এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • ও টগর, ও কুক্কুট

    Kulada Roy
    বইপত্তর | ২০ এপ্রিল ২০১১ | ১৭৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ০৭:৫৯471164
  • ও টগর, ও কুক্কুট :
    ---------------------------------------------------
    প্রথম পর্ব

    বরইগাছটার গায়ে সামান্য আগুনের তাপ লেগেছে। কয়েকটি ডাল শুকিয়ে গেছে। বাঁকলের একটি অংশ কালো। দূর থেকে বোঝা যায় না এই ডালে আগুনের আঁচ লেগেছিল। বরই ধরেছে প্রচুর। গোল গোল। দাঁতে কাটলে কচ করে শব্দ হয়। টক এবং মিষ্টি।

    বরইগাছটির নিচে একটি বাঁধানো চবুতরা। সবাই জামাকাপড় কাঁচে। মা কাঁচে না। এক বালতি জল এনে গাছটির গোড়ায় খুব ধীরে ধীরে ঢেলে দিল। পুড়ে যাওয়া বাকলে একটু তেল-সিদুঁর মেখে দিল। ঝির ঝির করে বরই পাতা কাঁপছে।

    পুকুরঘাটে দাদু ততক্ষণে মাথায় পাগড়ির মত করে গামছা বেঁধে ফেলেছে। দাদা পুকুরে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পাক থেকে তুলে আনছে কাঁসার থালা, ঘটি, বাটি। কমণ্ডলুটি খুঁজে পেতেই দাদু খুশি হয়ে হয়ে বলে উঠল, অ বৌমা, তোমার কোষাকুষি আইয়া পড়তেছে। আর বেপদ নাইক্যা।

    ঠিক তখনি ঠাম্মা দোতলার বারান্দায় একা একা ঘুরছে। কার্নিশে মৌচাক বসেছে। পোকাগুলো ভনভন করে উঠল। আর ঠাম্মা তারস্বরে ডেকে উঠল,কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কুউউউউ।অমা তখন ঘুরে ঘুরে নিমগাছের গোড়ায় জলদান করছে। বেলগাছটির গোড়ায় নিচু হয়ে প্রণাম ঠুকছে। নারিকেলগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কান্না লুকোচ্ছে। শিউলিগাছগুলোতে স্বর্ণলতা ঢলে পড়েছে। জবা পাতার উপর থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছে মাকড়সার জাল। লেবুগাছটি শুকনো হয়ে চেয়ে আছে। ছল ছল চোখ।

    হারুণ চাচা এলেন কাঁঠালকাঠের পিঁড়িটা হাতে করে। বেশ ভারী। পোড়া ঘরটির ভেতর থেকে এই অক্ষত পিঁড়িটি তিনি সোর করে রেখেছিলেন। হারুনকাকী লম্বা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে দুটো মুরগীর ছাও। দাদু গদগদ গলায় বললেন, বৌমা, তোমার লাইগা গড়িয়াহাটের কাপড় আনছি একখান। লোচনের মার কাছে আছে।
    ঠিক তখনি ঠাম্মা দোতলার বারান্দায় একা একা ঘুরছে। কার্নিশে মৌচাক বসেছে। পোকাগুলো ভনভন করে উঠল। আর ঠাম্মা তারস্বরে ডেকে উঠল, কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কুউউউউ।

    বাসকগাছের পাশে গন্ধভাদুল। মাটিতে ঝুঁকে পড়ে ঝোঁপালো হয়ে গেছে। একটি আমগাছ দীর্ঘ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডালপালা থেকে ঝুলে পদ্মগুলঞ্চের লতা। পাশে তেলি কদম। মাহবুব ভাইয়ের আম্মা বড়চাচী এক টিন মুড়ি নিয়ে এলেন। সঙ্গে রুম্মী কলা আর নলেন গুড়। মার হাত ধরে বলে উঠলেন, বিনা আইছ! বিনা আইছ!

    বছরখানেক পরে দেখা হচ্ছে। মা নিচু হয়ে প্রণাম করেছে বড়চাচীকে। মাহবুব সুপুরীগাছের উপরে কী একটা পাখি ডাকতে শুরু করেছে—হিট্টি হিট্টি হিট্টি। মাহবুব ভাই এখনো ফেরেনি। বড়চাচী আর মা কাঁদছে। মাহবুব ভাই বেশ লম্বা চওড়া মানুষ। এ বাড়ির পেয়ারাগাছ থেকে পড়ে ছেলেবেলায় তার বাঁ চোখের নিচে কেটে গিয়েছিল। সেই কাটা দাগটিকে মনে করে দুজন কাঁদছেন। তাঁর ফুরফুরে চুলের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। আর মাথার উপরে সেই পাখিটা হিট্টি হিট্টি করে ডাকছে। বড়চাচী কাঁদতে কাঁদতে কলমা তৈয়্যেবা বলছেন– লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। মা মাথায় কাপড় দিয়েছে। বড়চাচী কলেমা তৌয়্যেবা বলতে বলতে পুকুরপাড়ের দিকে তাকাচ্ছেন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দূরের বটতলাটির দিকে তাকাচ্ছেন। গোহাটার পথের দিকে তাকাচ্ছেন। এই পথ দিয়ে লোকজন যায়–এই পথ দিয়ে লোকজন ফিরে আসে। ছোট বোনদুটি মন্দিরের সামনে খোলা উঠোনে কাজলী ফড়িয়েংয়ের পেছনে ছুটতে লেগেছে। ফড়িংটা একটু উপরে ওঠে। আবার নীচু হয়। দুরে যায়। আবার কাছে আসে।
    দাদা পুকুরে নেমেছে। জলের ভিতর থেকে কী একটা ঘটি ছুড়ে মারল উপরে। ছিটকে পড়ল জলকাদা। ঘুরতে ঘুরতে ঘটিটা বরই গাছের ডালে আটকে গেল। নড়ে না- চড়ে না—পড়ে না। টপ টপ করে কাদা আর জল ঝরে ঝরে পড়ছে। দাদু নীচ থেকে ভাল করে দেখতে দেখতে বলে উঠল—দুগ্গা দুগ্গা। চোখ নাই। নাক নাই। কান নাই। হে হে করে বেরিয়ে আছে দাঁত। দুটো দাঁতে পোকা ধরা। আর আক্কেল দাঁত মরনকালেও ওঠে নি। করোটির কপালে একটি ছিদ্র। ছিদ্র পথে গল গল করে কাদাজল বেরিয়ে আসছে। দোতলার বারান্দা থেকে ঠাম্মা মন্দিরের সামনে নেমে এসেছে। দেওয়াল ঘেষে একটি টগরগাছ উঁকি দিচ্ছে। তাই দেখে ঠাম্মা চেঁচিয়ে উঠেছে—কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কু।

    এ সময় বাড়ির সামনে একটি রিক্সা থেমেছে। নামলেন কিরণ পিসেমশাই। তার মুখে লম্বা দাড়ি। পিসিমা কলকল করতে করতে বাড়ির উঠোনে পা রাখল। পিছনে বাচ্চুদা, বিশুদা,মানিক, ম্যাগা এবং মীরা। রাস্তা থেকে চুনু পিসি ডাকতে শুরু করেছে—মা, অ মা।
    দালানের দরোজা খুলে মেজ ঠাম্মা হাউ মাউ করতে বেরিয়ে এসেছে। বলে, তোরা আছিস। বাঁইচা আছিস।
    বাচ্চুদা গান ধরেছে দালানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে–পিঁয়া পিঁয়া ডাকে । বিশুদার এই গানটি পছন্দ নয়। বিশুদা হাঁক পেড়ে বলে , থাম দাদায়। মীরা ধর তো গান—
    –কোনডা ?
    –কোনডা আবার। বলেই বিশুদা হাত ঘুরিয়ে নেচে নেচে গেয়ে উঠল, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি। মীরা একটু চড়া গলায় গানটি ধরল। আর বিশুদা লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। বাচ্চুদা মাথায় একটি গামছা বেঁধে নিয়েছে।অতারপর একটু অপেক্ষা করে দীর্ঘ গলায় ধরল গান—

    হাওয়া মে উড়তা যায়ে
    মেরা লাল দোপাট্টা মল মল

    এইবার পাঁচ ভাইবোনে ঘুরে ঘুরে নাচে আর গান গায়। গাইতে গাইতে নাচে। আর নাচতে নাচতে গান গায়। দোতলার কার্নিশে একটি চাক থেকে মৌমাছিগুলো প্রথমে কেঁপে উঠেছে এবং ভো ভো করে উড়তে লেগেছে। তাই দেখে মেজ ঠাম্মা চেঁচিয়ে উঠেছে-তোরা ভিতরে আয়। ভিতরে আয়। মোমাছি চেইতা গেছে।

    ঠিক এ সময়ে দাদা পুকুরের জলের ভিতর থেকে কী একটা ঘটি মতো ছুড়ে মারল উপরে। ঘটি থেকে ছিটকে পড়ল কাদা। ঘুরতে ঘুরতে বরইগাছের ডালে আটকে গেল। গাছ থেকে ঘটিটা পড়ে না। ভেতর তেকে টপটপ করে কাদা আর জল ঝরে পড়ছে। দাদু নিচ থেকে ভাল করে দেখতে পেয়ে বলে উঠল, দুর্গা। দুর্গা। ওটা ঘটি নয়। মড়ার খুলি। চোখ নাই। কান নাই। হে হে করে দাঁত বেরিয়ে এসেছে। খুলির কপালে একটি ছোট ছিদ্র। গলগল করে জল কাদা ছিদ্র পথেও বেরিয়ে আসছে। দাদু পরে নামাবে ভেবে রাস্তার দিকে তাকাল। দোতলার বারান্দা থেকে ঠাম্মা মন্দিরের সামনে নেমে এসেছে। দেয়াল ঘেষে একটি টগরগাছ উঁকি দিচ্ছে। তাই দেখে জোরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, কুকরু কু। কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কু।

    একটা রিকশা থেমেছে বাড়ির সামনে। কিরণ পিসেমশাই হাসি হাসি মুখে নামছেন। মুখে লম্বা দাড়ি। পিছনে পিছনে কলকল করতে করতে পিসিমা। ছুট্টে আসছে বাচ্চুদা, বিশুদা, মানিক, ম্যাঘা এবং মীরা। রাস্তা থেকেই চুনু পিসি ডাকতে শুরু করেছে, অ মা। মা। অ মা, মা।
    দালানের দরোজা খুলে মেজ ঠাম্মা হাউমাউ করতে করতে বেরিয়ে এলো। বলল, তোরা আইছিস! তোরা আইছিসগো মা!

    মা ডাল চড়িয়ে দিয়েছে। বড় চাচী রায়েন্দা চাল দিয়ে গেছেন। হাড়িতে টগবগ করে ফুটছে। খবর পেয়ে বিমল কাকা এসেছেন। সিঁড়িতে বসে খুরে ধার দিতে দিতে অবাক হয়ে পিসে মশাইকে দেখছে। পিসিমশাইয়ের চোখে সুরমা টানা। গৌরবর্ণ গা। দক্ষিণাঞ্চলের রাজবেশ। দাদু উঠোনে খুরপি দিয়ে ভাদলা ঘাস বাছছে। আর পিসেমশাই গব গব করে বলছেন, বোজজেন কাকা, মেলিটারি আইবে শুইনা কলমা পইড়া ফেলাইলাম। আম্মুয়া থেইকা ধ্বলা হুজুর আইছেলেন। তিনি কইলেন, আপনের নামডা কি রাখবেন রায়মুশাই? শাহজাহান।
    পিসেমশাই গলাটা বিমলকাকার ঝকঝকে খুরের নিচে পেতে দিয়েছেন। বলছেন, আপনেগো মাইয়ার নাম—মমতাজ। তাজ মুহলের মমতাজ মহল। ফটাফট দাড়ি রাইখা ফেলাইছি। মসজিদে থাহি। আর আল্লা আল্লা করি। আপনের বড় নাতির নাম দারোশিকো। মাইজাটা—আলমগীর। সুজা আর মুরাদও আছে।

    বিমলকাকা পিসেমশাইয়ের কানটা চেপে ধরেছেন। হালকা ভারে একটু একটু করে বাঁগালের দাড়ি কামিয়ে দিলেন। আর বার বার খুরে ধার দিতে লাগলেন। নয় মাসের পুরনো দাড়ি। ফেলতে সময় লাগছে। পিসেমশাই মীরাকে ডেকে বললেন, অ মা মীরা, তর নামডা য্যান কি?
    –জাহানারা।

    দাদু ঘাস বাছতে বাছতে থেমে গেল। ডিএল রায়ের শাহজাহান নাটকের কথা মনে পড়ে গেছে। শাহজাহানের পার্টটা বলতে পারলে তার বেশ ভাল লাগত। মীরা ঘরের মধ্যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেছে—নূরজাহান, নূর জাহান/ সিন্ধু নদীতে ভেসে এলে মেঘনা নদীরও পাড়ে। বড় মিষ্টি সুর। মেঘনা নদীর পাড়ে এলে ইরানী গুলিস্তান। চুনুপিসি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা তসবী বের করে বাগানে ছুড়ে ফেলল। লম্বা করে একটা শ্বাস ফেলল। তার ফ্যার কাটতে শুরু করেছে। মা ডালে ফোঁড়ন দিয়েছে। ফোঁড়নের বাস ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। মীরা গাইছে—নার্গিস লালা গোলাপো আঙুর লতা, শিরী ফরহাদ সিরাজের উপকথা…

    বিমলকাকা ফস করে জিজ্ঞস করলেন, অ জামাইবাবু, দ্যাশতো স্বাদিন হৈল—অখন কী বোঝেন?
    –খুব ভালা বুজি। য্যাগো ভিটা নাই হ্যারা ভিটা পাইবে।
    –কী কন?
    –তাইলে যুদ্ধ হইল ক্যান!
    –য্যাগো ভিটা আছে হ্যাগো?
    –হ্যাগো আর ভিটা ছাড়া হওন লাগবে না।
    –হ্যাচানি?

    উত্তেজনায় বিমলকাকা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তার চোখে জল এসে পড়ছে। চিকটিগাছের সরু ডালে একটি কাকলাস সুড় সুড় করে এগিয়ে এসে জিহ্বা বের করছে। পিসিমশাই হাত-আয়নায় মুখ দেখছেন। মুখটি ফকফকা। বহুদিন পরে তার নতুন আনন্দ হচ্ছে। নিজেকে ফেরেস হিন্দু হিন্দু লাগছে। বিমলকাকাকে টেনে বসালেন। বললেন, হোনো মুশাই,বিশ্বাসে মিলায় বস্তু—তর্কে বউ দূর। বোজলা–সব হাচা। হাচা। হাচা। শ্যাখ মুজিবে কইছেন। হ্যার মাথার উপ্রে লোক আছে। চিন্তা নাই।

    বিমলকাকা খুর দিয়ে থুতনির অবশিষ্ট দাড়িটা পোঁচ মেরে নামিয়ে দিলেন। এইবার জল দিয়ে মুখ মুছে দেবেন। ভাল করে ফিটকিরি ঘসে দেবেন। খুরের সাবান আর কাটা দাড়ি কাঠিতে মুছতে মুছতে টের পেল তার শরীরে কম্প হচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, বারবার ভিটা ছাড়তে পরান চায় না। এক জনমে কয়বার দ্যাশ ছাড়া যায় জামাইবাবু?

    জামাইবাবু হা হা করে হেসে উঠছেন। হাসতে হাসতে তিনি চুলে একবার টেরিও কাটলেন। চুনুপিসি দৌঁড়ে এলেন। বললেন, কী হৈছে তুমার?
    –পিসেমশাই হাসতে হাসতে কি বলবেন মনে করতে পারলেন না। হাসতেই থাকলেন। হাসতে হাসতে কড়া এক বিষম খেলেন। পিসি বিমলকাকার ছোট্ট বাটি থেকে সাবানজল পিসেমশার মাথার থালুতে ঢেলে দিলেন। বললেন, দুর্গা। গুর্গা। দুর্গা।
    ঠাম্মা মুরগীর বাচ্চা দুটোকে দানাপানি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কু।

    সেদিন রাতে চাঁদ ওঠেনি। ঘোর অমাবশ্যা। মন্দির শূন্য। কালীমা নেই। পিসেমশাই গভীর রজনীতে মন্দিরের সামনে একজোড়া পাঁঠা বলি দিলেন। ফিনকি দিয়ে উঠল রক্ত। বহুদিন পরে কপালে গরম রক্তের ফোঁটা লাগিয়ে আকাশ বাতাস মথিত করে ধ্বনি দিলেন, জয় মা কালী। জয় মা কালী।

    সেবারে পিসেমশাই বেশ কিছুদিন থেকে গেলেন। কয়েকজন বোবা লোকদের ধরে আনলেন। ওরা খায় দায়। রগড় করে। দালানের সিঁড়িতে বসে ধোঁয়া গেলে। মাঝে মাঝে দোতলার বারান্দায় উঠে আসে। আ আ করে শব্দ করে। মা লম্বা ঘোমটা দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। বোবা লোকগুলো ঘরে ঢুকে কলসী থেকে জল ঢেলে খায়।

    একদিন ডেলাইট জ্বালিয়ে উঠোনে মাইফেল হয়ে গেল। রাজকাপুরকা রাত। শহরের রাজ্জাক মুন্সী মুখের সামনে হাত তুলে গান ধরল, জিনা এহা মরনা এহা, ইসকা শিবা জানা কাহা…। পিসে মশাইয়ের গোপ রাজ কাপুর ছাট। তিনি হেলে দুলে নেচে গেয়ে উঠলেন, জি চাহে জব হামকো আওয়াজ দো/ হাম ওহি—ওহি হাম থে জাঁহা…। অনেক লোকজন এলো। দাদু শুধু বটতলায় কাটিয়ে দিল। বড় দুটো বোন দোতলার ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গান শুনতে পিসি মশাইয়ের গলা ছিল সত্যি সত্যি সিনেমার রাজ কাপুরের মত। মুকেশর মত। লোকজন মুগ্‌ধ। ঠাম্মা শুধু বার তিনেক বলে উঠল, কুকরু কু। কুকরু কু। কু কু কু।
    পিসে মশাই তখন মধ্যরাতের হাওয়া পাল্টে গান ধরেছেন—মেরা জুতা হ্যায় জাপানি…

    পিসেমশাইয়ের বরিশালে ফেরত যাওয়ার আগের দিন ভোরবেলা তিনজন করাতি এসে বরই গাছের ডালপালা ছেটে ফেলল। ডালে ডালে বরই ডাঁসা হয়ে উঠেছে। বরইগুলো তুলে নিয়ে চুনুপিসি মাকে বলল, বউদি, শুকাইয়া রাইখ। পরের বার নিয়া যামুআনে।

    আর পিসেমশাই শহরের ভবঘুরে বোবা লোকগুলোর সঙ্গে হাসকি ফাসকি করতে করতে দেখলেন করাতিরা ডালাপালাহীন বরইগাছটির গোড়া কেটে ফেলেছে। পুকুরপাড়ে অতি সাবধানে কায়দা করে কাটা গাছটিকে কাত করে ফেলতে পেরেছে। কিছুই নষ্ট হয়নি। বরইগাছ দিয়ে তিনি নৌকা বানাবেন। গাছটি পুরনো বলে সারি। কতটা পুরনো তা কেউ বলতে পারে না। ভাল নৌকার জন্য সারি গাছের তুলনা নাই। পিসেমশাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তক্তা বানালেন। করাতিরা করাত চালাল। আর মাঝে মাঝে হুকো টানল। বলল, জামাইবাবু, দ্যাশের কী অবস্থা?
    –পিসেমশাই চোখ ছোট করে ফিসফিসিয়ে বললেন, খুব ভাল। আবার খুব খারাপ।
    করাতিরা করাত ঠেলা বন্ধ রেখে প্রশ্ন করল, তাইলে তো সমসস্যা!
    –কোনো সমসস্যা নাই। কার্তিক মাসে আইয়া সব সোর কইরা দিমুআনে। বলে পিসেমশাই বরইগাছের ডালে ঝুলে থাকা মড়ার খুলিটা অতি গুপ্তভাবে বেলগাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলেন। হাওয়া এলে শনশন করে শব্দ হয়। শব্দ শুনে পিসেমশাই গেয়ে উঠলেন, মে আওয়ারা হু…

    যাওয়ার সময় চুনুপিসি মায়ের হাত ধরে কেঁদে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বউদি, তুমি ছাড়া আর কেডা আছে। আমার মায়েরে দেইখো।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ০৮:২৪471173
  • ও টগর ও কুক্কুট--এই গল্পটি কদিন আগে লিখেছিলাম। পাঁচ পর্বে করা হয়েছে।অগল্পটির গায়ে এখন কাঁচা রং ধরে আছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত হওয়ায় পশ্চিম বঙ্গের কোন কোন পাঠকের ধরতে অসুবিধা হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন করলে সূত্র বলা যাবে। ধন্যবাদ।

    ইতি--
    কুলদা রায়
    বয়স ৪৬ বছর। বাংলাদেশী বাঙাল।
  • I | 14.99.225.74 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ১৩:২৫471174
  • হেব্বি। স্বপ্নের মত অসংলগ্ন।
  • Manish | 59.90.135.107 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ১৬:১২471175
  • কুলদা রায়ের গল্পের মধ্যে গ্রাম বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ যেন ভেসে বেড়ায়।
  • Manish | 59.90.135.107 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ১৬:১৬471176
  • সওয়াল:

    বরই ফলটা কি?
  • Lama | 203.132.214.11 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ১৬:৫২471177
  • মনীশদা/ মনীশভাই, বরই মানে কুল (যা সরস্বতী পূজোর আগে খেতে নেই)
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২০ এপ্রিল ২০১১ ১৭:০৪471178
  • ও টগর, ও কুক্কুট :
    কুলদা রায়
    দ্বিতীয় পর্ব
    ---------------------------------------------
    মেজ ঠাম্মার দীর্ঘ চাচর কেশ। গন্ধরাজ তেল মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠেই আবার গন্ধরাজ তেল মাখতে শুরু করে। ততক্ষণে সূর্যটা পশ্চিমপূর্ব দিক থেকে কিছুটা মাথাও উপরে উঠে যায়। সারি সারি নারিকেল গাছের পাতায় ছায়া দোলে। দেখতে দেখতে মেজ ঠাম্মা উচ্চস্বরে বলে, অ বিনা, টাকি মাছ দিয়া নটেশাক রানছ নাকি? সাথে দুইটা রসুন ভিজে দিও। টাকি মাছ দিয়ে নটে শাক, রুই মাছের মুড়ি ঘণ্ট, পিপ্পল শাক দিয়ে হালকা ব্যঞ্জন—কখনো কখনো চুকাই শাকের খাট্টামিঠা খেতে খেতে মেজ ঠাম্মা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে এক বাটি মুড়ি। দুটো নাড়ু। মুড়ি খাওয়ার পরে এলাচদানা দাঁতে কাটতে ভাল লাগে। দুটো পাখি সুপারিগাছের উপর থেকে ডাক দেয়, হিট্টি। হিট্টি। হিট্টি।

    এ সময় ঠাম্মা মুরগী দুটো নিয়ে মন্দিরের পাশে চুপচাপ বসে থাকে। দুপাশে দুটো শান্ত মুরগী। মাথায় ছোট্ট বোল উঠেছে। দানা দিলে ঠুক ঠুক করে খায়। খেতে খেতে সারা উঠোনময় হেটে বেড়ায়। আর হাফ ধরে গেলে ঠাম্মার দুপাশে বসে থাকে। ছোটট বোনটি ছুটে এসে বলে, আমিও মুরগী হমু। মুরগী হমু। ঠাম্মা পুরনো বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কুকরু। কু। কুকরু কু। ছাঁদের কার্ণিশে বটগাছ জন্মেছে। বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে সবুজ সরল বটপাতা।
    অন্ধকার নামার আগে খেতে বসেছে মা। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে নিয়েছে। কাঁচা পিঁয়াজ কুঁচি কুঁচি করে কাটা। মা সামান্য লবণ দিয়ে ডলে ডলেমেখে খেতে ভালবাসে। তারপর সঙ্গে লেবু। রান্নাঘরের পিছনটিতে লেবু গাছ। গোড়ায় ছাই ছিটিয়ে দিলে ফুল আসে। সারা বছর লেবু ধরে। এলাচি লেবু। দাদু বলে, এলাচি নয়রে শালা—এইটা কাগজী লেবু।
    ঠিক এ সময় একজন কালোপনা বউ রান্নাঘরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কপালে বড় করে সিদুঁরফোটা। চওড়া লাপেড়ে শাড়ি। কালো মুখ। কিছুটা শুকনো শুকনো। ঠোঁট দুটো লাল। নাকে নোলক। দীর্ঘ এলো চুল। বলল, চাট্টি খেতে দাও।

    অন্ধকার হয়ে আসছে। ডালিমগাছের উপর টুনটুনি পাখিদুটো বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছে। দাদু উঠোনে খট খট করে খড়ম পায়ে ঘোরাঘুরি করছে। পিদিম হাতে এবার মাকে মন্দিরে যেত হবে। কালো বউটি বারান্দার এক কোণে আঁচল পেতে বসে পড়েছে। মা তার পাতের ভাতগুলো একটি থালায় বেড়ে দিল। শুকনো মরিচ দিয়ে খেতে খেতে কালো বউটি বলে উঠল, ইলিশমাছ কবে রানবা গো বউ? ইলিশ খাতি মন চায়।
    মা হাত ধুয়ে পিদিম ধরাতে গেল দোতলায়। বড় বোন সাজবাতির সলিতা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ দরোজায় পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেজ বোনটি ঝটপট ধুপতিতে নারিকেলের খোসার উপর ধুপ ছড়িয়ে দিল। আগুন দেবে কি দেবে না ভেবে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে কয়েকটা মশা ভনভন করতে লেগেছে মাথার উপরে। দেওয়ালের একপাশে পলেস্তারায় ফাঁটা দাগে একটি টিকটিকি হা করে চেয়ে আছে। মশা কাছে এলেই গব করে গিলে খাবে। মৌমাছির চাক স্তব্ধ।
    দোঁতলার সিঁড়ি বেয়ে মা সাজবাতি নিয়ে নেমে আসছে। পিছনে দুবোন। বড় বোনটির হাতে মঙ্গল ঘট। ছোট বোনটির হাতে ধুপতি। দাদু উঠোনময় তুলসীর জলের ছিটা দিতে দিতে সন্ধ্যা মন্ত্র বলছে। ঠাম্মা মুরগী দুটো নিয়ে বসে আছে। কালো বৌটি বারান্দায় নেই। খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। মেজঠাম্মা দালানের নিচতলা থেকে বলে উঠছে, বিনা দেখতো কে য্যান মন্দিরে ঢুকছে। দ্যাখতো, কেডা ঢুকল।
    দাদু মন্দিরের সিড়ির উপরে জল ঢেলে দিল। শুকনো বারান্দায় কারো পায়ের ছাপ দেখা যায়। কেউ ভেতরে ঢুকে গেছে। সাজবাতি আসায় অন্ধকার সরে গেছে। ভেতরে কেউ নেই। ধুপের ধোয়ায় কিছু কিছু মশা জানালা দিয়ে হটে গেল। মেজ ঠাম্মা দালান থেকে চেঁচিয়ে বলল, কাউরি দ্যাখতে পাইছ বিনা? হ্যার লাল শাড়ি। আউলা চুল। দাদু গম্ভীর স্বরে গায়ত্রী মন্ত্র বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকাল। আর মুরগী দুটো ঠাম্মার হাত থেকে বাক্সের ভেতর যেতে লেগেছে। ভেতরে গিয়ে বার কয়েক কুকরু কু ডাক দিয়ে দিয়ে গেল।

    কাজুলিয়ার ধীরেন পাল আশ্বিনের শুরুতে হাজির। তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির মধ্যে পুকুরে নেমে খুঁজে বের করল কালিপ্রতিমার কাঠামোটি। ছনের বিচালি বাঁধতে বাঁধতে ধীরেন পাল মাকে বলল, গেলবার উন্ডিয়ায় ঘুইরা ঘুইরা মরি। আর মনে মনে কই, দোহাই মা কালি, বিধুবাবুর বাড়ির পিত্তিমা গড়তি দ্যাও গো মা জননী।

    ধীরেন পাল প্রতিমা বানাচ্ছে। দড়িদড়া নিজেই নিয়ে এসেছে। দাদু সিধে বলল, পাল মশাই, পূজাতো এবার হবে না।
    –ক্যান ছোটোবাবু?
    –খাতি পাই না, পূজা করি কি দিয়া!
    ধীরেন পাল আস্তে করে হাসছে। সাবধানে বিড়িটা নিভিয়ে রেখেছে। তার হাতে গড়ে উঠছে—মা কালি, শিবঠাকুর আর একটা জিব লকেলকে শিয়াল। দাদু জানতে চাইল, তোমারে খবর দিল কেডা?
    –কেডায় আবার—কালি মায়।

    রাতে ধীরেন পাল খেতে এলো না। মা ভাত নিয়ে বসে রইল। দাদু ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলল, বৌমা, পাল মশাই আসবে না। অন্য কোনো বাড়ি খাইয়া লইছে। তুমি খাইয়া লও।
    প্রতিমার গায়ে সরমাটি পড়লে গোলগাল মুখটি দেখা গেল। গলায় ঝোলানো হয়েছে মুণ্ডমালা। কোমর বেষ্টন করে আছে ছোট ছোট হাত। আর লকলকা শিয়ালটি কেন জানি আমাদের ভুলু কুকুরটির মতো হয়ে গেছে। শুধু তার লেজটি সোজা। ভুলু কুকুরটি তার চারপাশে ঘোরে আর ঘেউ ঘেউ করে।

    হারুণকাকী ঝুনা নারিকেল নিয়ে এলো। আর আখের গুড়। লিচুদের বাসা থেকে এক ঝাঁকা খৈয়া ধান এসে গেল। লিচুর বোন নীলু বায়না ধরেছে—মায়ের সঙ্গে নাড়ু বানাবে। ফাতিমাকেও সঙ্গে নেবে। নূরুকাকু দাদুর সঙ্গে লেগে গেল ঝোঁপঝাড় কাটতে। বড় চাচী কয়েকটা টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, বিনা, সাজ কিনে দিও। আর মায়েরে কইয়ো—মাহবুব য্যান ফিরয়া আসে।

    বড় চাচী নামাজ পড়তে পড়তে হররোজ কান্নাকাটি করেন। আর মাঝে মাঝে লেবুগাছটির পাশ দিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে হেঁটে আসেন। এই পথ দিয়ে মাহবুব ভাই গিয়েছিলেন। বটতলার সাবু তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। বড় চাচীর সব মনে আছে। মনে আছে তার ছেলেটির গলায় ঝোলানো আছে একটি কবজ। তামার। মালাটি রূপোর। ভেতরে ভুর্জপত্রে জাফরান কালিতে কলেমা তৈয়ব লেখা। মোম দিয়ে কবজের মুখ বন্ধ করা। কে তাকে আটকে রাখে!

    চক্ষুদানের আগে পিসিমশাই এসে গেলেন। সঙ্গে ভোলাই সাধু। মাথা জটাচুল। চক্ষু দুটি লাল। আকাশের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে—কিল কিল কিলা। মধ্যরাতে কারণবারি পান করে শ্মশানে বসে থাকে। চক্ষু মুদ্রিত। গভীর যোগনিদ্রায় চলে যায়। শোনা যায় এ সময় মাটি থেকে একটু উপরে উঠে যান—হাওয়ার উপরে ভাসতে থাকেন। দূর থেকে শিবাকুল বলে ওঠে হুক্কা হুয়া হুয়া হুয়া।
    মধ্যরাতে সেদিন যোগনিদ্রায় যাওয়ার আগে মন্দ্র সান্দ্র গলায় ভোলাই সাধু বলে উঠলেন, আইজ কুক্কুট ভোজন তার কাইম্য।

    রাত্রিব্যেপে অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। দাদু ঘুমিয়ে পড়ার আগে প্রতিমার গলায় পরিয়ে দিয়েছে শোলার ফুলের মালা। মালায় বুক অব্দি ঢেকে গেছে। এর মধ্যে তিনি জিব বের হয়ে আছেন। ধীরেন পাল একটি বেলের কাঁটা দিয়ে চক্ষুদান করতে করতে বিড় বিড় করে বলে উঠল, হেই মা জগজ্জননী—তুমি হাইসা ওঠো, মা। সন্তানেরে রইক্ষা করো। দাদুর চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। মা উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।

    চারিদিকে ঘন অন্ধকার। রাস্তা থেকে পিসিমশাই বেরিয়ে এলেন। হাতে কাঁটা মুরগী। উষ্ণ রক্ত ঝরছে। মুরগীর ছাল ফেলে দেওয়া হয়েছে। পিসমশাই মাকে ডেকে বললেন, মাংসটা রান্না কইরা দ্যান। সাধুবাবা খাইবে। লগে পেঁয়াজরসুন দিয়েন। মাংস না খাইলে সাধুবাবার যোগনিদ্রায় অসুবিধা।

    প্রতিমার চক্ষুদান হয়ে গেছে। ধীরেন পাল তৃতীয় চোখের নিচে সোনার টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। টিপটি বহু পুরনো। এই টিপটা চোখের মণির মত রক্ষা করা হয় প্রতি বছর। পূজার এ কদিন নিরামিষ। সবজি ডালখিচুড়ি। মাংস নৈব নৈব চ। ধীরেন পাল বলে, ঘরে যান বৌদি। দাদু একবার মায়ের দিকে, একবার মাটির দিকে তাকিয়ে পেয়ারা গাছে দিকে চলে গেল। উঠোন দিয়ে একটা শিয়াল হেঁটে গেল। ঝিঝির ডাক থেমে গেছে।
    মা রান্না ঘরে মাংস রাঁধতে লেগে গেল। পিঁয়াজ রসুন বাটতে হবে। কৌটার তলানিতে সামান্য কিছু জিরা আছে। বের করে জলে ভিজিয়ে দিল। বাইরে হাওয়া উঠল। ভোলাই সাধুর দাড়ি উড়ছে। চারিদকে দারুচিনি এলাচের ঘ্রাণ ভেসে যাচ্ছে। আর বেলগাছের উপরে শিরশির করে বাঁশির শব্দ হচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে একটা দাড় কাক কা কা করে উঠল। যোগনিদ্রা আজ প্রবল হবে। কারণবারি শোধন করতে করতে ভোলাই সাধু বলে উঠল, কিলি কিলি কিলা।

    ভোরবেলা ধীরেন পাল চলে গেছে। কেউ দেখতে পায়নি। যাওয়ার আগে মন্দিরে প্রণাম করে বলেছে, তুমি অন্তরজামি মা। আগামীবার য্যান তোমার পিতিমা বানাতি পারি। রাস্তায় পা রাখতে রাখতে একবার পিছন ফিরে ধীরেন পাল দেখতে পেল, টগর গাছটি বেশ বড় হয়ে উঠছে। পাতায় পাতায় শিশির পড়েছে। শিরশির করছে হাওয়া। ফুল ফুটতে দেরী নেই। মায়ের পূজার জন্য ফুল বড় প্রয়োজন।

    রতন ঢুলি এসে গেছে। মান্দিরের সামনে বাজনা শুরু করেছে। সঙ্গে ছোট নাতি। ঠাং ঠং করে কাসিতে বোল তুলছে। ছেলেটার চোখে ঘুম লেগে আছে। গায়ে গামছা জড়ানো। ঢলডলে প্যান্ট।

    ততক্ষণে সারা উঠোন নিকোনো হয়ে গেছে। কাঁচা গোবরের ঘ্রাণ উবে যাচ্ছে। তুলসীতলায় প্রদীপটি জ্বলে উঠছে। চবুতরার পাশে যে কয়েকটি ভাদলা ঘাস অলক্ষ্যে বেড়ে উঠেছিল—তা আর নেই। কলতলাটি ঝকঝক। বেলতলাটি ঘিরে চালবাটা দিয়ে আল্পনা আঁকা হয়েছে। ঢাকির নাতি এক থাল মুড়ি আর এক ঢেলা নলেন গুড় পেয়ে চিবুতে চিবুতে বলে উঠছে, দুইডা কলা—রুম্মি কলা দ্যান।
    মা রান্নাঘরে যেতে যেতে শুনতে পেয়েছে, মেজ ঠাম্মা বারান্দা থেকে বলছে, মন্দিরে কে গেল দ্যাখো তো বিনা।
    রান্নাঘরে ধামাভর্তি ভাজা মুড়ি। চালুনির নিচে গরম বালি আর খৈয়া ধানের খোসা। দুটো টিনভর্তি গরম গরম খই। মেজ ঠাম্মা ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠছে, মন্দিরে দেখতো কেডা গেল বিনা? কেডা গেল?

    চুনুপিসির ঘুম টুটে গেছে। বিরক্তি নিয়ে এসেছে মন্দিরে। সিঁড়িগুলো, বারান্দা এবং ভেতরে জল ঢেলে ধোয়া মোছা শেষ। ছোট আসনখাটের কোণে কোণে সিদুঁরের ফোঁটা। কোষাকুষি পূজার তৈজষপত্রাদি আলোর মত পয়পরিস্কার। কয়েকটি ধুপতি জ্বলছে। চন্দনগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। চুনুপিসি অবাক হয়ে বলল, কখন করলা বউদি এইসব?
    মার মুখে কথা নেই। ঢাকি নাতির থালা দেখিয়ে বলল, অরে দুগ্গা মুড়ি দ্যান। ছেলেটার হাত বেয়ে নলেন গুড়ের রস পড়তে লেগেছে। কয়েকটি নীলমাছি ভনভন করছে।

    তৃতীয় পর্ব
    ------------------------------------
    নীলু উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক হাড়ি খিরপুরি। মাকে বলছে, কালো বউটি দিয়া গেছে। বলছে, লোচনের মায়ের হাতে দিবি। ক্ষীরের নাড়ু বানানো চাই কাকী।
    নীলু নতুন ফ্রক পরে এসেছে। পায়ে মল। এই ভোরে দুটো বেনী বাঁধা। চুনু পিসি জানতে চাইল, কেডা দিছে?
    --কালো বউ।
    --কোন কালো বউরে নীলু?
    -আগে দেখি নাই। হ্যার চক্ষু দুইডা জলে ভাসা। কপালে লাল সিন্দুর। হাসি হাসি মুখ।

    রতন ঢুলি মুড়ি চিবুতে চিবুতে বলল, আমারে মুড়ি দিয়া হ্যায় বউ মন্দিরেইতো ঢুকল মা জননী। হ্যার পা দুখানি রাঙা টুকটুকা। এ জন্মে দেখিনি এইরকম রাঙা চরণ।

    মন্দিরে কেউ নাই। মাকালির চোখ ভরা হাসি। চারি হাতে অভয়বানী। কপালে সোনার টিপ জ্বল জ্বল করছে। এক হাতে মুণ্ডুমালা। রক্ত লাল। একটি শিয়াল মুখ উচু করে আছে। আরেকহাতে খড়গ। পায়ের নিচে শিবঠাকুর। শিবঠাকুরের মাথায় জড়ানো সাপ। পরনে বাঘছাল।

    টগরগাছে টগর ফুটেছে। ছোট ছোট। ফুটেছে মন্দিরের জানালা ঘেষে। সাদা পাপড়িগুলো ভোরের বাতাসে মেলেছে। কয়েকটি কালো পিঁপড়ে পাতার উপর থেকে মাথা উচু করে তাকিয়ে আছে। কী একটা প্রজাপতি গাছের উপর দিয়ে--কখনো নিচ দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কখন ফুটেছে টগর ফুলগুলি কেউ জানে নাই।
    টগরগাছের নিচে একটি মুরগী আছে। আরেকটি নেই। একলা মুরগীটি জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। সামনে কিছু দানা পড়ে আছে। তিরতির করে মুরগীটির ঠোঁট কাঁপছে।
    ঠাম্মার চুল খুলে গেছে। উদ্ভ্রান্ত চোখ। বাড়ির আনাচে কানাচে ছুটোছুটি করছে। আর নাকের ডগা ফুলে উঠেছে। মা দুথালা ভাত বেড়ে রেখেছে। এক থাল ঠাম্মার জন্য। আরেক থাল কালো বউটির জন্য। বোনদুটির খাওয়া শেষ হলে মা বলল, যাতো, ঠাম্মাকে ডেকে নিয়ে আয়।
    বোনদুটির ইচ্ছে টগরগাছের নিচে যায়। গুণে গুণে দেখবে কটি ফুল ফুটেছে।

    ঠাম্মা ততক্ষণে খেজুরতলা দিয়ে ঘরে এসে বাড়ির পিছনে মঠের দিকে চলে গেছে। জবা ফুলগাছটির ভিতর উঁকি দিয়েছে দেখছে। ওপাশে বাসকগাছের ঝাড়। তারপর আশ শেওড়ার গাছ। যশুরে লতার ঝোঁপ থেকে একটি বেজি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। বোনদুটির পিছনে মীরা ভয়ে কিছু পিছিয়ে গেল। বলে উঠল, ও দিদি, বাঘ বেরুইতে পারে। চল যাই।

    এই ঝোঁপের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে ঠাম্মা। হামাগুড়ি দিয়ে ঝোঁপের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে তার হাতপা ছড়ে গেছে। মেজ বোন জোরে জোরে ডাক দিল, ঠাম্মা, আইসা পড়। মা ভাত বাইড়া বইসা আছে। অইখানে যাইও না।
    ঠাম্মা আরও ভিতরে ঢুকে গেছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না। তার কোনো সাড়া শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। ঝোঁপের বাইরে তিনটি মেয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপরে সুপারিগাছে দুটো পাখি বসে আছে। হাওয়ার ভিতরে ওরা ডেকে উঠল, হিট্টি হিট্টি হিট্টি। একটি বন বেড়াল আশ শেওড়া গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল একটি মঠের উপরে। তার লেজটি তোলা। দাঁত বের করে বলে উঠল, মিয়াঁও। বড় বোনটিকে জড়িয়ে ধরে মেজ বোন শিউরে উঠল। ফিসফিস করে বলল, ও ঠাম্মা। ও ঠাম্মা। আমগো ভয় করতেছে। পাখিটা ডাকছে, হিট্টি হিট্টি হিট্টি। বেড়ালটার চোখে তীব্র বিদ্যুত ঝলকে উঠেছে। ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে।

    এ সময় ঝোঁপের ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো ব্লাউজ, ব্রা, চুলের ফিতে, আর ছেড়া ছায়ার কয়েকটা টুকরো। ভাঙা চুরি, চুলের কাটা আর কাটা চুলের খোপা। ঠাম্মা ছুড়ে দিচ্ছে। মীরা বলে উঠল, ও খোদা, এ দেহি মাইয়া লোকের জিনিস। একটি গুইসাপ জিহ্বা বের করতে করতে এসব মাড়িয়ে পুকুরে নেমে গেল। আর ঠাম্মা ঝোঁপের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে পুকুর পাড়ের দিকে দৌঁড়ে গেল।

    নূরু কাকুর ভোর ভোর আসার কথা। খাটরা থেকে সামিয়ানা এসে গেছে। এই সামিয়ানা নতুন করে বানানো। এক কোণে লেখা নীচুপাড়া যুবক সমিতি। পাশে ফুল আঁকা। পদ্ম ফুল। নূরুকাকু জানে বোড়াশীর বাঁশ আনতে হবে। বনবিহারীর অপেক্ষা করে আছে। দাদু অস্থির হয়ে মন্দিরের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। দাদাকে ডেকে বলল, যাওতো, নূরুকে ডাইকা আইস। মেলা কাম পৈড়া আছে।

    দাদা কয়েকটি মরিচবাতি এনেছে। মন্দিরের সামনে ঝুলিয়ে দেবে। তার আগে নেড়েচেড়ে দেখছে বাতিগুলো ঠিক আছে কিনা। ছবির বাগান থেকে দেবদারু কেটে আনতে হবে। রঙিন কাগজ কেটে বানাতে হবে শেকল। বড়বড় করে লিখতে হবে শ্রী শ্রী সর্বজনীন কালিপূজা। সাধনা পিসির লেখা ভাল। সাধনা পিসি কলেজ থেকে ফিরলে লিখবে।
    পিসিমশাই ঘুম থেকে উঠে এলেন। কোমরে গামছা বাঁধা। দুটো হাই তুলে বললে, কাকা, বড় মিয়ার লগে একবার দেখা করবেন নাকি?
    --কোন বড় মিয়া?
    --হেমায়েতউদ্দিন বড় মিয়া। আপনেগো বাড়িটার ব্যাপারে কথা বলবেন নাকি?
    --সেইটা তো ওনারা দখল নিছে পয়ষট্টিতে।
    --দখল কি আর তুলতে পারবেন? আলাপ সালাপ কইরা দ্যাহেন—কিছু ট্যাহা পয়সা আদায় করণ যায় নাকি।

    এ সময় শোনা গেল ভোলাই সাঁধু হাক ছেড়েছে—ভোম ভোলা। ভোম ভোলা। দালান থেকে এই হাঁক বেরিয়ে আসছে।
    পিসেমশাই দৌঁড়ে গেলেন। ভোলাই সাধুর যোগনিদ্রা ভাঙতে শুরু করেছে। এ সময় তার মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রভাতকালে তার মন সদা প্রফুল্ল থাকে। এ সময় অনেক প্রার্থনা মঞ্জুর হয়।

    নূরুকাকা এলো। নূরুর হাতে মুরগীর ছাল আর পাখনার পালক। কিছুটা হত বিহ্বল তার চোখ। রাস্তা থেকে বাড়িতে পা দিতেই একাকী বসে থাকা মুরগীটা তারস্বরে ডেকে উঠল—কুকরু কু। কুকরো কু। কুকরু কু। এতক্ষণ টগরগাছের নিচে চুপ করে বসেছিল। সবুজ পাতার উপর ফুল ফুটেছে। নবীন কুসুম। হাওয়ায় দুলছে। নূরু কাকু উঠোনে উঠোনে ঢুকতেই দৌঁড় লাগাল মুরগীটা। পুকুর পাড়ের দিকে উড়ে যেতে যেতে ডাকতে লাগল, কুকরু কু। কুকরু কু।

    দাদু নূরু কাকুকে দেখে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বলল, কিরে নূরু। দেরী করলি যে?
    --এইডার জইন্য দেরী হইছে!
    --এইডা কি?
    --কুড়হার ছাল।
    দাদু শুনতে পেয়েছে কি পায়নি বোঝা যায়না। তার দেখারও অবসর নেই। নূরুকে পেয়ে কাজের লিস্টিটা মাথার ভেতরে তেরেবেরে করছে। আজ পূজা। আয়োজনে দেরী হচ্ছে। একটা দা-য়ের সন্ধানে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ফেলায় দিয়ায়। মেলা কাজ পৈড়া আছে। বেলা বইয়া যায়।

    নুরু কাকু ফেলতে যাবে এ সময় পুকুরপাড় থেকে ঠাম্মা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।অপেছনে বড় দিদি। ছোট দিদি। আর মীরা আসছে লজেন্স চুষতে চুষতে। তার গোলাপী ফ্রকটি বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে। এ সময় নূরু কাকুর হাতে মুরগীর পালক দেখে ঠাম্মা উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দাঁত আর নখ দিয়ে নুরু কাকুকে আঁচড়ে কামড়ে দিতে দিতে গর গর করছে। নূরু কাকু ‘ও চাচী ও চাচী’ বলতে বলতে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেছে। ঠাম্মাও গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে গলা টিপে ধরেছে। নূরু কাকুর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বড়দিদি ঠাম্মার হাত প্রাণপণে ছাড়ার চেষ্টা করছে। মেজবোন ভয় পেলে কাঁদতে লেগেছে। আর মীরা ‘বাবারে বোলাই’ বলে ছুটে গেছে। পাড় থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরের দিকে নূরু কাকু, ঠাম্মা আর বড় বোন তিনজন পড়ে যাচ্ছে। পড়ার কালে শোনা গেল—সঙ্গীহীন মুরগীটি হাওয়ায় উপরে লাফিয়ে উঠে ডানা ঝাপটে ঝাপটে আর্তনাদ করে উঠেছে—কুকরু কু। কুকরু কু। কুকরু কু।

    এর মধ্যে কখন যেন বেলগাছের নিচে ছায়া পড়েছে। শান্ত হাওয়া আছে। সঙ্গে নিমগাছটি অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। পাতা ঝিরঝির করছে। নিমগাছটি রাধা। আর বেলগাছটি মাধব। রাধামাধব। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে অন্তত রাধামাধব দেখা দেন।
    বড় মিয়া তার পুরনো ছাতাটি রাধামাধবের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছেন। ছাতায় লেখা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। বড় মিয়ার পক্ক কেশ। চোখে সুরমা। কৃশকায় দেহ। হারুন কাকার কানে কানে কথা বললেন। হারুন কাকা চশমা আনতে ভুলে গেছেন। অস্পষ্ট দেখতে পেলেন বড়বোনটি বারান্দায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকজন বউঝি। আর টগরগাছটির নিচে ঠাম্মা চুল এলোমেলো করে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। ধরে আছে মুরগিটিকে। থরথর করে কাঁপছে। এই ফাঁকে গাছে টগর ফুটেছে। এক সারি পিঁপড়ে সার বেঁধে টগরের সাদা পাপড়ির উপর দিয়ে রেণুর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে।

    কালো বউটি মন্দিরে চন্দন ঘষতে শুরু করেছে। সাজিয়ে রেখেছে কোষাকুষি। আলো চাল ভিজানো আছে। শিলনোড়ায় বেটে আল্পনা খাড়া হবে। ফলপাকুড় রাখার জন্য কলাপাতা রাখা আছে। আর বড় তামার থালায় কে যেন একটি বড়সড়ো চিনির মুকুট রেখে গেছে। জানালার পাশে ফুটন্ত টগর ফুলগুলো আস্তে আস্তে দুলছে। সন্ধ্যার আগে ফুলগুলো তুলতে হবে। এবাড়ির লক্ষ্মী বউটি তুলবে। সাঁজিটি প্রতিমার বামপাশে রাখা।

    এ সময় নতুন মিয়া এ বাড়িতে এসে পড়েছেন। তিনি কিছুটা উত্তেজিত। ঘন ঘন তার শ্বাস পড়ছে। বড় মিয়া তার হাত ধরে জানতে চাইছেন—কি বৃত্তান্ত কওতো নতুন।
    --এখনো জ্ঞান ফেরে নাই। ডাক্তার কইছে বাঁচা কঠিন। গলায় নখ বইসা গেছে।
    --হুউম। নূরু মরলে অর বউটার কী হবে?
    --হ্যায়তো পাগল হৈয়া কানতেছে। পেটে ন পোলা।
    বড় মিয়ার কপালে ভাঁজ এসেছে। ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগলেন। বেলা বাড়ছে—লোকজন আসতে শুরু করেছে। বেলতলায় ছোটখাট ভিড় জমেছে। নতুন মিয়া সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী করন যায়?
    --কী আর করন যাইবে? বড় মিয়া এইটুকু বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলেন, ছাবুরে ডাক দ্যাও।
    --ছাবুরে পামু কই? হে না রাজাকারী কইরা পলাইছে?
    --তোমাগো ডরে পলাইছে। পলাইয়া তো দ্যাশ ছাইড়া যায় নাই। তোমরা ডাকলে আবার ছাবুরা আইসা যাবে।

    ছাবু ততক্ষণে ভিড় ঠেলে এসে পড়েছে। নতুন মিয়ার পায়ে কদমবুসি করে বলল, মামু কেমন আছেন?
    মামু বহুদিন পরে ভাগ্নেকে পেয়ে বুকে তুলে নিয়েছেন। মামুর চোখে অশ্রু। ভাগ্নের চোখে পানি। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে থাকতে করিৎকর্মা ভাগ্নে কিছুটা কাহিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু চোখদুটো ফসফরাসের মত জ্বলছে। মুখে চাপা হাসি। কদিন আগেও মুখে চাপ দাড়ি ছিল—আজ ক্লিন সেভ করা। নতুন মিয়া ছাবুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, নূরুরে তো পেরায় মাইরা ফেলাইছে ছোটবাবুরা। এখন কি উপায় রে ছাবু?
    ছাবু বহুদিন মজলিসে কথা বলে না। এখন বলল, হ্যাগো তো আপনেরাই মাথায় তুলছেন। আইজ নূরুরে মারছে। কাইল আপনেরে মারবে। হ্যাগো মারছি বৈলা আমরা রাজাকার।
    নতুন মিয়া ঠা ঠা করে হাসলেন। বললেন, বেল পাকলে কাকের কি!
    হারুনর কাকা মুখ খুললেন। বললেন, ছোট বাবুরা অরে কিছু করেন নাই। ভুল কইও না সাবু। ছোট কাকী মাথা খারাপ মানুষ। তার দোষ ধর ক্যান?
    -মাথা খারাপ টারাপ কিছু না। আমগো নূরুরে মারছে হেইডা হৈল বিষয়।
    --পাগল মানুষ। দুইডা মুরগি নিয়া থাকে। একডা হারান গেছে। নূরুর হাতে মুরগীর ছাল পাখনা দেইখা মনে করছে হ্যায় বুঝি মারছে। মনে কইরা খেইপা গেছে।
    --নূরু মারছে হ্যার প্রমাণ আছে?
    --নুরু যে মুরগিডা মারছে হেইডা কেউ কইছে?
    --তাইলে নুরুরে মারল ক্যান?
    --তাইলে কি চাও ছাবু?
    --বিচার। ন্যায্য বিচার।
    --কি রকম বিচার?
    --এনাগো ক্যান্টেনমেন্টে লইয়া যাই বেলুচ মেজরসাবের কাছে। তারপর ঠা ঠা ঠা। কথা ফাইনাল।
    --ক্যান্টনমেন্ট পাইবা কুনহানে? তোমার বেলুচ মেজররে পাইবা কুনহানে? হ্যারা কি আছে? সাবু ভুইলো না—দ্যাশ এখন স্বাধীন।
    --অ। সাবু সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। পুরনো অভ্যাস বশে বলে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি নতুন মিয়ার পায়ে আবার কদমবুসি করে বলল, বেলুচ মেজর নাইতো কি অইছে—আমগো মামু আছে। মামুই ঠা ঠা ঠা কইরা দেবে।
    লোকজন মুখ চাওয়া চাউয়ি করছে। কেউ কেউ ফিসফিসও করছে। ছাবু পাল্টায় নাই। সেই আগের মতৈ আছে। তার রক্তে খুনের নেশা। নতুন মিয়ার সামনে এই কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। তিনি বড় নেতা। হারুন কাকা রেগে গেছেন। রেগে গেলে তিনি তোঁতলাতে থাকেন। তিনি কি বলছেন তা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বলছেন কলমা তৈয়্যেবা– লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এই দরুদ শরীফ বললে তার মন শান্ত হয়।অবড় মিয়া ছাবুকে সামলাতে চেষ্টা করছেন। নতুন মিয়া দেখতে পেলেন পেয়ারাগাছের নিচে ছোটবাবু বসে আছে। তার মাথা নিচু। পা দিয়ে নখও খুড়তে পারছেন না। এই ছোটবাবুর কাছ থেকে একটা টর্চ নিয়ে গিয়েছিলেন গেল এপ্রিলে নতুন মিয়া।অটর্চটি সারা যুদ্ধেরকালে তার সঙ্গেই ছিল। এখনো আছে। ছোটবাবুকে ফেরত দেওয়া হয়নি। ছোটবাবু নতুন মিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, আমরা কী করব?
    --আপনেরা ইন্ডিয়া যাইয়েন। আমরা যুদ্ধ কইরা স্বাধীন দ্যাশ আনুম।
    নতুন মিয়ার সঙ্গে মাহবুবভাই ছিল। মাইবুব ভাই টগবগ করে ফুটছে। মাহবুব ভাই লম্বা চওড়া মানুষ।অমাহবুব ভাইয়ের বাঁ-চোখের উপরে একটা কাটা দাগ। ছেলেবলায় এ বাড়ির পেয়ারাগাছ থেকে পড়ে কেটে গিয়েছিল। নতুন মিয়ার আগে টকটকা যুবক মাহবুব ভাই বলছে, চিন্তা নাই ছোট দাদু। আমরা আছি।

    মাহবুব ভাই নাই। এ বাড়ির কুকুরটা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। মন্দিরের পাশে টগর ফুটেছে। গন্ধ ছুটেছে। দুএকটা অলি ছুটে এসেছে।

    চতুর্থ পর্ব.
    -------------------------------------
    হৈচৈ শুনে পিসে মশাই বেরিয়ে এসেছেন। তার চোখে মুখে ঘুম। গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম ঝুলছে। পিছনে তিনজন বোবা মানুষ। পিসি মশাইয়ের পায়ে কোলাপুরি জুতো। তিনি নতুন মিয়ার পায়ে নিচু হয়ে সালাম করলেন। বড়মিয়া স্বস্তি পেয়ে বললেন, আসো আসো জামাই। তুমি আইসা গেছো—আর চিন্তা নাই।
    পিসিমশাই বড় মিয়ারও পায়ে গড় হলেন। বললেন,পরভু আইসা পড়ছে, চিন্তা নাই।
    --তিনি কেডা?
    --তিনি তিনি-ই। তিনি কইলে বন্দুকের গুলিও থাইমা যায়। খান সেনারা পরভুরে ধইরা কইছেলে, তুম্ভিশালা হিন্দু লোক আইছ। তুম্ভিশালা মুক্তিলোক আইছ—তুম্ভিশালা ইন্ডকা দালাল আইছ। রেডি হও—হাত উঁচাও।
    পরভু আমার, আহা কী লীলা আমার পরভুর, বন্দুক তোলা দেইখা তিনি হাসতেই আছেন—হাসতেই আছেন। খানসেনারা পরভুর হাসি দেইখা আরও চেইতা গেল। চিৎকার কইরা কয়—হ্যান্ডস আপ। চক্ষু মুঞ্জো। ঠা ঠা ঠা।
    পরভু হাসতে হাসতে কইলে, ও ব্যাডারা, তরা করতেআছিস কি? তরা মোরে গুলি করতে চাস—তর গুলিতো বন্দুকে নাই। মাডিতে পইড়া আছে।

    মেজরসাব সত্যি সত্যি চাইয়া দ্যাখে—বন্দুকের গুলি মাটিতে পইড়া আছে। ঠা ঠা ঠা হওনের উপায় নাই। তিনি তার নিজের পিস্তলটা ধইরা কয়—এইবার ফাইনাল।
    পরভু আমার হাসতে হাসতে কয়—মোর ফাইনাল বোজলাম, তরতো ফাইনালের আব্বা হইয়া হইয়া গেছে গিয়া?
    মেজরসাবের হাতটা থরথর করে কাঁইপা উঠলে। পরভুর পায়ে পইড়া কয়, হুজুর আপনে জানলেন ক্যামনে—মেরা আব্বাহুজুরকা বুখার হ্যায়।
    পরভু হাসতে হাসতে কয়—জানি, মুই হগল কিছুই জানি রে বাজান। যা ,ঘরে যা। ঘরে গিয়া দেখ—তর টেলিগেরাম আইছে। তর আব্বার খবর আইছে।
    কথা সত্যি। বোজলেন চাচা। হেইদিন টেলিগ্রাম আইছেলে। মেজরসাবের আব্বা হুজুর ফট। এই আমার পরভু। তিনি সব জানেন। সব দ্যাখতে পারেন--অতীত বর্তমান ভবিষ্যত। কিচ্ছু বাকী নাই পরভুর কাছে। সব ফকফকা।
    নতুন মিয়া বললেন, মন পড়তে পারেন?
    —পারবে না ক্যান। মোর ভোলাই সাধুর কাছে মন পেরান দেহ—হেইয়া সবই পানিব্‌ৎ তরলং।

    তিনজন বোবা ভোলাসাধুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো। পরভুর খালিগা। গলায় একটা গামছা পেচানো। চক্ষু দুইটা লাল। চুল এলামেলো। গলায় ছোট ছোট হাড়ের টুকরো। হাড়গুলো মুরগী কি মানব শিশুর বোঝা মুশকিল। ভোলাইসাধুর পা চলে তো গা চলে না। টলে টলে পড়ে। কষ্টে সৃষ্টে বোবা মানুষের কাঁধে হাত দিয়ে এসে পড়েছেন। তার মাথাটা ঝুলে পড়েছে। পিসে মশাই ধরেধারে ভোলাইসাধুকে আসরে বসালেন। উর্দ্ধনেত্র হয়ে একজন বোবার হাত থেকে জ্বলন্ত কল্কিটা নিলেন। লম্বা টান দিলেন। তার বুকের খাঁচাটা ভেতরের দিকে ঢুকে গেল। কয়েকটা চড়ুই কিচিরমিচির করতে করতে দূরে সরে গেল। দম কিছুক্ষণ চেপে রেখে ফুস করে ছাড়লেন। ছাড়া শেষ হলে হাঁক পাড়লেন—বোম ভোলা। তার মুখের ধোঁয়া ক্রমশ চক্রাচারে হাওয়ায় উড়তে লাগল। এই সময় দোতলার বারান্দা থেকে বড় বোনটিকে নিয়ে মা ঘরের মধ্যে চলে গেল। কয়েকটা কাকও কা কা করতে করতে দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল।
    পিসেমশাই ঘোষণা করলেন, পরভু ঘোরে আছেন। এখন যে যেডা জানতে চান—কইয়া ফ্যালান।

    বড় মিয়া সালাম দিয়ে বললেন, পরভু, আমার নাম হেমায়েতউদ্দিন। সবাই বড় মিয়া বলে।
    --বড় মিয়া, তোর ফাড়া কাইটা যাইতেআছে। বাড়ি নিয়া আর কুনো সমস্যা নাই।
    বড় মিয়া তাজ্জব। একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তার বাড়িটি ছোট বাবুর বাড়ি। দখল নিয়েছিলেন। ফেরত দেওয়ার নাম নাই। ফেরত দেওয়ার ইচ্ছেও নাই। কোনো দলিল পত্রও হয় নাই। এই নিয়ে তার মনে একটা অজানা আশঙ্কা আছে। তিনি ভোলাই বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, ছোটবাবু ঝামেলা করবে নাতো?
    পিশে মশাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, বাবাতো কইয়া দিছেন আপনের ফাড়া কাডছে।
    --ছোট বাবু কেসকারবারী করবে না তো?
    --আপনেরা দখল নেলে কে কবে কেস করছে?
    --কথা সত্যি। বড় মিয়ার মুখ উঙ্কÄল হয়ে উঠল। বললেন,আর আইয়ুব খানের জামানায় কেস করে কেমনে! করার মত তাগদ লাগে না? অখন আঅইয়ুব খান নাই--দ্যাশ স্বাধীন হইছে। ওনাগে মনে কি আছে কেডা জানে!
    --দ্যাশ স্বাধীন হইয়া কি আপনের ক্ষ্যামতা কমছে? চিন্তা কইরেন না। যা কিছু ঝামেলা আছে মুই সৈর কইরা দিমুআনে। ভাইবেন না।
    পরভু মৃদু মৃদু হাসছেন। তিনি আরেকটা দম দিচ্ছেন। দমে দমে তিনি উর্দ্ধ থেকে উর্দ্ধে গমন করেন। এই সময় উর্দ্ধ গগণে বাজে মাদল। নিম্নে উতলা ধরণী তল।অওরে চল চল চল।

    বড় মিয়া ছাবুকে এগিয়ে দিলেন। ছাবু বলল, আমার কি উপায়?
    --মামুজানের লগে থাক। ভয় নাই।
    লোকজন চমকে গেল। ছাবু রাজাকারের নেতা ছিল। লোকজন ধরে ধরে মেরেছে। লুট পাট করেছে। এসব ভোলাই বাবা সব জেনে বসে আছে। কোনো লুকোছাপা নাই।
    বড় মিয়ার মনে ফূর্তির বান এসেছে। মনে কোনো খুঁত খুঁত নাই। ভোলাই বাবা সব মুশকিল আসানও জানেন। বেশ থরথর আবেগে ভোলাই বাবার সামনে বড় মিয়া হাঁটু গেড়ে বসলেন। আরো তমিজ সহকারে আরও মোলায়েম হয়ে—গলাটা একটু উঁচু করে বাবার কাছে জানতে চাইলেন, আমগো নতুনের কি হইবে বাবা?
    --মন্ত্রী। নতুন মিয়া মন্ত্রী হইবে। কথা ফাইনাল।

    নতুন মিয়াকে জড়িয়ে ধরেছে ছাবু। ধরে প্রায় ভুমি থেকে একটু উঁচুতে জাগিয়ে তুলেছে। নতুন মিয়ার পা থেকে জুতো খসে গেছে। তার পায়ের কড়ে আঙুলটা একটু খাটো। ছাবু আরামে আহ্লাদে চেঁচিয়ে উঠল, নারায়ে তকতীর। লোকজন বলে উঠল, আল্লাহু আকবার।
    আল্লাহ মেহের বান। তিনি সব পারেন।

    হারুন কাকা তোতলাতে তোতলাতে বেরিয়ে গেলেন। পেয়ারাগাছের নিচে দাদুর পাশে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। দাদুর শূন্য চোখ। মন্দিরের পাশে মুরগীটা কোলে নিয়ে ঠাম্মা বসে আছে। তার কাঁপুনিটা কমেনি। মাথার উপরে টগর ফুল। কয়েকটা ফড়িং উড়ছে। হারুন কাকা বললেন, ছোট কাকা, ভয় পাইয়েন না। এটা মগের মুল্লুক না। আমরা আছি।
    ভোলাই সাধু কল্কিতে আরেকটা টান দিয়ে হাঁকছেন—বোম ভোলা।

    নতুন মিয়া ঘোষণা দিলেন, পরভুর উদ্দেশ্যে আজ পাঠা বলি হবে। জোড়া পাঠা। মন্ত্রী হইলে মইশ বলি।
    পিসে মশাই ভোলাই সাধুর সামনে জোড় হাত করে বসেছেন। বলছেন, বাবা, এইবার কন, আমার শ্বশুরের ভিটার কি সমস্যা?
    উর্দ্ধনেত্র হয়ে ভোলাই বাবা তর্জনী উঁচিয়ে ধরলেন দালানটির ছাঁদের দিকে। বোবা লোকজন দৌঁড়ে গেল সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে বড় বোনকে নিয়ে মা ধীরে ধীরে উপরে যাচ্ছিল। তাদের ঠেলে মেলে টপকে উঠে গেল একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে ছাঁদের দিকে। মেজ বোনটি এইসব বোবা লোকদের ধাক্কা খেয়ে সিঁড়িতে পড়ে গেছে। ওরা তাকে মাড়িয়ে মাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। মা আঁচল চেপে কঁকিয়ে উঠল।
    ছাঁদের কার্নিশে বটগাছ গজিয়ে উঠেছে। বাতাসে দুলছে বটপাতা। পাতার আগায় শিস উঠেছে। এই বটের নাম শিসপড়ি। এই শিসপড়ি বটপড়িতে একটা লক্ষ্মী পেঁচা বাসা বেঁধেছে। বোবা লোকজনের কেউ একজন সেখানে হাত দিয়ে বের করে এনেছে একটি মড়ার খুলি। মাথাছোলা বোবা লোকটি দুহাতে খুলিটি উঁচিয়ে ধরে গো গো করে উঠল। ছাবু চেঁচিয়ে বলল, অইডারে ছুইড়া দে, ছুইড়া দে রে মাথাছোলা।

    বটপড়ি শিসপড়ির ভেতর থেকে লক্ষ্মীপেঁচাটি বেরিয়ে এসেছে। কয়েকবার পাখা ঝাপটে উড়ে গিয়ে আঁশ শেওড়া গাছে গিয়ে বসেছে। পেঁচাটার চোখে ঘুমের ক্লান্তি আর বিরক্তি। একটি তক্ষক জিহ্বা বের করে ডেকে উঠল, কট কট কট।
    ছাঁদে এখানে ওখানে কয়েকটা গুলির খোসা পাওয়া গেল। জলের পাইপের সঙ্গে আটকে আছে ছেড়া আর্মি বুট। একদম ধার ঘেষে ছাঁদের দেওয়ালে লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। বোবা লোকগুলো প্রথমে ছুড়ে মারল বুটটি। লোকজনের মাঝখানে গিয়ে পড়ল। ছাবু দেখে বলল, মেজরসাবের বুট। মেইড ইন শিয়ালকোট।
    বড় মিয়া ছেলেকে ধমক দিয়ে বলল, এইসব কইস না ছাবু।
    ছাবু অবাক হয়ে বলে,কমু না ক্যান। বালুচ মেজরের লগে আমার দোস্তি আছিল—হেইডা সবাই জানে।
    এর মধ্যে ওরা ছুড়তে শুরু করেছ গুলির খোসাগুলি। ছাবু হাসতে হাসতে বলছে—চাইনিজ। চাইনিজ। অর্জিনাল চাইনিজ গুলি।
    বড় মিয়া বললেন, আস্তে ক ছাবু।
    ছাবু বলে, আস্তে কমু ক্যান? এই বাড়িটা পাকিস্তানী মেলিটারিগো ওয়াচ টাওয়ার ছিল--হেইডা সবাই জানে।

    হাওয়ার মধ্যে আস্তে করে ছুটে এলো একটা পাইলট পেন। ছোট করে কলমের খাপে লেখা—সুখে থাক। বড় মিয়া সুখে থাকা কলমটিকে পকেটে পুরে নিলেন। ছাবু বলল, দ্যাখতো, তরা মেজরসাবের সানগ্লাসটা পাইস কিনা? মামুরে দিতাম। হ্যারে মানাইবে ভাল।
    সান গ্লাস পাওয়া যায় নি। ওরা ছুড়ে মারল খুলিটিকে। হাওয়ায় থাকতে থাকতে ছাবু খুলিটি ধরে ফেলল। নিখুঁত ক্রিকেট প্লেয়ারের মত তালু বন্দী করে খুলিটিকে চুমু দিতে গিয়ে চমকে গেল—খুলির কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ছিদ্র। বাঁ চোখের উপরের হাড় একটু ফাঁটা। ছেলে বেলায় পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ফেঁটে গিয়েছিল। আর ঠিক মাথার পিছন দিক থেকে একটা গুলি ঢুকে কপালের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ছাবু একবার চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে কী মনে করে হা হা করে হেসে উঠল। এই খুলিটি তার চেনা। আর দাদা অবাক হয়ে ভাবছে—খুলিটি নিমগাছে ছিল। গাছ থেকে খুলিটি ছাদে গেল কি করে?

    ভোলাইবাবা প্রাত: ভোজন করবেন। নতুন মিয়া বললেন, কি খাবেন বাবা?
    ভোলাই বাবা উর্দ্ধনেত্র। এখন সাড়া নাই। মাথার তালুতে ডান হাতের তর্জনীটি রেখেছেন। বাম হাত পেটের কাছে ধরে রাখা। পিসে মশাই বললেন, মুরগীর ঝোল আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা।

    এই সময় টগরগাছের নিচে ঠাম্মা বসে আছে। কোলের কাছে অবশিষ্ট মুরগীটি। মুরগীটির মাথায় লাল বোল। গাছে সবুজ পাতায় সাদা ফুল। হালকা হাওয়ায় দুলছে। জানালা দিয়ে দেখা যায় কালো বউটি নেই। কাজ সেরে চলে গেছে। ধুপকাঠি জ্বলছে। চন্দনগন্ধ। কে একজন ঠাম্মার কোল থেকে মুরগীটি ধরে নিয়েছে। মুরগীটির বোল কড়া লাল। বোলটি কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে ডেকে উঠেছে—কুকরু কু কু কু কু। ঠাম্মা থরথর করে কাঁপছে। মুরগীটি ধরে নিয়ে গেলেও হাতদুটি এখনো সেইভাবে ধরা আছে কোলের কাছে। চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ছে। টগরফুলের পাপড়ির উপর থেকে দুটো কাল পিঁপড়ে চলতে চলতে মাথা উঁচু করে থেমে গেছে।

    আর তক্ষুণি কালো বউটি মাকে লাল পেড়ে শাড়িটি পরিয়ে এনেছে। ঘিরে রঙের শাড়ি। দেশত্যাগের সময়েও শাড়িটি ব্যাগে করে নিয়ে নিয়েছিল। রোদ বৃষ্টি আর কাদার ভিতরে—রাতের অন্ধকারের মধ্যে ঝিকরগাছার ট্রেন লাইন পার হওয়ার সময়ে বুকে করে আগলে রেখেছে শাড়িটিকে। তখন দেখেছে ট্রেন লাইনের উপর রক্ত জমে আছে। দুদিন আগের রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ট্রেন লাইন পার হতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরেছে এখানে। এখানে পাকবাহিনীর তীব্র সার্চ লাইট ঘুরে ঘুরে আসে। সার্চ লাইট এড়িয়ে রেল লাইন পার হতে গিয়ে বিড় বিড় করে বলেছে, দোহাই রক্ষে কালি। রক্ষে কালি এই শাড়িটিকে রক্ষে করেছেন। ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পরেও অক্ষত আছে। পাট ভাঙেনি।

    টগরগাছটির দিকে ফুলের সাজিটি নিয়ে এগুতেই শুনতে পেল—ছোট পিসি দৌঁড়ে এসেছে। মায়ের হাত থেকে সাজিটি নিয়েছে। পিসি টগর ফুল তুলতে তুলতে বলেছে—ভোলাই সাধু কইছে –তোমাগো পূজার অধিকার নাই বউদি। তোমাগো ছুৎ আছে।
    মা কথা বলে না। পিসি বলে, তোমরা দ্যাশ ছাইড়া ইন্ডিয়া গেছিলা। আগানে বাগানে হাডছ। অপথ্য কুপথ্য খাইছ। ছুৎ না হৈয়া যায় কই। পিসি একটু করুণ করে বলে, ঠায়ুরকে অছ্যুৎ করা ভাল না বৌদি।

    পিসি চাঁপা কলির মত আঙুল দিয়ে টগরগাছটি থেকে নতুন ফুঁটে ওঠা টগরগুলি তুলতে লেগেছে। মৃদু স্বরে গান ধরেছে—মা আমার সাধ না মিটিল/ আশা না পুরিল/ সকলি ফুরায়ে যায় মা। পাতাগুলি কাঁপছে। বড় নাজুক টগর পাপড়িগুলো। দু একটা দুমড়ে মুচড়ে নিচে ঝরে পড়ছে। সেখানে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ঠাম্মা কোলের কাছে ধরে রেখেছে মুরগীরূপ হাওয়া। হাওয়ার মধ্যে মুরগীটি তারস্বরে ডেকে উঠেছে—কুকরু কু কু কু। উঠোনের একপাশে মুরগীটির গলা থেকে রক্ত ছুটেছে। রক্ত অনেক উষ্ণ। গাঢ় লাল।
    দালানের বারান্দা থেকে মেজ ঠাম্মা বলল, অ বিনা—তুমি বোগদার মত খাড়ায় আছ ক্যান। ভোলাই বাবার জন্য ভোগ চড়াও।
    ভোলাই বাবা ভোগ গ্রহণ করে বাড়ির ছুৎ দূর করবেন আজ রাতে। বাড়িটির দোষ কাটাতে চতুদিঋকে বান্ধা দেবেন। এই কাজে তার তুল্য আর কেউ নাই।

    পর্ব. পাঁচ
    --------------------------------------
    গোয়াল ঘরটি ঝাড় দিয়ে পরিস্কার করে নিয়েছে মা। পশ্চিমপাশের বেড়াটি নেই। নূরু কাকু একটি দরমার বেড়া লাগাচ্ছে।অপরে একটা দরোজাও লাগানো হবে। বেড়াটি লাগানো শেষ হলে গোয়াল ঘরটি থাকার ঘর হবে। নূরুকাকুর গলায় এখনো আঁচড়ের দাগ। ক্ষত শুকিয়ে এসেছে। দাদু নূরু কাকুকে তারগুণা এগিয়ে দিচ্ছে। দাদা দালানের দোতলা থেকে কাঁথা বালিশ নামাতে শুরু করেছে। নূরু কাকা চেঁচিয়ে বলছে, বড় কাগা, তুমি পারবা না। আমি আসতিছি। বড় দিদি বই খাতাপত্র আনতে যাবে। সিঁড়ির কাছে যেতেই দেখতে পেল—সিঁড়ির মাথায় বসে তিন তিনজন বোবা তাস খেলছে। তাদের উদোম পা। ভোলাই সাধু নেই। তিনি রাতে বাড়ি বান্ধন শেষ করে দক্ষিণে ফিরে গেছেন। তার কাজ শেষ। শুধু কল্কিটি রেখে গেছেন। বড় দিদি সিঁড়ির গোড়া থেকে ফিরে এসেছে।

    সবাই দোতলা থেকে নেমে এসেছে। মেজ বোনটি আসেনি। মা দিদিকে বলল, মাইজা আইল না?
    অরে ডাইকা আন।
    দিদি গোঁজ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ল না।
    মায়ের অনেক কাজ। গোয়াল ঘরটি ঘরের মত করে গোছাতে গোছাতে বলল, ফিইরা আইলি ক্যান। যা না। ডাইকা আন।
    --ওতো রান্না ঘরে। আসবে না। কানতেছে।

    মা ছেড়ে আসা রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেল। রান্না ঘরের এক পাশে ঢেঁকি। তার পাশে মেজ বোনটি উবু হয়ে শুয়ে আছে। আর মীরা বিশুদা মানিক ওকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে।
    মাকে আসতে দেখে মীরা বলে উঠল, মামী, বুড়িদি কাঁঠাল পিঁডাডা নিয়া যাইতে চায়!
    মেজ বোন বুড়ি দিদি আরও জোরে চেপে ধরেছে পিড়িটি। মাকে দেখে হাউ মাউ করে উঠল। বলে উঠল, অরা নিতি দিচ্ছে না।
    চুনু পিসি দোতলার ছেড়ে যাওয়া ঘরদোর দেখছিল। বারান্দায় এসে হাঁক দিয়ে বলল, বৌদি, মাইজা মাইয়াডারে লৈয়া যাও।
    মেজ বোন চেঁচিয়ে বলল, পিসিগো, আমগো পিড়া নিতি দ্যাও। দাদু বইসা ভাত খায়।
    পিসি দোতলা থেকে একটা পুরনো বেতির চাটাই ছুড়ে মারল। এটা দাদা ফেলে গিয়েছিল। পিসি বলল, হেইডা পাইতা দাদুরে খাইতে দিস মাইয়া।

    উঠানে চাটাইটা ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছে। মা মেজ বোনটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মানিক ম্যাঘা কাঁঠাল পিঁড়ির উপরে দাড়িয়ে গেল।অদখল নিশ্চিত। মেজবোন আছাড়ি বিছাড়ি খেতে খেতে মায়ের সঙ্গে চলেছে। মীরা এগিয়ে এসে চাটাইটা তুলে নিয়ে বুড়ি দিদির দিকে দিয়ে বলল, লক্ষ্মী দিদি-- এইডা নিয়া যাও। না নিলি মায়ে রাগ করবে।
    উঠোনের উপর দিয়ে হিট্টি হিট্টি পাখি উড়ে যাচ্ছিল। এ বাড়িটার গাছ থেকে দূরের কোনো গাছের দিকে উড়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে একদলা বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে। উষ্ণ বিষ্ঠা সিধে এসে পড়েছে চাটাইয়ের উপর। মীরা লাফিয়ে উঠেছে। তার গা ঘিন ঘিন করছে। মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠেছে—এ মা।
    হাত থেকে ফেলে দিয়েছে বিষ্ঠালিপ্ত চাটাই।

    হারুন কাকী দুটো মুরগী নিয়ে এসেছেন। মুরগী দুটোর মাথায় এখনো বোল ওঠেনি। ঠাম্মা ঝোঁপে জঙ্গলে বসেছিল। চুল তার খোলা। আঁচল লুটিয়ে পড়ছে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। এখানে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চুল-বাঁধা ফিতে, কোন এক শিশুর জুতো আর কিশোরী মেয়ের কাটা বেনী—মাথার চামড়াসহ উঠে এসেছে।
    হারুন কাকী ঠাম্মার হাতের ভেতরে মুরগী দুটো রেখে দিল। দ্রুত পিছন ফিরে চলে এলো। চলে আসতে আসতে দেখতে পেয়েছে—ঠাম্মা থরথর করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে মুরগীদুটো সস্নেহে বুকের কাছে ধরে রেখেছে। আর চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে জল। কড়াইগাছের উপর থেকে দুটো পাখি ডেকে উঠেছে-হিট্টি হিট্টি হিট্টি।

    পুকুরের মাটি কাটা হচ্ছে। বসে বসে মাটিকাটা দেখছেন পিসেমশাই। কাজের তদারকী করছে ছাবু। গতকাল ফিশারী অফিসার এসেছিলেন। তিনি পুকুরটির একটি ডিজাইন করে দিয়েছেন। নাম আদর্শ ম্‌ৎস চাষ প্রকল্প। দারিদ্র দূরীকরণ লোন পাশ হবে। বাড়িটি নিয়েও পিসেমশাই বেশ কিছু প্লান করেছেন। কিছু গাছ কাটা হবে। কিছু গাছপালা লাগানো হবে।

    বিমল কাকা খুর দিয়ে পিসে মশাইয়ের দাড়ি কাটতে শুরু করেছেন। খুব ধীরে ধীরে সাবধানে বিমলকাকা গলায় খুর চালাচ্ছেন। পিসে মশাই গলাটি উঁচিয়ে আছে।
    বিমল কাকা পিসে মশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে কইছেলেন--অহন আর কারো ভিটে ছাড়ন লাগবে ?--কী কন জামাই বাবু? স্বাধীন দ্যাশে আর কারো ভিডা ছাড়ন লাগবে?
    পিস মশাই গলা উঁচিয়ে আছে। উঁচু করে কথা বলতে তার সমস্যা। বিমল কাকা দাড়িতে মিহি কের পোচ দিচ্ছেন। পিসে মশাইয়ের চোখ বন্ধ। তিনি বললেন, বিমল ভাইডি পরে আইস, তুমারে বেবাক বুঝায়া দেবআনে। এই সব জটিল বেপার স্যাপার সহজ করে কওন যায় না।
    --তাইলে দ্যাশটা স্বাধীন অইলে ক্যান?
    --স্বাধীন অইল বৈলা তুমি আমার দাড়ি কাটবার পারতেআছ। পরাধীন থাকলে পারতা না। বিহারীরা কাডতো। উন্নতিডা বোজজো?
    --এই সেই ছাবুই আবার আইলে, বড় মিয়া আইলে--তাতে কি অইল?
    --হ্যাগো জামাই নতুন মিয়া মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার আছেলেন। তারা আসবে নাতো তুমি আসবা? তিনি এখন মন্ত্রী অইবেন। পাকিস্তান থাকলে মন্ত্রী অইতে পারতে? কও পারতে?
    বিমল কাকা আর দেরী করল না। তার বহু বাড়ি যেতে হবে। যা বোঝার ছোটবাবুকে বাড়ি থেকে নামতে তার দেখেই বোঝা হয়ে গেছে। মন খারাপ করে বিমল কাকা উঠে গেল।

    ছাবু বাড়িটির অন্দিসন্দি ভাল করে জানে। দশমাস এই বাড়িটিতে দিনরাত থেকেছে। কখনো ছাদের উপরে বায়োনোকুলারে চোখ পেতে রেখেছে। পাশে মেশিন গান। বালুচ মেজর সেই সময় তার পিঠ চাপড়ে বলেছিল, তারা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলে বাড়িটি ছাবুকে দিয়ে যাবে। মেজর খুবই রইস আদমী ছিল। আর কটা দিন গেলে সত্যি সত্যি তিনি খুশি মনে বেলুচস্তিআনে ফিরতে পারতেন। সপ্তম নৌবহর ফিরে গিয়ে আশা পূরন হল না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ছাবুর বুক থেকে। আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হচ্ছে।

    এ সময় মাটিকাটা মোজাম সর্দার চেঁচিয়ে উঠল, সর্বনাশ!
    পিসে মশাই গুনগুন করে মেরা নাম জোকারের গান করছিলেন, জিনা এহা, মরনা এহা। তিনি গান থামিয়ে জানতে চাইলেন—কী সর্বনাশ হইলে রে?
    ছাবু পিসি মশাইকে ইঙ্গিতে বসতে বলেছে। তিনি গানে ফিরে গেলেন। রাজ কাপুরের গান। মেরা নাম জোকার সিনেমাতে রাজ কাপুর গাইছেন।অশিল্পী মুকেশ। তারপর পাড় থেকে পুকুরে নেমে গেছে ছাবু । মাটিকাটা লোকজন ততক্ষণে থেমে গেছে। তারা কিছুটা ভীত বিহ্‌ব্‌ল। ছাবু নির্বিকারভাবে মোজাম সর্দারের কাছে জানতে চাইলে—কি উডছে?
    --মাটির ভিতর থেইকা আস্ত একটা কঙ্কাল উডছে।

    কঙ্কালটি লম্বা চওড়া মানুষের। কেবল মাথাটি নেই। বুকের খাঁচার সঙ্গে লেগে আছে একটি তাবিজ। চকচকে রূপোলী। ছাবু তাবিজের মোম খুলে বের করে আনল একটি ভুর্জপত্র। তাতে জাফরান কালিতে আরবীতে কলেমা তৈয়্যব লেখা—লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। নিচে বাংলায় নাম--মো:মাহবুবুর রহমান। কাগজটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছে ছাবু। তারপর ম্যাচকাঠি ধরিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সামান্য ধোঁয়া উঠেছিল। একটি লতানো সাপের মত হাওয়া বেয়ে ধোঁয়াটি মাথার উপরে একটু ক্ষণ থির ধরে দাঁড়িয়েছিল। ছাবু ফুঁ দিয়ে—হাত দিয়ে ধোঁয়াটিকে ভেঙে ছত্রখান করে দিয়েছে। ধোঁয়া নেই। উড়ে গেছে। মোজাম সর্দারের হাতে ফাঁকা তাবিজটি দিয়ে বলল, তুমি কিছু দেহ নাই মোজাম। কিছু দ্যাখছ?
    --না,কিছু দ্যাহি নাই।
    --কেউ কিছু দ্যাহে নাই।
    মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়েছে মাথাবিহীন কঙ্কালটি। কবজটি শুধু নেই। পিসে মশাই চেয়ার থেকে বসে বসেই আবার বললেন, কী হইছে ছাবু ভাই?
    --কিছু না। কিছু হয় নাই দুলাভাই।

    ঠিক এ সময়ে মাহবুব ভাইয়ের মা—আমাদের বড় চাচী এক ধামা মুড়ি আর এক ফানা কাঠালী কলা নিয়ে বাড়ির ভিতরে পা রেখেছে। গতরাতও তার কাঁদতে কাঁদতে কেটে গেছে। ভোলাই বাবার কাছে ছেলের জন্য হত্যে দিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, দেখতি পাইতেছেন?
    ভোলা বাবা বলেছিল, মুই কিছুই দ্যাখতি পাইতেআছি না আম্মাজান।
    --আমার মাহবুবরে দ্যাখতে পাইতেছেন না বাবা? কী দ্যাহেন তাহলে?
    --অন্ধকার দেহি মাগো। খালি অন্ধকার।

    এই রকম অন্ধকারের মধ্যে ছাবু নিয়ে এসেছিল মাহবুব ভাইকে বাসা থেকে। মাহবুব ভাই এসেছিল মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। বড়চাচীকে ছাবু বলেছিল, আপনে যান। এই আসুম আর যামু।
    মাহবুব কি একবার ফিরে তাকিয়েছিল? দেখেছিল—অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নাই।

    এইসব ভাবতে ভাবতে বড়চাচী গোয়াল ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ছাবু তাকে দেখতে পেয়ে পুকুর ঘাটের চিকটি ঝোঁপের আড়ালে ঢুকে গেছে। ওখানে লাল পিঁপড়ের বাসা। ছাবুর হাতে পায়ে গায়ে পিঁপড়েরা উঠে এসেছে। কাটুস কুটুস কামড় দিচ্ছে। কামড় খেতে খেতে হামাগুড়ি দিয়ে পিছন দিকে সরে যাচ্ছে ছাবু। যেতে যেতে দেখতে পেল, একটি গুঁই সাপ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘন ঘন জিহ্বা বের করছে। এখন টগর গাছটিতে জলদান করার সময়। মুড়ির ধামাটি রাখতে রাখতে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

    টগরগাছে ফুল নেই। পাতাও কুকড়ে গেছে। নিচে ঘাস বেড়েছে। দুটি মুরগী ডেকে উঠেছে কুকরু কু । কুকরু কু। কু কু কু।
  • achintyaraup | 59.93.245.177 | ২১ এপ্রিল ২০১১ ০৪:৫৬471179
  • কিছু কওনের ভাষা নাই। আফনে আরও ল্যাহেন কুলদাদাবাবু। আরও অনেক অনেক ল্যাহেন। খোদায় আফনারে সুনায় বান্দানো কলম দেউক।
  • Update | 128.231.22.150 | ২১ এপ্রিল ২০১১ ০৪:৫৭471180
  • Name:IMail:Country:

    IPAddress:14.99.229.125Date:21Apr2011 -- 12:56AM

    অসাধারণ !!

    Name:achintyarupMail:Country:

    IPAddress:59.93.254.255Date:21Apr2011 -- 01:58AM

    কিছু কওনের ভাষা নাই কুলদাদাবাবু। আফনে আরও ল্যাহেন। আরও অনেক অনেক ল্যাহেন। খোদায় আফনারে সুনায় বান্ধানো কলম দেউক।
  • achintyarup | 59.93.245.177 | ২১ এপ্রিল ২০১১ ০৪:৫৯471165
  • এতক্ষণে ঠিকমত পোস্ট করা গেল
  • kk | 71.236.36.122 | ২১ এপ্রিল ২০১১ ০৭:২৪471166
  • ও:, এই ভদ্রলোক এত অসম্ভব ভালো লেখেন! ভালোলাগায় আমার দম বন্ধ হয়ে এলো।
  • Nina | 64.56.33.254 | ২১ এপ্রিল ২০১১ ২০:৩৩471167
  • বহুদিন পর এ এক অদ্ভুত মায়াময় ভালোলাগা---বিষাদ-মধুর --মনটা এক আবেশে আচ্ছন্ন হল!
    আরো চাই আরও চাই ---কুলদাভাই!
  • Bratin | 117.194.101.198 | ২২ এপ্রিল ২০১১ ১২:৩৫471168
  • আপনার লেখা পড়ে অদ্ভুত ভালো লাগলো।কুলদা বাবু আমার শ্রদ্ধা নেবেন।
  • Bratin | 117.194.101.198 | ২২ এপ্রিল ২০১১ ১২:৫৬471169
  • আছি তিল দা।
  • Kulada Roy | 74.72.54.134 | ২২ এপ্রিল ২০১১ ১৯:৩৩471170
  • ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।
  • Nina | 68.84.239.41 | ২৩ এপ্রিল ২০১১ ১৯:৪২471171
  • ইস্টার-লং-উইকএন্ড---আরও পড়ান প্লিজ, কুলদাভাই। আগাম ধন্য যোগ করে রাখলাম।
  • ku ru ku | 193.222.161.6 | ০৪ মে ২০১১ ১৮:৫০471172
  • এই সব ভাট এর কি মানে । শুধু কু রু কু। Surrelistic লেখা পোর্তে হোলে র জন্য ম্রিত্যউ কুসুম পরুন কিন্নর রায় এর।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন