পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
।।১।।
সর্ষে বাটা দিয়ে পাবদা মাছ, কচি পাঁঠার ঝোল আর এক বাটি ক্ষীর সাঁটিয়েও দেখছি মেজাজটা সপ্তমে চড়েই রইল। সদ্য সদ্য বয়ফ্রেণ্ডের সাথে ব্রেকআপ হলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে! তা সবটাই কি আমার দোষ নাকি? টুকরো-টাকরা কথা কাটাকাটি তো হয়েই থাকে, কিন্তু একেবারে সোজাসুজি ছিঁচকাদুনে, সেলফিস, একস্ট্রাভেগেন্ট - আরো কী কী সব বলে গেল! তাও কিনা দেওয়ালির দিন, এক শপিং মল লোকের সামনে? আমিও ছাড়বার পাত্রী নয়। বেছে বেছে চারটে সুমধুর শব্দ রুবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি। বাড়িতে এসে প্রথমে খুব খানিক কেঁদে-টেঁদে নিলুম; সোস্যাল মিডিয়াতে ‘এনগেজেড’ কেটে ‘সিঙ্গল’ করেছি। কালকের দিনটা অফিস ছুটি নিয়ে বেছে বেছে বিরহের গান শুনেছি, ডিপ্রেশান কাটাতে পাঁচটা চকোলেট বার শেষ করে নিজের ওজন বাড়িয়েছি। কিন্তু এত করেও মাথাটা ঠাণ্ডা হচ্ছে না কিছুতেই। দুচ্ছাই।
হৃদয়ে মলম লাগাতে দুপুরবেলা শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ গুনছিলাম – আট দুকুনে ষোলবার হয়ে গেল, অঙ্ক কষাই সার হল। সেকেলে বাড়ি, আমার দাদুর। মার বাবা, তারও বাবার হাতে করে তৈরি। তবে আপাতত কড়িকাঠ গোনা ফেল, এবার মেডিটেশান থেরাপি। আমি চোখ বন্ধ করতেই মামুনের গলা।
- এই দেখ চুয়া, তোর মায়ের ম্যাট্রিকুলেশান সার্টিফিকেট।
মার ম্যাট্রিকুলেশান সার্টিফিকেট? আরেব্বাস, বলে কী? তার মানে তো অন্ততপক্ষে পঞ্চাশ বছর আগের কথা! হাত বাড়িয়ে হলদে হয়ে যাওয়া সার্টিফিকেটটা নিলাম। কী সুন্দর করে ক্যালিগ্রাফিতে মার নামটা লেখা – শ্রীমতী চিত্রলেখা ব্যানার্জ্জী। বিয়ের আগে তো ব্যানার্জ্জীই ছিল। বিয়ে হয়ে ভট্টাচার্য হয়েছে। আমি কিন্তু কিছুতেই বিয়ের পর নিজের পদবী বদলাব না। আগেভাগেই রুবাইকে সেসব বলে দিয়েছি। আরে দূর, আমাদের তো ব্রেক-আপ হয়ে গেছে, রুবাই আর আমার কেউ নয়। ঠিক হ্যায়, পরের প্রেমিককে বলে দিতে হবে প্রথম আলাপেই।
পাশ থেকে কুর্চি একক্ষণ চোখ পিটপিট আমার রকম-সকম ফলো করছিল। আমার পরের মাসতুতো বোন, বছর চারেকের ছোট। এবার ঘুম-জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল - ম্যাট্রিকুলেশান মানে কি ক্লাশ টেন পাশ?
-হ্যাঁ রে – মামুন উত্তর দিল - তোর মায়েরটাও আছে। আরে, বাবার স্কুল পাশের সার্টিফিকেটটাও দেখি তোলা রয়েছে।
দাদুর স্কুল পাশের সার্টিফিকেট? আমাদের ভাতঘুম ছুটে গেল। কুর্চি তড়াক করে উঠে বসল।
-কোথায় পেলে এসব মামুন?
-মাঝের ঘরে আয়, দেখে যা।
-কিন্তু, এসব দিয়ে হবে কী?
ভুরু নাচিয়ে মামুন বলল - সকলের পরিচয়পত্র। বড়দি, মানে তোর মা যে এখানেই জন্মেছে – তার প্রমাণ। তোর মা বাঁচল, তুই বাঁচলি, এমনকি তোর হবু ছেলে-পুলেও বাঁচল।
আমরা দুই বোন দুজনে দুজনের দিকে খানিক চেয়ে রইলাম। আমাদের মাসতুতো ভাই-বোনেদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, সব মিলিয়ে জনা দশেক। হবে নাই বা কেন, মায়েরা ছয় বোন, এক ভাই। আড়ালে ভাই-বোনেরা হাসাহাসি করি, ভারতের আদমশুমারিতে এই ব্যানার্জ্জী পরিবারের অবদান কিছু কম নয়।
আজ ভাইফোঁটা। এইদিনটা বরাবরই বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠান হয়। আজও হল। গুণে দেখলাম দাদুকে ফোঁটা দিয়ে মোট বত্রিশটা ফোঁটা। তাও তো দুজন ভাই আসতে পারে নি। কিন্তু আপাতত মামুনরা কী খনি খুঁড়ছে যার থেকে এসব আদ্যিকালের জিনিষপত্তর উদ্ধার হচ্ছে - সেটা জানাটা আগে দরকার। উঁচু মেহগনি কাঠের কাজ করা খাট থেকে লাফ দিয়ে নামলাম। বাপ্রে, আগেকার দিনের লোকেরা কী কসরত করে এই খাটে ওঠা-নামা করত?
।।২।।
মাঝের ঘরকে লোকে কেন মাঝের ঘর বলে তার কোন হদিশ নেই। একটা গোডাউন মতন। দুটো লোহার আলমারি আর গোটা তিনেক লোহার ট্রাঙ্ক থাকে সেখানে। একটা ট্রাঙ্কের বিশাল ডালা খুলে তার ওপর উপুড় হয়ে পড়েছে মামুন আর মামীন।
ট্রাঙ্কের নীচ থেকে একে একে উঠে আসছিল পুরোনো ফটো –– ধুতি আর শার্ট পরা দাদু অফিস যাচ্ছে, তানপুরা হাতে রেডিওতে গান গাইছে দিদা, চুপচুপে তেলা মাথায় মাসিরা বসে, আলবোট (অ্যালবার্ট?) কাটা চুলে মামুন। আর ব্যতিক্রমহীনভাবে জামাকাপড় ছাড়া কালো-কুলো কয়েকটা বাচ্চার চানের ছবি (কেন যে বাপু এরকম ছবি তোলার চল কে জানে, পরে সুযোগ মতো অপদস্থ করবে বলে?)। আমি আর কুর্চি যেন ইতিহাসের একেকটা পাতা উল্টোচ্ছিলাম। হঠাৎ রোল করা কয়েকটা কাগজ বেরোল। আকারে ছোট, তুলোট কাগজের, মোট তিনটে পাতা। পিন বা কিছু দিয়ে আটকানো নেই। তবে সুন্দর করে ফিতে দিয়ে বাঁধা, ফিতের আসল রঙ চেনা যায় না। দেখে তো সার্টিফিকেটের বলে মনে হচ্ছে না, বোধহয় একটা চিঠি। পড়বি তো পড় আমার হাতেই। পাতার একদিক করে নীল কালিতে সুন্দর হাতের লেখায় একখান চিঠিই বটে। সম্বোধনে লেখা – প্রিয়তমেষু “___”। একদম শেষে চিঠির লেখক/ লেখিকারও নাম নেই, তার বদলে লেখা – তোমারই, শুধু তোমারই “___”। অ্যাঁয়? সেকি? প্রেমপত্র? নামধাম নেই যখন, তখন তো গোপন প্রেমপত্র! কার? মা-মাসি-মামুন? কার?
মামীন আর মামুন – দু’জনেই ঝুঁকে পড়ে ঐ সম্বোধনটুকু দেখে ফেলছে। সকলেই অপ্রস্তুত। না জানি অতীতের কোন রহস্যের তারে টান পড়ল। সকলে প্রস্তুত হবার আগেই আমি ধাঁ করে চিঠিটা নিয়ে দৌড় দিলাম। কুর্চিও দৌড়ল আমার সাথে। সোজা ছাদের সিঁড়ির ঘর। এবার পর্দা ফাঁস।
আমার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহে কুর্চি পড়তে শুরু করল গলা কাঁপিয়ে -
“প্রিয়তমেষু ড্যাশ।”
“কেমন আছো? বিরহ বড় দীর্ঘ। তুমি যে আমার হৃদয়ের সিংহাসনে চিরকালের মতো স্থান করে নিয়েছ - সেকথা কি তুমি জানো না? কিন্তু, বেশ কিছুদিন তোমার সাক্ষাৎ পাই নি। তুমি কি আমায় বিস্-বিস্ ...।” - দূর ছাই এটা কী?
কুর্চি কনভেণ্ট পাশ। বাংলাটা এখনো টলোমলো। অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ও জানত মোষ মানে ছেলে গরু। আপাতত এখন আমি ধরিয়ে দিলাম – ওটা বিস্মৃত। মানে ভুলে যাওয়া।
- আচ্ছা। সেটা লিখলেই তো হত।
কুর্চি পড়ে চলল – “তুমি কি আমায় বিস্মৃত হয়েছ? নইলে কোন সংবাদ দাও না কেন? আমার মাথা খাও, সত্য বলো। তোমার কাছে কি আর আমার অনুরাগের কোন মূল্য নেই?”
“গত পরশু তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসছিলাম। একটি রিক্সা এক স্থূলকায়া মহিলাকে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর কিভাবে রিক্সাটি উলটে যায়। ভদ্রমহিলা খুব চীৎকার করছিলেন। সবাই মিলে রিক্সাওয়ালাকে খুব মারল, তার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিল। -”
কুর্চি পড়া থামিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
- এসব কি লিখেছে হাবিজাবি? লাভ-লেটারে আবার রিক্সাওয়ালা, মাথা ফাটা? বোগাস। তুই পড়।
চিঠিটা আমার হাতে আবার চালান করে দিল কুর্চি। তাই তো! আমি রিক্সার অংশটা বাদ দিয়ে আসলটা পড়তে থাকলাম –
“সেই ঘটনার পর অনেকক্ষণ তোমাদের বাড়ির সামনে অপেক্ষায় ছিলাম। যদি একটিবার বারান্দায় আসতে, সাক্ষাৎ হত।”
“কোনপ্রকার সংবাদ না পেয়ে বাধ্য হয়ে অনেক বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও এই চিঠি লিখতে বসেছি। তবে আর বেশীক্ষণ লিখতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া মনে হচ্ছে এই নির্ঝরিণী কলমও –”
কুর্চির চোখ কপালে। - কী? নির্ঝরিণী কলম?
আমি সাবটাইটেল দিলাম – ফাউন্টেন পেন, মানে কালির পেন।
“মনে হচ্ছে এই নির্ঝরিণী কলমও তোমার উপর ক্রুদ্ধ। তাই বোধহয় আমার হাতের অঙ্গুলীগুলি মসীলিপ্ত করছে। -”
কুর্চি আবার হাত তুলল।
আমি আবার সাবটাইটেল দিলাম – মসী মানে কালি। অঙ্গুলীগুলি মসীলিপ্ত করছে মানে পেন লিক করে হাতে কালি লেগে গেছে।
-ওফফ। কী ভাষা! কী এক্সপ্রেশান! চিঠির সাথে বাংলা অনুবাদ চাই তো? আমি তো স্মাইলি আর ইমোজি দিয়েই চালিয়ে দি।
কুর্চির বয়ফ্রেণ্ড তৈলঙ্গ বংশোদ্ভূত। বাংলা জানে না। হিন্দি বলে না, শোনে না। ভরসা বলতে ইংরেজি, আর ঐ স্মাইলি। ঝগড়া করে কী করে কে জানে? ইংরেজিতে? আমি হলে তো পারতাম না বাপু। এই যে রুবাইকে পরশুদিন আমার গালির বাছাই করা কালেকশানটা ঝেড়ে দিলুম, তামিল-কন্নড় হলে কি আর পারতুম? আরে দূর, আবার রুবাই এসে পড়ছে কেন? আমি চিঠিতে মন দিলাম।
“এই চিঠি পাবার পর যথা শীঘ্র সম্ভব উত্তর দিও। তোমার উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলাম। আর যদি তোমার হৃদয়ের কোন কোণে আমার কিছুমাত্র স্থান না থাকে, তবে আমার নিজেকে ধিক্কার। তোমাকেই সঁপেছি যে প্রাণ-মন।”
“ইতি তোমার, শুধু তোমারই ড্যাশ।”
ইসস, কী করুণ নিবেদন! আমরা কিন্তু দুজনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। কুর্চিটা তো পেটে হাত দিয়ে শুয়েই পড়ল মেঝের ওপর। এখন প্রশ্ন হল চিঠিটা কে লিখেছে? এবং কাকে? দিনক্ষণ কিছুটি নেই। নাম তো আগাগোড়াই নেই, শুধু দুটো ড্যাশ।
কুর্চি আরো মারাত্মক প্রশ্নটা করল - আচ্ছা, এই চিঠিটা এখানে এল কী করে?
সত্যি তো! লোহার ট্রাঙ্কের মধ্যে তো বেশ যত্ন সহকারে তুলে রাখা ছিল। এইরকম কানায় কানায় আবেগ ভর্তি প্রেমপত্র এত যত্ন করে সেখানে সুরক্ষিত রইল কী ভাবে?
মানতেই হবে যে, চিঠির ভাষা আর হাতের লেখা দুটোই অসম্ভব রকমের মেয়েলী। একটু ব্যোমকেশীয় বুদ্ধি লাগালাম - লেখার পর এই চিঠিটা নিশ্চয়ই আর আর পোস্ট করা হয় নি। হাতে নাতে ধরা পড়ে দিদার কাছে চিঠি বাজেয়াপ্ত হয়েছে, দিদা দাদুকে দেখাবার জন্য তুলে রেখেছিল। কিন্তু সে কাজ সারা হয়ে গেল তো চিঠি কুচি কুচি হয়ে জঞ্জালের বাক্সে যাবার কথা ছিল, আর পিঠে খুন্তির দুচার ঘা। দিদা ভয়ানক রাগী ছিল। শুনেছি মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে মামুন নাকি দরজার পেছনে কাটাকুটি খেলছিল, ধরা পড়ে সাপাটে চড়। সেই দিদার এহেন মেজাজ বাঁচিয়ে এ প্রেমপত্তরটি এমন যত্ন করে ফিতে দিয়ে বাঁধা হয়ে তোলা রইল কী ম্যাজিকে?
তাছাড়া লাখ টাকার প্রশ্ন, চিঠিটা কার? মায়েদের বা মাসিদের যারই হোক – বাংলায় বেশ দখল ছিল বলতে হবে – অত ভারি ভারি শব্দ যখন। আমার মা আর কুর্চির মা দুজনেই সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। তাহলে কি…?
- ডিসগাস্টিং। এই বয়েসে এসে বাবা-মার লাভ-লেটার পড়তে হবে – যা তা পুরো।
কুর্চি দেখছি ব্যাপারটা পুরো ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে চলে গেছে।
- অন্য কারোরও হতে পারে। চল দেখি গিয়ে কে কোথায় আছে।
চিঠিখানা হাতে নিয়ে সরজমিনে তদন্তে বেরোলাম – যাকে বলে সত্যানুসন্ধান।
।।৩।।
মাঝের ঘরে দেখলুম মামুন-মামীন এখনো খনি উদ্ধার করে চলছে। আর দাদুর ঘরে মাছের বাজার বসেছে যেন। ছয় বোনেরা একজোট হয়েছে, কিছু একটা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তেজিত গলার ছেঁড়া ছেঁড়া কথা কানে এল – কাঞ্চনার শাশুড়িটা কী বদমাইস, ছোটবউও কম কিছু নয়, তিনটে বিয়ে করেও শান্তি নেই, ইত্যাদি, প্রভৃতি।
এরা কারা? কে তিনবার বিয়ে করল রে বাবা? কিছুই তো জানি না? কুর্চি আমার গা টিপে কানে কানে বলল, সিরিয়ালের গল্প চলছে রে দি। কাঞ্চনার সংসার। রোজ সন্ধে সাড়ে সাতটা। মা দেখে, আমি জানি। হেব্বি পপুলার।
ভাগ্যিস আমি অফিসের কাজ সেরে সাড়ে আটটায় বাড়ি ফিরি।
লাল রঙের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে সকলে, মধ্যমণি হয়ে আদ্যিকালের ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে রয়েছে দাদু। দাদুর বয়স নব্বই পেরিয়েছে। মাথার চুল সাদা, দীর্ঘ শরীর বয়সের ভারে নুয়েছে। আজকাল সব কিছু ঠিকঠাক মনেও থাকে না। বয়সটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে গত দেড় বছরে – দিদার মৃত্যুর পর। কিন্তু আজ সবাইকে একসাথে কাছে পাবার খুশিটা চোখে-মুখে দিব্যি চকচক করছে।
- দ্যাখো তো? এই চিঠিটা কার লেখা? মাঝের ঘরের ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়েছে।
আমি সকলকে থামিয়ে ভালো মানুষের মতো মুখ করে বললাম। তারপর বুদ্ধি করে চিঠির মাঝের পাতাটা এগিয়ে দিলাম – যেখানে শুধু রিক্সাওয়ালার কথাটা আছে।
প্রথমে আমার মা – সবচেয়ে বড়। লেখাটা পড়ে একগাল হেসে বলল, আমার লেখা তো এটা। কবেকার রে? তারিখ নেই?
কই দেখি? – কাগজ চলে গেল মেজর কাছে। বড়দি, তুই ভুলে গেছিস। এটা তো আমার লেখা। হাতের লেখাটা মিলিয়ে দেখ। আগে আমি এইরকম করেই তো ইকার লিখতুম।
এবার সেজ, তারপর রাঙ্গা, তারপর ন, তারপর ছোট। চিঠির পাতা হাত ঘুরতে লাগল। সকলের মুখে নিজের নিজের অতীতকে খুঁজে পাওয়ার ঘোর। সকলেই নিজের লেখা বলে দাবি করছে দেখছি। আমি জানি আমার মা আর মাসি – সকলের হাতের লেখা একই ছাঁদের – গোল্লা-গোল্লা, সুঁড় লাগানো। সকলেই যখন নিজেকে এ চিঠির লেখিকা বলে ঘোষণা করল, তখন আমি মিসাইলটা ছুঁড়লাম – সাঁআআ – দুম্।
- চিঠিটার তারিখ নেই, শুরু আর শেষের অংশটা পড়ছি এবার, ভালো করে শোন।
আমি পড়তে থাকলাম, সবটা, মায় ড্যাশ সমেত। এবারে রঙ বদলাচ্ছে সকলের মুখের। সামনে আবার তাদের বাবা বসে আছে বলে কথা। বাবা, অর্থাৎ দাদুর কিন্তু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি জমা হচ্ছে। “তোমারই, শুধু তোমারই ড্যাশ” বলে চিঠি শেষ হল যখন, চারদিকে নিজ্ঝুম নিস্তব্ধতা।
আধ মিনিট চুপচাপ থাকার পর প্রথম মুখ খুলল সেজ মাসি - না না, আমি লিখি নি ওটা। আমার হতেই পারে না।
আমারও নয় – এবার ন-মাসি। আমি তো সবসময় কালো কালিতে লিখতাম। এটা তো নীল কালি।
তারপর বাকিরা – মেজ, ছোট, রাঙ্গা – সকলেই জোরের সঙ্গে জানাল এ প্রেমপত্র তাদের কিছুতেই নয়। হতেই পারে না। কী করে হয়? তারা তো অমন চিঠি সাতজন্মে কোনদিন কাউকে লেখেই নি, এমনকী কোন চিঠিই কাউকে কোনদিন লেখে নি। সবশেষে আমার ভালোমানুষ মা আমতা আমতা করে বলল – আমারও নয় বলেই মনে হচ্ছে।
-নয় মানে? আমি চেপে ধরলুম – তুমি ভালো বাংলা লিখতে যে? আমি তোমার লেখা কবিতাও পড়েছি। তাছাড়া কারোর না কারোর তো হবেই।
এবার তুমুল সোরগোল উঠে গেল। আমি আর কুর্চি বিশাল শত্রুপক্ষের আক্রমণে পেছু হটতে হটতে প্রায় ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে এসেছি, দাদু হঠাৎ শ্বেত পতাকা দেখিয়ে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে দিল।
-আমি লিখেছিলুম ঐ চিঠিটা। তোদের মাকে।
-মাকে? মানে দিদাকে? এক বাড়িতে থেকে চিঠি? যাঃ দাদু ঢপ দিও না।
-সত্যি রে চুয়া। তোর দিদা তখন দিল্লিতে। তার বাপের বাড়িতে। আমি সকলকে নিয়ে কলকাতায়। তোর সেজমাসির তখন পক্স হয়েছে। তখনই লিখেছিলাম।
-যাঃ, পক্সের কথার কোন উল্লেখ নেই তো।
-আহা, তোদের দিদা তখন আমার ওপর ভয়ানক রেগে ছিল যে। অনেকদিন খোঁজ খবর নেওয়া হয় নি তো। আর তখন তো খোঁজ নেওয়া সহজও ছিল না। কই দেখি, চিঠিটা একবার আমায় দে তো।
আমি হতভম্বের মতো চিঠিটা এগিয়ে দিলাম।
মাসিরাও চুপ। এরকম সমাধান কেউই আশা করে নি। তাদের সকলের মুখেই দোলাচল স্পষ্ট। দুর ছাই, এমন একটা সরস প্রেমপত্রের এই পরিণতি?
আমি জোর দিয়ে বললাম – কিন্তু দাদু –
-ব্যাস, চুপ। বাবা বলছে যে বাবার চিঠি, তাতেও হচ্ছে না? যা এখান থেকে। আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দে দেখি।
মার ধমক খেয়ে আমি রেগেমেগে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সক্কলে নিজেকে লুকনোর চেষ্টা করছে। হিপোক্র্যাট। আমার মেজাজ খারাপ দেখে কুর্চিও কেটে পড়ল।
খানিক বাদে ছোটমাসি আমার পাশে এসে দাঁড়াল। খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল –আরে, ওটা বাবার লেখা নয় রে। হাতের লেখাটা মোটেই বাবার নয়। ভাষাটাও দেখ। নিশ্চিত কোন মেয়ের লেখা। তাছাড়া ঐ প্রথমে প্রিয়তমেষু -
-তাই না? বলো? আমিও তো তাই বলছি। দিদাকে চিঠি লিখতে গিয়ে দাদু নিজের নামের জায়গায় কখনো ড্যাশ বসায়? তাছাড়া ঐ রিক্সাওয়ালা? বারান্দা? এসব?
-আসলে বাবার আর আজকাল কিছু মনে থাকে না। বৌদি বলছিল প্রায়ই ওষুধ খেতে ভুলে যায়।
-কিন্তু তাহলে প্রেমপত্রটা কার?
-সে বাপু আমি জানি না। তোরা আবার খোঁজ। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।
চোখ টিপে ছোটমাসি অদৃশ্য হল। আমি নতুন উৎসাহে দাদুর ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিশাল ঘরের মাঝখানে সেই একই জায়গায় ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দাদু বসে আছে। একা। চোখ দুটো বোজা। বুকের ওপর চিঠিটা পরম যত্নে ধরা। মুখে আবছা একটা হাসি লেগে। একটু দূরে টেবিলের ওপর দিদার ছবি। দিদা খুব সুন্দরী ছিল। আজ সকালে ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে ফটোতে মালা দেওয়া হয়েছে। ধূপের ছাইগুলো এখনো সেইভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। ঘরের ডানদিক বরাবর বিশাল কাজ করা খাট। দিদা-দাদুর বিয়ের খাট। ষাট বছরেরও বেশি বিবাহিত জীবন। আমরা ঘটা করে বিবাহবার্ষিকী করেছিলাম – পঞ্চাশের, ষাটেরও। দিদার জীবনের শেষের কটা বছর এই ঘরটা প্রায় হাসপাতালের চেহারা নিয়েছিল। পারকিন্সন ছিল দিদার। প্রথমে হাত-পা অসাড় হল। তারপর শয্যাশায়ী। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই মানুষটা ধীরে ধীরে একটা অসহায় শিশুর মতো হয়ে গেল। কাউকে চিনতে পারতো না। শুধু দাদুকে চিনত। ছেলে মেয়েরা দাদুকে বাবা বলত বলে, দিদাও শুনে শুনে নিজের স্বামীকে ‘বাবা’ বলত – এক অপার নির্ভরতা। একদম শেষের দিকে দিদা আর কোন সাড়াই দিত না। তার মধ্যেও আমি দেখেছি দাদু দিদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, দিদার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
শরৎ বিদায় নিয়েছে। এবার শীত আসার পালা। পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল। কীই বা এসে গেল ও চিঠি কে কাকে লিখেছে। কেউ যখন সাহস করে নিজের গোপন প্রেমকাহিনী প্রকাশ করতে পারল না, তখন ঐ চিঠি দাদুরই থাক। নাই বা মিলল সব প্রশ্নের উত্তর, নাই বা হল সত্যান্বেষণ। হয়ত কোনসময় দাদু এমন একটা চিঠি দিদাকে লিখেছিল – সেটা হারিয়ে গেছে। কিংবা হয়ত কোনদিন কোন চিঠি লেখাই হয় নি। মনের মধ্যে তবু রয়ে গেছে। আমি ধীরে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
বারান্দায় এসে মোবাইলটা বার করলাম। একটা রিং হতেই ওপাশ থেকে রুবাই চেঁচিয়ে উঠল – কি রে? দুদিন ফোন করিস নি কেন? গাধা কোথাকার। আমি চোখ মুছে চেঁচালাম – তুইও তো করতে পারতিস? বেবুন কোথাকার।
[সমাপ্ত]
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
ম্যাম,,,, প্রণাম নেবেন ।। পড়ে এক অন্য রকম অনুভব হচ্ছে....
লেখাটি এবং লিখনশৈলী-- এককথায় অনবদ্য।
দুর্দান্ত হয়েছে।
অসাধারণ লাগলো,দিদি।
লেখার কি অসাধারন গতি। মন ভরে গেল।
কি প্রেমময় পত্র! সত্যানুসন্ধান হলো?
তারপর?
তার আর পর নেই। যা হলো তাই যে বড় সত্য।