এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  লঘুগুরু

  • নেতা

    Nirmalya Nag লেখকের গ্রাহক হোন
    লঘুগুরু | ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১০৮৪ বার পঠিত
  • (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবু’ গল্পের অনুপ্রেরণায় এই রচনা। ‘বাবু’ প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৭৯-র ফাল্গুন সংখ্যায়। ‘লোকরহস্য’ বইয়ের পাতায় সেটি আসে ১৮৭৪-এ। প্রায় ১৫০ বছর পরে আজও তার গুরুত্ব কমেনি। হাজার বছর আগে ব্যাস বলেছিলেন মহাভারতের কাহিনী মানুষ পরেও নানা ভাবে বলবে। বাবুদের চরিত্র প্রকাশে বঙ্কিমচন্দ্র মহাভারতের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর এই সামান্য কলমচি রাজনৈতিক নেতাদের দেখতে শরণ নিল ‘বাবু’ নামের আয়নার। সুজন পাঠক অপরাধ নেবেন না, এটুকুই আশা।)  

    জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলি যুগে নেতা নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন। 
    বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই কূটবুদ্ধি, পানভোজনকুশলী নেতাগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চেন অলংকৃত, অদ্ভুতচরিত্র, বহুভাষী, বাইট-প্রিয় নেতাদিগের চরিত্র কীর্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন, যাঁহারা পাঞ্জাবি-পাজামাবৃত, মোবাইলকর্ণগত, গ্রহরত্নখচিত অঙ্গুরিয়শোভিত, এবং রোদচসমা পরিহিত, তাঁহারাই নেতা। যাঁহারা বাক্যে অজেয়, অপভাষাপারদর্শী, সুস্থভাষাবিরোধী, তাঁহারাই নেতা। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন নেতা জন্মিবেন যে তাঁহারা সুস্থভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের রসনেন্দ্রিয় অন্যদলীয় নেতানেত্রীপ্রতি গালিদানে পবিত্র, তাঁহারাই নেতা। যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও দুর্বলোপরি পাদপ্রহারে সক্ষম; হস্ত দুর্বল হইলেও মাইকধারণে এবং অর্থগ্রহনে সুপটু, তাঁহারাই নেতা। যাঁহারা ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করিবেন, রাজনীতির জন্য পার্টি করিবেন, পার্টির জন্য অপরাধ করিবেন, এবং আইনের হস্ত হইতে বাঁচিবার জন্য অপর পার্টিতে যোগদান করিবেন, তাঁহারাই নেতা। 
    মহারাজ! নেতা শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগের ভারতবর্ষে পরোক্ষে শাসক হইয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট ‘নেতা’ অর্থে শ্রমিক ইউনিয়নের পদাধিকারী বুঝাইবে। আই-পি-এল দলবিশেষের খেলোয়াড়দিগের নিকটে ‘নেতা’ শব্দে চিত্রতারকা বুঝাইবে। মার্কেটিং কর্মীদের নিকট ‘নেতা’ অর্থে টিম লিডার বুঝাইবে। এ সকল হইতে পৃথক, কেবল নেতাজন্ম নির্বাহ করিতে অভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্তন করিতেছি। যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি জনগণের এক জন হইয়া নেতাদিগের লক্ষ্য হইবেন।  
    হে নরাধিপ! সাধারণের বিপরীতে অবস্থান করিবার নিমিত্ত পঞ্চভূত নেতাদিগেরই কর্তৃত্বাধীন থাকিবেন। যথা, ক্ষিতি ইঁহাদিগের অতীব ক্ষমতাশালী আয়ুধ হইবে। শতনামে সহস্র যোজন জমি নেতাগণ ভোগ করিবেন। দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় সমুদ্ররূপী বরুণকে ইঁহারা শোষণ করিবেন, পানপাত্র ইঁহাদিগের গন্ডূষ। অগ্নিও ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন – ‘সিগারেট’ নামক একটি অভিনব খান্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রিদিন ইঁহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন। ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমনি অন্তরেও অগ্নি জ্বলিবেন। সেই অন্তরাগ্নির জ্বলন মধ্যে মধ্যে অন্যদলীয় এবং/অথবা স্বীয় সমর্থকরা তাঁহাদের আপন গৃহাভ্যন্তরে অনুভব করিবেন। বায়ু ইঁহাদিগের গৃহের বাহিরে বাহনরূপে এবং জঠরমধ্যে গ্যাসরূপে নিত্য বিরাজমান থাকিবেন। ইঁহাদিগের অধিকাংশ চন্দ্রলোভী বামন হইবেন, কেহ কেহ মধ্যাহ্নে চন্দ্র এবং নিশীথে সূর্য দেখিবেন। 
    সমাজকে ইঁহারা বহুধা বিভক্ত করিবেন—ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্ধর্ষ কার্যের নাম রাখিবেন, ‘সমাজসেবা’। জনগণের সম্মুখে ইঁহারা পূজার্চনা করিবেন, মন্দির মসজিদ গড়িবেন, আর তাঁহাদিগের পশ্চাতে যে পবিত্র স্থানে ইঁহারা আরাধনায় নিমগ্ন থাকিবেন তাহার নাম হইবে ‘গেস্ট হাউস’। 
    হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পান্ডিত্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুস্তকে সীমাবদ্ধ, তিনিই নেতা। ইঁহাদিগের সমর্থকেরা ইঁহাদের কাব্যে কালিদাস, সঙ্গীতে সরস্বতী, পান্ডিত্যে পাণিনি বলিয়া প্রচার করিবেন এবং তাহা শ্রবণ করিয়া যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই নেতা। যিনি নারীজাতির অবমাননাকারির শাস্তি লঘু করিতে প্রতিশ্রুত হইবেন, পরে তাঁহার বক্তব্য বিকৃত করা হইয়াছে দাবি করিয়া সংবাদ মাধ্যমের মুন্ড চর্বন করিবেন, তিনিই নেতা। যিনি স্বদলীয় কর্মীর অপরাধ লুকাইয়া রাখিবেন, ব্যক্তিবিশেষকে ব্যবহার করিয়া অবৈধ সুবিধা লইবেন এবং সুবিধালাভ সমাপ্ত হইলে তাহাকে সুদূরে নিক্ষেপ করিবেন, তিনিই নেতা। যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং ভাষণকালে সহস্র, তিনিই নেতা।
    যিনি ইতিহাসের কিছুই জানিবেন না, অর্থনীতির কিছুই বুঝিবেন না, কেবল আপনাকে অভ্রান্ত জানিয়া আপনার মত জনগণের উপর চাপাইয়া দিবেন, তিনিই নেতা। যিনি ফান্ড সংগ্রহার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, সমর্থকদের প্রীতিসম্পাদনার্থ গণেশপূজা করিবেন এবং নির্বাচনে জয়ের লোভে ঈদ পালন করিবেন, তিনিই নেতা। 
    হে কুরুকুলভূষণ! দেবদেবীদের কথা যখন উঠিল তখন বলা যাউক, বিষ্ণুর সহিত এই নেতাদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। ইঁহারা বিষ্ণুর তুল্য লীলাপটু হইবেন, বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার হইবে।  যথা –  কেরানী, মাস্টার, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, ধর্মগুরু, অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, সংবাদপত্র সম্পাদক এবং নিষ্কর্মা। সকল অবতারেই ইঁহারা অমিত বলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন। কেরানী অবতারে বধ্য অসুর প্রশাসন মুখাপেক্ষী, মাস্টার অবতারে বধ্য ছাত্র, অভিনেতা অবতারে বধ্য দর্শক, ব্যবসায়ী অবতারে বধ্য ক্রেতা, ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী, উকিল অবতারে বধ্য মক্কেল, ধর্মগুরু অবতারে বধ্য ধর্মভীরু, অফিসার অবতারে বধ্য আপনারই ছেড়ে আসা সরকার, সম্পাদক অবতারে বধ্য পাঠক, এবং নিষ্কর্মাবতারে বধ্য উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী। 
    হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, তাঁহারা আইনসভা দখল করিয়া, তথায় বাগাড়ম্বরের মেঘ জমাইয়া, মুষ্টিযুদ্ধ করিয়া, কর্দমাক্ত সলিলে মৎস্যশিকার করিয়া ভারতবর্ষের পুনরুদ্ধার করিবেন। 
    জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব! নেতাদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।
     
    (একটি অধুনালুপ্ত ওয়েব পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বর্তমানের ঘটনাবলীর সাথে তাল মেলাতে কিঞ্চিৎ সম্পাদনা করে এখানে পরিবেশিত হল)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • লঘুগুরু | ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১০৮৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন