পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
দুষ্টু সরস্বতী গেলেন কোথায়? স্কুল বছর ভর বন্ধ থাকার পরে সবে খুলছে। কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয় এখনই খুলছে না। মাধ্যমিক - উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পেছলো সেই জুন মাস পর্যন্ত। গৃহ শিক্ষকদের পৌষ মাস দীর্ঘায়িত হয়েছে। ছাত্রদের সরস্বতী পুজো নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো চিন্তা নেই। বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল যেতে হচ্ছে না। বাড়ির পুজো অধিকাংশ বাড়িতে নিউ নর্মাল কারনে উঠে যেতে বসেছে। লেখাপড়ার দেবী কৈলাস ছেড়ে এই হাড় কাঁপানো শীতে পুজো মন্ডপে আসবেন কিনা, এখনও কনফার্ম নয়।
যদিও কুমোরটুলি এই মুহূর্তে খুবই ব্যস্ত। পুজো এখন বাণিজ্য। পড়ুয়ারা রণে ভঙ্গ দিলেও, লেখাপড়ার সঙ্গে যাদের দীর্ঘদিনের আড়ি হয়ে গেছে, সেইসব নব -কার্তিকরা হঠাৎ সরস্বতীর আরাধনায় মেতে উঠেছে। এখন আর বিলবই ছাপানোর দরকার পড়েনা। বড় রাস্তায় শুধু একটা ব্যানার-ফেস্টুন। তাতে বড় বড় হরফে লেখা "শুল্কা বরণে - আমরা সবাই"। ওরা নিজেদের খুব বড় ভাবে। কি লিখতে কি লিখেছে সেটা বোঝারও প্রয়োজন নেই। পণ্য বাহী গাড়ী দেখলেই একদল উঠতি বয়সের ছেলে হাত দেখিয়ে সেই গাড়ী আটকাচ্ছে। মিনিমাম পঞ্চাশ ছাড়ো । দশ দিন মাত্র বাকি। বাইশ হাত কালীর মতো বাইশ হাত সরস্বতী। যত বেশি হাইট ,তত বেশি চাঁদা। থুড়ি, শুল্ক। পুরোহিতের হাতে পাঁচ শো টাকা দিতে উদ্দ্যোক্তাদের হাত কাঁপতে থাকে। অথচ প্রতিমা ভাসানে ডি- জে খরচ পাঁচ হাজারেরও বেশী। পিছনে দাদা। সামনে দাদা। থানা পুলিশ দেখিয়ে লাভ নেই। পাবলিকের এসব একরকম গা-সহা হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করতে যাওয়া মূর্খামি ছাড়া আর কি? চাঁদার জুলুমে দশ টাকার ফুল কপি কুড়ি টাকা। চল্লিশ টাকা কিলোর পেঁয়াজ পঞ্চাশ। তবু সরস্বতী পুজো তো ফেলে দেওয়া যায় না! মা সরস্বতী শুধু পড়াশোনার নয়, গান বাজনারও অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বাগদেবী হিসেবে জগৎ জোড়া তাঁর নাম ডাক। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তার বন্দনা, অঞ্জলি।
সরস্বতী পুজো হঠাৎ -পুজোর তালিকায় নাম লিখিয়েছে ইদানীং। যেমন কার্তিক পুজো। পথে ঘাটে অজস্র সরস্বতী। দুষ্টু ছেলেরা হাত খরচ তুলতে লোকের কাছে পুজোর নামে চাঁদা তোলে। একে তোলা বাজি বলা যাবেনা ভুলেও। বয়েস যাই হোক, শিক্ষার কি আর শেষ আছে? যত দিন বাঁচি, তত দিন শিখি! কে না জানে।
তবে সরস্বতী পুজো করতে পুরোহিত লাগে। এতো পুরোহিত আসবে কোথা থেকে? অগত্যা যাকে তাকে ধরে পুজোর আসনে বসিয়ে দাও। গলায় সারা বছর পৈতে না থাকলেও এই দিনটি পুরোহিতের গলায় পৈতে থাকা চাই ।যদিও চেনা বামুনের পৈতে লাগেনা। মুখার্জীদা, ব্যানার্জিদাদের সরস্বতী পুজোর দিন খুবই কদর। রেট হাই। কলেজ স্ট্রীট থেকে পুঁথি -পত্তর কিনে এনে নামাবলী গায়ে জড়িয়ে একবার পথে নামলে, আর পায় কে? টানাটানি পড়ে যাবে। শ্রী পঞ্চমী তিথিতে পুরোহিত পাওয়া সত্যিই ভাগের ব্যাপার । তবে অপেশাদার পূজারীদের কাছে মন্ত্র উচ্চারণ নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। সঠিকভাবে উচ্চারণ আশা করাটা একটু বেশি রকমের প্রত্যাশা। বেশিরভাগই না বুঝে মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকেন। যেমন, মন্ত্র হলো –“বিদ্যা স্থানেভ্য এব চ”। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সময় পূজারীদের অধিকাংশই বলে থাকেন – “বিদা স্থানে ভয়া বচ”। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় পুষ্পাঞ্জলি কালে। ফেল করা ছাত্র ছাত্রীদের এমনিতেই স্কুল কলেজের প্রতি এক ধরণের অনীহা। অধিকাংশই স্কুল- কলেজের দরজা না মাড়াতে হলেই বেঁচে যায়। যে -কোনো অজুহাত পেলেই হলো। আন্দোলন , ধর্না আরও কত কি ! গেল বছর তো লক ডাউন হেতু স্কুল- কলেজের গেটে আগাছা জন্মাতে দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করে লেখা হলো - "এখানে একদা পঠন পাঠন হতো ।এখন এটি একটি পোড়ো -বাড়ি।"
এখন সরস্বতী বন্দনা হয় নানা নামে। কেউ লেখে মহাশ্বেতা আরাধনায়, আবার কেউ শুক্লা বরণে। ভুল বানানে ভারতির আরতীতে অথবা বাগদেবির বন্দনাও নজর এড়ায় না। সর্বত্র ভুল থেকেই যায়। শুধরে দেওয়ার কেউ নেই। অভিভাবক বা শিক্ষক সম্প্রদায় সাহস দেখাতে রাজি নন। কেননা, বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ আজো কানে বাজে - "মাষ্টার মশাই আপনি কিন্ত কিছুই দেখেন নি।"
বাঙালির কাছে সরস্বতী পুজোর অন্য একটি মাহাত্ম্য আছে। এদিন প্রেম দিবস। যা কিনা "ভালেনটাইন ডে "। সরস্বতী পুজোর দিন মেয়েরা হলুদ রঙের শাড়ি পরে। স্কুল- কলেজের ঠাকুরের কাছে অঞ্জলি দেয় ।সারাদিন জমিয়ে আডডা চলে। ফেসবুকের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। ছেলেরা হঠাৎ বেশি মাত্রায় উদার হয়ে যায়। পয়সার মায়া কাটিয়ে হাত খুলে খরচ করে গার্লফ্রেন্ডকে নিজের স্ট্যাটাস বা পজিশন দেখাতে। এখন আর কেউ হলে বসে মুভি দেখে সময় নষ্ট করে না। সেরকম মুভিই বা কোথায়? নিউ নর্মাল কাটিয়ে প্রেক্ষাগৃহ গুলো খুললেও দর্শক সেভাবে সাড়া দেয় নি। সিটি সেন্টারের হলগুলোতেও দর্শক নেই। যেটুকু ভিড়, তা প্রায় সবই রেস্তোরাঁ ঘিরে। পয়সার চিন্তা করলে ওসব জায়গায় পা রাখাই উচিত নয়। এসব জায়গায় পয়সা যেন খোলামকুচি। কলকাতায় এই মুহূর্তে প্রেম করার জায়গা নেই। দীঘা, মন্দারমণি বহু বার ঘোরা হয়ে গিয়েছে ।মুকুটমনিপুরও একঘেয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাছে- পিঠে জোকা ,নলবনে তাই পা রাখাই দায়! গার্লফ্রেন্ড রাজী থাকলে কোথায় না যাওয়া যায়! পৃথিবী তখন পদ তলে। তালি মারো আর ডানা মেলে ইচ্ছে খুশি উড়ে যাও। কুছ পরোয়া নেহি।
সরস্বতী পুজোর সঙ্গে কুলের কী সম্পর্ক, কে জানে! পড়ুয়ারা পুজোর আগে কুল খেলে লেখাপড়া নাকি সব ভুলে যায়। তাই পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ চেয়ে খায় ।যেন দুএকটুকরো কুল ভাগে পড়ে। দুপুরে খিচুড়ি ভোগ, সঙ্গে ভাজা ভুজি অবশ্যই কুলের টক। প্রসাদে নারকেল- কুল। চাটনী তে টোপা -কুল। খিচুড়ি গরমাগরম সঙ্গে কুলের টক। খেলে মুখ ছাড়ে, ক্ষিদে বাড়ে। সত্যিই সেসব এক দিন গিয়েছে!
কয়েক দশক আগে, বেশ মনে পড়ে, শহরে বা শহরতলীর আশপাশে পাড়ায় -পাড়ায় সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যায় বিচিত্রানুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। রিয়েলিটি শো- এর ছেলে- মেয়েরা সবাইকে চমকে দিয়ে হাত তালি কুড়তো রাত -জাগা দর্শকদের। কৌতুক শিল্পীরাও চান্স পেতেন দুজন সঙ্গীত শিল্পীর মাঝখানে। এখন ওই সব শিল্পীরা প্রায়- নিরুদ্দেশ। শূন্য আসনে এসেছেন বাচিক শিল্পীরা। আবৃত্তি এখন পাবলিক দারুন খাচ্ছে। একেকজনের রেট সঙ্গীত শিল্পীর চেয়ে ঢের বেশি। ডেট পাওয়া গেলে হয়! দেমাকও বেশি। সহজে অটোগ্রাফ দিতে চান না। সেলফি তোলা তো দূর অস্ত! শোনা যায়, আমাদের বাগদেবী, মা সরস্বতী বর দিয়েছিলেন বোকা - কালিদাসকে। যে- ডালে বসে আছেন,সেই ডাল ভুলেও কাটবেন না। একালের অতি-চালাক দাদারা সম্ভবত বোকা-কালিদাসের সহজ পাঠ ভুলে মেরে দিয়েছেন। দলে থেকে দলের সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বীনা থামিয়ে বাগদেবীও বোধ হয় হাসছেন। হার মানছেন সন্তানদের রকমসকম দেখে। নতুন করে চেতনা জাগ্রত করার আগ্রহ তাঁর নেই। দুষ্টু সন্তানের দায় নিতে বীনাপানী মাতা রাজী নন। পুজো মন্ডপে কোনো রকমে পঞ্চমীর রাতটা কাটিয়ে, সাত সকালে দধিকর্মার পাট চুকিয়ে পবন হংসে ফুরুৎ। সোজা কৈলাসে, মায়ের কাছে!
মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর শিশুদের হাতে-খড়ি অনুষ্ঠান। নতুন স্লেটে খড়ি পেন্সিল ঠেকিয়ে - অ আ ই ঈ উ ঊ এ ঐ ও ঔ লেখা। স্রেফ অক্ষর চেনানো। পুরোহিত মশাই এ জন্য বাড়তি পারিশ্রমিক পান। আজকাল অবশ্য পাঁচ বছর পর্যন্ত কেউই শিশু দের অশিক্ষিত করে বাড়িতে বসিয়ে রাখেন না। তিনবছর হলেই স্কুলে ভর্তি ।মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন। বাচ্চা জমা থাকে স্কুলের দায়িত্বে। তাই পাঁচ বছরে মা সরস্বতীর সামনে শিশুর হাতে -খড়ি অনুষ্ঠান নেহাৎই বাতিল। আধুনিক বাবা মায়ের কাছে পুষ্পাঞ্জলিও গেঁয়ো ব্যাপার ছাড়া আর কি? বাড়িতে ঠাকুর এনে পুজো? এখন কষ্ট- কল্পনা!
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও যথারীতি সরস্বতী পুজোর আয়োজন হয়। পুরোহিতের উপস্থিতিতে পুজো -পাঠ ও হয়। ছাত্র ছাত্রীদের পুষ্পাঞ্জলি শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। গান-বাজনার আসরও বসে। তফাৎ বা পার্থক্য একটাই-ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অবাঙালির সংখা বেশি বলে সাধারণ কথা বার্তা হয় ইংরেজিতে। বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে।
এই মুহূর্তে কুমোরটুলি বা আশপাশের পটুয়া পাড়ায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মী সংখা অনেক কম। লক ডাউন পরবর্তী পরিস্থিতি শিল্পে মন্দা ডেকে নিয়ে এসেছে। অনেক মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মী দেশের বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। নিজের জমিতে চাষবাস শুরু করেছেন। সরস্বতী পুজোর জন্য আর শহরমুখো হন নি। ফলে, মৃৎশিল্পের বাজারে কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক হাজার বা বারোশো টাকা রোজ। দশ ঘন্টার কাজ। বাঁশ, কাঠ, দড়ি, পেরেকের দাম বেড়েছে। গঙ্গা মাটিতে টান পড়েছে বেশ কিছু দিন ধরে। লুকিয়ে চুরিয়ে মাটি কেটে লরি বোঝাই করার কর্মী পাওয়া যাচ্ছেনা লক ডাউনের পর থেকে। ফলে, মাটি এখন সোনার মতোই দামী। যেমন তেমন একটা মূর্তি তৈরি করতে গেলে অন্তত আট থেকে দশ হাজার টাকা খরচ। খরচখরচা বাদ দিলে টোয়েন্টি পার্সেন্ট লাভ থাকে। হাঙ্গামা সামলে সব সময় লাভের কড়ি ঘরে ওঠেনা । অর্ডার দেওয়ার পর, ডেলিভারি নেওয়ার সময় উদ্দ্যোক্তা গর -হাজির। বাজার একেবারে খারাপ। চাঁদা ওঠেনি । অগত্যা পুজো ক্যান্সেল। এদিকে প্রতিমা সাজানোর পর ডেলিভারির জন্য রেডি। টোটাল ইনভেস্টমেন্ট জলে। মৃৎ শিল্পীরা এই ভাবেই পথে বসেন। বরানগর টবিন রোড এলাকায় মৃৎশিল্পের কাজ হয় একাধিক জায়গায়। টবিন রোড মোড় থেকে রিক্সায় উঠে আপনি যদি বলেন,- "গণেশ পাল মোড়ে যাবো", রিক্সায় এসে আপনি নামবেন বিখ্যাত মৃৎশিল্পের কান্ডারী প্রয়াত গণেশ পালের বাড়ি সংলগ্ন তেমাথার মোড়ে। গণেশ পালের নাম ডাক এলাকা জুড়ে। তিনি নেই। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কাজল পাল বাবার মৃৎ শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছেন সংগ্রাম করে।মৃৎ শিল্প জগতে কাজল বাবু নান্টু পাল নামেই পরিচিত। এই মুহূর্তে নান্টু বাবু সরস্বতী মুর্তি গড়তে রাত দিন এক করে খেটে চলেছেন। নান্টু বাবুকে সাহায্য করছেন তাঁর ভাইপো প্রসাদ পাল। পোশাকী নাম রবিন পাল। বয়েস ষাট পেরিয়েছে। বেশ তরতাজা যুবা পুরুষ। মৃৎশিল্প প্রসাদের নেশা এবং পেশা দুইই। মুর্তি প্রসাদের হাতে যেন প্রাণ পায়। এই শহরে কাজ না থাকলে প্রসাদ চলে যান হায়দ্রাবাদ কিংবা ছত্তিশগড়। মৃৎ শিল্পে প্রসাদ, দাদু প্রয়াত মৃৎশিল্পী গণেশ পালের সবটুকু আর্শীবাদ পেয়েছেন। মুর্তি গড়ে তিনি নীচে নাম দেননা। ওর ধারনা, লোকের নজর টানলেই নাম ছড়িয়ে পড়বে। কাজটা যেন ঠিক ঠাক হয়। প্রসাদ নিজে লেখা পড়া যতদূর সম্ভব করেছেন। ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়ে কলেজে পড়ে নিজের চেষ্টায়। বাবার মৃৎ শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে দাদু গণেশ পালের অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। পরিবারের শুভেচ্ছা সঙ্গে আছে বলেই প্রসাদ মৃৎশিল্পের বাইরে অন্য কাজ খুঁজতে যান না। শুধু আফসোস একটাই - মনের মাধুরী মিশিয়ে এত দিনের পরিশ্রমে যে সুষমা মন্ডিত মূর্তি গড়া হলো, রাত পোহালেই জলে!
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |