এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাংলাদেশের কবিতা

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ০৮ জুলাই ২০১১ | ১০৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৮ জুলাই ২০১১ ১০:২০477596
  • বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে এই টইটি খোলা হল। এখানে মাঝে সাজে বাংলাদেশের কবিতা পোস্ট দেওয়ার ইচ্ছে রাখি। প্রথম কবি হিসাবে বেছে নিয়েছি কবি কাজল শাহনেওয়াজকে। তিনি আশির শেষদিকে বা নব্বইয়ের প্রথম দিক থেকে কবিতা লিখছেন। কৃষি প্রকৌশল অনুষদের স্নাতক। কবিতার পাশাপাশি গল্পও লেখেন। বাড়ি কিশোরগঞ্জ।

    ------------------------------------------------------------------
    কবি কাজল শাহনেওয়াজের পাঁচটি কবিতা
    আমার বর্ষাকাল

    আমাকে তছনছ করে
    .............
    আমাকে তছনছ করে দিলে, আমাকে থমকে দিলে আজ
    মাত্র দশ মিনিটের দর্শন আমার সারাটা দিনকে পথে বসিয়ে দিল
    উত্তর থেকে দক্ষিণে বাসে চরলাম,
    পূর্ব থেকে পশ্চিমে রিকসায় চরলাম, হাওয়ার উড়িয়ে দিলাম হাতপাখা
    মনে হচ্ছে আমার দেহের ভিতরে এই গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়া ঢুকে পড়েছে।
    দোকানের ছোট ছোট জেনারেটরগুলি আমার ভিতরে চলতে শুরু করেছে
    ঢাকা থেকে আমি চলে গেছি সিচুয়ানের ভূমিকম্পে
    ছোট ছোট শহরগুলি দেবে যাচ্ছে

    সকাল না হতেই
    ..........
    সকাল না হতেই, জ্যৈষ্ঠ মাসের পাখিরা ডাকছে ‘থ্যাঙ্কিয়্যু’
    ঢাকার পাখিরা শিখলো করে ইংরেজী
    পাখিগুলি সব ভদ্রপাখি
    যদিও কাকেরা ডাকছে হায় হায়
    যেনবা ওরা খবর পেয়েছে
    মিয়ানমারে চিনে মানুষের খুব দিন অসহায় সাইক্লোন আর ভূমিকম্প

    তুমি কি বিশ্বাস করো, পাখিরা মানুষের মনের কথা বোঝে?
    নইলে কেনো সে বলছে থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ,
    তোমাকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাকে
    আমাকে তুমি দিয়েছো যে তোমার অমূল্য মন
    যার তুলনা নই এ পৃথিবীতে
    দেখো কিযে শিউরে উঠছে আমার ত্বক
    শুধু ভাবতেই তোমার প্রসঙ্গ এই বেলা।
    আজকাল প্রায়ই প্রত্যুষে

    আজকাল প্রায়ই প্রত্যুষে উঠে বসে থাকিদ
    দেখতে দেখতে রাস্তা ও গাছ ভেসে ওঠে অন্ধকার থেকে
    আকাশে লুকায় প্রতিপদের চাঁদ লজ্জার
    ছেলেটি যেনবা বাড়ি ফেরে নাই রাতে
    পথে পথে আর এখানে সেখানে দেরী করে
    সূর্য ওঠার আগেই ফিরছে আজ ঘরে

    বলতো এসব দেখে কি মনে পড়ে যায়?
    কৃষ্ণ ফিরছে সারারাত পরে রাধার আঙ্গিনায়
    কলংকিত চাঁদ সে কারণ শত সখীর ব্যস্ত বিবিএ
    আমি বলি, খেলে আমার মাথাটি চিবিয়ে
    সারা দুপুর আর বিকাল সন্ধ্যা
    ক্লান্ত আমাকে দেখাচ্ছে খুব অফিস ফেরতা
    আসলে কি হয়েছে তোমার সঙ্গে সে কথা কাউকে বলা কি যায়?
    খুবতো হাসছো মন খুলে
    এদিকে আমাকে বাসায় ঢুকতে হচ্ছে মুখ শুকনো করে।

    পাশাপাশি অনেকগুলি দালান
    ...............
    পাশাপাশি অনেকগুলি দালানের মধ্যে
    দাঁড়িয়ে আছে একটা মাত্র গাজর রঙের দালান
    আমি দেখতে থাকি তাকেই
    মাঠ ভর্তি কোলাহল, যেন তুমি খেলছো ছোটবেলাকার ছেলেমেয়েদের মিশ্র ফুটবল
    সূক্‌ষ্‌ঞ কলাকৌশল যার ছিল না
    সূর্যাস্তের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকায়
    দালানগুলির ওপর শেষ আলোকচ্ছটা ঠিকরে পড়ার শব্দ বেশ টের পাচ্ছি

    এই বিকালটা যেন একটা ক্ষুধার্ত কাছিম
    জবা ফুলগুলি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে
    তার পাশে বসে, তোমার নাম মিশেল,
    তুমি পূরানো ও নতুন দিনকে চঞ্চল স্রোতে বেঁধে দিচ্ছ

    একটা ছাতার মত আকাশের নিচে
    একটা কাপের মত আলো অন্ধকারে
    পাষানের সাথে ঝর্নাকলমের বিয়ে হচ্ছে

    তোমার ক্রিকেট পিচে
    .............
    তোমাকে স্পর্শ করে বাতাস ও বইতে পারে না
    তোমার কাছে এসে পুলিসের বাঁশি থেমে যায়
    সেই প্রায় আয়তাকার মাঠটি থেকে সবার চোখ এসে
    তোমার ক্রিকেট পিচে একবার করে বল করে যাচ্ছে

    তোমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে পুরানো পাখিরা
    তোমাকে দেখে যাচ্ছে কার্নিশের ছায়া
    তোমাকে স্পর্শ করে করে গেল অনেক গাছের ভিড়ে
    দেয়াল ঘেঁষা একটা ছোট্টো চারা

    তোমাকে ঘুরে গেল একটা বদমাশ মাছি
    কার যেন রেকর্ড করা এস্রাজের সুর
    তোমার বাহুর সোনালী হলদে ত্বকের নিচ থেকে এমন
    মরমী শিরাগুলি ছুঁয়ে গেল আমার জন্মদিন
    যেন পৃথিবীতে কোন কালে ক্ষুধা তৃষ্ণা ক্ষমতার কোন সমস্যা ছিল না
    আমরা শুধু চুপচাপ বসে ছিলাম।

    কেমন ভেজে রেখেছে ফুলগুলি
    .................
    কেমন ভেজে রেখেছে ফুলগুলি, কেমন সাজানো টবে গাছ
    বাটি ভর্তি পদ্মার ইলিশ, থোকা থোকা অন্ধকার, স্বচ্ছ পানির দেশি সরপুটি
    সবাই খাচ্ছে সবাইকে, কেউ বন্ধুর চাঁদামাছ
    সহপাঠির উষ্ণ ভাজা
    সম্পর্কের আম জাম, নতুন পরিচয়ের তালশাস
    গল্পের রসালো লিচু থেকে খোসা ছাড়িয়ে
    অনেকেই টুকটাক আলাপ করছিল

    কিন্তু তোমাকে আমার খেতেই ইচ্ছা করল না
    মনে হলো একদিনে না খেয়ে
    বহুদিন একটু একটু করে দেখেই থাকিনা!
  • kallol | 220.226.209.2 | ০৮ জুলাই ২০১১ ১০:৩৩477597
  • অনেক পুরানো কিন্তু এখনো ভুলতে পারিনা।
    আল মাহমুদের কবিতা।

    নতুন অব্দে।
    ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ভাতের গন্ধ
    চোখ খুলতেই চারিদিকে দেখি দুয়ার বন্ধ
    দুয়ার খোলার সাহসে যখন শরীর শক্ত
    হঠাৎ তখনই মহতেরা বলে লোকটা অন্ধ
    বুকের অতলে লাফায় নীরবে আহত রক্ত
    #
    দুচোখে আমার ধানের স্বপ্ন
    এই নগণ্য দাবী তুলতেই কারা বলে ওঠে
    বন্য বন্য
    ধান তুলবার অস্ত্র নিলাম বিপুল শব্দে
    হঠাৎ তখনই মণীষীরা বলে এও জঘন্য
    তবু তো সূর্য উঠে আসে দেখি নতুন অব্দে
    #
    স্বপ্নে আমার ডকে গেছে কোন সুখের পক্ষী
    ঘুম ভেঙ্গে আমি ছুটে চলি তার কূজন লক্ষি
    কতদূর গেলে পাওয়া যাবে সেই নীল বিহঙ্গ
    আমি দিনমান হতে চাই তার শরীর রক্ষী
    তারে নিরালায় পেতে দিতে চাই আমার অঙ্গ

    সোনার নোলক।
    আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
    হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে
    নদীর কাছে গিয়েছিলেম - আছে তোমার কাছে
    হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে
    বললে কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
    সাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে
    জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
    সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
    বনের কাছে এই মিনতি ফিরিয়ে দেবে ভাই
    আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরে ফিরতে চাই
    কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
    আমরা য সব পাখ পাখালি বনের সাধারণ
    সবুজ চুলে ফুল পিন্ধেছি নোলোক পরি না তো
    ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও হাত পাতো হাত পাতো
    বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
    হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে আছে মুখ
    এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন ফের বাড়ালাম পা
    আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরে ফিরবো না
  • kallol | 220.226.209.2 | ০৮ জুলাই ২০১১ ১০:৪০477598
  • এটাও আল মাহমুদ। নাম ভুলে গেছি।

    তোমায় নিয়ে আপন মনে খেলা
    কখনো তো খেলিনি ভালোবাসা
    লক্ষ্যহারা রাজার মতো শেষ
    ধরেছিলেম জীবনপণ পাশা
    রক্ত দিতে চেয়েছিলেম বলে
    মোহিনী তো এমনই ছল যে
    সোনার থালে চাইলি টুকটুকে
    টুকরো করা আমার কলজে
    যখন আমি আর্তনাদ করি
    তুমি হেসে বলে যে গান ধরো
    যেই না আমি সঙ্গীতে দেই মন
    চেঁচিয়ে বলো আর্তনাদ করো
    কবে তোমার গোপন করতালি
    বাজিয়েছিলে কুটিল করপুটে
    আজও আমার স্বপ্নে অবসরে
    শব্দে তার তৃষ্ণা ফুটে ওঠে
    এখন কি আর বাকি আছে বলো\
    শূণ্য হাত বুকের কাছে খোলা
    কঠিন শ্রমে জীবন ঘষে ঘষে
    নগ্ন নিজ মূর্তি গড়ে তোলা
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৮ জুলাই ২০১১ ২০:০৩477599
  • আল মাহমুদ ভাল কবি। ষাট-সত্তরের দশকে তার লেখা কবিতাগুলি অসাধারণ। তাকে কেউ কেউ বলেন, জসিমউদ্দিনের আধুনিক সংস্করণ। তখন তাঁর বিশ্বাস ছিল বামপন্থায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে তিনি রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে উল্টি দেন। পুরো ডানপন্থা, সামরিকতন্ত্রের কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা নেন। এবং জামায়াতে ইসলামীর হয়ে দীর্ঘদিন থেকে এখন কাজ করছেন। ফলে তাঁর কবিতার সুরটাও পাল্টে গেছে। এখান থেকে বোঝা যায়--একজন কবির বিশ্বাস যখন টলে যায় তার কবিতাও টলে যায়।
    আমি নিজেও আল মাহমুদের কবিতার অনুরাগী।
    আমাদের দেশের কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আল মাহমুদের বেশ টক্কর ছিল। এক সময় দুজনে গভীর বন্ধুও ছিলেন। তবে সে বন্ধুত্ব আদর্শগত কারণে টেকেনি। শামসুর রাহমানকে মৌলবাদিরা হত্যা করতে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়েছিল। আর আল মাহমুদকে মৌলবাদিরা পদকদানে ভুষিত করেছে।
    তাদের সমকালে বাংলাদেশে আরও বেশ কয়েকজন ভাল কবি আছেন। যেমন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তাঁর কবিতা বহুকণ্ঠে ধ্বনিত হাওয়ার মত। শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক উল্লেখযোগ্য কবি। আমরা পরে তঁদের কবিতা পড়ব এখানে।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ০৯ জুলাই ২০১১ ২১:৫৬477600
  • কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর জন্ম ১৯৩৪ সালে বরিশালে। তাঁর পরিবারের সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বড় ভাই সাদেক খান এক সময়ের বামপন্থী বিপ্লবী। এখন ডানপন্থী। আরেকভাই রাশেদ খান মেনন একদা চিনাপন্থী--অধুনা আওয়ামীপন্থী। আরেকভাই এনায়েতুল্লাহ খান চিনাপন্থী এবং সামরিক সরকারপন্থী। বোন বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন। ভগ্নিপতি প্রখ্যাত রাজাকার এবং বিএনপির আমলে রাষ্ট্রপতি। এই পরিবারের কেউ না কেউ সকল সরকারের সঙ্গে আছেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহও সামরিক শাসক এরশাদের কৃষি মন্ত্রী ছিলেন। তাদের বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পীকার।

    আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবি হিসাবে সফল। ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময় নিহত শহীদদের নিয়ে তাঁর রচিত 'মাগো, ওরা বলে' কবিতা সবার মুখে মুখে ফেরে। এখনো। আরেকটি কবিতাও আমাদের আত্মার প্রতিধ্বনি। সেটা হল--আমি কিংবদন্তির কথা বলছি।

    আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা
    মাগো, ওরা বলে
    (একুশ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২)
    ------------------

    “কুমড়ো ফুলে ফুলে
    নুয়ে পড়েছে লতাটা,
    সজেন ডাঁটায়
    ভরে গেছে গাছটা,
    আর আমি
    ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
    খোকা, তুই কবে আসবি?
    কবে ছুটি?”
    চিঠিটা তার পকেটে ছিল
    ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।

    “মাগো ওরা বলে
    সবার কথা কেড়ে নেবে।
    তোমার কোলে শুয়ে
    গল্প শুনতে দেবে না।
    বলো, মা
    তাই কি হয়?
    তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
    তোমার জন্যে
    কথার ঝুড়ি নিয়ে
    তবেই না বাড়ী ফিরবো।
    লক্ষ্মী মা,
    রাগ করো না,
    মাত্রতো আর কটা দিন।”

    “পাগল ছেলে”,
    মা পড়ে আর হাসে,
    “তোর ওপরে রাগ করতে পারি!”
    নারকেলের চিড়ে কোটে,
    উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,
    এটা-সেটা
    আরো কতো কি!
    তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে
    ক্লান্ত খোকা।

    কুমড়ো ফুল
    শুকিয়ে গেছে,
    ঝরে পড়েছে ডাঁটা,
    পুঁই লতাটা নেতানো
    “খোকা এলি?”
    ঝাপ্সা চোখে মা তাকায়
    উঠানে উঠানে
    যেখানে খোকার শব
    শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।

    এখন
    মার চোখে চৈত্রের রোদ
    পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।
    তারপর
    দাওয়ায় বসে
    মা আবার ধান ভানে,
    বিন্নি ধানের খই ভাজে,
    খোকা তার
    কখন আসে কখন আসে!

    এখন
    মার চোখে শিশির-ভোর
    স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।

    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি | আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
    ----------------------------------

    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
    তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
    তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
    অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
    পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
    তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

    জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
    কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
    আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
    স্বপ্নের কথা বলছি।
    উনুনের আগুনে আলোকিত
    একটি উঙ্কÄল জানালার কথা বলছি।
    আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
    তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
    যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে নদীতে ভাসতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
    গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
    আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
    ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
    যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
    মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
    আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
    আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
    আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
    তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
    কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
    আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
    আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
    তিনি মৃত্তিকার গভীরে
    কর্ষণের কথা বলতেন
    অবগাহিত ক্ষেত্রে
    পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
    সবত্‌সা গাভীর মত
    দুগ্‌ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
    তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
    যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
    কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
    যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
    আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
    তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
    যূথবদ্ধ হলাম।
    বর্ষণের স্নিগ্‌ধ প্রলেপে
    মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
    বারিসিক্ত ভূমিতে
    পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
    সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
    শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
    এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
    আনি:শ্বাস গ্রহণ করলাম।
    তখন বিষসর্প প্রভুগণ
    অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
    এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
    রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
    তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
    কবিতাকে ধারণ করলাম।
    দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
    রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
    সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
    তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
    যখন কবিকে হত্যা করা হল
    তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
    সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
    প্রঙ্কÄলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
    ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
    ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
    এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
    কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
    তখন আমরা দু:খকে ক্রোধ
    এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
    নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
    সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
    অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্‌সারণ কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    নি:সঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
    আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
    আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
    অভ্যূত্থানের কথা বলছি
    উতি্‌ক্‌ষপ্ত নক্ষত্রের মত
    কমলের চোখের কথা বলছি
    প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
    সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
    আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
    আমি বহ্নমান মৃত্যু
    এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
    যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
    তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
    ঋজু এবং সংহত হলাম।
    পর্বত শৃংগের মত
    মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
    দিকচক্রবালের মত
    দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
    এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
    সমূলে উত্‌পাটিত করলাম।
    তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
    উঙ্কÄল এবং প্রশান্ত হলাম।
    উতি্‌ক্‌ষপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
    স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
    আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    আমি শ্রমজীবী মানুষের
    উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
    আদিবাস অরণ্যের
    অনার্য সংহতির কথা বলছি
    শৃংখলিত বৃক্ষের
    উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
    আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
    শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
    আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
    যে কবিতা শুনতে জানে না
    সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
    যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
    তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
    নি:সঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
    ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
    এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
    ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
    যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
    তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
    নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
    দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
    এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
    বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
    তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
    স্মরণ করলাম।
    প্রপিতামহের বীর গাঁথা
    স্মরণ করলাম।
    আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
    স্মরণ করলাম।
    তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
    এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
    আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
    সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
    শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
    ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
    আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
    স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
    ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
    যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
    যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
    যে উদ্‌গত অংকুরের মত আনন্দিত
    সে কবি
    যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
    সে কবি
    যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
    তখন প্রত্যেকে কবি।
    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    আমি বিচলিত বর্তমান
    এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
    খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
    আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
    হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
    পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
    এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
    শস্যের পরিচর্যা করছি।
    আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
    কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
    মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
    আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
    কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
    কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
    আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
    কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
    আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
    আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
    আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
    আমার সন্তানেরা
    আমি তোমাদের বলছি।
    যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
    সূর্যের মত সত্য হবে
    সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
    সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
    আমি বিষসর্প প্রভুদের
    চির প্রণের কথা বলছি
    দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
    পরিসমাপ্তির কথা বলছি
    সুতীব্র ঘৃণার
    চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
    আমি সুপুরুষ ভালবাসার
    সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
    যে কর্ষণ করে
    শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
    যে মত্‌স্‌য় লালন করে
    প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
    যে গাভীর পরিচর্যা করে
    জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
    যে লৌহখন্ডকে প্রঙ্কÄলিত করে
    ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
    দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
    আমি তোমাদের বলছি।
    আমি আমার মায়ের কথা বলছি
    বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
    ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
    আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
    আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
    সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
    সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
    জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
    রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
    আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
    আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।
  • MUhit | 180.149.7.190 | ১৪ জুলাই ২০১১ ১২:৫১477601
  • আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর কবিতা

    কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড

    এখানে কবিতা বানানো হয়।
    সব ধরনের কবিতা।
    রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
    নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
    প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
    স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
    চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
    ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
    আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
    কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
    শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
    চোখ, মুখ, নাক, কান,
    হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল--
    সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
    স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
    শব্দ ও ছন্দ,
    অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
    লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
    ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
    গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
    আপনি তো জানেনই,
    আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
    আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
    বলুন?
    হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
    চম্‌ৎকার হয়েছে।
    ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
    একটু বসুন স্যার, চা খান,
    কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
    পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
    এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।
    ___________________

    গ্রিনরোড

    একদিন কুলিরোড ছিলে।
    হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
    অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
    যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
    বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলো মটরশুঁটির খেতে।
    লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
    দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
    কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে

    আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
    ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
    নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
    তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
    ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল--
    অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম

    ___________________________________________

    তেস্রা জুলাই

    উত্তাল আবেগে অঝোরে কবিতা লিখে যাচ্ছিলাম।
    আর ঐসব খসড়া কবিতাই পড়ে শোনাচ্ছিলাম তোমাকে।
    অনেক কবিতাই শুনে স্তব্ধ হয়ে যেতে তুমি।
    কথা বলতে পারতে না।
    আমি জোর করে দু-একটা মন্তব্য শুনতাম তোমার কাছ থেকে।
    আমাদের কথা চলছিল
    সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে_সব সময়।
    মুখোমুখি আর টেলিফোনে আর সেলফোনে।
    কোথায়-কোথায়-না আমরা মিলেছি পরস্পর।
    একটিই লক্ষ্য ছিল : লোকচক্ষুর অগোচর হয় যাতে
    আমাদের কথা কেউ শোনেনি।
    দেখেছে-পড়েছে আমার কবিতা।
    তুমি-আমিই জেনেছি
    কথা আর কবিতা দুটি আলাদা জিনিস।
    যে-সব কথা তুমি আমাকে বলেছ,
    আমি বলেছি তোমাকে_
    তা আমি কাউকে জানাতে পারি না।
    লিখতেও পারি না।
    চিরকালের মতো সে-সব কথা
    তোমার-আমার ভেতরে বন্দি হয়ে থাকবে।
    লোকে দেখবে-পড়বে শুধু আমার কবিতা।
    কবিতা যে কথার ভেতরের কথা ধরতে পারে না,
    সে শুধু জানি তুমি আর আমি।

    তারপর এল তোমার-আমার মধ্যে সাগরপাড়ের ব্যাধি।
    আমাদের কথা শেষ।
    কবিতাও লিখি না আমি আর।
    কথার সঙ্গে কবিতার কি তাহলে একটা সাঁকো আছে ভেতরে?
    কী জানি।
    তোমার সঙ্গে দেখাও হয় না আর।
    কথাও হয় না।
    আমার সব উত্তালতা এখন স্থির হয়ে গেছে।
    যেন কোনো জাদুমন্ত্রবলে।
    খাবার সময় খাই।
    শোবার সময় শুয়ে পড়ি।
    ডাক্তার সাহেব সব নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন।
    বারান্দায় বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
    গাছের কাছে গিয়ে বসে থাকি চুপচাপ।
    আমার অতিপ্রিয় রঙ-চাও খাই না আর।

    তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে
    তেস্রা জুলাইয়ে।
    পরস্পরকে আমরা দেখলাম কি না জানি না।
    আমরা বসে থাকলাম দুটি আলাদা সোফায়।
    যে আমরা দেখা হলে হতাশ কলকণ্ঠ_
    ফুটে উঠত তোমার মুখে জ্যোতি_
    আমি যেন টগবগ করে ফুটতাম
    কেশর-তোলা একটা ঘোড়ার মতো_
    সেই আমাদের ভেতরে এখন স্তব্ধতা।
    তোমাকে বলব বলে কত কিছু ভেবে এসেছিলাম_
    কিছুই মনে পড়ছিল না।
    কিছুই বলতে পারলাম না।
    তুমিও না।
    এক ঘণ্টা শুধু আমরা নিস্তব্ধ বসে থাকলাম মুখোমুখি।
    আমার সামনে খাবার পড়ে থাকল।
    রঙ-চা নিথর হয়ে গেল।
    রাত্রি থেমে থাকল যেন বাইরে।
    ঘণ্টা-মিনিটও নিশ্চল।
    সময় হলে তুমি দরোজা খুলে দিলে।
    আমি হাত তুললাম।
    তুমি হাত তুললে।
    আজ সকালবেলা একটা কথা জাগছে মনে।
    একসময় আমরা শব্দ দিয়ে অনেক বাক্য তৈরি করেছি,
    কবিতা লিখেছি আমি সেও শব্দ দিয়ে।
    তেস্রা জুলাইয়ে নৈ:শব্দ্য কথা বলেছিল,
    কবিতা লিখেছিল।
    ___________________________________________

    পাঁচটি উঙ্কÄল মাছ

    পাঁচটি উঙ্কÄল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
    এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
    পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়--
    আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উঙ্কÄল মাছ
    ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
    পাঁচটি উঙ্কÄল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
    এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে

    ___________________________________________

    আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়

    ‘একি, আপনি বাজারে? কবিশাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?’
    --হ্যাঁ, আমাকেও বাজার করতে হয়,
    আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিশেব কষতে হয়--
    আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।
    কবিতাকেও হতে হয় পৌরুষেয়--
    শুধু নারীলাবণিগ্রস্ত নয়।
    বসন্তের সংঘর্ষে জ্বলে উঠতে হয় আগুনের মতো।
    জীবনানন্দকেও একদিন খালি গায়ে দুই হাতে দুই ভরা পানির বালতি
    বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন
    অনুজ কবি আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়

    __________________________________________
  • Atri Bhattacharya | 203.110.246.230 | ২৪ মার্চ ২০১২ ২২:৩১477602
  • আমার সংগ্রহে আল মাহমুদের কিছু কবিতা আছে। বাহারউদ্দীন সম্পাদিত "আরম্ভ" পত্রিকায় প্রকাশিত। দু'-একটি দিচ্ছি।

    খরা সনেটগুচ্ছ
    আল মাহমুদ
    --------
    নদীর মরন দেখে তোমাকেই জীবনের জল হতে বলি
    বসন উদ্ভিত হোক, অলঙ্কার শৈবাল যেমন
    একভাগ মাংসমেদ তিনভাগ রক্তের অঞ্জলী,
    এরই মাঝে স্নাপান প্রক্ষালন, বাঁচার বেদন।
    তোমাকেই পান করি। অজুর রক্ষিত জলাধার
    সে পানি ছিটৈ বুকে, সরোবর ধরেছি গন্ডুষে
    ক্ষরার মধ্যাহ্নে তুমি ঘুর্ণিতোলা মেঘের ভান্ডার
    ঝর, ঝর- প্রার্থনায় তোমাকেই নিতে চাই শুষে।
    ইচ্ছার মৃত্যুর মত প্রে আছে জরাজীর্ণ যমুনার নাম
    তোমাকে কি বলে ডাকি, করতোয়া? সস্তা লাগে বড়,
    মাছের কঙ্কাল দেখে ও ললাটে জমেছে কি ঘাম?
    নির্মেঘ বোশেখে তবে একবিন্দু বৃষ্টি হয়ে ঝরো।
    ভোঁদড়ের মরা চোখ যেন এই গোধূলীর বেলা,
    আমাদেরও কেহ্লা শেষ, অন্য কার বসে গেছে মেলা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন