এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কবি জয়দেব বসু: কিছু কথা

    Emanul Haque লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৬৭১ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  •  
     
    প্রতিটি কবিতার জন্ম, তুমি চাও বা না-চাও, হয় রাজনীতি থেকে। 
    প্রতিটি শিশুর জন্ম, সঙ্গমের ফলে শুধু নয়, নিবিড়-নিবিড়তম রাজনীতি থেকে। 
    রাজনীতি মানে আমি মানুষকে ঘৃণা করা, মানুষকে রুদ্ধশ্বাস ভালোবাসা বুঝি, 
    এবং, মানুষ চিনি নাম দিয়ে নয়, ক্ষমা কোরো, কাজ দিয়ে, পার্টি দিয়ে চিনি।

    হে আমার গণতন্ত্রী প্রাণীশাবকেরা, 
    তোমাদের সাথে আমি শুয়ে আছি ভাগাভাগি তেঁতুলপাতায় 
    সে কেবল তোমাদের ফুসলে নেব বলে। 

    তারপর,
    “ইটস ইওর টাইম কমরেড মাউজার...” 

    [জয়দেব বসুর ‘ভবিষ্যৎ’ কাব্যগ্রন্থের ‘বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য বিষয়ে’ কবিতা] 

    ছেঁড়াখোঁড়া যে-সব স্বপ্নের শেষে ‘আত্মঘাতী’ জয়দেব

    ইমানুল হক

    ১.
     ‘উঃ, এত গণতন্ত্র নিয়ে যে কী করি...!’   

     আক্ষেপ গণতন্ত্র নিয়ে, নাকি যাবতীয় ন্যাকামি ও আরোপিত বিষাদ ছুঁড়ে ফেলে দিতে; বিষ্ঠার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে অনন্তের প্রার্থনা –– আমাদের পাওয়া ও না-পাওয়া; স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অস্থির বেদনা –– সবকিছু পেতে চাই; পেতে চাই কোথায়, কার অথবা কীসের সামীপ্যে; আলো যদি মরে যায়, মরে যায় হীন কপট দানবী জ্যোৎস্নায় –– কী কবে একুশ শতকী কবিকুল? 
     কবিতা কি ধরতে পারছে সময়কে? অথবা ব্যর্থ আর্তনাদে ভরিয়ে তুলছে কবিতার ভাষা-দেহ? ভাসা ভাসা আবেগে, গদগদ পীরিতে, বিবমিষা জাগিয়ে ফেসবুকে দেবে লাইক? ই-মেলে ছড়াবে কেলিয়ে যাওয়া শব্দসম্ভার? 
     কবিতা কেউ মনে মনে লেখে, কেউ হরফে। কাগজের সাদা পাতায়। কম্পিউটার বা মোবাইলের পর্দায়। কবিতা লেখা ছাড়া আর কোনও গতি নেই বিবেকী মানুষের। যাবতীয় অহংকার, গর্ব, বলা ও না-বলা কথা, ক্রোধ –– ঘনিয়ে তোলা ঝঞ্ঝাট, রাজনীতির নামে দলীয় তথা ব্যক্তি আনুগত্যে মুখ ঘষাঘষি –– সবই তো কবিতার কান্না। 
    ২.
    অথচ বাঙালি কবিকুলের একটি বড় অংশ ‘যৌবনের বনে’ মন হারিয়ে বসে রইলেন। তাদের কানে ‘টিন’ বাজে ঝনঝন শব্দে। দুই তাল মাংসপিণ্ড ও ব-দ্বীপের আরণ্যক ঘেমো অন্ধকারে ডুবে গেল কোটি কোটি শব্দ ও টন টন কাগজ। 
    কবিতার নামে অলীক ও অস্থির বেলেল্লাপনায় যখন বাংলা কবিতা ডুবে যেতে চেয়েছিল –– তখন তরুণ কবিদের প্রেরণাস্থল হয়ে উঠেছিলেন জয়-জয়দেব বসু। ‘জাগো ভবিষ্যৎ। জাগো, নতুন কবিরা’ –– বলে ডাক পেড়ে কাদের জাগাতে চেয়েছিলেন জয়দেব? নিজেকে নাকি সহযাত্রী সহগামী অন্যদের?   
    ‘শূন্যতার মধ্যে কোনো ঢেউ নেই’, (শুধু) শিরশিরানি আছে –– জানতেন জয়দেব। জানতেন চুকলিবাজি, সাহিত্যিক সমস্যার থিকথিকে কাদা, পার্টিতে গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীতন্ত্র; বুঝতেন ––  

    ...সত্য যদি শুধুমাত্র বুনিয়াদি হয় 
    অনিবার্য জরা তবে ললাটলিখন। 
    জানি, সংঘ অনিবার্য; যখন দর্শনের প্রতি 
    শুধুমাত্র ভিন্ন কোনো দর্শনের নয়, এমনকী সশস্ত্র আক্রমণও আসে 
    তখন সংঘ ভিন্ন অন্য কোনো ব্যারিকেড নেই। 
    দর্শনকে রক্ষা করা সংঘের দায়, 
    তাই সংঘে মন্ত্রগুপ্তি, তাই সংঘ নিয়মকঠোর। 
    এবং, দীর্ঘদিন এইভাবে প্রতিরক্ষা শেষে 
    উদ্দেশ্য গৌণ হয়, 
    দর্শন থেকে তার সংঘারাম বড় হয়ে ওঠে। 

    এই সংঘারামের বড় হয়ে ওঠা বিপজ্জনক। জীবনানন্দ বুঝেছিলেন –– মশা তার অন্ধকার সংঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। জয়দেবও ভালবাসতেন তাঁর সংঘ –– পার্টিকে। সি পি এম তথা সি পি আই (এম)। সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন জয়দেব বসু। এই স্বপ্ন থেকেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকারের সামূহিক প্রকাশ –– ‘জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার ও অন্যান্য’-য়। 

    ৩.
    জয়দেব বিশ্বাস করতেন –– ‘নিরপেক্ষ কেউ নয়, কেউ নয় ব্যক্তিগত, প্রত্যেকেই অনিবার্য তীরের ফলক।’   
    সেই তীর ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে কথায়-চিন্তায়-তর্কে-কবিতায়। কিন্তু মুখে যা বলা হয়, জীবনে তার প্রয়োগ ঘটে কতখানি? কথা ও কাজে কি বড় বেশি ফারাক হয়ে যায় না? যায়। আর সেটা জানেন বলেই জয়দেব লেখেন, লিখতে বাধ্য হন –– 

    মনে কোন ইচ্ছা নিয়ে কাজ করছ, সেটা তত বড় কথা নয়, 
    কী কাজ করছ তুমি, সেটাই জরুরী।  

    ৪.
    কতটা ছিঁড়লে নিজেকে, কতটা ভেজালে আবহমান বোবা কান্নায় কবি হওয়া যায়? কবিতা ব্যঞ্জনা। ব্যঞ্জনা –– বাড়তি বা অধিক, অতিরিক্ত কিছু। 
    কবিতা বুঝবার এবং বাজবার। কবিতা অনুভূতিময় এবং অনুভূতিহীনতার অতিরিক্ত। কবিতার আবেদন বোধের কাছে। বোধিরও কাছে। হৃদয় এবং বুদ্ধি, আবেগ এবং প্রখর যুক্তির সোয়েটারি ভেলভেট বুনন কবিতা। শব্দ প্রতিমা, শব্দ ছবি –– কথা চিত্র –– কবিতা কী নয়? কবিতা তো একটা জীবনের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা; যে অভিজ্ঞতা কখনো কখনো তীব্র অনাসক্ত এবং নির্লজ্জভাবে পরস্পরবিরোধী। কবি কার কাছে বিশ্বস্ত? কবিতা, পাঠক, নিজের কাছে না কি সব মিলিয়ে সময়ের এক ধাবমান ছবি? ‘কে কবি কবে কে মোরে?’ –– জয়দেব বেঁচে থাকলে বলতেন। 

    ৫.
    মানুষের মধ্যে থাকে অনেকগুলো মন। খুপরি কেটে আলাদা আলাদা তাকে রাখতে পারলে ভাল। কিন্তু কখনো যায়, কখনো যায় না। যায় না বলেই অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত। নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের, দলের সঙ্গে। রাষ্ট্রের পরে দল? কোনও অসতর্ক ক্রমবিন্যাস নয়। দল –– দলই তো এখন সত্য। 
    আর তার ফল হয়েছে, হচ্ছে, হবেও বিপজ্জনক। দুটি মত শোনা যাচ্ছে প্রবল ––  
    ক) জয়দেব সি পি এমের কবি 
    খ) জয়দেব মানে মদ এবং আরও কিছু 
    কিন্তু সব ছাপিয়ে জয়দেব বসু কবি। বিশ শতকের অন্যতম সেরা কবি। নিজের প্রতি, কবিতার প্রতি সুবিচার করেননি জয়দেব বসু। যতটা দেওয়ার ছিল, দেন নি। জয়দেব হয়ত মুচকি হেসে বলে উঠবেন, দিতে চাই নি। কোথায় লিখব? কাদের জন্য লিখব? পড়বে কারা? খোচড়, কবিতাবাজ, দালাল আর নেকুপুষুমুনু, যৌনসন্ধিকালে কলম থুবড়ে পড়ে থাকা জঙ্ঘা-যোনি-মুত স্রোতে বেপথুমান ভ্রষ্ট কবির দল? 

    ৬.
    পাঠক তো চিরকালের। সমকাল তার কতটুকু জানে? জয়দেব জানতেন এটাও। সিপিএম-মদ-প্রেম-টিভি সিরিয়াল –এর বাইরে ছিল একটা বিরাট মনের মানুষ। বেলা বসুদের মতো মস্ত হৃদয়ের সন্তান জয়দেবের কবিতার জগতটাও মস্ত। গ্রন্থবদ্ধ কবিতাগুলো দিয়েই তার সবটুকু ধরা পড়ে না। এখানে সেখানে ছড়ানো, যদিও কম, কবিতার মধ্যে খুঁজতে হবে জয়দেবকে। 
    খবরের কাগজের বামপন্থী কলাম-লেখক হিসেবেও বহু মানুষ চেনেন জয়দেব বসুকে। জীবদ্দশায় শেষ প্রকাশিত লেখা –– ‘আজকাল’-এর উত্তর-সম্পাদকীয়। কিছু অবাঞ্ছিত লোকের সংস্পর্শে, কিছু ঘাতক মানুষের দুষ্ট প্ররোচনায় মরে গেল জয়দেবদা। বলা যায় স্বেচ্ছা-‘আত্মঘাতী’। অথচ শঙ্খ ঘোষের মত মানুষের ছায়া-সুনিবিড় আশ্রয় ছিল, বেলা বসুদের উত্তরাধিকার ছিল –– সে সব বাঁচাতে পারল না তাকে। বাঁচতে চায় নি বলে। 
    চায় নি বাঁচতে? বিশ্বাস হয় না! 

    ৭.
    ১৯২০-তে তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার পর ৯২ বছর পার। দু’বার বড় ভাগ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৬৪ এবং ১৯৬৭। সংশোধনবাদী বলে সি পি আই ভেঙে হয়েছিল সি পি আই (এম)। ১৯৬৭-তে একই অভিযোগ উঠল সি পি আই (এম)-এরও বিরুদ্ধে। নকশালবাড়ির একটি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল নকশাল আন্দোলন। সি পি আই (এম) থেকে একটি অংশ বের হয়ে গিয়ে গড়লেন সি পি আই (এম এল)। সে দল কত টুকরো হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। তবে সি পি আই (এম) হয়ে উঠল প্রধান ধারা। দেশের সর্বত্র না হলেও তিনটি রাজ্যে সি পি আই (এম)-এর শক্তি প্রবল। কেরল, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে তো ১৯৭৭ থেকে ৩৪ বছর টানা রাজত্ব করেছে। কথা ছিল ‘এসটাব্লিশমেন্ট’-কে ব্যবহার করে মূল ‘এসটাব্লিশমেন্ট’-কে ভাঙার। তা হয় নি। উল্টে ‘এসটাব্লিশমেন্ট’-এর অংশ হয়ে ওঠে সি পি এম। ‘আই’ বাদ পড়ে যায়। সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতের বদলে রাজ্যের শাসনক্ষমতায় থাকাই যেন লক্ষ্য হয়ে যায়। আর তার মাঝেই চেষ্টা চলতে থাকে দিল্লিতে বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলার। যদিও রাজ্যে শুধুই বামফ্রন্ট। কিন্তু দিল্লিতে বারেবারেই চেষ্টা হয়েছে যুক্তফ্রন্ট বা তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার। আর রাজ্যে ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ বা ‘সৃজনশীল’ মার্কসবাদের নামে বদলে গেছে মন, মনন, মনোভাব। সেখানে পার্টির নামে ব্যক্তিতন্ত্র চলে। আর এলাকায় এই তন্ত্রের চূড়ান্ত প্রকাশ জয়দবের ‘আমার লোকাল কমিটি’। জয়দেব বসু লিখেছিলেন ––  

    পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমি একবার মোটা হয়েছি,
    তারপর রোগা হয়েছি, ফের এখন গত্তি লাগছে গায়ে;
    এর দাওয়াত, ওর ভোজে ক্রমাগত চক্কর খেয়েছি

    এটা একই সঙ্গে ব্যক্তি এবং দলের কথা। ২৫ মে ১৯৯০-এ জয়দেব লিখেছিলেন এই কবিতা –– ‘নিজেকে দেখুন’। তখন ১৯৯৬ দূর স্বপ্ন। কষ্টকল্পনাতেও ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ‘অনুষ্ঠিত’ হয় নি। কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যকে সবাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সাধাসাধি করছে –– এটা ভাবা যায় নি। 
    এর ১০ বছর আগে, ১৯৮৬-র ১৭ জানুয়ারি রাত ১১টা ৫৩ মিনিটে জয়দেব বসু লিখলেন, কবিতা  –– ‘বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য বিষয়ে’। 

    ৮.
    পার্টি যার ঈশ্বর, পার্টি যার ধ্যানজ্ঞান, সেই জয়দেব তখন পার্টি-সদস্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফেডারেশন কর্মী। ১৯৮৪-তে রাজীব ক্ষমতায়। এই প্রথম বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস রাজ্যে সরকার ফেলবে না। ভয় কাটছে। তার মানে নামছে রাজীব গান্ধীর জনপ্রিয়তার পারদ, ঈষৎ –– সেই সময়ে দেশে বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলা। স্বৈরতন্ত্রী কংগ্রেসকে হঠানো। সেজন্য প্রয়োজন বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য। কিন্তু কেবল দলীয় দর্শন নয়, রাজনৈতিক দর্শন বড় হয়ে উঠেছে কবির কাছে। তাই জয়দেব লেখেন––  ‘প্রতিটি কবিতার জন্ম, তুমি চাও বা না-চাও, হয় রাজনীতি থেকে।’ জানাতে চান গভীর বিশ্বাস থেকে –– ‘প্রতিটি শিশুর জন্ম, সঙ্গমের ফলে শুধু নয়, নিবিড়-নিবিড়তম রাজনীতি থেকে।’ আর রাজনীতি কী? কী জয়দেবের ভাবনা? ‘রাজনীতি মানে আমি মানুষকে ঘৃণা করা, মানুষকে রুদ্ধশ্বাস ভালোবাসা বুঝি, / এবং, মানুষ চিনি নাম দিয়ে নয়, ক্ষমা কোরো, কাজ দিয়ে, পার্টি দিয়ে চিনি।’ এই ‘কাজ’ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু যেই ‘পার্টি’-তে চলে গেলেন, তখনই একটা সর্বনাশের ইঙ্গিত দিলেন। 
     পার্টি –– পার্টিই কি সব? যদিও কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করে যে, কোনো দেশে একই সময়ে কেবল একটাই কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে। কিন্তু কোনটা আসল কমিউনিস্ট পার্টি বা পার্টিটা আদৌ কমিউনিস্ট পার্টি কি না? কমিউনিস্ট নামের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কি না –– কে কবে মোরে, জয়দেবদা? 
     পার্টি দিয়ে মানুষ চেনার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এক সময়ে যেতে হয়েছে বলে বুঝি –– এ এক বিপজ্জনক ঝোঁক। এক অন্ধকার মশাতন্ত্র। পার্টি কারও জীবন হতেই পারে। কিন্তু পার্টি দিয়ে মানুষ চেনা বিপজ্জনক কৃষ্ণগহ্বর। এতে প্রবেশ আছে, পরিত্রাণ নেই। পরিশ্রমও নেই। তাই এক সময়ে সব ‘আমাদের লোক’ হয়ে যায়। আর এই ‘আমাদের লোক’-রাই আবার ক্ষমতা রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ‘আমার লোক’-এ রূপান্তরিত হয়। জয়দেব অন্যত্র লিখেছিলেন –– 

    বেদীর উপর থেকে বাণী দেওয়া ছাড়ো।
    সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু কাউকেই তোষণ কোরো না।

    কিন্তু সেটা ঘটতেই থাকে। পার্টি তখন মতাদর্শের নয়, ভোটের, নোটের, জোটের বা ঘোঁটের হয়ে যায় বলে। বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যর নামে ‘ঘোঁট’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে আছে তাও বুঝতেন জয়দেব বসু। তাই লেখেন ––
       
    হে আমার গণতন্ত্রী প্রাণীশাবকেরা, 
    তোমাদের সাথে আমি শুয়ে আছি ভাগাভাগি তেঁতুলপাতায় 
    সে কেবল তোমাদের ফুসলে নেব বলে। 

    তরুণ ভাবুক, স্বপ্নদর্শী জয়দেব জানতেন না, গণতান্ত্রিক প্রাণীশাবক দূরে থাক, পুঁজিবাদী, এমনকী সাম্রাজ্যবাদীরাও তাদের ফুঁসলে নিতে তৈরি হচ্ছে। 
     জানতেন না বলাটা বোধহয় ভুল হল। জয়দেব জানতেন। আর জানতেন বলেই তাঁকে লিখতেই হয় ––  

    তারপর, 
    “ইটস ইওর টাইম কমরেড মাউজার...” 

    মাউজার মানে অস্ত্র। বন্দুক। রণধ্বনি। শুধু ব্যালট নয়, বুলেটের দিকে তাকানো, পার্টি গঠনতন্ত্রের ১১২ ধারায় প্রকৃত মূল্যায়ন করার। যতদূর সম্ভব শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রের উত্তরণে যাওয়া সম্ভব না হলে –– রক্তপাতে, অশ্রুপাতে, সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। 
     জয়দেব বসু তখন জানতেন না ১৯৮৭-তে পার্টি মুচলেকা দেবে –– সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা রেখে। 
     ব্যক্তি আর ব্যক্তির সামাজিক সত্তা তো আলাদা হয় কখনো কখনো। কবি আর কবির স্বপ্ন তো আলাদা হয় না কখনো। বাস্তবে যাকে পাই না, তাকেই তো কল্পনায় খুঁজে পেতে চাই। মনের বাইরে তৈরি হয় গুহা-মন। এই গুহা-মন প্রবণতাই রোমান্টিকতা।
     জয়দেব, মদ নন, মার্কসবাদী পার্টির নন, জয়দেব বামপন্থী রোমান্টিকতার কবি। 
     সেই রোমান্টিকতাই তাঁকে নিজেকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে নষ্ট করতে শেখায়। মাউজার জুটল না। বদলে জুটল এল সি-প্রমুখের খবরদারি, কাটা-ছেঁড়া, তরজা, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। আর তাই রোমান্টিক জয়দেবের কাছে এল প্রলয়ংকর মদ, মোহ। ‘আত্মঘাতী’ হলেন জয়দেব। স্বেচ্ছা ‘আত্মঘাতী’। বাম গণতান্ত্রিক প্রাণীশাবক আর পার্টি প্রাণীশাবকে যখন তফাৎ করা যাচ্ছিল না, তখন পার্টি-অন্তপ্রাণ জয়দেব নামে জুড়লেন ‘হার্মাদ’। 
     হার্মাদের মূলে আছে ‘আর্মাডা’। মাউজার তুলে নিতে চেয়ে সেই আর্মাডার দিকে তাকাতে বলেছিলেন সবাইকে। এই আর্মাডার বদলে ‘আর্ম’ বড় হয়ে উঠল। বাহুবলের সঙ্গে যোগ দিল বাক্যবল। 
     আর তাই অনেক অ-নে-ক অ-নে-ক নিবিড় স্বপ্নভঙ্গের শেষে অ-শঙ্খীয় আবেশে ফেব্রুয়ারির এক ওমহীন সকালে আমাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন জয়দেব। 
     গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন স্বপ্ন, যে স্বপ্ন দেখলে মাওবাদী বলে না সামূহিক পরাভব জেগে ওঠে! 
     যাবতীয় প্রাণীশাবকেরা যদি তোমার কথা কিঞ্চিৎ শোনে, জয়দেবদা! 

    **************************************************** 

    পুনশ্চঃ- প্রতিমা ঘোষ একটি চমৎকার, মননপ্রসারী স্বাদু নিবন্ধে লিখেছেন –– জয়দেব ‘শব্দ-খ্যাপা, জীবন-খ্যাপা’। তার সঙ্গে জয়দেব স্বপ্ন-খ্যাপা, পার্টি-পাগলা, বিশ্বাসে স্থিত, ভবিষ্যতের আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। 
     আপত্তি আছে? তর্কে আসুন, বন্ধুরা, মাতি তরজায়।
     
    সৌজন্যে : পাঠকই কবিতা 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Neptune_Plato | 37.111.193.214 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৫৩504351
  • খুব ভাল লেখা ; বিজেপি সামর্থক গাধাদের নিয়ে পরিসর নষ্ট করার চাইতে এমন লেখা আরো বেশি ছাপা হওয়া দরকার !
  • Emanul Haque | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:২৯504401
  • ধন্যবাদ
  • Sumantune | ১৯ মার্চ ২০২২ ২৩:১৩505040
  • চমৎকার লেখা 
  • কৃশানু ভট্টাচার্য | 115.187.42.175 | ১৯ মার্চ ২০২২ ২৩:৪৩505045
  • অনবদ্য দাদা।
    মনে হলো একটা কবিতা পড়ছি।
    অসাধারণ মূল্যায়ন ও নিজের চোখে দেখা সময় ও মানুষকে চেনানো।
    শ্রদ্ধা নেবেন 
  • Emanul Haque | ২০ মার্চ ২০২২ ০০:০৫505046
  • সৌজন্যে::পাঠকই কবিতা
  • Sandipan Majumder | ২০ মার্চ ২০২২ ০৭:৩৪505054
  • অসাধারণ  লেখা।  এত হৃদয়স্পর্শী মূল্যায়ন ঘোরের মধ্যে ফেলে দিলো।
  • গৌতম সরকার, মালদা। | 45.249.68.34 | ২০ মার্চ ২০২২ ১১:০৪505068
  • এই অসাধারন সময়োপযোগী বিশ্লেষনটা আমাদের অনেকের প্রয়োজন ছিল। কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকেও একটু সামনে আনুন প্লীজ।
  • Emanul Haque | ২০ মার্চ ২০২২ ২৩:০৮505101
  • ধন্যবাদ গৌতমবাবু। চেষ্টা করবো
  • তৌহিদ হোসেন | 2402:3a80:1cd1:c90b:278:5634:1232:5476 | ২১ মার্চ ২০২২ ১৪:৪৯505138
  • অনবদ্য আলোচনা। স্পষ্ট, ধারালো। সুখপাঠ্যও। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন