ত্রাণ দিয়ে কী হয়?
ত্রাণ দিয়ে কী হয়?
ত্রাণ নিয়ে কী হয়?
এইসব ভাবতে ভাবতেই লোকটি পৌঁছে যায় এক কংক্রিটের রাস্তায়। গাড়ি ওঠে না উঁচু রাস্তায়। অগত্যা হাত ধরাধরি করে নামাতে হয় চালের বস্তা। চালকের সঙ্গে হাত লাগাতে গিয়ে হাঁফিয়ে রায় করোনার সদ্য আধ সেরে ওঠা লোকটি। একটু আগে কৌতূহল বসে দেখেছে অক্সিমিটার। ৯২।
যন্তর ভুল।
না আরেকজনের আঙুলে দেয়। ৯৮।
নিজেকে বোঝায় কোথাও ভুল হচ্ছে।
লোকটি-- আমাদের আধ চেনা লোকটি;
আসতো না।
এক সাংবাদিক খবর করেছিলেন।
সাংবাদিককে পছন্দ করেন আমাদের আধচেনা লোকটি। কী সব জরুরি কথা আছে।
সাংবাদিকের একটা চায়ের দোকান ছিল স্টেশনে। তা বন্ধ। লক ডাউনে।
সাংবাদিকতা তাঁর নেশা। চা বিক্রি পেশা। গাদাগুচ্ছের রোগ ও ঝামেলা বাধিয়েছে সাংবাদিকটি পরোপকার করতে গিয়ে।
সে-বিষয়ে পরামর্শ করতে চায়।
কোথায় বসাবে তাঁকে।
অগত্যা লোকটিই চলে যায়।
সাংবাদিকটি একটি খবর করছে এক বৃদ্ধ ছোটোখাটো শরিক দলের বামপন্থী কর্মীকে নিয়ে।
জলে ডুবে আছে তাঁর ঘর।
ঘর যদি বলা যায় তাকে। বাঁশের চাটাই দিয়ে ৪৫ বছর আগে বানানো।
একাই এসেছিলেন এই পঞ্চভারতীতে। তখন লোকে বলতো ঝিল এলাকা।
ঝিল আর ঝিল।
জনমনিষ্যি নেই। একদিকে চাষের জমি আর একদিকে ঝিল।
১৯৬৪র দাঙ্গার পর এখনকার চাষিরা পালায়।
কোথায় কেউ জানে না।
জানতেও চায় নি।
তারপর কিছু জমি চাষ হতো কিছু পড়ো।
অবশেষে ১৯৮০ তেল একজন তিনহাজার টাকায় তিন কাঠা জমি হাত চিঠি করে লিখে দেয়।
নতুন বৌ নিয়ে চলে আসেন অধীর।
নামেও অধীর কাজেও।
হাতে টর্চ আর লাঠি দিয়ে ফিরতেন রাতে রিক্সা চালিয়ে। তারপর একটু পার্টি অফিসের বাইরের বেঞ্চে আড্ডা।
বউ লন্ঠন জ্বেলে লাঠি হাতে সাপ তাড়াতো আর লোকটাকে গাল দিতো।
কী ভুল না করেছে এই লোকের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে।
পেটে বাচ্চা।
খুব গাল দেওয়াও ঠিক নয়। পেটের বাচ্চাটাও শিখে যেতে পারে।
তাই ভালো ভালো কথা ভাবতে ইচ্ছে করে।
'দানবীর হরিশ্চন্দ্র' পালা মনে করে ।
একা একা থাকতো শ্মশানে।
শ্মশানে তো তবু লোক আসতো পোড়াতে।
এখানে রবিবার লোক আসে ঝিলে মাছ ধরতে।
সেদিন লোকটা কোথাও যায় না। বিড়ি খায় আর দুএকটা মাছ জোগাড় করে খিদমত খেটে। নিজেই কেটেকুটে ঝাল বানায়।
বৌয়ের সোহাগ দেখে কে?
একদিন একটা কুকুর এলো দুপুর বেলায়। লোকটার সঙ্গে। আর গেলো না।
থেকে গেল।
বৌটা মাঝে মাঝে কথা কয়।
তারপর বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে বৌটা মরে যেতে যেতে বেঁচে গেল।
ততদিনে ইন্দিরা গান্ধী মরে গেছে। যেদিন মরলো,দুটো ঘটনা ঘটল।
এক মেয়ে হলো।
বৌ ভালো করে চোখ মেলে বলল, মেয়ের নাম হবে ইন্দিরা।
আর সে ২০-২৫ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে এসে দেখলো পাশের একটি টিনের ঘর বাঁধা হয়েছে।
তাতে একটা নতুন বৌ নতুন সিঁদুর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিকেলেই ভাব হয়ে গেল।
মেয়ের দায়িত্ব নিল লালগামছা সই মিতা।
দুই বাড়ির রান্না একসঙ্গে।
#
আস্তে আস্তে পাড়া ভরলো। পাকা বাড়ি হলো।
কিন্তু লোকটার কিছু হলো না।
শুধু বয়সের কারণে রোজগার কমা ছাড়া।
একদিন বৌটা মরে গেল, বিধবা মেয়েকে রেখে।
লোকটার বয়স এখন ৭২, মেয়ের ৪২।
করোনায় রোজগার গেছে। মেয়ে লোকের বাড়ি রান্না করে আর চোখের জল মোছে আড়ালে।
এইসব রান্না যদি সে বাবাকে একদিন খাওয়াতে পারতো।
#
গতবছর আমফান গেলো।
ঘরের অবস্থা শোচনীয় হলো।
তার বাপ দল বদলায় নি। কিছু হলো না। এবার ইয়াস ঝড়। জল সেই বাড়লো, কমলো না। মাথার ওপরে জল পায়ের নীচে জল। স্টোভ তুলে রান্না বাঁশের চৌকির ওপর।
আমাদের গল্পের সাংবাদিক তাকে নিয়ে খবর করেছে। একটা আধটা লোক আসছে।
হিল্লে হতে পারে শুনছে।
মেয়ে বলে, চলো চলে যাই।
কোথায় যাবি?
চুপ মেরে যায়।
তিনদিন সবাই পঞ্চভারতী স্কুলে ছিল। তাঁরাও।
এখন?
স্কুলের সামনের রাস্তা জমজমাট। মোড়ে ঘুগনি বিরিয়ানির দোকান খুলতে খুলবে করছে।
শুধু চৌরাস্তার মোড় ছাড়ালে বাকি এক কিমি প্রায় অদৃশ্য ইটের রাস্তা।
রাস্তাকে গিলে নিয়েছে ঝিল আর পুকুরের জল। ঝিলকে গিলেছে কচুরিপানা আর মুথাঘাস।
তারা রয়ে গেছে আর রয়ে গেছে সাপ।
বিদ্যুৎ এসেছে মাথায়।
ছাউনি পাকা নয়।
দেওয়ালও।
পাক্কা একশো মিটার হাঁটু ডোবা জল।
পা কুটকুট করছে বাবুদের।
মেয়েটি বোঝে।
ওরা তো কেরোসিন মাঠে রোজ।
পায়ে।
আমাদের লোকটিও কুটুকুটে পা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটি ও মহিলার দুয়ারে।
৪২ বছরে মেয়েরাও মহিলাও হয়ে যায়।
বাহাত্তরের বাপও বুড়ো।
লোক টি এসেছে ত্রাণ নিয়ে।
তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।
কেন এলো সে?
ফিরে যাবে?
নাকি মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নেবে---
ত্রাণ দেওয়া উচিত না উচিত নয়?