সেবার ২য় স্থান অধিকার করিয়াছিল। তাহার গুণপনার ইহাই প্রথম পরিচয়।

    অতুল আমার ঐ ভাড়াটীয়া বাসায় ন্যূনাধিক তিন বৎসরকাল বাস করে, তৎপর নিজের অধ্যবসায় ও কৃতীত্বগুণে অচিরেই মুন্‌সেফী পদ গ্রহণে চলিয়া যায়। ওকালতি প্রসারও মন্দ ছিল না, কিন্তু তাহাতে যে গুণপনা ও তেজ বর্ত্তমান আছে, আজকালের দিনের ওকালতীতে তাহা পর্য্যবসিত হইলে দেশের ও আমাদের মুখ কখন উঙ্কÄল হইত না। বিচার বিভাগে (দেওয়ানী) অষ্টগ্রাম নিবাসী স্বর্গীয় বাবু হরিশচন্দ্র সেন মুনশেফের জীবনলীলা অবসানের পর ত আর কাহাকেও বিচারকের পদে দেখিতে পাই না। এক অতুলই ত এখন পূর্ব্ব ময়মনসিংহের একমাত্র গৌরবস্থানীয়। অতুলের ন্যায় তীক্ষ্ণ মনীষাসম্পন্ন ব্যক্তি আমাদের অঞ্চলে দ্বিতীয় নাই। তাহার পূত চরিত্রও অতুলনীয়।

    যে তিন বৎসরকাল অতুল আমার সংশ্রবে ছিল, আমি তাহার গুণে ও ব্যবহারে বিশেষ মুগ্‌ধ ছিলাম। অতুল এখনও আমার প্রতি পূর্ব্ববৎ শ্রদ্ধা ...... সুহৃদগণের মধ্যে প্রধানতম। স্নেহের ভাব এত উচ্চপদস্থ হইলেও ......

    ....... বাধা প্রদান করায় অতীব দু:খের সহিত তাহাতে নিরস্ত হইতে হইল।

    আবার মনে হইল অনেক লোকই জীবনের শেষভাগে তীর্থবাসী হয়। আমিও কোন তীর্থে গিয়া বাস করি না কেন? ""পঞ্চাশোর্দ্ধে বনং ব্রজেৎ'' এই শাস্ত্রবাক্যটা স্মৃতিপথে উদিত হইয়া মনকে ব্যাকুলিত করিয়া তুলিল। পরে ভাবিলাম, বন্‌ ত এখন আর নাই তীর্থই অর্থাৎ সাংসারিক আসক্তিশূণ্য স্থানই এখন বন্‌। তখনই আবার মনে হইল তীর্থ ত আর এখন বনসদৃশ নাই, সকল তীর্থই এখন ভোগ বিলাসের আবরণে ঢাকা পড়িয়াছে, চোর, প্রবঞ্চক, জোয়াচোর ও অসদ্‌ উপায়ে অর্থ সংগ্রহকারী লোকের আড্ডা হইয়াছে। তীর্থে গিয়া এমন বিপদশঙ্কুলাবস্থায় একা কি করিয়া বাস করিব? আমার সঙ্গে নিবার উপযুক্ত লোকও ত দেখিতে পাই না। টাকা পয়সাই বা ভ্রমণে কোথায় নিয়া রাখিব? পুন: মনে হইল না এত দুরতর স্থানে যাইব না। নিকটস্থ কোন সজ্জনের আশ্রয়ে থাকিয়া জীবনের অবশীষ্ট কাল যাপন করিব। ...ন করিয়া একদিন কাহাকেও কিছু না বলিয়া তৃতীয় মেয়ের বাটীতে ... উপস্থিত হইলাম। দিন কয়েক তথায় আরামে বাস করিয়াছিলাম।

    আমার এইরূপ এলোমেলো মনোভাব পরিলক্ষিত করিয়া অনেকে ..য়াছে যে মাথার দোষ হইয়াছে, এই হেতু পাগ্‌লামী করিতেছে, ...বিক রোগের মধ্যে আমার মাথা গরমই প্রধান ছিল, তৎসঙ্গে ... প্রমেহ জনিত মূত্রকৃচ্ছ রোগও বর্ত্তমান। কবিরাজী চিকিৎসা .........ছে না। অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তিই মত.......... দিতে পাইতাম না, বিশেষত; বিরুদ্ধবাদী লোকের সংখ্যার অপ্রতুল ছিল না, তখন তচ্চিন্তায়ই আমার মস্তিষ্ক আরও উষ্ণ হইয়া উঠিত। এহেন অবস্থায় অধিক বাক্যালাপ ও বাহিরের কার্য্য কতকটা এলোমেলো ভাবের হওয়া ত স্বাভাবিকই। কিন্তু কোন সময়েই আমার মস্তিষ্কের বিকৃতাবস্থা ঘটে নাই; যদিও অধীনস্থ লোকের প্রতি সময়২ কর্কশ ও অপ্রীতিকর বাক্য প্রয়োগ করিয়াছি, কিন্তু ন্যায়ের ও সত্যের সীমা লঙ্ঘন করিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। এইরূপ কর্কশ বাক্য প্রয়োগের কারণ ইহাই মনে হয়, আমি মনে করিতাম, আমার এত দীর্ঘকালের বহুদর্শিতা ও অভিজ্ঞতার কি এই ফল দাঁড়াইল যে আমার আজ্ঞাধিন লোকেরা পর্য্যন্ত আমার মতানুযায়ী চলিবে না!! এই চিন্তায় আমার মনে কষ্ট ও ক্রোধের যুগপৎ সম্মিলনে মাথার উষ্ণতা সমধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইত। তাহারা মনে করিত কর্ত্তার এখন বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে, আর অধিক দিন বাঁচিবেন না, তাঁহার কথায় চলা যায় না। তখন শরীরের ... দৃষ্টে অনেকে আমার মৃত্যু নিকটবর্ত্তী বলিয়াই মনে করিত। আবার ..... নাকি আমার আশু মৃত্যু আকাঙ্ক্ষাও করিত, ""এ আপদ বালাই গেলেই ...'' এই কথাটা বোধহয় তাহাদের মনে জাগিত। এই পরস্পর প্রতিদ্বন্দি .... হইতে আমার মনে গুরুতর অশান্তীর সৃষ্টি হইল। এরূপ পারি...... হইলে স্বতএব নিম্নলিখিত মহাজনোক্তি মনে উদয় হয় --

    ""যাবদ্‌ বিত্তোপার্জ্জন শক্ত, স্তাবন্নিজ পরিবারো রক্ত।
    তদনুচ জরয়া জর্জ্জর দেহে, বার্ত্তাং কোহপিন পৃচ্ছতি গেহে।।''

    এই মহাজন বাক্য হইতে ইহা প্রাপ্ত হওয়া যায় যে কেবল আমারই যে ঈদৃশ অবস্থা হইয়াছে তাহা নহে, সংসারের সকল লোকেরই এইরূপ অবস্থা বীপর্যয় শেষ জীবনে ঘটে। যাহা হউক মনকে প্রবোধ দিবার একটা পথ পাওয়া গেল। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? আমার মেজাজটা যে উল্লিখিত অশান্তীর আগুণে আরও গরম হইয়া গেল। আমার সারা জীবনেই আমি একটু চটা মিজাজের অভিনয় করিয়াছি বলিয়া মনে হয়। এই গ্রন্থের কোনও স্থানে পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি যে ""আমি ছোট কাল হইতেই কিছু কোপনস্বভাব সম্পন্ন, ইহাও বলিয়াছি যে তাহা গ্রহদোষেই ঘটীয়াছে এই জ্যোতীর্ব্বিদ পণ্ডিতগণের মত; লগ্নে রাহুর দৃষ্টি থাকায় সময়২ তাহার ফল দৃষ্ট হয়, বোধ হয় ক্রোধের অনুকূল ক্ষেত্র পাইলেই তাহা প্রবল হয়। এই জন্য আমার মতের বিরুদ্ধে কেহ কথা বলিলে কি কার্য্য করিলে তাহা আমার প্রায়ই অসহ্য হয়। ঈদৃশ স্বাভাবিক উষ্ণভাবের দরুণ আমার অধীনস্থ ব্যক্তিগণ চিরকালই কেবল ভয়ে২ মানিয়া চলিয়াছে, প্রকৃত ভালবাসার টানে আমাকে কেহ ভক্তিশ্রদ্ধা করে নাই। শেষজীবনে বাড়ীতে অল্পকাল মাত্র অবস্থান করিয়াই আমার এই ভাবটা উপলব্ধি হইল যে এখন যে অবস্থায় বাড়ীতে অবস্থিত তাহাতে ভয়ও দূরে গিয়াছে বিশেষত: ভালবাসারও অভাব হেতু সকলেই আমার আজ্ঞাপালনে বিমুখ।
  • achintyarup | 59.93.254.136 | ১২ অক্টোবর ২০১১ ০৪:৩৩480411
  • ভালবাসাশূণ্য হইয়া লোক কোথাও থাকিতে পারে না। বনে যাঁহারা একাকী নির্জ্জনে বাস করেন তাহাদিগকেও দেখি ময়ুরকে জল দিতেছেন, কুকুরকে রুটী, চড়ুইকে চানা ও গোবৎসকে মিষ্টী দিয়া মনের আনন্দ ভোগ করিতেছেন, তখন এই যে মনের আকর্ষণ ইহাকে কি বলিব? অবশ্য তাঁহারা জীবে দয়া বলিয়াই ব্যাখ্যা করিবেন, কিন্তু তাহা দয়া হইলেও আসক্তিবিশেষ -- ভালবাসারই রূপান্তর বা নামান্তর ভিন্ন কিছু নহে। আমার মন বাড়ীতে যে তিষ্ঠিতে চাহে না তাহার কারণ প্রথম এই অনুমান হয় -- আমার সংসৃষ্ট লোকের আমার প্রতি ভালবাসা বা ভাল ভাবের অভাব। দ্বিতীয় কারণের কথা নিম্নে বিবৃত করিতেছি।

    অনেক লোকেই বলিয়া থাকেন এবং অনেক বিজ্ঞ লেখক তাহা লিপিবদ্ধ করিতেও ত্রুটী করেন নাই যে দীর্ঘকাল সহরে জীবন যাপন করিয়া শেষকালে পল্লিবাসে সুখ ও সুবিধা ভোগ করা, তিনি যেরূপ পদস্থ ব্যক্তিই হউন না কেন, দুষ্কর। কদাচিত কাহারও ভাগ্যে সুখ ঘটীতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ সহর নিবাসীর পক্ষেই পল্লিগ্রামের বাস বিষময়। আমার পক্ষেও তাহাই প্রতিপন্ন হইল, ইহা অস্বীকার করিব কি করিয়া?

    গ্রামে আমার ছোটকাল হইতেই দেখিয়াছি দলাদলী বর্ত্তমান, পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন শত্রু মিত্র দুই পক্ষ সামাজিক কার্য্য পরিচালন করেন। আমার বয়:প্রাপ্তির পূর্ব্ব পর্য্যন্ত এই দলাদলী ও সামাজিক ব্যাপার যে ভাবেই চালীত হইয়া থাকুক তাহাতে কম পরিমাণই লিপ্ত হইয়াছি, তবে পিতৃবিয়োগ নিবন্ধন ও পুজ্যপাদ জ্যেষ্ঠতাতঁ রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের বার্দ্ধক্যজনিত অক্ষমতা নিবন্ধন অপ্রাপ্ত বয়সেও যে ২/৪ টা মোকদ্দমায় জড়িত না হইয়াছি এমন নহে। এই বাল্যকালাবধি মামলা মোকদ্দমা পরিচালনার অভ্যাস থাকা হেতুই বোধহয় উত্তরকালে আইনাধ্যয়ন সুগম হইয়াছিল এবং অত্যল্পকাল শিক্ষা অন্তেই পরীক্ষায় সুফল লাভ করিয়াছিলাম। যাহা হউক বয়:প্রাপ্তি ও পাঠসমাপ্তীর পর যখন বাটীতে গেলাম তখনও দলাদলী পূর্ণমাত্রায়ই বর্ত্তমান দেখিতে পাইলাম। আমোদ প্রমোদে পর্য্যন্ত দলাদলীর অভিনয় হইত। আমাদের স্বপক্ষে যাহারা ছিলেন তাঁহারা যেন আমাকে পাইয়া বিশেষ উৎসাহিত হইলেন। ৮ বৎসরকাল গ্রাম্য জীবনে এই দলাদলী ও শত্রু মিত্র ভাবাপন্ন অভিনয়ের মধ্য দিয়া অতিবাহিত হইল। স্বপক্ষে বিপক্ষে অনেক মামলা মোকদ্দমা ও বাদ বিসম্বাদে অনেক সময়েই আমাকে দলপতীর ভার বহন করিতে হইত। ঐ সময়ে মিত্র পক্ষের অনেকের উপকারকল্পে অনেক কার্য্য করিতে হইয়াছে এবং সময়২ আর্থিক ও অন্যপ্রকারে বহুবিধ ক্ষতিকে তুচ্ছ জ্ঞান করিতে হইয়াছে। ৮ বৎসর পরে যখন মোক্তারী ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইলাম তখন ভ্রাতা শ্রীমান্‌ গুরুদাসের উপর সে ভার ন্যস্ত হইল।

    মোক্তারী কার্য্যে যখন অসুস্থ শরীরে বাড়ীতে আসিলাম তখন ভাবিয়াছিলাম দীর্ঘ প্রবাসের পর যখন আবার গ্রাম্য জীবনে যাইতেছি তখন যেমন পারিবারিক সুখ লাভ করিব সেরূপ গ্রাম্য লোকের সাহানুভূতি লাভে সমর্থ হইব। কিন্তু আমার সে সুখ স্বপ্ন অল্পদিন মধ্যে বিলয়ে পরিণত হইল; পারিবারিক অশান্তীর বিষয় ত উপরেই উল্লিখিত হইয়াছে। গ্রাম্য লোকেরাও যেন আমাকে আপন বলিয়া অনেকে মনে স্থান দিলেন না। অসুস্থ শরীরে পড়িয়া আছি, আসিয়া দেখাশুনা করিলে আমার শারীরিক মানসিক অবসাদের কিছু লাঘব হইত। কিন্তু তাহা যে একবারেই আমার পক্ষে দুÖপ্রাপ্য হইল।

    তখন ভাবিলাম বিদেশ হইলেও সহরের জীবন কি সুখের ছিল, কত বন্ধু বান্ধব দিবা নিশি খোজ খবর রাখেন, পরস্পর আলাপ আপ্যায়নে কত সুখ দু:খের বিনিময় ঘটে। এই অবস্থায় কখনও মনে হইয়াছে কাজ যদি নাও করি তথাপী ময়মনসিংহ বাসায় গিয়াই বাস করি, মনের শান্তি পাইব। আমার বাসা তখনও বর্ত্তমান আছে, সে ১৩২৭ সালের কথা। মহরের প্রকাশ বাসা রক্ষা কল্পে বাসায় বাস করিয়া অপরের কার্য্য করে। প্রকাশ একবার এই সময় আমাকে দেখিতে আসিয়া বলিয়াছিল, ""চলুন্‌ বাসায়ই থাকিলে ভাল হইবেন, আমি সেবা শুশ্রুষা করিব''। প্রকাশের উৎসাহ বাক্যে একবার মন টলিলেও পরক্ষণেই মনে হইল কেবল আমার বাসের জন্য একটা বাসা রাখিয়া বৃথা খরচ বৃদ্ধি করা সঙ্গত নহে। সে চিন্তা পরিত্যাগ করিলাম।

    দেখিলাম পূর্ব্বে যাহারা মিত্র ছিলেন এখন তাঁহারাও শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। এক সময়ে যাহাদের আপদ বিপদে প্রভূত উপকার করিয়াছি তাঁহারাও এখন আমার অপকার সাধনে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। আমার অসুস্থাবস্থা ও আত্মকলহ তাঁহাদের হাস্য পরিহাসের বিষয়। দেখাশুনা ত দূরের কথা। চাকর ও ভৃত্য শ্রেণীর লোকেরা পর্য্যন্ত উচিত বেতন গ্রহনে আমার কাজ করিতে চায় না। একসময়ে মনে হয় এই শ্রেণীর লোকেরা আমার দ্বারা উপকৃত হইবার জন্য কতই না আগ্রহ সহকারে আমার সেবা পরিচর্য্যা করিয়াছে ও নানা প্রকারে উপকৃত হইয়া ধনসঞ্চয় (বলসঞ্চয়?) করিয়াছে।

    এই কারণে কোনও অভিজ্ঞ লেখক লিখিয়াছেন যে এই অপ্রীতিকর প্রতিদ্বন্দি ভাবের মূলে ঈর্ষাই প্রধান। যাহার একটু প্রতিপত্তিশালী হয় তাহাদিগকে অপর সাধারণ লোকে স্বভাবতই হিংসা বিদ্বেষের চক্ষে দেখে ও তাহাদের সহিত মিশিতে চায় না। কেবল টাকা পয়সায় বশ্যতা স্বীকার ভিন্ন এক্ষেত্রে প্রীতি ও ভালবাসার বড়ই অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমিও তাহাই অনুভব করিলাম। বিপদ ঘনীভূত দেখিয়া দিবানিশি সেই দিনবন্ধু অনাথশরণ বিপদভঞ্জন শ্রীমধুসূদনকে মনে প্রাণে ডাকিতে লাগিলাম। বলিলাম ভগবান আমি ত কখন জ্ঞানত: ন্যায়পথ ভ্রষ্ট হই নাই। তবে কেন আমার ঈদৃশ অশান্তী ঘটীল। যাহ হউক এভাবে দিন যাইতে লাগিল। এ সময় আমার জীবনের কর্ত্তব্যপালন ও ত্যাগস্বীকারের কথা ও বিষয়গুলী মনে অনুক্ষণ জাগরিত হইত। তাহা এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিতে প্রয়াস পাইতেছি।
  • achintyarup | 59.93.241.111 | ১৩ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৪৮480412
  • (খ) কর্ত্তব্যপালন ও ত্যাগস্বীকার

    সংসারে কর্ত্তব্য নানা প্রকার, আবার তাহার গুরুত্ব লঘুত্ব আছে। যে কর্ত্তব্য পালন না করিলে প্রত্যবায় (?) আছে তাহা গুরু আর যাহা কেবল নাম ও যশ লাভের জন্য কৃত হয় তাহা লঘু। পরিবারের লোকের প্রতি কর্ত্তব্যটাকে সর্ব্বপ্রধান বলিতে হইবে। আমাদের মত লোকের পক্ষে দেশ সেবার কর্ত্তব্যের পূর্ব্বে আত্মরক্ষা চাই। তৎপরে সাধারণের মঙ্গলজনক কার্য্য।

    দেশ সেবার ক্ষমতা নাই, তাহা কিছু করিও নাই সেকথা বলাই নিÖপ্রয়োজন।

    সাধারণের মঙ্গল -- মোক্তার লাইব্রেরীতে শতাধিক টাকা সাহায্য দিয়াছি ও কতকগুলী পুস্তক দান করিয়াছি। অন্য২ লোককেও কতকগুলী মূল্যবান্‌ গ্রন্থ দান করিয়াছি। গ্রামিক ২/৪ জন লোকের অভাব অভিযোগে যথা সাহায্য প্রয়োজন তাহা নির্ব্বিকার চিত্তে করিয়াছি। ২/৪ জন ভৃত্যশ্রেণীর লোকের কোন২ কার্য্য ও বিবাহাদির ব্যয় সাধ্যমত দিয়াছি। ... উপলক্ষে প্রজাগণকে সাধ্যমত সাহায্য করিয়াছি। সমুদ্রে শিশিরবিন্দুবৎ এই...

    এখন দেখা যাউক পরিবারের লোকের কাহার প্রতি কি কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতে পারিয়াছি।

    পিতৃদেব দ্বাদশ বৎসর বয়সের সময় স্বর্গগত: হওয়ায় তৎপ্রতি কোন কর্ত্তব্য পালনের অধিকার তখন আমার জন্মে নাই, সুতরাং তাঁহার সম্বন্ধে কিছু করিবার সুযোগ আদৌ ঘটে নাই। জ্যেষ্ঠতাতঁ রাজচন্দ্র রায় মহাশয় ও মধ্যম জেঠিমাতার পারলৌকিক শ্রাদ্ধ কার্য্য যথাসাধ্য সম্পন্ন করা ভিন্ন অন্য কোন উল্লেখযোগ্য কার্য্য করি নাই।

    মাতৃঠাকুরাণীর প্রতি -- আমার সুবৃদ্ধা মাতৃঠাকুরাণী এখনও জীবিতা। তাঁহার সম্বন্ধেও আমি কিছু করিতে পারি নাই। তাঁহার নিজের কিছু জমী ও টাকালগ্নির কারবার আছে। তদ্বারা তিনি বিধবা হওয়ার পর হইতেই তীর্থ পর্য্যটন ও অন্যবিধ নানাপ্রকার সৎকার্য্য করিয়া আসিয়াছেন এবং এখনও সময়২ করিতেছেন। অনেক সময় তাঁহার তহবিলের টাকা তছরূপ করা ও তাঁহার জমীর ফশল উপভোগ করিয়াছি ভিন্ন তাঁহাকে কিছু দিতে হয় নাই।

    আমি বর্ত্তমানে তাঁহার দেহাবসান ঘটীলে যে শেষ কর্ত্তব্য আছে তাহাতেও আমার অধিকার শাস্ত্রমতে লোপ পাইয়াছে। যেহেতুক আমি সংন্যাস গ্রহণ করায় আমার পুনর্জন্ম লাভ হইয়াছে, পূর্ব্বাশ্রমের জাতী কুল ও সম্বন্ধ রহিত হইয়াছে। এখন সে কর্ত্তব্যের অধিকারী ভ্রাতা শ্রীমান্‌ গুরুদাসই বটে, তবে ভবিষ্যৎগর্ভে কি আছে কে বলিতে পারে। যাহা হউক শাস্ত্র বলেন বংশে যদি একজন মাত্র বৈষ্ণবও জন্মগ্রহণ করে তবে উর্দ্ধাধ: সমস্ত ক্কুলেরই সদগতীলাভ হয়, ""নৃতত্তী পিতর: সর্ব্বে'' এই শাস্ত্রবাণী। আমি ত সেরূপ বৈষ্ণবত্ব এখনও লাভ করিতে পারি নাই, পারিব কিনা এই শ্রীবৃন্দাবনধামের যিনি একমাত্র মালীক, একমাত্র রাণী ও বৈষ্ণবের একমাত্র শিক্ষাগুরু এবং গতীমূক্তির বিধানকর্ত্তৃ সেই শ্রীকৃষ্ণানন্দরূপিণী রাধারাণীই জানেন। আমি তাঁহার শ্রীপাদপদ্মে কায়মনপ্রাণ সমর্পণ করিয়া বসিয়া আছি, ইহা ভিন্ন আর কিছু জানি না ও বুঝি না।

    স্ত্রীর প্রতি -- স্ত্রি সহধর্ম্মিণী, অর্দ্ধাঙ্গিনী ও সকল সৎকার্যের ঘরে বসিয়া অর্দ্ধেক ফলভাগিনী, ইহাই শাস্ত্রের অমোঘ বাণী। তখন আর স্ত্রীর প্রতি পৃথক কর্ত্তব্য কি আছে তাহা ত ভাবিয়া পাই না। তবে ভরণ পোষণ ও অলঙ্কার দেওয়া এটাকে পৃথক্‌ কর্ত্তব্য বলিয়া গণ্য করা যায় না, আমার কথা দূরে যাউক, এরূপ কর্ত্তব্যে নিতান্ত নিরোপায় ব্যক্তিও হিন্দুর মধ্যে কেহ পারিতপক্ষে অবহেলা করে না।

    ১৩৩০ সালেঁ রথযাত্রা দর্শনে পুরীধামে গমনের মনে করিলে, তখন আমি চুঁচুড়ায় মুক্ষদার বাসায় গঙ্গাতীরে বাস করি, মুক্ষদা বলিল সস্ত্রীক যান, সেই সময় আমার স্ত্রীকে সংবাদ দিয়া আনিয়া, নবদ্বীপ, মাহেশে, তারকেশ্বর ও কালীঘাটেরঁ জয়কালী মাতার দর্শন ও গঙ্গাস্নানাদি এবং পুরীতে গিয়াঁ রথোপরি জগন্নাথ দর্শনরূপ পূণ্য যে তৎপক্ষে কতকটা করা হইয়াছে তাহা আমার সাহায্য হইলেও তাহার নিজের টাকার সাহায্যই বলিতে হইবে, টাকা আমার সংসার হইতে দেওয়া হয় নাই, তাহার নিজের তহবিলের টাকা খরচ করিয়া ঐ সকল তীর্থাদি দর্শন করিয়া গিয়াছে। এটাতে আমার কর্ত্তব্য কতকটা পালন হইয়াছে কিনা বুঝিতে পারি না।

    আর এখন যে শ্রীবৃন্দাবনে বাস করিতেছি তাহার ফলও আমার স্ত্রী প্রাপ্ত হইবে কিনা তাহা ভগবান জানেন। স্ত্রীর ধর্ম্মকার্য্যে সহায়তাই প্রকৃত প্রস্তাবে স্ত্রীর প্রতি কর্ত্তব্য পালন, তাহা যেরূপে পারিয়াছি বলিলাম।

    পুত্রের প্রতি -- পুত্রকে যথোপযুক্তরূপে বিদ্যাশিক্ষা করাইয়া বিবাহাদি সম্পন্নে সংসার প্রবিষ্ট করণে ও উপার্জ্জনের পথে দণ্ডায়মান করাইয়া দিতে পারিলেই পুত্রের প্রতি কর্ত্তব্য শেষ হইল মনে করি, তাহা করিয়াছি। তাহার কর্ম্মক্ষেত্রে বাস করার উপযোগী বাসাটী পর্য্যন্ত করিয়া দিয়া তবে সংসার ছাড়িয়াছি।

    কন্যাগণের প্রতি -- আমার চারি মেয়ে পূর্ব্বেই বলিয়াছি। মেয়েদিগকে সদবংশে সৎপাত্রস্থ করিয়া সুখী রাখিতে পারিলেই মেয়ের প্রতি কর্ত্তব্য শেষ হইল। তাহা আমার হইয়াছে। কুলে শীলে রূপেগুণে যোগ্য পাত্রেই মেয়েদিগকে সম্প্রদান করিয়াছি, মেয়েরা সুখে আছে।

    ভ্রাতার প্রতি -- আমার একমাত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তাহার সম্বন্ধে প্রথম কর্ত্তব্য ছিল শিক্ষা, কিন্তু তাহাতে আমি অপারগ হইলাম। সে সাধারণ বাঙ্গলা লিখাপড়া শিক্ষা করিয়া ময়মনসিংহ বাসায় গেল, ইংরাজী স্কুলে ভর্ত্তি করাইয়া দিব মনে করিলাম। কিন্তু কয়েক দিবস বাসায় থাকিয়াই বলিয়া উঠিল ""আমার আর কিছু হইবে না। বাড়ী গিয়া গৃহস্তিই করিব''। তখন তাহার বয়স ১৭/১৮ বৎসরের কম নয়। সত্য সত্যই বাড়ী গিয়া হালের গরু খরিদ করিয়া গৃহস্তি আরম্ভ করিয়া দিল। তাহার লিখাপড়া শিক্ষা এখানেই সমাপ্ত হইল।

    ১২৯১ সাল হইতে ১৩১৫ সাল পর্য্যন্ত ২৫ বৎসর কাল সে বাড়ীতে গৃহস্তি ও কর্ত্তৃত্ব করিল। ১৩১৫ সালের শেষভাগে তাহার সহিত পৃথকান্ন হইলাম। ইতিপূর্ব্বে তাহার বিবাহ হইয়াছে এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাহার ঔরষে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। নানা কারণে মনান্তর হইলেই পৃথকান্ন হওয়ার কারণ হয়। তাহার সবিশেষ উল্লেখ নিÖপ্রয়োজন।

    পৃথক হওয়ার কালে সর্ব্বোপরি মূল্যবান সম্পত্তি ""খামারের জমী''র ভাল ভাগ তাহাকে দিয়াছি; খড়ের ও টিনের গৃহগুলীর মধ্যে খড়ের ঘর ২টা আমার মধ্যে রাখিয়া ও পুরাতন টিনের ঘর আমার মধ্যে রাখিয়া নূতন টিন গৃহগুলী তাহার ভাগে দিয়াছি। অবশ্য মূল্যের অনুপাত মতে বিভাগ হইয়াছে, কিন্তু তাহাতেও তাহারই অধিক সুবিধা হইয়াছে, আমার যে অসুবিধা তাহা আমি বুঝিয়াও ছোট ভাই বলিয়া কোন আপত্য করি নাই। আমার নিজধনে অর্জ্জিত এই গ্রন্থের কোনও স্থানে উল্লিখিত মূল্যবান অস্থাবর সম্পত্তিগুলীর মধ্যে যে সকল সম্পত্তি আমি একান্নে থাকা কালে অর্জ্জিত তাহার অর্দ্ধেকাংশ তাহাকে বিনা আপত্তিতে দিয়াছি। আইনমতে তাহা দিতে বাধ্য ছিলাম না। এই খামার, গৃহ ও অস্থাবর মাল ১ম বণ্টন হয়, তখন ফিল্‌ ফাজিল্‌ হিসাবে তাহার নিকট আমার কতক টাকা পাওনা থাকে তাহা তাহাকে ছাড়িয়া দিয়াছি।

    তৎপর সমস্ত ভূসম্পত্তি দেওয়ানী বাটওয়ার কালে খানাবাড়ীর সুবিধাজনক রোকের অংশ তাহাকে দিয়াছি, (আপোষেই বণ্টন হয়) দালান মেরামতে ন্যূনাধিক ১২০০ শত টাকা ব্যয় হইয়াছিল তাহার অর্দ্ধেক তাহা হইতে না লইয়া দালানের ভাল ভাগ তাহাকে দিয়াছি। এই খানা বাড়ী ও দালান বণ্টনে আমার স্ত্রী পুত্রাদি আমাকে বাধা দিলেও আমি ভ্রাতার সুবিধা লক্ষ্য করিয়া তাহাদের কথা অগ্রাহ্য করিয়াছি।

    কোন২ সুচতুর লোকে বলিয়া থাকেন যে প্রথম বিভাগ বণ্টন আরম্ভ হওয়ার কালে গুরুদাসের নিজকৃত ১২০০ শত টাকা ঋণ থাকা যে গুরুদাস প্রকাশ করিয়াছিল, তাহার অর্দ্ধেক আমি না দিয়া গুরুদাসকে পৃথক করিয়া দিয়াছি। গুরুদাস সহ পৃথকান্ন হওয়ার সূত্রপাতের মূল কারণ গুরুদাস যে ২৫ বৎসর সংসারের কর্ত্তৃত্ব করিয়াছিল তাহার জমা খরচ হিসাব না রাখা, ১২০০ শত টাকা ঋণের কথা যখন প্রকাশ করিল তখন আমি বলিলাম, আমাকে না জানাইয়া যখন ঋণ করিয়াছ, তখন কি কারণে এতাধিক ঋণ করিতে হইয়াছে তাহার জমা খরচ দেখাও, তাহা সঙ্গত হইলে দিব। গুরুদাস উত্তর করিল ""আমি চাকরও নহি তহশীলদারও নহি আমি জমা খরচ কেন রাখিব'' এই অদ্ভূত বাক্য হইতেই পৃথকান্ন হওয়া স্থিরিকৃত হইল। পক্ষান্তরে আমি যে ৮ বৎসর বাটীতে কর্ত্তৃত্ব করিয়াছিলাম তাহার দৈনীক, মাসিক ও বাৎসরিক পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ আয় ব্যয়ের হিসাব অতি পরিস্কার ভাবে লিখিয়া আল্‌মায়রাতে উঠাইয়া রাখিয়াছিলাম। আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য ফরম ছাপাইয়া মাসিক হিসাবে আয় ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য বার মাসের ১২ খণ্ড বহী পর্য্যন্ত বান্ধিয়া দিয়াছিলাম, তথাপী সে আমার কথা গ্রাহ্য করে নাই, ইহার ভিতরে যে কি রহস্য বর্ত্তমান ছিল তাহা ভগবানই জানেন, আমার তাহা অনধিগম্য হেতু অতীব মন:কষ্টের সহিত যাহার তাহার মতে ভিন্নভাবে বাস করাই সঙ্গত মনে করিলাম। ভিতরের কথা লোকে অনুসন্ধান না করিয়া যে বিজ্ঞতা প্রকাশ করে ইহা বড়ই দু:খের বিষয়।

    যাহা হউক, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বার শত টাকার অর্দ্ধাংশ নগদ না দিলেও তদপেক্ষা অনেক বেশী যে ত্যাগ স্বীকার করিয়াছিলাম তাহা যাহারা জানে তাহারা কখনও অস্বীকার করিতে পারিবে না। দুই বৎসরের তালুকাতের প্রজার নিকট প্রাপ্য খাজানা, দুই বৎসরের খামার জমীর উৎপন্ন শস্যাদি অর্থাৎ ধান্য সরিষা ও কলাই, ইহা ছাড়া ১৩১৪ ও ১৩১৫ সনের অর্থাৎ দুই বৎসরের অবিক্রীত আমানতি কুষ্ঠা ৩-১/২ শত মোন্‌ তাহার অনুকুলে পরিত্যাগ করিয়া, ঐ সকলের অর্দ্ধেক ভাগ না নিয়াই আমি ১৩১৬ সন হইতে আমার বণ্টনকৃত অর্দ্ধাংশ পাওয়ার বন্দবস্থে অম্লানচিত্তে পৃথকান্ন ব্যবস্থা মানিয়া লইলাম। যে চক্ষুষ্মান্‌ সে কখনও আমাকে দোষ দিবে না, যে পক্ষাশ্রিত সে ত অন্ধ তাহার কথা কখনও গ্রাহ্য যোগ্য নহে। এ সকল দু:খের কথা প্রচারের জন্যই এই পরিশ্রম ও মস্তিষ্ক পরিচালনা সাপেক্ষ গ্রন্থ লিখা। এই পৃথিবী হইতে নীরবে চলিয়া গেলে লোকে ত আর আমার মানসিক বেদনা অনুভব করিতে সক্ষম হইবে না! সংসার যে কি ভয়ানক স্থান তাহা এ সকল অভিনয় দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হইবে। এত করিয়াও যে সংসারে সুখী হইতে পারিলাম না, পাগল সম্বোধনে আপ্যায়িত হইয়া গৃহবাস পরিত্যাগ করিতে হইল, ইহা কি এই গরলোদ্‌গীরণকারী সংসারের বিচিত্রতা নহে? ধন্য সংসার! তোমাকে ত দিয়াছি নমস্কার! তথাপী কেন তোমার কথা লইয়া যুগপৎ মস্তিষ্ক ও হস্ত চালনা করিতেছি, না তোমাকে যেন লোকে চিনিতে পারে সেইজন্যে। আর আমার মত যেন আমার পরবর্ত্তী বংশধরগণের মতীগতী লাভ হয় ইহাও এই গ্রন্থ লিখার উদ্দেশ্যতর বটে। তাহা হইলে আমার ন্যায় সৌভাগ্য লাভেঁ শ্রীবৃন্দাবন বাসের অধিকারী হইয়া জীবনকে ধন্য মনে করিতে সক্ষম হইবে। যদি আমার বংশধর কেহ আমাকে না চিনে সে চিরদিনই আঁধারে থাকিবে, কখনও আলোক প্রাপ্ত হইবে না, আমার এই সামান্য কথা কয়টা যেন পাঠকমাত্রেরই স্মরণীয় হয়।
  • achintyarup | 59.93.243.77 | ১৪ অক্টোবর ২০১১ ০৫:০৩480413
  • (গ) বাটীত্যাগ

    এই ত কর্ম্মত্যাগের আনুসঙ্গিক নানা কথা বলা হইল। ১৩২৮ সাল পর্য্যন্ত ময়মনসিংহের বাসা বর্ত্তমান ছিল। মনে হয় উক্ত সালের পরবর্ত্তী বর্ষাকালে বাসা বিক্রয় করিয়া শ্রীমান্‌ সতীশ তাহার প্রয়োজনীয় জিনিশগুলী তাহার ব্যবহারের জন্য বাজিৎপুরের বাসায় রাখিয়া দেয়, অবশীষ্ট অনেক জিনিশ বাটীতে আনা হয়। এইরূপে ময়মনসিংহ নগরের ও তৎপ্রবাসী বন্ধু বান্ধবগণের নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিলাম। তথায় চিরকালের জন্য আমার স্মৃতিচিহ্ন বিলুপ্ত হইল।

    ভগবান চির দিনই জীবের ভাগ্যে সুখ দু:খের অভিনয়রূপ লীলা খেলা করিয়া তৃপ্তিলাভ করেন। ইহাই তাঁহার সৃষ্টিকার্য্যের ভিত্তি বলিয়া ..........
  • achintyarup | 59.93.243.77 | ১৪ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩২480414
  • পরিশীষ্ট।

    শৃঙ্খলা বিধান।

    সর্ব্বকার্য্যেই শৃঙ্খলা ও পরিপাটী থাকা দরকার। যাহার তাহা নাই সে কখনও সংসারে উন্নতীবিধানে সফলকাম হইবে না। এই গ্রন্থেও বিষয় নির্ব্বাচনে, পরিচ্ছেদ গঠনে এবং কোন্‌টীর পর কোন্‌টী দিলে ভাল হয় তৎনির্দ্ধারণে কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছি তাহা অভিজ্ঞ পাঠকদিগের বিবেচ্য।

    আমার ছোটবেলা হইতেই অভ্যাস কোন বিষয়ের বিশৃঙ্খলভাব সহ্য করিতে পারি না। দন্ত পরিস্কারের খড়কাটী, কর্ণ পরিস্কারের কাটিটী, কল্‌কের আগুন উস্কাইবার সলাটী এমন কি অতি সামান্য কলম পরিস্কারের নেকরাটী তাহাও আমার যথাস্থানে থাকা চাই, যথাসময়ে বিনা আয়াসে পাওয়া চাই, নতুবা আমার মনের শান্তী বিনষ্ট হয়। এজন্য অনেকে অনেক সময় আমাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করিতেও ত্রুটী করে নাই। কিন্তু এ ঠাট্টাকেও আমি বাতুলতাই মনে করিয়াছি। গৃহস্থিত কি আঙ্গীনাস্থিত দ্রব্যাদি যথাস্থানে না থাকিলে অথবা যথা বিন্যস্ত বা পরিপাটী ব্যবস্থায় না থাকিলে যেরূপ কাজের সময় খুজিয়া পাওয়া যায় না আবার তাহাতে দেখিবারও অসৌষ্ঠবতা হেতু মানসিক অশান্তী ঘটে, ইহা যে উপলব্ধি না করিয়াছে সে তাহার উপকারিতা সহজে বুঝিয়া উঠিতে পারে না।

    এই শৃঙ্খলা বিধানে জিনিশ ভাল থাকে, শীঘ্র নষ্ট হয় না, কাজের .... হয় না ও সাজান অবস্থা চক্ষুর প্রীতিকর .... অথচ ইহাতে বেশী ....... থাকা ভিন্ন বিশেষ পরিশ্রম কি ..... হয় না। এই .... আমার কোন জিনিশ শীঘ্র অপচয় হয় না কি কাজের সময় হয়রান হইতে হয় না।

    স্বনামধন্য ময়মন বারের প্রধানতম ধনাঢ্য উকীল বাবু অনাথবন্ধু গুহ মহাশয়ের এত সুক্ষ্ম দৃষ্টি ও যত্ন ছিল যে অতি সামান্য বিষয়েও তিনি উপেক্ষা করিতেন না। মজুর কি চাকরগণ কাজ করিয়া চলিয়া যাওয়া মাত্রই তিনি অনুসন্ধান লইতেন, তাহাদের কার্য্যস্থলে কোন কিছু পরিয়া রহিয়াছে কিনা! দা, কুড়ল, রসী ও বাঁশের টুকরা ইত্যাদী ছোট বড় যাহাই সেখানে থাকুক না কেন, তিনি নিজ হস্তে যত্নের সহিত তুলিয়া রাখিতেন। অতি নগণ্য বংশখণ্ড ও রসী দড়ির টুকরাগুলী যাহা অন্যেরা জ্বালানীর কাজে লাগাইয়া দেয়, তাহা তিনি পৃথক পৃথক ভাবে বান্ধিয়া সাতীর (?) সহ ঝুলাইয়া রাখিতেন।

    একপিঠ লিখা অব্যবহার্য্য কাগজগুলী পর্য্যন্ত নথীর ন্যায় গ্রন্থিত করত: শৃঙ্খলা বিধানে তুলিয়া রাখিতেন এবং টুকা টাকা লিখার প্রয়োজন হইলে তদ্বারা কার্য্য নিষ্পন্ন করিতে ভূলিতেন না। কর্ম্মচারীদিগকেও ঐরূপ উপদেশ সদা সর্ব্বদা দিতেন।

    ফরাসের নিকটে বৈঠকখানার দালানে থুক্‌ ফেলীবার কয়েকটা পাত্র দুই পাশেই রাখা দেখিয়াছি। কেহর কাসী ফেলার উদ্বেগ দৃষ্ট হইলেই বলিয়া উঠিতেন, মহাশয় ঐ পাত্রে থুক্‌ ফেলুন, ভূমিতে না পরে। পরিস্কার পরিচ্ছিন্নতা বিষয়ে এত প্রখর দৃষ্টি কি সকলের থাকে?

    স্বগ্রাম নিবাসী সর্ব্বজন বিদিত রামজয় চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের কথা শুনিয়াছি, তামাকের পাত্র, টিকিয়ার পাত্র ত বৈঠকখানা গৃহে যথাস্থানে সজ্জিত থাকিতই, তন্নিকটে আরও একটা মৃৎপাত্র থাকিত, কেহ যেন তামাকের গোলগুলী ভূমিতে নিক্ষেপ না করিয়া, ভূমিতে এলোমেলো ভাবে না ফেলীয়া, ঐ পাত্রস্থ করে, এই তাহার উদ্দেশ্য; কেহ ইহার অন্যথা করিলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে কটুবাক্য প্রয়োগে সতর্ক করিতে কখনও ছাড়িতেন না।

    শৃঙ্খলাবিধান ও পরিস্কার পরিচ্ছিন্নতা সম্বন্ধে দৃঢ় যত্ন না থাকিলে অশান্তী ও অস্বাস্থ্যতা ভোগ অনিবার্য্য। এ সম্বন্ধে বড়২ সুবিজ্ঞ লোকদিগের দৃষ্টান্তের অভাব নাই।
  • achintyarup | 59.93.241.160 | ১৫ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩৮480415
  • বৃন্দাবনের ভাব।

    উপরে আকাশের নিলীমা, নীচে যমুনার নীলাভ তোয়রাশী, আশে পাশে মাটে, বাগানে, বনে, উপবনে ও পুলীনে শ্যামল শোভা বিরাজমান; এহেন স্থানে দাঁড়াইয়া কি বসিয়া সেই দ্বাপরের ব্রজলীলা স্মৃতিপথে চিন্তা ও স্মরণ করিলে কি সেই নটবর শ্যামসুন্দরের অতুল রূপের প্রভা দৃষ্ট হয় না? ভক্ত তাহা জ্ঞানচক্ষুতে ত নিত্য অবলোকন করিতেছেনই, আবার যে ভক্তের একান্ত আগ্রহযুক্ত ভালবাসায় সেই লীলাময় আকৃষ্ট হন, তাহাকে সশরীরে রাধাকৃষ্ণরূপে দর্শন দিতেও ভূলেন না; এজন্য তাঁহার ভক্ত চূড়ামণিরা সদাই উচ্চ ধ্বনী করিয়া বলিতেছেন -- গোবিন্দ শরীর নীত্য, তাহা লীলা সত্য। এইটী বৃন্দাবনের মুখ্য ভাব।

    এখানে সেই ভগবানের বংশীয় গোপজাতীয় লোক কেহ বর্ত্তমানে দৃষ্ট হয় না। বনের গাঁয়ে -- নন্দগ্রামে, বৃক্ষভানুপুরে ও যাবটে আছে বলিয়া লোক মুখে শুনা যায়। বৃন্দাবন ৮৪ ক্রোশ স্থান ব্যাপী। তন্মধ্যে বৃন্দাবন সহর শুদ্ধ যে বন ভূভাগ আছে, তাহা ৫ ক্রোশ ব্যাপী সকলেই বলে, কিন্তু যমুনা গর্ভে অনেক স্থান লীন হওয়ায়, অনুমান ৩-১/২ ক্রোশের বেশী স্থান এই মুখ্য বৃন্দাবনে নাই। এই স্থানই যাত্রীগণ ও ব্রজবাসীগণ অহর্নিশী প্রদক্ষিণ করিয়া পরিতৃপ্তি লাভ করিতেছে। এই পঞ্চক্রোশী বৃন্দাবনের বাহিরে অনেক দূরে২ গোকুল ও নন্দগ্রামাদি অবস্থিত। তাহাতে যে সকল লোক বাস করিতেছেন, তাঁহারা দ্বাপরের লীলানুষ্ঠানে এখনও পরিতৃপ্ত। কিন্তু জনবহুল ও পাষাণাদি নির্ম্মিত দ্বিতল তৃতল অট্টালীকা বহুল এই বৃন্দাবন নামক স্থানের বনভাগ ব্যতীত আর সমস্ত স্থানই ভারতের অন্য প্রদেশস্থ ইংরাজাধিকৃত মিউনীসিপাল সহরের ন্যায় সহর।

    এই সহরে বেনীয়া অভিধেয় বৈশ্যজাতীয় লোকই ব্যবসা বাণিজ্য কারবারে দরবারে প্রায় ৩/৪র্থ স্থান অধিকার করিয়া আছে। বেনীয়া দোকানদার লোকেরা বাজারের দোকানে দিবানিশী নানা প্রকার মিষ্টদ্রব্য ও শাকতরকারী সহ পুরী কচুরী তৈয়ার করিয়া বিক্রয় করিতেছে, তাহাই দেবালয়ে২ এবং ব্রাহ্মণাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকে দিবানিশী খরিদ করিয়া ভোগ দিতেছে ও ভক্ষণ করিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছে। ইহাতে কোন অশ্রদ্ধা কি অশুদ্ধি জ্ঞান কাহারও নাই। আমার মন্দিরেও বিকালে ব্যঞ্জন সহ পুরী ও মিষ্টি বাজার হইতে আইসে এবং ভোগের পর আমি সে প্রসাদে নিত্য তৃপ্ত হই।

    তৎপর এখানে ব্রজবাসী বলিয়া এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁহারা অন্যান্য তীর্থের পাণ্ডার ন্যায়। তাঁহাদের ব্যবসা যাত্রী সংগ্রহ করা; চেলা শ্রেণীর একপ্রকার ক্ষত্রিয় কি তন্নিম্ন শ্রেণীর লোককে নানা দেশে পাঠাইয়া যাত্রীকে প্রলোভিত করিয়া এখানে আনয়ন করেন। প্রত্যহ রেলষ্টেশনে বহু ব্রজবাসীর ভির দৃষ্ট হয়। কোন্‌ চেলায় কত যাত্রী আনিল, তাহাই দেখা ও যাত্রীদিগকে স্তোকবাক্যে গৃহে লইয়া যাওয়া ও হাটবাজার করা ও যথাসময়ে নানা দেবালয়ে দর্শনাদি করানই ইহাদের একমাত্র কার্য্য।

    ইহারা ব্রাহ্মণ হইলেও প্রকৃত ব্রজবাসী নহে। বাঙ্গালী গোস্বামীগণ বৃন্দাবনের বন জঙ্গল আবাদ করিয়া ওঁ গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহন মূর্ত্তিত্রয়কে আবিস্কার করিয়া সেবা পূজার ব্যবস্থা ও লোকের দর্শনযোগ্য করিলে পর, যখন সেই তিনশত বৎসর পূর্ব্বে লোকে এই বৃন্দাবনের সংবাদ পাইয়া দর্শন লালসায় আসিতে লাগিল, তখনই পাণ্ডার প্রয়োজন বোধে নানা প্রদেশাগত এই ব্রজবাসী নামধেয় ব্রাহ্মণগণ সুযোগ বুঝিয়া আসরে নামিলেন, তাঁহারাই এখন চরণ পুজা লওয়ার ও সফলাদি প্রদানের অধিকারি হইয়াছেন এবং নিরিহ যাত্রীগণের প্রতি অত্যাচার যতদূর হইতে পারে তাহা করিয়া বৃন্দাবনে ধনসম্পদের অধিকার লাভ করিয়াছেন ও মহারাজ নামে সম্বোধিত হইয়া আধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন।

    কিন্তু এ আধিপত্যটা কেবল নীরিহ ও বোকা বাঙ্গালীর উপরই দৃষ্ট হয়। অন্য প্রদেশের লোকেরা চরণ পুজাও করে না, সফলও গ্রহণ করে না, বাঙ্গালীরা এ কথাটা কেন বুঝেনা যে ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণের চরণ পুজায় ফল কি? আরঁ দর্শনের আবার সফল কি?ঁ গয়াশ্রাদ্ধ ভিন্ন সফল লওয়ার কোনও প্রয়োজন কোন শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ নাই। আমিঁ জগন্নাথ দর্শন করিলাম, পাণ্ডা আসিয়া বলিল তোমার সফল হইয়াছে, আমাকে টাকা দেও। এই প্রতারণার কার্য্যে কেবল বাঙ্গালীই ভূলে, অন্য দেশবাসী লোকে তাহা গ্রাহ্য মাত্রই করে না। অবশ্য ইহাদের মধ্যে ভাল লোকও আছেন।
  • pi | 72.83.90.203 | ১৫ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৪৮480416
  • ১৩ ত ২০১১ -- ০৫:৪৮ আ এর শেষ প্যারা তো বিপদার টইতে যাবে।
  • achintyarup | 210.212.18.172 | ১৫ অক্টোবর ২০১১ ১৮:২২480418
  • :-)
  • maximin | 59.93.220.232 | ১৬ অক্টোবর ২০১১ ০২:৩৭480419
  • কী যে ভালো লাগছে পড়তে। এখনও পুরোটা পড়া হয় নি।
  • achintyarup | 59.93.255.162 | ১৬ অক্টোবর ২০১১ ০৪:৫৮480420
  • তারপর বৃন্দাবনে নানা নিম্নশ্রেণীর লোক আছে তাহারা ভাঙ্গি অর্থাৎ মেথর এবং মালী ও মুটীয়া মজুরের কাজ করে।

    ব্রাহ্মণ ব্রজবাসিনী স্ত্রীলোকের মধ্যে এখানে পুরুষাপেক্ষা ভক্তি ও প্রীতির ভাব বেশী দেখা যায়। বনে জঙ্গলে যে সাধুরা বাস করেন তাহাদের জীবিকা মাধুপুরী অর্থাৎ রিটী ভিক্ষা, এই ভিক্ষা ব্রজবাসিনীরা যোগাইয়া থাকেন, ইহা তাঁহাদের নিত্য কার্য্য। যমুনা স্নান ও পরিক্রমা অর্থাৎ পঞ্চক্রোশী বৃন্দাবনের চতু:সীমা প্রদক্ষিণ ও দেবালয়ে২ নিত্যদর্শনে ইহারা অগ্রগণ্য। ইহাদের মধ্যে এমন লাবণ্য বিশিষ্টা মেয়ে দৃষ্ট হয় যাহাকে দেখিলে চক্ষু জুড়ায় ও ব্রজদেবীরূপা গোপী ভ্রমে মস্তক তাহাদের রাতুল চরণে আপনা আপনি অবনত হয়। তপ্ত কাঞ্চন গৌরাঙ্গী ও দুগ্‌ধালক্তা বর্ণা সুন্দরী বঙ্গদেশে কখনও দৃষ্ট হয় না, এখানে ভাগ্যক্রমে তাহা দৃষ্ট হয়। তাঁহাদের সুমধুর ধ্বনী সেই শ্যামসুন্দরের বংশীরব বলিয়াই ভ্রম জন্মায়। তাঁহাদের বীণানিন্দিত স্বরের সুমধুর গীতধ্বনীতে প্রাণ মন আত্মহারা হয়। তাঁহাদিগের পবিত্র দর্শন ও শ্রবণে ব্রজগোপীর ভাব স্বত:ই উদ্দিপীত হয়।

    বৃন্দাবনে চারিশ্রেণীর সাধু আখ্যাধারী লোক দৃষ্ট হয়। বনে যে হাজার২ সাধু মহন্ত বাস করেন তন্মধ্যে বোধহয় শতকরা ২/৪টী প্রকৃত সাধু। ইঁহাদের মধ্যে হিন্দুস্থানী লোকই বেশী। বাঙ্গালী বৈষ্ণব যাঁহারা বনে আছেন তাঁহাদের মধ্যে খাটী বৈষ্ণব কেহ২ আছেন। তারপর বাবাজী নামধারী অগণিত বাঙ্গালী বৈষ্ণব, ইহাদের সংখ্যাই এখানে বেশী। ইহাদের মধ্যে দুই শ্রেণী দৃষ্ট হয়। যাহারা মাতাজী শূণ্য ও ঠোরে (আখ্‌ড়া বা আড্ডা) বাস করেন, তাহাদেরই আধিপত্য বেশী, নিমন্ত্রণ খাওয়া ও সামাজিক চালে চলা ইহাদের কার্য্য। বৈষ্ণব সমাজকে ইহারা নিয়মিত রাখিতে সচেষ্ট। ব্যবসা নিমন্ত্রণ খাওয়া। আর এক শ্রেণী মাতাজী সহ যোগলরূপী, ইহাদের মধ্যে মাতাজীরা রাধেশ্যাম ব্যবসায়ী ও বাবাজীরা অন্য ব্যবসায়ী, ইহাদের বেশ ঘরকন্না আছে।

    রাধেশ্যাম বলিতে কোনও ধনী লোক বৃন্দাবন ও নবদ্বীপ ইত্যাদি স্থান বাসী স্ত্রীলোক বৈষ্ণবীদিগের জন্য দেবালয় স্থাপনে, নাম করা, বা নাম জপের ব্যবসা খুলিয়াছেন। এখানে দেখা যায় প্রায় হাজার সংখ্যক বৈষ্ণবী ও অবৈষ্ণবী, সতী ও সতীত্ব বিহীনা রমণীর দল প্রাতে ভোরে ঐ রাধেশ্যাম নামা দেবালয়ে যায়। কেহ২ বঙ্গদেশী গৃহস্তির চাকরদিগের ভোরে ঘাটে যাওয়ার প্রাক্কালের নাস্থা ভোজনের ন্যায় ভোরে রান্না করিয়া ভোজন করিয়া দ্রুতপদে যায়। বেলা ১০টা পর্য্যন্ত দলে২ তথায় নাম গান ও জপ করে, দুষ্টা প্রকৃতির অনেকেই বাগানাদি আড়ালে থাকিয়া জটলা অর্থাৎ গল্প গোজবে সময়াতিবাহিত করে। ১০টার কালে /০ কি /৫ পয়সা মূল্যের চাউল কি ময়দা কোন দিন বা ডাইল, লবণ ইত্যাদিও পায়। আবার ২।। টা কি ৩টায় যায়, সন্ধ্যাকালে ঘরে ফিরে, ঐ পরিমাণ কেবল পয়সা পায়।

    ইহা ছাড়া আর এক শ্রেণীর বাবাজী ও মাতাজী আছে, ইহারা চুট্‌কী অর্থাৎ ময়দা কি চাউল মুষ্টি ভিক্ষা, চনা অর্থাৎ ভাজা কি সিদ্ধ আস্থ বুট ভিক্ষা ও মাধুপুরী ভিক্ষা করিয়া দিনপাত করে। ইহারা সদ্‌ অসদ্‌ সব কার্য্যই করিয়া বেড়ায়।

    এই যে উপরে দুই শ্রেণীর বৈষ্ণবের কথা বলা হইল, ইহাদের অধিকাংশই বঙ্গদেশ হইতে আমদানী হইয়াছে। বাপ তাড়ান, মায় খেদান, দুষ্ট প্রকৃতি বদ্‌মায়েশ পুরুষ ও অসতী স্ত্রীলোক বাঙ্গলাদেশে স্থান না পাইয়া এই স্বর্গসম বৃন্দাবনে আসিয়া নরকের অভিনয় করিয়া, যত অকার্য্য, কুকার্য্য সবই হৃষ্টমনে করিয়া ফিরিতেছে।

    আমার বিশ্বাস ইহাদের জন্যই ভগবান বৃন্দাবনের এই স্বর্গীয় ভাবের ন্যায় ভাবের মধ্যেও ষড়রিপু সৃজন করিয়া অসদ্‌সংসর্গ জনিত অপরাধের ফল সাধু মহন্ত ও খাটী বৈষ্ণবদিগকেও ভোগ করাইয়া জ্বালাতন করিতেছেন।

    ষড়রিপু অর্থে ভিতরের ষড়রিপু নহে। কচ্ছপ, বানর, ইন্দুর, মশক, শীত ও গ্রীষ্ম, এসকলকে এখানে অভিজ্ঞ লোকে ষড়রিপু বলেন। যমুনার জলে স্থান বিশেষে কচ্ছপের সংখ্যা ও আকার, আস্ফালন দেখিলে ভয়ের উদ্রেক হয়। তাহারা মৃতদেহ ভক্ষণ করিয়াই আছে, যেহেতুক বৃন্দাবনে অধিকাংশ মৃতদেহই, মুখে অগ্নি প্রদানে বা আধপোড়া করিয়া যমুনার জলে নিক্ষেপ করে। তৎব্যতীত ইহারা সুযোগ পাইলে জীবন্ত মানুষ ভক্ষণ করিতেও ত্রুটী করে না। এই সেদিন একজন ব্রজবাসীর দিব্য ফুট ফুটে ৭/৮ বৎসরের ছেলে স্নানার্থ জলে নামিয়াছিল, কচ্ছপের দল তাহাকে নিমেশ মধ্যে গ্রাস করিয়া পিতা মাতাকে শোক সাগরে ভাসাইল। এইরূপ ঘটনা এখানে নূতন নহে। স্নানার্থ ঘাটে নামিলে প্রায়ই হাত পায়ের মাংস তাহারা অবলীলাক্রমে আত্মসাৎ করিয়া নীরিহ অজ্ঞ লোককে উৎপীড়ণে অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়।

    তারপর বানর এখানে অসংখ্য দলে২ পালে২ বিচরণ করে, এমন স্থান প্রায় নাই যেখানে বানর নাই। এজন্য এখানে গৃহহাদির দরজা ও কবাট জানালাদি নির্ম্মাণের প্রণালী অন্য দেশ হইতে ভিন্ন অভিনব প্রকারের, লোহার শিক ও জালের বেড়া ও ঘেরা ত আছেই, আবার অনেক ছোট খাট আঙ্গীনাবিশিষ্ট বারীতেই আঙ্গীনার উপরে লোহার শিক বা সরু পাতের আবরণ, এ সকল যন্ত্রণাদায়ক ব্যয় বাহুল্যের কার্য্য কেবল, বানরের উপদ্রব হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য। প্রত্যেক দরজা ও জানালার কপাটে বাহিরে ভিতরে শিকল ও বিন্নি (?) লাগান। যদি কখন ভূলক্রমে শিকল কি বিন্নি লাগান না হয় তবে পঙ্গপালের ন্যায় সুযোগ বুঝিয়া বানর ঘরে প্রবেশ করিয়া সর্ব্বস্য লুণ্ঠন করে। এমন বানরও আছে দৃঢ়তাবিহীন শিকল ও বিন্নি খুলীয়াই গৃহে প্রবেশ করিতে পারে।; হস্ত হইতে ঘটী বাটী ও কাপরের পুটলী সংযুক্ত দ্রব্য কাড়িয়া নেওয়া এবং খোলা হাতের খাবারের জিনিশ নেওয়া ত বানরের নিত্য অনায়াস সাধ্য কার্য্য। ভিন্নদেশী যাত্রীকে ও স্ত্রীলোক, বালক মাত্রকেই বানরে গ্রাহ্য করে না। জোড় করিয়া আস্তনীয়া ধরিয়া, কাপড় ছিঁড়িয়া ও সুযোগ মতে তীক্ষ্ণ আঁচড় ও কামড় দিয়া জিনিশাদি লইয়া যায় ও বিব্রত করে। এজন্য এখানে সকলই দৃঢ় লাটী হস্তে চলিয়া থাকে। বানরের ন্যায় শত্রু আর দ্বিতীয় নাই।

    অত:পর ইন্দুর ও মশকের উপদ্রব দিবারাত্রিই এখানে বিদ্যমান। ইন্দুরের উপদ্রবে কোন জিনিশ আঢাকা রাখার উপায় নাই। দিনেও মশার জ্বালায় নিদ্রা হয় না।

    আর শীত ও গ্রীষ্মের কথা কি বলিব? শীতের জ্বালায় এখানে প্রায় লোকেই তোলাভরা, কম্বলের আচ্ছাদনে দেহরক্ষা করে। লুই নামক পশমী কাপড় অর্থাৎ ধুতী চাদর ও জামা শীতে নিত্য ব্যবহার্য্য দৃষ্ট হয়। এই শীত কার্ত্তিকে আরম্ভ হইয়া চৈত্র মাসে শেষ হয়, কখন বা ফালগুণেও শীত গত হইতে দেখা যায়। বৈশাখ হইতে গ্রীষ্মের প্রকোপ বাড়িতে থাকে। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রে পূর্ণ পরিণতি, কেবল আশ্বীন মাসটী নাতিশিতোষ্ণ হেতু আরামদায়ক।

    এই যে গৃহাভ্যন্তরে বসিয়া এই আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগে এই গ্রন্থ সংকলন করিতেছি, তাহাতে বোধ হইতেছে যেন গৃহাভ্যন্তরে অগ্নি বা প্রখর কেরোসিনালো প্রঙ্কÄলীত করিয়া রাখা হইয়াছে। দিবা ১২টা কি কোন দিন ১০/১১টা হইতেই এই উষ্ণ তাপ ও বায়ু প্রবল হয় আর রাত্রি ২/৩টা তক একই ভাবে থাকে। এজন্য এখানকার লোকে বাহিরে খোলা স্থানে কি খোলা ছাদোপরি রাত্রে নিদ্রা যায়। আমারও তাইই করিতে হয়, তবে এবার সেই কৃপাসিন্ধু ভগবান কৃপা করিয়া একটা আরামের স্থান আমার জন্য অকস্মাৎ ব্যবস্থা করায় আমি যেন হাতে স্বর্গ লাভ করিয়াছি। মন্দিরের পূর্ব্ব মালীক যিনী মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন, বোধহয় তিনি এই দারুণ শীত গ্রীষ্মের আক্রমণ হইতে নিরাপদে থাকার জন্য ব্যয়বাহুল্যে মৃত্তিকার প্রায় ৫ হস্ত নিম্নে গর্ত্ত করিয়া মন্দিরের তোসাখানা প্রকোষ্ঠের নিম্নভাগে দুইটী কামরা তৈয়ার করাইয়াছিলেন; দুইটী বোধহয় স্ত্রীলোক ও পুরুষের ভিন্ন২ ব্যবস্থা জন্য; মাঝে বৃহৎ দরজা বিশিষ্ট, পর্‌দা দ্বারা আচ্ছাদন চলে। আলো ও বায়ু চলাচলের সুন্দর জানালা আছে। দীর্ঘে ২ কামরায় ১০/১২ হাত প্রস্তেও ৭/৮ হাত হইবে। এই কামরায় প্রবেশ করিলে এই বহির্তাপ খুব কমই অনুভূত হয়। মেজে খুব ঠাণ্ডা। শীতেও বোধহয় শীতানুভ খুব কমই হইবে। জানালা ও দ্বার বন্ধ করিলে শীত জনিত ঠাণ্ডা কমই লাগিবে।

    এই কাম্‌রা অন্ধকার দৃষ্টির ন্যায় প্রতিয়মান হওয়ায় ও তদভ্যন্তরে পূর্ব্ব২ মন্দিরাধ্যক্ষ লোকের সময় হইতে অব্যবহার্য্য হেতু ও কোন২ সময়ে জ্বালানী কাষ্ঠ ও ঘুইটে প্রভৃতি রাখার দরুণই বোধহয় কেহ তাহার নির্ম্মাণের হেতু অবগত নহে। তাহা সাপ ও ইন্দুরের বাসস্থান বলিয়াই এত দিন আমার ধারণা ছিল, আমি ভয়ে কখনও উক্ত ঘরে পা বাড়াই নাই। অন্ধকারাচ্ছন্ন সুগভীর গর্ত্ত বলিয়াই মনে হইত। যাহা হউকঁ বৃন্দাবন চন্দ্রের কৃপায় একদা পুজারী বলিলেন যে, ""ভূমির নিম্নে যে একটা কামরা আছে সেই ঘরটা বাবা! পরিস্কার ও মেরামত করাইয়া লন্‌, তাহাতে গরম কম হইবে''। যথাসময়ে পুজারী রাজমিস্ত্রীকে ডাকিয়া আনিলেন। ৫/৬্‌ টাকা খরচে ঘর দুইটী নির্ম্মাণ ও মেরামত হইল। এখন তাহাতে পরম সুখে বাস করিয়া আরামোপভোগ করিতেছি। এই গেল বৃন্দাবনের ষড়রিপুর কথা।
  • achintyarup | 59.93.247.61 | ১৭ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩৪480421
  • বৃন্দাবনে অনুমান ৫/৬ হাজার দেবমন্দির আছে। তন্মধ্যেঁ গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহন সেই পুরাকালে নির্ম্মিত হইয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়। মুশলমানের অত্যাচারে বৃন্দাবন জনশূণ্য হওয়ার সময়ে সেই আদি মূর্ত্তি জয়পুরের মহারাজা নিয়া যান, তৎপর স্বপ্নাদেশে পুন: এই বৃন্দাবনে মূর্ত্তি গঠিত হয়। পুন: যবন অত্যাচারে মূর্ত্তিত্রয়সহ সেবক ""কাম্যবনে'' পলাইয়া যায়। কিয়ৎকাল পর বাঙ্গালী গোস্বামী প্রভূগণের এথায় আগমণের অব্যবহিত পূর্ব্বে যে মূর্ত্তি গঠিত হয় তাহাই এখন এই পূণ্যধামে বিরাজমান। আদি মূর্ত্তি জয়পুরাধিপতীর ভবনে থাকিয়া স্বমহিমা বিস্তারে আজও আগ্রহব্যাকুল ভক্তজনগণের দর্শন ও ভক্তিপিপাসা নিবৃত্তি করিতেছেন।

    ঐ মূর্ত্তিত্রয় মধ্যেঁ গোবিন্দের মুখ কমল,ঁ গোপীনাথের বক্ষস্থল ওঁ মদনমোহনের চরণদ্বয় ঠিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুরূপ আকারে আকারিত হইয়াছে বলিয়া বৃন্দাবনবাসী জনসাধারণের সুদৃঢ় বিশ্বাস; সাধুগণ ঐ তিনমূর্ত্তিতে একই ভগবানের চিন্তা করেন। ঐ মূর্ত্তিত্রয় ব্যতীত, আর যে মূর্ত্তি বাহুল্যতা দৃষ্ট হয় তাহা ভক্ত, রাজা জমীদার ও ধ্বনী লোকের স্থাপিত। এখনও নূতন২ মন্দির নির্ম্মাণ হইতেছে, বৎসর২ই মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠার বিরাম নাই। ইহা অর্থের সদ্‌ব্যবহার বটে।

    এই সকল দেবালয়ে সেবাপুজার ব্যবস্থা আছে এবং ঐ তিন মন্দিরে যাত্রীগণ হইতে ভেট অর্থাৎ দর্শনী আদায়ের কড়াকড়ী আছে কিন্তু অতিব দু:খের বিষয় যে প্রায় অধিকাংশ মন্দিরেই কর্ত্তা হইতে আরম্ভ করিয়া নীচে দরওয়ান পর্য্যন্ত সকলেই পাপাভিনয়ে পূর্ণমাত্রায় লিপ্ত। দেবসেবার নৈবিদ্যের "কণা' তাহারা অগ্রেই গ্রহণ করিতেছে, তাহার সকলে লুণ্ঠন করিয়া নিয়া যাহা অবশীষ্ঠ থাকে তাহাই দেবসেবায় লাগে, তৎপরেও প্রসাদ চুরী ও বিক্রয়ের বিরাম নাই, কয়েকটী বড়লোকের সুবৃহৎ মন্দির ছাড়া কোথাও ভোগ রাগ পরিপাটী রূপে হয় না। আমার এই মন্দিরে দৈনীক ২্‌ দুই টাকা সেবা খরচ নিয়ত আছে, কিন্তু আমি এই মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছি, ভোগের ব্যবস্থায় আট দশ আনার বেশী খরচ হয় না। এখন ভগবানের কৃপায় সকলেই আগ্রহ পূর্ব্বক এই মন্দিরে প্রসাদ খাওয়ার আশায়ঁ গোবিন্দাদি মন্দিরও ছাড়িয়া আসে দেখা যায়। আর ঐ সকল মন্দিরে পয়সা না দিলে প্রসাদ লাভের আশা নাই, আর এখন অবারিত দ্বার করিয়া দিয়াছি, কেহ যেন না ফিরে।

    বলা বাহুল্য যেঁ গোবিন্দ, গোপীনাথ ও মদনমোহনজিওই এই পঞ্চক্রোশী শ্রীবৃন্দাবনের ভূমির অংশ বিভাগানুযায়ী মালীক। পাণ্ডার আশ্রয় না লইয়া বুদ্ধিমান জনগণ এখানে আগমন করিলে দর্শনাদি সুলভে সম্পন্ন হয়। কিন্তু ব্রজবাসী নামধেয় সর্ব্বভোক্‌ পাণ্ডাগণের সঙ্গলাভেই যত বিপদ। বাঙ্গালী নির্ব্বোধ লোকদিগের ইহারা যমস্বরূপ। এই গ্রন্থে বৃন্দাবনের ভাবের দিক এখানেই শেষ করিলাম। যদি ভগবান কুলন করেন তবে যে স্বস্তীবাচণ ও মঙ্গলাচরণ করিয়া রাখিয়াছি -- সেই ""বৃন্দাবন তঙ্কÄ'' বহীতে সর্ব্ব বিষয় বিস্তার লাভ করিবে।
  • achintyarup | 59.93.243.148 | ১৭ অক্টোবর ২০১১ ২০:৫২480422
  • বৃন্দাবনের পাগলামী।

    ১। বৃন্দাবনে প্রতি দেবমন্দীরেই পাকা মঞ্চের উপর তুলসী বৃক্ষ রোপিত আছেন। বৃন্দাদেবী জ্ঞানে তাঁহার পুজা ও পরিক্রমা প্রচলীত আছে। ব্রজবাসী পাণ্ডাগণ এই পুজা উপলক্ষে ১্‌ টাকা গ্রহণ করেন। এ যাহা হউক একটা রহস্য এই দৃষ্ট হয় যে পরিক্রমা বা প্রদক্ষীণ করার কালে প্রত্যেকেই ঠাকুরের সম্মুখে আসিয়া উল্ট বাজীর ন্যায় ঘুরিয়া পাছাইয়া চলে। এটা এমনই অভ্যাসগত হইয়া পড়িয়াছে যে যেখানে ঠাকুর বহুদূরে আছেন সেখানেও এই উল্টবাজী করিতে ছাড়ে না। ইহার অর্থ এই বলে যে ঠাকুরের দিকে পাছ দিতে নাই।

    আমি বলি ঠাকুর যখন সর্ব্বব্যাপী তোমার আগে পাছে চারিদিকেই বিদ্যমান তখন তাঁহাকে আবার পাছ দিবে কি? যদিও এই মন্দিরস্থ বিগ্রহ সীমা বিশিষ্ট প্রস্তর মূর্ত্তি, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ত তিনি সীমাবদ্ধ নহেন, অজ্ঞানীর সেবাপুজার সৌকার্য্যার্থে এই মূর্ত্তি গঠন করিতে পূর্ব্বতন ভক্ত মনীষিগণ বাধ্য হইয়াছিলেন। কিন্তু সেবাপুজাকারীর মনে যদি সর্ব্বব্যাপী ভাব না থাকে তবে ত তার সবই বৃথা। জীবন্ত জাগ্রত সর্ব্বজ্ঞ ও সর্ব্বব্যাপী ভগবান এই মূর্ত্তিতে আছেনেই চিন্তাটা ত জাগরুক রাখা চাই।

    তবে তুমি বৃন্দাদেবীর পরিক্রমায় এই পাগলামী কর কেন? তখন মনে করিবে, এই বৃন্দাদেবীতে সেই ভগবানই বিদ্যমান তাঁহাকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, তাহার আবার আগ পাছ কি?

    ২। বৈষ্ণবের ছায়া লঙ্ঘন ব্যাপার আর এক পাগলামী। যমুনা স্নানে যাওয়ার রাস্থাটা প্রায় এক মাইল অতিক্রম করিতে হয়, এই রাস্থায়ই এই পাগলামীর অধিক অভিনয় দৃষ্ট হয়। কে কাহার কোন্‌ দিক্‌ দিয়া যাইবে এই ঠেলাঠেলী ব্যাপারে কাঁটাবনের ভিতরে বিষম বিব্রত হইতে হয়।

    কেন এই অহেতুক পাগলামী? ছায়া ত কোন পদার্থ নহে? আলোর অভাব যে অন্ধকার তাহাই ছায়া, তবে বস্তুর প্রতিকৃতির আবরণে তাহা বস্তুর ন্যায় দৃষ্ট হয়। এই ছায়া লঙ্ঘনে যে কি প্রত্যবায় আছে তাহার হেতু আমার অল্প বুদ্ধি কল্পনা করিতে অক্ষম হেতু তাহ যে পাগলামী এই মনে হয়।

    ৩। অশুচীজ্ঞান

    প্রসাদ ও চরণামৃত ভক্ষণান্তে কি স্পর্শান্তে হস্তাদি অশুদ্ধ হওয়া জ্ঞানে তাহা জলে ধৌত করার রোগ অনেক লোককে দেখা যায়। শ্রীক্ষেত্রে কিন্তু তাহা দৃষ্ট হয় না। তবে কাঁচা প্রসাদ ভক্ষণান্তে কি হস্ত দ্বারা অপর লোককে পরিবেশনান্তে হস্তাদি অপরিস্কার হয় বলিয়া আচমণ করা ও হস্তাদি ভাল করিয়া ধৌত করা সকলের পক্ষেই বিধেয় এবং সর্ব্বত্রই এ রীতি প্রচলীত থাকা দৃষ্ট হয়। তাহা যে সুসঙ্গত তাহাতে সন্দেহ মাত্র নাই।

    কিন্তু পাকা প্রসাদ, ফলমূলাদি, পানীয় জল ও চরণামৃত পানে সেরূপ পরিচ্ছিন্নার প্রয়োজন দৃষ্ট হয় না, জলমাত্রই শুদ্ধ তাহাতে আবার প্রসাদী জল ত অমৃত ইহা পানের পর যে ব্যক্তি অপর অশুদ্ধ জল দ্বারা হস্ত মুখাদি প্রক্ষালণ করে তাহার ন্যায় মূর্খ দ্বিতীয় নাই। প্রসাদ মস্তকে স্পর্শ করাইয়াই গ্রহণ করা কর্ত্তব্য সেখানে কি মস্তকও ধৌত করিতে হইবে? এসকল স্থানে সুবোধ লোকে সর্ব্ব পবিত্রকারিণী বৃন্দাবনের রজ স্পর্শই যথেষ্ট মনে করেন এই জন্য যে, আবার যদি ঠাকুরের সেবার কোন কাজ করি তবে ঠাকুরকে ঠাকুরেরই উচ্ছিষ্ট দেওয়ার সংস্পর্শ দোষ ঘটীবে। ইহাও মনেরই ভ্রম, ঠাকুরের আবার শুচী অশুচী কি? মহাপ্রভূ আস্থাকুঁড় হইতে আসিয়াই বিনা স্নানে গৃহপ্রবেশ এমন কি ঠাকুর ঘরে পর্য্যন্ত প্রবেশ করিতেন, মাতাকে বলিতেন শুচী অশুচী কিছু নাই মা। ইহা ত গেল বালক কালের কথা। পরিণত বয়সে লীলার পরিপক্কাবস্থায় নৈয়ায়ীক চুড়ামণী বিধিমার্গে একান্ত বিশ্বাসী সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্যকে অতি ভোরে নিদ্রোত্থিত হওয়ার পূর্ব্বেই কাঁচা মহাপ্রসাদ আনিয়া তাঁহার সেই অপ্রক্ষালীত মুখে দিয়া বলিয়াছিলেন খাও, প্রসাদে কোন বিচার নাই। এখনও সর্ব্বদাই দৃষ্ট হয় শ্রীক্ষেত্রের মহাপ্রসাদ রৌদ্রে শুষ্ক করিয়া রাশীকৃতাকারে বিক্রয় করিতেছে এবং পাণ্ডাগণ কাপরের থলীয়া পূরিয়া তাহা সহ দেশে২ ঘুরিয়া লোক মাত্রেরই মুখে দিয়া প্রসাদের মহিমাটা বিশেষরূপে প্রচার করিতেছে।

    তুমি বৈষ্ণব ঠাকুর, তোমার এই শুদ্ধাশুদ্ধ জ্ঞান কোথা হইতে আসিল? ভিতরে প্রবেশ করিয়া তঙ্কÄ বুঝ? কেবল ডুর কপাল ও বহির্ব্বাসে বৈষ্ণব সাজিলে হইবে না। প্রসাদে অন্নবুদ্ধি যে অপরাধ তাহা কি ভূলিয়া গিয়াছ? এ পাগলামী ছাড়। আমি বৈষ্ণবত্বের কিছু জানি না, তথাপী পাগ্‌লামীটা ভাল লাগে না।

    তারপর "লুই' কাপড় পরিয়া পয়খানায় যাওয়া এখানে একটা পাগলামীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ সর্ব্বদাই করিতেছি এবং আমিও উপদিষ্ট হইতেছি। বাবা! শীতের দিনে শীত নিবারণের জন্য যদি তাহা কর ক্ষতি নাই, কিন্তু এহেন অগ্নির উত্তাপোপম গ্রীষ্মেও যে লুই কাপড় ছাড় না ইহা ত নিহাত পাগলামী। যে সুতার কাপড়খানা পরিয়া রাত্রি যাপন করিলে তাহা ত অশুদ্ধই, বিশেষ শাস্ত্র বলেন বস্ত্রাদি যে পর্য্যনত শরীর সংলগ্ন থাকে ততক্ষণই শুদ্ধ, পরিত্যাগ মাত্রই অশুদ্ধ হইয়া যায়। তাহাতেই দেখা যায় তুমি যে সূত্র নির্ম্মিত বস্ত্র ছাড়িয়া লুই কাপড় পরিলে, তাহা ত অশুদ্ধই হইয়া গেল। তখন আর ইহা না ধৌত করিয়া উপায় নাই, তখন বৃথা কেন এই দারুণ গ্রীষ্মে লুই কাপরের টানাটানী? যে বস্ত্র পরিয়া নিদ্রা গিয়াছিলে তাহা পড়িয়াই মলত্যাগান্তে তাহা ধৌত কর, যদি না পার তবে রজে ফেলীয়া ঝাড়িয়া নেও, সর্ব্ব শুচীকারক রজের তুল্য আর কি আছে, তাহাতেও প্রবোদ্ধ না হইলে যমুনা বা তুলসী পত্রের জলে ছিটা দিয়া শুদ্ধ কর। তাহাও যদি কষ্টকর হয় "পুণ্ডরীকাক্ষ' নাম স্মরণ কর আর যদি বিশ্বাস থাকে "হরেকৃষ্ণ' মহামন্ত্রই সর্ব্বশুচীকারক জানিও। ইহাও জানিও যে শুচী এক কথা আর পরিস্কার পরিচ্ছিন্নতা আর এক কথা। তোমার লুই কাপড়ে যদি অনবধানতায় মল লাগে তবে কি তাহা না ধুইলে শুদ্ধ হইবে? বৃথা পাগলামী কর কেন? পেটেও যে "মল' রহিয়াছে, হরেকৃষ্ণ নাম বল! সব বাহির ভিতর শুচী হইবে। সাধুরা তাহাই বলেন। এই গেল এক পাগলামীর কথা।
  • achintyarup | 59.93.247.226 | ১৭ অক্টোবর ২০১১ ২২:৫৩480423
  • ৪। মালাজপের ঝোলা।

    বৃন্দাবনে স্ত্রী পুরুষ অনেককেই দেখা যায় মালা জপের ঝুলাটা দক্ষীণ হস্তের কব্‌জায় বান্ধা। অবিরত মালার ঠকঠকানী চলিয়াছে, বৈষ্ণব সাধু দৃষ্টে প্রণাম বা মন্দিরাদিতে দেবতার প্রণাম সবই "বাঁ' হাতে চলিতেছে। লোকের আলাপাদির বিরাম নাই, হাট বাজার, কেনা বেচা সব কার্য্যই বাঁ হাতে হইতেছে; এমন হতভাগিনীও দেখিয়াছিবাম হাতে গুরুর পদধূলী এবং দেবমন্দিরের পান্থরজ গ্রহণে কুণ্ঠিত হয় না। ঠাকুরসেবার কাজ পর্য্যন্ত বাম হাতে সম্পন্ন করিতেছে।

    বাম হাতটা যে শাস্ত্রমতে একেবারেই অশুদ্ধ ও কোন পবিত্র কার্য্যে ব্যবহার্য্য নহে এ জ্ঞানটা ইহাদের আদৌ জন্মে নাই।

    নাম জপ দুই প্রকারে হওয়াই যুক্তি ও বিধিসম্মত বুঝা যায়,এক একাসনে বসিয়া নিয়ত সংখ্যাপূরণ, দ্বিতীয় মালা ব্যতীত অবিরাম মনে মুখে এক করিয়া, নামে ও ভগবানের রূপে ঐক্যভাবে অনিয়ত জপ। তদ্ভিন্ন হাতে কি গলদেশে ঝুলা বন্ধনে যে অন্য মনে জপ, সেটা যে কিছুই নহে তাহা বিবেকী ও বুদ্ধিমান লোকে সহজেই বুঝিয়া থাকেন। এরূপ নিরর্থক চেষ্টাকে পাগলামী ভিন্ন কি বলিব? হেলায় অনবধানতায়ও যদি নাম লয় তাহাও ভগবানের জ্ঞান গোচর হয়, ইহা শাস্ত্রেরই বাক্য। বাবা! তাহাতে মালার কি প্রয়োজন? মনে মুখে যদি এক করিয়া বিনা মালায় অবিরাম জপিতে পার, খেতে, শুইতে পথে ঘাটে, এমন কি মলাদি ত্যাগ সময়েও যদি নাম ও রূপ মনে জাগরূক থাকে, তবে নিশ্চয় জানিবা তোমার সিদ্ধি নিকটবর্ত্তী। পাগ্‌লামী ছাড়িয়া পথে চল। বৃথা লোককে ও দেবতাকে বাম হস্তে অসম্মান করিয়া অপরাধী হইও না।

    ৫। তিলক ধারণ

    অনেক বৈষ্ণব বাবাজীকে দেখা যায় তিলক ধারণে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চিত্রিত করিতে ত্রুটী করেন না বা ভূলেন না। শাস্ত্রে দৃষ্ট হয় দ্বাদশ নামাবলী-যুক্ত মন্ত্রোচ্চারণে দেহের দ্বাদশ প্রত্যঙ্গে পবিত্র জল বা মৃত্তিকা অথবা চন্দন দ্বারা স্নানান্তে তিলক করিবে। ইহা ভগবানের নাম স্মরণের এক উপায় বই আর কিছু নহে। তাহা লোকের দৃষ্টি গোচরে নিবার কোন প্রয়োজন নাই। এ স্থলে সর্ব্বশরীর চিত্রিত করিয়া লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা কি পাগ্‌লামী নহে?

    পক্ষান্তরে দৃষ্ট হয় উচ্চ অঙ্গের সাধকগণ তিলকাহ্নিকের কোন ধার ধারেন না, সর্ব্ব শরীররই যখন হরিমন্দির বলিয়া জ্ঞান জন্মে তখন আর কোন্‌ স্থান বাদ দিব? যতদিন উচ্চে না উঠিতে পারি ততদিন বিধিমাত্র পালন। বাবা! লোকে দেখিয়া আমাকে বড় ভক্ত মনে করিয়া দণ্ডবৎ করুক এ পাগ্‌লামী বুদ্ধি ছাড়। মনে রাখিবে বাহিরের আচরণে বৈষ্ণব হয় না। ইন্দ্রিয় ও কুবুদ্ধিকে সংযত করিয়া ভিতরে খাটী বৈষ্ণব হও। আমি তাহা পারিতেছি না, তথাপী লোক দেখান কাজ করিতে মন বারণ করে।

    ৬। জাত্যাভিমান

    অনেক বাবাজীকে দেখিতে পাই গলদেশে অব্যবহার্য্য একটা যজ্ঞসূত্র সংলগ্ন আছে। বৈষ্ণবের পক্ষে উহা যে অবিধেয় তাহা উহারা মনে করেন না। জাতীর চিহ্ন পর্য্যন্ত পরিত্যাগ না করিলে সন্ন্যাস হয় না। যদি আমি উচ্চবর্ণ এ অভিমানই থাকিল তবে আর সর্ব্বত্যাগী হইলে কৈ! সংসার বাসনা যে এখানে উকী দিতেছে। ""তৃণাদপী সুনীচেন'' মহামন্ত্রের সম্মান আর রহিল কৈ? ঐ সকল বাবাজীরা অন্যে দণ্ডবৎ প্রণামাদি করিলে মুখে প্রতিনমস্কার উচ্চারন শুনা যায় না। বোধহয় উচ্চ গৌরবে মনে২ আশীর্ব্বাদই করেন। বাবা! বৃন্দাবনে ভাঙ্গি নমস্কার করিলেও প্রতিনমস্কার না করিলে অপরাধ হয় ইহা কি জান না? সকল জীবেই ত ভগবান বর্ত্তমান, ""যত্র জীব তত্র শীব'' একথাটা কি ভূলিয়া গিয়াছ? একজন আর একজনকে কেন প্রণাম করে? এক ভক্তিতে, হয় সামাজিক সম্মাননার প্রথায়। যেখানে ভক্তি সেখানে ভগবানেরই তাহা প্রাপ্য। দণ্ডবৎ এই জড়দেহকে নহে, সেই অন্তর্য্যামীকে জানিও। কখন কাহাকে নীচ বা ঘৃণার পাত্র মনে করিলে যে মহাপরাধ হয় ইহা যদি ভূল, তবে বৃন্দাবন কেন? সংসারে যাও!

    আরও একটা জাত্যাভিমানের পরিচয় বৈষ্ণব বাবাজীদের মধ্যে পাওয়া যায়। কোনও স্থানে বৈষ্ণব সেবা উপলক্ষে বহু বাবাজীর সমাগমে দৃষ্ট হয়, সকলের হাতে হাতে প্রসাদ গ্রহণ কি এক পংক্তি বসিয়া ভোজনে বিশেষ আপত্য উত্থাপিত হয়। বৈষ্ণবকে কোন্‌ জাতী জিজ্ঞাসা করাও যেমন অপরাধ, আবার আপনার পূর্ব্ব উচ্চবংশানুভূতি থাকাও বিশেষ অপরাধ। যেখানে জাতীহীনতা ঘটীয়া একত্ব সম্পাদন হইয়াছে, সেখানে আর এসকল পাগলামী কেন?

    এই সকল অপব্যবহার ও ভ্রমাচরণে বৃন্দাবনের স্বাস্থ্য খারাপ হইয়াছে, হাওয়া ও জল ও আলো পর্য্যন্ত দূষিত হইয়াছে।

    আমি বৈষ্ণবের নিন্দা করার উদ্দেশ্যে এসকল কথা কালীকলমে বদ্ধ করিলাম না। বড়ই দু:খ যে স্বর্গসম পবিত্র স্থান যদি কলোষিত হইয়া কালীমাচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয় তবে দেশের সাধারণ লোক শান্তী পাইবে কোথায় গিয়া? বৈষ্ণব বাবাজীরা পূর্ব্বেকার ষড় গোস্বামী প্রভূগণের পন্থাঅ চলিয়া শিক্ষা বিস্তার করিবেন, না, তাঁহাদের সেই কীর্ত্তি লোপ করিতে বসিয়াছেন, ভাবিয়া দেখুন। আমার অপরাধ দৃষ্ট হইলে ""তরুরিব সহিষ্ণুনাং'' মন্ত্রের স্মরণ করিবেন।
  • achintyarup | 59.93.192.216 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ০৪:০৪480424
  • ৭। বৈষ্ণবগ্রন্থের কথা।

    বেদ ও ভগবদ্‌গীতা ভিন্ন আর কোন অপৌরেষয় শাস্ত্র গ্রন্থ ত দেখিনা। ইহা ছাড়া সকল গ্রন্থই মনুষ্য রচিত। মনুষ্য রচিত গ্রন্থে ভ্রম প্রমাদ যে থাকিবে ইহা কখন বুদ্ধিমান অভিজ্ঞ লোকে অস্বীকার করিবেন না। কিন্তু এখানকার বাবাজীদের বিশ্বাস গীতা হইতেও আধুনিক বৈষ্ণবগ্রন্থ অভ্রান্ত এবং মান্য। গীতাতেও ভগবানের বাক্য ব্যাসদেব লিখিতে ভূল না করিয়াছেন তাহা কে জানে। অনেক সুবিদ্বান লোক বলেন গীতায়ও অন্য লোক কর্ত্তৃক সম্পাদিত শ্লোক প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। গীতা পাঠে যে স্থানে অসামঞ্জস্য ভাব মনে উদয় হয় তখন ঐ কথাটা মূলশূণ্য বলিয়া মনে হয় না।

    আর অধুনিক গ্রন্থের কথা কি বলিব? রাশী২ আবর্জ্জনা ঢুকিয়া থাকিলেও যদি কেহ ভ্রম প্রমাদের উল্লেখ করে তখন বাবাজীদের রাগ পঞ্চমে আরোহণ করিতে দৃষ্ট হয়। কেন বাবা! যে কথা পূর্ব্ব২ গোস্বামীদের কোন গ্রন্থে নাই সে কথা বৃন্দাবন দাস ও কবিরাজ গোস্বামী কোথায় পাইলেন? ভগবানের তিন বাঞ্চা অপূরণ ছিল গতিকে তিনি দ্বাপরলীলা অবসানে কলিতে গৌরলীলা প্রকাশ করিলেন, একথাটা বাবা! কোথায় পাইলেন? আর কেনই বা এই কথা নিয়া এত আলোচনা? কৈফতে প্রকাশ মহাপ্রভূ বলিলেন অন্তরঙ্গ ভক্তস্বরূপ দামোদরের কাছে, তিনি বলিলেন বৃন্দাবন দাসকে, তাহার লিখা দৃষ্টে গোস্বামী মহাশয় বিস্তার বর্ণনা করিলেন।

    আমার বিশ্বাস এই কথাটায় চৈতন্যের মহিমা বাড়িয়াছে সত্য, কিন্তু সেই ব্রজলীলাকারী পূর্ণ ভগবান শ্যামসুন্দরকে খাট করা হইয়াছে, যাহার পূর্ণত্ব লইয়া গৌরের গৌরত্ব, তাঁহার যদি বাঞ্চা অপূর্ণ থাকে তবে তিনি পূর্ণ থাকেন কি রূপে? এই কথাটা যেন শেল সম বাজে। যিনি পূর্ণতম স্বয়ং তাঁর কি কোন বাঞ্চা অপূর্ণ থাকিতে পারে? তিনি যে বাঞ্চাকল্পতরু। এই কথা বলিয়া সেই সর্ব্বশক্তিমানের শক্তি তুমি খাট কর কেন? তাঁহাকে মানুষ বানাও কেন? ইহা যে ভ্রমপূর্ণ উক্তি সে বিষয়ে কি সংশয় আছে?

    আর একটা কথা যাহা চৈতন্য চরিতামৃতে প্রচার ও নিরূপণ করার অশেষ বিশেষ চেষ্টা দৃষ্ট হয়, তাহা কেবল পণ্ডশ্রম বলিয়াই মনে হয়। ভক্তির পূর্ণতমত্ব কেবল শ্রী রাধিকা দেবীতেই প্রকাশ পাইয়াছিল, সেই ভক্তি কলিকালে ম্লান হইয়া গিয়াছিল বলিয়াই তাঁহার ভাব ও দ্যূতি অঙ্গীকারে গৌরাঙ্গ অবতারের প্রয়োজন হইল, কারণ গীতায় ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন, যখনই ধর্ম্মের গ্লানী উপস্থিত হয়, অসুরতার বৃদ্ধি দৃষ্টি হয় তখনই ভবলীলা প্রকাশে তিনি জীবগণের শান্তি ও স্বস্তি বিধান করেন।

    গৌরাঙ্গরূপে নবদ্বীপে অবতীর্ণ হইয়া তাহাই করিলেন, কেবল ভক্তিতঙ্কÄই শিক্ষা দিলেন। দ্বাপরের লীলার ন্যায় সর্ব্বশক্তিটা এখানে প্রকাশ পাইল না। প্রকাশের প্রয়োজনও ছিল না। কলিতে ম্লেচ্ছাধিকার শাস্ত্রে পূর্ব্বেই যখন নিরূপণ করিয়া রাখিয়াছেন, ম্লেচ্ছরূপী অসুর বিনাশে পুন: হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এখানে অপ্রয়োজন হেতু, শক্তি প্রকাশের দিকে না গিয়া কেবল ভক্তির প্রচার করিলেন; যত সহজে লোকে ভক্তিলাভ করিতে পারে তাহার পথ দেখাইলেন। নিম্নাধিকারীগণকে নাম জপ ও নাম সংকীর্ত্তণের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। উচ্চাদিকারীদিগকে বিধিমার্গ পরিত্যাগে রাগমার্গের অনুসরণ করিতে উপদেশ দিলেন। ভক্তির জয় ঘোষণা হইল। শ্রীরাধারাণীর ভাবদ্যূতি গ্রহণের সাফল্য পূর্ণ পরিমাণেই প্রকাশ পাইল।

    এই অবস্থায় ভক্তগণ তাঁহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা ও মনন করিতে আরম্ভ করিলে তিনি স্পষ্টরূপেই নিষেধ করিলেন, কেহ যেন ভ্রমেও তাহাকে ঈশ্বর মনে না করে, আরও বলিলেন জীবকে ঈশ্বর ভাবিলে মহা অপরাধ হয়। তিনি নিজমুখেও স্পষ্ট বলিলেন আমি মানুষ এবং কার্য্যতায়ও দেখাইলেন আমি জীব। দ্বাপরে যে সকল অলৌকিকত্ব ও পদে পদে ঈশ্বরত্ব বাল্যকালেই প্রকাশ করিয়াছিলেন, নবদ্বীপে কি নীলাচলে তাহার কিছুই করিলেন না। অধিকন্তু বিশেষ করিয়া নিষেধ করিলেন তাঁহার পূজা কেহ না করে, কেবল রাধাকৃষ্ণই একমাত্র ভজনীয়, এই তাঁহার দৃঢ় উপদেশ।

    যদি তিনি ঈশ্বরত্ব প্রকাশ করিতেন, তবে রাজাকে দর্শন দেওয়া ও স্ত্রীসংসর্গে যাওয়ার এত কঠোর ব্যবস্থা কখনই তিনি করিতেন না, যেখানে দ্বাপরে ষোল হাজার রমণী সংস্পর্শেও তাঁহার চিত্ত বিকারের লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই, ঈশ্বর হইলে, এখানে একটীমাত্র স্ত্রীলোকের (বিষ্ণুপ্রিয়া) সহবাস বর্জ্জন করিয়া সন্ন্যাসী হইলেন কেন? আবার সন্ন্যাসাবস্থায় কেবল স্ত্রীলোকের ভিক্ষামাত্র গ্রহণ অপরাধে ছোট হরিদাসকে বর্জ্জন করিয়া আত্মঘাতী করিলেন। কেন?

    গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া যে ভ্রম করিয়াছিলেন তাহা বুঝিতে পারিয়া, শেষ জীবনে আজন্ম সন্ন্যাসী নিত্যানন্দকে তাহা পরিত্যাগে গৃহী সাজাইলেন, বিবাহ করাইলেন। ইহা মনুষ্যোচিত কার্য্য; ঈশ্বরের কার্য্য ভ্রম প্রমাদের অতীত, দ্বাপরে এরূপ কার্য্য দৃষ্ট হয় না। ষড়ভূজ দর্শন, রাশীকৃত অন্নভোজন ও আমের আঁটী পুঁতিবা মাত্র বৃক্ষরূপে পরিণত হওয়া ও ফল প্রদান, এ সকল ভক্তগণের অতিরঞ্জন -- কল্পনা ভিন্ন কিছু নহে।

    রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে গৌরের ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ হওয়ায় তাহার দৈব পরীক্ষা গ্রহণ করা হইয়াছিল, তখন দৈবশক্তি কর্ত্তৃক কাগজখণ্ডে লিখিত হইয়াছিল ""গৌরাঙ্গ -- পরম ভক্ত ন চ পূর্ণ ন চাংশক''। এই বাক্যাংশের সরল অর্থ যে -- গৌর ভক্ত মাত্র, তিনি পূর্ণ কি অংশ নহেন, এ বিষয়ে কাহারও কোন সন্দেহ হইতে পারে না। কিন্তু গৌর ভক্তগন তাহার বীপরিত অর্থ নিষ্কাশন করত: তাঁহাতে পূর্ণ ঈশ্বরত্ব আরোপ করিতে ত্রুটী করেন নাই।

    এরূপ চেষ্টায় কি ফল, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাহা ধারণা করিতে পারিনা। জীব মাত্রই ঈশ্বরের অংশ; গীতায় বিভূতি যোগে তাহা পরিস্কার নিজ মুখে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইতে ত্রুটী করেন নাই। যে জীবে ঈশ্বরের শক্তি সমূহের বা বিশেষ শক্তি প্রকাশ পায় তাঁহাকে ঈশ্বর তুল্য জ্ঞানে লোকে পূজাদি করে ও জীবিত কাল পর্য্যন্ত শরণাপন্ন হইয়া সর্ব্ববিষয়ে আনুগত্য স্বীকারে তাঁহার মহিমা প্রচারে ত্রুটী করে না। মরিলেও তাঁহার ফট কি প্রতিমূর্ত্তি গড়িয়া তাঁহার স্মৃতি রক্ষা করিতে পরাঙ্মুখ হয় না। ইহাতেও যাহার তৃপ্তি না হয়, তাহারা পূর্ণ ঈশ্বরকে ছাড়িয়া তাঁহারই স্মরণ মননে নিযুক্ত হয়। গীতায় বলিয়াছেন যে ""যে ভাবে যাহাকেই পুজা কর, প্রকারান্তরে আমাকেই কর। যে ভাবে কর সেই ভাবে ফলও পাইবা। তবে সে ফল অস্থায়ী, আর যে আমাকে অর্থাৎ পূর্ণতম ঈশ্বরকে ভাবনা চিন্তা করে সে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে''।

    গৌরাঙ্গে ভক্তি শক্তির আত্যন্তিক স্ফুরণ হওয়ায় ইহা স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে ভগবান ভক্তরূপে বা ভক্তাধীন হইয়াই লোককে ভক্তি শিক্ষা দিলেন। এই অংশে ভগবান ও ভক্ত অভেদ হেতু গৌরকে ঈশ্বর জ্ঞানে তাঁহার উপদেশ শিরোধার্য্য করিয়া চলিতে পার কিন্তু তাঁহার আদেশের বিরুদ্ধে তাঁহাকে ঈশ্বর বানাইয়া তাঁহাকে এবং আমাদের ন্যায় অভক্তগণকে বাবা! ভ্রমে ফেলাও কেন?

    গৌরাঙ্গ ছাড়া নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাদিও ঈশ্বরের কণা অংশ প্রভৃতি বর্ণনে চরিতামৃতের কয়েক অধ্যায় বাড়িয়াছে। বাবা! এত কথার কি প্রয়োজন ছিল? ভক্তে ও ভগবানে অভেদ তাহা ত ব্রজলীলায়ই দৃষ্ট হইয়া প্রমাণিত সত্যরূপে গ্রহণ করিতে ভাগবতগণ ত্রুটী করে নাই। তখন গৌরলীলায় এসকল কথার বিস্তার অনাবশ্যক। লোকে যাহাতে ভগবানের কিঞ্চিৎ মাত্রও বিকাশ দর্শন করিবে তাঁহাকে কি আর অবহেলা করিতে পারে। লোকসকল ত পিপীলিকাবৎ যেখানে মধু দেখিবে সেখানে হাট বসাইবে। গৌরলীলায় গোপী অর্থাৎ অন্তরঙ্গ ভক্তগণ সকলই তৎসহ অভেদ মনে করিলেই গোল চুকিয়া গেল। দ্বাপরলীলায় তাহাই দেখাইয়া, নিজ ভক্তরূপিণী শ্রীরাধার দাসত্ব পর্য্যন্ত করিয়াছিলেন। বাবা! আর কি চাও, জগত ব্রহ্মময় দেখ। সেই শ্যামসুন্দরের নিত্য লীলা দেখ। গৌরাঙ্গকে বৈষ্ণব ধর্ম্মের আদি গুরুর গুরু মহাগুরু বলিয়া মনে জাগরূক রাখ। সর্ব্ব সাধন ভজনের আরম্ভেই নতশিরে তাঁহাকে অভিবাদন জানাইতে ত্রুটী করিও না। কিন্তু দুহাই বাবা! তোমাদের, প্রসাদ সম্মুখে লইয়া তিনবার ভগবানকে স্মরণ করা ভিন্ন এত শিকলী পাঁচালীতে বৃথা সময় ও প্রসাদ নষ্ট করিও না। পাগ্‌লামী ছাড়।
  • achintyarup | 59.93.192.216 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ০৫:২৫480425
  • আমার প্রতি ভগবান ব্রজেন্দ্র নন্দন
    শ্রীহরির অহেতুকী কৃপা ও প্রেমভাব।

    ১। আমার বাল্যকাল হইতেই গৃহকন্নার কাজে বিশেষ উৎসাহ ও ইচ্ছা সবিশেষরূপে অনুভব করিয়া আসিতেছি। খাওয়া পরার জিনিশপত্র সংগ্রহ, তাহার আয়োজন, উদ্যোগ ও প্রস্তুতিকরণে যেন মন স্বত:ই ধাবিত হয়। যদিও কঠোর আইন ব্যবসা ও সংসারের যাবতীয় অসাধ্য কার্য্য পরিচালনে বিমুখ হই নাই, কিন্তু তাহাতে এরূপ শান্তি পাই নাই যেরূপ শান্তি গৃহস্থালীর সুবন্দবস্থ করণে প্রাপ্ত হই। ভগবান আমার ভাব ও স্বভাবের অনুকূলে এই ব্রিন্দাবনধামে আনয়ন করিয়া তাঁহার নিজ গৃহস্থালীর কার্য্যে যে ব্যাপৃত রাখিয়াছেন তাহ কি অহেতুকী কৃপা নহে।

    ২। শ্রীবৃন্দাবনে আসিবার কোন মনন ছিল না, সুযোগও ছিল না; অকস্মাৎ মন কেন ধাবিত হইল এবং অচিন্তিতরূপে এই মন্দিরে সুযোগ উপস্থিত হইল, তাহা তিনিই জানেন। আমি ইহা তাঁহার অসীম দয়া মনে করি।

    ৩। ছোট কাল হইতেই নিরামিশ ভোজনে রুচি ও দেবগুরুর প্রসাদে প্রীতি অনুভব করিয়া আসিতেছি, এই শেষ বয়সে তাহা যে পূর্ণ পরিমাণে লাভ হইল, ইহা তাঁহারই কৃপা।

    ৪। এখানে অত্যধিক শীত ও গ্রীষ্ম, আমার স্বাস্থ্যের অনুকূল নহে। তাহা চিন্তা করিয়া কোথায় গিয়া বাস করিলে শান্তি পাইব এই চিন্তা মনকে আলোড়িত করিতেছিল। অকস্মাৎ মন্দিরাভ্যন্তরে পাঁচ হস্ত মাটীর নিম্নে এক প্রকোষ্ঠ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে বাস শীত ও গ্রীষ্ম উভয় কালেই আরামজনক। দয়া আর কাহাকে বলে?

    ৫। এখানে লোকজনের সৌহৃদ্দ ও সহানুভূতি মিলিবে কিনা তাহাও চিন্তার বিষয় ছিল। তাঁহার কৃপায় সৎসঙ্গলাভ ও আত্মীয় সুহৃদ বিস্তর জুটীয়াছে, কোন চিন্তারই কারণ আর নাই। গুরু একজন শ্রীরাধিকার স্থানীয় দ্বিতীয় গৌরাঙ্গের স্থানবর্ত্তীই মনে করিয়া পুজা ও প্রীতি করি। উভয়ের দয়া, স্নেহ ও অন্তরঙ্গ ভাবের অপ্রতুলতা নাই। পুজারী আমাকে বাবা সম্বোধন করিয়া পুত্রের ন্যায় ব্যবহারে ত্রুটী করে না, ব্রাহ্মণ হইলেও কোন কাজে আপত্য বা অবহেলা দেখি না। টহল্‌নী অর্থাৎ ঝি মাতার ন্যায় স্নানাহারের ব্যবস্থা ও যত্ন পরিচর্য্যার ত্রুটী করে না। ডাক্তার ও কবিরাজ দুইজনই খাটী ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক পাইয়াছি। একাধারে সুহৃদ ও চিকিৎসক, ইহা কি ভগবানের কৃপা নহে? ইহা ছাড়া বহু হিতৈষী লোকও আছেন আপদ বিপদে সহানুভূতি যথেষ্টই করেন।

    ৬। আধ্যাত্মিক অর্থাৎ ইষ্ট বিষয়ে ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীহরি অন্তরে অন্তর্য্যামী শিক্ষাগুরুরূপে বর্ত্তমান থাকিয়া যে শিক্ষা দিতেছেন ও কৃপা প্রকাশ করিতেছেন তাহা লোকের নিকট প্রকাশ করিতে শাস্ত্র ও গুরু উভয়ই নিষেধ করিয়াছেন, সুতরাং তাহা প্রকাশ করিতে না পারিলেও এই মাত্র বলিতে পারি যে যখন যে সন্দেহ মনে উপস্থিত হইতেছে তাহা সেই অন্তর্য্যামীই নিরসন করিতেছেন। তজ্জন্য বাহিরের গুরুগণের উপদেশ লাভের অপেক্ষাও রাখিতেছেন না।

    ৭। বৃন্দাবনে আসিয়াই প্রথমে নিকুঞ্জ বন মন্দিরস্থ শ্রীরাধারাণীর যে চিত্রপট দর্পণাভ্যন্তরে স্থিত থাকিয়া দর্শনাভিলাষী জনগণের বাসনা পূরণ করিতেছেন, সেই চিত্রপট দর্শন করিতে হয়, তাহা যে মন্দিরে বিরাজমান সেই মন্দিরাভ্যন্তর দিবাতেও অন্ধকারাচ্ছন্ন, আরতীর আলোক দ্বারা যখন মন্দিরাভ্যন্তর আলোকিত হয়, তখনই প্রখর দৃষ্টিশক্তি বিশীষ্ট ব্যক্তিগণ সে "চিত্রলেখা' দর্শন করিতে পায়। তাহা জানিয়া, আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রস্বতা নিবন্ধন, আমি ভাল চস্‌মা লইয়া গিয়া দর্শন করার উদ্যোগী হইলাম, অকস্মাৎ সেই জনবহুল স্থানেও একটা বানর অলক্ষিতে আমার পশ্চাৎ দিকে আগত হইয়া আমার চক্ষু হইতে মূল্যবান চস্‌মাট অবলীলাক্রমে খুলীয়া লইয়া পলায়ন করিল। অবশ্য সে চস্‌মা পরে দিয়া গেল। কিন্তু এই অচিন্তিত ঘটনায় মনের ভিতরে যে একটা গুরুতর দার্শনিক তঙ্কÄ জাগিয়া উঠিল, তাহা যেন প্রহেলীকাবৎ মনে প্রবাহ বিস্তার করিতে লাগিল, এই ঘটনায় এই শিক্ষা কি দিলেন না যে বাহিরের চক্ষু দিয়া দেখার এত ব্যগ্রতা ও ব্যস্ততা কেন? মনশ্চক্ষে কি জ্ঞানচক্ষে দেখার চেষ্টা কর্‌? অত:পর তাঁহার কৃপাবারি যে ভাবে বর্ষিত হইয়া আমার উত্তাপিত হৃদয়তাপ দূরীভূত হইল ও দর্শনাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি হইল তাহা লোকের নিকট প্রকাশ করিতে গুরুদেব নিষেধ করায়, এই মাত্রই ঈঙ্গিত করিলাম যে অনন্ত দয়ার যিনী আধার, তিনি প্রাণেই রহিয়াছেন, প্রাণের ব্যথা বুঝিতে কি আর তিনি বাহিরের আড়ম্বর জনক আরাধনা সুচনা চাহেন? না, তাহা নহে। কেবল মনের ভাব চাহেন, তিনি যে সদাই ভাবগ্রাহী জনার্দ্দন। আর কি বলিব? দিদিমণি! তুমি বৃন্দাবনেশ্বরী তোমার জয় হউক, আমার দাসীপণা যেন বহাল থাকে, নতুবা আমি অবোধ বালীকা -- গৃহের সব লণ্ডভণ্ড করিব। পাছে তোমাকেই সব গোছাইতে হইবে।
  • achintyarup | 59.160.219.101 | ১৮ অক্টোবর ২০১১ ২০:৩৭480426
  • গগন চন্দ্র কর্তৃক এই গ্রন্থ রচনার প্রায় ৮০ বছর পরে তাঁর এক বৈষ্ণবকুলকলঙ্ক প্রপৌত্র বৃন্দাবন সংক্রান্ত কিছু লেখালিখির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। নিচে তার লিং দেওয়া হল:

    http://www.fazalsheikh.org/online_editions/moksha/online_edition_ben/start.php
  • achintyarup | 59.93.242.174 | ১৯ অক্টোবর ২০১১ ০৫:১১480427
  • যেটা লিখতে ভুলেছি -- ওপরের লিঙ্কে ক্লিক করলে নতুন জানালায় যে বইটা দেখা যাবে সেটা ভার্টিকালি নয়, হরাইজন্টালি, ডানদিকের তীরচিহ্ন চেপে চেপে পড়তে হবে। লেখা পড়তে গিয়ে যদি বোর হয়ে পড়েন, ছবিগুলো দেখে নিতে ভুলবেন না। মনে হয় গগন রায়ের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি বৃন্দাবনবাসীদের।
  • siki | 123.242.248.130 | ১৯ অক্টোবর ২০১১ ১৮:০২480429
  • ঢিঁচ্‌ক্যাঁও ...
  • achintyarup | 59.93.244.242 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ০৪:৫৮480430
  • ৮। উল্লিখিত ঘটনার কয়েক মাস পর, সন্ন্যাস গ্রহণের বাসনা কেন যেন মনকে আলোড়িত করিতে লাগিল। শিক্ষাগুরু নিষেধ করিলেন, তথাপী মন প্রবোধ মানে না। কেবল পাঞ্চাশোর্দ্ধে বনং ব্রজেৎ এই কথাটা বার২ মনে উদয় হয়। বাহিরে যে বন, তাহাতে ত আসিয়াছিই, বৃন্দাবনের তুল্য বন কি আর জগতে কোথাও আছে? কিন্তু ভিতরে বনে বাস ত হইতেছে না। তাহাই ত প্রকৃত বনে বাস। কি করিলে তাহা হয়, না মহাপ্রভূ যাহা শিক্ষা ব্যপদেশে নিজে আচরণ করিয়া গিয়াছেন, তাহাই ত অবলম্বন করিলে মনই বনে পরিণত হইবে। বাহিরের কতকগুলী সন্ন্যাসের অনুকুল কারণও আছে তাহা প্রকাশ নিÖপ্রয়োজন।

    কিন্তু তাহাতে একটা ভয় জাগিল। পূর্ব্বে ত একবার দীক্ষা গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহাও বৈষ্ণব পন্থানুসরণেই করিয়াছি। এখন যদি সে মন্ত্র ও গুরু পরিত্যাগ কারিতে হয়, তবে ত জীবন কলঙ্কিত হইয়া অশেষ দুর্গতি হইতে পারে। কিন্তু শিক্ষাগুরু সহ আলোচনায় দেখিলাম তাহা নহে, পূর্ব্বের গুরু, প্রণালী ও মন্ত্র সবই বহাল থাকিবে, কেবল কতকগুলী অনুষ্ঠান মাত্র বৃদ্ধি হইবে। পরে দীক্ষাগুরু হইতে যে মন্ত্র পাওয়া গেল, তাহা পূর্ব্ব গ্রহণীয় মন্ত্রই। সবই ঠিক রহিল। ভগবানের কৃপা অপার!!

    ৯। সন্ন্যাস অবলম্বনের পর ভাবনা হইল, গুরুগণ যে পথে চালিত করিলেন, সে পথে ত চলিতে হইবে, কিন্তু ভগবানের কোন্‌ আদর্শ হৃদয়ে অনুক্ষণ ধারণ করিলে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ হইবে, তাহা ত বুঝিতেছি না। গুরুর নিকটও এ প্রশ্নের মিমাংসা পাওয়া যায় না। কারণ কাহার হৃদয়ে ভগবান কি ভাবে দেখা দিবেন তাহা বুঝা কঠিন, ভগবান লীলাকারী, যাহার যে ভাবে রুচি ও আনন্দ হইবে তাহা তিনি ভিন্ন আর কে সাধককে বুঝাইবে? তাই মনে বড় অশান্তী ও নিরানন্দ ভোগ করিতে লাগিলাম। কিন্তু সেই হৃদবিহারী ত অন্তর্য্যামী শিক্ষাগুরু, তিনি তাঁহার অবোধ ছাত্রের মনের ভাব বুঝিতে বিলম্ব হয় না, তাই কৃপা করিয়া যাহা বুঝাইয়া দিলেন তাহা প্রকাশযোগ্য নহে। আর কি বলিব? প্রাণপতী, প্রাণেশ্বর, প্রাণধন তোমাতে যেন থাকে মন।

    ১০। জীব হিংসা ত বর্জ্জনীয়, ইহা সকলেই জানে, কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রে ইহা অপেক্ষাও কঠিন সূত্র করা হইয়াছে -- ""প্রাকৃত ক্ষোভেতে হবে অক্ষোভিত মন, প্রাণি মাত্রে উদ্বেগ না দিবে কদাচন'' এই বাক্যদ্বয় মধ্যে সর্ব্বপ্রকার সংযম নিহিত রহিয়াছে। তাহা পালনের চেষ্টা করিতেছি বটে কিন্তু সকল সময়ে ধৈর্য্য রক্ষা হয় না। একদিন ২টা ইন্দুরের উপদ্রবে বড় জ্বালাতন হইয়া গীতার উক্তি স্মরণ করিয়া, আততায়ী বধে পাপ নাই মনে করিয়া, দিবাভোগ প্রসাদ গ্রহণের সময়েই একটা ইন্দুরকে বাম হাতে ধরিয়া ফেলীলাম ও বাম হাতেই টিপিয়া মারিলাম, আহারান্তে দেখি তৎ স্থলে আর একটা হাজীর, তাহাকেও পুর্ব্বনুগামী করিলাম। এই বধ ক্রীয়ার দণ্ড স্বরূপ বাম হস্তে আজও বেদনা বোধ হয়। ইহা ভগবানের কৃপা, লঘু পাপে লঘু দণ্ড হাতে২ দিয়া শিক্ষা দিলেন।
  • achintyarup | 59.93.244.84 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৫২480431
  • আয়ুবৃদ্ধি।

    বৃন্দাবন রম্য স্থান, অতি আনন্দের ধাম ইহা যে অনুভব করিতে পারে, সে অচিরেই শান্তী প্রাপ্ত হয় ও তাহার আয়ু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আয়ুবৃদ্ধির কতকগুলী অনুকূল কারণ এখানে সতত বর্ত্তমান।

    যথা--

    ১। তুলসী ও নিম্ব তরুরাজীর হাওয়া সেবন নিত্য কার্য্য।

    ২। আরতীর শঙ্খজল মস্তকে গ্রহণ, চরণামৃত ও চরণতুলসী তিনবার নিত্য গ্রহণ কার্য্য।

    ৩। প্রসাদান্ন বা অন্যবিধ যে কোন প্রসাদ নিত্য সেবন কার্য্য।

    ৪। নিশ্চিন্ততা, সেবা ও স্মরণ মননে মনের স্ফূর্ত্তিজনক কার্য্য।

    ৫। স্বাস্থ্যকর জল বায়ু সেবন।

    ৬। পুষ্টীকর টাটকা ও সুলভ আহার্য্য গ্রহণ এবং তাহা আবার প্রসাদরূপে নিত্য গ্রহণ।

    ৭। ইন্দ্রিয়ের অসংযমতার কারণ উপস্থিত হইলেও বন্দাবনের ভাবে ও মাহাত্বে ইন্দ্রিয় সংযম সহজ সাধ্য হেতু ইন্দ্রিয় সংযম আয়ু বৃদ্ধির মুখ্য কারণ।

    ঐ সকল বিষয়ে অনেকে অনুধাবন করেন না, চিন্তা করেন না। করিলে ঐ সকল কার্য্যের ফল সহজেই বোধগম্য হইবে এবং তৎসঙ্গে ২ ঐ সকল কার্য্যে আশক্তিও প্রবল হইবে। ঐ সকল কার্য্যে দৃঢ় বিশ্বাস না থাকিলেও অজ্ঞাতসারে কতকটা ফল যে না হইবে তাহা নহে। অনুধাবন করিলে তাহা যে ভগবানের সাক্ষাৎ কৃপা তাহা সহজে প্রতীতি হয়। তুলসী ও নিম্ব তরু প্রায় সকল মন্দিরের আঙ্গীনায়ই রোপিত দৃষ্ট হয়। তাহা প্রদক্ষিণ করা দিবানিশী নিত্য কার্য্য, ইহা যে স্বাস্থের অনুকূল তাহা অধুনিক পাশ্চাত্য সুধীগণও স্বীকার করেন। প্রতিনিয়ত ঐ দেবপ্রিয় তরুরাজীর বায়ুসেবনে, মনের শান্তী হয়, রোগ দূর হয় ও আয়ুবৃদ্ধি হয়। প্রতেক মন্দিরে দিবারাত্রিতে ৫/৬ বার ঠাকুরের আরতী হয়, তৎসময় উপস্থিত থাকিলে, শঙ্খের জল মস্তকে পতন হয়, চরণামৃত সেবন ও চরণ তুলসীপত্র ভক্ষণ ঘটে, ইহা যে আয়ুবৃদ্ধিকর তাহার কোনই সন্দেহ নাই।

    সুস্বাদু, সুপেয় চর্ব্ব চুষ্য লেহ্য পেয় প্রসাদী অন্নব্যঞ্জনাদি রুটী, পুরী, মিষ্টানাদি ও ফল মূলাদি প্রতিনিয়ত গ্রহণে মনের বল ও শারীরিক বল যে বৃদ্ধি হয়, ইহা কে অস্বীকার করিবে? তাহার প্রমাণ ত আমি নিজেই দেদীপ্যমান। কোথায় সংসারে থাকিতে আসন্ন মৃত্যু কল্পিত হইয়াছিল, আর কোথায় এখানে বলশালী হইয়া সারা বৃন্দাবন ভ্রমণেও কষ্টানুভব হয় না এবং মানসিক বলের পরিচয় ত এই গ্রন্থ লেখা ব্যাপারেই দৃষ্ট হয়। কোথা হইতে এ ভাবলহরী ও বাক্য যোজনার চাতুরী আসিতেছে? ইহা কি ভগবানের সাক্ষাৎ কৃপা নহে? কৃপাময়ের কৃপাবারি যে অন্ত:সলীলা ফল্গু গঙ্গা সদৃশ প্রবাহিত হইতেছে।

    তারপর মনের শান্তি; ভগবদারাধনা ও সেবায় যে স্ফুর্ত্তি তাহাতে কি আয়ুবৃদ্ধির অনুকুলতা করে না? শাস্ত্র বলেন পাপে আয়ুক্ষয় পূণ্যে বৃদ্ধি; বৃন্দাবনবাস পূণ্য কার্য্য, আবার দেবসেবাদি নানা পূণ্যানুষ্ঠান তাহার সঙ্গে মিশিয়া ভগবচ্চিন্তার ঐকান্তিকতা ঘটে, তবে কেন যে বৃন্দাবনবাসী সাধু প্রকৃতির লোকেরা দীর্ঘজীবি হইবেন না, ইহার কি সন্দেহ জন্মিতে পারে? এখানে দীর্ঘজিবী লোকের অভাব নাই, ৬০-৬৫-৭০-৮০ বৎসর বয়স্ক বাবাজী ও মাতাজীর দল ত অহর্নিশীই দৃষ্টিপথে বিচরণ করিতেছেন। প্রত্যহ প্রাতে যে শতাধিক লোককে চুট্‌কি ভিক্ষা দেই তন্মধ্যে ৩/৪র্থ ভাগই বৃদ্ধ অধিক বয়স্ক; এই দীর্ঘ জীবন লাভের হেতু বৃন্দাবনে বাস করারই ফল।

    অত:পর বৃন্দাবনের জলবায়ুও স্বাস্থের অনুকূল। যদিও শীত ও গ্রীষ্মাতিশয়তা সময়২ অসহীন বোধ হয়, তথাপী বিশেষ মারাত্মক মড়ক সদৃশ কোন পীড়া এখানে দৃষ্ট হয় না। যমুনার জল প্রায় বারমাসই নির্ম্মল, বর্ষায় কয়েকদিন ঘোলা হইলেও তাহা অনিষ্ট উৎপাদক নহে। কুয়ার জল অতি সামান্য স্থানে ঘোলা, তাহা বাদ দিলে, অন্যান্য কুয়ার জল নির্ম্মল, সুস্বাদু ও সুশীতল। আমার ... মন্দিরে যে বৃহদায়তন কূপ আছে, তাহার জল এমন সুশীতল ও মিষ্ট যে তাহা বর্ণনীয় নহে। বায়ু খুব শুষ্ক, সময়২ উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হইলেও যমুনার সুশিতল লজ স্পর্শী বায়ু যে আরাম ... না। আহার্য্য দ্রব্যের বার আনা ভাগই সস্তা ও .... প্রধান আহার্য্য, তাহা যে সর্ব্বপেক্ষা বলকারী তাহা ....। ফল এখানে প্রচুর টাটকা মিলে। কেবল কলা .... রস নাই। আম যাহা মিলে তাহা বড় মন্দ নহে আর ..... এখানে উপকারী। সর্ব্বপ্রকার টকই এখানকার লোকে ... ভালবাসে, তাহার কারণ বোধহয় উষ্ণতা অধিক বলিয়া লোকে টক সহযোগে না হইলে কোন আহার্য্যই গ্রহণ করিতে রুচিকর মনে করে না। পুদিনা শাক এখানে বিস্তর, তাহা লোকে চাটনী প্রভৃতি করিয়া খাইতে ভালবাসে, তৎসহ কাগজী লেবু কি আম কি আমের ফল্‌সী বা আমচূড়, লঙ্কা ও লবণ সহ মিশাইয়া চাট্‌নী তৈয়ার করে। পুদিনা যে পরিপাক শক্তির তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি করে তাহাতে আর সন্দেহ কি? পুদিনা গুড় সহ মিশাইয়া যে এক প্রকার খাদ্য তৈয়ার করে, তাহা সুস্বাদু, রুচিকর ও সর্দ্দিগরমী দোষের নিবারক। এখানকার কূপের জল যেমন সুস্বাদু, শিতল তেমনি পাচক।

    এইসকল আহার্য্য দ্রব্যের সুলভতা ও জল, বায়ুর নির্দ্দোষীতা সাধারণ স্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে খুবই অনুকূল হেতু আয়ুবৃদ্ধি অনিবার্য্য। মিউনিসিপালিটীর বন্দবস্থও উত্তম।

    আমার কুষ্ঠিতে লিখিত আয়ুর পরিমাণাপেক্ষা আমি .... দীর্ঘ দিন বাঁচিব বলিয়াই মনে হয়, মনে যখন বার্দ্ধক্যের ভাব বিন্দুমাত্র উদয় হয় না, তখন মরিবার আশঙ্কা কোথায়?
  • achintyarup | 59.93.244.84 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৫৬480432
  • ইতি

    শ্রী গগনচন্দ্র রায়স্য আত্মকথা।

    এই মহাগ্রন্থ টুকিবার কালে ভুলত্রুটি যাহা করিয়াছি, গুরু ও চণ্ডালগণ তাহা নিজগুণে ক্ষমা করিবেন, এই আশা করি :-)
  • ranjan roy | 115.118.231.77 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ০৮:০৬480433
  • অচিন্ত্য,
    ছোটভাইয়ের কাছে শুনেছি যে গগনচন্দ্র হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন, সে নিয়ে কেস হিস্ট্রি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আর যৌনশিক্ষা নিয়েও একই হাতে লেখা ছোট পুঁথিগোছের আছে। তোমার চোখে পড়েছে কি? তোমার পিতৃদেবকে জিগ্যেস করা কতটা
    risky ?
  • achintyarup | 59.160.219.101 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ১৭:৩৭480434
  • আরও একটি বা দুটি পুঁথি আমার চোখে পড়েছে, নাকতলায় কোনও বাড়িতে সেগুলি আছে
  • kumu | 122.161.156.169 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ২৩:২৫480435
  • এই মহা মূল্যবান জীবনচরিত টাইপ করিতে বাবু অচিন্ত্যরূপ যে অবিশ্বাস্য নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়াছেন,তাহাকে প্রণাম।
  • achintyarup | 59.160.219.101 | ২০ অক্টোবর ২০১১ ২৩:৪৭480436
  • অশেষ ধন্যবাদ কুমুদিদি
  • ranjan roy | 14.97.113.239 | ৩০ অক্টোবর ২০১১ ২৩:৩৬480437
  • গগন রায়ের শেষ জীবন
    ------------------
    ওনার আত্মজীবনী পড়লে মনে হবে উনি যেন বৃন্দাবনেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আসলে উনি শেষ জীবনে নিজের গৃহনগরে, থুড়ি গৃহগ্রাম আঠারবাড়িয়ায় ফিরে এসেছিলেন। সন্ন্যাসীকে নাকি মৃত্যুপূর্ব জন্মভূমি দর্শন অবশ্য কর্তব্য ইত্যাদি।
    এসে উনি মূল বসতবাড়ির আউটহাউসে থাকতেন, কামরাটিতে ঘরের কোনে টাঙানো দড়িতে পরিধেয় বস্ত্র ছাড়া একটি সবরি কলার কাঁদি ঝোলানো থাকত। কারণ উনি রাত্রে ফলার করতেন। দিনের বেলাতেও ওনাকে বাহির বাড়িতেই খাবার পরিবেশন করা হত, করতেন ওনার ছেলে বৌ, স্ত্রী নন।
    লেখা দেখেই বোঝা যায় বৃন্দাবনের বৈরাগী হলেও নামকীর্তনের ভাবাবেগে ভেসে যেতে ওনার ঘোর অনীহা। নেড়া-নেড়ির কান্ডের প্রতি ওনার নাক কুঁচকেই রয়েছে। ঝোঁক জ্ঞান মার্গের দিকে, একটু তর্কপ্রবণ। সেই সময়ের হিসেবে একটু এলিটিস্ট সংস্কৃতির। প্রথম যৌবনে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।
    কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম জনগণের ধর্ম। নিজে অনূযায়ী হয়েও অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন আর আবেগে ""কুমড়োগড়াগড়ি'' পছন্দ ছিল না। তাই একবার নিজের বাড়িতেই ভাই ও অন্যেরা একমাস ধরে
    কীর্তনের আয়োজন করালে তিতিবিরক্ত গগনচন্দ্র ময়মনসিংহ সদরে চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, বেশ আইনের ধারা-উপধারা কোট করে, এতে ওনার রাত্রের ঘুম ব্যাঘাত হয়ে শান্তিনষ্ট হচ্ছে। তিনদিন পরে ঘোড়ায় চড়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে সরেজমিনে দেখে কীর্তন বন্ধ করালেন। কিন্তু গগনচন্দ্র প্রজাদের মাঝে অপ্রিয় হলেন।
    ""তরোরিব সহিষ্ণুনা'' বাস্তবে পালন বড় কঠিন।:)))
    এই কথাগুলো ওনার বড় নাতির মুখে শোনা যে সন্ন্যাসীদাদুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করত: মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গগনচন্দ্রের স্নানের ঘাটে পায়খানা করে রেখে যেত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন