স্বস্তি জোড় হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, নিচু হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, “গুরুদেব, আজকে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন?” গৌতম আরও এগিয়ে স্বস্তিকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই? ঠিক কী রকম লাগছে বল তো?” স্বস্তি গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক কী বলতে পারব না, তবে একদম অন্যরকম। আপনি যেন কোন নক্ষত্রের মতো। সবে ফুটে ওঠা পদ্মফুলের মতো। কিংবা... কিংবা... গয়াশীর্ষ পাহাড়চূড়ার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো”। ... ...
মানুষের শৈশব ও বাল্য চেতনায় যে শিক্ষার বীজ রোপিত হয় – কৈশোর ও তারুণ্যে নিজের মস্তিষ্কের রসায়নে সেই শিক্ষাতেই সে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খুঁজতে থাকে। কেউ হয় অত্যাচারী এবং বিলাসী রাজা, কেউ মানবদরদী সমাজ-সংগঠক, কেউ দার্শনিক, কেউ দারুণ যুদ্ধবাজ, আর অধিকাংশ হয়, আমাদের মতো থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনের অধিকারী। মস্তিষ্কের এই বিশেষ রসায়নের ফর্মুলাটি আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ... ...
ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নিচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। ... ...
যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে। ... ...
ইতিহাস চর্চা করত করতে যদি মাথা ঝিমঝিম করে এবং ছাত্রজীবনের যত দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায় - তাহলে পড়ে ফেলুন "অচিনপুরের বালাই" - অচেনা মনের গোপন "খপর"ও তার কাছে ঠিক ধরা দেয়। ... ...
এই দ্বিতীয় পর্বের প্রাককথায় বলেছিলাম, প্রতিটি উত্তরণ হল সভ্যতার অসীম সিঁড়ির এক একটি ধাপ। আমাদের সমাজের বেশ কিছু মানুষ এই পর্যায়ে এসে সভ্যতার অনেকগুলি ধাপ খুব দ্রুত পার হতে পেরেছিল, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও রপ্তানির বাজার মন্দা হওয়ার কারণে, তারাই আবার বেশ খানিকটা পিছিয়ে দিল আমাদের সভ্যতার অগ্রগতি। ... ...
সাম্রাজ্যই হোক বা কোন উদ্যোগই হোক, তার সাফল্য এবং দীর্ঘস্থায়ীতা নির্ভর করে প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর। আমার বিস্ময় এখানেই, কোন প্রশাসনিক দক্ষতার জোরে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এমন একটা উদ্যোগকে এত দীর্ঘ সময় সাফল্যের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল? আমার বিশ্বাস – এই প্রশাসন চালাতেন নির্বাচিত কোন গণসঙ্ঘ বা বুধমণ্ডলী। তাঁদের এতদিন ধরে সগৌরবে টিকে থাকার রহস্য হল বন্ধুত্বপূর্ণ নিবিড় যোগাযোগ। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল – যুদ্ধ নয়, রাজ্য জয় ও ক্ষমতার লিপ্সা নয় - মৈত্রী এবং সহযোগীতা। যার সূচনা করেছিলেন, পিতা পশুপতি, মাতা মিত্তিকা এবং বিশ্ভাই। ... ...
পরিবারে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের যে সমমর্যাদা এবং সমদক্ষতার অবস্থান ছিল, সেখান থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে, কৃষিসমাজের পরিবারগুলি পুরুষপ্রধান - পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠল। মেয়েরা এখন জন্ম থেকেই পরের ঘরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতে থাকল। অতএব আগের মতো দক্ষ শিকারী, অরণ্যচারী হওয়ার থেকে মেয়েরা এখন রূপচর্চা করে, কোমল ও পেলব অবলা নারী হয়ে উঠতে শুরু করল। তাদের সঠিক বরে এবং ঘরে বিয়ে দেওয়াটাই হয়ে উঠল পরিবারের অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয়। ... ...
একদিকে ইতিহাসের একঘেয়ে গল্প - অন্যদিকে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা, একটু হাসাহাসি হলে মন্দ হয় না। ফচকে এই নাটকটি আশা করি হাসির হাল্কা স্পর্শ দেবে আপনার মনে। ... ...
তখনকার বণিকেরা এতটা শিল্প সম্মত মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিতে শেখেনি, কিন্ত তাদের সামগ্রীর বাস্তব বিজ্ঞাপন করাটা অবশ্যই জরুরি ছিল। কারণ গ্রামের সাধারণ মানুষদের কাছে সে সময় ব্রোঞ্জ সামগ্রী, তেল, গাভী ও বলদ কিংবা মূল্যবান পট্টবস্ত্র ছিল, একেবারেই নতুন এবং অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অতএব আমার এই কল্পনা, অলীক অবাস্তব নয়। আমরা প্রকৃতিজাত অনন্য এক প্রাণী - হোমোস্যাপিয়েন্স, সেদিনও ছিলাম, আজও আছি। সে সময় ব্যবসায়ীরা মনোহারী সত্য কথায় মানুষকে প্রলুব্ধ করেছিল, এখন ব্যবসায়ীদের মনোহারী নির্জলা-মিথ্যা কথায় আমরা প্রলুব্ধ হই, তফাৎ এইটুকুই। ... ...