এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গল্প: সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানাং

    Sankar Tutu Speaking লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ জুন ২০২১ | ১৪০০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মাথাটা নীচু করে বসেছিলেন বৃদ্ধ মানুষটি। দুটো চোখে শূন্য দৃষ্টি। এতক্ষণে বেশ কয়েকবার তার নাম ডাকা হয়ে গেছে। তিনি শুনেও শোনেন নি। উঠে এগিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। স্থির, স্তম্ভিত অনুভূতিহীন এক মানুষ। খাতায় লেখা তথ্য জানাচ্ছে,

    নামঃ- শ্রী মাধবচন্দ্র ভট্টাচার্য্য
    বয়সঃ- ৭০ বৎসর (আনুমানিক)
    পেশাঃ- পুরোহিত
    ঠিকানাঃ- জানা যায় নি, খোঁজ চলছে।

    আজ দিন সাতেক হল একটি স্কুলের ঘরে ঠাঁই হয়েছে মাধবচন্দ্রের। আরও আরও বহু মানুষের সাথে। সরকারী ব্যবস্থাপনায়। এর পোষাকি নাম ত্রাণশিবির। দুবেলা ভাত তরকারী অথবা খিচুড়ি দেওয়া হয়, যেদিন যেমন। মাঝে কিছু মানুষ শিবিরে এসেছিলেন। তাঁরা সরকারী নন। নিজেদের উদ্যোগে। এন জি ও। মুড়ি, চিঁড়ে, গুড়, নুন, টুথপেস্ট এইসব দিয়ে গেছেন ক্যারিব্যাগে। আর মাধবচন্দ্রের বয়স দেখেই বোধহয় তাঁকে দিয়েছেন ধুতি, চাদর, গামছা। বোঝা যাচ্ছে সবগুলিই আগে কারো দ্বারা ব্যবহৃত। সেগুলোই গায়ে দিয়ে বসেছিলেন মাধবচন্দ্র। পাশে পড়ে আছে খাবারের প্যাকেট। ভ্রুক্ষেপ নেই। সমস্ত ভাবনাচিন্তা ওলটপালট হয়ে গেছে। আজন্ম অর্জিত সম্মান আজ প্রশ্নচিহ্নের সামনে।

    কিছু নার্স আর দুজন ডাক্তার এসেছেন এই শিবিরে। আশ্রিত মানুষগুলোর মেডিক্যাল চেক আপ হচ্ছে। সে কারনেই নাম ডাকা। মাধবচন্দ্রেরও নাম ডেকেছে। তাঁর ইচ্ছে নেই, একেবারেই। দেহে নয়, মনে কষ্ট তাঁর। আছে কি সেই ওষুধ এদের কাছে? কে জানে?

    *******

    আশেপাশের পাঁচ-সাতটা গাঁয়ে ঘরে ঘরে ভয়ে ভক্তিতে তটস্থ হয়ে থাকে। ঠাকুরমশাইয়ের এমনই দাপট। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করেন মাধব ভট্চায। তবে ঠাকুরমশাই যতই খড়্গহস্ত হোন না কেন, গৃহস্থের ওনাকে দিয়েই পুজো করানো চাই। নাহলে যেন পুজো করিয়ে তৃপ্তি হয় না। গ্রামের দূর্গাপুজো, কালীপুজো সবেতেই মাধব বাবুই শেষকথা। সম্মান, প্রতিপত্তি এমনই তাঁর। তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুনলে নিজে নিজেই হাত কপালে ঠেকায় আট থেকে আশি। অথচ শুধু দক্ষিণাটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু নেন না। কাকভোরে নদীতে স্নান সেরে নদীকে পুজো করে, গৃহদেবতার পুজো সেরে দিন শুরু হয়। শিক্ষিত মানুষটি একসময় শহরের স্কুলে ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন। রিটায়ার করার পর স্ত্রী গত হওয়ায় নিঃসন্তান মাধববাবু নিজের গাঁ রামদেবপুরেই ফিরে এলেন পাকাপাকিভাবে। অখন্ড অবসর। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের একটা ঘরে গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের পড়া দেখিয়ে দেন। টাকা পয়সার কথা বলতে গেলে তাঁর উত্তর সবাই জানে, “আমি একা মানুষ। এই তো পেনশনে আমার বেশ চলে যায়। টাকা কি হবে? তোরা তো আছিস। মরে গেলে দাহকাজটা কেবল করে দিস, তাহলেই হবে”। এরপর আর কেউ কথা বাড়াতে সাহস করে না। সারাজীবন এভাবেই মাথাটা উঁচু করে বেঁচেছেন।

    *******

    দিন দশেক আগে যখন মাইকে ঘোষণা হল যে গাঁয়ের সবাইকেই নিজের নিজের বাড়ি ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরের একটা হাইস্কুলে গিয়ে ত্রাণশিবিরে উঠতে হবে, গাঁয়ে কান্নাকাটি পড়ে গেছিল। পটলার দোকানে মাধববাবুকে পেয়ে সবারই প্রশ্ন, “স্যার, কি হবে?” ঠাকুরমশাই, ছেলেপুলে নিয়ে কি এবার পথে বসব? মাধববাবু ধমক দিয়ে বললেন, তোদের সবেতেই বাড়াবাড়ি। আগে কখনো বান দেখিস নি না আগে কখনো দুর্যোগ হয় নি? যেমন নদীর জল আসে প্রতিবার, আবার নেমেও যায়, এবারেও তাই হবে। অত চিন্তা করছিস কেন?

    সঠিক দিনে দরকারী জিনিষটুকু নিয়ে সকলেই রওয়ানা হল হাইস্কুলের পথে। সেখানে পৌঁছে শুরু হল প্রহর গোনা। তুমুল ঝড় এলো, আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি এলো। উথাল পাথাল হলো চারিদিক। ডুবে গেল গ্রামের পর গ্রাম। ভেসে গেল কত সংসার। তারপর আবার এক সময় প্রাকৃতিক নিয়মে সব থেমেও গেল, যেমন ভীষণ ঝড়ের পর শান্ত হয় মানুষ, তেমন প্রকৃতিও। তখন আবার নতুন প্রতীক্ষা। কখন সবাই ঘরে ফিরবেন?

    *****

    আর তারপরেই এল চরম দুঃসংবাদ। যে দ্বীপটিতে তাঁদের গ্রাম-বাড়ি-সংসার, সেই দ্বীপটাই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সমুদ্রের গর্ভে মিলিয়ে গেছে। এই সেদিনও যেখানে তাঁদের চাল-ডাল-হাসি-ঠাট্টা-রাগ-গান-সকাল-সন্ধ্যে ছিল, আজ সেখানে শুধু নদী-সমুদ্র, শুধুই জল আর জল। শুধুই ছলাৎ ছলাৎ।

    নোটিশ এসেছে এরই মধ্যে। এই স্কুল বাড়ির ত্রাণ শিবির খালি করা হবে। মাধবচন্দ্র দেখলেন একটা ফর্ম সবার হাতে হাতে ঘুরছে। তাতে জানাতে হচ্ছে, কে কোথায় যেতে চায়? মাথাটা নীচু করে বসে আছেন মাধবচন্দ্র। তাঁর হাতেও কেউ একটা ফর্ম দিয়ে গেছে। কোথায় যেতে চান? কি লিখবেন? এ উত্তর তাঁর জানা নেই। নিজের গ্রামটি ছাড়া আর যে তাঁর যাবার কোথাও নেই। সারাজীবন যে নদীকে মাতৃরূপে তিনি পুজো করেছেন, উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করেছেন, “সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনী...”, সেই নদীই আজ তাঁর সৃষ্টি, স্থিতিকে বিনাশ করেছে?

    *****

    ধীর পায়ে স্কুলবাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধ মাধবচন্দ্র। সামনে পড়ে অন্তহীন পথ, বিশাল পৃথিবী, মাথার ওপর খোলা আকাশ। কোথায় যাবেন, কি করবেন, কিচ্ছু জানা নেই। শুধু মনে মনে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন, কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। সারা জীবন ধরে ভূগোল পাঠ্যপুস্তকে পড়া অথবা ছাত্রদের শেখানো একটা সংজ্ঞা আজ তাঁর কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে।

    শরণার্থী কাকে বলে?

    তাহলে, শুধু এক দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে অন্য দেশে এলেই যে শরণার্থী হয়, তা নয়। নিজের দেশেও মানুষ শরণার্থী হয়?

    -----------------------------------------------------

    আগামী কাল ২০শে জুন। বিশ্ব শরণার্থী দিবস।

    ( প্রসঙ্গতঃ- মাথা গোঁজার মত একটা আস্তানা আছে মানে ঠিক আজকের দিনে আপনি এই পৃথিবীর নব্বই কোটি মানুষের চেয়ে ভাগ্যবান )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন