এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভারতীয় গণমাধ্যম ও নারীসমাজ 

    riya das লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৬৭৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • গণমাধ্যমই হল সমাজের এবং সংস্কৃতির মুখ।আমরা সাধারণভাবে মনে করি গণমাধ্যমের ছায়াই আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। মার্শাল মাল্যুকয়হান তাঁর "understanding media" বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বলেছেন "Medium is the message"। আর এইখানেই বিশেষ করে মনে আসে নানারকম বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন এবং সিনেমার কথা। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রতিচ্ছবি শুধুমাত্র সিনেমা বা বিজ্ঞাপনেই নয় বরং নানা উপন্যাস, গ্রন্থ, কবিতা এককথায় সাহ্যিতেও ফুটিয়ে তোলা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্যে যেমন বেদ, উপনিষদ, পুরান বা মহাকাব্যে নারীর অবস্থান মোটেও কোনো উচ্চমার্গে নেয়। সীতার বনবাস অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় নারীর অসম্মান ও লাঞ্ছনার কথা। সেই সময় সমাজের নিয়ন্ত্রক ছিলেন মুনি, ঋষি, রাজন্যবর্গ। আর তাঁদের বিধানই ছিল বেদবাক্য। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ "মুনিসংহিতা" যাকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে তা নারীর জন্য মোটেই সম্মানজনক ও সুখপ্রদ নয়। যদিও অপালা, লোপামুদ্রা এই সব বিদূষী নারীর কথা আমরা জেনেছি। ক্রমে ক্রমে সমাজ ব্যবস্থাকে এমন এক শৈলীতে বুনে দেওয়া হয় যেখানে নারী শুধুই ভোগ্যপন্য। সময়ের সাথে সাথে দেবী পরিণত হল সেবাদাসীতে। দেবী সাজানোর মিথ্যা আশ্বাসে দেবদাসী হয়ে উঠলো ভোগ্য। প্রাচীন বৈদিক সমাজে স্ত্রীজাতির সাধারণ নাম ছিল "নারী" যেখানে নারী শব্দের অর্থ "নেত্রী" তাই আমরা অপালা, লোপামুদ্রার মতো নেত্রীদের পায়।যারা ছিলেন বিদূষী। রূপগরিমায় নয় যারা জ্ঞানগরিমায় ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।

    বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস নায়িকা প্রধান তাঁর নায়িকারা আত্মশক্তি, এবং বুদ্ধিমত্তায় নায়কদের ছাপিয়ে গেছেন। তারপরেও বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত বলেছিলেন, "নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না। স্ত্রী লোকের বিদ্যাও বড় নয়।" তাহলে একথা বলাই যায় যে তৎকালীন জ্ঞানী পুরুষগণও পুরুষ- স্ত্রী সমতা মেনে নিতে পারেননি। মুক্তচিন্তার মানুষ হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "চোখের বালি" র বিনোদিনীকে বিধবা বিবাহের মধ্যে দিয়ে সুখী করতে পারেননি। আর বঙ্কিমচন্দ্র তো রোহিনী চরিত্রের অপমৃত্যুই ঘটিয়ে দিলেন।

    নারী ও পুরুষের ভারসাম্য রাখার জন্য গণমাধ্যমে নারীর ইতিবাচক প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত জরুরী। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতার মধ্যে পণ্যের চাহিদা তৈরি করা একটি ব্যবসায়িক কৌশল। কিন্তু এখানেও নারিকে অধঃস্তন করে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করে যায়। বিজ্ঞাপনে নারীকে হাজির করা হয় যৌনতার অবলম্বন হিসাবে। যেন নারীর প্রথম কাজই হল পুরুষকে আকর্ষণ করা। পুরুষকে সন্তুষ্টি প্রদান করাই নারীর শেষ ভরসা। কখনো স্ত্রী বা মা ও ঘরোয়া মহিলা হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত সাধারণ দর্শক। আজকের সমাজের মূলমন্ত্র হল "প্রচারেই প্রাসার"।

    এই যেমন কিছুদিন আগেও "ফেয়ার এন্ড লাভলী" র যদিও এখন নাম বদলে "গ্লোও এন্ড লাভলী" র বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হত ফর্সা হওয়ার মাধ্যমেই নারীর স্বপ্নপূরণ সম্ভব। কি ভীষন অদ্ভুত, অবাস্তব, এবং হাস্যকর ভাবনা। কিন্তু আমাদের সমাজ এখন এটাই মেনে নিয়েছে। আর তাই নারীকে ঘিরে বিকৃত মানসিকতা গড়ে উঠেছে মানুষের মনে। বেশী দিন না এই কিছু দিন আগেই সানি লিওন একটি কনডোমের বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলেন। তাতে অনেকেই এমনকি কিছু ৰাজনৈতিক নেতাও মন্তব্য করেছিলেন এই বিজ্ঞাপনের ফলে ধর্ষণের ঘটনা নাকি আরও বাড়বে। আশ্চর্য কথা! শুধুমাত্র সানি লিওন অভিনয় করেছেন বলেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়বে। যদিও আমরা লক্ষ্য করেছি বিগত কিছু বছরে তিনি বলিউডের কিছু সিনেমার মধ্যে দিয়ে তার পর্ন তারকা ইমেজ কিছুটা হলেও ভাঙার চেষ্টা করেছেন। তবুও তাকে আমরা সমাজের স্বাভাবিক নারী হিসাবে মেনে নেব না এবং বাঁচাতেও দেব না। মার্কিন সাংবাদিক স্যার ওয়াল্টার লিপম্যানের মতে একেই মনে হয় বলে "stereotype reflects the picture in our mind to the specific things"। মানুষ সত্যিই নিজের মনের গড়ে তোলা চিন্তা ভাবনা থেকে বেড়োতে পারে না।

    সিনেমা হল আর এক আয়না। যাতে সমাজের মুখছবি স্পষ্ট দেখে যায়। কিন্তু এখানেও ব্যবসা ও লাভের হিসাব ও নারী পণ্য। প্রথমে আসা যাক কমার্শিয়াল হিন্দী এবং বাংলা সিনেমাতে। যেখানে সিনেমার গল্প ও বাস্তবের সাথে আকাশ আর পাতালের তাফাৎ। যেখানে দেখানো হয় তথাকথিত নায়ক নায়িকার সাথে অসভ্যতা করছে, হাত বা ওড়না ধরে টানাটানি করছে এবং নায়িকাও যথারীতি নায়ককে পছন্দ করছে এবং ভালোবাসছে। সত্যিই কি তাই? ভাবুন তো যদি বাস্তবে এই রকম হত তাহলে কি এইরকম অসামাজিক, উদ্ধত, নীতিজ্ঞানহীন মানুষকে কোন মেয়ে ভালোবাসতো? তা কখনও হত না। মেয়েরা সাধরণত সেই মানুষকে ভালোবাসে যে বা যারা তাদের সম্মান দেয়। তাহলে সিনেমার মাধ্যমে যুবসমাজে এই ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে নারীদের সাথে খারাপ আচরণ করা যায়। এবং এতে মেয়েরা আনন্দও পায়। যেটি একদমই ঠিক নয়।

    এর পরে আসা যাক "আইটেম সং" এর কথায়। প্রতেকটি কমের্শিয়াল সিনেমায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা কিনা দর্শকের আকর্ষন বাড়ায়। এখন এই গানগুলো শুনলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শোনা যায় তান্দুরি চিকেন, দারু, ককটেল, এই সব। আর এতে করে নারীকে শুধু পণ্য নয় একেবারে খাদ্যদ্রব্যে পরিনত করা হচ্ছে। আর ছোটোরা শেখে যে এই সব অশ্লীল দেহভঙ্গিমায় হাততালি পাওয়া যায়। জনপ্রিয় হওয়া যায়। আর ছোটো বাচ্ছাদের মনে যদি এই মানসিকতা বাসা বাঁধে তাহলে পরবর্তী সমাজ কোন দিকে এগোবে? আর সত্যিই কি মনে হয় যে এই সব অশ্লীল উত্তেজক ভঙ্গী নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যায়?

    "না" মানে কিন্তু আসলেই "না"

    অরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রেম ও যৌনতার ক্ষেত্রে নারীর বিশেষত ভারতীয় নারীর সম্মতি এবং অসম্মতি। আমাদের ছকেবাঁধা মজ্জাগত ধারনা এটি যে, কোনো ভারতীয় নারী যখন প্রেমে ও যৌনতার বিষয়ে "না" বলেন তখন তিনি মুখে না বললেও, এতে তাঁর সম্মতি আছে। এটি একদমই ভ্রান্ত একটি ধারণা উপস্থাপন করা হয় সিনেমাতে। সিনেমাতে কোনো ছেলের পক্ষে কোনো মেয়ের পিছনে লেগে থাকার ঘটনা খারাপ ভাবে দেখানো হয় না যেটি বাস্তবে খুবই বিরক্তিকর। এই সব ধারনা যুবসমাজকে ভুলপথে চালিত করে।

    কিন্তু বর্তমানে নারীর সামাজিক ও মানসিক দর্শন নিয়ে বেশ কিছু নারীকেন্দ্রিক সিনেমা তৈরী হচ্ছে। "থাপ্পড়" হিন্দী নারীকেন্দ্রিক সিনেমার এক মাইলস্টোন। এর মধ্যেই আছে "নীরজা" র মতো সিনেমা। নারীর চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে বলিউডের থেকে টলিউড এর ভূমিকা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়। সমাজ পরিবর্তন এর আশায় "বেলাশেষে", "প্রাক্তন", "ব্রহ্মা জানেন গোপন কর্মটি" এই সব সাম্প্রতিক সিনেমা সত্যিই আশার আলো দেখায়। যেমন "বেলাশেষে" এক বৃদ্ধাকে জীবনসায়াহ্নে এসেও পরনির্ভরতা কাটিয়ে আত্মনির্ভর কোরে তোলে। তেমনই "প্রাক্তন" শেখায় মানিয়ে নেওয়া ও আত্মত্যাগের ভেদ।

    এইবারে এই ভারতীয় সমাজে নারীর শাপমুক্তি ঘটুক। নারীদের মননে ও চিত্রায়ণে আত্মনির্ভর হোক ভারতীয় সিনেমা। এই আশার আলো দেখা যাক ভারতীয় গণমাধ্যমে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন