জে আর আর টোকিন ( J.R.R. Tolkien) তখন তাঁর বিখ্যাত লেখা "দ্য হবিট", জার্মান ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর পাবলিশারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। এই সময় তিনি নাৎসি হেডকোয়ার্টার থেকে একটা চিঠি পান। আসলে নাৎসি বাহিনী বুঝে নিতে চাইছিল, যে টোকিন জাত-ধর্মে ঠিক কতটা ইহুদি বা আদৌ টোকিনের সঙ্গে ইহুদি সংস্কৃতির কোনো সুদূরতম যোগাযোগও আছে কিনা। টোকিন-কে নাৎসি পার্টি থেকে চিঠি লিখে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। নিচে টোকিনের উত্তর।
ভদ্রমহোদয়রা,
আপনাদের চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমি দুঃখিত আমি ঠিক ধরতে পারলাম না 'আর্য' বলতে আপনারা ঠিক কী বুঝিয়েছেন। না আমি 'আর্য' নই। আমার কোনো ইন্দো-ইরানিয়ান উত্তরাধিকারও নেই। আমি যতদূর জানি আমার কোনো পূর্বপুরুষ হিন্দুস্থানি, ফার্সি, জিপসি বা এই জাতীয় কোনো ভাষা বা উপভাষাতে অভ্যস্তও ছিলেন না কখনো। কিন্তু আপনাদের অনুসন্ধানের হেতু যদি আমি ঠিকঠাক বুঝে থাকি তবে বলতে হয়, আপনারা জানতে চাইছেন আমার কোনো পূর্বপুরুষ ইহুদি ছিলেন কিনা? না আমার অরিজিনে এই অতি-সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ইহুদি জাত-ধর্মের কোনো স্পর্শ মাত্র নেই।
আমার প্রপিতামহ আঠারোশো শতকে জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। আমার বংশের মূল অংশটি তাই খাঁটি ইংরেজ। অথচ আমার জার্মান পদবীটিতে আমি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে এই পদবীটি আমার নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েই, দুর্ভাগ্যজনক যুদ্ধটিতে আমি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করেছি। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এবং সাহিত্যিকদের বিষয়ে আপনারা যদি এই ধরণের অনভিপ্রেত অনুসন্ধান চালাতেই থাকেন, তবে সেই দিন আর দূরে নয়, যখন কেউ নিজেদেরকে জার্মান বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করবে। আমার ধারণা, আপনাদের দেশের বর্তমান সরকারের অনুমতিক্রমেই আপনারা আজকাল এই ধরণের পুছতাছ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু এভাবে নিজের দেশের বাইরের কোনো সাহিত্যিককে যে এই ধরণের জিজ্ঞাসাবাদ করা যায় না, এই সাধারণ জ্ঞানটুকুও আপনারা বিস্মৃত হয়েছেন। তাছাড়া আমি ভাবতেও পারি না একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে তাঁর ইহুদি বা জার্মান উত্তরাধিকার কীভাবে সম্পর্কিত!
আশা করি আপনারা আপনাদের উত্তর পেয়ে গেছেন।
আপনাদের বিশ্বস্ত
জে আর আর টোকিন
এই চিঠির দ্বারা টোকিন শুধু ফ্যাসিস্টদের ভাঁড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনেননি, নাৎসিদের কারা 'আর্য', কারা ‘আর্য’ নয়—এই সংজ্ঞাটিও যে ত্রুটিপূর্ণ এবং সম্পূর্ণতই মনগড়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাল্পনিক, তাও বলেছেন। কিন্তু নাৎসি পার্টির এই যে ভুলে ভরা ন্যারেটিভ, টোকিনের চিঠিটি যদি সে-সময়ই প্রকাশ্যে আসতো, তবুও কি নাৎসি পার্টির সমর্থকদের ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে মোহভঙ্গ হতো? এর একটাই উত্তর, না।
ফ্যাসিস্টদের চরিত্রলক্ষণ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে আজকাল। এই চর্চা ভারতে তুলনামূলক ভাবে নতুন। ভারতের ঐতিহাসিকরা, জনজীবনের ধারাভাষ্যকাররা কিন্তু এতদিন ধরে ঔপনিবেশিকতার বিষক্রিয়া সম্পর্কেই লিখেছেন। সম্ভবত ফ্যাসিজমের এই উত্থান এবং মোকাবিলার জন্য কোনো আপৎকালীন প্ল্যানও আমাদের অভিভাবকরা তৈরি করে দিয়ে যাননি। তাই ফ্যাসিজম বা ছদ্ম-ফ্যাসিজমের বিষ এখন ভারত-শরীরে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু একটা কথা আমাদের বুঝে নিতে হবে, ফ্যাসিস্ট শাসক আর ফ্যাসিস্টদের সমর্থকরা একই অক্ষাংশে অবস্থান করলেও তাদের দ্রাঘিমাংশ আলাদা। ফ্যাসিস্ট শাসকরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মানুষের বিশ্বাসকে ম্যানিপুলেট করেন এবং তাকে এক্সপ্লয়েট করেন। সমর্থকরা? শাসকরা তাদেরকে যা বিশ্বাস করতে বলেন, সমর্থকরা তাই বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রে পড়াশুনা, তথ্য-উপাত্ত কোনো কাজেই লাগে ন। শিক্ষাদীক্ষা সব ব্যর্থ হয়। ফলে প্রচুর পড়াশোনা করা মানুষও ফ্যাসিজমের ‘ভক্ত’ হয়ে যান এবং পাড়ার মস্তানের ভাষায় কথা বলতে থাকেন। ফ্যাসিজমের অজস্র মুখ তখন এক হয়ে যায়। কিন্তু আবারও মনে করিয়ে দিই, এরা কিন্তু ফ্যাসিজমের মস্তিষ্ক নন, শুধুই মুখ। অর্থাৎ শাসকরা সত্যের পরিবর্তে 'সত্যের মতো'-কে প্রজেক্ট করেন এবং ভক্তরা তাকেই দ্বিধাহীন ভাবে গেলে। গত দেড়-দশক আগেও ‘ভক্ত’ শব্দটার মোটামুটি সদর্থক একটা মানে ছিল। আজ 'ভক্ত' শব্দটির মাহাত্ম্য কিন্তু ভক্তিতে নয়, তার অন্ধত্বে। ফলত এই অন্ধত্ব এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় যে শাসকের চূড়ান্ত ব্যর্থতায় ব্যক্তিজীবনের দুর্ভোগকেও সমর্থকরা মেনে নেয় এবং এই মেনে নেওয়াকে সে মনে করে তার দলের বা তার নেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার একটা সুযোগ। ভক্তের ধারণা হয়, এভাবেই সে দেশের প্রতি আত্মোৎসর্গ করবার একটা সুযোগ পাচ্ছে। ফলে প্রশ্ন করা তো দুরের কথা, ফ্যাসিজমের সমর্থকরা মনে মনে বরং কৃতজ্ঞ থাকে— এভাবে হলেও, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ স্বীকার করতে হলেও, পরোক্ষভাবে সে দেশ-সেবার একটা সুযোগ পাচ্ছে। এই অন্ধত্ব বা 'সত্যের মতো'-কে সত্য বলে ভাবা, ফ্যাসিজমের সমর্থকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রলক্ষণ। প্রশ্নহীনতাই একজন ভক্তের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। একজন ভক্ত বা সমর্থক, সেই মানুষ, যে শুধু একটা ন্যারেটিভেই আটকে থাকে। একটা বাইনারি। জাত-পাত-ধর্ম বা কখনো ন্যাশনালিজম। বহুত্ববাদ তখন তার কাছে শয়তানের ভাষা। আমাদের অল্পবয়সে কাউকে দেখিনি, "এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে", বা "পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে", এই হুমকি কেউ কাউকে দিচ্ছে। কিন্তু এখন, তুমি আমার মতের সঙ্গে একমত নও, তুমি অন্য ধর্মের, তুমি আমার পার্টিকে ভোট দেবার বিরোধিতা করো, তবে তুমি আমার সঙ্গে একই দেশে একই জাতির আইডেন্টিটি বহন করার উপযুক্ত নও। এই কথাগুলি এখানে বলছি এই কারণে যে, কেউ যদি ভাবে, তর্ক বা প্রতর্ক দ্বারা কেউ ফ্যাসিজম সমর্থকদের বুঝিয়ে বলবে তাদের বিশ্বাসের জায়গাগুলি কতখানি সারবত্তাহীন, সে গুড়ে শুধু বালি নয়, যথেচ্ছ পরিমাণে কাদা ও মাটি। "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ"। তাই আজ বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলও ফ্যাসিবাদকে রুখতে পারবে কি-না, সন্দেহ জাগে, যদিও এ ছাড়া উপায়ও তো কিছু নেই আপাতত।