বিমল করের 'সুখ' গল্পটার কথা মনে করিয়ে দেয় এই ছবি।
বছরের এই দিনটি এঁদের কাছে না গেলে মন বর্ণহীন হয়ে ওঠে।
যাওয়া ঠিক হবে কি?
দ্বিধান্বিত।
ফোন করি।
এসো।
আমার বাবা-মায়ের কাছে গেলে যে শান্তি পেতাম, এ যেন তার মতোই।
কলকাতার শেষ সামাজিক মানুষ।
শেষ সামাজিক দম্পতিও।
আমাদের পার্টি সমাজ, ক্লাব সমাজ, গোষ্ঠী সমাজ, ধর্মীয় সমাজ, ফেসবুকে খাপে খাপ সমাজ --- সামাজিক সমাজ মরে গেছে।
শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে সবাই যেতে পারতেন। পরস্পরের গলা কেটে নেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকতে বাধ্য হতো লোকে, লেখকে।
এবার পলাশ নিয়ে যেতে পারি নি।
পলাশের বড়ো আকাল কলকাতায়।
২০১৯ স্যার হাসপাতালে। তাই যাই নি দোলের দিন।
পরদিন স্যারের ফোন,তুমি কোথায়? বাংলাদেশ থেকে ফেরো নি?
আমি কোথাও গেলে স্যারকে বলে যাই। ত্রাণে গেলে প্রণাম করে। করোনা কালে অবশ্যই যাই নি।
ফিরেছি স্যার।
ও দোলের দিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল, তুমি আসবে ভেবে।
আমি নিজের কাছে কুন্ঠিত হয়ে পড়ি।
আমি শুধু স্যারের কথাই ভেবেছি।
'নয় বোনের বাড়ি'র লেখিকার কথা ভাবি নি।
আজ গেছি অনুমতি নিয়ে। দরজা থেকেই চলে আসার ইচ্ছে।
চলে আসছি।
স্যারের বাড়ির সহকারিণী বললেন, উনি অপেক্ষা করছেন স্নান করে। আপনি আসবেন বলে।
স্যার এলেন।
দূরত্ব রেখে বসলাম।
কথা হলো ইতিউতি।
৩৩ বছর যাচ্ছি ওই বাড়িতে। দোলে যাচ্ছি ১১ বছর।
একটু পরে প্রতিমা ঘোষ এলেন।
আমি বিব্রত, ভাবলাম, বকুনি জুটবে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এক্ষুণি চলে যাচ্ছি।
উনি কোনো কথা বললেন, না, হলুদ আবির খুঁজলেন। দেখিয়ে দিলাম। স্যানিটাইজ করে আঙ্গুল।
উনি আমার কপালে একটু আবির দিলেন।
তারপর স্যার শঙ্খ ঘোষের কপালে।
আমি ছবি তুলি না সাধারণত।
আজ ইচ্ছে হল।
তুললাম।
স্যারও একটু আবির তুলে দিলেন তাঁর প্রিয় ইভার কপালে।
আমারও একটু স্নেহ ছোঁয়া জুটল। আবিরে।
এতো মানসিক অশান্তি যাচ্ছে নির্বাচন ঘিরে।
মন শান্ত হয়ে এল। অশ্রু চিকচিক করে উঠল।
লিখতে লিখতে চোখ ভরে এল জলে।
চলে আসছি।
প্রতিমা ঘোষ, আসলে কী বলে সম্বোধন করবো বুঝতে পারি না মাতৃসমা এই মহিয়সীকে।
আমার দেওয়ার ছবি তুলেছো?
অক্ষম চেষ্টা করেছি। ছবি কি তোলা যায়?
চলে আসছি।
স্যার, মাথায় হাত রাখলেন।
আমার মন দীঘির ভরা জল হয়ে গেল।
২৮.০৩.২০২১
অশোক মিত্র বলতেন, জানো, শঙ্খ ঘোষ আমার লতায় পাতায় আত্মীয়। অশোক মিত্র আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য, রাজনৈতিক বিষয়ে ভরসা রাখতেন জ্যোতি বসুর ওপর। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের জীবনের ওপর কুৎসাপূর্ণ রাশিয়ান-জার্মান যৌথ প্রযোজনার ছবি 'টরাস' বিতর্কে তিনি আমাকে, জ্যোতি বসুর কাছে পাঠান।
যাও, কথা বলো। উনি বুঝতে পারবেন।
যদিও পার্টির এক সিদ্ধান্ত, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আর বেসরকারি কলেজের অ্যাডহক অধ্যক্ষ সবার বেতন সমান, এই সিদ্ধান্ত জ্যোতি বসু অশোক মিত্রের অমতে নেওয়ায়, তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন।
অশোক মিত্র আর যাঁদের খুব ভরসা করতেন, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, কুমার রায়, সুচিত্রা মিত্র, কল্পতরু সেনগুপ্ত, শোভা সেন এবং শঙ্খ ঘোষ। কোনো বিবৃতিতে সই দরকার হলে বলতেন, এদের সই নাও।
স্নেহের ছিলেন সুজিত পোদ্দার, মলয় চট্টোপাধ্যায়, জয়িতা ঘোষরা দুই বোন সহ আরো অনেকে।
২০১৩ তে ঠিক করলেন 'আরেক রকম' পত্রিকা বের করবেন ৮৫ বছর বয়সে। সঙ্গী শঙ্খ ঘোষ। শঙ্খ ঘোষ ৮১+।
দুই অশীতিপর মানুষ যে-ভাবে প্রুফ দেখে প্রেসে গিয়ে যে-মানের পত্রিকা বের করেছেন, তা এক ইতিহাস।
শঙ্খ ঘোষের লেখা খুব পছন্দের ছিল। আর পছন্দ করতেন, প্রতিমা ঘোষের লেখা। বলতেন, 'নয়বোনের বাড়ি'র লেখিকার একটা লেখা আনতে পারবে।
আমি সে-কথা প্রতিমা ঘোষকে বলতেই উনি হেসে বললেন, আমি কি আর লিখতে পারি?
বাংলা গদ্যের ব্যালেমাস্টার অশোক মিত্র আপনার লেখা পছন্দ করেন-- আর আপনি বলছেন, লিখতে পারি?
হেসে বললেন, হবে খন।
তাঁর কাছে গিয়ে বসলে মায়ের কাছে পৌঁছে যাওয়ার বোধ হতো।
যতোবার দেখেছি, প্রায় প্রতি রবিবার,হাতে একটি বই।
আতসকাচ দিয়ে পড়তে হতো।
পড়তেন। আর পড়তেন।
ছোটো বড়ো সবার লেখা। অনাদর করতেন না।
#
আবার বসন্ত আসবে।
দোলপূর্ণিমা।।
আমিও থাকবো কিনা জানি না, থাকলেও কাঠবাদামের বাতাস বয়ে আনা বাড়িতে আর যাওয়া হবে না।
#
বাতাস শুধু একজনের গায়ে মায়ের গন্ধ রেখে দিল