অতএব দেখা যাচ্ছে, ভগবান যিশুর ভারতবাস যথেষ্ট ঘটনাবহুল। ইজরায়েলের আগেই, তিনি ধর্মপ্রচারের সূচনা করেছিলেন এই ভারতেই, অন্ততঃ বৈশ্য এবং শূদ্র বর্ণের অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে। যদিও তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে যাওয়াতে তাঁর এদেশেও প্রাণনাশের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর নিজের দেশেই হোক অথবা ভারতে, সব দেশেই পুরোহিত সম্প্রদায় এবং রাজন্যবর্গদের চরিত্র যে একই, ধার্মিক ভারতে এসে অন্ততঃ এটুকু স্পষ্ট উপলব্ধি তাঁর হয়েছিল। ... ...
আজ থেকে মাত্র কয়েকশ’ বছর আগে (১৭৫৬-৫৭ সি.ই.), নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সরিয়ে ক্লাইভ ও তাঁর অনুগত মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাতে বণিক মহতাব চাঁদ ও স্বরূপ চাঁদের (ইতিহাসে যাঁরা “জগৎ শেঠ” (Banker of the World) উপাধিতে বিখ্যাত) ভূমিকা এবং তাঁদের বিপুল অর্থব্যয়ের হিসেব জানলে চমকে উঠতে হয়। অতএব রাজাকে রাজা বানিয়ে তুলতে (king-maker) বণিকসম্প্রদায়ের প্রভাব আজও যেমন আছে, সে সময়েও ছিল – এমন অনুমান করাই যায়। ... ...
তাঁর নির্দেশের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষ, অতএব তিনি মাগধী প্রাকৃত এবং আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নির্দেশগুলিতে। এর অপরিসীম গুরুত্ব বুঝে সংস্কৃতর পাশাপাশি গড়ে উঠতে লাগল প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা এবং তাদের নিজস্ব লিপি। অর্থাৎ আজ আমি বাংলাভাষায় এই যে লেখাটি লিখছি এবং আপনি যে সেটি পড়ছেন, তার পিছনে সম্রাট অশোকের অসাধারণ এই অবদান স্বীকার করে আমরা যেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় প্রণত থাকি। ... ...
শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, নন্দরাজারা সেচ ব্যবস্থার জন্যেও বহু ক্যানাল এবং জলাধার নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজ্যের সমস্ত ভূমি এবং ভূসম্পদ ও জলসম্পদের অধিকারী যে রাষ্ট্র এবং সেই যাবতীয় সম্পদই যে করযোগ্য ভারতবর্ষে সে ধারণারও প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন নন্দরাজারাই। ... ...
দীক্ষিতের প্রথম পাঠ নির্দিষ্ট মাপের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে লোকালয়ে ভিক্ষা করা। ভিক্ষাপাত্র একবার পূর্ণ হলেই লোকালয় থেকে আশ্রমে ফিরতে হত। সেখানে সকলের সঙ্গে বসে সেই ভিক্ষালব্ধ খাদ্য নিবিষ্ট মনে আহার করতে হত। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিক্ষা গ্রহণের এই প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু হত দীক্ষিতদের সাধনা। এই সাধনায় দীক্ষিতের অহংকার, লোভ ও ঔদ্ধত্য বিনাশ হয়, বাড়ে ধৈর্য এবং মানসিক স্থিতি। ... ...
স্বস্তি জোড় হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, নিচু হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, “গুরুদেব, আজকে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন?” গৌতম আরও এগিয়ে স্বস্তিকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই? ঠিক কী রকম লাগছে বল তো?” স্বস্তি গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক কী বলতে পারব না, তবে একদম অন্যরকম। আপনি যেন কোন নক্ষত্রের মতো। সবে ফুটে ওঠা পদ্মফুলের মতো। কিংবা... কিংবা... গয়াশীর্ষ পাহাড়চূড়ার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো”। ... ...
মানুষের শৈশব ও বাল্য চেতনায় যে শিক্ষার বীজ রোপিত হয় – কৈশোর ও তারুণ্যে নিজের মস্তিষ্কের রসায়নে সেই শিক্ষাতেই সে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খুঁজতে থাকে। কেউ হয় অত্যাচারী এবং বিলাসী রাজা, কেউ মানবদরদী সমাজ-সংগঠক, কেউ দার্শনিক, কেউ দারুণ যুদ্ধবাজ, আর অধিকাংশ হয়, আমাদের মতো থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনের অধিকারী। মস্তিষ্কের এই বিশেষ রসায়নের ফর্মুলাটি আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ... ...
ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নিচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। ... ...
যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে। ... ...
ইতিহাস চর্চা করত করতে যদি মাথা ঝিমঝিম করে এবং ছাত্রজীবনের যত দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় - তাহলে পড়ে ফেলুন "অচিনপুরের বালাই" - অচেনা মনের গোপন "খপর"ও তার কাছে ঠিক ধরা দেয়। ... ...