এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বুরা না মানো -- ফাগুন লেগেছে বনে বনে

    shrabani
    অন্যান্য | ১৭ মার্চ ২০১১ | ১২৯৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • nina | 79.141.168.137 | ২১ মার্চ ২০১৩ ২৩:৪৫469230
  • আহা! শ্রাবণী,
    তোর লেখা, আমার বসন্ত উৎসব! মনটা একেবারে বাগ বাগ হয়ে গেল---
  • শ্রাবণী | 69.94.105.133 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:২৮469231
  • ফাগুনের প্রথম দিন ও চোদ্দই ফেব্রুয়ারী...................এই টই তোলাই যায়!
  • শ্রাবণী | 69.94.105.133 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৪৩469232
  • *********************************????
    তোমায় নিয়ে গল্প লেখা যায় না, কবিতা তো আরৈ নয়। সবাইকে যেমন সব কিছু মানায় না, তোমাকে তেমনি লেখনীতে মানাবে না। তবু যে কালি কাগজে আমার বারে বারে কেন উঁকি দাও! তোমার জন্য বাজারের হিসেব লেখার খাতাও কেমন আমার সন্দেহের তালিকাভুক্ত হয়ে পড়ে মাঝে মাঝেই, কাগজ ছিঁড়ে নতুন করে লিখি। যদি জীবনও এমন করেই পাতা ছিঁড়ে লেখা যেত তাহলে তো শুধু তোমার পাতা নয়, একটা নতুন খাতাই কিনতাম হয়ত!

    তুমি আমার বন্ধু ছিলেনা, কিছুতেই না। বড় ছেলেরা আবার ছোটমেয়েদের বন্ধু হয় নাকি, তায় চার ক্লাস উঁচুতে পড়া ছেলে? আমি ক্লাস ফাইভে যখন তুমি নাইনে, শাড়ি পরা দিদিগুলো তোমাদের ক্লাসে, কত লম্বা ওরা, ওদের পাশে আমরা সব লিলিপুট। প্রার্থনার সময় রীনাদিকে রোজ দেখতাম তোমার দিকে আড়চোখে চেয়ে ফিকফিক করে হাসত, তুমি তখন দুরের খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে আবছা হাসির মত কিছু, চেষ্টা করে লুকোনো খুশী, অন্তত আমার তো সেরকমটাই লাগত। আশেপাশে তাকিয়ে বন্ধুদের দিকে দেখতাম আর কেউ খেয়াল করল কিনা।
    কোনোদিন কাউকে কিছু বলিনি, যদিও সোমা মুনমুনরা মাঝে মাঝেই এসে বড় ক্লাসের গল্প শোনাত, ভাবের গল্প, এর সঙ্গে ওর ভাব, ওর সঙ্গে তার। ওদের দিদিরা পড়ত কিনা বড় ক্লাসে, তাই ওরা অনেক খবর রাখত। বাকীরা আমরা হাঁ করে সেইসব ভাবের কথা শুনতাম। কখনো আবার ভাবতে চেষ্টা করতাম বড় ক্লাসে গেলে যদি আমারও ভাব হয় তো ক্লাসের মধ্যে সম্ভাব্য সখাটি কে হতে পারে, যার সাইকেলের পেছনে ইস্কুলের একটু আগে অবধি এসে নেমে যাওয়া যায়, যার সঙ্গে বাড়ির পথ হাঁটা যায়। একজনকেও ঠিক মনের মত মনে হত না, ছোট ছোট এক চিলতে মত বাঁটকুলে সব!
    তবে ভাব হলে কী কথা বলে সেটা ঠিক সোমা মুনমুনদের জানা ছিলনা, ওদের দিদিদের জানা ছিল কিনা কে জানে, খুব জানতে ইচ্ছে হত মাঝে মাঝে!
    তা সেই আমিও একদিন বন্ধুদের টেক্কা দেবার জন্যে ভাবলাম রীনাদি আর তোমার কথাটা সক্কলকে জানিয়ে দিই। সবসময় সোমারাই সব খবর আনে, আমরা ভেবলির মত শুধু শুনি। এবার নাহয় গল্পটা একটু উল্টে দিয়ে, পাল্টা রঙ তুলি হাতে নিয়ে, জলছবি আমিই আঁকলাম। তবে তার আগে ব্যাপারটা নিয়ে নিঃসন্দেহ হতে রোজ প্রার্থনার সময় তোমাদের দিকে তাকিয়ে থাকি লাগাতার বেশ কিছুদিন। ওদিকে কেউ যে আমার দিকেও তাকিয়ে আছে আর আমার তোমায় দেখাকে দেখছে সে তো আর আমি জানিনা!

    সেদিন টিফিনের সময় ঝুমু এসে ধরল। ঝুমু এমনিতে আমার প্রিয়বন্ধু নয়, কেউই আমার সেরকম আলাদা করে প্রাণের বন্ধু ছিলনা তখন। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জনকে ভালো ও খারাপ দুইই লাগত। আসলে বাড়িতে দিদি ছিল, বড় প্রিয়, তার সঙ্গে আমার যত প্রাণের কথা, বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন সেভাবে পড়েনি তাই কখনো। আমার দিদি আবার ছিল সকলের প্রিয়, তোমাদেরও। অথচ দিদি তো তখন বারো ক্লাসে পড়ে, তবু পাড়ার ছোট বড়, সম অসম বয়সী সবার বন্ধু ছিল সে।
    ঝুমু চুপচাপ থাকত ক্লাসে, নিজে আমি খুব বলিয়ে কইয়ে ছিলাম না কোনোদিন কিন্তু ঝুমু আমার থেকেও শান্ত। সে এসে ডাকল তেঁতুল খেতে, বাড়ি থেকে তেঁতুল চটকানো এনেছিল লুকিয়ে, দেখালো। আমার বাড়িতে মায়ের কড়া নজরে তেঁতুল প্রায় জুটতই না, অথচ ভালো লাগত দারুন, মনে করলে এখনো জিভে জল চলে আসে। লুকিয়ে খেতে ভয়ও হত, খেলেই কিভাবে যেন শরীর টরীর খারাপ হয়ে মা ঠিক ধরে ফেলত। তবু মাখা তেঁতুলের গন্ধে একটা মোহময় আমন্ত্রণ আছে যা উপেক্ষা করা কঠিনই নয় প্রায় অসম্ভব ছিল, অন্তত সেই সব দিন রাত্রিতে।
    বলগ্রাউন্ডে বসে টিফিনকালীন জমাটি আড্ডা ছেড়ে আমি ঝুমুর পিছু পিছু যাই নিশিতে পাওয়ার মত।

    আঃ, দারুন মাখা ছিল তেঁতুলটা, গুড় লঙ্কা নুন তেল দিয়ে পাকা নতুন তেঁতুল। দুজনে বটপুকুরের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে কোনো কথা না বলে তেঁতুল খেয়ে যাই, স্বর্গীয় এক অনুভূতির আবেশে আমার দুচোখ প্রায় বুজে এসেছে, চটকা ভাঙে ঝুমুর কথায়,
    -"তুই কী অরুদাকে ভালোবাসিস? সবসময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিস কেন?"
    আমি হঠাৎ জেগে ঝুমুর মুখের দিকে তাকাই, চোখে কী ছিল জানিনা,সে দৃষ্টিতে ঝুমু কুঁকড়েমুকড়ে যায়। চকিত বিস্ময় বা কোনো অবিশ্বাসের ভাষা ছিল বোধহয়, আমাদের মধ্যে কেউ এমন একটা খারাপ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, তখন ভাবতে পারতাম না। তবু সোমার মত সবজান্তা পাকা মেয়ে হলেও হয়ত এতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হতনা, ঝুমু যাকে আমি আমারই মত একজন মনে করতাম সে এইরকম বলছে। ভালোবাসা, কথাটার যে অভিঘাত ছিল তাতে পুরো বিষয়টিতে পাত্র অর্থাৎ তুমি চাপা পড়ে গেলে অন্তত সেই মুহূর্তে। ভালোবাসা জিনিসটার যেখানে কথাই ওঠা উচিৎ নয় সেখানে কাকে ভালোবাসি তার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে!
    আমি কেঁদেই ফেলি শেষে, এমন একখানা অপবাদ, শুনলে মা হয় মরে যাবে নয় আমাকে মেরে ফেলবে। ঝুমুর আহত শালিকের গলা, ঝুমুর কালো মেঘ মুখ,
    -"আমি কাউকে বলিনি, বিশ্বাস কর, তেঁতুলবীচি ছুঁয়ে বলছি।"
    আমরা তখন কথায় কথায় কোনো কথার যথার্থতা প্রমানে "বিদ্যা" বলতাম বই ছুঁয়ে। পুকুরঘাটে টিফিনবেলায় সেসময় হাতের কাছে বই ছিলনা, বিকল্পে তেঁতুলবীচির কতটা প্রামাণ্যতা ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ সেই ক্লাস ফাইভে ছিল না। আমি ঝুমুকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার কান্না তখন ঝুমুতে সংক্রমিত হয়েছে, দুজনে দুজনকে ছুঁয়ে ফেলি, সান্ত্বনার ছোঁয়া। প্রথম বিস্ময় আঘাত সামলে নিয়ে আমি তখন প্রায় শান্ত, ঝুমু গড়গড় করে বলে চলেছে সে কিভাবে রোজ প্রার্থনায় আমাকে ও আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তোমাকে দেখে দেখে শেষে আজ আর থাকতে না পেরে কথাটা পেড়েই ফেলেছে। দেখলাম সোমা আর মুনমুন বেচারারা শুধু মাছরাঙা সাব্যস্ত হয়, নাহলে ভাব নিয়ে আমাদের সবার প্রাণেই অল্পবিস্তর মাছশিকারীদের বাসা। ভিজে থেকে শুকনো চোখে যেতে গিয়ে ফিক করে হেসে ফেলি,
    -"এমা, অরুদার সঙ্গে কীকরে ভাব হবে, আমার থেকে কত বড় না?

    তুমি তখন কত বড় ছিলে আমার থেকে। তারপর আমি যখন বড় হলাম, তোমার বড় হওয়াটা আস্তে আস্তে ছোট হতে লাগল, মানে আমার থেকে তোমার বড় হওয়াটা। রীনাদির সঙ্গে পরে দেবাশিষদার ভাব হয়েছিল শুনেছি, এগারো বারো ক্লাসে।
    একবার পরীক্ষার হলে রীনাদির পাশে বসেছিলাম, সেবার ফাইন্যালে সব ক্লাসের ছাত্রদের মিলেমিশে বসানো হয়েছিল, বলাবলি (সেই নিস্পাপ বেলায় টোকাটুকি শব্দটির তখনো আমাদের আঙিনায় পা পড়েনি) এড়াতে। ভুগোল পরীক্ষার দিন রীনাদি ত্রিপুরার প্রধান নদীর নাম বলে দিয়েছিল, আমি ত্রিপুরা পড়ে যাইনি। উত্তর না জানার টেনশনমুক্ত হয়ে ওর হাসিটা খুব মিষ্টি লেগেছিল তখন, আধগালে টোলও যেন পড়েছিল। সেই থেকে দেখা হলে হাসি ফিরিয়ে দিতাম আমিও, টোল ছাড়াই।
    তোমার সঙ্গে কী অ-ভাব হয়েছিল জানিনা, আমার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল রীনাদির। তবে দেখা আর তেমন হত কই, পথ গিয়েছিল বেঁকে। আমরা জুনিয়র সব, মাঠের আল ধরে হেঁটে এসে স্কুলে উঠি,তোমরা সিনিয়ররা দলবেঁধে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে করে কলেজে যাও।
    পরে আমাদের ইস্কুলেও শুনেছিলাম বারো ক্লাস হয়েছিল, পড়ুয়াদের সাবালকত্ব দুবছর পিছিয়ে দিয়ে, কিন্তু ততদিনে তোমার তো বটেই, আমারও ওপাট চুকে গেছে। ক্লাস ফাইভে আঙুল গুনতাম, দশ ক্লাস মানে আরো পাঁচটা বছর, মানে বড় হওয়া, মানে হাতখরচের পয়সা আর বাসে করে কলেজে যাওয়া।

    ক্লাস টেনে উঠে তোমাদের আর দেখাই যেত না কোনোকিছুতে। বোর্ডের ছাত্রছাত্রী, তাদের সবই আলাদা ব্যাপার, খেলাধূলা, ফাংশান, সরস্বতী পুজো, সবেতে মাতব্বর নাইনের সবাই, তোমরা নয়। তোমরা পড়া, এক্সট্রা ক্লাস ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত, তোমাদের দিকে সমস্ত মাস্টারমশায়দের শ্যেণ দৃষ্টি, বোর্ডের রেজাল্টের ওপর ইস্কুলের অনেক কিছু নির্ভর।
    তুমি আসতে মাঝে মাঝে দিদির কাছে, নোটস বই নিতে, দুজনের গল্প জমে উঠত। সেসব গল্পে আমার কোনো উৎসাহ ছিলনা, আমি কোনোদিন সে আড্ডায় শামিল হইনি তাই। তুমি ছাত্র এমন কিছু মহামারী ছিলেনা, অথচ আমার আবার তখন ভালো ছাত্রীর তকমা লাগার পালা শুরু। পালেদের তাপস আর আমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, কোয়াটার্লিতে একজন এগোয় তো হাফইয়ার্লিতে আর একজন। তুমি কেন জানিনা সবসময় আমাকে দেখলে তাপসের সুখ্যাতি করতে, বলতে,কী ভালো গীটার বাজায় ছেলেটা!

    সেবার সরস্বতী পুজোর দিন মধুপুরে ইন্টারস্কুল গান,আবৃত্তি, নাটক প্রতিযোগীতা হল, আশেপাশের ইস্কুলগুলোর মধ্যে। আবৃত্তিতে তিনজনই আমরা এক ইস্কুল এক ক্লাস থেকে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হলাম। সুকান্তর কবিতা ছিল,আমরা এসেছি," একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশ নীল"। কবিতাটা কিছুটা বুঝে অনেকটা না বুঝে প্রিয় ছিল, সুরে বাঁধা। এমন সুর যাতে হাত পায়ের সাথে শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় এক অদ্ভুত স্পন্দন অনুভব করতাম, আপনা আপনিই।
    দিদিকে রাস্তায় দেখতে পেলে মাস্টাররা ডেকে ডেকে তার বোনের প্রশংসা করত কিছুদিন। হেডস্যার বলেছিল আমার মধ্যে নাকি বিদ্রোহী ভাবটা খুব ভালো ফুটেছিল, মা শুনে বলল, হবেনা, বাড়িতে রোজ বিদ্রোহ প্র্যাকটিস করে তো মুখে মুখে তর্ক করে, কোনো কথা একবারে শুনেছে। অবশ্য মায়ের এই সিরিয়াল অভিযোগ বাবা থেকে শুরু করে বাড়ির সবার বিরূদ্ধেই, নাহলে আমি মোটামুটি শান্ত ছিলাম।
    তখন গরম পড়বে পড়বে করছে। হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে হাল্কা ঝোড়ো হাওয়া এসে শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেদিনও এমনি এক বকুলগন্ধী হাওয়ায় আমতলায় সাইকেলটা গাছে ঠেকিয়ে, মুখের ওপর পড়া চুলের অবিন্যস্ত গোছাটা হাত দিয়ে সরিয়ে তুমি চাঁদুদাকে বললে, "তুষার ছেলেটার গলাটা দারুন, ওতো আবৃত্তি শেখে, শুধু উচ্চারণে এক আধটু ত্রুটি ছিল বলে ওকে ফার্স্ট করেনি, নাহলে ওরই ফার্স্ট হওয়ার কথা। বেচারা চাষীবাড়ির ছেলে বলে মার খেল, জাজেদের উচিত ছিল কনসিডার করা।"
    আমি তুতুনদের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম, আকাশ আমার প্রিয় ছিল, বিশেষকরে নীল আকাশ, নানা কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাটত।
    কাজ বলতে তখন হাওয়ায় আমার ঘের দেওয়া নীল নেটের ফ্রকটা বার বার উঠে যাচ্ছিল, এক হাত দিয়ে তাই সামনেটা ধরে ফ্রক সামলানো। তুতুন ঘরে দুধমুড়ি খাচ্ছিল, দুজনে প্রাইমারী ইস্কুলের মাঠে খেলতে যাব, আমি অপেক্ষায়। তোমার কথা কানে আসতে গিয়েও কেমন আকাশের নীলে মিশে গিয়েছিল, নাকি হাওয়ায় হাওয়ায় হারিয়ে গেল। তুতুন জামায় মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলে আমি ওর হাত ধরে দে দৌড়, খেলার বিকেল পেরিয়ে যায় যে! অনেকদিন পরে যখন তলিয়ে দেখার বয়স হয়েছে, জীবন যখন পুরনো হয়ে নানা ঘোরপ্যাঁচের ঘূর্ণিতে ঘুরে বেড়ায়, সময়ে অসময়ে, তখন একদিন কোন পুরনো সিন্দুক থেকে তোমার গলায় তুষারের আবৃত্তির প্রশংসা, আম ডাল, তোমার মুখের ওপরের চুলের গোছ আর বসন্ত বাতাস, সব মিলে এক দৃশ্যপট সামনে এসে হাজির। এমন অসময় আর কী বলব, একদা আবৃত্তি করে প্রাইজ পেয়েছিলাম সেটাই তখন সবচেয়ে আশ্‌চর্যির মনে হল, তোমার গলার শ্লেষের ধার ততদিনে ভোঁতা হয়ে ফসিলত্ব লাভ করেছে!
  • sosen | 125.240.63.154 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৪৯469233
  • বা:, অপূর্ব।
  • sosen | 125.240.63.154 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৫০469234
  • তিথিডোর মনে পড়ল--
  • শ্রাবণী | 69.94.105.133 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৫৬469235
  • সেবার হোলির আগের দিন সন্ধ্যায় ঠাকুর বেরোলো, সঙ্গে আমরা সবাই। আমার দুই মুঠিতে দু রঙের আবির, গোলাপী আর নীল। ঢোল কর্তালের তালে তালে রামধনু রঙা আবির ওড়ে আকাশে, সেও যেন তাল মিলিয়ে বাতাসে ভাসে। আমাকে কেউ আবির দিলনা, ছিঁচকাঁদুনে, গোমড়ামুখী তায় রেজাল্টের গরবে ধরাকে সরা দেখি, কে আসবে যেচে ঝামেলা নিতে।
    এমনকি দিদিও বন্ধুদের সাথে এমন মেতে গেল যে আমাকে গেল ভুলে, অনেকক্ষণ রইলাম সাদা, বেরঙ।
    তুমিও খেলছিলেনা, একটু দুরে দাঁড়িয়েছিলে। যেই কেউ যাচ্ছিল তোমার কাছে, তাকে হাত দিয়ে আটকাচ্ছিলে, হাসিমুখে। আমিও কালীতলার মূল অনুষ্ঠান থেকে দুরে সরতে থাকি, অভিমানে, অবহেলায়। কখন তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি খেয়ালও নেই, না, তুমিও দেখনি। বুলুদি ভিড় থেকে দৌড়ে এল আমাদের দিকে, লাল আবির হাতে নিয়ে। বাধা দেওয়ার আগেই, তোমার মুখ, মাথা, সাদা পাঞ্জাবী ভরে দিল রঙে, দিয়েই দৌড়ে পালালো তোমায় জিভ দেখিয়ে। আমায় কেউ অমন করে আবির দিলে রেগে যেতাম খুব, কিন্তু তোমায় দেখে সেরকম কিছু মনে হল না, হাসছিলে তুমি।
    রাগ আমার হল, তোমার হাসি দেখে, আদিখ্যেতা মনে হল। কই, আমি তো পাশেই ছিলাম, আমায় একটু রঙ দিতে আসার কথা মনেও এল না বুলুদির, বা অন্য কারুর? তুমিই বা কেমন বেহায়া, সবাইকে হাত দিয়ে আটকে এখন বুলুদিকে দেখে সব বারণ জল হয়ে গেল!
    নেহাত তখন ভাব নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি, নাহলে বুলুদির আর তোমার ভাবের কথা বলতামই, অন্তত দিদিকে।

    গোলাপী আবির পুকুরের সিঁড়ির প্রথম ধাপটায় আর নীল আবির শেষ ধাপটায় ছড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ঢুকলাম। মা বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে, হলুদের হাত মুছে আঁচল রাঙিয়ে, রাঙা চোখ আমার দিকে, "ভালো করে মুখ ধোবে আর চুল না আঁচড়ে বিছানায় উঠবেনা, মাথার আবির চাদরে বালিশে পড়ে একশা হবে।" আবির? তাড়াতাড়ি গিয়ে আয়নায় মুখ দেখি, বেশী না হলেও এদিক ওদিক মুখে চুলে লাল আবিরের ছোপ। হাওয়ায় উড়ে তোমার রঙ কখন আমাতে লেগেছে, টেরই পাইনি!

    চারটে বাড়ি পরে তোমার বাড়ি, তোমার ঘরের জানালা আমার চলাফেরার পথে হলেও চোখে তুমি পড়তে না। আসলে পাড়ায় ছিলে, হুল্লোড়ে আসরে উৎসবে ছিলে, নিত্য প্রয়োজনে সাইকেলে বাজারের থলিতে ছিলে, শুধু আমার পৃথিবীতে তুমি কোথাও ছিলেনা। কবে যেন তোমার মোটামুটি পাস করার রেজাল্ট বেরিয়েছিল, কবে যেন তুমি কোথায় দুরে কলেজে পড়তে চলে গিয়েছিলে। মাঝে মাঝে আমার মায়ের দুপুরের আসরে, তোমার মায়ের চোখে তোলা আঁচলে তুমি ছিলে। শেষে পরের দিকে তোমার মায়ের ছেলে নিয়ে নিরন্তর ঘ্যানঘ্যানানি শুনে শুনে বেজার আমার, বিরক্তিতেও তুমি ঢুকে পড়েছিলে, অস্বীকার করব না।
    আমার তখন ভালো রেজাল্ট, আমার তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে, আমি তখন মাটি থেকে কিছু ওপরেই থাকি। দশ বারো সব পেরিয়ে গেলাম, ক্লাস ফাইভের ভাবের গল্পের কথা মনে পড়লে হাসি পায়, ভাব জিনিসটার প্রতি অল্প করুণা মেশানো হাসি। নিজেকে এমন করে নিয়েছি যে আমার কাছে ভাবের গল্প করতে কেউ আসেনা, সোমা মুনমুনরা কেউ ফেল করে নীচু ক্লাসে, নয়ত পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এমনকি তাপসও আমার নাগাল পায়না আর, লড়াইয়ে অনেক পেছনে রয়ে গেছে। কেন জানি হারের হলুদ আলোয় হলদেটে নতমাথা তাপসকে আশেপাশে দেখলে তোমার মত কোনো একজনের কথা মনে মুহূর্তের জন্যে আসত। অথবা গীটার দেখলে?

    তারপর তো আমিও সব ছেড়েছুড়ে গেলাম চলে, অন্য আলোর দেশে। আমি গেলাম না, আমায় নিয়ে যাওয়া হল, তুমি, তোমার মত মনে না হওয়া, মনে হওয়া, সব কিছুকে ফেলে খুশীতে ডগমগ, আমি এলাম নতুন দেশে। বড় কলেজ, বড় রাস্তা, আলো ঝলমল চারধার। সেই আলোর ধাঁধানিতে আমি অনেক কাল পরে নিজেকে কিঞ্চিৎ ফ্যাকাশে পেলাম, তাপসের মত হলদেটে না হলেও অনেকটাই ম্লান। ভেবেছিলাম পুরনো যা কিছু সবের পাট চুকিয়ে এসে নতুনে মেতে যাব, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল এমনটা হলনা। ঘসেমেজে আলোর ঔজ্জল্য বাড়ানো গেলেও পিছুটান কিছু কিছু ডাক দিত মাঝে সাঝেই।

    সেবার ছুটিতে সেই প্রথম ফেরা, শুধু ঘরে নয়, মাটিতেও ফিরলাম যেন অনেকদিন পরে। আশপাশকে নতুন আলোয় দেখলাম, কাছে থেকে দুরে দুরে সরিয়ে রাখার পালাশেষে, হাতের নাগালকে ভালোবাসলামও সেই প্রথম। তোমার সঙ্গেও আমার প্রথম দেখা, সেই গ্রীষ্মে। তার আগে ছাই জানতাম কী আর যে আমার খোলা জানালা, আমার নতুন আকাশ বেশ কিছুকাল ধরে তোমারও বিচরণক্ষেত্র।
    ঝুমু তখন কাছেদুরে কোথাও নেই নাহলে কী জিজ্ঞেস করত কে জানে। দিদি, আমার সঙ্গী, নেই। আমি
    সকাল বিকেল তখন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি, তুমি আমায় নতুন শহুরে জীবনকে সহজ করে নেওয়ার নানা টিপস দাও। তোমার মা আর আঁচল চোখে তোলেনা বরং একই বিভুঁইয়ে পড়ুয়া দুইয়ের আসর দেখে খুশীতে ডগমগ হয়ে বলে, "দুজনে সব সময় পড়ার আলোচনা করে, পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বোঝেনা"।

    না, পড়ালেখার কথা তোমার সাথে বেশী হতনা, আমাদের বিষয় আলাদা। তবে কিভাবে কবে যেন তুমি আমার ভবিষ্যত গন্তব্য অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছ, সেই কচ্ছপের মত ধীর অথচ সুস্থির গতিতে। সেইসব দেখাঅদেখা চারপাশ নিয়েই যত কথা। অবশ্য পথে কোথাও আমার মারকাটারি রেকর্ড তুমি ছুঁতে পারনি, কোনোদিন আর পারবেও না চেষ্টা করলে, তোমার যে সে দিন গেছে চলে, তুমি আমার থেকে বড় না!
    তখন তুমি আমাকে মাঝে মাঝে পুরনো লোকেদের খবর দিতে, ইস্কুলের খবর। মেয়েদের কার কোথায় বিয়ে হয়েছে আর ছেলেরা কে কোথায় পড়ছে বা পড়ছেনা অথবা তোমাদের দলের কে কোন স্কুলে কী চাকরি পেয়ে গেছে। রীনাদির বিয়ে হয়েছে কিনা আমি জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কী ভেবেছিলে কে জানে, হুঁ তে জবাব সেরে দেবাশিসদা পড়া ছেড়ে কোথায় মধ্যপ্রদেশে কোন জঙ্গলে চাকরি নিয়ে চলে গেছে সেকথা জানিয়েছিলে, বেশ ক্ষোভের সাথে। আমি শুধু রীনাদির কথাই জানতে চেয়েছিলাম, গোমতী নদীর দিব্যি, আমি ইস্কুলের ভাব আড়ি নিয়ে ভাবতে অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিলাম।

    তোমার বাড়িতে তখন তোমার উচ্চশিক্ষার খুশী স্তিমিত হয়ে আসন্ন ভবিষ্যত ও চাকরির চিন্তায় আকুল সব। আমার সঙ্গে আগড়ম বাগড়ম বকে তুমি বোধহয় সেই চিন্তা থেকে সরে,কিছুটা মুক্তির আস্বাদ পেতে চাইতে।
    কলেজের প্রথম বড় পরীক্ষার রেজাল্ট আহামরি না হলেও ভালো ছিল, যদিও আমি তখন শহরের প্রতিদ্বন্দীদের চাপে মাটি ছুঁয়ে, ধরিত্রীর ভেতরে ঢোকার প্রবেশপথে। বাড়ির কেউ অখুশী ছিল না তার দুঃখও আরেকরকম, আমায় নিয়ে এদের আশা এত অল্প, এরা এত অল্পেতেই খুশী!
    এক ভরসা ছিল, তুমি অন্তত কোনো এক পাতাঝরা বিকেলে মন্দিরের গায়ে সাইকেল ঠেকিয়ে, মুখের ওপর থেকে হাওয়ায় ওড়া চুলের গোছা সরিয়ে কাউকে একটা বলবে কোনো একটা নাম, তুষার তাপস বা অন্য কোনো পরিচিতজনের। নাই বা চিনলাম আমি, তোমার চেনা কেউ থাকবে, যে অনেক অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। তুমিও, শেষে তুমিও, সাইকেলটাকে আমাদের রকে ঠেকিয়ে বাজারের থলিটা মায়ের হাতে দিতে দিতে বললে, পরের পরীক্ষাটায় ও অনেক ভালো করবে, মেক আপ করে নেবে, দেখে নিও ও অনেক বড় হবে।
    আমার চোখদুটো তখনো আকাশ দেখছিল, পা ভেতর উঠোনে দাঁড়িয়ে, কান ছিল তোমার উপেক্ষার অপেক্ষায়। আকাশটা তখনো নীল ছিল, শুধু আমার চোখ সরে মাটির পানে গেল আর কদবেল গাছের ওপর থেকে পাখি বলল "চোখ গেল", দেওয়ালের টিকটিকি বলল "ঠিক ঠিক"। মা কী বলল সে আর শুনিনি বা শুনে মনে রাখিনি, মন ভারী ছিল যে, বোঝা নাবোঝায়।

    গ্রীষ্ম আর পুজোর ছুটিতে তোমার আমার দেখাশোনা, মাঝখানের দিনগুলোতে কেউ কারোর খবর রাখিনা। সে আবার এমন দেখাশোনা, তাতে দুজনেরই মন থাকে কোথায়, চোখ কোথায় আর কথা কার সঙ্গে! দুজনে দুজনার সাথে নয়, আসলে কথা আমরা দুজনেই শুধু নিজেদের সাথে বলতাম, দোসর উপলক্ষ্য ছিল।
    একদিন সেই সিঁড়িটায় যেখানে রোজ সকাল বিকেল তুমি বসতে বাজারের বা অন্য কোথাকার আড্ডাশেষে বাড়ি ফিরে, যেখানে তোমাকে দেখলে আমি গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতাম নীচের ধাপে, সেখানে দেখি অন্য কে বসে। হতাশ মন ফিরতে গেলে তুমি ডাক দাও।
    আলাপ করিয়ে দাও কৃতী আত্মীয়, দারুন রেজাল্ট করা একজনের সাথে, আমার বিষয়ে বিষয়ী একজন। রাগ হয়, আমার চেয়ে ভালো খোঁজার অভ্যেস আর তোমার গেল না! ভালো মানুষের মত অচেনা আলাপে পড়াশোনার কথা কইতে কইতে মনে মনে স্থির করে নি, কোনোদিন এর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে,দিতেই হবে জবাব তোমাকে।
    সেই বেঞ্চমার্কের চোটেই কী কেন কে জানে, শেষ পরীক্ষায় আবার হৃতগৌরব ফিরে পাওয়ার পালা। ছুটির মাঝে রেজাল্ট বেরোলে তা জানতে তুমিই ছুটেছিলে, অথচ ছুটেছিলে যে আমায় জানতে দাওনি। তুমি যে আমার খেয়ালীপনাকে খেয়াল করতে তাও জানতাম না তার আগে পর্যন্ত। কীভাবে আন্দাজে একটা একটা করে কাছাকাছি সমস্ত রোল নাম্বারের রেজাল্ট হাতে লিখে এনেছিলে পাতাভরে, যত্নে। অনেকটা সময় আর অসীম ধৈর্য্য না হলে হয় না এ কাজ, এও আগে ভাবিনি, এই ভাবলাম।

    উঠোনে মাদুরে বসে রোদ পোয়াচ্ছিলাম আমরা কজন। পরদিন সকালে রেজাল্ট জানতে কলকাতা যাওয়ার কথা আমার। তুমি এসে পাশে বসে পড়লে হাতের কাগজ মেলে। ওভাবে অত কাছ ঘেঁসে বসায় আমি অবাক ও বিরক্ত। তোমার চোখমুখ চাপা উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। "এই দ্যাখ রেজাল্ট, আমাকে বলতে হবেনা, তুই দ্যাখ।"
    আমি দেখি, তাকিয়ে দেখি নীলকালিতে তোমার হাতে আঁকা আমার ভবিষ্যতের ছবি। গায়ের রোদের চাদরে ফুটে ওঠে খুশী আনন্দের ঝিলমিল আর তাই জড়িয়ে পরদিন নয় তখনি রওনা হই। সামনে চোখ তাই তোমার দিকে তাকানোই হয়না, তুমি পাশে ছিলে যে। খেয়াল করে আমার থেকে ভালো খোঁজা এবার শেষ করো বলতেও মনে থাকেনা। আর সময়ের কথা সময়ে না বললে কে না জানে তা নাবলাই থেকে যায়, জীবনভোর।

    শহুরে প্রতিদ্বন্দীরা ছিটকে গেছে, আমার গ্রীষ্মে শরতে বাড়ি যাওয়া কমে এসেছে, পিছন ফিরে দেখার অবকাশ বড়ই কম। পড়া শেষ করে তুমিও এদিক ওদিক নানান চেষ্টায়, মাটি খুঁজতে ব্যস্ত। ঝাপসা সেসব দিন, আমি তোমার খবর রাখিনি। তুমি রাখতে, আমার আসার পথ চেয়ে না থাকলেও খোঁজ নিতে, দিনক্ষণ জানলে খুশী হতে, খুব আলগোছ কোনো মন্তব্যে কারো মুখে হঠাৎই জেনেছি আবার ভুলেও গেছি। তোমার বড় হওয়া ছোট হয়ে তখন আমার বেড়ে ওঠার দিন।

    মসৃণ রাস্তায় স্পীডব্রেকার থাকে চালক ও যাত্রীদের সুরক্ষার জন্যে, জীবনে যে স্পীডব্রেকারের কী দরকার হয় তা আজও আমার বোঝা হলনা। যেখানে থামার দরকার ছিলনা সেই মোড়েই একদিন থামালো জীবন আমাকে। অনেকদিন পরে তুমিও পাশে, তুমিও থেমে গেছ একই মোড়ে। সামনের মাঠটাতে শামিয়ানার মধ্যে তখন তোড়জোর চলছে, ব্রাহ্মণ পুরোহিত, নানা লোকের আনাগোণা। সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রাণপন, একপাশে দাঁড়িয়ে, গুনগুন করে কে যেন কত কী বলে চলেছে, তিলকাঞ্চন ও ষোড়শের পার্থক্য, আমি আর পারছিলাম না।
    তুমি এসে হাত ধরে নিয়ে গেলে তোমার ঘরে, সেই প্রথম। বিছানার ওপর সেই জানালাটার ধারে বসালে, যে জানালাটা আমার চলাফেরার রাস্তায় পড়ত, যার মধ্যে দিয়ে হয়ত তোমাকে দেখা যেত। কিন্তু আমি কোনোদিনও তাকাবার কথা ভাবিনি। জানালাটা দিয়ে রাস্তা মাঠ শামিয়ানা সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই প্রথম, সেই প্রথম আমি আর কোথাও যেতে চাইলাম না, শুধু তোমার পাশে ঐ জানালার ধারে বসে থাকতে চাইলাম, সারাদিন, সারারাত, সারাজীবন। আমার রেজাল্টের বই, চোখ ধাঁধানো শহর, উজ্জ্বল সব বন্ধুবান্ধব, ততোধিক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি, সব কিছু ছাপিয়ে ঐ বিছানার স্পর্শ দিয়েছিল যে নির্ভরতা তা আর কিছুতে কোনোদিনও পেলাম না।

    ঝুমু থাকলে কী জিজ্ঞেস করত জানিনা, তবে আমি হয়ত জানতে চাইতাম যে কথা আমি বটপুকুরের ধারে ওকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবিনি, তুমিও কি আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে?
    ঝুমু শুধু আমাকে লক্ষ্য করেছিল, তোমায় করেনি? ঝুমু ছিলনা তবে আমি তখন তার কথা ভেবেছিলাম, সোমার কথা, মুনমুনের কথা। আমি সেদিন চেয়েছিলাম ওরা এসে আমার ভাবের গল্প করুক, নাহলে আর ভাব কিসের!
    তুমি চুপ করে বসেছিলে চেয়ারে, তোমার অনেক কাজ ছিল বাইরে, খাওয়াদাওয়া, ব্রাহ্মণবিদায়ের দেখাশোনা, বাড়ির সবার, মায়ের, তোমার ওপর অনেক ভরসা, তাই দায়িত্ব পেয়েছ অনেক। তবু তুমি গেলেনা ছেড়ে, আমাকে। আমিও যেতে বললাম না, বলতে পারলাম না, যাও। কত জনম পরে বোধহয় নাকি যুগের পরে, তোমার গলা শুনতে পাই, যেন কোন সুদুর থেকে, "আমাকে একটু যেতে হবে, তুই এখানেই থাক, আমি ফিরে আসব এক্ষুনি।"
    - "রীনাদির সঙ্গে তোমার ভাব ছিল?"
    আমার অনেক কিছু মনে নেই, মনের মত করে মনে তুলে রাখিনি হয়ত, তবু তোমার সেই অবাকবিস্ময়ে হতচকিত ভাবের মুখটা মনে আছে। দরজার কাছে যেতে গিয়ে কী ভেবে ফিরে এলে, বাইরে কারা তোমায় ডাকছিল। আমার হাতটা এসে শক্ত করে ধরলে, খুব শক্ত, এখনো চোখ বুজে ভাবলে ব্যথা করে ওঠে, হাতে না হলেও মনে, কোনোখানে,
    -"না।" তারপর খুব দ্রুত ব্যকুল গলায় আবার বলে উঠেছিলে, "ফিরে আসব, এক্ষুনি, থাকিস"।

    তুমি ফিরে এসেছিলে, বারে বার, থমকানোর মুহূর্তগুলোতে আমার ঠিক পাশটিতে, এখনো তুমি ফিরে আস। আমি কি ছিলাম? হয়ত হ্যাঁ, হয়ত না, কে জানে!
    যা জানিনা, শুরু শেষ কিছুই নেই যার, তাকে নিয়ে লেখা হয় না। হয় লেখা নিজেকে নিয়ে, অথবা নিজেকে হেলাফেলা করে, ভুল বুঝে, না বুঝে?
  • sosen | 111.63.238.227 | ১৬ মার্চ ২০১৪ ১০:২৭469236
  • তুলে দিলাম
  • সিকি | ১৬ মার্চ ২০১৪ ১২:০৫469237
  • এগুলো তো মিস করে গেছি দেখছি!
  • phutki | 122.79.37.130 | ১৬ মার্চ ২০১৪ ১৭:৫২469238
  • আরে। আমিও মিস করে গেছিলাম।
  • sosen | 212.142.113.65 | ১৪ মার্চ ২০১৫ ১৩:৩৯469240
  • এই কলুষহীন, নির্মল লেখা ও লেখিকাকে বড়ো মিস করি।
  • sosen | 212.142.113.65 | ১৪ মার্চ ২০১৫ ১৩:৪১469241
  • এই দোলেও খুঁজে গিয়েছি। সময় হয়নি লেখার-বলে যাই।
  • Tim | 101.185.27.124 | ১৪ মার্চ ২০১৫ ১৩:৫৭469242
  • শ্রাবণীদি তো গুরুতে অনেকদিনই আসেনা। সোসেনকে ক, হ্যাঁ ভীষণ মিস করি এই কলম।
  • Sarbani | 236712.158.8990012.177 | ২৩ আগস্ট ২০১৯ ১২:৫৭469243
  • বসন্ত বর্ষা দিনে...............
    -------------------------------------

    “মা বাইরে তাকিয়ে দেখ না, বৃষ্টি হচ্ছে?”

    “হচ্ছে, কিন্ত জোরে নয়, উঠে পড়।“

    “আর পনের মিনিট, মা। তুমি দশ মিনিট পরে আবার জানালায় যেও। যদি দেখ প্রাইমারির ছেলেমেয়েরা ফিরছে, তাহলে ডেকো না, তাহলে রেনি ডে। যদি না ফেরে তাহলে ডেকো।

    “রেনি ডে হলেই বা কী? সকাল সকাল উঠে পড়, বাড়িতেই পড়বি। আর এক মাস পরে তোর ফার্স্ট টার্ম না?

    এ কথার জবাব দিতে গেলে সকালের মিষ্টি আলতুসি ঘুমটা মাটি হয়। ঝিমলি মুখের ওপর চাদরটা টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুল।

    মা গজগজ করতে করতে মশারি খুলতে থাকে। ক্লাস টুয়েলভের পড়া, এত কম পড়ে কী করে হয় কে জানে। স্কুল টুকু বাদ দিলে সারাদিনই তো হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে নয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, অথবা গল্পের বইয়ে মুখ দিয়ে বসে আছে। এত বন্ধু যে কোত্থেকে আসে, আবার কারুর না কারুর জন্মদিনের পার্টি লেগেই আছে। আজকাল নাকি এরপরে সব আলাদা হয়ে যাবে বলে, জন্মদিন পালনের বেশী ঘটা। রাত্রি দশটা এগারোটায় সবাই ঘুমোতে গেলে, তিনি আলো জ্বালিয়ে বই খাতা নিয়ে নাকি পড়তে বসেন । অত রাতে কী ছাই পড়া হয় অমন করে কে জানে!

    এদিকে টিভিতে কাগজে সব ভালো রেজাল্ট করিয়েদের কথা লেখে, সেসব ছেলেমেয়েরা কত কত ঘন্টা পড়ে দিনে, কতজনের আবার একবছরেই সব স্কুলের সিলেবাস শেষ হয়ে এখন শুধু এন্ট্রান্সের প্রস্তুতি চলছে, শুনলেও কান জুড়িয়ে যায়। আর ইনি তো বোধহয় পারলে বারো ক্লাসটাও ফেল মারেন!

    “মা, ছটা বেজে গেছে, তুমি ডাকনি কেন? দেরী হয়ে গেল।“

    মা হাসে।

    “উঠে কী করবি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। স্কুলে ফোন করেছিলাম, রেনি ডে দিয়ে দিয়েছে। তুই তখন বললি তো, রেনি ডে হলে ডেকো না। “

    “এমা, বলেছিলাম নাকি? ওমা, আমার মনে নেই, কী মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখলাম মা, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, হ্যাঁ মা?”

    “ওঠ,বিছানাটা ঝাড়ি। আমি জানিনা, আমার কোনো স্বপ্ন মনে থাকেনা, তাই সত্যি হয়েছে কিনা জানিনা। তা, কী এমন স্বপ্ন দেখলি তুই, যার জন্যে এত আহ্লাদ? স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে? তোকে আর পড়তে হচ্ছেনা?”

    ঝিমলি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পেছন থেকে মায়ের গোলা জড়িয়ে ধরে,

    “কী যে বল মা, সবসময় শুধু স্কুল আর পড়া। আমি কি এত ফাঁকিবাজ নাকি? অনুর থেকে কম।“

    “শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল আর তোমার অনু”, ছাড়, আমার গলায় লাগছে।“

    “মাম্মা, শোন না, দেখলাম, খুব বৃষ্টি হচ্ছে, একদম ঝম ঝমিয়ে। আর আমি আবার ছোট্ট হয়ে গেছি, এ্যালবামের ছবির মত। একটা চারিদিক খোলা গোল বারান্দায় আকাশী রঙের ফ্রক পরে, তুমি একটা সুন্দর নতুন শাড়ি পরে আমার মাথায় ফিতে দিয়ে ফুল বাঁধছ। ফিতে টাকে থুতনি থেকে দুই গালেতে জড়িয়ে, মাথায় তুলে ফুল বানাচ্ছ, আমি হাসছি আর বলছি, মা আজকে গোলাপ, আজকে গোলাপ। তোমার শাড়ীর কী সুন্দর গন্ধ। এমন সময় দাদা একটা সাদা তুলতুলে কুকুর নিয়ে এল, আর বাবু কোথা থেকে এসে বলল,

    “আজ বৃষ্টির ছুটি, আমরা আজ খিচুড়ি খাব।“

    হঠাত বৃষ্টির ঝাট এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে, অথচ আমাদের জামা ভিজছে না, কোথা থেকে দিদি মিনুদি সবাই এসে আমরা হাত ধরে গোল হয়ে ঘুরছি, আর বৃষ্টিও আমাদের সাথে গোল হয়ে ঝরছে। কী মিষ্টি না মা?”

    মার মুখটা কেমন নরম হয়ে এসেছিল শুনতে শুনতে। প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে, জোরে জোরে বিছানার বেডকভারটা ঝেড়ে পাতে।

    “এর আর সত্যি হবার কী আছে মা। তুমি কী আবার ছোট হতে চাও? এমনিতেই তোমার ঠিকঠাক বড় হবার লক্ষণ খুব একটা দেখতে পাই না আমরা।
    বড় হলে কী আর সকালবেলা এইভাবে ঘুমিয়ে আর গুলতানি করে নষ্ট করতে, বারো ক্লাসের মেয়ে যে কী করে এমন ঘুমাস! আর ওইরকম ফিতে ঘুরিয়ে ফুল আমি তোর মাথায় বানাতাম যখন তুই ভেজা বারান্দায় পা পিছলে পড়ে থুতনি ভেঙেছিলি, চার বছর বয়সে, এমনি বর্ষা দিনে। সে গল্প তোমার অনেকবার শোনা। বাইরে ফেরিওয়ালার ডাক শুনে দৌড়েছিলি।

    ওরকম ছোট থেকেই মা তোমার হাতে পায়ে লক্ষ্মী ছিল, দিনরাত কিছু না কিছু বাধাতে তো।“
    ............

    “এই বাদলায় আবার বেরচ্ছিস কেন। এমন দিনে কুকুর বেরালও রাস্তায় বেরয় নি।“

    “বা রে আজ বেস্পতিবার না, আমি অনুর বাড়িতে পড়তে যাই না আজ! রোহিত কালকে ওর স্যারের কাছে যে অঙ্কগুলো করেছে সেগুলো আমাদের করায় তো আজ। “

    “কাল করে নিস।“

    “কাল আমি ফিজিক্স পড়তে যাব গুপ্তা স্যরের কাছে। বৃষ্টি হচ্ছে না এখন,চলে যাই। ফেরার সময় হলে সাইকেল ওখানে রেখে রিক্সায় চলে আসব। তুমি বরন রিকশা ভাড়া দাও আর ভেলের জন্য দুটাকা। সিনেমা হলের সামনে থেকে ভেল কিনে নিয়ে যাব, দুজনে খাব।“

    মা একটু দ্বিধায়। পড়ার থেকে বন্ধুর সাথে আড্ডার টান বেশী, সে তো বোঝাই যায়। তবে স্কুলের পরে প্রতি বেস্পতি বার ওখানে যায় এটাও ঠিক। অঙ্কে খুব একটা খারাপ নয়, বরং ওটাই একটু ভালোবেসে করে। আড্ডার সাথে একটু পড়া যদি হয়, তাই সই। ঘরে থাকলে বরং কিছু করবে না।

    “এই ভাত খেয়েছিস এখনই ভেল খেতে হবেনা। আমার অত পয়সার গাছ নেই। দু টাকা দিচ্ছি, একটাকা কুড়ি রিকশা ভাড়া।“

    ঝিমলি মুখটা নীচু করে মায়ের মুখের কাছে নিয়ে আসে, চোখের পাতায় মেঘ নেমে আসে, গলার স্বর ভারী,

    “মা, আমাদের পয়সা নেই মা? আমরা গরীব?”
    মা একটু সরে গিয়ে হাত তুলে হেসে এক থাপ্পড় দিতে, মুখ কুঁচকে হি হি করতে করতে দুড়দাড় সাইকেল নামায় লনের কাদায়।

    গেটে প্রিয় বান্ধবী দাঁড়িয়ে, উদাস বাউল মুখে, চোখ দূরে বাস্প ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসা খালের ব্রিজের পানে। সামনে জমিতে জমা জলের আয়নায় কালচে ধূসর আসমানের প্রতিচ্ছবি। বুক ধুকপুক, সাইকেল থেকে একলাফে নামে। হাতের ঠেলায় প্রাণ ফিরে পায় মূর্তি, এতক্ষণ থেমে থাকা মুখের ভেতর বাবল গামের ঠেলা বাবল ফাটিয়ে নিজেকে মানবী প্রমাণ করে। হাসিতে, একটু বা অভিমানে,
    “ এত দেরী করলি, আমি তো ভাবছিলাম আসবি না।“

    ঝিমলির মুখ ছোট হয়ে আসে উদ্বেগে আর শঙ্কায়,

    “কেন? ফোন এসে গেছে?“

    অনু কিছু বলার আগেই সামনের ঘর থেকে ফোনের রিং বেজে ওঠে , রিন রিন রিন। দুজনে দৌড় পড়িমরি করে, জীবন মরন শমন। কেউ এসে পড়ার আগে তুলতে হবে রিসিভার। সাইকেলটা ঠিকমত স্ট্যান্ডে লাগানো হয়না, ধড়মড়িয়ে পড়ে যায়.........কেউ দেখেনা।

    “ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়?”

    “আজ এখানে দারুন বৃষ্টি হয়েছে, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি।“
    ----------------------------
    “সকাল বেলা রেনি ডে। মা ডাকেনি, আমিও ঘুমিয়েছিলাম আর স্বপ্ন দেখলাম, মিষ্টি মোমের মত স্বপ্ন।“
    -----------------------------
    “একটা রাস্তা, অনেকদুর চলে গেছে। আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? রাস্তারা কি চলে যায় না একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার তো মনে হয় ওরা চলে, চলতেই থাকে, আঁকাবাঁকা সোজা সে যেমনই হোক, পথ তাই সবসময় সুন্দর হয়।, পথে নামলে খুশীতে ভরে প্রাণ ।“
    ----------------------------------
    “জানো, দুধারে সারি সারি গাছ। আমাদের ক্যাম্পাসের মত, আবার ঠিক এক নয়, আলাদা। প্রথমে দেখলাম বৃষ্টি, ঘন, নিঃশব্দ। আমি একা ভিজে চলেছি। তুমি পাশে এলে, কোথা থেকে কে জানে। তোমার সেই ব্লু উইন্ডচিটার টা। মাথায় হুড তোলা, চশমার কাঁচে জলের ঘাম। আমি ভিজছি, তুমি শুকনো, আমার হাতে বৃষ্টি, আমার মনে ভয় মেশানো অভিমান, তুমি হাল্কা পায়ে এই বোধহয় পেরিয়ে গেলে আমায়!”
    -------------------------------------
    “হঠাত বৃষ্টি বরফ হয়ে গেল। সাদা সাদা গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ, তোমার গায়ে কোথা থেকে একটা ব্রাউন ওভারকোট, সেই যেমন তোমার বাবা পরেন। তুমি এবার কোট খুলে আমাকে দিলে, আমরা দুজনে একটা কোটে, হেঁটে চলেছি বরফ কেটে......রাস্তাটা কী দারুন একটা শান্ত, শান্তি বুলিয়ে দেয় গায়ে মাথায়.........”
    --------------------------------------
    “ধ্যাত, রোমান্টিক আবার কী! রোমান্টিক কেন হতে যাবে। মিষ্টি স্বপ্ন। তুমি আজকাল কেমন ভীষণ বড়দের মত কথা বল, ভাল্লাগে না। “
    ------------------------------------
    “হ্যাঁ, অনুকে বললে এখনি বলবে এটা “লেপার্ড ইন দ্য স্নো” র সিন। আমি ওকে মোটেই বলব না স্বপ্নের কথা।“
    -----------------------------------
    “কিন্তু তুমি বুঝছ না। এটা একটা ক্যাম্পাসের স্বপ্ন। আমি তো এমনিতে কিছুতেই তোমার ক্যাম্পাসে চান্স পাব না। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হলে যদি কিছু হয়।“
    -----------------------------------
    “হু, করব। এবার থেকে আগরওয়াল গুলো ভালো করে করব। আমার যে ওই রাস্তা, ওই গাছগুলো ওই বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ হয়েছে।“
    ---------------------------------
    “নাঃ । ওই ছোটবেলার সেই পুরনো উইন্ডচিটার আর বাবার কোট, ছিঃ। ওই রাস্তায় আমি একাই চলব কাউকে লাগবেনা, এক যদি “লেপার্ড ইন দ স্নো” র হিরো টা এসে যায়, তো ভাবা যাবে। “
  • Sarbani | 236712.158.8990012.177 | ২৩ আগস্ট ২০১৯ ১৩:০২469244
  • এই শারদপ্রাতে .....................
    ________________________________
    এই হিমালয়ঘেরা শহরটাতে পুজো আসার সাথে সাথে চারদিক থেকে হিমেল হাওয়ার দল উঁকিঝুঁকি মারে।সারাদিন নানা শোরগোলে আর লোকের ভিড়ে পুজোমন্ডপের চারধার বেশ সরগরম থাকলেও সন্ধ্যে হতে না হতেই ঠিক শীত না তবে হিম ভাব।আরতি শেষে ফাংশন শুরু হলে প্রথম দিকটায় ভিড়টা চারিদিকে মাঠের ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আস্তে আস্তে ঘন হয়ে আসে শামিয়ানার নীচে। একটু রাতে বাড়ি ফেরার সময় হাল্কা একটা পাতা পোড়ার গন্ধ মেশে রাত কি রানীর মাতাল গন্ধে, টুপটাপ হিম ঝরে গন্ধরাজের পাতায়, আর ঝিমলির মন কেমন করে, কারণ তার ভালো বোঝা যায়না, তবু করে, অন্তত ওই সরস্বতী মন্দির থেকে বাড়ির আধো অন্ধকার পথ চলার ক্ষণে তো করেই।

    এবার পুজোয় তার কিছু করার তেমন ছিলনা। এমনিতেও সে কোনো বছরই ফাংশনের দিকে ঘেঁসেনা খুব একটা, ওই অনন্ত রিহারসাল পর্ব তার মোটেই পছন্দ নয়। আসলে বাঁধাধরা সময়ে কোন কিছু করতেই ঝিমলির ভালো লাগেনা। সেই কারনে এতকাল কোথাও টিউশনই পড়ে উঠতে পারল না। এবার বারো ক্লাস বলে জোর করে শরাফ স্যরের কাছে অংক করতে পাঠানো হচ্ছে, খুব নিমরাজী হয়েও যাচ্ছে, খারাপ লাগলেও নিজেই মনকে বুঝিয়ে যায়।

    প্রতিবারেই তাকে আন্টিরা ধরে নাচ বা গান কিছু করার জন্যে, সে ঠিক ম্যানেজ করে কেটে বেরিয়ে আসে। এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়ির লোকেরাও খুব সাহায্য করে। তাকে না বাগাতে পেরে আন্টিরা কেউ বাড়িতে এলে মা বা বৌদিই বারণ করে দেয়।অবশ্য এতে স্কুলের কৃতিত্বও কম নয়। ক্লাস সেভেন থেকেই তাদের সেকেন্ড টার্মের পরীক্ষা পুজোর আগে আগে হয়। বাড়ির লোকের বক্তব্য যে পরীক্ষার সময় রিহার্সাল চললে যেটুকু পড়ে সেটুকুও হবেনা।
    তাহলে অন্য ছেলেমেয়েরা কি করে সব সামলায়? পুজো ও পরীক্ষা তাদের কি নেই? তারা সব লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে, এ বাড়ির এনার মত অমনোযোগী আর ফাঁকিবাজ তো দুটি নেই এ শহরে!

    আন্টিরা এর পরে আর তেমন জোরাজুরি করতে পারেনা। তবে এও সত্যি যে ঝিমলি যদি তেমন গুণের গুণবতীটি হত তাহলে কি আর আন্টিরা এত সহজে ছেড়ে দিত! নেহাত বাঙালীর সংখ্যা কম এমনিতে তার ওপর আবার তাদের বয়সী একেবারেই আজকাল কমে গেছে, নাহলে আন্টিদের বয়ে গেছে ঝিমলিকে সাধাসাধি করতে।ছোটবেলায় সে তবু কিছুটা উৎসাহ নিয়ে রিহার্সালে যেত, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা যেত, পড়ায় ফাঁকি দেওয়া যেত, বদলে একটু গ্রুপ ড্যান্স বা কোরাসে গলা মেলালেই হয়ে যেত। বড় হয়ে যবে থেকে স্বাবলম্বী হয়েছে, সাইকেল তুলে একা একা বেরনোর ঢালাও পারমিশন, আড্ডা মারার অনেক দরজা খুলে গেছে, এখন পুজোর বাঙালীদের ফাংশনের প্রস্তুতি তাকে আর টানেনা।

    তবু এবারে অবস্থা বিপাকে তাকে ঢুকতেই হল। বাসু আন্টির এবারের নাটক ছিল অন্যরকম, একেবারে নতুন অভিনব পরিকল্পনা। সপ্তমীর দিন প্রতিবারেই বড়দের বাংলা নাটক থাকে, এবং পরিচালনা ও অভিনয় দুইয়েই আন্টি নিজে থাকে, বরাবর, নাটক আন্টির প্রাণ।অষ্টমীর দিন ছোটদের নাটক নাচ ইত্যাদি, সব বাংলায়।নবমীর দিন পুরোপুরি হিন্দিভাষীদের জন্য যাকে বলে কালচারাল প্রোগ্রাম, নবরাত্রি স্পেশাল। এই একটি দিনের জন্য তেমন কোনো খাটুনি নেই বাঙালী কর্মকর্তাদের। স্কুলগুলিতে যেসব বাঙালী শিক্ষিকারা আছেন তারাই যে যার স্কুলের প্রতিযোগিতার সেবছরের সেরা প্রোগ্রামগুলি, নৃত্যনাট্য বা নাটক যে কোন কিছুর রিপিট শো এর ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও কিছু না কিছু করে, নবমীর আইটেমের অভাব সচরাচর হয়না।

    তা এইবারে আন্টির নাটকে সব মেয়ে চরিত্র। তাও আবার বাংলা উপন্যাসের সেরা নারী চরিত্ররা এক এক করে এসে একক অভিনয় করবে, নাটকের নাম তাই “একই অঙ্গে এত রূপ”। রিহার্সাল ভালোই চলছিল কিন্তু মাঝখানে বাধল গোল। মাম্পিদি লখনউতে কিসে একটা চান্স পেয়ে গেল, এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে এবং পুজোতে আসতে পারবেনা। মাম্পিদি ডাক্তারকাকুর মেয়ে, শহরের বঙ্গালী ডাক্তার। পড়াশোনায় খুবই সাধারণ ছিল, ঝিমলি ওর দুঃখ বোঝে, ডাক্তারের মেয়ে সবাই ধরেই নিয়েছিল ডাক্তার হওয়া অবধারিত।

    সে জায়গায় মাম্পিদি কোনরকমে সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট হয়েছে, কোথাও মাস্টার্সে চান্স পাচ্ছিলনা, মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াত। আন্টি অনেক ধরে বলে মাম্পিদিকে রাজী করিয়েছিল ওই রোলটা করতে, কারণ একমাত্র ওই চরিত্রটারই বয়স কম, আন্টিরা করলে ভালো দেখাবেনা। অন্যান্য চরিত্রের জন্য এক একজন সব আন্টি ছিল আর বাসু আন্টি নিজে দুটো চরিত্রে। আড়ালে অন্যরা বাসু আন্টিকে নিয়ে নানা মজা করে, সবাই সেদিন মন্দিরের পেছনের ঘরে রিহার্সালে এসে হাসাহাসি করছিল যে পারলে আন্টি নাকি সব চরিত্রই নিজে করতে চায়, সবার ভুল ধরছে শুধু নিজে নাকি দারুন করছে, আপন প্রশংসায় পঞ্চমুখ!

    রীনা কাকীমা আবার মুখচোখ ঘুরিয়ে সেদিন আন্টিকেই বলল, "হ্যাঁ দিদি পটেশ্বরী বৌঠান তো খুব সুন্দরী, আপনাকে বৌঠানের চরিত্রে একটু কেমন লাগছে না?"
    আন্টি সত্যিকারের শিল্পী, এসব কথাবার্তায় পাত্তাই দেয়না, সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “আরে এইসব সুন্দরী মেয়েগুলো দু লাইন সংলাপই মুখস্থ করতে পারেনা, ভাব তো দুরের কথা, এদের পটেশ্বরী বৌঠান করতে দি কিভাবে। আমাকেই মেকআপ আর অভিনয়ে ম্যানেজ করতে হবে, কী করব!” জবাব শুনে রীনা কাকিমার মুখের ভাব দেখে ঝিমলির দারুন মজা লেগেছিল, এই না হলে ।।।।।।।।।।।।!

    আন্টিকে সে ভালোবাসে, মানে বাসতেই হয়, তাই তো নিয়ম। মাম্পিদি যাওয়ার পরে আন্টি একেবারে ধরে পড়ল, ওর পার্টটা ঝিমলিকে করতে হবে। ঝিমলি তো কিছুতেই রাজী নয়। এদিকে এবারে আন্টির কাতর অনুরোধে বাড়ির লোকেরাও গলে জল, তাছাড়া এগারো ক্লাসে টার্ম পরীক্ষার সময় পালটে গেছে, সর্বোপরি টেনের বোর্ড খারাপ নামেনি, তাই দুরছাই ভাব একটু কমতির দিকে।

    তবু সে একবার শেষ চেষ্টা করে এত বাংলা সংলাপ সে একসাথে বলতে পারবেনা। কিন্তু আন্টি সে অজুহাত উড়িয়ে দিল, আরে মাম্পি মুখস্থ করে ফেলল আর তোর মত বুদ্ধিমতী মেয়ে পারবিনা এই কটা লাইন মুখস্থ করতে।

    আর না করা গেল না, আন্টি প্রায় কাঁদকাঁদ। সিকোয়েন্সটা নষ্ট হয়ে যাবে এটা বাদ দিলে, আর আমরা সব যা মুটকির দল, একেবারে মানাবেনা ফিংফিঙ্গে এই মেয়ের রোলে, খুব বোকা বোকা লাগবে।

    শেষমেশ ওই চিরতার জল গিলতেই হল। একটাই রক্ষে, স্কুলের বা ক্লাসের পাবলিক এদিন ফাংশনে কেউ থাকবেনা, বন্ধুরা তার কেউই বাঙালী নয়। বাঙালী গ্রুপে স্কুলের এখন যারা তারা সবাই অনেক জুনিয়র, বড়দের নাটক দেখতে বসার চান্স কম, দেখলেও বুঝবেনা। আন্টি বলেছে যদি সংলাপ ভুলে যায় মাঝে, ঝুড়িটা কোমরে তুলে নিয়ে একটু নেচে নেচে ঘুরে বেড়াতে। বাসু আঙ্কল আর ধর আন্টি মিলে প্রতিটা অংকের শুরুতে চরিত্র নিয়ে বলবে ব্যাক স্টেজ থেকে, আর ভূমিকার শেষে আলো কম হয়ে চরিত্র মঞ্চে প্রবেশ করবে।দরকার হলে নাকি সংলাপ ভুলে যাচ্ছে মনে হলে ইশারা করতে, আলো কমিয়ে দিয়ে ওরাই আড়াল থেকে বলে দেবে কলাইন!
    অবশ্য পরে শুনল এরকম কোন প্ল্যান ছিলনা, আন্টি তাকে সাহস দিতে এসব মন থেকে এমনিই বলেছিল।

    যাইহোক, দারুন হল কিন্তু নাটক, সবাই খুব প্রশংসা করছে। আন্টির অভিনয় তো যাকে বলে দুর্দান্ত, ঝিমলি এসব উপন্যাস কিছুই পড়েনি, তবু ব্যাকস্টেজ থেকে অবাক হয়ে দেখেছিল আন্টিকে, মাতাল পটেশ্বরীর দুঃখ কী বিষয় কিছু না জেনেই বুকের ভেতরটা কেমন হা হা করে উঠছিল আবার সেই মহিলাই যখন ডাইনী হয়ে ফিরে এল, সাদা কাপড়, খোলা চুল আর জ্বলন্ত চোখে, সেও কেমন দুঃখেরই, অন্যরকম কষ্ট সারা শরীর চুঁইয়ে চুঁইয়ে চারপাশে দুঃখডোবা যেন।

    পুজোটা সেই সপ্তমীর রাত থেকে কেমন যেন মনকেমনীয়া হয়ে গেল। অষ্টমীর অঞ্জলি শেষে খাবার স্টলগুলোতে চেনা জটলার দিকে তাকিয়ে চেনা মুখ না দেখে বুক হু হু করতে লাগল। নবমীর সকালে দাদা সিভিল লাইন্সের বইয়ের দোকান থেকে আনন্দমেলা নিয়ে এসে হাতে দিতে, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ভাষায় গোগ্রাসে গিলতে না বসে বইয়ের তাকটায় তুলে রাখল। সবাই লক্ষ্য করে একটু অবাক বা অপ্রস্তুত। প্রতিবারে এই বই পড়া নিয়ে প্রচুর বকুনি খেতে হয়, না শেষ করা অবধি খাওয়া নেই ঘুম নেই।সকালে তো ভোগ খাওয়া এ কদিন, রাতে খাবার টেবিলে শুনতে হল,
    “হ্যাঁরে সত্যি বড় হয়ে গেলি নাকি, আনন্দমেলা পড়ছিস না?“

    বড় হওয়া নিয়ে এত কথা শুনতে হয়, যে ঝিমলি আজকাল কানই করেনা।তার সব কাজেই বাড়ির সবার মনে হয় বয়সোচিত হল না। ঝিমলির সবচেয়ে প্রিয় জেমস আর পপিন্স, এখনো, এটা নিয়েও বয়সের খোঁটা দেয় সবাই, কমিক্স আর ন্যান্সি ড্রু নিয়েও। এমনকি বারো ক্লাসে ফেল করার পরে তার বিয়ের আয়োজনের আলোচনাতেও মনে করানো হয় তত্বে জেমস আর পপিন্সের ট্রে রাখার কথা !

    এবার দ্যাখো কেমন লাগে বড় হলে!

    পুজো শেষে শুরু হয় বাড়ি বাড়ি বিজয়া সম্মিলনীর ঘটা। খাওয়া দাওয়া ভালো হয় বলে এগুলো মন্দ লাগেনা। ঘুগনি, চপ, লুচি মাংস, বাড়িতে বানানো বাঙালী মিষ্টি, আন্টিরা সব কম্পিটিশনে নেমে পড়ে এ কদিন। আড্ডাটা তেমন পোষায় না, তার বন্ধু কেউ থাকেনা। সে চুপচাপ গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসে খেয়ে একসময় আস্তে করে বেরিয়ে পড়ে আসর থেকে। আসরে সে একেবারেই বসেনা, সেখানে যত বড়দের গান হুল্লোড় গল্প আড্ডা চলে। ভুলক্রমে বসে পড়লে তাকে দেখলেই দাদা বা আর কারোর হঠাত মনে হয়, ঝিমলি কিছুই করেনি সারা পুজোয় অতএব বিজয়া পার্টিতে সে গান গাইবে।
    সেই সব ক্ষণগুলোতে ঝিমলির মনে হয় মানুষের দাদা থাকে কেন কে জানে!
    আসরে তাকে পাকড়াবে সবাই আর দাদা অবধারিত বলবে, “ঝিমলি একটা গান খুব ভালো গায়, গা তো সখী ভাবনা কাহারে টা”।এতদিনে সারা শহর জানে ঝিমলি ওই একটা বাংলা গানই জানে। অনেক বকাবকি অনুরোধ উপরোধের পরে ঝিমলি কখনো সখনো এটি গেয়েছে। একটাই রক্ষে যে গাইতে শুরু করিয়ে দিয়ে সবাই গল্পে মত্ত হয়ে যায়, ফলে সে দু চারটে লাইন বাদ দিয়ে শেষ করে দেয়। তখন শুরু হয় আর এক নাটক, সবাই না শুনেই বলবে আহা কী ভালো গায়, ওকে গান শেখালে না কেন।
    ব্যস, শুরু হয়ে যাবে সে এক পাঁচ বছরের পুরনো বিলাপ।ক্লাস ফাইভে তাকে পাঠানো হয়েছিল বর্ধন স্যরের কাছে গান শিখতে। বর্ধন স্যর লখনউর “হচ্ছি” বাঙালী, তাদের স্কুলের মিউজিক টীচার, তাছাড়া শহরের একমাত্র ক্ল্যাসিকাল গায়ক। তিন চার মাস আ আ করে ইমন আর বসন্ত শেষে অন্যান্য টিউশনের মত এটিতেও ইতি হয়।মোটামুটি এই দুটির ওপর দিয়ে সে বাকী বছরের পরীক্ষা পাস করে যাওয়ায় গান শেখা গলা সাধা এসব কষ্টকর পদ্ধতির দিকে আর পা বাড়ায় নি। তার মধ্যে তেমন প্রতিভাও নিশ্চয়ই স্যর দেখেননি কারণ পরবর্তীতে গান ছাড়ার আক্ষেপ শিক্ষক বা ছাত্রী দুজনের কারো মধ্যেই দেখা যায়নি। তবুও মাঝেসাঝে অতর্কিতে এই সখী ভাবনা কাহারের খাঁড়া ঝিমলির ওপর এখনো নেমে আসে, এবং এ ব্যাপারে তার ঘরের শত্রু দাদাই!

    বাসু আন্টির বিজয়া সম্মিলনীর আগে এবার শুধু নাটক আর নাচের দলকে ডাকল চায়েতে। আহা, পুজো আর দেওয়ালীর এই সময়টা দুপুর বিকেলগুলো যা দারুন হয়। রোদ ঝলমল, ঠান্ডা মোলায়েম হাওয়া, বাতাসে নানারকম সুন্দর গন্ধ ভাসে, ইউক্যালি আর হাস্নুহানা। বিকেলে সাইকেল নিয়ে ক্যানালের ধার দিয়ে দিয়ে অনেকদুরে কালভারটের ওপর বসে সূর্যাস্ত দেখতে বড় ভালো লাগে। আন্টির বাড়ি যাবেনা যাবেনা করেও শেষ অবধি গেল। মন ভালো নেই, একেবারেই নেই। আচ্ছা পুজোয় বাড়ি আসা যাবেনা যখন তখন আর বাংলার আই আই টিতে পড়ে কী লাভ! দিল্লিতে পড়া যেত না! নানারকম চিন্তায় চোখ কেমন ভিজে যায় আর নাক ফিচফিচ করে। কালকেও মা ধরে মধু তুলসী খাইয়ে দিল, খানিকটা, খামকা, বলতে পারলনা ইহা আসল সর্দি নহে!

    আজকের আসরে লোক কম, তবে আন্টি নিজে দারুন রান্না করে। কত কী বানিয়েছে, মীট বল ওর ফেভারিট। আন্টি জোর করে অনেকটা তুলে দিল, কিন্তু খেতে যে একদম ইচ্ছে করছেনা। আজকে সবাই এমনকি রীনা কাকিমাও আন্টির খুব প্রশংসা করল। আন্টি আজ খুব খুশী, ঝিমলিও একদম না ভুলে পুরো সংলাপ বলেছে, এত কম সময়ে তৈরি করে উতরে দিয়েছে, সবাই ওকেও ভালো বলল। আন্টি আবার বলে, বারো ক্লাস হয়ে গেলে তোকে আমার নাটকে বড় পার্ট দেব। এত দুঃখেও একটু হেসে ফেলে সে, বারো ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা তো তারও তবে আন্টি ভাবতেও পারেনা সে কোন রোল নিতে চলেছে আগামী দিনে।

    মেজাজ শরীফ হওয়ার জন্যে না তার ওপর সদয় হওয়াতে, বা যে কোনো কারণেই হোক হঠাত আন্টি বলে ওঠে, “ঝিমলি তোর সেই গানটা গা তো, বাইরেটা কী সুন্দর লাগছে।তুই গা তারপরে সবাই এক এক করে গাইবে।“

    কী যে হল তার, আজ যেন বারণ করতেও ভুলে যায়। বসার ঘরে মোড়াতে যে জায়গাতে সে বসে, সেখান থেকে ভেতরের ঘরটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ব্রুস লী র ছবির ওপর র‍্যাকেট গুলো আড়াআড়ি টাঙানো, জানালা দিয়ে পড়ন্ত বেলার একফালি রোদ তেরছা হয়ে এসে পড়েছে, “তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা.........সখী ভালোবাসা কারে কয়”। এই প্রথম কোন আসরে তার গানে পিন পড়া নৈশব্দ।

    গান শেষে কেউ কোন কথা বলে না প্রথমটায়, তারপরে আন্টিই সামলে নিয়ে বলে, “কী ভালো গাইলি রে মেয়ে, তোর মা ঠিক বলে মহা ফাঁকিবাজ তুই, গানটা শিখলি না কেন যে।“ সোমবতীকে ডেকে হইচই করে আঙ্কল তাকে একটা স্পেশাল দইবড়া দিতে বলে। পরের গান শুরু হতে প্লেট হাতে ও বেরিয়ে আসে বাইরে, সবুজ লনের ওপর দিয়ে হেঁটে শিউলি গাছটার দিকে যায়, নীচে ছড়িয়ে আছে সকালের ঝরা শিউলিরা। ইস কেন যে “মন কেমন করে” গানটা জানিনা, সদ্য গাওয়া গানের জন্যে, না জানা গানের কথা মনে করে না কী ঝরা শিউলির দুঃখে, হু হু করে কেঁদে ফেলে, শিউলিতলায় বসে।

    একটা রিকশা থামার শব্দ গেটে। উমনো ঝুমনো চুল, সেই রঙ চটা ব্লু জ্যাকেট আর পিঠের রুকস্যাক, রিকশাওয়ালা কে পয়সা দিতে দিতে বাড়ির দিকে আনমনে তাকানো। ঝিমলি ভেসে চলে শরতের হাওয়ায়, শিউলি রাঙা বিকেল গায়ে জড়িয়ে কনে দেখা আলোয়, দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে গেটে, এমনও হয়, গল্পের মত সত্যি?
    ঘরের ভেতরে ভট্টাচার্য জেঠু তখন গান ধরেছে, “এবার হর এলে পরে বলব উমা ঘরে নেই”।
  • Sarbani | 236712.158.8990012.177 | ২৩ আগস্ট ২০১৯ ১৩:১১469245
  • আমি ঝিমলির গল্প গুলো একসাথে রাখছি একটু দরকারে, আশাকরি টই কিছু সময়ের জন্যে ভাসলে অসুবিধে নেই।
  • র২হ | 236712.158.895612.138 | ২৩ আগস্ট ২০১৯ ১৪:১০469246
  • কিছু সময় কেন, এসব টই তো সব সময়ই ভেসে থাকলে ভালো।
    সক্কালবেলা প্লেনের জানলা দিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসতে দিগন্তবিস্তৃত নদীর জলে ঝকমকে রোদ দেখে ভাবছিলাম, শরৎকাল। এই টইএর শেষ পোস্ট দেখে মনে হলো।
  • SANTANU | 237812.68.564523.240 | ২৩ আগস্ট ২০১৯ ১৪:৫৬469247
  • আপনারা ক্যানো এমন লেখা এখানে বন্ধ করে দিলেন?
  • | ২৪ আগস্ট ২০১৯ ০৯:১৭469248
  • আরে বাহ!
  • গবু | 124512.101.780112.209 | ২৪ আগস্ট ২০১৯ ১০:৫৩469249
  • ভাসুক ভাসুক - এই রকম টই সবসময়ই ভেসে থাকা ভালো।

    গুরু জনের প্রতি - ক্যাটাগরি আর পিনড থ্রেডের সুবিধে পেলে জমে যেত ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন