এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  শিক্ষা

  • শিক্ষানীতির অশিক্ষা ও সর্বজনীন প্রশ্নের দাবি

    কুমার রাণা
    আলোচনা | শিক্ষা | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৯৯৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)

  • একত্বের উপাদান, বিভাজনের প্রক্রিয়া
    কয়েকদিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম –ফ্রাইডে নাইট প্ল্যান। সিনেমার চরিত্ররা মুম্বাই-র একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী। ঝকঝকে স্কুল, ছাত্রছাত্রীর মা-বাবারা প্রভূত অর্থবান, সকলের গাড়ি আছে। স্কুলেই ব্যবস্থা আছে, উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর ছাত্রছাত্রীদের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হতে সাহায্য করার। স্কুলের পরামর্শকেন্দ্র থেকেই সেই সব কলেজে ভর্তির ফর্ম পূরণ করিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই –তারা জানে মা-বাবার টাকা আছে, সেই টাকায় তারা বিদেশে পড়াশুনো করে দেশে বা বিদেশ কোনো না কোনো মোটা মাইনের চাকরি পাবে। সিনেমার পটভূমিটিকে সচ্ছন্দে মুম্বাই থেকে বদলে দিল্লি, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, এমনকি কোনো কোনো জেলা শহরেও নিয়ে আসা যায়। কাঞ্চনমূল্যে প্রতিভা তৈরি অজস্র ছোটবড় কারখানা এখন আর কোনো বিসদৃশ, লজ্জার ব্যাপার নয়, বরং, সমাজ এই ব্যবস্থাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মস্তিষ্কে জায়গা করে দিয়েছে। যারা এই বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে, তাদের অনুপাতটি কম হতে পারে, কিন্তু, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জোরে তারা সংখ্যাগত লঘুত্বকে সহজেই অতিক্রম করে গোটা সমাজকে নিজেদের প্রতাপে প্রভাবিত করে।

    সেই প্রভাব নামতে থাকে দেশের হাজার হাজার সরকারি, এমনকি অনেক বেসরকারি স্কুলেও। যেমন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার একটি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল। ছাত্রছাত্রীরা খেতমজুর, গরিব চাষি, ভ্যান চালক, বা ছোট ব্যবসায়ী বাড়ির সন্তান। স্কুলে নিয়মিত ক্লাস হয়, শিক্ষকের সংখ্যা তুলনায় কম হলেও কাজ চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। অথচ, এখান থেকে পাস করার পর, কতজন যে শিক্ষাব্যবস্থায় টিকে থাকবে তার “গ্যারান্টি নেই।” “কেন নেই?” “এরা ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার, তার ওপর সবার মা-বাবা ট্যুশন দিতে পারে না, পারলেও কমজোরি মাস্টার দেয়, ভাল মাস্টার দেওয়ার ক্ষমতা নেই।” “স্কুলে কি লেখাপড়া হয় না?” “হয়, কিন্তু আমরা কী করতে পারি? এরা প্রাইমারিতে কিছু শিখে আসে না, এখানে আর কতটা শেখাব?” এ সবে সমস্যার তালিকা দেওয়া শুরু। পর্যবেক্ষক যত এগোবেন, ততই তিনি দেখতে পাবেন, এক বিশ্বাসের প্রতিমূর্তি, “টাকা ছাড়া বাচ্চার লেখাপড়া হবে না”।

    স্বাধীনতার পর থেকে সাক্ষরতার হার বেড়েছে –২০১১ তে পৌঁচেছে ৭৪ শতাংশে। ইস্কুল বেড়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে। শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে। ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত এই সহস্রাব্দের গোড়ায়, বেশ কটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেমন, ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্কের রচনা, ইস্কুলে ইস্কুলে রান্না করা খাবার দেওয়া, আইসিডিএস প্রকল্পের সর্বজনীন বিস্তার, এবং সর্বোপরি শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) পাশ। গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই সব পরিবর্তনগুলো এসেছে ব্যাপক আলোচনা-প্রত্যালোচনার মধ্য দিয়ে। এবং এর ভেতর দিয়ে বুনিয়াদী বিদ্যালয় শিক্ষার স্তরে একটা ইতিবাচক বদল ঘটেছে। সেটা হল, ইস্কুলে ভর্তির হার, উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়া। যে শিশুর মাতাপিতা নিজেরা কোনও দিন ইস্কুলে যাবার কথা কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁরা তাঁদের বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠাচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ মেয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে। ওপরে বলা, লেখাপড়ার দুরবস্থার কথা মেনে নিলেও এটাকে একটা অগ্রগতি হিসেবে মানতে হবে।

    আবার এই সব ইতিবাচক পরিবর্তনের বিপরীতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থদাতা সংস্থাগুলোর। শিক্ষাবিস্তার একটা সর্বাঙ্গীণ এবং নিরন্তর কাজ; অথচ, দাতা সংস্থাগুলোর নির্দেশ মেনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হল প্রকল্প-নির্ভর। এর হাত ধরে এল, আংশিক সময়ের শিক্ষক, বিকল্প শিক্ষাকেন্দ্র, ইত্যাদি । বস্তুত স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসটাই নানাবিধ নানা পোড়েনে ভরা, যার কারণে যে অগ্রগতি প্রত্যাশিত ছিল, প্রতিশ্রুত ছিল, এবং সম্ভব ছিল আমরা বস্তুত তার চেয়ে বহু যোজন পিছনে পড়ে আছি।

    শিক্ষার অধিকার আইন হয়েছে। স্কুলে মাইনে নেই। বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে, পোশাক দেওয়া হচ্ছে, খাবার দেওয়া হচ্ছে। তার পরেও বঞ্চনা বাড়ে কী করে? বাড়ার কারণটা নতুন কিছু নয়। যেমন, শিক্ষার অধিকার আইনের আওতা তো কেবল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবুও, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। অনেক নতুন স্কুল খুলল, অনেক বাচ্চা স্কুলের নাগাল পেল। কিন্তু, শিক্ষক? কিছু অস্বচ্ছতার অভিযোগ, মামলা-মকদ্দমা, আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যে কিছু নিয়োগ যদিও বা হল, প্রতি স্কুলের বাস্তব প্রয়োজন মেনে শিক্ষকের ব্যবস্থা হয়ে উঠল না। প্রাথমিক এমনকি উচ্চ প্রাথমিক স্তরেও এমন স্কুল দেখা যায় যেগুলো চলছে দু’জন মাত্র শিক্ষক নিয়ে, আবার এমন স্কুলও আছে যেখানে বাড়তি শিক্ষকের সংখ্যাটা দৃষ্টিকটু। প্রথম বর্গের স্কুলগুলো সাধারণত শহর থেকে দূরে, যেখানে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের সংখ্যাধিক্য, আর দ্বিতীয় বর্গের স্কুলগুলো শহর-গঞ্জের সহজ নাগালের মধ্যে।

    ছোট্ট একটি দেশ ভিয়েতনাম। ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বলিদানের মধ্য দিয়ে তার বিকাশ। সেই বিকাশে একটা প্রধান উপাদান ছিল, দেশবাসীর নেতা হো চি মিনের একটা উপলব্ধি: সকলের জন্য শিক্ষাই হচ্ছে দেশপ্রেম। আর ভারতবর্ষের কাছে দেশপ্রেম হয়ে দাঁড়াল প্রতিবেশীর প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণার বর্ষণ। শিক্ষার অন্তঃস্থিত অর্থকে সম্বল করে ভিয়েতনাম গড়ে তুলল এক উন্নত সমাজ, আর শিক্ষার নামে অশিক্ষাকে পুষ্টি জুগিয়ে ভারতের প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলা পশ্চাতের পানে।

    পশ্চাদগমনের উন্মত্ততা

    আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পশ্চাদগমনে উন্মত্ত এক সরকার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে টিকে থাকা শিক্ষার সীমিত অর্থটুকুকেও ধ্বংস করার উদযোগ করবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, এই উদযোগের ঘোষণা। আগের নীতিগুলোর মতোই এতেও সবার জন্য শিক্ষার সুযোগের অঙ্গীকার, শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি, শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা না করার হুঁশিয়ারি, ইত্যাদি ভাল ভাল কথা লেখা আছে। কিন্তু, তার পাশাপাশি বলে দেওয়া হল, একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিংশ শতাব্দীর পদ্ধতি-প্রকরণ চলে না, চাই নতুন দিশা, নতুন গতি। দলিলটির একেবারে গোড়াতেই, তৃতীয় প্যারাগ্রাফে, এই কথাটি স্পষ্ট করে লেখা:


    জ্ঞানের ভুবনে পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ তথ্যপভান্ডার (বিগ ডেটা), যন্ত্রগত শিক্ষা (মেশিন লার্নিং), এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নাটকীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলির কারণে বিশ্বজুড়ে নানা অদক্ষ শ্রমের কাজ যন্ত্রই করে দেবে, [মানব-শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না]। কিন্তু, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, সমাজ বিজ্ঞান ও কলাবিভাগের বিভিন্ন শাস্ত্রের বিবিধ দক্ষতার সংযোগে বিশেষত গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য বিজ্ঞান (ডেটা সায়েন্স) নির্ভর দক্ষ শ্রমের চাহিদা খুবই বেড়ে উঠছে।


    আপাতদৃষ্টিতে দলিলটি অত্যন্ত দূরদর্শী – আগামী কয়েক দশকে দেশে এবং বিশ্বে যে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কীভাবে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করা যায়, বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতির অভিমুখ সেইদিকেই।


    জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান দূষণ, এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ে চলার মধ্যে আমরা কী করে বিশ্বের শক্তি, জল, খাদ্য, এবং সাফাই-সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলো মেটাব সেই দিকে বেশ বড় আকারের চাহিদা দেখা দেবে, যেখানে জীবনবিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, জলবায়ুবিজ্ঞান, এবং সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক নতুন দক্ষ শ্রমের প্রয়োজন পড়বে।


    শুধু তাই নয়:


    মহামারী ও অতিমারীর ক্রমবর্ধমান উদ্ভবের কারণে ছোঁয়াচে রোগের মোকাবিলার জন্য যৌথ গবেষণা ও টীকা তৈরি করার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলো উঠে আসছে; এসবের ফল হিসেবে উঠে আসা সামাজিক বিষয়গুলো বিভিন্ন বিদ্যার সংযুক্ত চর্চার প্রয়োজনটাকে খুবই বাড়িয়ে তুলছে।


    তা বলে মানববিদ্যা ও কলাবিভাগের বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা,


    ভারত যেমন যেমন একটি উন্নত দেশ হিসেবে এবং বিশ্বের তিন সর্ববৃহৎ অর্থব্যবস্থা হিসেবে উঠে আসছে তেমন তেমন মানববিদ্যা ও কলাবিভাগের বিষয়গুলোর চাহিদাও ব্যাপকভাবে বেড়ে উঠছে।


    এই অভিমুখ হচ্ছে [ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রণীত] “সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৪-এ দেওয়া লক্ষগুলোকে মাথায় রেখে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এমন একটি আমূল পরিবর্তন আনা, যা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বে “অদ্বিতীয় করে তুলবে।” এটা করার জন্য এই নীতি “শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাসহ শিক্ষাকাঠামোর সমস্ত ব্যাপারে পরিবর্তন ও পুনর্গঠন করতে চায়।” এর “দিকনির্দেশক নীতি হচ্ছে ভারতের প্রাচীন ও চিরকালীন জ্ঞান ও চিন্তার সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার।”

    সন্দেহ করাটা শিক্ষার প্রধান একটা বৈশিষ্ট্য। গৌতম বুদ্ধ যেমন শিখিয়েছেন, “ সন্দেহ করাটাই সঠিক কাজ; যা সন্দেহজনক এবং যা স্পষ্ট নয় তাকে প্রশ্ন করাটাই সঠিক কাজ; যে কোনও সন্দেহজনক ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক হতে বাধ্য।” শিক্ষা বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সন্দেহের জন্মা দেয়। তদুপরি বর্তমান নীতিটির একদিকে প্রচণ্ড আত্মম্ভরিতা এবং অন্যদিকে এর ভিতরকার নানা স্ব-বিরোধিতার কারণে এর উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ ফল – দুই ব্যাপারেই সন্দেহ গভীরতর হয়।

    আত্মম্ভরিতা কেন বলছি? সারা দলিলে কোথাও বলা নেই, এটি কীভাবে তৈরি হল? কার কার সঙ্গে, কোন প্রক্রিয়ায় আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পোঁছোনো হল? এর আগের নীতিগুলোর মধ্যে অনেক খামতি থাকলেও প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে দেশবাসীকে জানাব্র মতো বিনয় ছিল। এটি সেদিক দিয়ে “অনন্য” – সোজা কাজের কথায় আসা গেছে, তার আগের প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি বাক্য নেই। স্পষ্টত, এটা সরকারের নীতি, লোকেদের গ্রহণ করা নীতি নয়। একে অশিক্ষা ছাড়া কী বলা যায়?

    স্ব-বিরোধিতার একটা উদাহরণ হল, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যকে দিশা মেনে নেওয়া। এই ঐতিহ্যে যেমন বুদ্ধ আছেন – যিনি বারবার মানুষের পুত্র এবং মানুষের কন্যাদের জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার কথা বলছেন – তেমনি আছেন দ্রোণাচার্য যাঁর রাজসেবাবৃত্তি একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নিয়ে তার অর্জিত বিদ্যা হরণ করে। আবার আছেন রাম, বেদপাঠের অপরাধে যিনি শম্বুকের মস্তকছেদন করেন। কোন ঐতিহ্যকে আমরা মানব?

    শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

    শিক্ষা মানুষের জাগতিক উন্নতির একটা উপায় ঠিকই, কিন্তু তার অন্তর্লীন মূল্য অনেক বেশি। সুভূতির প্রশ্ন ছিল, জ্ঞানলাভ করে কী লাভ হবে? গৌতম বুদ্ধের উত্তর ছিল, লাভের কথা না ভেবেই জ্ঞানলাভ করতে হবে – জ্ঞান নিজেই মূল্যবান। কিন্তু বর্তমান শিক্ষানীতিতে যেভাবে শিক্ষার কেজো দিকটাতে প্রচণ্ড জোর দেওয়া হয়েছে, এবং সেটাও খুব বেশি করে উন্নত বিশ্বের বাজারের কথা ভেবে তাতে সন্দেহ জাগে শিক্ষার নিজস্ব মূল্য বিষয়ে এই নীতি বোধ হয় খুব একটা বিশ্বাসী নয়। একদিকে বিগ ডেটা, মেশিন লার্নিং, আরটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদির ওপর জোর এবং অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হয়ে পড়া- এই দুটোর মধ্যে একটা যোগসূত্র দেখতে পাওয়া কঠিন নয়। এর সঙ্গে হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক থেকে এমন সন্দেহ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় যে, প্রাচীন ভারতের বর্ণাশ্রম প্রথার দিকে ফেরত নিয়ে যাবার একটা আকাংক্ষা শিক্ষানীতির রচয়িতারা পোষণ করেন। যারা গণিতে ফেল করবে, পদার্থবিদ্যা বা রসায়নে অনাগ্রহী হবে – তাদের চাষের কাজ, মাছ ধরা, গোপালন, ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে দাও। কথাটা এই জন্য বলছি যে, অদ্যাবধি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় গণিতে ফেল করিয়ে দেওয়াটাই রীতি হয়ে চলে এসেছে, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ইত্যাদিতে অনাগ্রহ তৈরি করাতে শিক্ষাপ্রক্রিয়া তৎপর ভূমিকা নিয়ে এসেছে। বর্তমান নীতিতে যে শিক্ষা প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাতে এর ব্যত্যয় হওয়া কঠিন। অন্তত শিক্ষক প্রশিক্ষণের যে নিদান দেওয়া হয়েছে তা থেকে এই আশংকাই দৃঢ় হয়। প্রথমত শিক্ষকদের দেখা হচ্ছে পরিষেবাপ্রদানকারী হিসেবে। তাঁরা যে শিক্ষার নীতি ও প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিগত ভূমিকা রাখতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করে, তাঁদের উদ্ভাবনী ভাবনাগুলোকে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার প্রভুত সুযোগ আছে –এমন কোনও ঈঙ্গিত নেই।

    শিক্ষার সংজ্ঞা হিসেবে মানুষের মনের মুক্তির যে ধারণাটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সেই ধারণাটা প্রায় বর্জিত হল। এক কথায় বলতে গেলে, শিক্ষার যে প্রধান দাবি, শিশুর মনের দিকে নজর দেওয়া সেই ধারণাটারই বিলোপ ঘটিয়ে দেওয়া হল। স্কুলে যাওয়ার আগে ট্যুশন, স্কুল থেকে ফেরার পর ট্যুশন, এক স্টারের কাছ থেকে আর এক মাস্টারের কাছে ছোটা – এই যাঁতাকলে শিক্ষার্থীর মনের বিকাশের সুযোগ বলে কিছু রইল না। রবীন্দ্রনাথ, সেই ১৯০৫ সালে আমাদের এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন, কিন্তু, সামাজিক-আর্থিক শ্রেণিবিভাগ ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার টান এতই প্রবল যে, শিক্ষাবিজ্ঞান হার মানল, জয়ী হল তথাকথিত বাস্তব চাহিদা।

    সে চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমরা যে জিনিসটার সঙ্গে সমঝোতা করে বসলাম, তা হল নজর। প্রতিটা শিশুর প্রতি আলাদা আলাদা দৃষ্টিপাত ছাড়া তাদের নিজস্ব বিকাশের পথ খুলে দেওয়া যায় না। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “শিশুর মন” নামক পুস্তিকাতে, রতন লাল ব্রহ্মচারী লিখেছিলেন,


    সব ছেলেমেয়ে কখনও সমান নয়। এক এক জনের মানসিক শক্তি এক এক দিকে বেশি পরিস্ফুট হয়। কেহ লেখাপড়ায়, কেহ গানবাজনায়, শিল্পকলায়, কেহ কলকব্জার কাজে অন্য সকলের অপেক্ষা কৃতিত্ব অর্জন করে।…অল্পবুদ্ধি ছেলেদেরও কোন-না-কোন দিকে কিঞ্চিত পটুত্ব থাকে। যেমন সুযোগ না পাইলে প্রতিভার বিকাশ হয় না, তেমনি ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, সবার ভিতর সবরকম প্রতিভা থাকে না।


    এর পর তিনি একটি মোক্ষম কথা বলছেন:


    কোনও বাবা-মা ভাবিয়া রাখিয়াছেন ছেলেকে ডেপুটি করিতে হইবে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই বেচারার মানসিক শক্তি যা আছে তাহাতে তাহার টিকেট-কালেক্টোর হওয়াই মানায়। এখানে বৃথা তাহাকে গঞ্জনা দিয়া, প্রাইভেট টিউটরকে টাকা খাওয়াইয়া বা মাস্টার মহাশয় ও ইউনিভার্সিটিকে অযথা গালাগালি দিয়া কি লাভ? যাহার ভিতর কলকব্জার কাজের প্রতি অনুরাগ ও ক্ষমতা আছে তাহাকে সেই লাইনের জন্য তৈয়ার করিতে হইবে।



    কিন্তু, তা করতে গেলেতো প্রতিটি শিশুর প্রতি আলাদা আলাদা নজর দিতে হবে, তাদের আচরণ, অভ্যাস, চাওয়া, বিতৃষ্ণা, ইত্যাদি সমস্ত গূণাবলীর প্রতি নজর দিতে হবে, এবং সেই নজরের ভিত্তিতে তার পাঠদানের কাজটা করতে হবে। শুধু তাই নয়, বহু শিশুই পাঠে মন দিতে পারে না বলে বকা খায়, মার খায়, এবং শিক্ষার সঙ্গে তার একটা শত্রুতা গড়ে ওঠে। কিন্তু, শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াটা যদি মানবিক হয় – মানবিক না হলে বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না – তাহলে শিশুর পাঠের অনীহার কারণটা সহজেই ধরে ফেলে তার সমাধান করা যায়। বস্তুত, সারা বিশ্ব জুড়ে এমন বহু উদাহরণ আছে যে, শিক্ষকের নজর যদি ঠিক সময় না পড়ত তাহলে আমরা অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক বা অন্য ক্ষেত্রের প্রজ্ঞাবান মানুষদের পেতামই না।
    আগেকার দলিলগুলোর মতোই ২০২০-র শিক্ষানীতিতে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা বলা আছে। কিন্তু এই টাকা আসবে কোথা থেকে? যে ভারত সরকারের হাতে নানা ক্ষমতার মতোই অর্থভাণ্ডারও কেন্দ্রীভূত সেই ভারত সরকার কত দেবে? এবং ঋণের ভারে ন্যুব্জ রাজ্য সরকারগুলোর ওপর কতটা চাপানো হবে? তার চেয়ে বড় কথা এই ৬ শতাংশের মধ্যে সরকারি অংশ কতটা আর বে-সরকারি অংশ কতটা? তারপর, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জবাবদিহি বলতে প্রায় কোনও বস্তু নেই। যেটুকু আছে তা একেবারে দুর্বলদের জন্য – যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের জবাদিহি তাদের পরীক্ষার ফলের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বাচ্চারা যদি ইস্কুলে যেটুকু শেখার কথা সেটুকু না শেখে তার জবাবদিহির কোনও ব্যবস্থা নেই। যদিবা এ নিয়ে অভিযোগ ওঠে, সবাই হয় শিক্ষকদের দিকে বা অভিবভাবকদের দিকে কিম্বা উভয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত। নতুন শিক্ষানীতিও এব্যাপারে ধোঁয়াসার ওপর অধিক নির্ভরশীল।

    অবহেলার অনুশীলন

    অপরদিকে রাজ্য সরকারগুলি, যারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সরব, তারা কী করছে? ছোত একটা উদাহরণ: পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, উদ্বেগজনক, যথাক্রমে ৩৯ ও ৫৭। আমাদের থেকে খারাপ অবস্থা কেবল বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডে। মনে রাখা ভাল, এ ঐতিহ্য অনেক দিনের, এই সহস্রাব্দের শুরুতে শিক্ষকের অভাব যে সব রাজ্যে সবচেয়ে প্রকট ছিল, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গ-সহ এই তিন রাজ্য। যা-ই হোক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকের সংখ্যায় স্কুলে স্কুলে বিরাট তারতম্য। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার উত্তর কুসুমপুর হাই স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ৪৭০০, আর শিক্ষকের সংখ্যা ৩৯! উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে কনকনগর সৃষ্টিধর ইনস্টিটিউশনে ছাত্রসংখ্যা ১২৯৬, শিক্ষক আছেন ১৪। এগুলো নমুনামাত্র। দেখতে চাইলে, রাজ্যের যে-কোনও প্রান্তে শিক্ষকের এই উৎকট অভাব দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষক থাকলেই যে লেখাপড়ার মান খুব উন্নত হয়ে যাবে, তেমন নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন, সমাজব্যবস্থার গভীর অসুখগুলো শিক্ষকদের সংক্রমিত: এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু শিক্ষক না থাকলে স্কুলশিক্ষা বলে যে কিছু হয় না, সেটা বলে দিতে লাগে না। যে হেতু বহু লোকেরই সেই সঙ্গতি নেই, তাদের ভাগ্য তাদের জুতে দেয় বঞ্চনার ঐতিহ্যের জোয়ালে। একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাওয়া যায়, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ তাদের আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল তারা কোন অঞ্চলের বাসিন্দা, তার উপর। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যারা বিজ্ঞানে যারপরনাই আগ্রহী, কিন্তু পড়তে পারে না, কারণ তাদের স্কুলে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ নেই। ওয়েস্ট বেঙ্গল কাউন্সিল ফর হায়ার এডুকেশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কিছু জেলার তথ্য থেকে দেখা যে ছবিটা উঠে আসছে, সেটাকে ভয়াবহ বললে কম বলা হয়: কোচবিহার, মালদহ, পুরুলিয়ার মতো জেলায় প্রতি পাঁচটি স্কুলের একটিতেও বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সুযোগ নেই। কয়েক বছর আগে প্রতীচী ট্রাস্ট প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে অশোকেন্দু সেনগুপ্ত দেখেছিলেন, কেরলে বিজ্ঞান পড়া ছেলেমেয়ের অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ, আর এ-রাজ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ! বর্তমানে অবস্থাটা খারাপ বই ভাল হয়নি।

    শিক্ষক সংক্রান্ত সমস্যাটা শিক্ষাক্ষেত্রে বৃহত্তর অবহেলার একটি অংশমাত্র। যতই কেউ খোঁজ নেবেন, দেখতে পাবেন পরতে পরতে বঞ্চনার ঐতিহ্য সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা। যেমন মিড-ডে মিল। এর জন্য যতটা অর্থবরাদ্দ করা দরকার দেওয়া হচ্ছে প্রায় তার অর্ধেক।

    একই সমস্যা স্কুল চালানো নিয়ে। কম্পোজ়িট স্কুল গ্রান্ট নামে একটা তহবিল স্কুলগুলোকে দেওয়া হয় দৈনন্দিন খরচ মেটাবার জন্য। ২০১৮ সালে ‘শিক্ষা আলোচনা’-র বাস্তব চাহিদা ভিত্তিক হিসেব ছিল, প্রাথমিক স্কুলগুলোকে যথাযথ ভাবে চালাতে গেলে এই গ্রান্টের টাকা প্রায় পাঁচগুণ বাড়ানো দরকার।

    আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আগে ছিল প্রধানত জমিদারতান্ত্রিক – শিশুর ওপর সব দায় চাপিয়ে দাও, আর পরীক্ষায় ফেল করলে মহানন্দে হাততালি দিয়ে তার আত্মবিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দাও। এবার, যদিও বা বহু শিক্ষাবিদের বহুদিনের চেষ্টায় সরকারি নীতিতে শিক্ষার পদ্ধতি ও প্রকরণ বিষয়ে পরিবর্তন আনা গেল, সেগুলো রূপায়ণ করার কাজটা প্রায় হলি না। একথা ঠিক যে, আমাদের ঐতিহ্যে অন্যরকম শিক্ষা প্রকরণও ছিল। যেমন সপ্তদশ শতাব্দীতে এই বাংলাতেই কিছু টোলে এমন শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল যা হয়তো আজকের দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও ঈর্ষার উদ্রেক করবে। সেই পদ্ধতিতে, দু জন শিক্ষক নিজেদের মধ্যে তর্ক করতেন, ছাত্ররা সেই তর্ক শুনত, এবং তাতে যোগ দিত। কিন্তু, সে সুযোগ ছিল সীমিত, তদুপরি ব্রিটিশ শাসনে আমাদের যা কিছু মূল্যবান ছিল তা ধ্বংস হল। থেকে গেল, কিছু প্রাচীন সংস্কার। দুর্ভাগ্যের কথা, শিক্ষকদের একটা বড় অংশই শিক্ষাবিজ্ঞান অপেক্ষা সংস্কারকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন। উদাহরন দিয়ে বলতে গেলে আর টি ই তে 'কোন শিশুকে ফেল না করানো', ' নিরবিচ্ছিন্ন এবং সার্বিক মূল্যায়ন বা সি সি ই', এবং 'শাস্তি না দেওয়া' এই বিষয়গুলির উল্লেখ করা আছে যা কিনা সমগ্র পৃথিবীতেই শিক্ষাদানের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় চিরাচরিত কাল ধরে শিশুকে ফেল করানো,বার্ষিক পরীক্ষা,বা সামান্য ত্রুটিতে চড় চাপড় মারা বা অন্য আরও কোনো বড় শাস্তি দেওয়ার অভ্যেস চলে আসছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই সংস্কার অনুগামী শিক্ষক এবং বাবা মায়ের কাছে আর টি ই - র এই নতুন চিন্তা ধারা এবং ব্যবস্থাপনা খুবই বিস্ময়কর ঠেকে ছিল। প্রথম থেকেই এই অংশের মানুষের কাছে আর টি ই - র রূপায়ণ নিয়ে প্রবল বাধা আসতে থাকে এবং কোনও মানে না জেনে এবং বুঝে তাঁরা মানুষের কাছে এই আইন সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা প্রচার করতে থাকে। বহু শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছি " যদি বাচ্চাদের এমনি এমনি পরের ক্লাসে তুলে দিতে হয় তবে পড়ানোর আর কি প্রয়োজন?" অথচ, “তাঁদের যখন প্রশ্ন করা হয়, বাচ্চাতো স্কুলে এসেছে পাশ করতে, সে ফেল করবে কেন? যদি ফেল হয়, তার দায় কার?” – তাঁরা প্রায়শ, স্কুলব্যবস্থার পরিকাঠামোগত ও অন্যান্য দুর্বলতার দিকে আঙুল তোলেন। এটা ঠিক আমাদের শিক্ষা পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। তার পরিবর্তন দরকার। কিন্তু যাঁরা শিক্ষা দেবেন, সেই শিক্ষক, বাবা-মা, এবং পরিজনের অন্তর যদি না বদলায় তাহলে যত বড় স্কুলবাড়ি হোক, তাতে যত শিক্ষক থাকুন, এবং যতই শিখন-সামগ্রী সরবরাহ করা হোক না কেন, ছাত্রছাত্রীদের ওপর নজর দেবার কাজটা হবে না। তা যদি না হয়, দেশের মানুষ কার্যত অধিকতর অশিক্ষিত হতে থাকবে। শিক্ষাকে প্রকৃতই যদি মুক্তির উপায় হিসেবে দেখতে হয়, তাহলে তার অন্তর্নিহিত মূল্যকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা রোজগারের একটা উপায় ঠিকই, কিন্তু কেবল রোজগারের জন্য শিক্ষা অর্জন যে আসলে মানুষের চারিত্রিক অবনমন, তার মানবিক সত্ত্বাকে খন্ডিত করা – এই মূল কথাটা আমাদের আত্মস্থ করতেই হবে। শিক্ষা মানুষের জাগতিক উন্নতির একটা উপায় ঠিকই, কিন্তু তার অন্তর্লীন মূল্য অনেক বেশি। সুভূতির প্রশ্ন ছিল, জ্ঞানলাভ করে কী লাভ হবে? গৌতম বুদ্ধের উত্তর ছিল, লাভের কথা না ভেবেই জ্ঞানলাভ করতে হবে – জ্ঞান নিজেই মূল্যবান।

    সর্বজনীন কর্তব্যদায়

    এ-কাজ করতে গেলে, প্রথমেই আমাদের স্কুলগুলোকে স্কুল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বাচ্চারা স্কুলকে তাদের নিজেদের অংশ বলে মনে করে। অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে শিক্ষকরা নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে স্কুলগুলোকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে পেরেছেন, সেখানে বাচ্চারা ছুটির পরেও স্কুল ছেড়ে বাড়ি যেতে চায় না। কিন্তু সামগ্রিক চিত্রটি বেশ খারাপ। একটা হিসেব কষে দেখা গেল এ-বছর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে রাজ্যের প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলগুলোতে গড় উপস্থিতি ছিল সত্তর শতাংশের কম। এই মাত্রার উপস্থিতি থেকে শিক্ষার মান বজায় রাখা কঠিন। উপস্থিতির এমন হারের কারণ হিসেবে একটা সিদ্ধান্ত এই যে, বাচ্চাদের কাছে স্কুলটা যথেষ্ট আকর্ষণীয় নয় – কেন নয়, তার নানা কারণ আছে, যার মধ্যে শিক্ষার বিষয়বস্তু যেমন একটা তেমনি পড়ানোর পদ্ধতিও একটা। একদিকে যেমন, পরিকাঠামোগত কারণে, আলাদা আলাদা শিশুর আলাদা আলাদা প্রয়োজনের দিকে নজর দেওয়া কঠিন, আবার বাজারের প্রভাব এমনভাবে কাজ করছে যাতে প্রতিটি শিশুর প্রতি নজর মানে মুনাফা কমে যাওয়া। বাজার কখনোই চায় না মানুষ চৈতন্যে মুক্ত হোক, সে মুক্তির অর্থ মুনাফার ধারণাটাকেই তুলে দেওয়া। প্রকৃত শিক্ষার অর্থ, প্রতিটি মানুষকে সমান চোখে দেখা, প্রতিটি মানুষের চোখ থেকে অশ্রু মুছে দেওয়া। কিন্তু মুনাফাভোগী ব্যবস্থায় সেটা চলে না। তাই, শিক্ষাক্ষেত্রে মুনাফা ও মুক্তির বৈরদ্বন্দ্বটির সমাধান না করে আমরা এগোতে পারব না।

    হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। শিক্ষার গুণগত মান সম্পর্কে আমাদের সমানে কথা বলে যেতে হবে, এবং বারবার এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এভাবেই কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণার জন্ম হবে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করার জন্য, আদর্শ শিক্ষা আসলে ঠিক কী সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আমরা বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। আমাদের ভাবতে হবে আসলে সত্যিটা কী এবং কোনটা আমাদের লাভের জন্য করা হচ্ছে এবং কোনটা বেসরকারি সংস্থাকে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার জন্য করা হচ্ছে।
    পাশাপাশি, কীভাবে শিক্ষা প্রকরণকে কেবল সরকারি দপ্তর বা কিছু বিশেষজ্ঞ্র বৈঠকখানা থেকে বের করে এনে সমাজের বৃহত্তর পরিসরের সঙ্গে যোগ করা যাবে তা নিয়েও ব্যাপক প্রচেষ্টার দরকার। এই দিকটি নিয়ে অরণ্যজিৎ সামন্ত নামে একজন শিক্ষক আমাকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন:

    …সরকারি টাকায় চলতে থাকা স্কুলে কিছুই হয়না, এরকম ধারনাও আমরা অনেকটাই সঠিক বলে মনে করি এবং সেটা ক্রমপ্রসারমান। বেসরকারি বিদ্যালয় ভাল কিনা, সেখানে শিক্ষার প্রকৃত উন্নতি সম্ভব কিনা, সেই কূট প্রশ্নে যাবার আগে একটি অতি সাধারণ বাক্য আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে ‘সরকারি ব্যাবস্থাপনা কোনও ব্যাক্তির মুনাফার জন্য কাজ করে না।’ সেখানে বিদ্যালয় বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ‘আমাদের’ হয়ে ওঠবার সুযোগ থাকে। ‘উন্নয়নের মডেল’ পরিকল্পনার আগে তাই বিদ্যালয় যাদের, তাঁদের অংশগ্রহণের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
    এই প্রশ্নটিই শিক্ষা সমস্যার সব চেয়ে স্পষ্ট উত্তর হতে পারে। শিক্ষক, অভিভাবক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, সকলের কাছেই প্রশ্নটি একটি সর্বজনীন দাবি তুলে ধরে।




    ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এ পি ডি আর, মালদা শাখা আয়োজিত “নতুন শিক্ষানীতি কী ও কেন” শীর্ষক আলোচনাসভার জন্য প্রস্তুত বক্তব্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৯৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:২৬523741
  • খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। প্রশ্ন গুলো সঠিক তোলা হয়েছে। উত্তরের দিকে আরও একটু ইঙ্গিত দিলে ভালো লাগত।
     
    ফেল বন্ধ করে দেওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে পরীক্ষা ভীতিটা হয়তো কমছে, বন্ধুদের সাথে আনন্দ সহকারে নতুন ক্লাসে উঠতেও পারছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনেকাংশেই তারা এইট অব্দি কিছুই প্রায় শিখছে না। নাইনে উঠে হাবুডুবু খাচ্ছে। সরকারি স্কুলে শিক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে ধরেই নিচ্ছেন এরা কি আর শিখবে, আসবে খাবে চলে যাবে। খয়রাতি করা হচ্ছে এই ধারনা থেকে শিক্ষকদেরও বেরিয়ে আসতে হবে।
  • &/ | 107.77.236.125 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:৫৯523745
  • নিজের সন্তানকে (বা নাতিনাতনিকে) কোন স্কুলে ভর্তি করবেন?
  • শক্তিপদ পাত্র | 103.245.2.253 | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৫১523749
  • ভাবনা, অনুভূতি, আন্তরিকতা ও অভিজ্ঞতা -নির্ভর লেখা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবকে অপূর্বভাবে তুলে তুলে ধরেছেন। Pedagogy -তে তিনটি 'প'-কে গুরুত্ব দিতেই হবে - particularity, practicality, and possibility।
  • মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় | 2401:4900:3be0:db56:c3b5:b4af:2ab4:18bc | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:০৬523754
  • অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাস্তব ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। সরকারি স্কুলশিক্ষা সম্পর্কে যে ধারণা বিত্তবানেরা মেনে নিয়েছেন তা হল সেটা বিত্তহীনের জন্য। পুরোটাই নাকি দানখয়রাতি। অধিকার শব্দটি প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ধন্দে আছেন শিক্ষকেরাই। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য যে  গাড়িঘোড়া চড়া নয়, এইটা আগে না ভাবলে সবটাই বৃথা। 
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৫523755
  • কর্মমুখী শিক্ষা করতে গিয়ে প্রকৃত শিক্ষার অস্তিত্বই বিপন্ন।
  • শুদ্ধসত্ত্ব দাস | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৭523804
  • আশা করি আপনার লেখা আর বক্তব্য নানান জায়গায় প্রচার পাবে, আর ক্ষমতাসীন বর্গেরা এতে গুরুত্ব দেবে। 
  • Kishore Ghosal | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৫523877
  • শিক্ষা নিয়ে এই প্রবন্ধটি সকলের কাছেই শিক্ষণীয়, সন্দেহ নেই। 
     
    তবে আমার মনে হল, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করাও জরুরি। সেটি হল সামাজিক অবক্ষয় - যার শিকড় ছড়িয়ে পড়েছে আধুনিক সমাজের গভীরে। 
     
    যে যোগ্য শিক্ষকেরা প্রায় দুবছর হতে চলল, পথে বসে আন্দোলন করছেন। অথবা যে নিয়োগকর্তারা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য মানুষকে শিক্ষকতায় নিযুক্ত করতে চলেছিলেন, সেই সমাজে কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধন হওয়া সম্ভব? অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এখনও তদন্তসাপেক্ষ ও  আদালতের বিচারাধীন। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু - এই তদন্তের অন্ত কোনদিন হবে কি? বিচারে দোষীরা শাস্তি পাবে কি? 
     
    দুর্নীতি ছাড়া কোন নীতিই  আজ আর যেখানে প্রযোজ্য নয় - সেখানে শিক্ষানীতির ভুল-ভ্রান্তিতে কী আসে যায়?  
     
    সরকারি স্কুলগুলিকে শিক্ষা নয় , শুধু  "মিড ডে মিল" খাবার লঙ্গরখানা বানিয়ে তোলার দায় কার?  আমাদের সকলের নয়?
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন