এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বেশরমি বদনামী 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ নভেম্বর ২০২২ | ৬০৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সেদিনই একটা মন্তব্যে 'এজ শেমিং' শব্দটা বাংলায় লিখতে গিয়ে জুতসই প্রতিশব্দ বানাতে পারলাম না। 'বয়সজনিত বদনাম', খুবই নরম একটা ব্যাপার। শেমিং মানে কী? মুখে চুনকালি মাখিয়ে জুতোর মালা পরিয়ে উল্টো গাধায় চড়িয়ে গ্রাম থেকে দূর করে দেওয়া। এতটা তো লেখা যায়না, দুই-শব্দে সেই অনুভূতিটাই এলনা। তারপরই হিন্দি সিনেমায় কেমন বলবে ভাবতে গিয়ে একটা বলিউডি কাটিং শব্দ মাথায় এসে খট করে উপস্থিত হল। 'উমরি বদনামী'। উফ কী জোশ। শুনলেই মনে হয় ইউপি থেকে রোমিও স্কোয়াড এসে বলছে, 'বুড়ো বয়সে এত শখ কীসের অ্যাঁ?' 

    তারপরই  পরখ করে দেখার জন্য আরেকটা জিনিস ভাবলাম। 'নেমিং অ্যান্ড শেমিং' কী হবে? দিব্যজ্ঞানের মতো মাথায় এলো 'নাম করো বদনাম করো'। তারপরই 'স্লাট শেমিং'। তার অনুবাদ লিখলে ফেবু রাগ করবে, ওটা নিজেই করে নিন। একটা সহনীয় প্রতিশব্দ দিতে পারি, সেটাও মন্দ না। 'বেশরমি বদনামী'।

    এই করতে গিয়ে কটা বিখ্যাত বলিউডি গান মাথায় এল। তার মধ্যে একটা হল  'ম্যায় তো তন্দুরি মুর্গি হুঁ ইয়ার, গটকালে সাঁইয়া অ্যালকোহল সে'। এটা 'বেশরমি বদনামী'র ঠাকুদ্দা-ঠাকুমা। কিন্তু শুনলে বেশ লাগছে। আরও কটা আইটেম গান ভেবে দেখলাম, সত্তর-আশি-নব্বই (সময়টা একটু নড়বে- এরকম চিনের প্রাচীর তো নেই) এর বলিউডি ভাষায় খারাপ কথা বা নিন্দে-মন্দ দিব্যি লাগে। তাতে দোষের কিছু নেই। সেটা ভাষাটার গুণ। আমাদের কলেজেও কিছু ছেলে ছিল, যারা কবিতা আবৃত্তি করলে জঘন্য লাগবে, কিন্তু খিস্তি দিত অসাধারণ। 

    তো যাই হোক, গানটা বাংলায় লেখার চেষ্টা করলাম। 'গ্গুরু আমি তন্দুরি মুর্গি, সাঁটাও আমায় অ্যালকোহলে'। অখাদ্য হলেও এইটা লিখতে গিয়ে আমি আসল রহস্যটা বুঝে ফেললাম। দেখুন, আমি গুরু লিখিনি গ্গুরু লিখেছি। উচ্চারণ ভেঙে লিখলে হবে 'গ্গুরু আমি ত্তন্দুরি মুর্গি', অর্থাৎ কিনা গুরু আর তন্দুরির পয়লা সিলেবলে প্রচণ্ড জোর। মুজতবা যাকে বলতেন গাঁকগাঁক করে বলা। এই গাঁক-গাঁক থেকেই জোশের উৎপত্তি। 'বেশরমি বদনামী' শুনলেও ওইরকমই লাগে। 'ব্বেশরমি ব্বদনামী'। ভারতীয় ভাষাগুলোয় যেহেতু জোর দেওয়ার আলাদা করে প্রচলন নেই, কাজেই এই গ্গুরু জাতীয় শব্দ বিশেষ নেই। আমরা নরম করে কথা বলি। মৈথিলি-ব্রজবুলি থেকে আওধি অবধি, অর্থাৎ বিহার থেকে লক্ষ্ণৌ, কোথাওই নেই। আরও পশ্চিমে প্রথাগত হিন্দুস্তানি, যা উর্দু নামেও প্রচলিত ছিল, তাতেও নেই। এই ভাষাগুলো আলাদা করে জানিনা, কিন্তু গান তো সব্বাই জানি। জনপ্রিয় গানই ধরুন। 'মথুরা নগরপতি' থেকে 'বাবুল মোরা' পর্যন্ত কোত্থাও নেই। এক-আধটা জায়গায় হয়না, তা নয়। যেমন ধরুন আনুশে আনাদিলের 'ক্কী ক্করি আমি ক্কী ক্করি', বা বড়ে গোলাম আলির 'ক্কা ক্করু স্সজনী'। কিন্তু ওগুলো ছন্দের মজা, রবি ঠাকুরের 'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে'র মতো। গাঁক-গাঁক করে উচ্চারণ নয়।

    তাহলে কথা হল, উচ্চারণটা হিন্দি সিনেমায় কোথা থেকে এল? কারণ ৭০-৮০-৯০এ বোম্বের সিনেমায় যে ভাষাটা, বা ভাষাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আদ্যন্ত বানানো। কারো মুখের ভাষা নয় (এখনকার আস্ত সরকারি হিন্দি সম্বন্ধেই বোধহয় সেটা বলা যায়, কিন্তু সে অন্য বিষয়)। 'ম্মেরে প্পাস ম্মা হ্যায়' থেকে শুরু করে 'খ্খুন ক্কে ব্বদলা খ্খুন' -- সিনেমায় যেমন শোনেন, এই উচ্চারণে পাড়ায় কাউকে কথা বলতে শুনলে পাবলিক ঠ্যাঙাবে। বা হাসবে। এমনকি উত্তর ভারতেও। ওটা নায়কোচিত ভাষা, নায়কের ভাষা, সিনেমার ভাষা। মানুষের না। ওই জন্যই 'ব্বেশরমি ব্বদনামি', বা 'ন্নাম ক্করো বদনাম ক্করো' শুনলেই মনে হয়,চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গোলাপি প্যান্ট আর ঝিলমিলে জামা পরে, বাইক থেকে সবুজ জুতো পরে নেমে নায়ক কিছু একটা অপকর্ম করছে। আর কোনো রহস্য নেই। 

    এবার এই মেলোড্রামাটিক ভাষা নিয়ে গুচ্ছের থিয়োরি আছে। ভাষা নিয়ে নয়, ভঙ্গীটা নিয়ে আর কি। ঋত্বিক ঘটকেরই একটা আছে। ওই আদি মাতৃমূর্তি, সমষ্টিগত অচেতন, মেলোড্রামা ইত্যাদি। ঋত্বিক নিয়ে খুব হুল্লোড় হলেও তাঁর তত্ত্বটা তেমন চলেনি। যেটা খুব চলে সেটা হল, বোম্বের সিনেমা এইসব করে একটা সময় 'ছোটোলোক'দের অ্যাসপিরেশনকে তুলে ধরেছিল। সেইটা শুনলেই আমার মজা লাগে। সমাজের নিম্নস্তরের লোকজনের মধ্যে হিন্দি সিনেমা খুব হিট করেছিল ঠিকই, কিন্তু তুলে ধরা বা সম্বোধন  করা? পৃথিবীর কোথায় নিম্নবর্গের সংস্কৃতিকে সমাজ তুলে ধরেছে? শুনলে এঙ্গেলস, গ্রামশি, আলথুজার সব্বাই ভির্মি খেতেন। তাছাড়া খেয়াল করবেন, জিনিসটা শুধু হিন্দিতেই হিট হয়েছিল। বাংলায় ওই উচ্চারণভঙ্গী আমদানি করার চেষ্টা হয়েছে। কিশোরকুমারই গেয়েছিলেন, 'ন্নয়ন স্সরসি ক্কেন'। লোকে শুনেছে, কিন্তু ভঙ্গীটা টেকেনি। যেগুলো টিকেছে, যেমন তার মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি হল, 'মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে', কিন্তু তাতেও ওই গাঁকগাঁক জোরটা নেই। তাহলে বঙ্গের নিম্নবর্গকে কি শুধু হিন্দিতেই তুলে ধরা যায়?

    এর উল্টো একটা প্রস্তাবনা তৈরি করা যায়। কিন্তু সে অনেক লম্বা গপ্পো। ১০ মিনিট টাইপ করা হয়ে গেছে, কিছু পেপার লেখা হচ্ছেনা, যে পাবলিশ অর পেরিশ। এছাড়াও আরও কে কে আহত হয়ে গেলেন কে জানে। ওসব পরে হবে। লোকজনকে রইয়ে সইয়ে শক দেওয়া ভালো। জ্জয়গ্গুরু।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 2401:4900:1f2a:207f:fdc0:2f18:9ec0:e6a1 | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ০৯:০৩513458
  • 'নাম করো বদনাম করো' পড়ে একটা গান মনে পড়ে গেলো। 
     
    ম্যায় কিসি কে নাম সে লিখকে চিটঠি পেয়ার কি ভেজ দুঙ্গা ঘর তেরে নাম তেরা মুফত মে বদনাম হো যায়েগাঃ 
     
  • Subhadeep Ghosh | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১১:৫৯513463
  • 'উমরি বদনামী'। উফ কী জোশ। শুনলেই মনে হয় ইউপি থেকে রোমিও স্কোয়াড এসে বলছে, 'বুড়ো বয়সে এত শখ কীসের অ্যাঁ?' - এটা চরম।
  • | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১৭:৫১513472
  • আরে এইটা তো ফেবু নয়। আসল টার্গেট ফেবু, তারপর  সোজা কপি মেরে দিয়েছ দেখি। 
    বডি শেমিঙের বাংলা করার চেষ্টা করছিলাম একবার।  তো কে যেন বলেছিল সুরত-ই-বদনাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন