এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  কাব্য  তর্জমা

  • কবি চন্দ্রাবতীর জীবন ও সাহিত্য

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    কাব্য | তর্জমা | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৩৭৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মৈমনসিংহ গীতিকা পড়তে পড়তে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তখন হাইস্কুলে পড়ি। কত সহপাঠীকে দেখেছি পড়া ফাঁকি দিয়ে প্রেম করতে। আমরা যখন দিনে ষোলো ঘন্টা, আঠারো ঘন্টা পড়ছি তখন ওরা চুপি চুপি প্রেম করে বেরাচ্ছে। কেউ কেউ ইলেভেনে উঠেই পালিয়ে বিয়ে করত। যাদের সে সাহস নেই তারা দুটিতে মিলে জুটি বেঁধে আত্মহত্যা করত কখনও গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে তো কখনও বিষ খেয়ে। একবার প্রেমিকা বিষ খাওয়ার পর কষ্ট পাচ্ছে দেখে ভয়ে সে আর খায়নি। বেচারা প্রেমিকা মারা গেল।

    আর একটা ঘটনা ছিল ! পালিয়ে বিয়ে করার পর বাড়ির লোক মেনে না নেওয়ায় ছেলেটি মেয়েটিকে ত্যাগ করেছিল। তার আগে গর্ভপাত করাতে ভোলে নি স্বামী থুড়ি প্রেমিক। পালানো মেয়ে কে বাপের বাড়ির লোক ঘরে নেইনি আর শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটি এক সহৃদয় প্রতিবেশীর কাছে আশ্রিতা হয়ে ক'দিন ছিল। সে আর কাউকে বিয়ে করে নি। পরে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চরকায় সুতা কেটে দিন চালাত। মেয়েটি প্রতারকের লজ্জা হয়ে বেঁচে ছিল। আত্মহত্যা করে নি।

    মৈমনসিংহ গীতিকার দেওয়ানা মদিনা পালা পড়ে মনে হল মদিনা দুলালের কাছে অবহেলিত হয়ে আত্মহত্যা না করলেই পারত। ছোট ছেলেটার কথা ভেবে বেঁচে থাকতে পারত। বাবার থেকে পাওয়া যে জমিতে দুলালের সঙ্গে চাষ আবাদ করে সংসার চালাত, সেই জমিতে ফসল ফলিয়ে ছেলেকে নিয়ে জীবন ধারণ করতে পারত। মলুয়া বাপের বাড়ি ফিরে আসতে পারত, সে রাস্তা খোলা ছিল তার। তবু অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। সোনাই নিজেই স্বামী শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে খেটে খেতে পারত।

    মৈমনসিংহ গীতিকার যে ক'টি প্রেমের গল্প আছে তার বেশিরভাগই প্রেমিক প্রতারণা করেছে প্রেমিকার সঙ্গে। মদিনা সঙ্গে দুলাল করেছে, মলুয়ার সঙ্গে বিনোদ করেছে, চন্দ্রাবতীর সঙ্গে জয়ানন্দ করেছে। চন্দ্রাবতী ছাড়া বাকিরা আত্মহত্যা করেছে। সোনাই সুন্দরী অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। লীলা ভুলবুঝে আত্মহত্যা করেছে।

    শুধু চন্দ্রাবতী আত্মহত্যার কথা ভাবেনি। চন্দ্রাবতীর বাড়িতে তখন বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। পাত্র প্রেমিক জয়ানন্দ। বিয়ের দিনে খবর পেল জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করতে আসবে না। অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। সে মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিজের ধর্মও ত্যাগ করেছে। সামাজিক প্রথা অনুযায়ী চন্দ্রাবতী লগ্নভ্রষ্টা হল কিনা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা তাঁর প্রেমিক তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করল। চন্দ্রাবতী আত্মহত্যা করতেই পারত, অন্তত মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যান্য নায়িকাদের মত। চন্দ্রাবতী এই আঘাতের পর সারাজীবন বিয়ে না করে থেকেছে। হয়ত পুরুষের প্রেম, ভালোবাসার প্রতি ঘৃণা এসেছিল তাঁর। চন্দ্রাবতী শুধু কুমারী থাকেনি, বাবার কথা মত সাহিত্য চর্চায় আত্ম নিয়োগ করেছেন। শিব উপাসনার পাশাপাশি লিখেছেন রামায়ণ। লিখেছেন দেওয়ান ভাবনা পালাগান, মলুয়া পালা, দস্যু কেনারামের পালা। বাবা মনসামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কবি ও গায়ক দ্বিজ বংশীদাস জানতেন মেয়ে পারবে। তাঁর পদ্মাপুরাণের কিছু অংশ মেয়ে লিখেছিল যে!

    চন্দ্রাবতী পেরেছে। জয়ানন্দ সেদিন চন্দ্রাবতীকে বিয়ে করলে তার একটা সংসার হত আর গোটা কতক সন্তান হত। তার চেয়ে বেশি কিছু জয়ানন্দ দিতে পারত না। কিন্তু জয়ানন্দের আঘাত চন্দ্রাবতীকে অমূল্য সম্পদ দিয়েছে। চন্দ্রাবতী এক রামায়ণ রচনা করেই ইতিহাস তৈরি করেছেন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একমাত্র মহিলা কবি হিসাবে চন্দ্রাবতী র নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাঁর রামায়ণ পড়লে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। তাঁর রামায়ণে সীতার দুঃখের কথা, সীতার জন্ম কথা, সীতার প্রতি রামের চরম অমানবিক আচরণের কথা লেখা আছে। রাম সেখানে দুর্বল প্রেমিক, অমানবিক স্বামী আর লোভী রাজনীতিবিদ। মধুসূদন দত্তের জন্মেরও বহু আগে রচিত এই রামায়ণ শুরু হয়েছে রাবণের রাজমহলের বর্ণনা দিয়ে। সীতা সরমার বন্ধুত্বের কথাও লিখেছেন এখানে। সীতা এখানে রাবণ পত্নী মন্দোদরীর কন্যা। তবে রাবণের ঔরসে জাত নয়। মন্দোদরীর একার কন্যা। কী নারীবাদী আধুনিক মানসিকতার পরিচয়!

    এই রামায়ণের কাহিনি অবশ্য জাভাদেশেও প্রচলিত। কাশ্মীর সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত।

    মৈমনসিংহ জেলার কিশোর গঞ্জ অঞ্চলে এই সমস্ত কাহিনি বহুদিন থেকে ছড়িয়ে আছে। সেখান থেকে হয়ত চন্দ্রাবতী এই কাহিনি সংগ্রহ করে থাকবেন। তবে বর্তমানে এই অঞ্চলে চন্দ্রাবতী রামায়ণ বেশি প্রচলিত। মেয়েদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন এই রামায়ণ পড়ে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে নিজে ঐ অঞ্চলের গিয়ে দেখে এসেছেন, শুনে এসেছেন সেই রামায়ণ। এই রামায়ণ নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রসিডেন্সি কলেজে, আশুতোষ কলেজে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে,নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা ভারত ঘুরে আঞ্চলিক রামায়ণের বিভিন্ন রূপ খুঁজে বার করলেন। দক্ষিণ ভারতের মল্লিকা নামের এক শূদ্র কবির রামায়ণ পড় লেন। বক্তৃতায় তুলনা করলেন সেই সব রামায়ণের সঙ্গে চন্দ্রাবতীর রামায়ণের। তার বক্তৃতা পরে বই হয়ে প্রকাশ পায়। এই অঞ্চলে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে, রীতিমত গবেষণা করে পরিচালক রাশেদ চৌধুরী চলচ্চিত্রে চমৎকার রূপ দিয়েছেন তাঁর 'চন্দ্রাবতী কথা'য়। তার আগে অধ্যাপক স্বপন সাহা কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজনায় 'কবি চন্দ্রাবতী' ছবি করেন।

    সম্প্রতি গবেষক কোয়েল চক্রবর্তী চন্দ্রাবতীর জীবন ও রামায়ণ নিয়ে বই লিখলেন। লিখলেন রামায়ণের সার্বিক এক ইতিহাস। মৈমনসিংহ গীতিকার নয়ানচাঁদ ঘোষের চন্দ্রাবতী পালাগান আর রামায়ণ নিয়ে একটি বই বার করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি। চন্দ্রাবতীকে জানতে এই বইগুলি অবশ্য পাঠ্য। চন্দ্রাবতীকে জানলে বোঝা যাবে সে আঘাতের পরিবর্তে জয়ানন্দকে কী আঘাত ফেরত দিয়েছে। চন্দ্রাবতীর জীবদ্দশায় জয়ানন্দ আত্মহত্যা করেছে। চন্দ্রাবতী আত্মহত্যা করলে জয়ানন্দের কী হত বলা যাবে না তবে জয়ানন্দের আঘাত ছিল শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতের মত। যে আঘাতে হীরাকে কেটে সঠিক রূপ দেওয়া হয়, উজ্জ্বল করা হয়। চন্দ্রাবতী আজ উজ্জ্বল!

    প্রেম এমন হোক যেখানে প্রতারক আত্মহত্যা করতে চাইবে প্রতারিতা নয়। প্রতারকদের আঘাতে নিজেকে আরো উজ্জ্বল করতে শিখিয়েছে চন্দ্রাবতী সেই ষোড়শ শতকে এই বাংলায় বসে। তাই চির উজ্জ্বল হয়ে আছেন চন্দ্রাবতী চরিত্র মৈমনসিংহ গীতিকার সব নারী চরিত্রকে ম্লান করে দিয়ে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • কাব্য | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৩৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন