এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দশমীর চকোলেট

    Saikat Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ অক্টোবর ২০২১ | ৫৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • লকডাউনের সন্ধ্যে।

    বাড়ি ফাঁকা।

    পুজোর মরশুমে বই নিয়ে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছিল না–হয়তো দু-বেলা দুমুঠো ভাতের অভাব বা দেশে চাকরি কোনোটাই নেই বলেই। একমনে সিলিং ফ্যান দেখতে দেখতে চোখ গেল ঘরের কোণে দেওয়ালের ফাটা দাগটায়। হালকা ফাটা দাগটার একেবারে শেষ প্রান্তে কোত্থেকে যেন একটা মাকড়সা এসে জাল বুনেছে। জীর্ণ হলুদ রঙের দেওয়ালে ফাটা দাগ আর মাকড়সার জালের ধূসর বলিরেখা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল বাড়িটার বয়স হয়েছে। ঠাকুমারও বয়স হয়েছিল। বয়স বাড়লে সবারই যেন একটা অদ্ভুত রকমের অসুখ করে–সে বাড়ি, গাড়ি, জামা, জুতো হোক, বা মানুষ। তবে বাড়ি-গাড়ির বয়স বাড়লে তাদের মেরামত করে বয়স কমিয়ে নেওয়া যায়। মানুষের বয়স বাড়লে কমানোর উপায় নেই। তারা হারিয়ে যায় চিরতরে। মাঝে মাঝে মনে হয় এরকমভাবে মানুষেরও বয়স কমাতে পারলে বেশ হতো। ঠাকুমাকে আজও দেখতে পেতাম। পুরোনো বাড়ি সারিয়ে রং করলে যেরকম নতুন লাগে, সেরকমই বয়স কমানোর পর হয়তো ঠাকুমা ফিরে যেতেন তাঁর শৈশবে–অনেকটা পাকা চুলে কলপ করার মতো। বাবার বৃদ্ধা মা হয়ে যেতেন তাঁর ছোট্টো মেয়ে। মা-কে আর আমার ছোটো চুল বাঁধার চেষ্টা করতে করতে বলতে হতো না, "বাবু, তুমি মেয়ে হলেই ভালো হতো; চুল বেঁধে দিতাম, আমি কোথাও গেলে বাড়িটা সামলে রাখতে বলতে পারতাম..."

    অবশ্য মায়ের মেয়ে না থাকার দুঃখটা ঠাকুমা কিছুদিনের জন্যে হলেও লাঘব করতে পেরেছিলেন। ঠাকুমার জীবনের শেষদিকে মাকে দেখেছি বার-বার অবিশ্রান্ত ভাবে হাসিমুখে ঠাকুমাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে, স্নান করিয়ে দিতে। এসব নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রশ্রয় মেশানো ভালোবাসায় মা বলতো, "মা তো এখন আমার মেয়ে; ছোট্টো মেয়েকে তো এইটুকু ভালোবাসতেই হয়। কথা না শুনলে আমি তো ওনাকে বকেও দিই।" মায়ের ধারণা ছিল, হয়তো এখনও আছে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষের মনের বয়স কমতে থাকে। যখন শরীরের বল কমতে কমতে মানুষ একটা শিশুর মতো পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তার মনের ভিতরেও একটা শিশু জন্ম নেয়। শিশুদের সঙ্গে তাদের একটাই পার্থক্য থাকে, ছোট্টো শিশুরা তাদের পছন্দমতো সবকিছু না পেলে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে থাকে; কিন্তু বৃদ্ধ শিশুরা কাঁদে না–হয়তো নিষ্ঠুর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের কাঁদতে ভুলিয়ে দেয়–তারা গোমড়া মুখে বুকভরা অভিমান নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

    ডিং ডং... ডিং ডং...

    কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি মা-বাবা ফিরেছে। মা সাধারণত বেরোয় না এইসময়, আসলে দুর্গাপূজা উপলক্ষে আটচালায় আজ পাড়ার মহিলাদের একটা মিটিং ছিল; বাবার সান্ধ্যআড্ডাও এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় না, তবে আজ সম্ভবত আড্ডা মাঝপথে থামিয়ে এসেছে মা কে বাড়িতে পৌঁছে দিতে। ঠাকুমার দেখাশোনার জন্য গতবছর পুজোর কাজে মা সেভাবে লাগতে পারেনি। তাই হয়তো এবারে একটু বেশিই উদ্যোগী। বাবাকে বলতে শুনলাম, "ঘোষবৌদি এসেছিলেন? জেঠুর শরীরের অবস্থা তো একদম ভালো নয় শুনলাম।"

    ঘোষ দাদু এ অঞ্চলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভালোই ছিলেন। তারপর ঘোষ ঠাকুমা মারা যেতেই যেন একেবারে ভেঙে পড়লেন। ছোটবেলায় যখন পাড়া ঘুরে খেলতাম উনি আমাদের সবাইকে ডেকে ঘোষ ঠাকুমার বানানো আচার খাওয়াতেন। আর পুজোর পরে, বিজয়া দশমীর দিন চকোলেট। খানিকটা চকোলেটের লোভেই গতবছর দশমীর প্রণাম করতে গিয়ে দেখেছিলাম ঘোষ ঠাকুমা শয্যাশায়ী। প্রণাম করার পর শুয়ে শুয়েই আশীর্বাদ করেছিলেন। জলভরা চোখে বলেছিলেন ওনার জন্যেও প্রার্থনা করতে। কি করণীয় বুঝতে পারছিলাম না, কাউকে মনমরা দেখলে এমনিই বেশ খারাপ লাগে। অবশ্য নিজে থেকে কিছু বোঝার আগেই বাইরে থেকে রমা কাকিমার বাজখাঁই চিৎকার শুনেছিলাম। দাদুকে যাচ্ছেতাই ভাবে ভর্ৎসনা করছিলেন চকোলেট কিনে আনার জন্য–উনি নাকি ছেলের টাকায় পাড়াসুদ্ধু লোকদের দান করে বেড়ান, বাড়িতে যে একটা রুগীর পিছনে জলের মতো খরচ হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো হুঁশ নেই ইত্যাদি– স্পষ্ট মনে আছে, ঘোষ ঠাকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে মুখ নিচু করে মা দুর্গার কাছে ওনার জন্য প্রার্থনা করতে করতে সোজা বেরিয়ে এসেছিলাম।

    বাবার প্রশ্নের উত্তরে মা চুপ করেই ছিল। দরজা খোলার সময় মুখে যে আনন্দ দেখেছিলাম সেটা যেন উধাউ হয়ে গেছিল। উত্তর না পেয়ে বাবাকে স্বগতোক্তি করতে শুনলাম, "ঘোষ জেঠু যেন হঠাৎ করেই ভেঙে পড়লেন, জেঠিমাও চলে গেলেন!"

    মা অস্ফুটে বললো, "উনি বেঁচে গেছেন।"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২৮ অক্টোবর ২০২১ ০৮:০৭500313
  • বয়স্ক মানুষদের পারিবারিক অবহেলা, নিষ্ঠুরতা সত্যিই খুব কষ্টের, চোখ ভিজে যায়! 
     
    আরও লিখুন 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন