এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • পেন্সিলে লেখা জীবন (১২)

    অমর মিত্র
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ৩৪০০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মাল্যবান, জলপাইহাটি, বাসমতীর উপাখ্যান লেখা হয়েছিল পেনসিলে। গোপনে লিখতেন কবি, আর ভাই অশোকানন্দ দাশের বাড়ি গিয়ে ট্রাঙ্কে জমা করে ফিরে আসতেন। , ১৭২/৩ রাসবিহারী এভিনিউয়ের সেই বাড়ি অতি সম্প্রতি ভাঙা শুরু হয়েছে। সেখানেই ছিল সন্দেশ পত্রিকার অফিস। বাড়িটি পেনসিলে আঁকা বাড়ির মতো ধূসর হতে হতে মুছে গেল। ট্রাঙ্কগুলি অনেকদিন আগেই জাতীয় গ্রন্থাগারে জমা পড়েছিল। অনুজ প্রতিম লেখক আফসার আমেদ তা কপি করে আনত ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে। ভাইরাস আক্রান্ত এই অন্তরীন কালে আমি আমার জীবনের কথা বলব ভাবছি। জীবনানন্দ মুছে যাননি, আমার লেখা অস্পষ্ট হতে হতে হারিয়ে যাবে জানি। আমি সামান্য মানুষ, জীবনভর কলমে লিখেছি, তার উপরে জল পড়ে লেখা ধুয়ে গেছে কতবার। আমি আমার কথা পেনসিলে লিখতে শুরু করলাম। এই ভাইরাস আক্রান্ত কালে মানুষের কথা মানুষ লিখে যাচ্ছেন পেনসিলেই। কোনটি থাকবে, কোনটি আবার ভেসে উঠে আমার কাছে চলে আসবে দু’বছর বাদে, আমি জানি না। তবু লেখা। কারণ জীবনে এক জাদু আছে, জীবনের জাদুতে কতবার মুগ্ধ হয়েছি, কতবার অশ্রুপাত করেছি, সেই কথাই তো লিখব, লিখতে বসেছি। অতি প্রত্যুষে এই পেনসিলিয়া খবরিয়ার নিদ্রা ভাঙে। তখন বাইরে অন্ধকার। কাকও ডাকে না। কী করবে সে? এ নভমণ্ডল তখন হিম নীলাভ, চারদিকে অসীম স্তব্ধতা, সেই নীরবতার ভিতরেই জীবনের আরম্ভে পৌঁছে যেতে চায় সে, মাতৃগর্ভে স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায়। সেই স্মৃতিলেখ এই বিবরণ।
    বারো

    ১৯৭৭ সাল আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। বংশীধরপুর থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে বদলি হয়ে আসি ঝাড়গ্রাম মহকুমার সাঁকরাইল থানার কুলটিকরিতে। গঞ্জ কুলটিকরি। এই প্রথম আমি একটি জায়গায় এলাম চাকরি করতে যেখান পৌঁছতে হাঁটতে হত না। এইটি যেন প্রাইজ পোস্টিং। আসলে কেউ বহুদূরে, দুর্গম জায়গায় থাকলে, পরের বছর তাকে একটু সুবিধাজনক জায়গায় দেওয়া হত। ডিসেম্বর মাস ছিল স্থানান্তরের মাস। বদলির মাস। ৭৫-এর ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম বংশীধরপুর, ৭৬-এর ডিসেম্বরে এলাম কুলটিকরি। কুলটিকরি দিয়ে বাস যেত। খড়্গপুর থেকে রোহিণী গ্রাম অবধি যে বাসের রুট ছিল তার পথ কুলটিকরি ছুঁয়েই। আর-একটা বাস যেত দিঘা ঝাড়গ্রাম ভায়া কুলটিকরি। সেই বাসে আমি ঝাড়গ্রাম যেতাম। ওইসব জায়গা কত সুন্দর। দেশ, মানুষ, এই পৃথিবীর প্রেমে পড়তে কুলটিকরি, রোহিণী, ডুলং নদী, সুবর্ণরেখা নদীই যথেষ্ট। কুলটিকরি থেকে বোম্বে রোড (জাতীয় মহাসড়ক নং -৬, তখন মুম্বই হয়নি বোম্বাই) রাস্তাটি ছিল লালমাটির। মহাসড়কের ধারে গুপ্তমণি থেকে কুলটিকরি যাওয়ার রাস্তা ঘুরেছে। আবার কুলটিকরি থেকে পুবে পিচ রাস্তা খড়গপুর কেশিয়াড়ির রাস্তায় মিলেছে হাতিগেড়্যাতে। কিছুই ভুলিনি, সব মনে আছে। এবার বলি, গ্রামগুলির কথা। একটি গ্রামের নাম রোহিণী।

    রোহিণী এক নক্ষত্রের নাম। রোহিণী হাইস্কুলেই আমার সহযাত্রী বন্ধু লেখক নলিনী বেরা পড়তেন। নলিনী রোহিণী ছাড়িয়ে সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে নয়াগ্রামের মানুষ। খুব দুর্গম, জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ওইসব। তখন নলিনীর নাম আমি শুনেছি মাত্র, কুলটিকরি হাই ইস্কুলের শিক্ষক সুকুমার ঘোষ বলেছিলেন। সাঁকরাইল থানার একটি গ্রামের নাম ছিল সিঁদুরগৌরা। দুর্গাহুড়ি ছিল এক জঙ্গল এবং টিলা। দুর্গাহুড়ি কিংবা কেশিয়াপাদা থেকে বাস ঘুরত বাম দিকে। যাবে রণজিতপুর হয়ে রোহিণী। কুলটিকরি আমাকে সাধু সঙ্গ দিয়েছিল। যেমন সুকুমার ঘোষ। কবি। ওঁর কবিতা কবিপত্র ছেপেছিল। সবচেয়ে বড়ো লাভ ছিল কবি অমর ষড়ঙ্গী মহাশয়ের সঙ্গ পাওয়া। তাঁর রণজিতপুরের বাড়িতে ছিল আমার নিয়মিত যাতায়াত। রণজিতপুর গ্রান্থাগার থেকে বইও নিয়ে এসেছি। পিতৃপ্রতিম অমরবাবুর বাড়িতে তরুণ অমর রাত্রিবাস করেছে। আলাপ করেছে তাঁর দাদা অধ্যাপক সৌরীন ষড়ঙ্গীর সঙ্গে, মনে পড়লে বিধুরতা আসে মনে। অমরবাবু এবং সত্যেনবাবুর কাছে ওই অঞ্চলের ইতিহাস জেনেছে সেই তরুণ। সব মনে পড়ে। কুলটিকরিতে থাকাকালীন আমি পশ্চিম সীমান্ত বাংলা চিনতে শুরু করি। সুকুমারবাবু আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন সুধীর করণ লিখিত ‘সীমান্ত বাংলার লোকযান’ বইটি। কুলটিকরিতে আমি কয়েকটি গল্প লিখেছিলাম, ‘গাঁওবুড়ো’ গল্পটি লিখে সুকুমারবাবুকে শুনিয়েছিলাম। অমর ষড়ঙ্গী মহাশয়কেও। অমর ষড়ঙ্গী খুব ভালো কবি ছিলেন। তাঁর কবিতা ছিল স্নিগ্ধতায় আকীর্ণ। যৌবনে কৃত্তিবাস পত্রিকায় লিখতেন। সৌম্যদর্শন মানুষ। স্নেহশীল ছিলেন। আর-একটি গল্প লিখেছিলাম, কিয়ারচাঁদের পাথরস্তম্ভ নিয়ে ভারতবর্ষ। দুটি গল্পই অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ও হিন্দিতে। অমর ষড়ঙ্গীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৭-এর জানুয়ারিতে। ২০০৬ ডিসেম্বরে ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের জন্য আমি অকাদেমি পাই। ২০০৭-এর জানুয়ারিতে মেদিনীপুর জেলা বইমেলা উদ্বোধন করতে যাই। আমার সঙ্গে দেখা করতে অমরবাবু এসেছিলেন। মেদিনীপুর শহরে তাঁর একটি বাড়ি আছে। তখন শহরেই থাকেন। বয়স বাড়ছে। আমি তাঁকে প্রণাম করেছিলাম। বলেছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া, কুলটিকরি যাওয়া আমার জীবনের বড়ো একটি বাঁক। আমার লেখালেখির ধাত্রী মা ওই এলাকার লালমাটি আর মানুষজন।

    কুলটিকরির অনেক মানুষের কথা মনে আছে। শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ জানার বাড়িতে মেস করে থাকতাম। তার আগে একটি বাড়ির ছাদের ঘরে একা থাকতাম। সে এক জীবন গেছে। অপূর্ব জীবন। পূর্ণিমা রাতে ছাদে ঘুরে বেড়াতাম একা একা। একা থাকার এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। গ্রীষ্মের রাতে তারাভরা আকাশের নীচে মাদুরে শুয়ে আছি। কত গ্রহতারা, আকাশগঙ্গা দেখে মনে হত আমি কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। ধূলিকণার মতো পড়ে আছে এই মহাব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে। লিখব? লেখা কি হবে আমার? জানি না। কত দূর মফস্‌সলে পড়ে আছি। বন্ধুরা কলকাতায়। জীবন আমাকে কোন্‌ দিকে নিয়ে যাবে? কিন্তু একটা ধারণা আমার ভিতরে প্রবেশ করেছিল, এত রকম মানুষ, আলোর বিচ্ছুরণের মতো এত রঙের মানুষ, এই দেখার একটি এমন দিক আছে, যা আমি কল্পনা করতে পারছি না। হাটে হাটে ঘোরার সময় কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে যে দেখা হত। এসব আমাকে কিছু দেবে। কী দেবে ভবিষ্যৎ জানে। আবার অপরাহ্নে কিংবা ভোরের স্নিগ্ধ সকালে পশ্চিমে সিংভূমের শৈলমালার নীল ছায়া দেখতে পেতাম দিগন্তে। সে বড়ো সুন্দর।

    ১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয়। পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ২২/বি নম্বরের আড্ডায় যেতে এক রবিবার তিনি বললেন, শ্যামলদা এই প্রতাপাদিত্য রোডে এসেছেন, চলো তোমরা আলাপ করবে। আমি, সমীর, তুষার চললাম শ্যামলদার ৫১/১ নং প্রতাপাদিত্য রোডের বাড়ি। দেখি মস্ত চেহারা, গায়ে পাতলা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, বসে আছেন তিনি। সমুখে সুদর্শন এক ভদ্রলোক। তিনি শৈবাল মিত্র। আমার দাদার কলিগ নিউ আলিপুর কলেজে। শৈবালদার সঙ্গেও আলাপ হল ওইদিন। তিনি বললেন আমার লেখা পড়েছেন। আমি আপ্লুত। তখন কেউ লেখা পড়েছেন বললে, শিহরিত হতাম। সেই শিহরণ এখনো হয়। লেখা ব্যতীত লেখকের অস্তিত্ব কোথায়? তিনি ভালোমানুষ, তিনি লোকের উপকার করে বেড়ান, তিনি অমুকের ভাই, পুত্র—এসব অর্থহীন। লেখা নিয়েই লেখক বাঁচেন। শৈবালদা আমার ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্পের কথা বললেন। শৈবাল মিত্র ছিলেন সিপিআই (এমএল) গড়ার সময় যে পাঁচজনের স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়েছিল তাঁদের অন্যতম। তাঁর হৃদপিণ্ডে একটি ছিদ্র ছিল। তা নিয়ে একটি অপূর্ব গল্প লিখেছিলেন অমৃত পত্রিকায়, ‘সুবলের হৃদয় ও ডাক্তার কালিদাস পাল’। লেখক শৈবাল মিত্র এবং রাজনীতিক শৈবাল মিত্রর ভিতরে তফাত ছিল। তাঁর সঙ্গে যে আড্ডা হত, তা সাহিত্য নিয়েই। শৈবাল মিত্রর গল্প, আতর আলির রাজ সজ্জা, পেপার ওয়েট, সংগ্রামপুর যাত্রা... অনন্য। অকালে প্রয়াত হয়েছেন। গোরা উপন্যাসটি আমাদের সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তা ব্যতীত অজ্ঞাতবাস, অগ্নিপুত্র, অগ্নির উপাখ্যান, মানবপুত্রী, যাচ্ছি যাই আমার প্রিয় গ্রন্থ ছিল। আর-একটি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে, আজকাল শারদীয়তে লিখেছিলেন, নিজের হৃৎপিণ্ডের অপারেশন করাতে ব্রিটেনের রাস্তায় শীতের রাতে একা। ডা. বারনারড যিনি প্রথম হৃৎপিণ্ড সংস্থাপন করেন বাই পাস সার্জারি করে, তিনিই শৈবালদার হৃদয় মেরামত করেন। উপন্যাসটির নাম ভুলে যাচ্ছি। অনেক দিনের কথা। কিন্তু উচ্চারিত হওয়ার মতো লেখা। শৈবালদার মৃত্যু হয় ২০১১-র নভেম্বরের ২৮ তারিখে। তার আগে বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি ছিলেন অনেকদিন। শৈবালদার স্মরণসভায় তাঁর রাজনৈতিক সহযাত্রীরা এসে যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, তার ভিতরে তাঁর সাহিত্যকৃতির কোনো উল্লেখ ছিল না। তা উল্লেখ করেছিলেন একমাত্র আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব)। আমিও বলেছিলাম। শ্রীচৈতন্যের ভিতরে চারু মজুমদারের ছায়া পড়েছিল যে তা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ই উল্লেখ করেছিলেন গোরা উপন্যাস প্রকাশের অনুষ্ঠানে। আর-একটি স্মরণসভায় তাঁর বন্ধুরা, যার ভিতরে অসীম চট্টোপাধ্যায় থেকে বড়ো বড়ো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ছিলেন, কেউ শৈবাল মিত্রর একটি গল্প বা উপন্যাস নিয়ে একটি বর্ণও উচ্চারণ করেননি। আমি ছিলাম শ্রোতা। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে শৈবালদার বন্ধু অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি এই কথাটিই বলেছিলাম। বলেছিলাম শৈবাল মিত্রর রাজনীতিক জীবন যতদিনের তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর লেখক জীবন। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে পড়েননি আমি বিশ্বাস করি না। তাহলে কি শৈবাল মিত্রর লেখক জীবন তাঁদের কাছে অনভিপ্রেত ছিল? পার্টি, সরকার, ধর্মীয় মিশন লেখককে বাঁচিয়ে রাখে, এই কথা বিদ্রূপের সুরে অকপট শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন। শৈবালদার পার্টির কমরেডরা তাঁর অসামান্য উপন্যাস গোরা বা অসাধারণ গল্পগুলিকে মর্যাদাই দিল না। তারা সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বই লিখছেন। সেইসব বই শৈবাল মিত্রর উপন্যাস গোরা, যাচ্ছি যাই, অগ্নির উপাখ্যান বা গল্প সংগ্রামপুর যাত্রা, আতর আলির রাজ সজ্জার শত শত মাইল দূরে।

    শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অমৃত পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন। আমাদের লিখতে বললেন। শ্যামলবাবুর সঙ্গে মেশা আমার জীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি। তা ছিল অম্ল এবং মধুরতায় মেশানো। প্রথমে শ্যামলবাবু ধরেই নিয়েছিলেন আমার দ্বারা তেমন লেখা হবে না। বন্ধুরাই বলে। আর শৈবাল বলে। একদিন তো আমাকে বলেই বসলেন, লেখা অভ্যাস করো, প্রতিদিন লেখো, তবে তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ভয় করতাম খুব। একদিন তুষার সমীরের সঙ্গে সন্ধ্যায় গিয়েছি শ্যামলদার বাড়ি। ওরাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পান করা হল। শ্যামলদা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার কাছে কুলটিকরির খবরাখবর নিলেন। হাটের খবর, চালের দর, সবজির দর ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা এবং ডুলং নদীর কথা শুনলেন। তিনি বললেন বিদ্যাধরীর মৃত্যুর কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা দেখেছিলেন। তাঁর রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় ইত্যাদি গল্পে আর কুবেরের বিষয়আশয় উপন্যাসে যা আছে। নদীরও আয়ু আছে বললেন। তারপর বললেন একটা গল্প দিও, দেখি কেমন লেখো।

    গাঁও বুড়ো গল্পটি তখন লিখেছি। অমৃতে জমা দিলাম। শুনলাম শচীন উপন্যাস লিখছে। শচীন খুব পড়ুয়া ছেলে ছিল। সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ। দু-বছর আগে শচীন চলে গেছে দুরারোগ্য অসুখে। আচমকা তা ধরা পড়েছিল। তার ‘চোখ’ গল্পেই তাকে প্রথম চিনি। বড়ো বড়ো সাময়িকপত্রের লেখক ছিল শচীন। তার ‘উদ্বাস্তু নগরীর চাঁদ’ খুব ভালো উপন্যাস। শচীনকে শ্যামলদা পাঠিয়েছিলেন দ্বারভাঙা, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তখন বেঁচে। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেবে। নিয়ে এসেছিল। কভার স্টোরি করে ছাপা হয়েছিল। শচীনই আমাকে বাংলাদেশের আকবর উদ্দিন অনূদিত অপরাধ ও শাস্তি (ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট--ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি) পড়িয়েছিল। ওর পুস্তক সংগ্রহ খুব ভালো ছিল। তো আমি গল্প দিলাম সাধারণ সংখ্যার জন্য। অমৃত পুজোসংখ্যার বিজ্ঞাপন বেরোল যুগান্তর পত্রিকায়। গল্পের তালিকায় আমার নাম দেখলাম। আনন্দ রাখি কোথায়? কিন্তু পুজোসংখ্যা যখন প্রকাশিত হল, দেখি আমার গল্প নেই। চূড়ান্ত বিজ্ঞাপনে অবশ্য সকলের নাম দেয়নি, আরও অনেকের ভিতর আছি ভেবেছিলাম। গল্প নেই। কর্মস্থলের বন্ধুদের কেউ কেউ বিদ্রূপ করল, বিজ্ঞাপনেই শেষ। তারা কেউ লেখক নয়। কলকাতায় ফিরেছি মনখারাপ নিয়ে। শুনলাম বিজ্ঞাপন বেশি আসায় আমার লেখায় কোপ পড়েছে। পুজোর পর সাপ্তাহিক অমৃততে গল্পটি প্রকাশিত হয়। তখন এক সন্ধ্যায় ২২/বি প্রতাপাদিত্য রোডে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের বাসস্থানে, চারতলার সিঁড়ি ভেঙে মস্ত শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় উঠে এলেন। সিঁড়ি থেকে গম্ভীর গলায় ডাক দিলেন পবিত্র, পবিত্র, সেই অমর ছেলেটা আছে তোর ওখানে?

    শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। পবিত্রদা সিঁড়ি থেকে নিয়ে এলেন শ্যামলবাবুকে। তিনি আমাকে দেখে বললেন যা তা এই রকম অনেকটা। হুবহু মনে নেই। আমি ভীত হয়েছিলাম, গল্প বেরিয়েছে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে নিশ্চয়। তিরস্কার করতে এসেছেন। কয়েকদিন আগে এক লেখককে তাঁর পুজোসংখ্যার লেখা নিয়ে খুব বকাবকি করেছেন। সুনীলকে নকল করে প্রেমের উপন্যাস লিখলি... এসব ছাপতে আমি সম্পাদক হয়েছি। আমি দম প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর কথা শোনার জন্য। বললেন, ‘তুমি ভাই আমাকে মার্জনা করবে, তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম, সেরা গল্পটি আমি পুজোসংখ্যা থেকে বাদ দিয়েছি। আমার এই বইটা পড়ে দেখ তো হয়েছে কি না।’

    কুবেরের বিষয় আশয় উপহার দিয়েছিলেন শ্যামলদা। আমাকে দেওয়ার জন্য আনন্দ পাবলিশার্সে গিয়ে বই নিয়ে এসেছিলেন। জীবন ধন্য। অমৃত পত্রিকায় গাঁওবুড়ো পড়ে মহাশ্বেতাদি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অনেক খোঁজ নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দিয়েছিলেন হাসান আজিজুল হকের ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পের বই। কুলটিকরিতেই আমি আমার প্রথম উপন্যাস লিখতে শুরু করি। লিখি। নদীর মানুষ। সেই উপন্যাস শোনাতেই অমর ষড়ঙ্গী-বাবুর কাছে যেতাম রণজিৎপুর গ্রামে। সুকুমার বাবুও শুনেছেন সেই উপন্যাস পাণ্ডুলিপি থেকে। কুলটিকরিতে সেই ১৯৭৭ সালে বিদ্যুৎ ছিল না। তা বাদে সবই ছিল। হাট বসত খুব বড়ো। সেই হাটে আমি ভাবুকচরণ দাস নামে এক আশ্চর্য ফেরিওয়ালাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। ভাইটগড় গ্রাম হয়তো ছিল দাঁতন বা ওইদিকে কোথাও। সেখানে হয়েছিল ঘূর্ণি ঝড়। ভাবুকচরণ গান বেঁধেছিল সেই ঝড় নিয়ে। আমি তার বই কিনেছিলাম। ষোলো পাতার বই। ঝড় নিয়ে গান-কবিতা। একটি গল্প লিখেছিলাম, ‘ভাবুকচরণ’ নামেই। ভাবুকচরণ ছিল যেমন লোককবি, তেমন নানারকম পশরা বিক্রেতা। আঁধারকানা, বাতের বড়ি, বদহজম, মাথা ধরা... কত যে সমস্যা আর রোগ আছে মানুষের। সব নিরাময়ের ভার যেন নিয়েছিল সে।

    কুলটিকরিতে ডা. অবধূত হাটুই-য়ের বাড়ি গিয়েছিলাম একদিন। গাঁওবুড়ো গল্পে বড়োবাবু যেন তিনিই। পরম শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক ছিলেন। ক-বছর আগে তাঁকে হত্যা করবে মনস্থ করেছিল নকশাল যুবকরা। শ্রেণিশত্রু খতম। রাতে তিনি একা ফিরতেন রোগী দেখে। পথ আটকেছিল যুবকরা। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে পায়ে পড়ে গিয়েছিল। গান শুনতে খুব ইচ্ছে হত। আমার ট্রানজিস্টার ছিল না। সুকুমারবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন মহাপাত্রবাড়ি। অনাদি মহাপাত্র, সর্বেশ্বর মহাপাত্রদের বাড়িতে গিয়ে রেকর্ডে গান শুনেছি দম দেওয়া গ্রামোফোনে। একজনের কথা মনে পড়ে, জ্যাকব মুন্ডা। সে আসত সিঁদুরগৌরার দিক থেকে তার জমির কাজে। আমি তাকে দিয়েছিলাম মহাশ্বেতাদির অরণ্যের অধিকার পড়তে। আমার কাছে মেদিনীপুর সেটেলমেন্ট অফিস লাইব্রেরি থেকে আনা সুরেশ সিঙের ডাস্ট স্টরম অ্যান্ড হ্যাঙ্গিং মিস্ট—লাইফ অফ বিরসা মুন্ডা’ বইটিও ছিল তখন। আমি সেই জ্যাকব মুন্ডাকে বিরসা ভগবানের কথা শোনাতে সে অবাক। মহাশ্বেতাদির বইটি সে নিয়ে গেল পড়তে। বিরসার অত কথা জানত না সে। তার চিঠি আমি মহাশ্বেতাদির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। জ্যাকব মুন্ডার পরনে থাকত একটি ঢলঢলে প্যান্ট এবং ঝুলে অনেক বড়ো হাওয়াই শার্ট। কুলটিকরি থেকে আমি চলে আসি এক বছর বাদে। যাই গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের বেলিয়াবেড়ায়। ১৯৭৮। বন্যার বছর। ১৯৭৮-এ প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’ যা লিখেছিলাম কুলটিকরিতে বসে, তা অমৃত বিনোদন সংখ্যায় ছাপা হয়। বেলিয়াবেড়া থেকে বালুঘাটা হয়ে আমি দিঘায় যাই ১৯৮০ সালে। তখন জ্যাকব মুন্ডাদের ডাকে আবার যেতে হয় কুলটিকরি। তারা ব্যবস্থা করেছিল, আমি যোগাযোগ করেছিলাম। ১৯৮০-র জুলাই মাস নাগাদ এক বর্ষার দিনে কলকাতা থেকে মহাশ্বেতাদি, নির্মল ঘোষ, কবি সব্যসাচী দেব, হিন্দি কবি পবনকুমার, সাংবাদিক অরুণ শ্রীবাস্তবদের নিয়ে যাই রোহিণীতে। খড়্গপুর অবধি ট্রেনে। তারপর রোহিণীর বাসে। আমি ও পবনকুমার কুলটিকরি এলে বাসের মাথায় উঠে বসেছিলাম। রোহিণীতে হয়েছিল আদিম জাতি ঐক্য পরিষদের সভা। সারারাত সভা হয়েছিল প্রায়। মনে পড়ে সম্মেলনের পরদিন সকালে ডুলং ও সুবর্ণরেখার সংগমে স্নান। মহাশ্বেতাদি সাঁতার কেটেছিলেন। মহাশ্বেতাদির আদিবাসী যোগাযোগ সেই প্রথম। আমার বন্ধু জ্যাকব মুন্ডার মাধ্যমে তা হয়েছিল। জ্যাকব আমাকে আর ফেরত দেয়নি ‘অরণ্যের অধিকার’। বইটি নাকি সকলের কাছেই ঘুরছিল। আমার ভালোবাসা নিও জ্যাকব মুন্ডা। সে তখন আমার চেয়ে বয়সে বড়োই ছিল। আমরা পরস্পরকে তুমিই বলতাম।

    কুলটিকরির ভ্রমরগড়ের কথা শুনেছি কত, সেই মিথ। কুলটিকরির কিয়ারচাঁদের পাথর ও বর্গি আক্রমণ নিয়ে এক অপূর্ব কাহিনি শুনেছিলাম। তা ভারতবর্ষ গল্পটিতে ব্যবহার করেছিলাম। কী অপূর্ব সেই ভূপ্রকৃতি আর কী সুন্দর মানুষজন। সেই দলিল লেখক রামেশ্বর সাউ, বারবার ভোটে দাঁড়িয়ে হারা কোনো এক মাহালী, চায়ের দোকান, চপের দোকান, বইয়ের দোকান, কত যে কথা মনে পড়ে। কত সব গ্রাম, সুবর্ণরেখার তীরের রগড়া, আমলাদাড়ি... । সব আছে। থাকবে। আমার মাথার ভিতরে সেই বিশ্ব জেগে আছে সত্য। এখনও মধ্যরাতে বুঝি শুনতে পাই সীমান্ত বাংলার ডাক।

    গত ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ আমি কুলটিকরি গিয়েছিলাম এক আমন্ত্রণে। কুলটিকরি এখন ঝাড়গ্রাম জেলায়। এর আগে ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। আমি ১৯৭৭-এ যখন কুলটিকরি ছিলাম, তখন অখণ্ড মেদিনীপুর। কুলটিকরি হাইস্কুলের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে ছিল এই যাওয়া। আমাকে তাঁরা মনে রেখেছেন, আমি শিহরিত। কুলটিকরিতেই যেন সাহিত্যের পথে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু। শেষ হয় নাই সেই যাত্রা। কুলটিকরি এক আশ্চর্য জনপদ। রাঙামাটি, সুবর্ণরেখা নদী, ভাইটগড়ের ভাবুকচরণ দাস নিয়ে আমি যেন এখনও ভোরে জেগে উঠি। যাই। অপেক্ষা কর রাঙামাটি, যাই। ১৫০ কিমি তো কম দূর নয়। যাই। সিঁদুরগৌরার জ্যাকব মুন্ডা তুমি এসো। বহু বছর আমাদের দেখা হয়নি। সুকুমারবাবু আসুন। কতদিন বাদে যাব আপনার গঞ্জে। আহা, জীবনের এক অনন্য সময় কাটিয়েছিলাম ওখানে। মনে পড়ে কিয়ারচাঁদের পাথরগুলিকে। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সারামাঠে। ভারতবর্ষ গল্পের সূত্র ওই আত্মাপাথর।

    কুলটিকরি হাইস্কুলের প্লাটিনাম জয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠানে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। চোখ মুছেছি মাউথপিসের সামনে দাঁড়িয়ে। কী বলব, ভাবিনি আবার কোনোদিন আসতে পারব ওই গঞ্জে। লালমাটির দেশ। জঙ্গল, টিলা, দূরে সেই কন্যাডিহি গ্রাম, সুবর্ণরেখা নদী, গাঁওবুড়ো যাত্রা করেছিল বড়োবাবুর উদ্দেশে। সেখানে আমার সহকর্মী পীযুষ জানালেন দীপক পাত্র বেঁচে নেই। সেও আমার সহকর্মী ছিল। আত্মহত্যা করেছে। জীবন মৃত্যু সব আমার আড়ালে ঘটেছে। ওদের নিয়ে আমি কুলটিকরি থেকে কানাইসর পাহাড়ে গিয়েছিলাম পাহাড়পুজো দেখতে। বেলপাহাড়ির আগে নারাণপুর নেমে ঘণ্টা দুই হাঁটা। বড়ো পাহাড়ের পুজো। তারপর ঘণ্টা চার হেঁটে ফিরেছিলাম চাকুলিয়া। রাত দশটা। ঝুপড়ির হোটেলে ভাত-ডাল খেয়ে শুয়েছিলাম প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে। ভোরে হাতিয়া হাওড়া প্যাসেঞ্জার ধরে কলকাতা। লিখছি এরপর কিয়ারচাঁদের পাথর স্তম্ভের কথা।

    কিয়ারচাঁদ কুলটিকরির নিকটবর্তী এক মৌজা। বিস্তৃত মাঠ ভরে ছিল বুক সমান উচু পাথরস্তম্ভে। আমি বেলা শেষের আলোয় সেই মাঠ দেখে ভেবেছিলাম অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কথিত আছে ওই পাথরস্তম্ভগুলির গায়ে জ্বলন্ত মশাল বেঁধে বর্গি হাঙ্গামা থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন কিয়ারচাঁদের রাজা। মারাঠা সৈন্যরা ভেবেছিল কত যোদ্ধা সমবেত হয়েছে রাজ্য রক্ষা করার জন্য। এইভাবে প্রস্তরপুরুষরা রক্ষা করেছিলেন তাঁদের দেশ। ওই পাথর নিয়ে গল্পটি আরও অনেক বড়ো। কিংবদন্তি যে যার মতো তৈরি করেছিল। নানা মত। যাইই হোক, ১৯৮০ সালে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম আশিস লাহিড়ী, পুলক চন্দ, সিদ্ধার্থ ঘোষ সম্পাদিত প্রস্তুতি পর্ব পত্রিকায়, ভারতবর্ষ। সেই পাথরস্তম্ভগুলি ছিল গল্পের মূল সূত্র।
    শুনলাম গত শতকের ৮০-র দশকে পাথর সাফ করে জায়গাটাকে খেলার মাঠ করে দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন। আমার চোখে জল এসে গেল সেই পাথরবিহীন মাঠ দেখে। আসলে এই পাথরগুলি ছিল মুন্ডাদের কবরে স্থাপিত আত্মাপাথর। তাদের বিশ্বাস মানুষের মৃত্যুর পর তাদের আত্মাকে এই ভাবে ধরে রাখা যায়। মৃত পূর্বপুরুষ জনপদ ছেড়ে যাবেন না। তাদের রক্ষা করবেন। কিয়ারচাঁদ রক্ষা পেয়েছিল মৃতের আত্মাপাথরে মশাল জ্বালিয়ে। মৃতরাই রুখে দাঁড়িয়েছিল।

    ১৯৭৭-এ মহাশ্বেতাদির সঙ্গে সমর সেনের বাড়ি গিয়ে প্রাক্তন আইসিএস, অশোক মিত্রর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমার পরিচয় শুনে তিনি আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কুলটিকরি থাক, তুমি কিয়ারচাঁদের মাঠ দেখেছ। দেখেছি এবং কিংবদন্তির কথা বলতে তিনি খুব খুশি, জিজ্ঞেস করেছিলেন সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বলেছিলেন কিছু ছাড়বে না, সব দেখে নাও। এমন জীবন আর পাবে না।

    ২২/বি, প্রতাপাদিত্য রোডে সাহিত্যের যে আড্ডা হত রবিবার সকাল বিকেল, সেখানে সকালে আড্ডা দিয়ে বিকেলে আবার গেছি। আবার কলকাতায় থাকলে সাহিত্যের আড্ডা হত ওখানেই। এক সন্ধ্যায় সাদার্ন এভিনিউ থেকে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে হাজির জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বটুকদা। তিনিই মেঘে ঢাকা তারার সঙ্গীত পরিচালক। তিনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের গায়ক কবি, নবজীবনের গান-এর রচয়িতা। বটুকদা সেই সন্ধ্যায় শোনালেন দু-হাত তুলে উদাত্ত স্বরে গণসংগীত… এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার, এসো শিল্পী, এসো বিশ্বকর্মা, এসো স্রষ্টা, রস রূপ মন্ত্র দ্রষ্টা... । বটুকদা ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর প্রয়াত হন হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় আসতে ট্রেনের ভিতর। মনে আছে সমীর, আমি, তুষার... আমরা তাঁর অন্ত্যেষ্টিতে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলাম। বরফে দেহ রাখা থেকে শবযাত্রা, কেওড়াতলা শ্মশান। তখন চিতা জ্বলছে, পঞ্চভূতে বিলীন হচ্ছেন তিনি, আমরা মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সমীর আমার গায়ে হাত দিয়ে বলল, পিছনে তাকা। দেখি পাশাপাশি দুই দীর্ঘকায় বাঙালি, সত্যজিৎ রায় এবং অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। ক-দিন আগে কথা হচ্ছিল, বটুকদা সমীরের কথায় ঋত্বিক জন্মোৎসবে গান গাইতে লোকাল ট্রেনে চেপে চলে গিয়েছিলেন ব্যান্ডেলে। সমীরের বাড়ি ব্যান্ডেলেই। সমীর সামান্যদিনের পরিচয়ে তাঁর স্নেহ পেয়েছিল।

    ১৯৭৭-এর শীতে আমি শচীন এবং সমীর যাই ঘাটশিলা। শীতকালে। ২৫ ডিসেম্বর নাগাদ হয়তো। বলতে গেলে সেই প্রথম পাহাড় দেখা। ঘাটশিলা গেলাম খড়গপুর লোকালে খড়গপুর পৌঁছে, সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে। স্টিম ইঞ্জিন। ছিলাম বিভূতি স্মৃতি সংসদের একটি গেস্ট হাউসে। ওইটি বিভূতিবাবুর বাড়ি ছিল শুনেছি। ফুলডুংরি টিলা, সুবর্ণরেখা নদী, নদীর ওপারে কপার প্ল্যান্ট… যা দেখি এপার থেকে, মুগ্ধ হই। হাঁটতে হাঁটতে একদিন গেলাম ধারাগিরি জলপ্রপাত দেখতে। জলপ্রপাত খুঁজেই পাই না। পাহাড়ের পাকদণ্ডি দিয়ে উপরে উঠেই যাচ্ছি। আমি সমীরকে বললাম, পথ ভুল হয়েছে। এত উপরে উঠেছি যে পাখির ডাক নেই। এক কাঠুরে নামছিল উপর থেকে একটি শালগুড়ি কাঁধে নিয়ে। জিজ্ঞেস করতে পথ বাতলে দিল। অনেক নীচে। এই অভিজ্ঞতা ভুলিনি। ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ উপন্যাসে গারো রাজার প্রাসাদ খুঁজতে যাওয়া লিখেছি ৪৩ বছর আগের সেই সামান্য কিছুক্ষণের অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করে। ঘাটশিলায় আমাদের পাশে একটি পরিবার এসেছিল। তাদের ভিতরে দুটি কিশোরী ছিল। তাদের একজনের প্রতি আমাদের একজন আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। এখন মনে পড়লে হাসি পায়। বয়সের ধর্ম ছিল তা। সেই পরিবার আমাদের আগেই চলে এসেছিল। কোন্‌ জেলা শহর থেকে যেন এসেছিল। তারা চলে যেতে আমাদের সেই অতিথিশালা নিঝুম হয়ে গেল। সমীর বলল, চ, অনেক ঘোরা হয়েছে, ফিরি।


    (ক্রমশঃ)

    ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ৩৪০০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    নবীন - Suvasri Roy
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • চিরঞ্জয় চক্রবর্তী | 2409:4060:2e83:faca:a026:5dcb:cdc2:7212 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১০:৪৪101575
  • অমরদা র লেখা পড়ে মতামত দেওয়ার মত ধৃষ্টতা আমার নেই।এখনো অনেক অজানা বিষয় পড়ার অপেক্ষায় আছি। নমস্কার নেবেন দাদা।

  • Prativa Sarker | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১২:২৬101576
  • কী সমৃদ্ধ জীবন আর সাহিত্যকৃতি !  


    শৈবাল মিত্র প্রথমে লেখক পরে রাজনৈতিক সংগঠক। গোরা পড়ার পর থেকে এ-ই ধারণায় স্থিত আছি।

  • অলোক গোস্বামী | 103.87.140.20 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১২:৫৮101579
  • চমৎকার। 

  • অনিরুদ্ধ | 2409:4060:2e1a:d850:888d:f2ff:fe52:d082 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:১৬101581
  • সুন্দর

  • পার্থপ্রতিম মন্ডল | 2402:3a80:a9b:7ed2:0:19:f0b7:bf01 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:৫৭101583
  • এমন জীবন সত্যিই সবাই পায় না। কত কী যে জানছি এই লেখা পড়ে! বাংলা ভাষার এত উল্লেখযোগ্য গল্প, উপন্যাস! সব তো এখনও পড়ে শেষ করা হল ​না! কবে যে ​হবে! 

  • সমীর চট্টোপাধ্যায় | 103.211.20.169 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ২২:২৮101588
  • ঝরা পাতা হাওয়ায় উড়ে গেলে যেমন সবুজ ঘাস উঁকি দেয়, তোর লেখা দমকা হাওয়ার মতো বিস্মৃতি উড়িয়ে দিয়ে সব হারিয়ে যাওয়া ঘটনা সামনে মেলে ধরল। কী অনিশ্চিত ছিল জীবন অথচ কী নতুন নতুন অভিজ্ঞতার দরজা উন্মুক্ত করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত সময়। তখন মনে হতো জীবন কী রহস্যময়। চেটেপুটে খাওয়ার জিনিস। আর কোনও দিন কোনও জাদুতেও ফিরে পাব না সেই সময়। তোর লেখা উসকে দিচ্ছে নিভু নিভু প্রদীপের শিখা। 


    অসাধারণ লিখছিস বন্ধু অমর হে। 

  • নিরঞ্জন মিত্র | 103.240.99.40 | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ২২:৫৭101590
  • অপূর্ব !

  • Dr. Koushik Lahiri | ১০ জানুয়ারি ২০২১ ১২:১৪101595
  • নির্ভার নিরাভরণ অক্ষরমালা !


    পড়তে পড়তে কেমন জড়িয়ে ধরে আপনার লেখা শব্দগুলো !


    বুকের কাছে মুখের  কাছে কেমন ঘুরে বেড়ায়,  নাকে কানে চোখে।..তার পর সটান সেঁধিয়ে যায় মাথায়  


    আর কিছুতেই বেরোতে পারে না 

  • Kalyan Santra | ১০ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:২৩101602
  •  একরাশ মুগ্ধতা। আর কিছু লেখার নেই।

  • ওয়াসি আহমেদ | 113.11.116.126 | ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৩৪101696
  • অমরদা , পড়ছি আর ভাবছি মানুষ ও মাটির অন্দরে-অন্তরে এই অগাধ বিচরণ আপনার লেখাকে যেমন করেছে অসামান্য , তেমনি আপনার জীবনকেও দিয়েছে অপার সমৃদ্ধি।

  • আসাদুল ইসলাম | 157.40.9.1 | ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:২৮101698
  • সবকটি পর্ব টানা পড়লাম। একটা লাইন মনে গেঁথে গেল, আলো ঠিকরে বেরনো লেখা যদি লিখতে পারতাম!  আহা কী সুন্দর প্রকাশ। অনেক শুভকামনা রইলো অমর বাবুর প্রতি। ভালো থাকুন।


    গুরুর সাইটে এসে বড়ো লেখা অনেক দিন পড়া হয়নি। আজ এসে দেখলাম অনেক বদল হয়েছে। ভালো লাগল। গুরুর সঙ্গে যুক্ত সকলকে অনেক ভালোবাসা। 

  • তপনজ্যোতি মিত্র | ১৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:৩০101761
  • অসাধারণ এবং অপূর্ব উপাখ্যান - জীবনের পরতে পরতে জড়ানো - মুগ্ধ হয়ে পড়ছি |

     

  • রেখা রায়, বজবজ,দ ২৪ পরগণা। | 2409:4060:2e84:c98b:dec3:965:91d:86b5 | ২১ জানুয়ারি ২০২১ ০৮:৪৮101915
  • ১২ পর্বটি পড়লাম। আগেরগুলি পড়ার তাগিদ অনুভব করছি।  যে কেন পড়িনি আগে! 


    নমস্কার নেবেন দাদা।

  • অমর | 43.252.249.228 | ২২ জানুয়ারি ২০২১ ২২:১৪101945
  • আপনারা যাঁরা পড়ছেন নিয়মিত, সকলকে আমি ধন্যবাদ  জানাই।  স্মৃতি  বিভ্রমের  ও  হয়ে থাকে। তা যেন না হয়,  হলেও আবার ফিরব সত্যে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন