এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাংলাদেশের গল্পকার-উপন্যাসিক হা&

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ২৫ মে ২০১১ | ১১৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২৫ মে ২০১১ ০৬:৫৩474543
  • সাপ্তাহিক : আমাদের শিল্প-সাহিত্য এখন অনেকটা ঢাকা শহর কেন্দ্রিক। যারা প্রান্তে থেকে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছেন তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন যে-- প্রান্তে থেকে বুঝি কিছুই হয় না, কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হয় না। তাই সবাই কেন্দ্রের দিকে ছোটে। আবার কেন্দ্রে যারা আছেন তারাও ভাবেন, প্রান্তে যারা আছেন তাদের বুঝি কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা তো ব্যতিক্রম। আমরা অনেককেই দেখি, যাঁরা প্রান্তে থেকেও কেন্দ্রের চাইতে অনেক ভালো করেছেন। সামগ্রিক ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কী মতামত?

    হাসান আজিজুল হক : এই মনোভাব আসলে এক ধরনের গ্রাম্যতা। মফস্বলে যারা আছে তারা মফস্বলে আছে বলেই তাদের কোনোরকম এক্সপোজার নেই আর রাজধানীতে আছে বলে এদের এক্সপোজার আছে-- মূল ব্যাপারটাই গ্রাম্যতা। গোটা দেশের লোকের মনের মধ্যে এ ধরনের একটা ব্যাপার আছে যে, যা কিছু করতে হবে সব ঢাকাতেই করতে হবে। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, যারা বলেন, জীবনের সবকিছু ছেড়ে দেব, কিন্তু ঢাকা কোনোদিন ছাড়ব না। আমার কাছে মূলত মনে হয় এই মনোভাবটাই হচ্ছে গ্রাম্যতা। কোনো উন্নত জায়গায় তথা উন্নত দেশে এই মফস্বল ও রাজধানীর পার্থক্য হয় না। হয় না এই জন্যে, ওখানে যে সংস্কৃতি, যে সাহিত্য বা শিল্পটা তৈরি হয়- নানা স্তরে তার মালিকানা ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের এখানে তাই চলছে। আমাদের এখানে নানা সিঁড়ি আছে। এক এক সিঁড়িতে এক একজনের অবস্থান। আমাদের এখানে বড়লোকদের কোনো সিঁড়ি নেই, অর্থাৎ তাদের কোনো সংস্কৃতিও নেই; দরকারও হয় না, ধারও ধারে না তারা। বিশেষ করে এ কালে যারা খুব বড়লোক হয়েছে তাদের বড়লোক হওয়ার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমি মন্তব্য করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না। কারণ, এটা বাংলাদেশের সবার সামনে দিবালোকে ডাকাতির মতৈ পরিষ্কার। তাই এটা নিয়ে কিছু বলার নেই।
    তাহলে আমাদের বাকি যে সংস্কৃতিটা, যাকে মূলত একটু উচ্চবিত্ত শ্রেণী বলা যায়, স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত বলা যায় এবং টেনেটুনে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত বলা যায়। এটা হচ্ছে খাঁটি, নির্মম, বাস্তব সত্য কথা। আমরা যারা কাজ করছি, আমরা এই সীমাবদ্ধতা বুঝে চলি। আমরা যখন গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য আফসোস করি, আক্ষেপ করি, ফিরিয়ে আনতে চাই-- সেটাও কিন্তু মূলত একটা রোমান্টিক জায়গা থেকেই চাই। সেটা বিমূর্ত একটা জায়গা থেকে তা আমরা করি। যেটা বাস্তবে কখনৈ অনুভব করি না। তারপর যেটুকু চর্চা গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য কিংবা আমাদের চিরকালীন ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত-নাটক ইত্যাদি যেটুকু আমরা প্রকাশ করি, এটা কিন্তু বাস্তব মধ্যবিত্তের জায়গা থেকেই করি। মধ্যবিত্তেরই আফসোস এটা। এবং মধ্যবিত্তই এটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে; যে জিনিষটা কখনৈ কার্যকর হবে না। এ সমস্ত দোষ আমাদের সমাজে শেষ নেই। আমরা যা কিছু করি তা সবার নয়। হাসান আজিজুল হক যতই জনগণের জন্য লিখে থাকুন না কেন, জনগণ তার পাঠক নয়। আমার সমস্ত সম্মোধন শেষ পর্যন্ত গিয়ে আমার শ্রেণীর লোকের কাছেই আসে। এই নির্মম সত্যটা মেনে নিয়ে, এর সীমাবদ্ধতাটা স্বীকার করে নিয়ে আমি লেখক হয়েছি। আমি তবু মনে করি যে, এটা একেবারেই বৃথা যাবে না। নিশ্চয়ই যাবে না। কেননা সমাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে না। বিত্ত বাড়ছে। আর বহু লোক নিজেদের শ্রেণীকে পরিত্যাগ করে আসছে এবং যাবে। যেটাকে বলে যে, বালির মধ্যে যদি পানি ঢালো, তবে পানিটা পরিশ্রুত হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নিচে যায়। এরকম কোনো একটা পদ্ধতিতে জনগণের কাছ পর্যন্ত একটা জিনিষ পৌঁছুবে-- এই আশা যদি না করতাম, তাহলে হয়ত লেখক হতে পারতাম না। কাজেই তুমি ঢাকাকেন্দ্রিকতার প্রথম যে প্রশ্ন করলে, যে প্রশ্নের জবাব এক কথায় দিয়েছিলাম-- না। তার কারণ, পুরো অবস্থাটাকে আমি পরিত্যাগ করি।
    আমরা যখন সহানুভূতির মন দিয়ে ঐ গ্রামের মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য গ্রামে যাই, বক্তৃতা করি, তখন কিন্তু আসলে অহংবোধ কাজ করে। আমি যখন বলি, আমার গ্রামীণ সংস্কৃতির বা আমার বাংলাগানের কী বৈভব ছিল। তাই জারিগানের দলটাকে বরিশাল থেকে শহরে নিয়ে এসেছি, বা আমাদের সাঁওতালদের নাচটা কেমন ছিল তা দেখার জন্য নিয়ে এসেছি শহরে, এটা কিন্তু আসলে এক ধরনের প্রদর্শন। এটা কিন্তু তাদের জীবনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত নয়। গ্রামগুলো কিন্তু মরে গিয়েছে। সাঁওতাল গ্রামগুলো তো মৃতগ্রাম। আমি এক জায়গায় বলেছি, সেখানে শুয়োরেরও স্বাস্থ্য খারাপ! সেখানকার হাঁসের স্বাস্থ্য খারাপ, ছাগল এবং গরুগুলূ শীর্ণ। দারিদ্‌র্‌য তাদের বহু দূরে নিয়ে গেছে। সেখানে বিশ্বব্যাংকের হিসেব, সরকারের হিসেব, বুদ্ধিজীবীদের হিসেব কিছুই যে মেলে না- এ কথাগুলো কে বোঝাবে? ড. মুহাম্মদ ইউনুস যতই করুন না কেন, কিছুই হচ্ছে না, মাংস ওভাবে লাগে না। গায়ে মাংস লাগাতে গেলে পুষ্টিটা সমস্ত শরীরে যেতে হবে। নিজের সম্মন্ধে এই কথাটা বলা যায়। যদিও সেসব সমাজে এক ধরনের শোষণের রূপ আছে, শ্রেণী বিভাগ আছে। তুমি বলতে পার আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো দেশেও আছে। কিন্তু সেখানে- যেটা বলেছিলাম-- এক ধরনের প্ররিশ্রুত হয়ে তলা পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়ান এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বললাম, তোমরা এত করতে পার, তোমাদের প্রকাশনা থেকে বাংলায় কত রাশান গ্রন্থের অনুবাদ করছ। কিন্তু টলস্টয়ের অনুবাদ করাও না কেন, ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এর অনুবাদ হয় না কেন? করলে তো আমরা পড়তে পারতাম। আমরা তো সঠিক অনুবাদ করতেও পারি না। গৌরিশঙ্কর ভট্টাচার্য যে টলস্টয়ের অনুবাদ করেছিলেন সেটা প্রকৃত অনুবাদ নয়। তোমরা কেন করো না? উত্তরে সে বলল, বাংলা ভাষায় বের করা তো দূরের কথা, আমরা রাশানও করি না। তার কারণ, আমাদের দেশের লোক সেন্ট পার্সেন্ট শিক্ষিত। তারা টলস্টয় পড়ছে বা পড়ে ফেলেছে। এই সেন্ট পার্সেন্টের জন্য, তিনি বললেন, ধরুন আমাদের দেশে লোক সংখ্যা বাইশ কোটি আছে। তাহলে আমাদেরকে বাইশ কোটি বই ছাপতে হবে। এটা করলে আমাদের রাষ্ট্র চালানোর টাকা থাকবে না। কী অদ্ভুত কথা! কারণ, সেখানে ঐ পরিশ্রুতিটা হয়েছে। সেখানে মফস্বল ও শহরের প্রশ্ন ওঠে না। এমনকি যখন অনগ্রসর দেশ ছিল, তখনো পর্যন্ত মস্কো বলে একটা শ্রেণীর নাম করা হতো না, অজস্র শ্রেণীর নাম করা যেত। আজকে যদি তুমি ইংলিশ কালচারের কথা বল, সাহিত্যের কথা বল-- তবে কি তোমাকে লন্ডন শহরের কথা বলতে হবে? নাকি লন্ডন শহরে যা হয় ম্যানচেস্টারেও তাই হয়? সব জায়গাতেই তাই হয়? তাহলে তোমার প্রশ্ন ছিল এই যে, ঢাকা কেন্দ্রিক কেন? তাহলে আমি বলব যে, সত্যি সত্যি এখানে শিক্ষার বিস্তার হয়নি, এখানে সংস্কৃতির বিস্তার হয়নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের মধ্য দিয়ে সমাজের যে কাঠামোটা দরকার তা আমরা করিনি, তা আমরা ভাবিনি, তা আমরা করতে চাইনি এবং চাই না। এখন কেউ যদি মফস্বল ও রাজধানীর এই বিভাজনের কথা বলে, তখন আমি বলব-- এটাই গ্রাম্যতা। সত্যিকারের নাগরিকতা ঐসব দেশে, আমাদের এখানে এটাই গ্রাম্যতা।

    সাপ্তাহিক : আপনি রাজনীতি দ্বারা তাড়িত। জীবনভর এই দেশের রাজনীতির যে পরিবর্তন চেয়েছেন তার ফলাফল দেখে কি আপনি তৃপ্ত?

    হাসান আজিজুল হক : মোটেই না, একেবারেই না।

    সাপ্তাহিক : কেন তৃপ্ত নয়?
    হাসান আজিজুল হক : তৃপ্ত নয় এই কারণে যে, আমাদের রাজনীতি করার কারণটা কী ছিল? আমি যে রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে সচেতন হওয়া এবং যতটুকু পেরেছি সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছি-- তার কারণ তো একটা ছিল। কারণটা হচ্ছে, রাজনীতি ছাড়া কোনো মানুষ হয় না, নেই। জন্তু-জানোয়ার থাকতে পারে যাদের কোনো রাজনীতি নেই, কিন্তু রাজনীতি ছাড়া মানুষ হয় না। রাজনীতি করে তুমি যদি মনে কর দেশটাকে লুট করবে, দেশের জনগণের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, দেশটাকে শাসন করবে-- এবং সেই কারণে যত রকমের পন্থা আছে, সব পন্থাই তুমি অবলম্বন করবে। তাহলে সেই রাজনীতির জন্য তো আমি রাজনীতি করিনি। আমারও রাজনীতি করার একটা বিশেষ কারণ ছিল। আমি নিশ্চয়ই সব জিনিসটাকে ধাপে ধাপে ভাগ করে নেব যে, এ মুহূর্তে কি করব, এক বছরের জন্য কি করব, দশ বছরের জন্য কি করব ইত্যাদি। দশ বছরে তো অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে। পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি ছিল আমরা স্বায়ত্ত শাসন চাই, বিদেশি যে চুক্তিগুলো আছে তা থেকে মুক্তি চাই। তার মানে রাজনীতি করার পেছনে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। গোটা দেশ তখন আমাদের সমর্থন করেছিল। সেই সময়ে আমরা মনে করেছি, ভুল তঙ্কেÄর ভিত্তিতে আমাদের এই দেশ ভাগ হয়েছে। মানে দ্বিজাতিতঙ্কÄ। মুসলমানরা তো কোনো জাতি নয়, সম্প্রদায়। কি রকম ভুল তঙ্কÄ দেখো! ধরো, ইরানিয়ানরা কি মুসলমান নয়? তারা জাতিতে কি আরব না? আবার আরবরা কি জাতি নয়? তারা কি তুর্কি? আবার দেখ তারা কিন্তু মুসলমানও। তাহলে জাতি আর ধর্ম এক হবে কি করে? এটা গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল ভুল রাজনীতি করতে গিয়ে। কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘানিতে যেমন বলদকে ঘোরায়, বাংলাদেশের এবং ভারতবর্ষের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘোরানো হয়েছিল। তার ফল কি হলো তা তো তোমরা জানই। তা-ই যদি হতো, তাহলে মুসলমানের দেশে তো একটাও হিন্দু থাকা উচিত না, আর হিন্দুদের দেশে তো একটাও মুসলমান থাকা উচিত না। অথচ দেখ, এখনো বাংলাদেশে যত মুসলমান আছে প্রায় তত মুসলমান ইন্ডিয়াতে আছে। কিন্তু কেন? তার মানে ভুল রাজনীতি।
    অত:পর দেশ ভাগ হলো। তারপর আমরা যখন দেখলাম, এই দেশটা কোনো একটা স্বাধীন দেশের অংশ নয়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ আলাদা করা হয়েছে, অথচ দেশটা একভাবে শাসিত হচ্ছে না। তখন আমরা দেখলাম, মূলত আমাদের দেশ একটা উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তখন এটার বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়ালাম। ছাত্ররা ঘুরে দাঁড়াল। ওটা ছিল আমাদের তখনকার রাজনীতি। কিন্তু সেটার সঙ্গে এখনকার রাজনীতি তুলনা কর! সেই ছাত্র-রাজনীতির কথা মনে করে আজকের ছাত্র-রাজনীতি দেখলে লজ্জায়, ঘৃণায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়। কি করছ তোমরা ছাত্র রাজনীতির নামে, যুব সম্প্রদায় নামে! তাহলে আমি যদি বলি, এদের মধ্যে দেশ বলে কোনো ভাবনা নেই-- তাহলে কি আমার অন্যায় হবে? তোমাদের এই অবস্থায় আমি তোমাদেরকে তারুণ্য বলে স্বীকার করে নেব? শুধু রাজনীতি কেন, যারা সাহিত্য করছে তারা নিজেদের দেশের দিকে না তাকিয়ে বলছে যে, আমরা এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশেষ যে সমস্ত মতবাদ এসেছে তাকেই গ্রহণ করব। তাহলে তো এটা অপমান করা হয় আমাদের দেশকে! এই যদি মানসিকতা হয়, তাহলে আমি আবার বলছি, আমি এটাকে পরিত্যাগ করি।
    তাহলে বোঝ আমরা কেন রাজনীতি করেছিলাম। কিন্তু আমরা যা চেয়েছিলাম তা তো বাস্তবায়ন হলো না। আমাকে এখনো গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে হবে? সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে? জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে? তাহলে কি তোমরা দেশ স্বাধীন করে এসবকেই রিপ্লেস করতে চেয়েছিলে? তবে আমি কেন তৃপ্ত হব? তুমি বলবে, দেশ স্বাধীন করে আমরা কত উন্নত হয়েছি, এই ঢাকা শহরে কত জৌলুস, কত উন্নতি, কত কি! এখানে আন্তর্জাতিক মানের জিনিসপত্র পাওয়া যায়, পণ্য পাওয়া যায়। আহা কত দারুণ, কত চম্‌ৎকার! আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলতে হয়, যা কিছু ছিল তোমাদের তোমারা তা শেষ করে দিয়ে দাসত্বকে গ্রহণ করেছ। ইতিহাসের ক্ষেত্রে দাসত্ব, দর্শনের ক্ষেত্রে দাসত্ব, রাজনীতির ক্ষেত্রেও দাসত্ব। আমাদের যুবকরা হারিয়ে ফেলেছে কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়। কত তীব্র, তীক্ষè, অনি:শেষ প্রশ্ন ছিল তাদের। কিন্তু তা হারিয়ে ফেলেছে তারা। বিশ্বায়ন চলছে এখন, গ্লোবালাইজেশন! একবারও মনে করছ না, ভিক্ষুকের আবার গ্লোবালাইজেশন কিসের! যে মুক্ত বাজার চায়, কেন সে চায়-- সেটা তো দেখতে হবে। তুমি গ্লোবালাইজেশন দিয়ে কি করবে? তুমি তো স্রেফ ক্রেতা। তোমাকে স্রেফ ক্রেতা হিসেবেই ট্রিট করা হয়। তোমার তো বেচার কিছু নেই। তোমাকেই কিনতে হবে এক কোটি টাকা দামের গাড়ি। এই বিশ্বায়নের যত ছোট-খাটো সুযোগ-সুবিধা আছে তা তোমাকে গ্রহণ করতে হবে।
    কাজেই আমার মন থেকে তিক্ততা কেন দুর হবে? আমি কেন তৃপ্ত হব? এই করব বলেছিলাম, সেই করব বলেছিলাম, কিন্তু কিছুই করা হলো না। কাজেই আমাকে তৃপ্ত হওয়ার কথা বল না, তিক্ত হওয়ার কথা বল।
    সাপ্তাহিক : তাহলে দেশের রাজনীতি কাঙ্খিত লক্ষ্যে না পৌঁছার পেছনে আপনাদের মতো যাঁরা বুদ্ধিজীবী আছেন, তাঁদের ব্যর্থতাও ছিল?
    হাসান আজিজুল হক : আমি যা বলেছি, তাতে তো সবই স্পষ্ট। আমাকে কি নাম করে করে বলতে হবে? ব্যর্থতা যদি বল, তবে বুদ্ধিজীবীদের কথা বলবে না কেন, রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা নয় কেন? শিক্ষক সমাজের নয় কেন? শিল্পী-কবি-সহিত্যিকদের নয় কেন? আমি আমার দায়কে অস্বীকার করব কেন? এই ব্যর্থতা সবার।
    সাপ্তাহিক : আপনারা তো এক সময় সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হলো কেন?
    হাসান আজিজুল হক : ঐ একই কারণ। সমাজতন্ত্র তো মুখের কথা নয়, সমাজতন্ত্র করতে গেলে সমস্ত জনগণকে সংহত করে শক্তিটাকে তৈরি করতে হয়। গণতন্ত্র করতে গেলেও তাই করতে হবে, সমাজতন্ত্র দুরে থাক। কিন্তু জনগণের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে-- এটা শুধু কথার কথা নয়। শক্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে কিচ্ছু হবে না, শক্তি সংহত হয়ে একটা মুখে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। যেমন, হোমারের ‘ইলিয়াড’-এ দেখ, একিলিস যে বল্লমটা ছুঁড়েছিল তা এত ইফেক্টিভ কেন হয়েছিল? কারণ, তার শরীরের সমস্ত শক্তি বল্লমের ঠিক মুখটাতে এসে ঠেকেছিল। অতএব, জনগণের শক্তিকে সংহত করে ঠিক ঐভাবে মুখে আনতে হবে। নইলে সমাজতন্ত্র কেন, কিছুই হবে না। সেটা করতে গিয়ে কারা কারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের প্রত্যেকের নাম তুমি ইচ্ছে করলে লিখে দিতে পার। আমাকে নিশ্চয়ই বলতে হবে না! সেই ব্যর্থতার দায় আমারো।
    সাপ্তাহিক : আমাদের দেশে যারা যারা এখন নিজেদের মার্কসিস্ট বলে দাবি করেন, তাদের অধিকাংশই মার্কসকেও পুরোপুরি জানে না, অথচ মার্কসিস্ট। ধর্মকে পড়ে না, জানে না, অথচ ধর্মবিরোধী। এই না জেনে কোনো কিছুর আনুগত্য এবং বিরোধিতা-- ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
    হাসান আজিজুল হক : এই প্রশ্নের উত্তর তো আগেই বলে দিয়েছি আমি। উপরে যা কিছুই বলেছি তাতেই নিহিত আছে এর উত্তর। আমি তো বলেছি বর্তমান তরুণ সমাজের কথা, তাদের দুর্বলতম দিকগুলোর কথা। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বলতে পারি, যারা না জেনে কোনো কিছুর বিরোধিতা বা আনুগত্য করে তাদের মতো অকালকুষ্মা- আর নেই। তাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না।

    http://www.facebook.com/home.php?sk=group_175129282505026&view=doc&id=218761864808434
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন